বর্ষণক্লান্ত ধরণী বসন্তে এসে শান্তির নিশ্বাস ফেলে।বর্ষার আরম্ভ হতেই মধু বসন্তের জন্য মানুষ পাগল হয়ে ওঠে। অবশেষে বহুদিন পরে শেষটায় ফাগুন এসে সাক্ষাৎলাভ
হয় বসন্তের।কাননে কান্তারের,বৃক্ষে বৃক্ষে নতুন পত্র,নতুন পুষ্প,নতুন মাধুর্য।বসন্ত প্রকৃতি মানুষের হৃদয় মনকে আলিঙ্গন করে চঞ্চল উদ্দামতায়- হৃদয়ে জাগায় পুলক শিহরণ।
প্রকৃতির নিয়মে বসন্ত আসে একমাত্র প্রকৃতিতেই।কিন্তু
মানুষের জীবনে বসন্ত আসার জন্য দিনক্ষণ,নিয়মকানুনের কোন দরকার পড়ে না।যে কোন সময়,যে কোন বয়সেই মনের বসন্তের ঠিকানা মেলে।
কিছুদিন ধরেই মনোতোষ সায়নীকে বেশ লক্ষ্য করছে এটা একমাত্র সায়নী ছাড়া স্কুলের বাকি ছেলেমেয়েদের নজর এড়ায়নি।ডাকাবুকো স্বভাবের সুন্দরী সায়নীকে বলতে গেলে সকলেই একটু ভয় পেয়েই চলে।তবে তার খুব কাছের কয়েকজন সহপাঠী তাকে স্কুল চত্বরে ঘটে যাওয়া নানান ঘটনা জানাতে বিন্দুমাত্র ভুল করে না।সায়নীর মধ্যে একটা বিশেষ গুন হল যে কারো বিপদে-আপদে ঝাঁপিয়ে পড়া।গ্রামের অবস্থাপন্ন ঘরের সুন্দরী মেয়ে হওয়ার কারণেই হোক আর ক্লাসে ফাষ্ট গার্ল হওয়ার কারণেই হোক স্কুলের শিক্ষক,শিক্ষিকা সহপাঠী সকলেই তাকে খুব ভালোবাসে।
অমরেশ রায় চৌধুরীর প্রচুর জমিজমা।জমিদারী বংশ বলে কথা!ছেলের আশায় পরপর ন'টি মেয়ে।অর্থের কোন অভাব নেই তাই বছর বছর বাড়িতে মেম্বার সংখ্যা বেড়ে যাওয়াতে তার বা তার পরিবারের কোন চিন্তাও নেই।তখনকার দিনে অল্প বয়সেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিত তাদের পরিবার কিন্তু অমরেশবাবু তার মেয়েদের বিয়ের ব্যাপারে কোন চিন্তা ভাবনায় করতেন না।স্ত্রী এবং তাঁর মা যখন মেয়েদের বিয়ের কথা বলতেন তার একটাই উত্তর ছিলো," আমি আমার মেয়েদের লেখাপড়া শেষ না করিয়ে বিয়ে দেবো না।কোথায় কার হাতে গিয়ে পড়বে,তার পরিবার কেমন হবে; ভাতের থালা সামনে নিয়ে চোখের জল ফেলবে -- এসব আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারবো না।তারজন্য আমার মেয়েদের আমি সাবলম্বী করে তবেই বিয়ে দেবো।"অনেকে আবার ব্যঙ্গ করে অনেক সময় বলতেন,' অমরেশবাবুর মেয়েগুলি সব দুধভাত খাওয়া বাচ্চা।ওরা কোনদিনও উনার কাছে বড় হবেনা।"
আজ থেকে বেশ কয়েক যুগ আগে অমরেশবাবুর এহেন কথাবার্তায় পাড়ার অনেকেই আড়ালে-আবডালে তার সমালোচনা করলেও তিনি কোনদিনও সে সব ব্যাপারে ভ্রুক্ষেপ করেননি।আর যেহেতু তার অর্থের কোন অভাব ছিলোনা এবং তিনি ছিলেন একজন পরোপকারী মানুষ;বিপদে-আপদে যে যখন তার কাছে ছুটে এসেছে তিনি তাদের কখনোই খালি হাতে ফেরাননি।তাছাড়াও আরও একটি কারণ ছিল - কর্মজীবনে তিনি ছিলেন একজন উকিল।অধিকাংশ সময়ে গ্রামের লোকেরা জমি সংক্রান্ত ব্যাপারে নানান ঝামেলায় ফেঁসে যেতেন।তিনি সেই সব মানুষের কেস লড়তেন সম্পূর্ণ বিনা অর্থে।সপ্তাহের পাঁচদিন তিনি শহরে ঘরভাড়া করে একাই থাকতেন।সপ্তাহান্তে শনিবার কোর্ট করে তিনি তার গ্রামের বাড়িতে যেতেন।তার স্ত্রী,মা এবং বাবা ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো নিয়ে গ্রামের বাড়িতেই থাকতেন।অমরেশবাবুর রোজগারে যে সংসার চলতো তা কিন্তু মোটেই নয়।প্রচুর জমিজমা থাকার ফলে সংসার চালানোর যাবতীয় উপার্জন ওইসব জমিজমার থেকেই পেয়ে যেতেন।তিন তিনটে পুকুর,বছর মাইনের কাজের লোক।জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পরেও কিন্তু তার পরিবারটি জমিদারী চালেই চলতো।
কিন্তু তখনকার দিনে দশ,থেকে এগারো বছর বয়স হলেই গ্রামের লোকেরা অর্থাৎ মেয়ের বাবা,মা তাদের বিয়ের পিড়িতে বসিয়ে দিতেন।তিনি তাঁর বাবাকে যুক্তি,তর্ক দিয়ে বুঝাতে সক্ষম হলেও মায়ের সাথে পেরে না উঠতে পেরে এগারো বছর বয়সেই বড় মেয়েটির বিয়ে দিতে বাধ্য হন একজন স্কুল শিক্ষকের সাথে।বয়সের পার্থক্য চৌদ্দ বছরের।
