Sunday, October 31, 2021

জীবনের প্রতি বাঁকে (নবম পর্ব)

জীবনের প্রতি বাঁকে (নবম পর্ব)
  এক একটা মানুষের জীবনীএক একটা উপন্যাস বলা যেতেই পারে।সেই মানুষটাকে জড়িয়ে বাকি যারা রয়েছেন ঠিক তাদের জীবনী নিয়েও ছোট ছোট গল্পের সমন্বয়ে আরো বেশ কয়েকটি উপন্যাস তৈরি হতে পারে।আমার এই উপন্যাসটিও ঠিক তাই।পরিবারের মাথা অমরেশবাবু হলেও তাকে ঘিরে আর যারা রয়েছেন তাদের জীবনের সমস্ত ঘটনাগুলিও কিন্তু মস্ত বড় গল্প বা এক একটি উপন্যাস।
 সায়নীকে নিয়ে আমার উপন্যাস শুরু হলেও আস্তে আস্তে অনেক চরিত্রেরই অবতারণা হয়েছে।পরবর্তীকালে সায়নীর জীবনে কি ঘটেছিল শুধুমাত্র সেই ঘটনার কথায় জানাবো আপনাদের আজ।
 মনোতোষের সাথে সংসার করতে গিয়ে সায়নী বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারে আদতে মানুষটা খুবই ভালো।তার মন,মানসিকতা একটি সরল নিষ্পাপ শিশুর মত।কেউ চোখে জল নিয়ে কিছু তাকে বুঝালে সে সেটা সরল মনেই মেনে নেয়।তার নানান ফাঁদে পা দেওয়া এটাই মস্তবড় কারণ।
 এই দিপালী মেয়েটি সুন্দরী,শিক্ষিত।মনোতোষকে সে পছন্দ করে এবং তাকেই সে বিয়ে করতে চায়।কিন্তু মনোতোষ স্কুল জীবন থেকে সায়নীকে ভালোবেসে এসেছে।আর তাকেই বিয়ে করতে চেয়েছে।কিন্তু হঠাৎ করে দিপালী তার জীবনে এসে যাওয়ার পড়ে মনোতোষের অবস্থা দাঁড়ায় " শ্যাম রাখি না কুল রাখি গোছের "-।সে যখন দন্ডকারন্য থেকে বাড়িতে আসে তখন বাবা,মায়ের চাপে বিয়েতে মত দেয় কারণ তার আগেই সায়নীর বাবা "সীতার বনবাস হয়েছিল যেখানে সেখানে তিনি কোন অবস্থাতেই তার সানুর বিয়ে দেবেন না"- জানিয়ে দেন। এ কথায় তার বাবা,মা অপমানিত বোধ করেন এবং চোখ ভরা জল নিয়ে ছেলেকে সে কথা বুঝাতেও সক্ষম হন।তাই বিয়েতে মত দেওয়া।
 নানান কাঠ-খড় পুড়িয়ে যখন সায়নীর সাথে তার বিয়ে হয় সে কিন্তু তাকে সাথে করেই নিয়ে যেতে চেয়েছিল।কিন্তু এখানেও মনোতোষ পিছলে যায় তার বাবা,মায়ের চোখের জলে।সে বাধ্য হয় সানুকে রেখে যেতে।সানুর  কাছে কিন্তু কোন কথায় সে স্বীকার করে না যে তার বাবা,মায়ের মত নেই বলেই সে তাকে নিয়ে যেতে পারছে না।আর তখন তার মনের মধ্যে সব সময়ের জন্য একটা ভয় কাজ করতো তাহল এই যে কথায় কথায় সানুর বাবা যে কেসের ভয় দেখান যদি সেটা সত্যিই হয় তাহলে তার সরকারি চাকরি নিয়ে টানাটানি বেঁধে যাবে।কারণ তখন তার বয়সটাও খুব কমই ছিল তাই কি থেকে কি হবে ;সব সময়ের জন্যই মনের ভিতরে একটা ভয় কাজ করতো।এদিকে অমরেশবাবু যখন তার মেয়েকে হঠাৎ করেই পাঠিয়ে দিলেন তখন সত্যিই মনোতোষ কিন্তু কোয়ার্টারের জন্য চেষ্টা করছিল।কিন্তু দিপালী কিছুতেই সানুকে নিয়ে সংসার করাটা মেনে নিতে পারছিলো না।ওই যে আগেই বললাম মনোতোষকে যে কেউ যে কোন কথা বুঝিয়ে ফেলতে পারে কেঁদে-কেটে একসার হয়ে যদি তাকে সে বিষয়ে বোঝায়।তাই একটু হলেও কোয়ার্টার পাওয়ার ব্যাপারে মনোতোষের গড়িমসি ছিল।কিন্তু সায়নী যখন ঘর ভাড়া নিয়ে তার সাথে থাকতে চাইলো তখন সে মুখে কিছু না বললেও মনেমনে কিন্তু খুশিই হয়েছিল।
  মুখচোরা স্বভাবের মানুষগুলিকে নিয়ে যারা সংসার করে একমাত্র তারাই বলতে পারে এদের নিয়ে জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে চলতে গেলে নিজেকেই সব জায়গায় ভিলেন সাজতে হয়।আর এর কারণ হচ্ছে এই মুখচোরা লোকগুলো অন্যের হ্যাঁ তে হ্যাঁ আর না তে না করার ফলে ঘরের অন্য মানুষটাকেই সেই কথাগুলি সঠিক জায়গায় আনতে গেলেই চরিত্রের নাম হয়ে পড়ে ভিলেন।তাই অধিকাংশ জায়গাতেই সায়নী খুব বাজে মানুষ হলেও মনোতোষ কিন্তু ভীষণ ভালো মানুষ।এটা যে মনোতোষের কোন দোষ তা কিন্তু নয়।আর পরবর্তীকালে সায়নীরও ব্যাপারটা গা সওয়া হয়ে গেছিলো।
  প্রথম সন্তান তাদের মেয়ে।তার যখন বছর খানেক বয়স তখন দীপালীর বিয়ে ঠিক হয়।দিপালী অফিসে এসে মনোতোষের কাছে সোনার কানের ঝুমকো দুল দাবি করে।মনোতোষ বাড়িতে গিয়ে সায়নীকে সে কথাও গল্প করে।সায়নী তখন তাকে বলে,
--- ভালো তো ।তুমি একবারে একই রকমের দুটো ঝুমকো দুলের অর্ডার করো।আমার ইচ্ছা আমিও ওর মত দুল পরবো।আর ওটা পরেই আমি ওর বিয়েতে যাবো।
 এই ব্যাপারটা মনোতোষ কিন্তু বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারে।মনোতোষের সৎ সাহস ছিল ঠিকই কিন্তু কথার ঘোরপ্যাচ সে বুঝতো না।তাকে কিছু বলতে গেলে সোজা সাপ্টা না বললে সে কখনোই বুঝতে পারতো না।কিন্তু সায়নীর সাথে সংসার করতে করতে সায়নী তাকে নিজের হাতে অনেকটাই নিজের মনের মত করে গড়ে নিতে সক্ষম হয়েছিল।বুদ্ধিমান মনোতোষ তার চরিত্রের দোষ ত্রুটিগুলো নিজেই সংশোধন করে নিতে পেরেছে।পরবর্তীকালে সে এই রায় চৌধুরী পরিবারে অনেকগুলি জামাইয়ের মধ্যে ছিল অন্যতম জামাই।অমরেশবাবুর প্রিয় জামাই ছিলেন এই মনা।
 মেয়ের বয়স যখন বছর তিনেক তখন তাদের আর একটি ছেলে হয়। তারও প্রায় বছর চারেক পরে আর একটি মেয়ে।কিন্তু ছেলে যখন পেটে তখন ভারতী আসে তার দিদির কাছে।সে তার চাকরীটা ছেড়ে দিয়েই আসে ভালো কোন চাকরির আশায়।সে যে এখানে থাকতে এসেছিল সেও কিন্তু মনোতোষের কথায়।তখন অমরেশবাবুর বয়স হয়েছে বেশ অনেকটাই।মেয়েরা সবই বড় হয়ে উঠেছে।শুধুমাত্র আজকের দিনেই যে মেয়েদের পথেঘাটে নানানভাবে হেনস্থা হতে হয় তা কিন্তু নয় আগেও এ জিনিস ছিল,এখনো আছে শুধুমাত্র কম আর বেশি।
 ভারতী চাকরি করতো একটি প্রাইমারি স্কুলে।মর্নিং স্কুল ছিলো।খুব ভোরে ট্রেন ধরে তাকে স্কুলে যেতে হত।সেও একদিন ইভটিজিংয়ের সম্মুখীন হয়।আর তখনই তার বাবু তাকে চাকরি ছেড়ে দিতে পরামর্শ দেন।সেই সময় মনোতোষ বাড়িতে ছিল এবং তার পরামর্শ মতই সে তার দিদির বাড়িতে গিয়ে ওঠে।
 সায়নীর বড় মেয়েটি গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর নিজে পছন্দ করে বিয়ে করে।তবে সায়নী এবং মনোতোষ বেশ জাকজমক করেই তাদের বিয়ে দেয়।তবে ছেলেটি তার জীবনে সেভাবে কিছুই কোনদিন করে উঠতে পারেনি।কিন্তু প্রেমটা বেশ ভালোভাবেই রপ্ত করেছিলো।তাই মেয়ের বাড়ির চাপে বিয়ে করতেও বাধ্য হয়েছিল।যেহেতু মনোতোষ ভালো চাকরি করতো আর বেশ বড়োলোকের ছেলের সাথে ছোট মেয়েটির বিয়ে হয়েছিলো আর  এক এক্সিডেন্ট এ ছোট মেয়ের শ্বশুরবাড়ির সকলেই মারা গেছিল শুধুমাত্র তাদের মেয়েটি ও নাতিটি ছাড়া।তাই এই বিপুল অর্থ ওই বেকার বাউন্ডুলে ভায়ের পিছনেও কম খরচ হয় না।
  সায়নী এবং মনোতোষের জীবনে সবচেয়ে দূর্ভাগ্য যেটা তা হল তাদের জীবনদশায় তাদের দু,দুটি মেয়ের বৈধব্য মেনে নেওয়া।জীবন সুখের বলা যেতে পারে তখনই যখন সন্তান প্রতিপালন করার পর বেঁচে থাকতে তাদের সুখী দেখা।বাবা,মায়ের সামনে নিজের সন্তান অসুখী বা দুঃখকষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকলে তাদের সেই দুঃখকষ্ট শত গুণ হয়ে নিজেদের বুকে আঘাত হানে।আর এইখানেই তাদের জীবনের চরম ব্যর্থতা নেমে আসে।সায়নী ও মনোতোষ ততদিনই সুখী জীবন কাটিয়েছেন যতদিন না তাদের ছেলেমেয়ে বড় হয়ে উঠেছে।ছেলেমেয়ে একটু একটু করে বড় হয়ে উঠেছে আর তাদের জীবনের চাহিদা,ভালোমন্দ নিয়ে সায়নী ও মনোতোষ তাদের অতিকষ্টে খুঁজে পাওয়া সুখ একটু একটু করে হারাতে শুরু করেছে।

ক্রমশঃ 
    

Saturday, October 30, 2021

জন্ম দিলেই মা হয় না

জন্ম দিলেই মা হয়না
  "ভগবান সব দিক থেকেই আমাকে মারলেন।গরীব বাপের ঘরে জন্মগ্রহণ করে প্রেম করে বিয়ে করলাম এক রিক্সাওয়ালাকে।ভেবেছিলাম রিক্সা চালিয়ে ও যা পাবে আর নিজে দু,এক বাড়ি কাজ করে ঠিক চলে যাবে।একটাই বাচ্চা নেবো তাকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মত মানুষ করবো।ঠিকই চলে যাচ্ছিলো। সোয়ামী আমার খুবই ভালো।আমায় খুব ভালোবাসে।আমাকে কোন বাড়িতে কাজে যেতে দেয় না।কিন্তু আজ তিনবছর বিয়ে হয়েছে একটা বাচ্চা-কাচ্চা না হলে ভালো লাগে?তাই আজ ওকে নিয়ে এই হাসপাতালে এসেছি ডাক্তার দেখাতে।"
  আজ বিদ্যাসাগর হাসপাতালে ভিষন ভির।সেই সকাল থেকে টিকিট কেটে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে না পেরে চঞ্চলা সিড়ির উপর এসে বসে।ওর মত আরো একজন রোগী প্রায় ওরই সমবয়সী ওর পাশে এসে বসে।সে তার মাকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে এসেছে।তার সাথেই কথা প্রসঙ্গে কথাগুলো বলছিলো চঞ্চলা।
 চঞ্চলার বাবা ভ্যানগাড়ি চালান।এক ছেলে,এক মেয়ে তার।চঞ্চলার মা সারাটাদিন লোকের বাড়ি বাড়ি কাজ করে বেড়ায়।বাবাটা যদি নেশা করে এদিক ওদিকে পরে না থাকতো তাহলে তাদের সংসারটা দুজনের রোজগারে ভালোই চলে যেত।কিন্তু নরেশ যা রোজগার করে তাই দিয়েই নেশা করে।চঞ্চলা সেভেন পর্যন্ত পড়েছে।কিন্তু পরিমলের সাথে প্রেম করে বিয়ের ভুত মাথায় চাপলো।তখনো তার আঠারো বছর বয়স হয়নি।পালিয়ে এলো।পরিমলের সাথে।বলেকয়ে আসলেও যে খুব একটা বাঁধা পেতো তা চঞ্চলার মনে হয়না।তবুও সে না বলেই বাড়ি থেকে পালিয়ে আসে।
 পরিমলের একমাত্র বিধবা পিসি।বাপ,মা কেউই নেই তার।পিসিও খুব ভালোভাবেই চঞ্চলাকে মেনে নিয়েছে।টাকা,পয়সা কম থাকলেও যে সুখী থাকা যায় তা চঞ্চলা আর পরিমলকে দেখেই বোঝা যায়।
 কিন্তু বিয়ের তিন বছরের মাথাতেও যখন চঞ্চলা মা হতে পারলো না তখন তার মন খুঁতখুঁত করতে লাগলো।সে পরিমলকে অনেক বুঝিয়ে রাজি করালো ডাক্তার দেখানোর জন্য।কিন্তু ডাক্তার দেখিয়ে চঞ্চলা আর পরিমলের মনই খারাপ হয়ে গেলো।কি একটা বড় অপারেশন করতে হবে।অপারেশন করলেই যে বাচ্চা আসবে তারও কোন নিশ্চয়তা নেই।তবুও চঞ্চলা চায় সে অপারেশনটা করবেই।তবুও তো মনে একটা আশা থাকবে।
 অপারেশন করতে কোন টাকা-পয়সা লাগবে না ঠিকই।কারণ ও তো সরকারি হাসপাতালে দেখাচ্ছে।কিন্তু তারপরে তো অনেক ওষুধপত্র খাওয়াদাওয়া আছে।তারজন্য তো টাকা দরকার।পিসি দুই বাড়ি রান্না করে যা পায় এই সংসারের পিছনেই খরচ করে।পরিমল এখন রোজ ভোর ছটায় বেরিয়ে যায় আর অনেক রাতে বাড়ি ফেরে।একটা মাটির ভার কিনে এনেছে।রোজের রোজগারের টাকাটা রাতে বাড়িতে ফিরে ওই ভারের মধ্যেই রাখে।
  একদিন রাত প্রায় একটা হতে চললো।পরিমলের দেখা নেই।পিসি আর চঞ্চলা মিলে বড় রাস্তায় চলে এসেছে।রাস্তায় কোন জনমানব নেই।মাঝে মধ্যে কিছু কুত্তা ঘেউ ঘেউ করে উঠছে।হঠাৎ দেখে পরিমল তার রিক্সাটাকে একহাতে টানতে টানতে আসছে।আর একটা হাত দিয়ে বুকের কাছে কিছু চেপে ধরে আছে।দুজনেই এগিয়ে গেলো তার দিকে।
--- ওমা এত একটা বাচ্চা গো।এখনো নাড়িটাও কাটা হয়নি।কি পাষণ্ড ওর জন্মদাত্রী গো!
 পিসি কথাগুলো বলে চলেছে আর চঞ্চলা এগিয়ে গিয়ে বাচ্চাটাকে পরিমলের কোল থেকে নিজের কোলে নিয়ে নিয়েছে।
--- ও পিসি তুমি ওর নাড়িটা কাটতে পারবে গো ?
--- আরে পারবো না কেন একটা নূতন ব্লেড ওই একটু জলে ফুটিয়ে নিয়ে কেটে দেবো।কিন্তু তুই এটাকে পালবি নাকি?আর পুলু তুই ওকে কোথায় পেলি?
--- আর বোলো না গো পিসি।ওই যে কালিতলার কাছে যে ডাস্টবিনটা আছে ওর ভিতর কে যেন ফেলে রেখে গেছে।ওর চিৎকার শুনেই তো আমি এগিয়ে গেলাম ডাস্টবিনের কাছে।
--- দেখো না গো পিসি কি সুন্দর দেখতে গো।কেউ চেয়ে পায় না আর কেউ পেয়েও হেলায় হারায়।
 চঞ্চলা পিসির উদ্দেশ্যে বললো কথাগুলো।
--- ওরে পুলিশের ঝামেলা হবে গো!
--- আরে কিচ্ছু হবে না।ওসব বড় লোকদের বেলায় হয়।আমরা হলাম গিয়ে গরীব মানুষ।বলবো আমার ছেলে।বাড়িতেই জন্মেছে।
--- আর পাড়ার লোক ?
--- ওইসব আমি ঠিক ভেবে নিয়েছি। কাল রাতের বেলা আমি মায়ের কাছে চলে যাবো।তোমাদের বলা হয়নি মাঝে একদিন মায়ের সাথে দেখা হয়েছিলো।মা আমায় বাড়ি যেতে বলেছে।মাকে সব গিয়ে বুঝিয়ে বলবো।সব ঠিক আমি ম্যানেজ করে নেবো গো পিসি।
  রাতে ঘরে চা করার যে দুধ ছিলো তাই বাচ্চাটাকে ওরা খাওয়ালো।পরিমল বললো," খুব ভোরে উঠে ভারটা ভেঙ্গে ওর জন্য কৌটোর দুধ নিয়ে আসবো আমি।হ্যারে চঞ্চলা, তুই বললি না তো আমার এই উপহারটা তোর কেমন লাগলো?
বাচ্চাটাকে বুকের সাথে চেপে ধরে চঞ্চলা বললো,
--- এতদিনে তুমি আমাকে এমন একটা উপহার দিলে যার কোনকিছুর সাথেই তুলনা চলে না গো।আমি ভীষণ খুশি। পেটে ধরিনি তাতে কি হয়েছে।ওকে মানুষ করে আমি দেখিয়ে দেবো জন্ম না দিলেও মা হওয়া যায়।


