Thursday, October 28, 2021

জীবনের প্রতি বাঁকে (অষ্টম পর্ব)

জীবনের প্রতি বাঁকে (অষ্টম পর্ব)
   সংসারের নানান ঘাত_প্রতিঘাত ঘরে বাইরের নানান সমস্যায় জর্জরিত থাকলেও মানুষটি অর্থাৎ অমরেশবাবু সর্বদায় থাকতেন ধীর,স্থির।কেউ কোনদিন রেগে গিয়ে তাকে কোন কটু কথা বলতে দেখেনি। একমাত্র তার মনটা খারাপ থাকতো তিনি যেদিন কোন কেসে হেরে যেতেন।দুবেলা আহ্নিক অর্থাৎ সন্ধ্যা করা,একবেলা ভাত খাওয়া বা অন্ন গ্রহণ করা নিষ্ঠাবান একজন ব্রাহ্মণ।তিনি খড়ম পরে সিমেন্টের উপর থেকে হাঁটাচলা করলেও কোন শব্দ হত না।পাড়ার অনেকেই তাকে শিবঠাকুর বলতেন। আরও বলতেন "এই মানুষটা মাটির উপর দিয়ে এমনভাবে হাঁটেন যাতে মাটিও ব্যথা না পায়।"
  অমরেশবাবুর একমাত্র বোন বীণাপাণি।বেশ অবস্থাপন্ন ঘরে মা বেঁচে থাকতেই বিয়ে দিয়েছিলেন প্রহ্লাদ মুখার্জীর সাথে।খুব সুখী হয়েছিলেন তবে সে সুখ স্থায়ী হয়েছিলো মাত্র তিন বছর।দুবছরের মাথায় বীণাপাণিদেবীর একটি পুত্রসন্তান হয়।কিন্তু আঠারো দিনের মাথায় পুত্রটি আতুর ঘরেই মারা যায়।তারপর তার আর কোন সন্তান হয়না।এইভাবে বিয়ের পর সাত বছর কেটে যায়।একই ঘর একই বিছানা হলেও স্বামীর সাথে সম্পর্ক নেই বললেই হয়।অনেকবার অমরেশবাবু তার বোনকে বলেছিলেন,"শ্বশুরবাড়ির পাঠ চুকিয়ে তুই আমাদের কাছে চলে আয়।" কিন্তু তার বোন রাজি হননি।তিনি তার শ্বশুরের ভিটে ছেড়ে কোনদিনও এসে তার ভায়ের গলগ্রহ হতে চাননি।বিয়ের সাত বছরের মাথায় প্রহ্লাদবাবু পুনরায় বিয়ের তোড়জোড় করতে শুরু করেন।বিশাল সম্পত্তি দেখভালের জন্য তার উত্তরাধিকার চায়।বীণাপাণিদেবীর শ্বশুর,শ্বাশুড়ী তাদের একমাত্র ছেলের বউকে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন।তারা এ বিয়ের বিরোধীতা করেন।ঝামেলা মারত্মক আকার নেয়। প্রহ্লাদবাবু দুরাত বাড়ি ফেরেন না।শ্বশুর,শ্বাশুড়ির উদ্বিগ্নতা দেখে বীণাপাণিদেবী তাদের হাতে পায়ে ধরে রাজি করান এই মর্মে তাদের ছেলে বিয়ে করলে তার কোন আপত্তি নেই।তিনি সতীন নিয়েই ঘর করতে রাজি আছেন।
 চারিদিকে লোক পাঠিয়ে ছেলেকে খুঁজে আনা হল।অনিচ্ছা সত্বেও তারা তাদের ছেলের পুনরায় বিয়েতে মত দিলেন।কিন্তু পরিষ্কার করে জানিয়ে দিলেন, "বৌমা ওই ঘরেই থাকবে সে যেন একটি নূতন ঘর তৈরি করে নেয়।"এ কথায় বাঁধ সাধলেন স্বয়ং বীণাপাণিদেবী নিজেই।তিনি তার শ্বশুরকে জানালেন,"বড় হওয়ার পর থেকেই তিনি অর্থাৎ তার স্বামী ওই ঘরেই থেকে অভ্যস্ত।তিনি কেন ঘর ছাড়বেন? আমিই ওই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসবো।আপনি বরং আমার জন্য একটি ঘর তৈরি করে দিন।যে মেয়ে তার স্বামীকে ধরে রাখতে পারেনি,তাকে পিতৃত্বের স্বাদ দিতে পারেনি সে ঘর আটকে রেখে জীবনে কোন সুখ খুঁজে পাবে?"