সায়নী তার মেজ মেয়ে।মনোতোষ মাধ্যমিক পাশ করে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে বেশ ভালো চাকরি পেয়ে বাইরে চলে যায়।কিন্তু কর্মক্ষেত্রে চলে যাওয়ার আগে একদিন সে সায়নীর সাথে দেখা করে।সায়নীকে সে তার মনের কথা জানায়। সায়নী সে বছর মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী।
--- যদি তোমার আপত্তি না থাকে আমার বাড়ির থেকে তোমাদের বাড়িতে প্রস্তাব নিয়ে আসবে।
বন্ধুদের মাধ্যমে মনোতোষের মনের খবর সায়নী আগেই পেয়ে গেছিলো।তার উপর একদিন টিফিন পিরিয়ডে ফুটবল খেলতে গিয়ে মনোতোষ যখন পায়ে ব্যথা পেয়েছিলো সেদিন তার ব্যথা সারানোর জন্য সকলের সাথে সায়নীই অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলো।দুজনের চোখাচোখি হলেও সায়নী সে ব্যাপারটাকে কোন পাত্তাই দিয়েছিল না।কিন্তু আজ সরাসরি মনোতোষ যখন রাস্তায় তাকে একা পেয়ে প্রস্তাব দেয় তখন ক্ষণিকের জন্য হলেও তার কিশোরী মনে অদ্ভুত এক ভালোলাগা কাজ করে।পরমুহূর্তেই সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
--- কিসের আপত্তি আর কিসের প্রস্তাব দুটোর একটাও বুঝলাম না।
--- সত্যিই কি তুমি কিছু বুঝতে পারছো না?
সায়নী সরাসরি মনোতোষের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
--- না,সত্যিই আমি বুঝতে পারছি না।
--- বুঝতে পারছো না নাকি সরাসরি আমার কাছ থেকে জানতে চাইছো?
--- ভনিতা না করে সরাসরি বললেই তো হয়।ওহ্ আচ্ছা আচ্ছা তুমি চাকরি পেয়ে গেছো সেটাই বলতে এসেছো?
সায়নী কথাটা বলে মনেমনে হাসতে লাগল।বেশ মজা লাগছে তার।এই কিশোরীবেলায় প্রথম প্রেমের কথাটা সে মনোতোষের মুখ থেকেই শুনতে চাইছে।মনোতোষ ব্যাপারটা বুঝতে পারলেও সায়নীর সাথে কথা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সেও ভনিতা করেই চলেছে।পরিস্থিতি 'সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি'-।এটা নিয়েই কথা বলতে বলতে তারা হাঁটতে থাকে।সায়নী তার বাড়ির কাছে ততক্ষণে চলে এসেছে। বড় রাস্তা থেকে অনেকটা হেঁটেই নিজেদের জমির উপর দিয়ে বেশ খানিকটা হেঁটেই তাদের বাড়ি আসতে হয়।গ্রামের বাড়িগুলো যে রকম হয় আর কি?বড় আড়কাঠাটি সরাতে সরাতে সায়নী মনতোষের দিকে ফিরে বললো,
--- সত্যি কথা বলার সৎসাহস নেই তোমার।যদি কোনদিন সরাসরি তোমার মনের কথাটা বলতে পারো সেদিনই আমার সামনে এসে দাঁড়িও।
মনোতোষ কিছুটা সায়নীর কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো,
--- বলতে আমি এখনি পারি।তাহলে শোনো ---
ঠিক এই সময়ে সায়নী তাকিয়ে দেখে পাড়াতুতো এক কাকা তাদের বাড়িতে ঢোকার জন্য পা বাড়িয়েছেন।সায়নী মনতোষকে কিছু বলার সুযোগ আর না দিয়েই তার দিকে একটু তাকিয়ে ওই কাকার সাথে কথা বলতে বলতেই বাড়ির দিকে পা বাড়ালো।মনোতোষ সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সেও তার নিজ পথ ধরে তবে নিশ্চিন্ত মনেই যে সায়নী তাকে প্রত্যাখ্যান করেনি।
সায়নী মনতোষের সামনে থেকে চলে এলো ঠিকই কিন্তু প্রথম ভালোলাগার পরশটা তার মনে রয়েই গেলো।মনোতোষ তার হৃদয়ে অসময়েই বসন্তের লাল আবিরে রঞ্জিত করে তার কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায়।
সায়নী সেবার ছিল মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী।সারা সপ্তাহে নিজে না পারা বিষয়গুলি জমিয়ে রাখতো তার বাবুর জন্য।প্রত্যেক ছেলেমেয়েই অমরেশবাবুকে বাবা না বলে বাবু বলেই ডাকতো।আর অমরেশবাবু তার মেয়েদের মা বলে এমনভাবে ডাকতেন যে তার ডাক শুনে মনে হোত প্রতিটা মেয়েই যেন তার গর্ভধারিনী।
ক্রমশঃ
No comments:
Post a Comment