Friday, October 29, 2021

শুকনো গোলাপ

শুকনো গোলাপ
  সহপাঠী অমিতের প্রেমে পড়ে অতসী কলেজে দ্বিতীয় বর্ষের একদম শেষের দিকে পড়াকালিন।কিন্তু মুখচোরা অমিতের কাছে সে কথা জানানোর কোন সুযোগই পায় না সে।অতসীকে দেখলেই অমিত এমনভাবে সেই স্থান ত্যাগ করে যেন বাঘের মুখে পড়েছে।মাঝে মাঝে অতসীর খুব রাগ হয়।আর মনেমনে ভাবে কলেজে এত ছেলে থাকতে এই হাবলুটার প্রেমে কেন যে পড়লাম সেটাই বুঝতে পারিনা পরক্ষণে ভাবে কবিগুরুর গানের সেই লাইন," প্রেমেরই ফাঁদ পাতা ভুবনে,কে কোথায় ধরা পড়ে কে জানে -"।
 অতসী অনেকবার খেয়াল করেছে যদি কখনো সখনো অমিতের সাথে তার দেখা হয় সে সরাসরি চোখের দিকে কখনোই তাকায় না।অনেক সময় অমিত হয়তো দূরে কোথাও দাঁড়িয়ে আছে অতসীকে দূর থেকে দেখছে।অতসী বুঝতে পারে অমিতও তাকে পছন্দ করে।কিন্তু মুখচোরা হাবলু কখনোই সাহস করে তাকে ভালোবাসার কথাটা বলতে পারেনি।অতসী সাহস নিয়ে এগিয়ে গেছে ঠিকই কিন্তু কোন না কোন ছুতোয় অমিত সেই স্থান ত্যাগ করেছে।কি করবে অতসী কিছুই আর ভাবতে পারে না।ভাগ্যের হাতে সবকিছু ছেড়ে দিয়ে ওই হাবলুর কথাই ভাবে।
 অতসীর আর্টস আর অমিতের সাইন্স।শুধু বাংলা আর ইংলিশ ক্লাসটা একসাথেই হত ওদের।অতসী খেয়াল করে দেখেছে সে ক্লাসে ঢুকে যে কোন বেঞ্চেই বসুকনা কেন ওই হাবলুটা তার পিছনের বেঞ্চের দিকে বসবে।মাঝে মাঝে অতসীর মাথা গরম হয়ে যেত।
  ফাইনাল পরীক্ষা চলছে।পরীক্ষার পর কে কোথায় ছিটকে যাবে তার কোন ঠিক নেই।অতসী মেনেই নিয়েছে তার জীবনের প্রথম প্রেম অঙ্কুরেই ঝরে গেল।খুব কাছের বন্ধুদেরও কথাটা সে জানাতে পারেনি।পরীক্ষার মধ্যেই একদিন অতসী খুব তাড়াতাড়ি কলেজ গেলো।মনেমনে ভাবলো,'যা কপালে আছে হবে।যেভাবেই হোক আজকে অমিতকে তার মনের কথা বলতেই হবে।আর মাত্র দুদিন সময় হাতে আছে। কালই অতসীর পরীক্ষা শেষ।গেটের কাছে এসে দাঁড়িয়ে আছে।যেই কলেজ ক্যাম্পাসের মধ্যে ঢুকছে কেউ একটু আড়চোখে তাকে দেখছে আবার কেউ বা দুকদম তার কাছে এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইছে, "তুই কেন এখানে দাঁড়িয়ে আছিস"।উত্তর একটাই "কাজ আছে।" একদম ঘণ্টা পড়ার কিছুক্ষণ আগে অমিত আসলো।বাস থেকে নেমেই এদিক ওদিকে না তাকিয়ে ঘড়ির দিকে একবার সময়টা দেখে নিয়েই দে ছুট।মুহূর্তের মাঝে ঘটনাটা ঘটে গেলো যে অতসী তাকে ডাকার সময়ই পেলো না।তবুও মরিয়া অতসী অমিতের পিছনে কিছুটা ছুটে গিয়ে বললো,"প্লিজ অমিত আমার কথাটা শুনে যাও।" 
 অমিত দাঁড়িয়ে পড়লো।অতসীর দিকে একবার তাকিয়েই মুখটা নামিয়ে নিয়ে বললো,"এক্ষুণি ঘণ্টা পরে যাবে। কাল আমাদের পরীক্ষা শেষ।আমরা কালকে কথা বলবো।আমারও কিছু বলার আছে তোমাকে।"
 অমিত কথাগুলো বলেই চলে গেলো।অতসী যেন আজ হাফ ছেড়ে বাঁচলো।এখন শুধু অপেক্ষা কাল পরীক্ষা শেষ হওয়া পর্যন্ত।
 অতসী পরীক্ষা শেষে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।অমিত কোথায় আছে বোঝার চেষ্টা করছে।হঠাৎ অমিতের এক বন্ধু এসে বললো,"অমিত তোর জন্য কলেজের বকুলফুল গাছটার কাছে অপেক্ষা করছে।তোকে ওখানে যেতে বলেছে।অমিতের বন্ধুর মুখ থেকে এ কথাটা জানতে পেরে অতসীর বুকের ভিতরটা ধক করে উঠলো। আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলো বকুল গাছটার দিকে।অমিত সেখানে বসে আছে।অতসীকে দেখে উঠে দাঁড়ালো।এগিয়ে গিয়ে বললো," আমি জানি তুমি আমায় কি বলবে আর হয়তো তুমিও জানো আমি তোমায় কি বলবো।কিন্তু সবার আগে আমি তোমায় একটা উপহার দিতে চাই।হয়তো এই উপহারটাই তোমার এবং আমার না বলা সব প্রশ্নের উত্তর দেবে।
 অতসী হাত পেতে বললো,
--- দাও তবে।
  অমিত তার ব্যাগ থেকে একটা খাতা বের করে তার ভিতর থেকে একটা শুকিয়ে যাওয়া গোলাপ বের করে অতসীর হাতে দেয়।আর বলে,
--- তিন বছর ধরে গোলাপটা আমার ব্যাগেই থাকে।কলেজে প্রথম যেদিন তোমায় দেখেছিলাম সেদিনই ভালো লেগেছিলো।কিন্তু দুজনের পড়াশুনার কথা চিন্তা করে সব কথা বলা হয়ে ওঠেনি।আর কিছুটা লজ্জাও ছিল।আমি আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম শেষ পরীক্ষার দিন তোমায় উপহারটা দেবো।পছন্দ হয়েছে তোমার উপহারটা?
--- এই উপহারটার জন্য আমি দুবছর ধরে অপেক্ষা করছি।
--- আর আমি তিন বছর ধরে প্রতি মুহূর্তে সঠিক সময়ে তোমায় উপহারটা দেবো বলে বহন করে চলেছি।আজ আমি উপহারটা দিতে পেরে ভার মুক্ত হলাম।



 

Thursday, October 28, 2021

জীবনের প্রতি বাঁকে (অষ্টম পর্ব)

জীবনের প্রতি বাঁকে (অষ্টম পর্ব)
   সংসারের নানান ঘাত_প্রতিঘাত ঘরে বাইরের নানান সমস্যায় জর্জরিত থাকলেও মানুষটি অর্থাৎ অমরেশবাবু সর্বদায় থাকতেন ধীর,স্থির।কেউ কোনদিন রেগে গিয়ে তাকে কোন কটু কথা বলতে দেখেনি। একমাত্র তার মনটা খারাপ থাকতো তিনি যেদিন কোন কেসে হেরে যেতেন।দুবেলা আহ্নিক অর্থাৎ সন্ধ্যা করা,একবেলা ভাত খাওয়া বা অন্ন গ্রহণ করা নিষ্ঠাবান একজন ব্রাহ্মণ।তিনি খড়ম পরে সিমেন্টের উপর থেকে হাঁটাচলা করলেও কোন শব্দ হত না।পাড়ার অনেকেই তাকে শিবঠাকুর বলতেন। আরও বলতেন "এই মানুষটা মাটির উপর দিয়ে এমনভাবে হাঁটেন যাতে মাটিও ব্যথা না পায়।"
  অমরেশবাবুর একমাত্র বোন বীণাপাণি।বেশ অবস্থাপন্ন ঘরে মা বেঁচে থাকতেই বিয়ে দিয়েছিলেন প্রহ্লাদ মুখার্জীর সাথে।খুব সুখী হয়েছিলেন তবে সে সুখ স্থায়ী হয়েছিলো মাত্র তিন বছর।দুবছরের মাথায় বীণাপাণিদেবীর একটি পুত্রসন্তান হয়।কিন্তু আঠারো দিনের মাথায় পুত্রটি আতুর ঘরেই মারা যায়।তারপর তার আর কোন সন্তান হয়না।এইভাবে বিয়ের পর সাত বছর কেটে যায়।একই ঘর একই বিছানা হলেও স্বামীর সাথে সম্পর্ক নেই বললেই হয়।অনেকবার অমরেশবাবু তার বোনকে বলেছিলেন,"শ্বশুরবাড়ির পাঠ চুকিয়ে তুই আমাদের কাছে চলে আয়।" কিন্তু তার বোন রাজি হননি।তিনি তার শ্বশুরের ভিটে ছেড়ে কোনদিনও এসে তার ভায়ের গলগ্রহ হতে চাননি।বিয়ের সাত বছরের মাথায় প্রহ্লাদবাবু পুনরায় বিয়ের তোড়জোড় করতে শুরু করেন।বিশাল সম্পত্তি দেখভালের জন্য তার উত্তরাধিকার চায়।বীণাপাণিদেবীর শ্বশুর,শ্বাশুড়ী তাদের একমাত্র ছেলের বউকে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন।তারা এ বিয়ের বিরোধীতা করেন।ঝামেলা মারত্মক আকার নেয়। প্রহ্লাদবাবু দুরাত বাড়ি ফেরেন না।শ্বশুর,শ্বাশুড়ির উদ্বিগ্নতা দেখে বীণাপাণিদেবী তাদের হাতে পায়ে ধরে রাজি করান এই মর্মে তাদের ছেলে বিয়ে করলে তার কোন আপত্তি নেই।তিনি সতীন নিয়েই ঘর করতে রাজি আছেন।
 চারিদিকে লোক পাঠিয়ে ছেলেকে খুঁজে আনা হল।অনিচ্ছা সত্বেও তারা তাদের ছেলের পুনরায় বিয়েতে মত দিলেন।কিন্তু পরিষ্কার করে জানিয়ে দিলেন, "বৌমা ওই ঘরেই থাকবে সে যেন একটি নূতন ঘর তৈরি করে নেয়।"এ কথায় বাঁধ সাধলেন স্বয়ং বীণাপাণিদেবী নিজেই।তিনি তার শ্বশুরকে জানালেন,"বড় হওয়ার পর থেকেই তিনি অর্থাৎ তার স্বামী ওই ঘরেই থেকে অভ্যস্ত।তিনি কেন ঘর ছাড়বেন? আমিই ওই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসবো।আপনি বরং আমার জন্য একটি ঘর তৈরি করে দিন।যে মেয়ে তার স্বামীকে ধরে রাখতে পারেনি,তাকে পিতৃত্বের স্বাদ দিতে পারেনি সে ঘর আটকে রেখে জীবনে কোন সুখ খুঁজে পাবে?"
  বিয়ের আগেই ঘর তৈরি হল।পুনরায় অমরেশবাবু তার বোনকে আনতে গেলেন।কিন্তু এবারেও তাকে খালি হাতেই ফিরে আসতে হল।শ্বশুরবাড়ির ভিটে ছেড়ে বিয়েদারি হয়ে তিনি কোন অবস্থাতেই বাপের ভিটেই ভায়ের সংসারে আসবেন না।
  মন্দিরে সিঁদুর পরিয়ে বাপ মা মরা নমিতাকে বউ করে প্রহ্লাদ মুখার্জী বাড়ি নিয়ে এলেন।কিন্তু বউ নিয়ে বাড়ি এসে দেখেন পুরো বাড়ি অন্ধকার।বেশ কয়েকবার "মা,মা" বলে চিৎকার করে ডেকেও কোন সাড়া পেলেন না।হঠাৎ দেখেন বীণাপাণিদেবী একহাতে হারিকেন আর এক হাতে বরণডালা নিয়ে বাড়ির সদর দরজার কাছে হাজির হলেন।একাই উলু দিতে নূতন বউকে বরণ করলেন।জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে কিছুক্ষণ ইতস্তত করার পর হাসিমুখে নিজের হাতের সোনার নোয়া বাঁধানোটা খুলে নূতন বউকে বরণ করে ঘরে নিয়ে এলেন।সেই ঘরে যে ঘরে তিনি নূতন বউ হয়ে ঢুকেছিলেন।নূতন বউকে নিজের ঘরে নিজের বাবার দেওয়া খাটে বসিয়ে সেই ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন নিজের বালিশ আর একটা টিনের বড় বাক্স নিয়ে।আগেই নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলি তিনি ওই টিনের বাক্সে ভরে রেখেছিলেন।আজীবন তিনি আর ওই ঘরে ঢোকেননি।
  প্রহ্লাদবাবুর বাবা,মা পরদিন থেকে ছেলের সাথে কথা বলা বন্ধ করলেন।শ্বাশুড়ী দুই বউয়ের মাঝে কাজ ভাগ করে দিলেন।নমিতাদেবির ভাগে পড়লো রান্নাবান্না,বাড়ির সবাইকে খেতে দেওয়া।আর বাকি সবকিছুর তদারকি,শ্বশুর শ্বাশুড়ির দেখভাল আত্মীয়-স্বজনের সাথে লোক লৌকিকতা সবকিছুর ভার বড় বউয়ের।ঝামেলা ছাড়াই সংসারে দুই বউ নিজেদের মত করেই দিনাতিপাত করছিলো।বড় বউয়ের গুনে ছোট বউ তার সতীনকে নিজের দিদির আসনেই বসিয়েছিল।কিন্তু বীণাপাণিদেবী আমৃত্যু একই বাড়িতে থেকেও স্বামীর সাথে কোন সম্পর্কই রাখেননি এমনকি কোন কথাও বলতেন না।
 সবই ঠিকই চলছিলো।কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো বিয়ের চার বছরের মাথাতেও যখন নমিতাদেবী কোন সন্তান ধারণ করতে পারলেন না।তখনকার দিনে চিকিৎসা শাস্ত্রের এত উন্নতি না থাকলেও বীণাপাণিদেবীর স্বামীর বিয়ের পূর্বে তার ভাই তাকে ডক্টর দেখিয়েছিলেন।কিন্তু ডক্টরের কথা অনুযায়ী তার কোনোই সমস্যা ছিলনা।ডাক্তার পরিস্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন তার (ডাক্তারের) যতদূর মনে হচ্ছে উনার স্বামীরই কোন দোষ আছে।কথাটা বাড়িতে জানানো হলে তারা হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন আর বলেছিলেন,"সন্তান ধারণে পুরুষের কোন অক্ষমতা থাকে না।আর সেটা তিনি বিয়ে করেই প্রমাণ করে দেবেন।"
 বিশাল সম্পত্তি অথচ ভোগ করবার জন্য কোন উত্তরাধিকার এলো না।তাহলে সম্পত্তি এবার ভাগ বাটোয়ারা করে দিতে হবে দুই বউ আর ছেলের মধ্যে।নমিতাদেবীর কেউ নেই সুতরাং তিনি মারা গেলেও এই সম্পত্তি থাকবে প্রহ্লাদবাবুর হেফাজতেই।কেউ তো আর নিজের মৃত্যু আগে হতে পারে এটা কোনদিন ভাবে না।তিনিও ভাবেননি।কিন্তু বীণাপাণিদেবীকে সম্পত্তি দিলে তার অবর্তমানে সেই সম্পত্তির অধিকারী হবে তার ভাইপো। প্রহ্লাদবাবু কিছুতেই চান না তার বড় বউকে কোন সম্পত্তি দেওয়া হোক।তার বাবা,মা এ কথা জানতে পেরে ছেলেকে জানালেন সম্পত্তি ভাগ-বাটোয়ারার ব্যাপারে সে যদি কোন নাক গলায় তাহলে সমস্ত সম্পত্তি  বড় বউয়ের নামেই তারা করে দেবেন।সংসারে তখন আবার আগুন জ্বলতে লাগলো।আর ঠিক এই সময়ে বীণাপাণিদেবী বেড়াতে এসেছিলেন তার ভাইয়ের বাড়িতে।তিনি বাড়ি ফিরে সব জানতে পেরে তার শ্বশুরকে অনুরোধ করেন তাকে যেন কোন সম্পত্তি না দেওয়া হয়।আর এও বলেন তার ভায়ের যে সম্পত্তি আছে তার হয়তো অর্ধেক আপনাদের আছে।আমার ভাইপো কোনদিনও এই সম্পত্তির ভাগ নিতে আসবে না।আপনার ছেলের যখন এতই ভয় আপনি আমাকে আপনাদের সমস্ত সম্পত্তি থেকে রেহাই দিন।আর কতদিনই বা বাঁচবো।এই সম্পত্তি,বাড়ি,ঘর কোনকিছুর প্রতিই আমার কোন লোভ নেই।শুধু এইটুকু অধিকার আমাকে দিয়ে যান আমি যে কটাদিন বাঁচবো যেন এই বাড়িতেই থাকতে পারি।কোনদিন যেন আমাকে আমার ভায়ের বাড়িতে গিয়ে উঠতে না হয়।
 নারী জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ তার স্বামী।তাই যখন আমি অন্যের হাতে তুলে দিতে পেরেছি আমার আর কোন কিছুতেই কোন লোভ নেই।
  বিনাপানিদেবী স্বামীর পরিবারেরই এক আত্মীয়ের একটি মেয়েকে খুব ভালোবাসতেন।নামটি ছিল তার গীতা।শ্বশুর শ্বাশুড়ির মৃত্যুর পর বেশ কয়েক বছর বাদে তার মৃত্যু হয়।তিনি তার পালিত কন্যা গীতাকেই বলে গেছিলেন তার মৃত্যুর সময় মুখে জল দিতে ও তার শ্রাদ্ধ করতে।গীতা সে কথা অতি নিষ্ঠাভরে পালন করেছিল।
 বিনাপানীদেবী তার মানসিক অসীম শক্তি বলে নিজের শত দুঃখ,কষ্ট বুকে চেপে রেখে স্বামীর সাথে সংসার করতে না পারলেও শ্বশুরের ভিটেতেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন।আজ থেকে বেশ কয়েক যুগ আগে পিছিয়ে গিয়ে বলতেই পারি " আদর্শ ভারতীয় বাঙ্গালী নারী।"

ক্রমশঃ 

Wednesday, October 27, 2021

জীবনের প্রতি বাঁকে (সপ্তম পর্ব)

