Thursday, October 14, 2021

নীরবে এসেছিল প্রেম

নীরবে এসেছিল প্রেম

  "অঞ্জলী দেওয়ার সময় ঘটেছিলো ঘটনাটা"- সবাই উৎসুক হয়ে নবনীতার দিকে তাকিয়ে আছি।ও তখন মনেহয় স্কুল লাইফে আমাদের দশম শ্রেণীর ক্লাসরুমে ফিরে গেছে।তাই কয়েক মিনিট আমাদের শুধু ফ্যালফ্যাল করে ওর বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হল।তারপর চোখ খুলে বললো,
--- তোরা সেখানে সকলেই ছিলি কিন্তু সেদিন সুনীলের সেই কান্ড কেউ দেখতে পারিসনি।কারণ সকলেই অঞ্জলীর মন্ত্র বলেছিলি চোখ বন্ধ করে।আমারও চোখ বন্ধ ছিল।কিন্তু --
   নবনীতা আবারও চুপ।আর আমরা চেয়ারগুলো সামান্য টেনে নিয়ে তার দিকে এগিয়ে গেলাম।বহুবছর বাদে আজ আমরা আবার সবাই একসাথে।আমরা সকলে এসেছি আজ একটা হোটেলে খাবোদাবো আর চুটিয়ে আড্ডা দেবো।ফেসবুকের সৌজন্যে প্রায় বছর দশেক বাদে আমাদের দেখা।আমরা ফোনেই কনফারেন্স করে ঠিক করে নিয়েছিলাম সকলের জীবনে ঘটে যাওয়া এমন কোন ঘটনা আজ শেয়ার করবো যা নিজে ছাড়া আর কেউই জানেনা।প্রায় সকলেই তার জীবনের প্রথম প্রেম থেকে প্রথম পরশ মন খুলে বলেছে। কারো কারো জীবনের প্রথম প্রেম স্বার্থকতা পেয়েছে বিয়ে করে।আবার কেউ তার ভালোবাসার মানুষটাকে কাছে পায়নি।বিয়ে হয়েছে অন্য কারো সাথে।সুখী হয়েও মনের কোন এক গোপন গভীর কোনে তাকে আজও সযত্নে লালন করে চলেছে।কেউবা ভালোবেসে বিয়ে করেও সুখী হতে পারেনি।বিয়ের পরপরই মানুষটার ভিতরের কালো দিকটা বেরিয়ে পড়েছে।খুব কাছের দশ বন্ধুর জীবন দশ রকমভাবে এগিয়ে চলেছে।অনেকদিন পর মন খুলে সকলে সকলের মনের কথাগুলি বলতে পেরে অনেকটাই হালকা হয়েছে।সবার শেষে পালা ছিল নবনীতার।
 নবনীতা আবারও শুরু করলো,
-- আমি তো চোখ বন্ধ করে মন্ত্র উচ্চারণ করে চলেছি হঠাৎ আমি টের পেলাম আমার জোর করা হাতের মধ্যে কেউ একটা ছোট কাগজের টুকরো গুঁজে দিলো।বুকটা ধরাস করে উঠেছিল তখন।হঠাৎ করেই কাঁপতে শুরু করি।এদিকওদিক তাকিয়ে এমন কাউকে দেখতে পেলাম না যাকে এই কাজের নায়ক ভাবতে পারি।খুব তাড়াতাড়ি কাগজের টুকরোটা তুলে ব্লাউজের ভিতর লুকিয়ে ফেলি।কোন রকমে অঞ্জলী শেষ করে তোদের সকলের সাথে প্রসাদ খেয়ে বাথরুমে গিয়ে ঢুকি কাগজের টুকরোটা পড়বার জন্য।
বুঝতেই পারছিস জীবনের প্রথম প্রেমপত্র।বুকটা কেমন যেন উথালপাথাল করছে।
 সুস্মিতার আর দেরি সহ্য হয়না।সে নবনীতার কথার মাঝখানেই বলে বসে,
--- আরে আমরা সকলেই জানি এগুলো।তুই আসল কথাটা বল। কাগজটাতে কি লেখা ছিল?
--- সেটাই তো বলছি।কোনদিন তো একথা কাউকেই বলতে পারিনি।আজ তোদের সব বলবো বলেই তো আমি এমন একটা প্রস্তাব রেখেছিলাম তোদের কাছে যে সব্বাইকে বলতে হবে তার জীবনের এমন কোন ঘটনা যা সে নিজে ছাড়া আর কেউ জানেনা।যাকগে তারপর শোন। আস্তে আস্তে কাগজটা খুলে পড়তে লাগলাম --
 নিতা,
  আমি তোমায় খুব ভালোবাসি।আমি অনেকদিন ধরে তোমায় কথাটা বলবো ভাবছি কিন্তু সুযোগ হয়নি।তাই আজ তোমার স্কুলেই চলে এলাম।এটা অবশ্য আমারও স্কুল।আমি সেনাবাহিনীতে চাকরি পেয়ে গেছি।আমি তোমার পড়াশুনা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে রাজি আছি। কাল সন্ধ্যায় আমার ট্রেন।মোবাইল নম্বর দিলাম।তোমার মতামত জানিও আজই।তুমি ফোন না করলে বুঝবো আমাকে তুমি পছন্দ করো না।
 নিচুতে সুনীলের নাম লেখা।
অপরূপা বলে উঠলো,
-- এই কোন সুনীল রে ?সেই আমরা সবাই যাকে উত্তম কুমার বলতাম?
--- হ্যাঁ।
 তখন আমি বললাম, "তারপর গেছিলি তুই?"নবনিতা উদাস হয়ে বললো,
--- আমরা তো সকলেই সুনীলকে পছন্দ করতাম সেই সিক্স,সেভেন থেকেই।তখন ওর চেহারার প্রতি ছিলো আমাদের আকর্ষণ।সেই আকর্ষণ থেকেই কিন্তু প্রত্যেকেই ওর প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েছিলাম বড় হয়ে।ভাবলাম বাড়িতে গিয়ে মায়ের ফোন থেকে সুযোগ বুঝে ফোনটা করবো।কাগজটা আবার যথাস্থানে রেখে বাড়ি গেলাম।আমার দূর্ভাগ্য এমনই বাড়িতে পৌঁছে শুনি বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে সবাই হাসপাতালে।কোন রকমে ঘরে ঢুকে একটা সালোয়ার কামিজ পরেই মাসীর সাথে হাসপাতাল পৌঁছালাম।তখন আমার মনেই ছিলনা ওই কাগজের টুকরোটার কথা।বাবা ভেন্টিলেশনে চলে গেলেন সেদিন।সাতদিন ছিলেন ভেন্টিলেশনে।তারপর সব শেষ।
 সব কাজ মিটে যাওয়ার পর ওই নম্বরে বহুবার ফোন করেছি।সব সময়ই শুনেছি সুইচ অফ।আজও আছে নম্বরটা আমার কাছে।এখন শুনি নম্বরটার কোন অস্তিত্ব নেই।মাঝে মাঝেই মোবাইলে সুনীল নয় সুনিলা বলে সেভ করে রাখা নম্বরটাই নিজের অজান্তেই কল হয়ে যায়।সঠিক নামে সেভ করতে পারিনি ভয়ে।
 নবনীতা চুপ করে গেলো।আমরাও চুপ করে দেখতে লাগলাম নবনীতার চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়ছে।শুধু নবনীতা নয় আমাদের সকলের অন্তর ভেদ করে দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়তে লাগলো।

No comments:

Post a Comment