Friday, October 15, 2021

অন্য দেবদাস

অন্য দেবদাস

  "পুজোর মধ্যে ঘটেছিলো ঘটনাটা - শুরুতেও ছিল পুজো আর হয়ত শেষেও সেই পুজোয় থাকলো।আর কোনদিন দেবুদার সাথে দেখা হবে কিনা জানিনা।তাই আজ আমি ঠিক করেই এসেছি একবার তার সাথে দেখা করবো আজ।ছেলের বয়স এখন আমার আঠারো বছর।তার জেদাজেদিতেই এবার পুজোয় বাপের বাড়িতে আসা।বিয়ে হয়ে সেই যে চলে গেছিলাম বাবার পরে রাগ করে আর কোনদিন বাড়িতে আসিনি।কানাডা থেকেই বাবার মৃত্যুর খবর পেয়েছিলাম।মা,ভাই হয়ত ভেবেছিল আমি এই সংবাদ পেয়ে বাড়িতে আসবো।কিন্তু এখানে আমার পরিবারের প্রতি যে শুধু রাগ কাজ করেছে তা কিন্তু নয়।বাড়িতে আসলেই দেবুদার সাথে আমার দেখা হবে আমি জানতাম।কোন মুখে আমি তার সামনে গিয়ে দাঁড়াবো?তার কাছে তো বটেই নিজের কাছেও যে নিজে ছোট হয়ে গেছি।আজ কুড়ি বছর ধরে মনের মধ্যে অপরাধবোধ,পাপবোধ কাজ করে চলেছে।"
  কুড়ি বছর আগে পাড়ার ক্লাবে অষ্টমীর সন্ধ্যায় যে জলসার আয়োজন করা হয়েছিলো সেখানে শ্রীলেখা একটি আগমনী গান গেয়েছিল।আর সেবারের পুজোয় সেক্রেটারি ছিল দেবদুলাল চ্যাটার্জী।একই পাড়া।মুখ চেনা মানুষটির সাথে সেদিন অনেক কথা হয়েছিল।পাড়ার লোকেরা দেবদুলাল ওরফে দেবুকে সবাই খুব ভালোবাসতো তার মিষ্টি স্বভাবের জন্য।শ্রীলেখার সাথে সেদিনের পুজোতে গান গাওয়ার সূত্র ধরে আস্তে আস্তে কাছে আসা।দেবদুলাল পাগলের মত ভালোবাসত শ্রীলেখাকে এটা শ্রী ভালোভাবেই বুঝেছিল।
  শ্রীলেখাদের বাড়িতে এ খবর পৌঁছাতেই আগুন জ্বলে উঠলো।কারণ একটাই দেবদুলালের বোন অবাঙালী একটি ছেলেকে ভালোবেসে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছে।তাই ওই পরিবারটাই খারাপ হয়ে গেছে শ্রীদের বাড়িতে।সুতরাং নিজ পরিবারের সম্মান বাঁচাতে সেই চিরাচরিত প্রথা!জোর করে মেয়েকে অন্যখানে বিয়ে দেওয়া,ঘরে আটকে রাখা বাবা,মা ছাড়া বাড়ির বাইরে না বেরোতে দেওয়া।
  শ্রীলেখার বিয়ে হয়ে গেলো কানাডা নিবাসী ছেলের সাথে। বিয়ের কথা জানতে পেরে অকুতোভয় দেবদুলাল শ্রীদের বাড়িতে এসেছিলো।কিন্তু তার গায়েই শুধু হাত তোলা হয়নি।পুলিশের ভয়টা তাকে নয় তার বাবাকে রাস্তায় ধরে দেখানো হয়েছিলো।বিয়ের দিন বাড়িতে কিছু পুলিশ পোষ্টিং ছিল।
শ্রী এতক্ষণ ধরে কথাগুলো বলছিলো তার ছেলেবেলার এক বন্ধুকে। তারও কলকাতার বাইরে বিয়ে হয়েছে শ্রীর বিয়ের আগেই।প্রতিবছর একমাত্র পুজোতেই মুর্শিদাবাদ থেকে আলোকা বাপের বাড়িতে আসে।সে এসব কিছুই জানতো না।তারা কথা বলতে শুরু করার পর খেয়াল করলো প্যান্ডেল থেকে বহু দূরে একজন পাগল বসে আছে।আলোকা তাকে বললো,
--- দেবুদা বহুবছর পাগল হয়ে গেছে তুই জানিস?
--- সে কি? আমি তো কিছুই জানিনা।তুই একটু আমার সাথে যাবি দেবুদার বাড়িতে।আজ আমি মনেমনে ঠিক করেই প্যান্ডেলে এসেছি দেবুদার সাথে একটু দেখা করবো।
--- তার বাড়িতে যেতে হবে না।ওই দেখ দেবুদা দোকানের সিড়িতে বসে আছে।
শ্রীলেখা তাকিয়ে দেখে উঠে দাঁড়ায় তার দিকে এগিয়ে যেতে।কিন্তু তখনই সামনে দেখে ছেলে আর স্বামীকে।তারা কোথায় যাচ্ছে জানতে চাওয়ায় বলে,
--- অনেক বছর আগে এই রকম এক পুজোর সময় একজন মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছিলো।এখন সে পুরো উন্মাদ।যাচ্ছি তার সাথে দেখা করতে।তোমরাও আসতে পারো আমার সাথে।
 শ্রী এগিয়ে যায়।সাথে অলোকা।কাছে গিয়ে ডাক দেয়,
--- দেবুদা
 ঘোলাটে চোখে দেবদুলাল শ্রীর মুখের দিকে তাকায়।
--- আস্তে কথা বলো।আমার মন বলছে ও আশেপাশেই কোথাও আছে।আমার সাথে দেখা করতে নিশ্চয়ই আসবে।
--- কে সে দেবুদা?
--- তুমি চেনো না।সবাই জানে তো।সবাই বলে আমি নাকি দেবদাস।ভালোবেসে পাগল হয়েছি।
শ্রীর দুচোখ বেয়ে জল পড়ছে। কাঁদতে কাঁদতেই বললো,
--- দেবুদা আমার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখো আমি শ্রীলেখা।
 দেবু তর্জনী দিয়ে নিজের ঠোঁটের উপর হাত রেখে বললো,
--- যাই প্যান্ডেলের কাছে।শ্রী এসে গেছে -- 
 দেবদুলাল সামনে এগিয়ে যেতে লাগলো।পিছন থেকে শ্রী কয়েকবার দেবুদা, দেবুদা বলে ডাক দিল।কিন্তু কোন সাড়া না দিয়েই সে এগিয়ে যেতে লাগলো।শ্রীর স্বামী,সন্তানকে ক্রস করে যখন এগিয়ে যাচ্ছে তখন তার ছেলে আকাশ বাবাকে বলে,
--- দেখো বাবা ওই পাগলটা মায়ের বন্ধু।মা না একটা যা তা ।
 শ্রী সেখানে বসেই দুই হাঁটুর মধ্যে মুখ রেখে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলো।


No comments:

Post a Comment