জীবনের প্রতি বাঁকে (সপ্তম পর্ব)
   সায়নী তার বাবুর কাছে চিঠিটা নিয়ে যায়।কিন্তু তিনি মেয়ের চিঠি পড়তে অস্বীকার করেন।সায়নী তখন পুরো ঘটনাটা তার বাবাকে খুলে বলে।চিঠিটা তার নামে আসলেও আদতে চিঠিটা দিপালী নামে অন্য কোন মেয়েকে লেখা।মেয়ের কথা শুনে তিনি কিছুটা সময় দম মেরে বসে থাকেন।ঝানু উকিলবাবুর বুঝতে একটুও সময় নিলো না যে মনোতোষ দুই দুটি মেয়েকে বেশ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েই একসাথে নাচিয়ে গেছে,এবং এখনো সেটা চালিয়ে যাচ্ছে।চিঠির ভাষাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যেহেতু দিপালী মেয়েটি কায়স্থ আর এই কারণেই ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে মনতোষের বাবা,মায়ের আপত্তির কারণেই সে দিপালীকে বিয়ে করতে পারেনি।আর এদিকে বাবা,মা তার বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগায় এবং তারা অমরেন্দ্রনাথ বাবুর মেয়েটি পছন্দ করায় সে বাধ্য হয়ে বিয়েতে মত দেয়।আর আশীর্বাদের দিন সে তার মোক্ষম চালটি মারে।সে স্বপ্নেও ভাবেনি শেষমেষ অমরেশবাবু রাজি হবেন।কিন্তু ভালো মানুষের মুখোশটা যাতে না খুলে যায় তারজন্য অমরেন্দ্রনাথ বাবুর সাথে ওই আলাপচারিতা করেছিলো।আর এখন একইভাবে একই জায়গায় বসে সায়নী আর দিপালী দুজনকে চিঠি লিখে আগেই খামের উপর ঠিকানা রেডি করে যখন চিঠি দুটি খামে ভরতে যায় তখনই সে তার অন্যমনস্কতায় একের চিঠি অন্যের ঠিকানা লেখা খামে ভরে ফেলে।এইরূপ একটি ছেলের সাথে তিনি কি করে তার সানুর বিয়ে দিলেন সেটাই এখন বুঝে উঠতে পারছেন না।
  এখনকার দিনের মত তখনকার দিনে ডিভোর্স কথাটা এত সহজে উচ্চারিতই হত না।সমাজ এটাকে ভালো চোখে দেখতো না।যদিও সমাজের তোয়াক্কা তিনি কোনদিনই করেননি তবুও তার স্ত্রী এটা যে কিছুতেই মেনে নেবেন না এটা তিনি ভাবেই জানতেন।তিনি তার মেঝমেয়েকে গ্রামের বাড়ি তার মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিলেন।আর এই সমুহ বিপদের ব্যাপারে তিনি নানান চিন্তাভাবনা করতে লাগলেন কিভাবে এর মোকাবেলা করবেন।
  এদিকে ভারতী গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেই স্কুলেএকটা চাকরি পেয়ে গেলো কিন্তু বাড়ি থেকে অনেকটাই দূরত্বে।মালতীর তখন ক্লাস টেন।বাড়িতে তখন পাড়ারই অবস্থাপন্ন চ্যাটার্জী পরিবারের একটি ছেলে আসতো নাম যার দেবদাস চ্যাটার্জী।না পাঠক এ দেবদাস কথাশিল্পীর দেবদাস নয়।মনেমনে সে মালতীকে ভালোবাসলেও কোনদিন তার প্রকাশ ছিলো না। মালতী মাধ্যমিক পাশ করে শহরে চলে আসে।অমরেশবাবুর প্রতিটা মেয়েই গ্রামের থেকে পাশ করে শহরে এসে কলেজে ভর্তি হয়।এদের মধ্যে ব্যতিক্রম শুধুমাত্র তার ছোট মেয়ে ও একমাত্র ছেলেটি।একটি ছেলে সন্তানের আশায় পরপর ন'টি মেয়ে।ছেলের জন্মের সময়ও সকলেই ভেবেছিলেন এবারেও বুঝি মেয়েই হবে।তাই বাড়ির সকলেরই মন খুবই খারাপ ছিল।এর আগে অবশ্য একটি ছেলে হয়েছিলো।কিন্তু পাঁচ বছর বয়সে ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় তার মৃত্যু হয়।তখন বাড়ির প্রত্যেকেই শোকে প্রায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিলেন।
 যাহোক সকলের শেষে যখন পুনরায় একটি পুত্রসন্তান হল তখন রায় চৌধুরী বাড়িতে আনন্দের হাট।কিন্তু তার মুখেভাত দেওয়া হল গোবিন্দ মন্দিরে।আগের পুত্রটির মুখেভাতে দু থেকে তিন গ্রামের লোকজনকে ভুরিভোজ করানো হয়েছিল।কিন্তু তার অসময়ে চলে যাওয়ার ফলে রায় চৌধুরী বাড়ি থেকেই মুখেভাতে আয়োজন উঠেই গেলো।তখন অবশ্য রঙ্গিলিবালাদেবি বেঁচে ছিলেন।তিনিই এ নিয়মটি চালু করেছিলেন।আর মেয়েদের কখনোই জাকজমোক করে মুখেভাত হয়নি।তার বক্তব্য ছিল মেয়েদের জন্মদিন,মুখেভাতে আড়ম্বর করলে বিবাহিত জীবনে সে মেয়ে সুখী হয়না।
 আসলে তখনকার দিনে প্রতি পদেপদে সংসারে মেয়েদের নানানভাবে বঞ্চিত করা হত।আজও অনেক সংসারে এ ধারা অব্যহত রয়েই গেছে।তবে আগের তুলনায় অনেক কম।
  যাহোক মালতী মাধ্যমিক পাশ করে শহরে এসে যখন ভর্তি হল তখন অমরেশবাবুর এক মুহুরীর (এখন অবশ্য মুহুরী কেউ বলে না তাকে অ্যাসিস্টেন্ট বলে থাকে।কিন্তু তখনকার দিনে মুহুরীই বলা হত) বড় ছেলে প্রায়ই তার বাবার খাবার নিয়ে অফিস টাইমে অমরেশবাবুর বাড়িতে আসতো।খুব সকালে তিনি টিফিন করেই অমরেশবাবুর বাড়িতে এসে তার চেম্বার খুলে বসতেন।অমরেশবাবু যখন অফিস যেতেন তখন তার সাথেই মুহুরী অমল পাল একই সাথে কোর্টে যেতেন।এই অমল পালের ছেলে অভয়ানন্দের প্রেমে পড়ে মালতী।
 দেবদাস চ্যাটার্জীর মালতীর প্রতি ভালোবাসাটা ছিল এক তরফা।শান্তিদেবী ব্যাপারটা জানতেন।কিন্তু সাহস করে কোনদিন স্বামীকে বলে উঠতে পারেননি।তার পছন্দের সব চেয়ে বড় কারন ছিল যেটা অবস্থাপন্ন বামুন ঘরের ছেলে।কিন্তু এদিকে অমরেশবাবু ছেলেটিকে তার নরম স্বভাবের জন্য ভালোবাসলেও এই বেকার ছেলেটির সাথে তার মেয়ের সম্মন্ধ হলে মেনে নিতেন না।অপরদিকে অমল পালের ছেলেটিকে তার খুবই ভালো লাগতো।কিন্তু তখনো পর্যন্ত তিনি তাকে জামাই করার স্বপ্ন দেখে পারেননি।
 অভয়ানন্দ আস্তে আস্তে রায় চৌধুরী বাড়ির ছেলের মতোই হয়ে উঠতে লাগলো।কারণে,অকারণে,প্রয়োজনে,অপ্রয়োজনে সে এ বাড়িতে নিত্য দুবেলা যাতায়াত করতে লাগলো।এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন আর সেটা হল অমরেশবাবু শহরে জমি কিনে মাথা গোঁজার মত ঠাঁই ততদিনে করে ফেলেছেন।কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই এই জমি সংক্রান্ত বিষয়ে তিনি এক মস্তবড় সমস্যায় পড়েন।জমির মালিক এই একই জমি দুজনের কাছে বিক্রি করেন।আইনের পথ ধরে প্রথম বিক্রয় যার কাছে হয়েছিল সেই হিসাবে তিনি এ জমির অধিকার পেয়ে যান।কিন্তু এই প্রথম তার শত্রু জন্ম নিল এই বিষয়কে কেন্দ্র করে।
  মনোতোষের খোঁজ খবর নিয়ে তিনি তার সায়নীকে মনোতোষের কাছে পাঠিয়ে দিলেন।এর আগে অবশ্য প্রথমে টেলিগ্রাম তারপর চিঠির মাধ্যমে তার সাথে কথা বলে তিনি মেয়েকে একজন পরিচিত মানুষের সাথে তার কাছে পাঠিয়ে দেন।মনোতোষ তখনো ফ্যামিলি কোয়ার্টার সেখানে পায়নি।তাই ওখানে থাকতে থাকতে আত্মীয়ের মত হয়ে যাওয়া এক পরিবারে সায়নীর আশ্রয় হয়।মাঝে মধ্যে মনোতোষ সেখানে আসে আর চেষ্টা করছে নাকি কোয়ার্টার পাওয়ার।এখানেও সেই একই জিনিষ সায়নীর কপালে ঝুঠলো।দিনরাত বাড়ির কাজের মেয়ের মত পরিশ্রম।এবার আর সে তার বাবুকে কিছু না জানিয়ে নিজেই সবকিছু ঠিক করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়।একদিন মনোতোষ আসলে সে সরাসরি জানায় কোয়ার্টার যেহেতু সে পাচ্ছে না তাকে যেন সাতদিনের মধ্যে ঘরভাড়া করে মনতোষ এখান থেকে নিয়ে যায়।অন্যথায় এখনকার সমস্ত ঘটনা সে তার বাবুকে জানাবে।আর এবার যদি সে সংসার করতে না পারে তাহলে তার যতদূর মনেহয় বাবু মনোতোষকে এত সহজে ছাড়বেন না।সরকারি চাকরি করা মানুষ কিভাবে তার বিবাহিত স্ত্রীর উপর অন্যায় অত্যাচার করতে পারে আর এটা করলে কি কি একশন নেওয়া যায় তাও মনোতোষকে সায়নী স্মরণ করিয়ে দেয়।
 মনোতোষ ঠিক পনেরদিনের মধ্যেই তাকে ঘরভাড়া করে নিজের কাছে নিয়ে যায়।কিন্তু মনোতোষের কাছে গিয়েই যে সে সুখী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে তা কিন্তু নয়।সায়নীর জীবনে সুখ এসেছে বেশ কয়েক বছর পরে।তারজন্য তাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে।অনেক অপমান,লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছে।কিন্তু পরবর্তীতে সে তার জীবনের কোন দুঃখের কথায় তার বাবু মা মায়ের সাথে কোনদিন শেয়ার করেনি।

ক্রমশঃ 

Monday, October 25, 2021

অপেক্ষার আত্মতৃপ্তি

অপেক্ষার আত্মতৃপ্তি
  রোজের মত আজও দুপুরের দিকে একটা খাবারের প্যাকেট আসলো।যুথিকাদেবী মনেমনে বললেন,' আজও মায়ের সাথে দেখা না করে চলে গেলি বাবু?' বলেই তিনি খাবারের প্যাকেটটা খুলে খেতে শুরু করলেন।ভাতের উপর টপটপ করে চোখের জল পড়ছে আর বিড়বিড় করে নিজের মনেই বলে চলেছেন,' রোজ রোজ খাবার না পাঠিয়ে যদি একবার এসে দেখা করতিস সোনা তাহলে তোর এই অভাগা মা সবচেয়ে বেশি খুশি হত।'
  বছর খানেক আগে দুপুরের দিকে দেবেশ যখন অফিসে তখন যুথিকাদেবীএকমাত্র ছেলের বউয়ের কুকীর্তি দেখে ফেলেন।এই সময়ে সাধারণত তিনি ঘরের বাইরে আসেন না।কিন্তু সেদিন জলের জগে জল না থাকার দরুন ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে যেতে গিয়ে হঠাৎ বৌমার ঘর থেকে হাসির আওয়াজ শুনে ভেবেছিলেন তার বাবু ওরফে দেবেশ বুঝি অফিস থেকে ফিরে এসেছে এই অসময়ে।তাই তিনি দরজার কাছে দাঁড়িয়েই 'বাবু বাবু' বলে বেশ কয়েকটা ডাক দেন।ভিতর থেকে তখন কথা ও হাসির আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়।তখন তিনি 'বৌমা বৌমা' বলে অনেক ডাকাডাকির পর ভিতর থেকে তার আদরের বৌমা অভিনয়ের মত ঘুম জড়ানো গলায় চেঁচিয়ে বলে ওঠে,"আমি ঘুমাচ্ছি এখন।পড়ে শুনবো আপনার কথা।"
 বৃদ্ধা আর কথা না বাড়িয়ে নিজের ঘরে চলে আসেন।কিন্তু মনটা তার খুঁতখুঁত করতেই লাগে।তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেটের কাছে পাঁচিলের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রেখে অপেক্ষা করতে থাকেন।কিছুক্ষণ পর তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে একটি ছেলে।সে গেট থেকে বেরিয়ে গেলে যূথিকাদেবী বৌমার মুখোমুখি হন।দু এক কথায় ঝামেলা প্রচন্ড শুরু হয়।'বাবু আসলে তাকে সব জানিয়ে দেবো'- এটাই ছিল তার মস্তবড় ভুল যা তিনি তার বৌমাকে বলেছিলেন।
 শীলা ঘরে ঢুকেই তার স্বামীকে ফোন করে প্রচণ্ড কান্নাকাটি করতে থাকে যে দেবেশের মা খামোখা তাকে উল্টোপাল্টা কথা বলেছেন।শীলা এতই কাদঁছিলো সব কথা দেবেশ ভালোভাবে বুঝতেও পারছিল না।তাই তাকে বলেছিলো ,"বাড়িতে গিয়ে সব শুনবো" বাড়িতে এসে যা শুনেছিল তা হল দুপুরের খাবার দিতে দেরি হওয়ায় শ্বাশুড়ী খাবারের থালা তার গায়ের উপর ছুড়ে মেরেছেন আর অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেছেন।দেবেশ মায়ের কাছে ঘটনার বিবরণ শোনার কোনো প্রয়োজনীয়তা মনে করেনি।তার মা তাকে সেদিনের কোন ঘটনায় জানিয়েছিল না।তার উদ্দেশ্য ছিল বৌমাকে ভয় দেখিয়ে সোজা পথে আনা।
 দেবেশ এই ঘটনার দুদিন পড়ে মাকে নিয়ে মাসীর বাড়ি যাবে বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে স্টেশনে মাকে বসিয়ে রেখে টিকিট কাটতে যাচ্ছি বলে সেই যে গেল আর ফিরে আসেনি।অনাহারেই বৃদ্ধার দিন কাটতো।কিন্তু রেলে কর্মরত একজন সহৃদয় ব্যক্তি দিনের পর দিন একজন বৃদ্ধাকে একই জায়গায় বসে থাকতে দেখে তার কাছে গিয়ে সব কথা জানতে পারেন।তিনিই নিত্য যুথিকাদেবীর খাবারের ব্যবস্থা করেন।প্রথম প্রথম নিজেই  খাবার বৃদ্ধার সামনে এনে দিতেন।এখন অবশ্য কোন লোক মারফৎ পাঠিয়ে দেন।কারণ প্রথমদিন খাবারের প্যাকেট দেখে বলেছিলেন, "আমার বাবু পাঠালো বুঝি?"আর তিনিও 'হ্যাঁ' বলেছিলেন।শত আঘাত পাওয়া এক মাকে আর আঘাতে জর্জরিত করতে চাননি।আর কটাদিনই বা বাঁচবেন।বাকি জীবনটা ছেলের অপেক্ষাতে নিজ ছেলের পাঠানো অন্ন মনে করে আত্মতৃপ্তিটা নিয়েই থাকুন।

Sunday, October 24, 2021

যদি ফিরে আসে

যদি ফিরে আসে

  বহুদিন পর বাড়ির ছেলে বাড়ি আসছে।আজ প্রায় বছর আট হল সেই যে অসিত বিয়ের দুবছরের মাথায় চাকরির সুবাদে কানাডা চলে যায় তারপর আর বাড়িতে আসেনি।প্রতিবারই বলে পুজোর সময় বাড়ি আসবে কিন্তু শেষ মুহূর্তে জানায় আসতে পারবে না।অফিস ছুটি দিচ্ছে না।
  কলকাতায় একটি বিদেশি কোম্পানির উচুঁ পোষ্টে চাকরি করতো অসিত পাল।মায়ের ছেলেবেলার বন্ধুর মেয়েকে মা নিজেই পছন্দ করে পাকা কথা দিয়ে তারপর ছেলেকে জানান।ছেলেও না বলতে পারেনি মায়ের মুখের উপর। অসিতের মনে হয়েছিল এতে মা মনে খুব আঘাত পাবেন।বাবার মৃত্যুর পর অনেক কষ্ট করেই অসিতকে তার মা মানুষ করেছেন।লোকের বাড়িতে রান্নাও করেছেন একসময়।আজ তিনি একটু সুখের মুখ দেখেছেন।তাই হয়ত মায়ের মুখের উপর না করতে পারেনি।কিন্তু মন থেকেও বিদিপ্তাকেও মেনে নিতে পারেনি।বিয়ের পর থেকেই একটা ভালোমানুষের মুখোশ পরে মা আর বউয়ের সাথে দুটো বছর কাটিয়েছে।আর তলে তলে চেষ্টা চালিয়ে গেছে বাইরে চলে যাওয়ার।যা মা বা বউ কেউই ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি।অসিত যখন বাইরে চলে যায় তখন বিদিপ্তা পাঁচ মাসের প্রেগন্যান্ট।সুন্দর ফুটফুটে ছেলেটি হওয়ার পরেও সে দেশে ফেরেনি।সব সময়ের জন্যই সে অফিসের দোহাই দিয়েই দেশে না আসা করেছে।মাস গেলে ঠিক খরচের টাকাটা মায়ের অ্যাকাউন্টে  সময়মত পাঠিয়ে দেয়।সপ্তাহে দু থেকে তিনবার ফোনও করে।মাঝে মধ্যে তার অফিস টাইমে ভিডিও কল করেও সকলের সাথে কথা বলে।
 মায়ের পছন্দ করা মেয়েকে মেনে নিতে না পেরেও নিজের অমতে সেই মেয়েকে মায়ের মন রাখতে বাধ্য হয়ে বিয়ে করে শত চেষ্টা করে বিদেশের মাটিতে পারি দেয় নিজের মনে ক্ষোভ নিয়ে - ' মায়ের পছন্দ করা মেয়ে নিয়ে মা নিজেই সংসার করুন,ওই স্বল্প শিক্ষিত মেয়েটাকে আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারবো না।মা একবারও আমার কাছে কিছুই জানতে চাইলেন না?এবার তো তাকে দেখার লোক এসেই গেছে আমি আমার নিজের মত করেই জীবনটা কাটাবো অথচ কিছুই কেউ বুঝতে পারবে না।"
 কানাডা পৌঁছানোর দুবছরের মাথায় একই অফিসে কর্মরত প্রবাসী সুনীল বোসের নজরে আসে সে।সুনিলবাবু তাকে নিজের বাড়িতে প্রায়ই নিমন্ত্রণ করতেন এই কারণেই অসিতকে তার বড় মেয়েটির সাথে বিয়ে দিয়ে বড় জামাই করার এক অদম্য ইচ্ছায়।অসিত অজান্তেই তার ফেলা টোপটা গিলে ফেলে।দুবছরের মাথায় পায়েলের সাথে তার বিয়ে হয়ে যায়।সে সুনীল বোসকে জানিয়েছিল দেশে তার নিজের বলতে কেউই নেই।কোনদিন দেশে ফেরার ইচ্ছাও নেই।
 সকাল থেকেই বিদিপ্তা আর তার শ্বাশুড়ী অসিতের প্রিয় খাবারগুলো করতে ব্যস্ত।সাত বছরের অয়ন বারবার মা,ঠাকুমার কাছে জানতে ছুটে আসছে "বাবার আর কত দেরি হবে আসতে?বাবা কখন আসবে?" আর মাঝে মাঝেই ছুটে চলে যাচ্ছে ঘরে বড় করে বাঁধানো বাবা,মায়ের ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে।
  আজও অয়ন মাঝে মধ্যেই বাবা,মায়ের ছবিটার দিকে তাকিয়ে ভাবে বাবা কেন এমন করলেন আমাদের সাথে?এখন তার বয়স আঠারো বছর।মায়ের লাল সিঁথিটার দিকে তাকিয়ে মনে আসা সব প্রশ্নের উত্তর নিজেই খোঁজার চেষ্টা করে।ঠাকুমা মৃত্যুর সময় বারবার করে বাবার কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন আজও চোখ বুঝলে অয়ন দেখতে পায় - অত কষ্টের মাঝেও মায়ের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন,"ওকে ক্ষমা করে দিও বৌমা।একদিন না একদিন ও ঠিক ফিরে আসবে তোমার কাছে।"
 বলাবাহুল্য অসিত সেদিন আসেনি শুধু না ; সেদিনের পর থেকে বিদিপ্তাদের সাথে সম্পর্কও ছিন্ন করেছে।
 
