সায়নী তার বাবুর কাছে চিঠিটা নিয়ে যায়।কিন্তু তিনি মেয়ের চিঠি পড়তে অস্বীকার করেন।সায়নী তখন পুরো ঘটনাটা তার বাবাকে খুলে বলে।চিঠিটা তার নামে আসলেও আদতে চিঠিটা দিপালী নামে অন্য কোন মেয়েকে লেখা।মেয়ের কথা শুনে তিনি কিছুটা সময় দম মেরে বসে থাকেন।ঝানু উকিলবাবুর বুঝতে একটুও সময় নিলো না যে মনোতোষ দুই দুটি মেয়েকে বেশ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েই একসাথে নাচিয়ে গেছে,এবং এখনো সেটা চালিয়ে যাচ্ছে।চিঠির ভাষাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যেহেতু দিপালী মেয়েটি কায়স্থ আর এই কারণেই ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে মনতোষের বাবা,মায়ের আপত্তির কারণেই সে দিপালীকে বিয়ে করতে পারেনি।আর এদিকে বাবা,মা তার বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগায় এবং তারা অমরেন্দ্রনাথ বাবুর মেয়েটি পছন্দ করায় সে বাধ্য হয়ে বিয়েতে মত দেয়।আর আশীর্বাদের দিন সে তার মোক্ষম চালটি মারে।সে স্বপ্নেও ভাবেনি শেষমেষ অমরেশবাবু রাজি হবেন।কিন্তু ভালো মানুষের মুখোশটা যাতে না খুলে যায় তারজন্য অমরেন্দ্রনাথ বাবুর সাথে ওই আলাপচারিতা করেছিলো।আর এখন একইভাবে একই জায়গায় বসে সায়নী আর দিপালী দুজনকে চিঠি লিখে আগেই খামের উপর ঠিকানা রেডি করে যখন চিঠি দুটি খামে ভরতে যায় তখনই সে তার অন্যমনস্কতায় একের চিঠি অন্যের ঠিকানা লেখা খামে ভরে ফেলে।এইরূপ একটি ছেলের সাথে তিনি কি করে তার সানুর বিয়ে দিলেন সেটাই এখন বুঝে উঠতে পারছেন না।
এখনকার দিনের মত তখনকার দিনে ডিভোর্স কথাটা এত সহজে উচ্চারিতই হত না।সমাজ এটাকে ভালো চোখে দেখতো না।যদিও সমাজের তোয়াক্কা তিনি কোনদিনই করেননি তবুও তার স্ত্রী এটা যে কিছুতেই মেনে নেবেন না এটা তিনি ভাবেই জানতেন।তিনি তার মেঝমেয়েকে গ্রামের বাড়ি তার মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিলেন।আর এই সমুহ বিপদের ব্যাপারে তিনি নানান চিন্তাভাবনা করতে লাগলেন কিভাবে এর মোকাবেলা করবেন।
এদিকে ভারতী গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেই স্কুলেএকটা চাকরি পেয়ে গেলো কিন্তু বাড়ি থেকে অনেকটাই দূরত্বে।মালতীর তখন ক্লাস টেন।বাড়িতে তখন পাড়ারই অবস্থাপন্ন চ্যাটার্জী পরিবারের একটি ছেলে আসতো নাম যার দেবদাস চ্যাটার্জী।না পাঠক এ দেবদাস কথাশিল্পীর দেবদাস নয়।মনেমনে সে মালতীকে ভালোবাসলেও কোনদিন তার প্রকাশ ছিলো না। মালতী মাধ্যমিক পাশ করে শহরে চলে আসে।অমরেশবাবুর প্রতিটা মেয়েই গ্রামের থেকে পাশ করে শহরে এসে কলেজে ভর্তি হয়।এদের মধ্যে ব্যতিক্রম শুধুমাত্র তার ছোট মেয়ে ও একমাত্র ছেলেটি।একটি ছেলে সন্তানের আশায় পরপর ন'টি মেয়ে।ছেলের জন্মের সময়ও সকলেই ভেবেছিলেন এবারেও বুঝি মেয়েই হবে।তাই বাড়ির সকলেরই মন খুবই খারাপ ছিল।এর আগে অবশ্য একটি ছেলে হয়েছিলো।কিন্তু পাঁচ বছর বয়সে ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় তার মৃত্যু হয়।তখন বাড়ির প্রত্যেকেই শোকে প্রায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিলেন।
যাহোক সকলের শেষে যখন পুনরায় একটি পুত্রসন্তান হল তখন রায় চৌধুরী বাড়িতে আনন্দের হাট।কিন্তু তার মুখেভাত দেওয়া হল গোবিন্দ মন্দিরে।আগের পুত্রটির মুখেভাতে দু থেকে তিন গ্রামের লোকজনকে ভুরিভোজ করানো হয়েছিল।কিন্তু তার অসময়ে চলে যাওয়ার ফলে রায় চৌধুরী বাড়ি থেকেই মুখেভাতে আয়োজন উঠেই গেলো।তখন অবশ্য রঙ্গিলিবালাদেবি বেঁচে ছিলেন।তিনিই এ নিয়মটি চালু করেছিলেন।আর মেয়েদের কখনোই জাকজমোক করে মুখেভাত হয়নি।তার বক্তব্য ছিল মেয়েদের জন্মদিন,মুখেভাতে আড়ম্বর করলে বিবাহিত জীবনে সে মেয়ে সুখী হয়না।
