Sunday, October 17, 2021

জীবনের প্রতি বাঁকে (পঞ্চম পর্ব)

জীবনের প্রতি বাঁকে ( পঞ্চম পর্ব)
  চৌধুরী গিন্নী বেশ ভালোভাবেই মনোতোষকে চিনতেন।তিনি জানতে চাইলেন,
--- মনোতোষ কোথায়?তুমি তো মনোতোষ নও।
বরযাত্রীদের ভিতর থেকে একজন উত্তর দিলো,
--- আছে আছে।আপনারা যে এত তাড়াতাড়ি চলে আসবেন বরণ করতে আমরা বুঝতে পারিনি।
--- এর মানেটা কি?বিয়ে তো ঠিক হয়েছে মনোতোষের সাথে।তুমি কোথা থেকে আসলে?
 --- আসলে কি হয়েছে জানেন?মনোতোষ তো সকাল থেকে না খেয়ে আছে।ওই সেজেগুজে রিক্সায় করে আসছিল।খালিপেটে ও খেঁজুরের রস খেতে ভালোবাসে।হঠাৎ দেখে একটা খেঁজুর গাছে রসের ঠিলেটা ভর্তি হয়ে পড়ে যাচ্ছে।অমনি রিক্সা থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়ে গাছে উঠে ঠিলে থেকে রস খেতে শুরু করলো।তাই টোপরটা আমায় মাথায় পরিয়ে দিয়ে গেছে।আপনাদের পুকুরেই হাতমুখ ধুচ্ছে।এখনি এসে পড়বে।
 গল্প শুনে সকলে তো তাজ্জব।শান্তিদেবী মনেমনে ভাবলেন এ কোন বাঁদরের সাথে তার সায়নীর বিয়ে ঠিক হল।মেয়েটা কি সুখী হবে? এ ছেলের তো গুণের শেষ নেই।একে মানিয়ে গুছিয়ে নিয়ে কিভাবে তাদের সানু সংসার করবে?
 ইতিমধ্যে ভিড় ঠেলে বেরিয়ে বর হাজির হলেন।ধুতি ছেড়া,পাঞ্জাবিতে নোংরা লাগানো।এসেই খপাত করে রিক্সায় উঠে বসে বন্ধুর মাথা থেকে টোপরটা খুলে নিয়ে নিজেই টোপরটা মাথায় পরে নিল।অন্যেরা হাসাহাসি করতে লাগলেও শান্তিদেবীর রাগে তখন সর্বশরীর জ্বলছে।তিনি মুখ ভার করে মনোতোষকে বরণ করে এসে আলমারির ভিতর থেকে তার স্বামীর একটা নূতন ধুতি বের করে এক মেয়ের হাতে দিয়ে বলেন,
--- এটা পরে নিতে বল।ওই ছেড়া ধুতি পরে তো আর বিয়ে করতে বসতে পারবে না।
 এ কথা বলে তিনি রাগে গজগজ করতে লাগলেন।কিন্তু মনোতোষ নির্বিকার।সে কোন অন্যায় করেছে বলে তার মনেই হয়না।
  বেশ ভালোভাবেই বিয়ে মিটে গেলো। বর কর্তা হয়ে যিনি এসেছিলেন তিনি ছিলেন মনোতোষের কাকা।ওই গ্রামেই তিনি থাকেন।তিনি মনোতোষকে ডেকে বলেছিলেন,
--- এই মেয়েকে বিয়ে করবি বলে অনেক খেল দেখিয়েছিস।তারপর আজকে আবার যা তুই করলি তার কোন ক্ষমা নেই।আর যদি কোন গোল তুই বাঁধিয়েছিস তাহলে কিন্তু আমার থেকে খারাপ কেউ হবেনা।এই পরিবারটা অত্যন্ত ভদ্র তাই তুই আজ এই অন্যায় করার পড়েও মুখ বুঝে বর বরণ করেছেন এরা।এইরূপ যদি আমার বাড়িতে ঘটতো বিয়ে করা ঘুচিয়ে দিয়ে মেরে তক্তা বানিয়ে দিতাম।
 মনোতোষ মাথা নিচু করে মিনমিন করে বললো
--- ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেছে।আমি ঠিক বুঝতে পারিনি।
--- ঠিক আছে।তবে দোহাই তোমার বংশের মুখে আর চুনকালি দিও না।নির্বিঘ্নে বিয়েটা হয়ে যেতে দাও।
 তারপর সেদিন মনোতোষ আর কোন কান্ড ঘটায়নি।কিন্তু অমরেশবাবু তার মেঝমেয়ের বিয়ে দিয়ে খুবই ভেঙ্গে পড়েন।দিন সাতেক তিনি গ্রামের বাড়িতেই থেকে যান আর ঠিক তারই মধ্যে গ্রামের কুখ্যাত ডাকাত খালু খা ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা পড়ে।এই কালু খার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি ডাকাতির কেস চলছে।আর প্রতিটা কেসেই একই গ্রামে থাকার ফলে আসামী পক্ষের উকিল অমরেশবাবু।শেষবার তাকে ছাড়ানোর সময় সে অমরেশবাবুকে কথা দিয়েছিল জীবনে আর কখনো চুরি,ডাকাতি করবে না।কিন্তু পুনরায় ডাকাতির কেসে সে ফেঁসে যাওয়ায় অমরেশবাবু যান প্রচণ্ড খচে।যারফলে তিনি কালু খার বাড়ির লোকদের বলে দেন তার হয়ে আর কেস তিনি লড়বেন না।বাড়ির লোক ফিরে যায়।কিছু পড়ে তার বৃদ্ধা মা আসেন দেখা করতে অমরেশবাবুর সাথে।তিনি এসে তাকে জানান,
