জন্ম দিলেই মা হয়না
"ভগবান সব দিক থেকেই আমাকে মারলেন।গরীব বাপের ঘরে জন্মগ্রহণ করে প্রেম করে বিয়ে করলাম এক রিক্সাওয়ালাকে।ভেবেছিলাম রিক্সা চালিয়ে ও যা পাবে আর নিজে দু,এক বাড়ি কাজ করে ঠিক চলে যাবে।একটাই বাচ্চা নেবো তাকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মত মানুষ করবো।ঠিকই চলে যাচ্ছিলো। সোয়ামী আমার খুবই ভালো।আমায় খুব ভালোবাসে।আমাকে কোন বাড়িতে কাজে যেতে দেয় না।কিন্তু আজ তিনবছর বিয়ে হয়েছে একটা বাচ্চা-কাচ্চা না হলে ভালো লাগে?তাই আজ ওকে নিয়ে এই হাসপাতালে এসেছি ডাক্তার দেখাতে।"
আজ বিদ্যাসাগর হাসপাতালে ভিষন ভির।সেই সকাল থেকে টিকিট কেটে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে না পেরে চঞ্চলা সিড়ির উপর এসে বসে।ওর মত আরো একজন রোগী প্রায় ওরই সমবয়সী ওর পাশে এসে বসে।সে তার মাকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে এসেছে।তার সাথেই কথা প্রসঙ্গে কথাগুলো বলছিলো চঞ্চলা।
চঞ্চলার বাবা ভ্যানগাড়ি চালান।এক ছেলে,এক মেয়ে তার।চঞ্চলার মা সারাটাদিন লোকের বাড়ি বাড়ি কাজ করে বেড়ায়।বাবাটা যদি নেশা করে এদিক ওদিকে পরে না থাকতো তাহলে তাদের সংসারটা দুজনের রোজগারে ভালোই চলে যেত।কিন্তু নরেশ যা রোজগার করে তাই দিয়েই নেশা করে।চঞ্চলা সেভেন পর্যন্ত পড়েছে।কিন্তু পরিমলের সাথে প্রেম করে বিয়ের ভুত মাথায় চাপলো।তখনো তার আঠারো বছর বয়স হয়নি।পালিয়ে এলো।পরিমলের সাথে।বলেকয়ে আসলেও যে খুব একটা বাঁধা পেতো তা চঞ্চলার মনে হয়না।তবুও সে না বলেই বাড়ি থেকে পালিয়ে আসে।
পরিমলের একমাত্র বিধবা পিসি।বাপ,মা কেউই নেই তার।পিসিও খুব ভালোভাবেই চঞ্চলাকে মেনে নিয়েছে।টাকা,পয়সা কম থাকলেও যে সুখী থাকা যায় তা চঞ্চলা আর পরিমলকে দেখেই বোঝা যায়।
কিন্তু বিয়ের তিন বছরের মাথাতেও যখন চঞ্চলা মা হতে পারলো না তখন তার মন খুঁতখুঁত করতে লাগলো।সে পরিমলকে অনেক বুঝিয়ে রাজি করালো ডাক্তার দেখানোর জন্য।কিন্তু ডাক্তার দেখিয়ে চঞ্চলা আর পরিমলের মনই খারাপ হয়ে গেলো।কি একটা বড় অপারেশন করতে হবে।অপারেশন করলেই যে বাচ্চা আসবে তারও কোন নিশ্চয়তা নেই।তবুও চঞ্চলা চায় সে অপারেশনটা করবেই।তবুও তো মনে একটা আশা থাকবে।
অপারেশন করতে কোন টাকা-পয়সা লাগবে না ঠিকই।কারণ ও তো সরকারি হাসপাতালে দেখাচ্ছে।কিন্তু তারপরে তো অনেক ওষুধপত্র খাওয়াদাওয়া আছে।তারজন্য তো টাকা দরকার।পিসি দুই বাড়ি রান্না করে যা পায় এই সংসারের পিছনেই খরচ করে।পরিমল এখন রোজ ভোর ছটায় বেরিয়ে যায় আর অনেক রাতে বাড়ি ফেরে।একটা মাটির ভার কিনে এনেছে।রোজের রোজগারের টাকাটা রাতে বাড়িতে ফিরে ওই ভারের মধ্যেই রাখে।
একদিন রাত প্রায় একটা হতে চললো।পরিমলের দেখা নেই।পিসি আর চঞ্চলা মিলে বড় রাস্তায় চলে এসেছে।রাস্তায় কোন জনমানব নেই।মাঝে মধ্যে কিছু কুত্তা ঘেউ ঘেউ করে উঠছে।হঠাৎ দেখে পরিমল তার রিক্সাটাকে একহাতে টানতে টানতে আসছে।আর একটা হাত দিয়ে বুকের কাছে কিছু চেপে ধরে আছে।দুজনেই এগিয়ে গেলো তার দিকে।
--- ওমা এত একটা বাচ্চা গো।এখনো নাড়িটাও কাটা হয়নি।কি পাষণ্ড ওর জন্মদাত্রী গো!