 বিদিপ্তা আজও একমাথা সিঁদুর নিয়ে অসিতের অপেক্ষায় যদি সে ফিরে আসে।


 

সব স্বপ্ন পূরণ হয় না

সব স্বপ্ন পূরণ হয় না
"এমনই ভারী বর্ষার দিন ছিল সেটা,কত স্বপ্ন ছিল মনে...কিন্তু মুহূর্তের মাঝে সব স্বপ্ন ঝড়ের সাথে সাথে উড়ে গেলো।কোনদিন ভাবতেই পারিনি আমার জীবনে এরূপ একটি অঘটন ঘটতে চলেছে।"
  প্রথম যেদিন কুশলের সাথে আমার পরিচয় সেদিন পুরো কলকাতা শহর ছিল জলের তলায়।প্রায় দুঘন্টা ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলাম কলেজ স্ট্রিটের একটি দোকানের সেডের নিচে।ভিজে পুরো চুপসে গেছিলাম।শুধু আমিই নই ওখানে যারা যারা দাঁড়িয়ে ছিল তারা প্রত্যেকেই।বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতই যেন হঠাৎ করে আসা এই মুসলধারে বৃষ্টি।ট্যাক্সি,উবের সব বন্ধ।দু একটি বাস যা চলছে তাতে পা দানিতেও পা রাখার জায়গা নেই।একে একে সেডের এবং আশেপাশের সমস্ত দোকানগুলোর জমায়েত জায়গাগুলি ফাঁকা হতে লাগলো।আমার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল কুশল।তখনো আমি অবশ্য ওর নামটা জানতাম না।হঠাৎ অপরিচিত ছেলেটি আমার কাছে এগিয়ে এসে বলল,
-- আপনি তো একেবারেই ভিজে গেছেন।কফি হাউজের ভিতর গিয়ে শাড়ীটা একটু নিংড়ে নিন।আর যদি আপত্তি না থাকে চলুন দুজনে এক কাপ করে কফি খেয়ে নিই।
 মনেমনে ভাবলাম লোকালয়ে অযাচিতভাবে এভাবে আমার ভালো চাওয়া মানুষটি খুব একটা খারাপ হবে না।রাজি হয়ে গেলাম।সেদিন কথায় কথায় অনেক কথাই জানলাম আর বললাম। ব্যাংকে চাকরি করেন,বাবা নেই - মা আর সে।সেই শুরু।প্রথমে ফোনে তারপর সপ্তাহে দু একদিন দেখা করা।বেশ চলছিলো।একদিন ওর বাড়িতে নিয়ে গেলো ওর মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য।তিনিও খুব ভালো মানুষ।দুবাড়িতেই আমাদের সম্পর্কটা মেনে নিল।
  হঠাৎ করেই হল ওর মাতৃবিয়োগ। ফোনে আমাকে জানিয়ে ছোট শিশুর মত ভীষণ কান্নাকাটি করতে লাগলো।আমার বাবা সবকিছু জেনে আমায় নিয়ে ওদের বাড়িতে গেলেন।আত্মীয়স্বজন বলতে এক বিধবা মামী আর তার বিয়েদারি মেয়ে।তারাও আমাকে মুহূর্তের মাঝে আপন করে নিলেন।দেখতে দেখতে এক বছর কেটে গেলো।
  বিয়ের দিন ঠিক হল।বিয়ের দিন সকালে আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবশী ভর্তি বাড়ি।সকলেই হৈ হট্টগোলে সামিল।সেদিন সকাল থেকেই ছিল আকাশের মুখ ভার।চারিদিক এমনভাবে অন্ধকার করে নিয়ে এসেছিল বাইরের দিকে তাকালে মনে হচ্ছিল যেন চারিদিকে কেউ কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দিয়েছে।ওদের বাড়ি থেকে হলুদ নিয়ে এসে পৌঁছাল প্রায় সন্ধ্যার দিকে।হুগলি থেকে কলকাতার এই দূরত্ব - কিভাবে বরের গাড়ি আসবে এটা নিয়েই আমার বাবা,মা আত্মীয়দের চিন্তা।সেদিন দুটো লগ্নে বিয়ে ছিলো।একটা ছিল সন্ধ্যা লগ্নে অপরটা রাত তিনটের পর।আমার বিয়ের সময় ছিল সন্ধ্যা লগ্নে।কিন্তু সবাই বুঝেই গেছিলাম সন্ধ্যা লগ্নে বিয়ে হওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়।সবাই পরের সময়টার অপেক্ষায় ছিল।আমি কনে সেজে সেই বিকেল থেকে বসে।বুকের ভিতর যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে।সমানে ঠাকুরকে ডেকে চলেছি।রাত বারোটা কিন্তু কোথায় বরবেশি কুশল?বাড়ি তখন ফাঁকা হতে শুরু করেছে।খুব কাছের কয়েকজন ছাড়া তখন আর কেউ নেই।বাবা পাগলের মত ছটফট করছেন।মা ঠাকুরঘরে পরে আছেন।আর আমার কথা নাইবা বললাম।
  ভোরবেলা সেই বৃষ্টি থামলো।কাছের যারা ছিল সবাই যে যার মত গাড়ী,বাইক নিয়ে বেরিয়ে গেলো।পুরো চব্বিশ ঘণ্টা পাগলের মত ছোটাছুটির পর বাবা গিয়ে মর্গে কুশলের লাশ সনাক্ত করলেন।বিশাল এক্সিডেন্ট!
 বিয়ে না হয়েও আমি বিধবা হলাম।বাকি জীবনটা এভাবেই কাটিয়ে দেবো মনে করে বাবা,মায়ের মৃত্যুর পর সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করে পাহাড়ে চলে এসে এখানেই এই বাচ্চাগুলোর দেখাশুনার দায়িত্বে আছি।
 এতক্ষণ ধরে আমি আমার কলিগের সাথে আমার জীবনের কথাগুলো শেয়ার করছিলাম কারণ অনিন্দ্য আমাকে তার ভালোবাসার কথা জানিয়েছে।আমি যে জীবনে আর কাউকেই স্বামী হিসাবে মেনে নিতে পারবো না,কাউকে ভালোবাসতে পারবো না এটা পরিস্কার করে অনিন্দ্যকে জানিয়ে দেওয়ায় শ্রেয় মনে করলাম।
    

Thursday, October 21, 2021

জীবনের প্রতি বাঁকে (ষষ্ঠ পর্ব)

জীবনের প্রতি বাঁকে (ষষ্ঠ পর্ব)
  সায়নী তার শ্বশুরবাড়ি পা দিয়েই বুঝতে পারলো তার শ্বশুর,শ্বাশুড়ী মন থেকে মেনে নিতে তাকে পারেনি।কারণ এ বিয়েকে কেন্দ্র করে আত্মীয় ও পাড়া প্রতিবেশিদের মাঝে যে গুঞ্জন উঠেছিল তার রেশ ধরেই কথায় কথায় তাকে নানান কটূক্তি শুনতে হচ্ছে।নূতন বউ সুতরাং সেভাবে মনোতোষকেও সেভাবে কিছু বলতে পারছে না।আর বাপের বাড়িতে তো নয়ই।মনেমনে ভাবলো যাকগে বেশিদিন এই কথার ঝাল তো মেটাতে পারবে না কারণ মনোতোষের ছুটি শেষ হলেই তো সে তার কর্মস্থলে চলে যাবে।আর সঙ্গে সেও।কিন্তু ভাবনার সাথে বাস্তবের মিল অনেক সময়ই পাওয়া যায় না।এখানেও ঘটলো ঠিক তাইই।মনোতোষ তার বউকে নিয়ে যেতে চাইলে তার বাবা,মা রাজী হননা।তারা তাদের ছেলেকে বলেন,
-- সবে তো বিয়ে করলি। ওতো তোর কাছেই থাকবে সারাজীবন।কয়েকটা দিন আমাদের কাছে রেখে যা।পরেরবার এসে সাথে করে নিয়ে যাস।
 মনোতোষ বাবা,মায়ের কথাটা যুক্তিসঙ্গত মনে করায় সানুর শত কান্নাকাটিতে সে সায় দেয় না।সে একাই দন্ডকারন্য তার কর্মস্থলে ফিরে যায়।আর এর ফলে সায়নীর প্রতি মনোতোষের বাবা,মায়ের সকলের কাছে হেনস্থা হওয়ার রাগ গিয়ে পড়ে।তখনকার দিনে ফোনের এত রমরমা ছিলনা;যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম চিঠির আদানপ্রদান।কিন্তু নূতন বউ বাইরে বেরতেও পারবে না বা তারা বেরোতেও দেবে না।অত্যাচারের মাত্রা দিনকে দিন বেড়েই যেতে লাগলো।
 একদিন অফিস ফেরত পথে অমরেশবাবু মেয়েকে দেখতে আসায় সায়নী যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।কিন্তু বাবা আর মেয়ে যাতে একসাথে আলাদা কথা বলতে না পারে তারজন্য মনোতোষের বাবা,মা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন।কিছুটা হলেও অমরেশবাবু বিষয়টা আঁচ করতে পারেন।শত হোক উকিল মানুষ তিনি।কেউ হা করলে তিনি হাওড়া, হাবড়া পৌঁছে যান।ইশারায় মেয়েকে বুঝিয়ে দেন লিখে দিতে।সায়নী চা করতে করতেই রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে একটি চিরকুটে লিখে নেয় " বাবু ওরা আমার প্রতি খুব অন্যায়,অত্যাচার করে"। চা টা রাখতে এসে প্লেটের তলায় তার বাবুর দিকে চিরকুটটা রাখে।তিনি চা,জলযোগ করে বাথরুমে যাওয়ার নাম করে চিরকুটটা নিয়ে উঠে যান।চিরকুটটা পড়ে সঙ্গে সঙ্গেই তার মাথা গরম হয়ে যায়।ওখানে দাঁড়িয়েই তিনি সিদ্ধান্ত নেন তিনি তার মেয়েকে নিয়েই বাড়ি ফিরবেন।
 ঘরে ঢুকেই তিনি তার বেয়াই,বেয়ানকে প্রস্তাব দেন তিনি মেয়েটিকে সাথে করে কয়েকটা দিনের জন্য নিয়ে যেতে চান।সঙ্গে সঙ্গেই তারা সে প্রস্তাব নাকচ করে দেয়।কিন্তু অমরেশবাবু তার সিদ্ধান্তে অটল।তিনি তার সানুকে নিয়েই ফিরবেন।আর তার শ্বশুর,শ্বাশুড়ীও তাকে তার বাবার সাথে পাঠাবেন না।শেষমেষ তিনি রেগেমেগে বললেন,
--- আমি আমার মেয়েকে নিয়েই বাড়ি ফিরবো তারজন্য যদি তার স্বামী তাকে ত্যাগ করে করবে।তখন আমি আইনের পথেই হাঁটবো।ছেলের বিয়ে দিয়ে পুত্রবধুকে ছেলের সাথে না পাঠিয়ে তাকে বাড়িতে রেখে তার প্রতি যে অন্যায় অত্যাচার করছেন আপনাদের কোন ধারণা আছে আমি তারজন্য আপনাদের বিরুদ্ধে কি কি করতে পারি।
 সায়নীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
-- মা তুই রেডি হয়ে চলে আয়।আমি তোকে নিয়েই ফিরবো।
 সায়নী আমতা আমতা করতে লাগলে তিনি বলেন,
--- তোর কোন ভয় নেই।তোকে বিয়ে দিয়েছি স্বামীর সাথে সংসার করার জন্য।আর এরা তোকে তার সাথে না পাঠিয়ে তোর প্রতি মানসিক অত্যাচার করছেন।আমি বাবা হয়ে কিছুতেই এটা মেনে নেবো না।
--- আপনি কিন্তু ভুল করছেন বেয়াই মশাই।আজ যদি ওকে সাথে করে নিয়ে যান আমরা কিন্তু আপনার মেয়েকে আর কোনদিন এ বাড়িতে ঢুকতে দেবো না।
--- আমিও কোনদিন আর এ বাড়িতে আমার মেয়েকে পাঠাবো না।আর যদি তাকে পাঠাতেই হয় তাকে তার স্বামীর কাছেই পাঠাবো।
--- আপনার আজকের আচরণের কথা জানতে পারলে মনা কোনদিন আপনার মেয়েকে নিয়ে সংসার করবে না।
--- তাকে তো এটাও জানতে হবে তার প্রতি আপনারা কি অন্যায় করছেন।আমার মেয়ে তাকে কোন কথা জানায়নি ঠিকই কিন্তু আমি তো তাকে সমস্ত কথায় জানাবো।আর আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন আমার মেয়ে খাওয়াপরা আর একটু আশ্রয়ের জন্য কোনদিন আপনাদের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াবে না।আমি আমার মেয়েকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে তাকে নিজ পায়ে দাঁড় করাবো।
--- এতই যদি আপনার চিন্তাভাবনা তাহলে আমাদের ছেলের সাথে ওর বিয়ে দিলেন কেন?
--- সে ঘটনা আপনারা জানেন না?নাকি সব ভুলে বসে আছেন?আমার সেদিনই বোঝা উচিত ছিলো।যে ভুল সেদিন করেছি তা শুধরানোর সময় এসে গেছে।
  বাকবিতণ্ডা প্রচুর তর্কাতর্কির পর অমরেশবাবু তার মেয়েকে নিয়ে সে স্থান ত্যাগ করেন।পড়ে তাকে নিয়ে যখন গ্রামের বাড়িতে যান তখন তার স্ত্রী শুনে তো থ।সারাজীবনই মেয়েদের কোন কষ্ট তিনি সহ্য করতে পারেন না।প্রতিটা মেয়ে তাঁর প্রাণ।আর এই কারণেই মেয়েদের বিয়ের কথা উঠলেই তিনি তেলেবেগুনে জ্বলে যেতেন।" দুটো ভাত কোলের কাছে নিয়ে আমার মেয়েরা চোখের জল ফেলবে এটা আমি কিছুতেই মেনে নেবো না --"এই ছিল তার বক্তব্য।
 সমস্ত ঘটনা জানিয়ে সায়নী তার স্বামীকে চিঠি লেখে।কিন্তু কোন উত্তর সে পায় না।কয়েকমাসে বেশ কয়েকটা চিঠি দিয়েও যখন কোন উত্তর আসে না তখন অমরেশবাবু মেয়ের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে তাকে পুনরায় কলেজে ভর্তি করে দেন।কিন্তু মনটা তাঁর সব সময়ের জন্যই খুঁতখুঁত করতো মেয়েটার জন্য।মনোতোষ এই ঘটনার পর আর বাড়িতেও আসে না যোগাযোগও করে না।যে ছেলে সায়নীর জন্য এত পাগল ছিল,যে তাকে বিয়ে করার জন্য এত কান্ড করে লোক হাসালো তার চরিত্রের এই দিকটা কেউই কখনোই বুঝতে পারেনি।সায়নী কিন্তু তার স্বামীকে কয়েকদিন অন্তর অন্তর চিঠি লিখেই যাচ্ছে।আর প্রতিদিন প্রতি মুহুর্ত সে অপেক্ষা করে থাকে মনোতোষের উত্তরের আশায়।কিন্তু তার অপেক্ষা অপেক্ষাতেই শেষ হয়ে যায়। আস্তে আস্তে সে নিজেকে অনেকটাই সামলে নেয়।পড়াশুনায় মন দেয়।দেখতে দেখতে বেশ কয়েকটা বছর কেটে যায়।সায়নী গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে।কিন্তু চিঠি লেখা তার বন্ধ হয় না স্বামীকে।ইতিমধ্যে এই বিবাহিত সায়নীকে একজন পূর্ব পরিচিত ছেলে বিয়ে করতে চায় যেহেতু সকলেরই ধারণা তার স্বামী তাকে ছেড়ে দিয়েছে।কিন্তু সায়নীর বাবা পরিস্কার তাদের জানিয়ে দেন সংসার যদি করতেই হয় তাহলে আমার সানু ওই মনোতোষের সাথেই করবে।তারজন্য যতদূর যেতে হয় আমি যাবো।আমার মেয়ের জীবন নষ্ট করবে ;আর আমি এত সহজে তা মেনে নেবো না। আইনশৃঙ্খলা বলে দেশে একটা কথা আছে।মনোতোষ সরকারি চাকরি করে।আমি আইনের পথ ধরেই সেই পথে এগোবো।আমি এত সহজে সবকিছু ছেড়ে দেবো না।
 তিন বছরের মাথায় মনোতোষের একটি চিঠি আসলো।কিন্তু চিঠি খুলে সায়নী তো অবাক।খামের উপরে তার নাম।অথচ ভিতরে সে যে চিঠিটা লিখেছে এটা তো তাকে লেখা নয়!নামটাও তো তার নয়।কে এই দিপালী?কাকে মনোতোষ এইভাবে চিঠি লিখেছে?তাহলে কি মনোতোষ অন্য কাউকে ভালোবাসে?আর সেই কারণেই তাকে নিতে আসা বা তার চিঠির উত্তর দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে?চিঠি পড়ে মনেমনে ভাবে বাবুকে কথাটা বলতেই হবে।বাবু ছাড়া এই সমস্যার সমাধান কেউই করতে পারবে না।আজই রাতে বাবুকে চিঠিটা দেখাতে হবে।