  বিয়ের আগেই ঘর তৈরি হল।পুনরায় অমরেশবাবু তার বোনকে আনতে গেলেন।কিন্তু এবারেও তাকে খালি হাতেই ফিরে আসতে হল।শ্বশুরবাড়ির ভিটে ছেড়ে বিয়েদারি হয়ে তিনি কোন অবস্থাতেই বাপের ভিটেই ভায়ের সংসারে আসবেন না।
  মন্দিরে সিঁদুর পরিয়ে বাপ মা মরা নমিতাকে বউ করে প্রহ্লাদ মুখার্জী বাড়ি নিয়ে এলেন।কিন্তু বউ নিয়ে বাড়ি এসে দেখেন পুরো বাড়ি অন্ধকার।বেশ কয়েকবার "মা,মা" বলে চিৎকার করে ডেকেও কোন সাড়া পেলেন না।হঠাৎ দেখেন বীণাপাণিদেবী একহাতে হারিকেন আর এক হাতে বরণডালা নিয়ে বাড়ির সদর দরজার কাছে হাজির হলেন।একাই উলু দিতে নূতন বউকে বরণ করলেন।জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে কিছুক্ষণ ইতস্তত করার পর হাসিমুখে নিজের হাতের সোনার নোয়া বাঁধানোটা খুলে নূতন বউকে বরণ করে ঘরে নিয়ে এলেন।সেই ঘরে যে ঘরে তিনি নূতন বউ হয়ে ঢুকেছিলেন।নূতন বউকে নিজের ঘরে নিজের বাবার দেওয়া খাটে বসিয়ে সেই ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন নিজের বালিশ আর একটা টিনের বড় বাক্স নিয়ে।আগেই নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলি তিনি ওই টিনের বাক্সে ভরে রেখেছিলেন।আজীবন তিনি আর ওই ঘরে ঢোকেননি।
  প্রহ্লাদবাবুর বাবা,মা পরদিন থেকে ছেলের সাথে কথা বলা বন্ধ করলেন।শ্বাশুড়ী দুই বউয়ের মাঝে কাজ ভাগ করে দিলেন।নমিতাদেবির ভাগে পড়লো রান্নাবান্না,বাড়ির সবাইকে খেতে দেওয়া।আর বাকি সবকিছুর তদারকি,শ্বশুর শ্বাশুড়ির দেখভাল আত্মীয়-স্বজনের সাথে লোক লৌকিকতা সবকিছুর ভার বড় বউয়ের।ঝামেলা ছাড়াই সংসারে দুই বউ নিজেদের মত করেই দিনাতিপাত করছিলো।বড় বউয়ের গুনে ছোট বউ তার সতীনকে নিজের দিদির আসনেই বসিয়েছিল।কিন্তু বীণাপাণিদেবী আমৃত্যু একই বাড়িতে থেকেও স্বামীর সাথে কোন সম্পর্কই রাখেননি এমনকি কোন কথাও বলতেন না।
 সবই ঠিকই চলছিলো।কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো বিয়ের চার বছরের মাথাতেও যখন নমিতাদেবী কোন সন্তান ধারণ করতে পারলেন না।তখনকার দিনে চিকিৎসা শাস্ত্রের এত উন্নতি না থাকলেও বীণাপাণিদেবীর স্বামীর বিয়ের পূর্বে তার ভাই তাকে ডক্টর দেখিয়েছিলেন।কিন্তু ডক্টরের কথা অনুযায়ী তার কোনোই সমস্যা ছিলনা।ডাক্তার পরিস্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন তার (ডাক্তারের) যতদূর মনে হচ্ছে উনার স্বামীরই কোন দোষ আছে।কথাটা বাড়িতে জানানো হলে তারা হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন আর বলেছিলেন,"সন্তান ধারণে পুরুষের কোন অক্ষমতা থাকে না।আর সেটা তিনি বিয়ে করেই প্রমাণ করে দেবেন।"
