জীবনের প্রতি বাঁকে (ষষ্ঠ পর্ব)
সায়নী তার শ্বশুরবাড়ি পা দিয়েই বুঝতে পারলো তার শ্বশুর,শ্বাশুড়ী মন থেকে মেনে নিতে তাকে পারেনি।কারণ এ বিয়েকে কেন্দ্র করে আত্মীয় ও পাড়া প্রতিবেশিদের মাঝে যে গুঞ্জন উঠেছিল তার রেশ ধরেই কথায় কথায় তাকে নানান কটূক্তি শুনতে হচ্ছে।নূতন বউ সুতরাং সেভাবে মনোতোষকেও সেভাবে কিছু বলতে পারছে না।আর বাপের বাড়িতে তো নয়ই।মনেমনে ভাবলো যাকগে বেশিদিন এই কথার ঝাল তো মেটাতে পারবে না কারণ মনোতোষের ছুটি শেষ হলেই তো সে তার কর্মস্থলে চলে যাবে।আর সঙ্গে সেও।কিন্তু ভাবনার সাথে বাস্তবের মিল অনেক সময়ই পাওয়া যায় না।এখানেও ঘটলো ঠিক তাইই।মনোতোষ তার বউকে নিয়ে যেতে চাইলে তার বাবা,মা রাজী হননা।তারা তাদের ছেলেকে বলেন,
-- সবে তো বিয়ে করলি। ওতো তোর কাছেই থাকবে সারাজীবন।কয়েকটা দিন আমাদের কাছে রেখে যা।পরেরবার এসে সাথে করে নিয়ে যাস।
মনোতোষ বাবা,মায়ের কথাটা যুক্তিসঙ্গত মনে করায় সানুর শত কান্নাকাটিতে সে সায় দেয় না।সে একাই দন্ডকারন্য তার কর্মস্থলে ফিরে যায়।আর এর ফলে সায়নীর প্রতি মনোতোষের বাবা,মায়ের সকলের কাছে হেনস্থা হওয়ার রাগ গিয়ে পড়ে।তখনকার দিনে ফোনের এত রমরমা ছিলনা;যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম চিঠির আদানপ্রদান।কিন্তু নূতন বউ বাইরে বেরতেও পারবে না বা তারা বেরোতেও দেবে না।অত্যাচারের মাত্রা দিনকে দিন বেড়েই যেতে লাগলো।
একদিন অফিস ফেরত পথে অমরেশবাবু মেয়েকে দেখতে আসায় সায়নী যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।কিন্তু বাবা আর মেয়ে যাতে একসাথে আলাদা কথা বলতে না পারে তারজন্য মনোতোষের বাবা,মা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন।কিছুটা হলেও অমরেশবাবু বিষয়টা আঁচ করতে পারেন।শত হোক উকিল মানুষ তিনি।কেউ হা করলে তিনি হাওড়া, হাবড়া পৌঁছে যান।ইশারায় মেয়েকে বুঝিয়ে দেন লিখে দিতে।সায়নী চা করতে করতেই রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে একটি চিরকুটে লিখে নেয় " বাবু ওরা আমার প্রতি খুব অন্যায়,অত্যাচার করে"। চা টা রাখতে এসে প্লেটের তলায় তার বাবুর দিকে চিরকুটটা রাখে।তিনি চা,জলযোগ করে বাথরুমে যাওয়ার নাম করে চিরকুটটা নিয়ে উঠে যান।চিরকুটটা পড়ে সঙ্গে সঙ্গেই তার মাথা গরম হয়ে যায়।ওখানে দাঁড়িয়েই তিনি সিদ্ধান্ত নেন তিনি তার মেয়েকে নিয়েই বাড়ি ফিরবেন।
ঘরে ঢুকেই তিনি তার বেয়াই,বেয়ানকে প্রস্তাব দেন তিনি মেয়েটিকে সাথে করে কয়েকটা দিনের জন্য নিয়ে যেতে চান।সঙ্গে সঙ্গেই তারা সে প্রস্তাব নাকচ করে দেয়।কিন্তু অমরেশবাবু তার সিদ্ধান্তে অটল।তিনি তার সানুকে নিয়েই ফিরবেন।আর তার শ্বশুর,শ্বাশুড়ীও তাকে তার বাবার সাথে পাঠাবেন না।শেষমেষ তিনি রেগেমেগে বললেন,
--- আমি আমার মেয়েকে নিয়েই বাড়ি ফিরবো তারজন্য যদি তার স্বামী তাকে ত্যাগ করে করবে।তখন আমি আইনের পথেই হাঁটবো।ছেলের বিয়ে দিয়ে পুত্রবধুকে ছেলের সাথে না পাঠিয়ে তাকে বাড়িতে রেখে তার প্রতি যে অন্যায় অত্যাচার করছেন আপনাদের কোন ধারণা আছে আমি তারজন্য আপনাদের বিরুদ্ধে কি কি করতে পারি।
সায়নীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
-- মা তুই রেডি হয়ে চলে আয়।আমি তোকে নিয়েই ফিরবো।
সায়নী আমতা আমতা করতে লাগলে তিনি বলেন,
--- তোর কোন ভয় নেই।তোকে বিয়ে দিয়েছি স্বামীর সাথে সংসার করার জন্য।আর এরা তোকে তার সাথে না পাঠিয়ে তোর প্রতি মানসিক অত্যাচার করছেন।আমি বাবা হয়ে কিছুতেই এটা মেনে নেবো না।
--- আপনি কিন্তু ভুল করছেন বেয়াই মশাই।আজ যদি ওকে সাথে করে নিয়ে যান আমরা কিন্তু আপনার মেয়েকে আর কোনদিন এ বাড়িতে ঢুকতে দেবো না।
--- আমিও কোনদিন আর এ বাড়িতে আমার মেয়েকে পাঠাবো না।আর যদি তাকে পাঠাতেই হয় তাকে তার স্বামীর কাছেই পাঠাবো।
--- আপনার আজকের আচরণের কথা জানতে পারলে মনা কোনদিন আপনার মেয়েকে নিয়ে সংসার করবে না।
--- তাকে তো এটাও জানতে হবে তার প্রতি আপনারা কি অন্যায় করছেন।আমার মেয়ে তাকে কোন কথা জানায়নি ঠিকই কিন্তু আমি তো তাকে সমস্ত কথায় জানাবো।আর আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন আমার মেয়ে খাওয়াপরা আর একটু আশ্রয়ের জন্য কোনদিন আপনাদের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াবে না।আমি আমার মেয়েকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে তাকে নিজ পায়ে দাঁড় করাবো।
--- এতই যদি আপনার চিন্তাভাবনা তাহলে আমাদের ছেলের সাথে ওর বিয়ে দিলেন কেন?