ক্রমশ -
  

Tuesday, October 19, 2021

শুধু একটি রাত

শুধু একটি রাত

" এই দিনটার অপেক্ষা থাকে সারা বছর কিন্তু -"
  তবুও নিজের ইগো ঝেড়ে ফেলে তার কাছে আসতে পারে না।আমি জানি একবার যদি রুপশ্রী সব ভুলে গিয়ে দেবদূতের কাছে ক্ষমা চায়,ক্ষমা চায় বলছি কেন - একবার যদি তাকে আর একটা সুযোগ দেয় তাহলেই কিন্তু সবকিছু ঠিক হয়ে যেত।কিন্তু কিছুতেই সে মাথা মাথা নোয়াবে না।আসলে তুমিও তো ওই ধরনের।নিজের ভুল কিছুতেই স্বীকার করবে না।"
--- বেশ তো মেয়ের কথা বলছিলে।হঠাৎ আমায় ধরে টানছো কেন?
--- তোমায় ধরে টানছি এই কারণেই এই স্বভাবটা তো সে তোমার থেকেই পেয়েছে।
 অনিন্দ্যবাবু আর কোন কথা না বলে পেপারটা সামনে ধরে ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন।আর সেখানেই চুপচাপ রূপশ্রীর মা শ্রীময়ী বসে সাতপাঁচ ভেবে চলেছেন।
 আজ আট বছর হতে চললো রুপশ্রীর বিয়ে হয়েছে দেবদূতের সঙ্গে।বছর চারেক খুব ভালোই ছিলো দুজনে।দেবদূত নামকরা কোম্পানির উচ্চপোষ্টে কর্মরত।বাবা, মা হারা সন্তান সে।আত্মীয় স্বজনেরা দেখেশুনে বিয়ের সম্মন্ধ করেছিলো।তারপর দেবদূত দেখেই ফাইনাল করেছে।রূপশ্রী সাধারণ ভাবে গ্র্যাজুয়েশনটা কমপ্লিট করেছিলো।আহামরি সুন্দরী না হলেও কেউ কুৎসিত তাকে বলবে না।তবে রূপশ্রীর গায়ের রংটা চোখে পড়ার মত।দুধে আলতা গায়ের রং তার।সংসারের কাজেও যথেষ্ঠ পারদর্শী।তার চরিত্রের সব থেকে বড় দোষ যেটা -সে তার ভুল বুঝতে পারলেও কখনোই মুখ ফুটে ভুল স্বীকার করে না।'একদম বাপ কা বেটি।'
 একবার পুজোর সময় পাহাড়ে ঘুরতে গিয়ে সেখানে হঠাৎ করেই দেখা হয়ে যায় দেবদূতের অফিস কলিগ অপরিজিতার সাথে।দেখাটা কাকতালীয় হলেও রূপশ্রী নিজের ইচ্ছামত মনের মধ্যে একটা স্ক্রিপ্ট তৈরি করে নেয়।আর সেখানে সে তার যুক্তি,তর্ক দিয়ে দেবদূতকে বলে,
-- তুমি অপরাজিতার সাথে পরামর্শ করেই একই জায়গায় এসেছো।
--- পাগল নাকি তুমি?ও এসেছে ওর হাজব্যান্ড এর সাথে।আর আমি জানবোই বা কেমন করে যে ওরা এখানেই আসছে কলকাতার পুজো ছেড়ে।আর সব থেকে বড় কথা হল এখানে আসার সিদ্ধান্ত তোমার।আমি কিন্তু এবারের পুজোটা কলকাতাতেই কাটাতে চেয়েছিলাম।
  দেবদূতের সমস্ত কথায় অরণ্যে রোদন হয়।ঝামেলার এই শুরু।অফিস থেকে ফিরতে দেরি হলেও অপরাজিতাকে নিয়ে দেবদূতকে জড়িয়ে নানান কটূক্তি।তারপর রূপশ্রী একদিন সত্যিই ঘর ছাড়ে।দেবদূত শুধু পায়ে ধরতেই বাকি রেখেছিল সেদিন।তার মস্তবড় অপরাধ ছিল সেদিন তর্কাতর্কির মাঝে দেবদূত রূপশ্রীকে বলেছিলো,
--- তুমি একজন মানসিক রোগী ।তোমাকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো দরকার।
  রূপশ্রী তারপর আর ফিরে যায়নি দেবদূতের কাছে।সব থেকে অদ্ভুত যে ব্যাপারটা দেবদূত প্রতিবছর দশমীর দিনে তার শ্বশুরবাড়িতে আসে।একমাথা সিঁদুর পরে মাকে বরণ করতে যায় রূপশ্রী।দেবদূতের সাথে তার দেখাও হয়।কিন্তু কোন কথা সে বলেনা।সে বসে থাকতেই তার সামনের থেকে গটগট করতে করতে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।অথচ এই দশমীর দিনে বিকেল থেকেই সে সেজেগুজে বারবার জানলা দিয়ে রাস্তার দিকে উঁকি দিতে থাকে।তাকে দেখলেই বোঝা যায় সে আজ খুব আনন্দে আছে 
 শ্রীময়ীদেবী এবার ঠিক করেন যে ভাবেই হোক দেবদূতকে এক রাত এখানে রাখতেই হবে।
 দেবদূত এবারেও আসে।পূর্ব পরিকল্পনা মত অনিন্দ্যবাবু হঠাৎ অসুস্থ্য হয়ে পড়েন।শ্রীময়ীদেবী কাঁদো কাঁদো হয়ে দেবদূতকে তার শ্বশুরের কথা চিন্তা করে এক রাত থেকে যেতে বলেন।দেবদূত অনিচ্ছা সত্বেও রাজি হয়।কিন্তু অতিরিক্ত ঘর না থাকায় শ্রীময়ীদেবী যখন দেবদূতকে রূপশ্রীর ঘরে শুতে বলেন সে স্পষ্ট জানিয়ে দেয় 'না।' বাধ্য হয়ে দেবদূত ড্রয়িংরুমের সোফার উপর শোয়।
  সকলে ঘুমিয়ে পড়লে অনেক রাতে পা টিপে টিপে রূপশ্রী দেবদূতের কাছে এগিয়ে গিয়ে তার গায়ে একটি চাদর দিতে যায়।আর ঠিক তখনি জেগে থাকা আর ঠিক এই প্রতীক্ষাতে থাকা দেবদূত এক টানে রূপশ্রীকে নিজের বুকের উপর টেনে নেয়। মান-অভিমান, ঝগড়া অন্ধকারের মধ্যে মিশে গিয়ে দুটো নরনারী পুনরায় এক হয়ে যায়।

#আজকের_ব্লগিং_সূত্র

Sunday, October 17, 2021

জীবনের প্রতি বাঁকে (পঞ্চম পর্ব)

জীবনের প্রতি বাঁকে ( পঞ্চম পর্ব)
  চৌধুরী গিন্নী বেশ ভালোভাবেই মনোতোষকে চিনতেন।তিনি জানতে চাইলেন,
--- মনোতোষ কোথায়?তুমি তো মনোতোষ নও।
বরযাত্রীদের ভিতর থেকে একজন উত্তর দিলো,
--- আছে আছে।আপনারা যে এত তাড়াতাড়ি চলে আসবেন বরণ করতে আমরা বুঝতে পারিনি।
--- এর মানেটা কি?বিয়ে তো ঠিক হয়েছে মনোতোষের সাথে।তুমি কোথা থেকে আসলে?
 --- আসলে কি হয়েছে জানেন?মনোতোষ তো সকাল থেকে না খেয়ে আছে।ওই সেজেগুজে রিক্সায় করে আসছিল।খালিপেটে ও খেঁজুরের রস খেতে ভালোবাসে।হঠাৎ দেখে একটা খেঁজুর গাছে রসের ঠিলেটা ভর্তি হয়ে পড়ে যাচ্ছে।অমনি রিক্সা থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়ে গাছে উঠে ঠিলে থেকে রস খেতে শুরু করলো।তাই টোপরটা আমায় মাথায় পরিয়ে দিয়ে গেছে।আপনাদের পুকুরেই হাতমুখ ধুচ্ছে।এখনি এসে পড়বে।
 গল্প শুনে সকলে তো তাজ্জব।শান্তিদেবী মনেমনে ভাবলেন এ কোন বাঁদরের সাথে তার সায়নীর বিয়ে ঠিক হল।মেয়েটা কি সুখী হবে? এ ছেলের তো গুণের শেষ নেই।একে মানিয়ে গুছিয়ে নিয়ে কিভাবে তাদের সানু সংসার করবে?
 ইতিমধ্যে ভিড় ঠেলে বেরিয়ে বর হাজির হলেন।ধুতি ছেড়া,পাঞ্জাবিতে নোংরা লাগানো।এসেই খপাত করে রিক্সায় উঠে বসে বন্ধুর মাথা থেকে টোপরটা খুলে নিয়ে নিজেই টোপরটা মাথায় পরে নিল।অন্যেরা হাসাহাসি করতে লাগলেও শান্তিদেবীর রাগে তখন সর্বশরীর জ্বলছে।তিনি মুখ ভার করে মনোতোষকে বরণ করে এসে আলমারির ভিতর থেকে তার স্বামীর একটা নূতন ধুতি বের করে এক মেয়ের হাতে দিয়ে বলেন,
--- এটা পরে নিতে বল।ওই ছেড়া ধুতি পরে তো আর বিয়ে করতে বসতে পারবে না।
 এ কথা বলে তিনি রাগে গজগজ করতে লাগলেন।কিন্তু মনোতোষ নির্বিকার।সে কোন অন্যায় করেছে বলে তার মনেই হয়না।
  বেশ ভালোভাবেই বিয়ে মিটে গেলো। বর কর্তা হয়ে যিনি এসেছিলেন তিনি ছিলেন মনোতোষের কাকা।ওই গ্রামেই তিনি থাকেন।তিনি মনোতোষকে ডেকে বলেছিলেন,
--- এই মেয়েকে বিয়ে করবি বলে অনেক খেল দেখিয়েছিস।তারপর আজকে আবার যা তুই করলি তার কোন ক্ষমা নেই।আর যদি কোন গোল তুই বাঁধিয়েছিস তাহলে কিন্তু আমার থেকে খারাপ কেউ হবেনা।এই পরিবারটা অত্যন্ত ভদ্র তাই তুই আজ এই অন্যায় করার পড়েও মুখ বুঝে বর বরণ করেছেন এরা।এইরূপ যদি আমার বাড়িতে ঘটতো বিয়ে করা ঘুচিয়ে দিয়ে মেরে তক্তা বানিয়ে দিতাম।
 মনোতোষ মাথা নিচু করে মিনমিন করে বললো
--- ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেছে।আমি ঠিক বুঝতে পারিনি।
--- ঠিক আছে।তবে দোহাই তোমার বংশের মুখে আর চুনকালি দিও না।নির্বিঘ্নে বিয়েটা হয়ে যেতে দাও।
 তারপর সেদিন মনোতোষ আর কোন কান্ড ঘটায়নি।কিন্তু অমরেশবাবু তার মেঝমেয়ের বিয়ে দিয়ে খুবই ভেঙ্গে পড়েন।দিন সাতেক তিনি গ্রামের বাড়িতেই থেকে যান আর ঠিক তারই মধ্যে গ্রামের কুখ্যাত ডাকাত খালু খা ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা পড়ে।এই কালু খার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি ডাকাতির কেস চলছে।আর প্রতিটা কেসেই একই গ্রামে থাকার ফলে আসামী পক্ষের উকিল অমরেশবাবু।শেষবার তাকে ছাড়ানোর সময় সে অমরেশবাবুকে কথা দিয়েছিল জীবনে আর কখনো চুরি,ডাকাতি করবে না।কিন্তু পুনরায় ডাকাতির কেসে সে ফেঁসে যাওয়ায় অমরেশবাবু যান প্রচণ্ড খচে।যারফলে তিনি কালু খার বাড়ির লোকদের বলে দেন তার হয়ে আর কেস তিনি লড়বেন না।বাড়ির লোক ফিরে যায়।কিছু পড়ে তার বৃদ্ধা মা আসেন দেখা করতে অমরেশবাবুর সাথে।তিনি এসে তাকে জানান,
--- তিনদিন ধরে বাড়িতে কোন ভাত,রুটির সংস্থান নেই।সেইভাবেই চলছিলো।কিন্তু হঠাৎ করে আট বছরের নাতিটা অসুস্থ্য হয়ে পড়ায় ডাক্তার দেখানোর দরকার হয়ে পরে।আর এই কারণেই ----
--- তাই বলে চুরি,ডাকাতি করবে?আমার কাছে তো আসতে পারতো।আমি বারবার ওর হয়ে সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য করতে পারবো না।
--- বাবু এবারের মত উদ্ধার করে দেন।আর কোনদিন এসব ও আর যাতে না করে সে ব্যবস্থা আমি করবো।
 অমরেশবাবু জীবনে যত কেস লড়েছেন তার অধিকাংশই জিতেছেন।হেরে গেছেন খুব কম।কিন্তু কালুর এবারের কেসটাই তিনি হেরে যান।সেদিন ছিল শনিবার।তাই অফিস করে তিনি গ্রামের বাড়িতে আসেন।স্বভাবতই কেসে হেরে গিয়ে তার মনমেজাজ ভালো ছিলনা।শান্তিদেবী যখন তাকে চা করে এনে দেন তখন মুখে দিয়েই তিনি চিৎকার করে ওঠেন বাজে চা হয়েছে বলে।
 তার স্ত্রী অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন।কারণ আজ পর্যন্ত তার স্বামীর এরূপ আচরণ তিনি দেখেননি।অনেকক্ষণ তাকে পর্যবেক্ষণ করার পর হঠাৎ তার মনে পড়ে কালুর কিসের তারিখ ছিলো আজ।তিনি সরাসরি তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন,
--- তুমি কালুর কেসটাই হেরে গেছো তাই না?
 দুর্ব্যবহারের কারণটা স্ত্রী জেনে যাওয়ায় তিনি একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন।
--- ছেলেটার পাঁচ বছর শশ্রম হাজতবাস হয়ে গেলো।কিছুই করতে পারলাম না।ও ঢুকেছিলো ওই বাড়িতে চুরি করতে কিন্তু বাড়ির লোক জেগে যাওয়ায় শুরু করে ডাকাতি করতে।শুধু কি তাই বাড়ির গৃহকর্তা তাকে বাধা দিতে গেলে তাকে দা এর কোপ বসিয়ে দেয়।সে বেচারার কতগুলো সেলাই পড়েছে।এত কিছুর পরে তাকে কি আর বাঁচানো যায়?তুমি একটু ওর পরিবারটা দেখো।আমি তো সোমবার চলে যাবো। চাল,ডাল যা লাগে সব দিও।আর বাড়ির টুকটাক কাজের জন্য নিত্য একটু বেশি টাকা দিয়ে ওর বউটাকে কাজে লাগাও।
--- কিন্তু সেসব তো রতন দত্তের বউ যুথিকা দেখে।ওর সংসারের অবস্থা তো আরো খারাপ।কত লোককে তুমি এইভাবে দেখবে বলো তো?গ্রামের অধিকাংশ লোকের অভাব।এইভাবে এক একজন করে তুমি যদি তোমার নিজের বাড়িতে কাজে বহাল করো তাহলে কি করে হবে?
--- কিন্তু তাই বলে পরিবারগুলো না খেতে পেরে মরে যাক তাতো দেখতে পারবো না।
--- অন্য কোন একটা উপায় খুঁজে বের করতে হবে।এমন কোন উপায় যাতে ওদের দুপয়সা রোজগার হয়।
--- কি করা যায় বলো তো?
--- ভেবে কিছু তো একটা বের করতেই হবে।
  পরবর্তীতে তিনি দু,চারটি সেলাই মেশিন কিনে একজন শিক্ষক নিযুক্ত করে এদের জামা কাপড়ের কাটিং শিখিয়ে স্বনির্ভর হতে সাহায্য করেছিলেন।
  এতদসত্বেও অমরেশবাবু মানুষটি কিন্তু ঠিক সংসারী ছিলেন না।সংসারের কোন ব্যাপারেই তিনি মাথা ঘামাতেন না।সংসার সম্পর্কে উদাসীন এই মানুষটিই আবার অন্যের সংসারের হালহকিকতের খবর রাখতেন আর সাধ্যমত তাদের পাশে দাঁড়াতেন।অন্দরমহলের সমস্ত কিছু দেখাশুনা করতেন তার স্ত্রী।মেয়েদের শাসন করা থেকে শুরু করে তাদের লেখাপড়ার সমস্ত দায়িত্ব ছিল শান্তিলতাদেবীর।সত্যি কথা বলতে তখনকার দিনের ছেলেমেয়েরাও এত অবাধ্য ছিলনা।সন্ধ্যা হলেই বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে এক হ্যারিকেনের আলোতে সকলে মিলে জোরে জোরে যে পড়া চলতো সেখানে থাকতো একটা অদ্ভুত ভালোবাসার মেলবন্ধন।মায়ের নির্দেশ ছিলো সকলে জোরে জোরে পড়বে যাতে তিনি রান্নাঘর থেকেই শুনতে পান।ছোটরা কিছু না পারলে বড়দের সেগুলি দেখিয়ে দেওয়া,ছোটরা ভুল করলে বড়দের শাসন করা আর ছোটদের সেগুলি মেনে নেওয়া - তখনকার দিনে এগুলিই ছিল অধিকাংশ পরিবারের শিক্ষা।