পিসি কথাগুলো বলে চলেছে আর চঞ্চলা এগিয়ে গিয়ে বাচ্চাটাকে পরিমলের কোল থেকে নিজের কোলে নিয়ে নিয়েছে।
--- ও পিসি তুমি ওর নাড়িটা কাটতে পারবে গো ?
--- আরে পারবো না কেন একটা নূতন ব্লেড ওই একটু জলে ফুটিয়ে নিয়ে কেটে দেবো।কিন্তু তুই এটাকে পালবি নাকি?আর পুলু তুই ওকে কোথায় পেলি?
--- আর বোলো না গো পিসি।ওই যে কালিতলার কাছে যে ডাস্টবিনটা আছে ওর ভিতর কে যেন ফেলে রেখে গেছে।ওর চিৎকার শুনেই তো আমি এগিয়ে গেলাম ডাস্টবিনের কাছে।
--- দেখো না গো পিসি কি সুন্দর দেখতে গো।কেউ চেয়ে পায় না আর কেউ পেয়েও হেলায় হারায়।
চঞ্চলা পিসির উদ্দেশ্যে বললো কথাগুলো।
--- ওরে পুলিশের ঝামেলা হবে গো!
--- আরে কিচ্ছু হবে না।ওসব বড় লোকদের বেলায় হয়।আমরা হলাম গিয়ে গরীব মানুষ।বলবো আমার ছেলে।বাড়িতেই জন্মেছে।
--- আর পাড়ার লোক ?
--- ওইসব আমি ঠিক ভেবে নিয়েছি। কাল রাতের বেলা আমি মায়ের কাছে চলে যাবো।তোমাদের বলা হয়নি মাঝে একদিন মায়ের সাথে দেখা হয়েছিলো।মা আমায় বাড়ি যেতে বলেছে।মাকে সব গিয়ে বুঝিয়ে বলবো।সব ঠিক আমি ম্যানেজ করে নেবো গো পিসি।
রাতে ঘরে চা করার যে দুধ ছিলো তাই বাচ্চাটাকে ওরা খাওয়ালো।পরিমল বললো," খুব ভোরে উঠে ভারটা ভেঙ্গে ওর জন্য কৌটোর দুধ নিয়ে আসবো আমি।হ্যারে চঞ্চলা, তুই বললি না তো আমার এই উপহারটা তোর কেমন লাগলো?
বাচ্চাটাকে বুকের সাথে চেপে ধরে চঞ্চলা বললো,
--- এতদিনে তুমি আমাকে এমন একটা উপহার দিলে যার কোনকিছুর সাথেই তুলনা চলে না গো।আমি ভীষণ খুশি। পেটে ধরিনি তাতে কি হয়েছে।ওকে মানুষ করে আমি দেখিয়ে দেবো জন্ম না দিলেও মা হওয়া যায়।
No comments:
Post a Comment