আসলে তখনকার দিনে প্রতি পদেপদে সংসারে মেয়েদের নানানভাবে বঞ্চিত করা হত।আজও অনেক সংসারে এ ধারা অব্যহত রয়েই গেছে।তবে আগের তুলনায় অনেক কম।
যাহোক মালতী মাধ্যমিক পাশ করে শহরে এসে যখন ভর্তি হল তখন অমরেশবাবুর এক মুহুরীর (এখন অবশ্য মুহুরী কেউ বলে না তাকে অ্যাসিস্টেন্ট বলে থাকে।কিন্তু তখনকার দিনে মুহুরীই বলা হত) বড় ছেলে প্রায়ই তার বাবার খাবার নিয়ে অফিস টাইমে অমরেশবাবুর বাড়িতে আসতো।খুব সকালে তিনি টিফিন করেই অমরেশবাবুর বাড়িতে এসে তার চেম্বার খুলে বসতেন।অমরেশবাবু যখন অফিস যেতেন তখন তার সাথেই মুহুরী অমল পাল একই সাথে কোর্টে যেতেন।এই অমল পালের ছেলে অভয়ানন্দের প্রেমে পড়ে মালতী।
দেবদাস চ্যাটার্জীর মালতীর প্রতি ভালোবাসাটা ছিল এক তরফা।শান্তিদেবী ব্যাপারটা জানতেন।কিন্তু সাহস করে কোনদিন স্বামীকে বলে উঠতে পারেননি।তার পছন্দের সব চেয়ে বড় কারন ছিল যেটা অবস্থাপন্ন বামুন ঘরের ছেলে।কিন্তু এদিকে অমরেশবাবু ছেলেটিকে তার নরম স্বভাবের জন্য ভালোবাসলেও এই বেকার ছেলেটির সাথে তার মেয়ের সম্মন্ধ হলে মেনে নিতেন না।অপরদিকে অমল পালের ছেলেটিকে তার খুবই ভালো লাগতো।কিন্তু তখনো পর্যন্ত তিনি তাকে জামাই করার স্বপ্ন দেখে পারেননি।
অভয়ানন্দ আস্তে আস্তে রায় চৌধুরী বাড়ির ছেলের মতোই হয়ে উঠতে লাগলো।কারণে,অকারণে,প্রয়োজনে,অপ্রয়োজনে সে এ বাড়িতে নিত্য দুবেলা যাতায়াত করতে লাগলো।এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন আর সেটা হল অমরেশবাবু শহরে জমি কিনে মাথা গোঁজার মত ঠাঁই ততদিনে করে ফেলেছেন।কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই এই জমি সংক্রান্ত বিষয়ে তিনি এক মস্তবড় সমস্যায় পড়েন।জমির মালিক এই একই জমি দুজনের কাছে বিক্রি করেন।আইনের পথ ধরে প্রথম বিক্রয় যার কাছে হয়েছিল সেই হিসাবে তিনি এ জমির অধিকার পেয়ে যান।কিন্তু এই প্রথম তার শত্রু জন্ম নিল এই বিষয়কে কেন্দ্র করে।
মনোতোষের খোঁজ খবর নিয়ে তিনি তার সায়নীকে মনোতোষের কাছে পাঠিয়ে দিলেন।এর আগে অবশ্য প্রথমে টেলিগ্রাম তারপর চিঠির মাধ্যমে তার সাথে কথা বলে তিনি মেয়েকে একজন পরিচিত মানুষের সাথে তার কাছে পাঠিয়ে দেন।মনোতোষ তখনো ফ্যামিলি কোয়ার্টার সেখানে পায়নি।তাই ওখানে থাকতে থাকতে আত্মীয়ের মত হয়ে যাওয়া এক পরিবারে সায়নীর আশ্রয় হয়।মাঝে মধ্যে মনোতোষ সেখানে আসে আর চেষ্টা করছে নাকি কোয়ার্টার পাওয়ার।এখানেও সেই একই জিনিষ সায়নীর কপালে ঝুঠলো।দিনরাত বাড়ির কাজের মেয়ের মত পরিশ্রম।এবার আর সে তার বাবুকে কিছু না জানিয়ে নিজেই সবকিছু ঠিক করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়।একদিন মনোতোষ আসলে সে সরাসরি জানায় কোয়ার্টার যেহেতু সে পাচ্ছে না তাকে যেন সাতদিনের মধ্যে ঘরভাড়া করে মনতোষ এখান থেকে নিয়ে যায়।অন্যথায় এখনকার সমস্ত ঘটনা সে তার বাবুকে জানাবে।আর এবার যদি সে সংসার করতে না পারে তাহলে তার যতদূর মনেহয় বাবু মনোতোষকে এত সহজে ছাড়বেন না।সরকারি চাকরি করা মানুষ কিভাবে তার বিবাহিত স্ত্রীর উপর অন্যায় অত্যাচার করতে পারে আর এটা করলে কি কি একশন নেওয়া যায় তাও মনোতোষকে সায়নী স্মরণ করিয়ে দেয়।
মনোতোষ ঠিক পনেরদিনের মধ্যেই তাকে ঘরভাড়া করে নিজের কাছে নিয়ে যায়।কিন্তু মনোতোষের কাছে গিয়েই যে সে সুখী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে তা কিন্তু নয়।সায়নীর জীবনে সুখ এসেছে বেশ কয়েক বছর পরে।তারজন্য তাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে।অনেক অপমান,লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছে।কিন্তু পরবর্তীতে সে তার জীবনের কোন দুঃখের কথায় তার বাবু মা মায়ের সাথে কোনদিন শেয়ার করেনি।
ক্রমশঃ
No comments:
Post a Comment