ক্রমশঃ 
    


Friday, October 15, 2021

অন্য দেবদাস

অন্য দেবদাস

  "পুজোর মধ্যে ঘটেছিলো ঘটনাটা - শুরুতেও ছিল পুজো আর হয়ত শেষেও সেই পুজোয় থাকলো।আর কোনদিন দেবুদার সাথে দেখা হবে কিনা জানিনা।তাই আজ আমি ঠিক করেই এসেছি একবার তার সাথে দেখা করবো আজ।ছেলের বয়স এখন আমার আঠারো বছর।তার জেদাজেদিতেই এবার পুজোয় বাপের বাড়িতে আসা।বিয়ে হয়ে সেই যে চলে গেছিলাম বাবার পরে রাগ করে আর কোনদিন বাড়িতে আসিনি।কানাডা থেকেই বাবার মৃত্যুর খবর পেয়েছিলাম।মা,ভাই হয়ত ভেবেছিল আমি এই সংবাদ পেয়ে বাড়িতে আসবো।কিন্তু এখানে আমার পরিবারের প্রতি যে শুধু রাগ কাজ করেছে তা কিন্তু নয়।বাড়িতে আসলেই দেবুদার সাথে আমার দেখা হবে আমি জানতাম।কোন মুখে আমি তার সামনে গিয়ে দাঁড়াবো?তার কাছে তো বটেই নিজের কাছেও যে নিজে ছোট হয়ে গেছি।আজ কুড়ি বছর ধরে মনের মধ্যে অপরাধবোধ,পাপবোধ কাজ করে চলেছে।"
  কুড়ি বছর আগে পাড়ার ক্লাবে অষ্টমীর সন্ধ্যায় যে জলসার আয়োজন করা হয়েছিলো সেখানে শ্রীলেখা একটি আগমনী গান গেয়েছিল।আর সেবারের পুজোয় সেক্রেটারি ছিল দেবদুলাল চ্যাটার্জী।একই পাড়া।মুখ চেনা মানুষটির সাথে সেদিন অনেক কথা হয়েছিল।পাড়ার লোকেরা দেবদুলাল ওরফে দেবুকে সবাই খুব ভালোবাসতো তার মিষ্টি স্বভাবের জন্য।শ্রীলেখার সাথে সেদিনের পুজোতে গান গাওয়ার সূত্র ধরে আস্তে আস্তে কাছে আসা।দেবদুলাল পাগলের মত ভালোবাসত শ্রীলেখাকে এটা শ্রী ভালোভাবেই বুঝেছিল।
  শ্রীলেখাদের বাড়িতে এ খবর পৌঁছাতেই আগুন জ্বলে উঠলো।কারণ একটাই দেবদুলালের বোন অবাঙালী একটি ছেলেকে ভালোবেসে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছে।তাই ওই পরিবারটাই খারাপ হয়ে গেছে শ্রীদের বাড়িতে।সুতরাং নিজ পরিবারের সম্মান বাঁচাতে সেই চিরাচরিত প্রথা!জোর করে মেয়েকে অন্যখানে বিয়ে দেওয়া,ঘরে আটকে রাখা বাবা,মা ছাড়া বাড়ির বাইরে না বেরোতে দেওয়া।
  শ্রীলেখার বিয়ে হয়ে গেলো কানাডা নিবাসী ছেলের সাথে। বিয়ের কথা জানতে পেরে অকুতোভয় দেবদুলাল শ্রীদের বাড়িতে এসেছিলো।কিন্তু তার গায়েই শুধু হাত তোলা হয়নি।পুলিশের ভয়টা তাকে নয় তার বাবাকে রাস্তায় ধরে দেখানো হয়েছিলো।বিয়ের দিন বাড়িতে কিছু পুলিশ পোষ্টিং ছিল।
শ্রী এতক্ষণ ধরে কথাগুলো বলছিলো তার ছেলেবেলার এক বন্ধুকে। তারও কলকাতার বাইরে বিয়ে হয়েছে শ্রীর বিয়ের আগেই।প্রতিবছর একমাত্র পুজোতেই মুর্শিদাবাদ থেকে আলোকা বাপের বাড়িতে আসে।সে এসব কিছুই জানতো না।তারা কথা বলতে শুরু করার পর খেয়াল করলো প্যান্ডেল থেকে বহু দূরে একজন পাগল বসে আছে।আলোকা তাকে বললো,
--- দেবুদা বহুবছর পাগল হয়ে গেছে তুই জানিস?
--- সে কি? আমি তো কিছুই জানিনা।তুই একটু আমার সাথে যাবি দেবুদার বাড়িতে।আজ আমি মনেমনে ঠিক করেই প্যান্ডেলে এসেছি দেবুদার সাথে একটু দেখা করবো।
--- তার বাড়িতে যেতে হবে না।ওই দেখ দেবুদা দোকানের সিড়িতে বসে আছে।
শ্রীলেখা তাকিয়ে দেখে উঠে দাঁড়ায় তার দিকে এগিয়ে যেতে।কিন্তু তখনই সামনে দেখে ছেলে আর স্বামীকে।তারা কোথায় যাচ্ছে জানতে চাওয়ায় বলে,
--- অনেক বছর আগে এই রকম এক পুজোর সময় একজন মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছিলো।এখন সে পুরো উন্মাদ।যাচ্ছি তার সাথে দেখা করতে।তোমরাও আসতে পারো আমার সাথে।
 শ্রী এগিয়ে যায়।সাথে অলোকা।কাছে গিয়ে ডাক দেয়,
--- দেবুদা
 ঘোলাটে চোখে দেবদুলাল শ্রীর মুখের দিকে তাকায়।
--- আস্তে কথা বলো।আমার মন বলছে ও আশেপাশেই কোথাও আছে।আমার সাথে দেখা করতে নিশ্চয়ই আসবে।
--- কে সে দেবুদা?
--- তুমি চেনো না।সবাই জানে তো।সবাই বলে আমি নাকি দেবদাস।ভালোবেসে পাগল হয়েছি।
শ্রীর দুচোখ বেয়ে জল পড়ছে। কাঁদতে কাঁদতেই বললো,
--- দেবুদা আমার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখো আমি শ্রীলেখা।
 দেবু তর্জনী দিয়ে নিজের ঠোঁটের উপর হাত রেখে বললো,
--- যাই প্যান্ডেলের কাছে।শ্রী এসে গেছে -- 
 দেবদুলাল সামনে এগিয়ে যেতে লাগলো।পিছন থেকে শ্রী কয়েকবার দেবুদা, দেবুদা বলে ডাক দিল।কিন্তু কোন সাড়া না দিয়েই সে এগিয়ে যেতে লাগলো।শ্রীর স্বামী,সন্তানকে ক্রস করে যখন এগিয়ে যাচ্ছে তখন তার ছেলে আকাশ বাবাকে বলে,
--- দেখো বাবা ওই পাগলটা মায়ের বন্ধু।মা না একটা যা তা ।
 শ্রী সেখানে বসেই দুই হাঁটুর মধ্যে মুখ রেখে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলো।


Thursday, October 14, 2021

নীরবে এসেছিল প্রেম

নীরবে এসেছিল প্রেম

  "অঞ্জলী দেওয়ার সময় ঘটেছিলো ঘটনাটা"- সবাই উৎসুক হয়ে নবনীতার দিকে তাকিয়ে আছি।ও তখন মনেহয় স্কুল লাইফে আমাদের দশম শ্রেণীর ক্লাসরুমে ফিরে গেছে।তাই কয়েক মিনিট আমাদের শুধু ফ্যালফ্যাল করে ওর বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হল।তারপর চোখ খুলে বললো,
--- তোরা সেখানে সকলেই ছিলি কিন্তু সেদিন সুনীলের সেই কান্ড কেউ দেখতে পারিসনি।কারণ সকলেই অঞ্জলীর মন্ত্র বলেছিলি চোখ বন্ধ করে।আমারও চোখ বন্ধ ছিল।কিন্তু --
   নবনীতা আবারও চুপ।আর আমরা চেয়ারগুলো সামান্য টেনে নিয়ে তার দিকে এগিয়ে গেলাম।বহুবছর বাদে আজ আমরা আবার সবাই একসাথে।আমরা সকলে এসেছি আজ একটা হোটেলে খাবোদাবো আর চুটিয়ে আড্ডা দেবো।ফেসবুকের সৌজন্যে প্রায় বছর দশেক বাদে আমাদের দেখা।আমরা ফোনেই কনফারেন্স করে ঠিক করে নিয়েছিলাম সকলের জীবনে ঘটে যাওয়া এমন কোন ঘটনা আজ শেয়ার করবো যা নিজে ছাড়া আর কেউই জানেনা।প্রায় সকলেই তার জীবনের প্রথম প্রেম থেকে প্রথম পরশ মন খুলে বলেছে। কারো কারো জীবনের প্রথম প্রেম স্বার্থকতা পেয়েছে বিয়ে করে।আবার কেউ তার ভালোবাসার মানুষটাকে কাছে পায়নি।বিয়ে হয়েছে অন্য কারো সাথে।সুখী হয়েও মনের কোন এক গোপন গভীর কোনে তাকে আজও সযত্নে লালন করে চলেছে।কেউবা ভালোবেসে বিয়ে করেও সুখী হতে পারেনি।বিয়ের পরপরই মানুষটার ভিতরের কালো দিকটা বেরিয়ে পড়েছে।খুব কাছের দশ বন্ধুর জীবন দশ রকমভাবে এগিয়ে চলেছে।অনেকদিন পর মন খুলে সকলে সকলের মনের কথাগুলি বলতে পেরে অনেকটাই হালকা হয়েছে।সবার শেষে পালা ছিল নবনীতার।
 নবনীতা আবারও শুরু করলো,
-- আমি তো চোখ বন্ধ করে মন্ত্র উচ্চারণ করে চলেছি হঠাৎ আমি টের পেলাম আমার জোর করা হাতের মধ্যে কেউ একটা ছোট কাগজের টুকরো গুঁজে দিলো।বুকটা ধরাস করে উঠেছিল তখন।হঠাৎ করেই কাঁপতে শুরু করি।এদিকওদিক তাকিয়ে এমন কাউকে দেখতে পেলাম না যাকে এই কাজের নায়ক ভাবতে পারি।খুব তাড়াতাড়ি কাগজের টুকরোটা তুলে ব্লাউজের ভিতর লুকিয়ে ফেলি।কোন রকমে অঞ্জলী শেষ করে তোদের সকলের সাথে প্রসাদ খেয়ে বাথরুমে গিয়ে ঢুকি কাগজের টুকরোটা পড়বার জন্য।
বুঝতেই পারছিস জীবনের প্রথম প্রেমপত্র।বুকটা কেমন যেন উথালপাথাল করছে।
 সুস্মিতার আর দেরি সহ্য হয়না।সে নবনীতার কথার মাঝখানেই বলে বসে,
--- আরে আমরা সকলেই জানি এগুলো।তুই আসল কথাটা বল। কাগজটাতে কি লেখা ছিল?
--- সেটাই তো বলছি।কোনদিন তো একথা কাউকেই বলতে পারিনি।আজ তোদের সব বলবো বলেই তো আমি এমন একটা প্রস্তাব রেখেছিলাম তোদের কাছে যে সব্বাইকে বলতে হবে তার জীবনের এমন কোন ঘটনা যা সে নিজে ছাড়া আর কেউ জানেনা।যাকগে তারপর শোন। আস্তে আস্তে কাগজটা খুলে পড়তে লাগলাম --
 নিতা,
  আমি তোমায় খুব ভালোবাসি।আমি অনেকদিন ধরে তোমায় কথাটা বলবো ভাবছি কিন্তু সুযোগ হয়নি।তাই আজ তোমার স্কুলেই চলে এলাম।এটা অবশ্য আমারও স্কুল।আমি সেনাবাহিনীতে চাকরি পেয়ে গেছি।আমি তোমার পড়াশুনা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে রাজি আছি। কাল সন্ধ্যায় আমার ট্রেন।মোবাইল নম্বর দিলাম।তোমার মতামত জানিও আজই।তুমি ফোন না করলে বুঝবো আমাকে তুমি পছন্দ করো না।
 নিচুতে সুনীলের নাম লেখা।
অপরূপা বলে উঠলো,
-- এই কোন সুনীল রে ?সেই আমরা সবাই যাকে উত্তম কুমার বলতাম?
--- হ্যাঁ।
 তখন আমি বললাম, "তারপর গেছিলি তুই?"নবনিতা উদাস হয়ে বললো,
--- আমরা তো সকলেই সুনীলকে পছন্দ করতাম সেই সিক্স,সেভেন থেকেই।তখন ওর চেহারার প্রতি ছিলো আমাদের আকর্ষণ।সেই আকর্ষণ থেকেই কিন্তু প্রত্যেকেই ওর প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েছিলাম বড় হয়ে।ভাবলাম বাড়িতে গিয়ে মায়ের ফোন থেকে সুযোগ বুঝে ফোনটা করবো।কাগজটা আবার যথাস্থানে রেখে বাড়ি গেলাম।আমার দূর্ভাগ্য এমনই বাড়িতে পৌঁছে শুনি বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে সবাই হাসপাতালে।কোন রকমে ঘরে ঢুকে একটা সালোয়ার কামিজ পরেই মাসীর সাথে হাসপাতাল পৌঁছালাম।তখন আমার মনেই ছিলনা ওই কাগজের টুকরোটার কথা।বাবা ভেন্টিলেশনে চলে গেলেন সেদিন।সাতদিন ছিলেন ভেন্টিলেশনে।তারপর সব শেষ।
 সব কাজ মিটে যাওয়ার পর ওই নম্বরে বহুবার ফোন করেছি।সব সময়ই শুনেছি সুইচ অফ।আজও আছে নম্বরটা আমার কাছে।এখন শুনি নম্বরটার কোন অস্তিত্ব নেই।মাঝে মাঝেই মোবাইলে সুনীল নয় সুনিলা বলে সেভ করে রাখা নম্বরটাই নিজের অজান্তেই কল হয়ে যায়।সঠিক নামে সেভ করতে পারিনি ভয়ে।
 নবনীতা চুপ করে গেলো।আমরাও চুপ করে দেখতে লাগলাম নবনীতার চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়ছে।শুধু নবনীতা নয় আমাদের সকলের অন্তর ভেদ করে দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়তে লাগলো।

জীবনের প্রতি বাঁকে (চতুর্থ পর্ব)

জীবনের প্রতি বাঁকে (চতুর্থ পর্ব)

 অমরেন্দ্রনাথ মুখার্জী পড়লেন মহাফাপরে।তিনি তার শ্যালককে বেশ ভালোভাবেই চেনেন।নরম স্বভাবের মানুষ হলেও বেআইনি কিছু দেখলেই তার মাথাটি গরম হয়ে ওঠে।শ্যালক  এই বাঁচাল ছেলেটিকে যে কিছুতেই নিজের জামাই করবেন না,এটা তিনি ভালোভাবেই বুঝে ফেলেছেন।আর মনোতোষ যে ছেলের সাথে তার মেয়ের বিয়ের কথা বলছে তার সম্মন্ধে কিছু না জেনেই বা তিনি রাজি হন কিভাবে?আর ওদিকে তার শ্যালকটি চিৎকার,চেঁচামেচি করেই চলেছেন।মনোতোষের বাবা মা ছেলের এই কান্ড দেখে পুরো চুপসে গেছেন।তাদের মুখে কোন কথা নেই।
 অমরেন্দ্রনাথবাবু অনেক সাহস সঞ্চয় করে তার শ্যালকের কাছে এগিয়ে গিয়ে হাতদুটি ধরে বললেন,
--- শোনো ভাই আমার একটা অনুরোধ রাখো।ছেলেটিকে সেই ছোটবেলা থেকেই তো আমরা জানি।ওর চরিত্রের তো কোন খুদ নেই।কিন্তু ও একটু ডাকাবুকো স্বভাবের ছেলে।সত্যি কথাটা মুখের উপর বলতে বিন্দুমাত্র ভয় পায়না।বলি কি ভাই তুমি সায়নীর জন্যই ওকে আশীর্বাদ করে যাও।দেখো সেন্ট্রাল গভর্মেন্ট এর ভালো  চাকরি করে ,দেখতে শুনতেও ভালো। দোষ তো ওই একটাই শেষ মুহূর্তে এসে শুভ কাজে বাগড়া দিলো।এটা ক্ষমা করে দেওয়া যায়।
--- কি বলছো তুমি অমরদা?এত ঔদ্ধত্য যে ছেলের সে কখনোই ভালো হতে পারে না।আমি কিছুতেই জেনেশুনে মেয়েকে জলে ভাসিয়ে দিতে পারবো না।
  এরপর ওখানে আর যারা উপস্থিত ছিলেন তারা সকলে মিলে অমরেশবাবুকে বুঝাতে শুরু করলেন।অবশেষে তিনি রাজি হলেন।তার বাহুতে এক ভরির একটা সোনার পদক ছিল তিনি তাই দিয়েই মনোতোষকে আশীর্বাদ করে আসলেন এই শর্তে যে তিনি তাকে সোনার বোতাম দেবেন তখন ওই পদক তাকে ফেরৎ দিয়ে দিতে হবে।তবে এ কথাও তিনি তাকে জানিয়ে আসলেন যদি কোনদিন মনতোষের কারণে তার সানুর চোখ থেকে জল পড়ে তাহলে আজকের কথা স্মরণ করে তিনি তাকে পুলিশে দেবেন।
  মনতোষের খোঁজ দেওয়া ছেলের খবর নিয়ে বা অন্য কোন ভালো পাত্রের সন্ধান পেয়ে যাতে ওই তারিখেই তার বোনের মেয়েটিরও বিয়ে হয় সে ব্যবস্থা তিনি করবেন সে কথা তার ভগ্নিপতিকে দিয়ে আসেন।
 বাড়িতে ফিরে আসতে আসতে তিনি অনেক কথায় ভাবছিলেন।কি করে তিনি মেয়ে সায়নী ও পরিবারের সকলের সামনে কথাটা বলবেন।মেয়েকে নিজের পায়ে দাঁড় না করিয়ে তিনি বিয়ে দেবেন না বলেছিলেন।এখন তিনিই কিনা হঠাৎ করেই মেয়ের বিয়ে ঠিক করে আসলেন।বাড়িতে পৌঁছেই তো একটা প্রবল ঝড়ের সম্মুখীন হতে হবে।নানান কথা ভাবতে ভাবতে তিনি যখন নিজ বাড়ি পৌঁছলেন তখন সন্ধ্যা হয় হয়। তাঁর মা তখন তুলসীতলায় সন্ধ্যাবাতি দেখাচ্ছেন। আস্তে আস্তে মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন।রঙ্গিনীবালা তাঁর ছেলে ক্ষেতোকে (তিনি তাঁকে এই নামেই ডাকতেন)ভালো ভাবেই চিনতেন।ছোট থেকে সে কোন অন্যায় করলেই মায়ের গা ঘেঁষে ঘোরাফেরা করতো।কিন্তু এই বয়সে এসে সে এমন কি কান্ড করেছে যা আগেই মায়ের কাছে স্বীকার করতে এসেছে।তিনি ছেলের মুখের দিকে তাকালেন।
  অনেক চেঁচামেচি,সায়নীর কান্নাকাটি ঝামেলার পর সায়নী যখন জানতে পারে যে মনোতোষের সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে তখন সে চুপ করে।আর ওদিকে খোঁজ খবর নিয়ে মনোতোষের বলা ছেলের সাথেই ওই তারিখেই বিয়ে ঠিক হয় তাঁর বোনের মেয়ের।খোঁজ খবর নিয়ে জানা যায় সে অত্যন্ত ভদ্র ছেলে।মামাবাড়িতে মানুষ।এখন তার দণ্ডকারন্য পোষ্টিং।বিয়ে করে সে বউকে ওখানেই নিয়ে যাবে।
 অমরেশবাবু পুনরায় চলে এলেন শহরে।তার মুহুরী অমৃতলাল পালের সাথে সব সময়ই মেয়ের বিয়ে সংক্রান্ত লিষ্ট আর আলোচনা করেই চলেছেন।ওদিকে বাড়িতে বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ কেটে প্যান্ডেলের ব্যবস্থা শুরু হয়েছে।বাড়িতে প্রতিদিন চার থেকে পাঁচজন লেবার কাজ করেই চলেছেন।আর তখনকার দিনে বাড়িতে লেবার কাজ করা মানেই দুবেলা তাদের পেটপুরে খেতে দিতে হত।শ্বাশুড়ী,বউয়ের দম ফেলার সময় নেই।পাশের দরিদ্র দত্ত বাড়ির বিধবা রতন দত্তের বউ সব সময়ের জন্য রায় চৌধুরী বাড়িতে ফাইফরমায়েস খেটে চলেছে।প্রথম বর্ষে পড়তে পড়তেই সায়নীর পড়া গেলো বন্ধ হয়ে।তার বিয়ে এগিয়ে এলো।
 বিয়ের দিন সকালে ছজন জেলে নিয়ে তিন পুকুর থেকে বড় বড় রুই,কাতলা ধরা হয়।মাছ বাজার থেকে কিনে আনতে হয়না।বড় মেয়েটির সময়ও তাই হয়েছে।বড় মেয়েটি কিন্তু তার মেজো বোনের বিয়েতে আসতে পারেনি।কারণ বড় জামাইয়ের পোষ্টিং ছিল ত্রিপুরা শহরের এক আদিবাসী এলাকায়।তার প্রথম সন্তানটি তখন খুবই ছোট।আর অসুস্থ্যও বটে।তাকে নিয়ে প্লেনে ওঠা মানে নিজের হাতের মুঠোয় তার জীবনটিকে নিয়ে ওঠা।এই একটা কারণে বাড়ির সকলের ছিল মন খারাপ।
দুপুরের দিকে হলুদ নিয়ে জনাদশেক উপস্থিত।তারা এই যে এলো আর ছেলের বাড়ি ফিরে গেলনা।কারণ বিয়েটা হচ্ছিলো গ্রামের বাড়ি থেকেই।আর ছেলে তো এখন থাকে শহরে।তাই পথের ধকল তারা আর নেবে না বলে ওই দশজন লোক দুপুর থেকেই তাদের ভুরিভোজ সারতে লাগলো।তাতে অবশ্য রায় চৌধুরী পরিবারের কিছুই যায় আসে না।কারণ তাদের অর্থের কোনো অভাবই ছিলনা।
 সব জায়গাতেই ভালোমন্দ কিছু মানুষ থাকে।বরযাত্রী আসা মানুষদের মধ্যেও তার ব্যতিক্রম ছিলনা।কিছু দুষ্টু মানুষজন বিয়েবাড়িতে থেকে যাওয়ার কারণে নানান ধরনের কুকীর্তি করতেও বিরত থাকতো না।স্বভাবতই মেয়ের বাড়ির লোকজন তটস্থ থাকতো কখন কি বিপদ বাঁধিয়ে ফেলে তারা।হলুদ নিয়ে আসা কিছু অল্পবয়সী ছেলেগুলি যে ছিল তারা প্রত্যেকেই এক একটা বাদর।বাড়িতে অল্পবয়সী মেয়ে অনেকগুলো।তাছাড়া তাদের বন্ধুরা সব।এই ছেলেগুলো তাদের প্রচন্ডভাবে বিরক্ত করতে লাগলো।অমরেশবাবুর কাছে এক মেয়ে গিয়ে নালিশ করাতে তিনি গেলেন প্রচন্ড ক্ষেপে।তাকে সামাল দিলেন তার স্ত্রী শান্তিলতাদেবী।তিনি শান্তভাবে তাকে বোঝালেন এই ব্যাপারটা ম্যানেজ তিনিই করবেন।নিজের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে তিনি হলুদ নিয়ে আসা অতিথিদের কাছে গিয়ে তাদের মধ্যে সব থেকে বয়স্ক মানুষটিকে সমস্যার কথা জানান।আর তাতেই কাজ হয়।তিনি তার সাথে আসা ছেলেদের সাবধান করে দেন।তারা সে কথা শোনে পরবর্তীতে আর কোন অসুবিধা হয়না।
 যাহোক বিয়েবাড়ির হৈ হট্টগোল চলার মাঝে ঠিক সন্ধ্যার দিকে বাড়িতে বর এসে হাজির।তখনকার দিনে এত গাড়ির রমরমা ছিলনা।তাই রিক্সাতেই বর আসে বিয়ে করতে।সাথে লোকজন স্টেশন থেকে নেমে চার কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে।সে রাতে বিয়ের পর সকল বরযাত্রীরাই কনের বাড়িতে থেকে যেতেন।পরেরদিন সকাল,দুপুরের ভোজ সেরে তবে তারা বর কনের সাথেই বাড়ি ফিরতেন।