--- তিনদিন ধরে বাড়িতে কোন ভাত,রুটির সংস্থান নেই।সেইভাবেই চলছিলো।কিন্তু হঠাৎ করে আট বছরের নাতিটা অসুস্থ্য হয়ে পড়ায় ডাক্তার দেখানোর দরকার হয়ে পরে।আর এই কারণেই ----
--- তাই বলে চুরি,ডাকাতি করবে?আমার কাছে তো আসতে পারতো।আমি বারবার ওর হয়ে সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য করতে পারবো না।
--- বাবু এবারের মত উদ্ধার করে দেন।আর কোনদিন এসব ও আর যাতে না করে সে ব্যবস্থা আমি করবো।
 অমরেশবাবু জীবনে যত কেস লড়েছেন তার অধিকাংশই জিতেছেন।হেরে গেছেন খুব কম।কিন্তু কালুর এবারের কেসটাই তিনি হেরে যান।সেদিন ছিল শনিবার।তাই অফিস করে তিনি গ্রামের বাড়িতে আসেন।স্বভাবতই কেসে হেরে গিয়ে তার মনমেজাজ ভালো ছিলনা।শান্তিদেবী যখন তাকে চা করে এনে দেন তখন মুখে দিয়েই তিনি চিৎকার করে ওঠেন বাজে চা হয়েছে বলে।
 তার স্ত্রী অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন।কারণ আজ পর্যন্ত তার স্বামীর এরূপ আচরণ তিনি দেখেননি।অনেকক্ষণ তাকে পর্যবেক্ষণ করার পর হঠাৎ তার মনে পড়ে কালুর কিসের তারিখ ছিলো আজ।তিনি সরাসরি তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন,
--- তুমি কালুর কেসটাই হেরে গেছো তাই না?
 দুর্ব্যবহারের কারণটা স্ত্রী জেনে যাওয়ায় তিনি একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন।
--- ছেলেটার পাঁচ বছর শশ্রম হাজতবাস হয়ে গেলো।কিছুই করতে পারলাম না।ও ঢুকেছিলো ওই বাড়িতে চুরি করতে কিন্তু বাড়ির লোক জেগে যাওয়ায় শুরু করে ডাকাতি করতে।শুধু কি তাই বাড়ির গৃহকর্তা তাকে বাধা দিতে গেলে তাকে দা এর কোপ বসিয়ে দেয়।সে বেচারার কতগুলো সেলাই পড়েছে।এত কিছুর পরে তাকে কি আর বাঁচানো যায়?তুমি একটু ওর পরিবারটা দেখো।আমি তো সোমবার চলে যাবো। চাল,ডাল যা লাগে সব দিও।আর বাড়ির টুকটাক কাজের জন্য নিত্য একটু বেশি টাকা দিয়ে ওর বউটাকে কাজে লাগাও।
--- কিন্তু সেসব তো রতন দত্তের বউ যুথিকা দেখে।ওর সংসারের অবস্থা তো আরো খারাপ।কত লোককে তুমি এইভাবে দেখবে বলো তো?গ্রামের অধিকাংশ লোকের অভাব।এইভাবে এক একজন করে তুমি যদি তোমার নিজের বাড়িতে কাজে বহাল করো তাহলে কি করে হবে?
--- কিন্তু তাই বলে পরিবারগুলো না খেতে পেরে মরে যাক তাতো দেখতে পারবো না।
--- অন্য কোন একটা উপায় খুঁজে বের করতে হবে।এমন কোন উপায় যাতে ওদের দুপয়সা রোজগার হয়।
--- কি করা যায় বলো তো?
--- ভেবে কিছু তো একটা বের করতেই হবে।
  পরবর্তীতে তিনি দু,চারটি সেলাই মেশিন কিনে একজন শিক্ষক নিযুক্ত করে এদের জামা কাপড়ের কাটিং শিখিয়ে স্বনির্ভর হতে সাহায্য করেছিলেন।
  এতদসত্বেও অমরেশবাবু মানুষটি কিন্তু ঠিক সংসারী ছিলেন না।সংসারের কোন ব্যাপারেই তিনি মাথা ঘামাতেন না।সংসার সম্পর্কে উদাসীন এই মানুষটিই আবার অন্যের সংসারের হালহকিকতের খবর রাখতেন আর সাধ্যমত তাদের পাশে দাঁড়াতেন।অন্দরমহলের সমস্ত কিছু দেখাশুনা করতেন তার স্ত্রী।মেয়েদের শাসন করা থেকে শুরু করে তাদের লেখাপড়ার সমস্ত দায়িত্ব ছিল শান্তিলতাদেবীর।সত্যি কথা বলতে তখনকার দিনের ছেলেমেয়েরাও এত অবাধ্য ছিলনা।সন্ধ্যা হলেই বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে এক হ্যারিকেনের আলোতে সকলে মিলে জোরে জোরে যে পড়া চলতো সেখানে থাকতো একটা অদ্ভুত ভালোবাসার মেলবন্ধন।মায়ের নির্দেশ ছিলো সকলে জোরে জোরে পড়বে যাতে তিনি রান্নাঘর থেকেই শুনতে পান।ছোটরা কিছু না পারলে বড়দের সেগুলি দেখিয়ে দেওয়া,ছোটরা ভুল করলে বড়দের শাসন করা আর ছোটদের সেগুলি মেনে নেওয়া - তখনকার দিনে এগুলিই ছিল অধিকাংশ পরিবারের শিক্ষা।

ক্রমশঃ 
    


No comments:

Post a Comment