--- সে ঘটনা আপনারা জানেন না?নাকি সব ভুলে বসে আছেন?আমার সেদিনই বোঝা উচিত ছিলো।যে ভুল সেদিন করেছি তা শুধরানোর সময় এসে গেছে।
বাকবিতণ্ডা প্রচুর তর্কাতর্কির পর অমরেশবাবু তার মেয়েকে নিয়ে সে স্থান ত্যাগ করেন।পড়ে তাকে নিয়ে যখন গ্রামের বাড়িতে যান তখন তার স্ত্রী শুনে তো থ।সারাজীবনই মেয়েদের কোন কষ্ট তিনি সহ্য করতে পারেন না।প্রতিটা মেয়ে তাঁর প্রাণ।আর এই কারণেই মেয়েদের বিয়ের কথা উঠলেই তিনি তেলেবেগুনে জ্বলে যেতেন।" দুটো ভাত কোলের কাছে নিয়ে আমার মেয়েরা চোখের জল ফেলবে এটা আমি কিছুতেই মেনে নেবো না --"এই ছিল তার বক্তব্য।
সমস্ত ঘটনা জানিয়ে সায়নী তার স্বামীকে চিঠি লেখে।কিন্তু কোন উত্তর সে পায় না।কয়েকমাসে বেশ কয়েকটা চিঠি দিয়েও যখন কোন উত্তর আসে না তখন অমরেশবাবু মেয়ের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে তাকে পুনরায় কলেজে ভর্তি করে দেন।কিন্তু মনটা তাঁর সব সময়ের জন্যই খুঁতখুঁত করতো মেয়েটার জন্য।মনোতোষ এই ঘটনার পর আর বাড়িতেও আসে না যোগাযোগও করে না।যে ছেলে সায়নীর জন্য এত পাগল ছিল,যে তাকে বিয়ে করার জন্য এত কান্ড করে লোক হাসালো তার চরিত্রের এই দিকটা কেউই কখনোই বুঝতে পারেনি।সায়নী কিন্তু তার স্বামীকে কয়েকদিন অন্তর অন্তর চিঠি লিখেই যাচ্ছে।আর প্রতিদিন প্রতি মুহুর্ত সে অপেক্ষা করে থাকে মনোতোষের উত্তরের আশায়।কিন্তু তার অপেক্ষা অপেক্ষাতেই শেষ হয়ে যায়। আস্তে আস্তে সে নিজেকে অনেকটাই সামলে নেয়।পড়াশুনায় মন দেয়।দেখতে দেখতে বেশ কয়েকটা বছর কেটে যায়।সায়নী গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে।কিন্তু চিঠি লেখা তার বন্ধ হয় না স্বামীকে।ইতিমধ্যে এই বিবাহিত সায়নীকে একজন পূর্ব পরিচিত ছেলে বিয়ে করতে চায় যেহেতু সকলেরই ধারণা তার স্বামী তাকে ছেড়ে দিয়েছে।কিন্তু সায়নীর বাবা পরিস্কার তাদের জানিয়ে দেন সংসার যদি করতেই হয় তাহলে আমার সানু ওই মনোতোষের সাথেই করবে।তারজন্য যতদূর যেতে হয় আমি যাবো।আমার মেয়ের জীবন নষ্ট করবে ;আর আমি এত সহজে তা মেনে নেবো না। আইনশৃঙ্খলা বলে দেশে একটা কথা আছে।মনোতোষ সরকারি চাকরি করে।আমি আইনের পথ ধরেই সেই পথে এগোবো।আমি এত সহজে সবকিছু ছেড়ে দেবো না।
তিন বছরের মাথায় মনোতোষের একটি চিঠি আসলো।কিন্তু চিঠি খুলে সায়নী তো অবাক।খামের উপরে তার নাম।অথচ ভিতরে সে যে চিঠিটা লিখেছে এটা তো তাকে লেখা নয়!নামটাও তো তার নয়।কে এই দিপালী?কাকে মনোতোষ এইভাবে চিঠি লিখেছে?তাহলে কি মনোতোষ অন্য কাউকে ভালোবাসে?আর সেই কারণেই তাকে নিতে আসা বা তার চিঠির উত্তর দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে?চিঠি পড়ে মনেমনে ভাবে বাবুকে কথাটা বলতেই হবে।বাবু ছাড়া এই সমস্যার সমাধান কেউই করতে পারবে না।আজই রাতে বাবুকে চিঠিটা দেখাতে হবে।
ক্রমশ -
No comments:
Post a Comment