 বর আসাতে ঘরের বউ,ঝিরা গেটের কাছে ছুটে যায় তাকে বরণ করতে।মনোতোষ গ্রামের ছেলে হওয়ার কারণে তাকে অনেকেই চিনতো।কিন্তু রিক্সায় যে বসে আছে সেতো মনোতোষ নয়।

ক্রমশঃ 
  

Thursday, October 7, 2021

জীবনের প্রতি বাঁকে (তৃতীয় পর্ব)

জীবনের প্রতি বাঁকে (তৃতীয় পর্ব)
   (আমার এ উপন্যাসটি আত্মজীবনী বলতে পারেন।এটা সম্পূর্ণ আমার পরিবারের ঘটনা।যা আমার জন্মের অনেক আগে থাকতেই ঘটেছে।সমস্ত ঘটনায় সত্যি।অমরেশবাবু আমার জন্মদাতা।একজন মহান মানুষের কথা সন্তান হিসাবে লিখে যাওয়া শ্রেয় বলে মনে করলাম।এই অধ্যায়ে যে মনীষীর কথা আমি লিখলাম এমন অনেক ঘটনায় আমি আপনাদের জানাবো যা আমার বাবুর জীবনে ঘটেছিলো।ভালো লাগলে জানাবেন উৎসাহ পাবো।)

   মানুষের সাংসারিক জীবনটা যতই সুখের হোকনা কেন;অভাব,দুঃখ না থাকলেও ঘাত-প্রতিঘাত কিন্তু থেকেই যায়।
 সে যাত্রায় ভারতী এক অলৌকিক শক্তি বলে নিমাইবাবুর আগমনের ফলে সম্পূর্ণ সুস্থ্য হয়ে উঠে।পরিবারের সকলেই ঈশ্বর বিশ্বাসী,নানান পূজা-পার্বণ রঙ্গিনীবালা দেবীর কারণে লেগেই আছে।অমরেশবাবু কিন্তু কোন ঘটনায় যুক্তিতর্কের বাইরে বিশ্বাস করতেন না।এই ঘটনায় তিনি পুরো স্তব্ধ হয়ে গেছিলেন।তার কাছে ওই বৃদ্ধা বা সাইকেল আরোহীর কোন ব্যাখ্যায় ছিল না।আজীবন তিনি এই ব্যাপারটা নিয়ে ভেবে গেছেন।
 এরপর নিমাইবাবু রায় চৌধুরী পরিবারের ছেলেমেয়েদের কাছে শুধুমাত্র নিমাইদা বলেই পরিবারের খুব কাছের একজন হয়ে উঠেছিলেন।
 রোজ সকালে সাত্রাগাছি থেকে ট্রেন ধরে অমরেশবাবু ধর্মতলা ব্যাংকসাল কোর্টে আসতেন। এমনই একদিন তার অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যায়।শেষ ট্রেনের আশায় তিনি শিয়ালদা স্টেশনে অপেক্ষা করতে করতে চা খাওয়ার জন্য তিনি একটি চায়ের স্টলে আসেন।চায়ের অর্ডার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।হঠাৎ সেখানে টুপি মাথায় দিয়ে সাহেবী পোশাকে এক ভদ্রলোক এসে দাঁড়ান।স্টল মালিক তার মুখের দিকে তাকিয়ে তার হাতে অমরেশবাবুর জন্য তৈরি করা চা টা তাঁর হাতে ধরিয়ে দেন।অমরেশবাবু স্বভাবতই একটু বিরক্ত হন।স্টল মালিক ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তার দিকে হাত তুলে তাকে কিছু একটা ইঙ্গিত করেন যা তিনি বুঝতে পারেন না।তিনি সাহেবের মুখের দিকে ভালোভাবে তাকান।চমকে ওঠেন! এ কাকে দেখছেন তিনি!এত সেই ব্যক্তি - যার ভয়ে সমগ্র ইংরেজ রাজত্ব কম্পমান!তিনি এদিক ওদিক তাকিয়ে সাহেবের দিকে একটু এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে যাবেন ঠিক এই মুহূর্তে বয়ামের উপর চায়ের পয়সাটা রেখে তড়িৎ গতিতে সাহেব সেখান থেকে বেরিয়ে যান।কিন্তু পরমুহুর্তে সেখানে ইংরেজ সেপাইয়ে সেপাইয়ে ছয় লাফ।
 --- এখানে সাহেবী পোশাক পরা কাউকে দেখেছেন যিনি মাথায় একটি ক্যাপ পরে ছিলেন?
 একজন প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন অমরেশবাবুর দিকে।ততক্ষণে যা বোঝার বোঝা হয়ে গেছে অমরেশবাবুর।তিনি সরাসরি অস্বীকার করলেন যে সেখানে কোন সাহেব আসেননি।তারপর তারা স্টল মালিক এবং আশেপাশে যারা ছিলেন সকলকেই নানান প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে হতাশ হয়ে ফিরে যান।স্টল মালিক ইশারায় অমরেশবাবুকে ওখান থেকে দ্রুত চলে যাওয়ার জন্য বলেন।
 সেদিনের ওই ক্যাপ পরা সাহেব গোছের যে ভদ্রলোকটি ছিলেন তিনি আর কেউ নন স্বয়ং নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস।যিনি শিয়ালদহ স্টেশনে এলে একমাত্র ওই দোকান থেকেই চা খেতেন।এরপর বহুবার অমরেশবাবু তাকে একটু চোখের দেখা দেখার জন্য ইচ্ছাকৃত ওই স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে থেকেছেন কিন্তু তাঁর দেখা আর কোনদিনও পাননি।তবে বেশ কয়েকমাস পরে ওই স্টলটি তিনি বন্ধই দেখেছেন।আশেপাশে অনেক জানতে চেয়েও তিনি কোন সদুত্তর পাননি।তার জীবনে স্বচক্ষে নেতাজীকে দেখা ছিল এক গর্বের বিষয়।যা তিনি সুযোগ পেলেই অন্যের সাথে গর্বভরে গল্প করেছেন।
   সায়নী তখন কলেজে পড়ছে।অমরেশবাবুর পিসতুতো বোনের মেয়ের বিয়ে ঠিক হল।বোনের বাড়িতে কথা হল অমরেশবাবু গিয়ে আশীর্বাদ করবেন।কারণ সম্পর্কে তিনি মামা আর যেহেতু তাঁর পরিবার ছিলো খুলনা জেলা।এই জেলার মানুষের একটা ধারণা প্রচলিত আছে যেকোন শুভকাজ মামার দ্বারা শুরু হলে তা সেই ছেলে বা মেয়ের পক্ষে সেটা খুব সুখের হয়।মেয়েটির নিজের মামা ছিলেন না তাই তারা অমরেশবাবুকেই এই কাজের দায়িত্ব দেয়।তিনি সানন্দে সেই দায়িত্ব পালন করার জন্য সেখানে নিদিষ্ট দিনে হাজিরা দেন।কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল তিনি যখন ছেলের বাড়িতে আশীর্বাদের জন্য উপস্থিত হলেন তখন দেখলেন এ পরিবারের প্রতিটা সদস্যকেই তিনি চেনেন।তাদের মূল বাড়ি ওই পিলজঙ্গ গ্রামেই।যাকে তিনি আশীর্বাদ করতে গেছেন সে চাকরি পাওয়ার পর তার মা,বাবাকে গ্রামের একান্নবর্তী পরিবার থেকে এনে শহরে সামান্য একটু জমি কিনে সেখানে বাড়ি করে রয়েছে।যদিও ছেলে চাকরি করে দন্ডকারন্য।তারজন্য অবশ্য তাদের গ্রামের বাড়ির নিজেদের অংশটা শরিকের কাছেই কমদামে বিক্রি করে দিয়ে আসতে হয়েছে।অমরেশবাবুর বোন সুবলাদেবীর স্বামীও তার সাথে ছিলেন।তাদের বাড়িও ওই পিলজঙ্গ গ্রামের পরেই আর একটি গ্রাম বেতাগা য় ছিল।আশীর্বাদ শুরু হল।ছেলের মাথায় হাত ছোঁয়াতে গেলে ছেলে অমরেশবাবুর হাত চেপে ধরলেন।
--- কি হল বাবা তুমি হাত ধরলে কেন?
মনোতোষ সরাসরি অমরেশবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল,
--- আমার এখন মনেহচ্ছে এই বিয়েটা করা ঠিক হবে না।
--- এটা কি ইয়ার্কি হচ্ছে নাকি?
--- আসলে কাকু,আমি আপনার মেয়ে সায়নীকে ভালোবাসি।আপনাদের বাড়িতে বাবা,মা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গেছিলেন।আপনি সরাসরি জানিয়ে দিয়েছিলেন 'দণ্ডকারন্য সীতার বনবাস হয়েছিলো।তাই আপনি আপনার ঘরের লক্ষিকে ওখানে বিয়ে দেবেন না।এবার ছুটিতে বাড়ি আসার পরে আমার বাবা,মা ও নাছোড়বান্দা আমার বিয়ে দিয়ে তবে ওখানে পাঠাবেন।আমার আপত্তি শর্তেও তারা এই মেয়ের সাথে বিয়ে ঠিক করলেন।আমিও নিরুপায় ছিলাম।কিন্তু আজ যখন আপনাকে এখানে দেখলাম তখনই মনেমনে ঠিক করে নিয়েছিলাম আশীর্বাদ পর্ব শুরু হলেই আমি আপনাকে জানাবো।আপনি যদি রাজি থাকেন তবে আমায় আশীর্বাদ করুন।আর তানাহলে এ বিয়ে হবে না।
অমরেশবাবু আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।এবং পরিস্কার সকলকে জানিয়ে দিলেন,"এত ঔদ্ধত্যসম্পন্ন ছেলের সাথে কোন মেয়ের বিয়েই হবে না।এই ছেলের বিরুদ্ধে আমি মানহানির কেস করবো"
শোলগোল হৈ হট্টগোলের মধ্যে কেউ আর কারো কোন কথা শোনে না। অমরেশবাবুর ভগ্নিপতির মাথায় তখন আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে।তার মেয়ের বিয়ের আয়োজন তখন প্রায় শেষের পথে।সব জায়গায় টাকা বায়না দেওয়া হয়ে গেছে।আত্মীয়স্বজন পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে মুখে চুনকালি পড়বে।মনোতোষ তখন তার ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তাকে আলাদাভাবে বাইরে ডেকে নিয়ে গেলো কিছু কথা বলতে চায় বলে।
--- দেখুন মেসোমশাই আমি জানি আমি যা করছি সেটা ঠিক নয়।বাবা মায়ের জেদের কাছে নতি স্বীকার করে মনেমনে ভেবেই নিয়েছিলাম আপনার মেয়ের সাথে আমার বিয়ে হলে জীবন দুটোই নষ্ট হবে।কারণ আমি সেই স্কুল লাইফ থেকেই সায়নীকে ভালোবাসি।কিন্তু অমরেশবাবু যেহেতু তার মেয়ের বিয়ে আমার সাথে দিতে রাজি হননি তাই বাবাকেও আমি আর বুঝাতে পারিনি।তিনি এই ঘটনায় প্রচণ্ড অপমানিত বোধ করেন।আপনি চিন্তা করবেন না।ওই তারিখেই আপনার মেয়ের বিয়ে হবে একই পোষ্টে চাকরি করা ছেলের সাথে। তারও দণ্ডকারন্য এ পোষ্টিং।আপনি শুধু কাকুকে একটু রাজি করান।



ক্রমশঃ 

Tuesday, October 5, 2021

জীবনের প্রতি বাঁকে (দ্বিতীয় পর্ব)