 বিশাল সম্পত্তি অথচ ভোগ করবার জন্য কোন উত্তরাধিকার এলো না।তাহলে সম্পত্তি এবার ভাগ বাটোয়ারা করে দিতে হবে দুই বউ আর ছেলের মধ্যে।নমিতাদেবীর কেউ নেই সুতরাং তিনি মারা গেলেও এই সম্পত্তি থাকবে প্রহ্লাদবাবুর হেফাজতেই।কেউ তো আর নিজের মৃত্যু আগে হতে পারে এটা কোনদিন ভাবে না।তিনিও ভাবেননি।কিন্তু বীণাপাণিদেবীকে সম্পত্তি দিলে তার অবর্তমানে সেই সম্পত্তির অধিকারী হবে তার ভাইপো। প্রহ্লাদবাবু কিছুতেই চান না তার বড় বউকে কোন সম্পত্তি দেওয়া হোক।তার বাবা,মা এ কথা জানতে পেরে ছেলেকে জানালেন সম্পত্তি ভাগ-বাটোয়ারার ব্যাপারে সে যদি কোন নাক গলায় তাহলে সমস্ত সম্পত্তি  বড় বউয়ের নামেই তারা করে দেবেন।সংসারে তখন আবার আগুন জ্বলতে লাগলো।আর ঠিক এই সময়ে বীণাপাণিদেবী বেড়াতে এসেছিলেন তার ভাইয়ের বাড়িতে।তিনি বাড়ি ফিরে সব জানতে পেরে তার শ্বশুরকে অনুরোধ করেন তাকে যেন কোন সম্পত্তি না দেওয়া হয়।আর এও বলেন তার ভায়ের যে সম্পত্তি আছে তার হয়তো অর্ধেক আপনাদের আছে।আমার ভাইপো কোনদিনও এই সম্পত্তির ভাগ নিতে আসবে না।আপনার ছেলের যখন এতই ভয় আপনি আমাকে আপনাদের সমস্ত সম্পত্তি থেকে রেহাই দিন।আর কতদিনই বা বাঁচবো।এই সম্পত্তি,বাড়ি,ঘর কোনকিছুর প্রতিই আমার কোন লোভ নেই।শুধু এইটুকু অধিকার আমাকে দিয়ে যান আমি যে কটাদিন বাঁচবো যেন এই বাড়িতেই থাকতে পারি।কোনদিন যেন আমাকে আমার ভায়ের বাড়িতে গিয়ে উঠতে না হয়।
 নারী জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ তার স্বামী।তাই যখন আমি অন্যের হাতে তুলে দিতে পেরেছি আমার আর কোন কিছুতেই কোন লোভ নেই।
  বিনাপানিদেবী স্বামীর পরিবারেরই এক আত্মীয়ের একটি মেয়েকে খুব ভালোবাসতেন।নামটি ছিল তার গীতা।শ্বশুর শ্বাশুড়ির মৃত্যুর পর বেশ কয়েক বছর বাদে তার মৃত্যু হয়।তিনি তার পালিত কন্যা গীতাকেই বলে গেছিলেন তার মৃত্যুর সময় মুখে জল দিতে ও তার শ্রাদ্ধ করতে।গীতা সে কথা অতি নিষ্ঠাভরে পালন করেছিল।
 বিনাপানীদেবী তার মানসিক অসীম শক্তি বলে নিজের শত দুঃখ,কষ্ট বুকে চেপে রেখে স্বামীর সাথে সংসার করতে না পারলেও শ্বশুরের ভিটেতেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন।আজ থেকে বেশ কয়েক যুগ আগে পিছিয়ে গিয়ে বলতেই পারি " আদর্শ ভারতীয় বাঙ্গালী নারী।"

ক্রমশঃ 

No comments:

Post a Comment