 জীবনের প্রতি বাঁকে (দ্বিতীয় অধ্যায়)
   প্রতিটা মানুষের জীবনই এক একটা মস্তবড় উপন্যাস।কেউ যদি তার লেখনী ক্ষমতা দ্বারা তার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলি ভাষাক্ষরে লিপিবদ্ধ করেন তাহলে প্রত্যেকেই এক একটি উপন্যাসের জন্ম দিতে পারেন।অমরেশ রায় চৌধুরীকে কেন্দ্র করে শুধু তার জীবন নয়,তার ছেলেমেয়ে,স্ত্রী,বাবা,মা এবং পারিপার্শ্বিক নানান ঘটনায় এ গল্পের মূল উপজীব্য বিষয়।
  সায়নী গ্রামের স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করার পর বাড়ির সকলের অমতে অমরেশবাবু তার মেজমেয়েকে নিয়ে শহরে ঘরভাড়া করে মেয়েকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দেন।তখনকার দিনে মাধ্যমিক পাশ করার পর কলেজেই ভর্তি হতে হত।কিন্তু সায়নীর মন থেকে মনোতোষের শেষদিনের বলা কথাগুলি মাঝে মাঝেই মনে পরে।
  অমরেশবাবুর প্রতিটা মেয়েই যতই আদর যত্নের মধ্যে মানুষ হোকনা কেন তাদের মা এবং ঠাম্মা তাদের প্রত্যেকেই সংসারের উপযুক্ত করে গড়ে তুলেছেন।তাই মেয়েকে নিয়ে তিনি যখন ঘরভাড়া করে শহরে থাকতে শুরু করলেন বাবা,মেয়ের রান্না,খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে কোনোই অসুবিধা ভোগ করতে হলনা।কলেজ এবং পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে সায়নী তার বাবুর যত্নটাও ঠিকভাবেই সম্পন্ন করতো। ঠিকে কাজের একজন মহিলা অবশ্য থাকতো।
  সায়নী যখন কলেজে অমরেশবাবুর সেজমেয়েটি তখন ক্লাস টেন। ভারতী তার দিদির মত অতটা ডানপিঠে না ঠিকই কিন্তু দুষ্টুর শিরোমণি।পড়াশুনায় খুব একটা ভালো না হলেও কখনো ফেল করে একই ক্লাসে সে দুবার থাকেনি।সংসারের কাজকর্ম জানা থাকলেও সে প্রতি মুহূর্তেই সেগুলিকে এড়িয়ে একটু পাড়ায় পাড়ায় ঘুরতেই পছন্দ করতো।স্কুল ছুটি থাকলে তাকে বাড়িতে কেউ আর খুঁজে পেতো না।পাড়ার ধোপা বাড়ি ,নাপিত বাড়ি,দত্ত বাড়ি --- ঘুরে ঘুরে বেড়ানোই ছিল তার কাজ।তবে কোন বাড়িতে ভাত খাওয়া ঠাকুমার ছিল বারণ।তখনকার দিনে ব্রাহ্মণ বাড়ির মানুষেরা অন্য জাতের হাতের অন্ন খাওয়া মানেই ছিলো জাত যাওয়া।অমরেশবাবুর বাবার মৃত্যুর পর নিষ্ঠাবান বিধবা রঙ্গিনীবালা রান্নায় হলুদ পর্যন্ত ব্যবহার করতেন না।কারণ ওটা ছিলো রঙ্গিন।বাড়ির মেয়েরাও ঠাকুমার কথা অমান্য করতো না।কিন্তু অন্য খাবার খাওয়ায় কোন আপত্তি ছিলনা রঙ্গিনীবালার।
  ভারতী মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন। এমনই সময় একদিন বৃষ্টির মধ্যে সারা পারা ঘুরে বেড়ানোর কারণে রাতে প্রচণ্ড কাপুনি দিয়ে জ্বর এলো।শ্বাশুড়ী,বউ মিলে যেটুকু ডাক্তারী বিদ্যা তাদের জানা ছিল তারা তা প্রয়োগ করেও কিছু করতে পারলেন না।সকালবেলা বছর মাইনের বীরেন মান্নাকে শহরে পাঠালেন তার বাবুকে খবর দেওয়ার জন্য।বীরেন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘণ্টা দুয়েক বাদে বাড়িতে একজন ডক্টর এসে হাজির হলেন।নাম বললেন নিমাই দাস।তিনি আরও জানালেন সকাল আটটা নাগাদ একজন বৃদ্ধা তার চেম্বারে এসে তাকে জানান অমরেশবাবুর মেয়ের শরীর খুব খারাপ।আমি যেন সেই মুহূর্তেই তার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যাই।কলকাতা থেকে গ্রামের বাড়ির দূরত্ব ষোলো কিলোমিটার।ট্রেনে বারো কিলোমিটার।ট্রেন থেকে নামার পর আরো চার কিলোমিটার।যা সাধারণত হেঁটেই লোকে যাতায়াত করে।আবার অনেকে রিক্সাতে করেও আসা যাওয়া করে।তবে সংখ্যায় খুবই কম।কিন্তু ট্রেন থেকে নেমে তিনি দেখেন একজন মধ্য বয়স্ক ভদ্রলোক সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তাকে নিয়ে আসার জন্য।সরাসরি তাকে গিয়ে প্রশ্ন করেন,
--- আপনি পিলজঙ্গ গ্রামে যাবেন তো?অমরেশবাবুর মেয়ের চিকিৎসার ব্যাপারে?
 নিমাইবাবু তার সাইকেলে করে সেই বাড়ির গেটের অর্থাৎ আড়কাঠার কাছে নেমে হেঁটে উঠানে এসে দাঁড়ান।যে ভদ্রলোক তাকে নিয়ে এসেছিলেন তিনি রাস্তা থেকেই 'কাজ আছে'- বলে চলে যান।নিমাইবাবু উঠানে দাঁড়িয়েই ঘর থেকে কান্নার আওয়াজ পান।তিনি তখন মনেমনে ভাবেন হয়ত এত পরিশ্রম করে এসেও চিকিৎসার কোন সুযোগই তিনি পেলেন না।তিনি হতভম্বের মত ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকেন।ভারতীর পরের বোন মালতী তাকে দেখতে পেয়ে ঘরের ভিতরে নিয়ে যায়।যখন তিনি অত দূর থেকে রোগী দেখতে এসেছিলেন তখন কিন্তু তিনি জানতেন না রোগীর কি রোগ হয়েছে।কিন্তু আসবার সময় কিছু প্রয়োজনীয় ওষুধের সাথে একটা ইনজেকশন ও তার ব্যাগে রেখেছিলেন।সেই সময়ে নিউমোনিয়া রোগটা চারিদিকে প্রায় ছেয়ে গেছিলো।তিনি ভারতীকে ইনজেকশন দিয়ে যখন সেখানে অপেক্ষা করছেন তার চোখ মেলে তাকানোর জন্য সেই সময়ে অমরেশবাবু তার বন্ধু ডক্টর সুশীল দেকে নিয়ে রিক্সা করে বাড়িতে আসেন।তারা এসে নিমাইবাবুকে দেখে অবাক হয়ে যান।নিমাইবাবুর কাছে তার এখানে আসার বিবরণ সবিস্তারে জেনেও কেউই বুঝে উঠতে পারলেন না কে সেই বৃদ্ধা যে অত সকালে তাকে তার চেম্বারে গিয়ে খবর দিলো।শুধু তাই নয় কে তাকে স্টেশন সিংগাতি থেকে এ পর্যন্ত সাইকেলে বসিয়ে নিয়ে আসলো।সবই বাড়ির লোকের কাছে কেমন ধোঁয়াশা মনে হতে লাগলো।আর এই নিমাইবাবুকে দেখে ডক্টর সুশীলবাবু ও অমরেশবাবুর আরও অবাক হওয়ার কারণ যেটা তা হল নিমাইবাবু কোন পাশ করা ডাক্তার নয়।তিনি একদম ছোট থেকে ডাক্তার সুশীলবাবুর কাছে কম্পাউন্ডার হিসাবে কাজ করেছেন। কথায় বলে ' হাতে কর্মে শিক্ষায় হল বড় শিক্ষা।তারজন্য পুঁথি পড়বার দরকার পরেনা।' তিনি ডাক্তার দে র কাছে থেকে থেকে নিজের মেধা শক্তির গুনে কোন রোগের কি ওষুধ তা ভালোভাবেই জানতেন।পরিস্থিতি তখন এমন দাঁড়িয়েছিল রাতবিরেতে কেউ অসুস্থ্য হলে যাদের ডাক্তার দে কে ভিজিট দেওয়ার ক্ষমতা থাকতো না বা তিনি যেতে অস্বীকার করতেন তখন তারা নিমাইবাবুর শরণাপন্ন হত এবং রোগী সুস্থ্যও হয়ে উঠতো।কিন্তু এ খবর যখন ডাক্তার দে র কানে পৌঁছায় তখন তিনি নিমাইবাবুর সাথে খুবই খারাপ ব্যবহার করেন। যার ফলস্বরূপ তিনি ডক্টর সুশীল দে কে পরিত্যাগ করেন। নিমাইবাবুর এই ঘটনা জানতে পেরে একজন স্বর্ণকার তার দোকানের এক কোণে এক চিলতে জায়গা দেন সে যাতে সেখানে বসে রোগী দেখতে পারে।তার কারণও হচ্ছে এই স্বর্ণকারের বৃদ্ধা মা যখন মরণাপন্ন ছিলেন আর সুশীলবাবু ছিলেন শহরের বাইরে তখন নিমাইবাবুই তার মায়ের চিকিৎসা করে সুস্থ্য করে তুলেছিলেন।সেই কৃতজ্ঞতা বশত তিনি তাকে নিজেই প্রস্তাব দিয়েছিলেন তার দোকানের এককোনে বসবার জন্য।
সুতরাং নিমাইবাবুকে এ বাড়ির অধিকাংশ লোকেই চিনত।তাকে দেখে অমরেশবাবু খুশি হলেও ডক্টর সুশীলবাবু মোটেই খুশি হতে পারেননি।তিনি বলেই বসলেন একাকী যখন অমরেশবাবুকে পেলেন,
--- বড় ডাক্তার এসে গেছে তাহলে তো এখানে আমার কোন কাজ নেই।আমি তাহলে চলি।
 অমরেশবাবু বুঝতে পারলেন তার বন্ধুটি বেশ বেজার হয়েছেন।তিনি হাসি মুখে তাকে পুকুরের মাছ দিয়ে দুপুরে খাওয়াদাওয়া করে বেরোনোর জন্য অনুরোধ জানান।এদিকে মালতী দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে চিৎকার করে তার বাবাকে ডাকতে শুরু করলো,
--- বাবু,বাবু তুমি কোথায়?তাড়াতাড়ি এদিকে এসো।


ক্রমশঃ 
 

Saturday, October 2, 2021

জীবনের প্রতি বাঁকে (প্রথম পর্ব)

জীবনের প্রতি বাঁকে (প্রথম অধ্যায়)
  বর্ষণক্লান্ত ধরণী বসন্তে এসে শান্তির নিশ্বাস ফেলে।বর্ষার আরম্ভ হতেই মধু বসন্তের জন্য মানুষ পাগল হয়ে ওঠে। অবশেষে বহুদিন পরে শেষটায় ফাগুন এসে সাক্ষাৎলাভ
হয় বসন্তের।কাননে কান্তারের,বৃক্ষে বৃক্ষে নতুন পত্র,নতুন পুষ্প,নতুন মাধুর্য।বসন্ত প্রকৃতি মানুষের হৃদয় মনকে আলিঙ্গন করে চঞ্চল উদ্দামতায়- হৃদয়ে জাগায় পুলক শিহরণ।
  প্রকৃতির নিয়মে বসন্ত আসে একমাত্র প্রকৃতিতেই।কিন্তু
 মানুষের জীবনে বসন্ত আসার জন্য দিনক্ষণ,নিয়মকানুনের কোন দরকার পড়ে না।যে কোন সময়,যে কোন বয়সেই মনের বসন্তের ঠিকানা মেলে।
  কিছুদিন ধরেই মনোতোষ সায়নীকে বেশ লক্ষ্য করছে এটা একমাত্র সায়নী ছাড়া স্কুলের বাকি ছেলেমেয়েদের নজর এড়ায়নি।ডাকাবুকো স্বভাবের সুন্দরী সায়নীকে বলতে গেলে সকলেই একটু ভয় পেয়েই চলে।তবে তার খুব কাছের কয়েকজন সহপাঠী তাকে স্কুল চত্বরে ঘটে যাওয়া নানান ঘটনা জানাতে বিন্দুমাত্র ভুল করে না।সায়নীর মধ্যে একটা বিশেষ গুন হল যে কারো বিপদে-আপদে ঝাঁপিয়ে পড়া।গ্রামের অবস্থাপন্ন ঘরের সুন্দরী মেয়ে হওয়ার কারণেই হোক আর ক্লাসে ফাষ্ট গার্ল হওয়ার কারণেই হোক স্কুলের শিক্ষক,শিক্ষিকা সহপাঠী সকলেই তাকে খুব ভালোবাসে।
  অমরেশ রায় চৌধুরীর প্রচুর জমিজমা।জমিদারী বংশ বলে কথা!ছেলের আশায় পরপর ন'টি মেয়ে।অর্থের কোন অভাব নেই তাই বছর বছর বাড়িতে মেম্বার সংখ্যা বেড়ে যাওয়াতে তার বা তার পরিবারের কোন চিন্তাও নেই।তখনকার দিনে অল্প বয়সেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিত তাদের পরিবার কিন্তু অমরেশবাবু তার মেয়েদের বিয়ের ব্যাপারে কোন চিন্তা ভাবনায় করতেন না।স্ত্রী এবং তাঁর মা যখন মেয়েদের বিয়ের কথা বলতেন তার একটাই উত্তর ছিলো," আমি আমার মেয়েদের লেখাপড়া শেষ না করিয়ে বিয়ে দেবো না।কোথায় কার হাতে গিয়ে পড়বে,তার পরিবার কেমন হবে; ভাতের থালা সামনে নিয়ে চোখের জল ফেলবে -- এসব আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারবো না।তারজন্য আমার মেয়েদের আমি সাবলম্বী করে তবেই বিয়ে দেবো।"অনেকে আবার ব্যঙ্গ করে অনেক সময় বলতেন,' অমরেশবাবুর মেয়েগুলি সব দুধভাত খাওয়া বাচ্চা।ওরা কোনদিনও উনার কাছে বড় হবেনা।"
 আজ থেকে বেশ কয়েক যুগ আগে অমরেশবাবুর এহেন কথাবার্তায় পাড়ার অনেকেই আড়ালে-আবডালে তার সমালোচনা করলেও তিনি কোনদিনও সে সব ব্যাপারে ভ্রুক্ষেপ করেননি।আর যেহেতু তার অর্থের কোন অভাব ছিলোনা এবং তিনি ছিলেন একজন পরোপকারী মানুষ;বিপদে-আপদে যে যখন তার কাছে ছুটে এসেছে তিনি তাদের কখনোই খালি হাতে ফেরাননি।তাছাড়াও আরও একটি কারণ ছিল - কর্মজীবনে তিনি ছিলেন একজন উকিল।অধিকাংশ সময়ে গ্রামের লোকেরা জমি সংক্রান্ত ব্যাপারে নানান ঝামেলায় ফেঁসে যেতেন।তিনি সেই সব মানুষের কেস লড়তেন সম্পূর্ণ বিনা অর্থে।সপ্তাহের পাঁচদিন তিনি শহরে ঘরভাড়া করে একাই থাকতেন।সপ্তাহান্তে শনিবার কোর্ট করে তিনি তার গ্রামের বাড়িতে যেতেন।তার স্ত্রী,মা এবং বাবা ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো নিয়ে গ্রামের বাড়িতেই থাকতেন।অমরেশবাবুর রোজগারে যে সংসার চলতো তা কিন্তু মোটেই নয়।প্রচুর জমিজমা থাকার ফলে সংসার চালানোর যাবতীয় উপার্জন ওইসব জমিজমার থেকেই পেয়ে যেতেন।তিন তিনটে পুকুর,বছর মাইনের কাজের লোক।জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পরেও কিন্তু তার পরিবারটি জমিদারী চালেই চলতো।
 কিন্তু তখনকার দিনে দশ,থেকে এগারো বছর বয়স হলেই গ্রামের লোকেরা অর্থাৎ মেয়ের বাবা,মা তাদের বিয়ের পিড়িতে বসিয়ে দিতেন।তিনি তাঁর বাবাকে যুক্তি,তর্ক দিয়ে বুঝাতে সক্ষম হলেও মায়ের সাথে পেরে না উঠতে পেরে এগারো বছর বয়সেই বড় মেয়েটির বিয়ে দিতে বাধ্য হন একজন স্কুল শিক্ষকের সাথে।বয়সের পার্থক্য চৌদ্দ বছরের।
  সায়নী তার মেজ মেয়ে।মনোতোষ মাধ্যমিক পাশ করে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে বেশ ভালো চাকরি পেয়ে বাইরে চলে যায়।কিন্তু কর্মক্ষেত্রে চলে যাওয়ার আগে একদিন সে সায়নীর সাথে দেখা করে।সায়নীকে সে তার মনের কথা জানায়। সায়নী সে বছর মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী।
--- যদি তোমার আপত্তি না থাকে আমার বাড়ির থেকে তোমাদের বাড়িতে প্রস্তাব নিয়ে আসবে।
বন্ধুদের মাধ্যমে মনোতোষের মনের খবর সায়নী আগেই পেয়ে গেছিলো।তার উপর একদিন টিফিন পিরিয়ডে ফুটবল খেলতে গিয়ে মনোতোষ যখন পায়ে ব্যথা পেয়েছিলো সেদিন তার ব্যথা সারানোর জন্য সকলের সাথে সায়নীই অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলো।দুজনের চোখাচোখি হলেও সায়নী সে ব্যাপারটাকে কোন পাত্তাই দিয়েছিল না।কিন্তু আজ সরাসরি মনোতোষ যখন রাস্তায় তাকে একা পেয়ে প্রস্তাব দেয় তখন ক্ষণিকের জন্য হলেও তার কিশোরী মনে অদ্ভুত এক ভালোলাগা কাজ করে।পরমুহূর্তেই সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
--- কিসের আপত্তি আর কিসের প্রস্তাব দুটোর একটাও বুঝলাম না।
--- সত্যিই কি তুমি কিছু বুঝতে পারছো না?
 সায়নী সরাসরি মনোতোষের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
--- না,সত্যিই আমি বুঝতে পারছি না।
--- বুঝতে পারছো না নাকি সরাসরি আমার কাছ থেকে জানতে চাইছো?
--- ভনিতা না করে সরাসরি বললেই তো হয়।ওহ্ আচ্ছা আচ্ছা তুমি চাকরি পেয়ে গেছো সেটাই বলতে এসেছো?
 সায়নী কথাটা বলে মনেমনে হাসতে লাগল।বেশ মজা লাগছে তার।এই কিশোরীবেলায় প্রথম প্রেমের কথাটা সে মনোতোষের মুখ থেকেই শুনতে চাইছে।মনোতোষ ব্যাপারটা বুঝতে পারলেও সায়নীর সাথে কথা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সেও ভনিতা করেই চলেছে।পরিস্থিতি 'সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি'-।এটা নিয়েই কথা বলতে বলতে তারা হাঁটতে থাকে।সায়নী তার বাড়ির কাছে ততক্ষণে চলে এসেছে। বড় রাস্তা থেকে অনেকটা হেঁটেই নিজেদের জমির উপর দিয়ে বেশ খানিকটা হেঁটেই তাদের বাড়ি আসতে হয়।গ্রামের বাড়িগুলো যে রকম হয় আর কি?বড় আড়কাঠাটি সরাতে সরাতে সায়নী মনতোষের দিকে ফিরে বললো,
--- সত্যি কথা বলার সৎসাহস নেই তোমার।যদি কোনদিন সরাসরি তোমার মনের কথাটা বলতে পারো সেদিনই আমার সামনে এসে দাঁড়িও।
মনোতোষ কিছুটা সায়নীর কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো,
--- বলতে আমি এখনি পারি।তাহলে শোনো ---
 ঠিক এই সময়ে সায়নী তাকিয়ে দেখে পাড়াতুতো এক কাকা তাদের বাড়িতে ঢোকার জন্য পা বাড়িয়েছেন।সায়নী মনতোষকে কিছু বলার সুযোগ আর না দিয়েই তার দিকে একটু তাকিয়ে ওই কাকার সাথে কথা বলতে বলতেই বাড়ির দিকে পা বাড়ালো।মনোতোষ সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সেও তার নিজ পথ ধরে তবে নিশ্চিন্ত মনেই যে সায়নী তাকে প্রত্যাখ্যান করেনি।
 সায়নী মনতোষের সামনে থেকে চলে এলো ঠিকই কিন্তু প্রথম ভালোলাগার পরশটা তার মনে রয়েই গেলো।মনোতোষ তার হৃদয়ে অসময়েই বসন্তের লাল আবিরে রঞ্জিত করে তার কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায়।
 সায়নী সেবার ছিল মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী।সারা সপ্তাহে নিজে না পারা বিষয়গুলি জমিয়ে রাখতো তার বাবুর জন্য।প্রত্যেক ছেলেমেয়েই অমরেশবাবুকে বাবা না বলে বাবু বলেই ডাকতো।আর অমরেশবাবু তার মেয়েদের মা বলে এমনভাবে ডাকতেন যে তার ডাক শুনে মনে হোত প্রতিটা মেয়েই যেন তার গর্ভধারিনী।

ক্রমশঃ