জীবনের প্রতি বাঁকে (নবম পর্ব)
এক একটা মানুষের জীবনীএক একটা উপন্যাস বলা যেতেই পারে।সেই মানুষটাকে জড়িয়ে বাকি যারা রয়েছেন ঠিক তাদের জীবনী নিয়েও ছোট ছোট গল্পের সমন্বয়ে আরো বেশ কয়েকটি উপন্যাস তৈরি হতে পারে।আমার এই উপন্যাসটিও ঠিক তাই।পরিবারের মাথা অমরেশবাবু হলেও তাকে ঘিরে আর যারা রয়েছেন তাদের জীবনের সমস্ত ঘটনাগুলিও কিন্তু মস্ত বড় গল্প বা এক একটি উপন্যাস।
সায়নীকে নিয়ে আমার উপন্যাস শুরু হলেও আস্তে আস্তে অনেক চরিত্রেরই অবতারণা হয়েছে।পরবর্তীকালে সায়নীর জীবনে কি ঘটেছিল শুধুমাত্র সেই ঘটনার কথায় জানাবো আপনাদের আজ।
মনোতোষের সাথে সংসার করতে গিয়ে সায়নী বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারে আদতে মানুষটা খুবই ভালো।তার মন,মানসিকতা একটি সরল নিষ্পাপ শিশুর মত।কেউ চোখে জল নিয়ে কিছু তাকে বুঝালে সে সেটা সরল মনেই মেনে নেয়।তার নানান ফাঁদে পা দেওয়া এটাই মস্তবড় কারণ।
এই দিপালী মেয়েটি সুন্দরী,শিক্ষিত।মনোতোষকে সে পছন্দ করে এবং তাকেই সে বিয়ে করতে চায়।কিন্তু মনোতোষ স্কুল জীবন থেকে সায়নীকে ভালোবেসে এসেছে।আর তাকেই বিয়ে করতে চেয়েছে।কিন্তু হঠাৎ করে দিপালী তার জীবনে এসে যাওয়ার পড়ে মনোতোষের অবস্থা দাঁড়ায় " শ্যাম রাখি না কুল রাখি গোছের "-।সে যখন দন্ডকারন্য থেকে বাড়িতে আসে তখন বাবা,মায়ের চাপে বিয়েতে মত দেয় কারণ তার আগেই সায়নীর বাবা "সীতার বনবাস হয়েছিল যেখানে সেখানে তিনি কোন অবস্থাতেই তার সানুর বিয়ে দেবেন না"- জানিয়ে দেন। এ কথায় তার বাবা,মা অপমানিত বোধ করেন এবং চোখ ভরা জল নিয়ে ছেলেকে সে কথা বুঝাতেও সক্ষম হন।তাই বিয়েতে মত দেওয়া।
নানান কাঠ-খড় পুড়িয়ে যখন সায়নীর সাথে তার বিয়ে হয় সে কিন্তু তাকে সাথে করেই নিয়ে যেতে চেয়েছিল।কিন্তু এখানেও মনোতোষ পিছলে যায় তার বাবা,মায়ের চোখের জলে।সে বাধ্য হয় সানুকে রেখে যেতে।সানুর কাছে কিন্তু কোন কথায় সে স্বীকার করে না যে তার বাবা,মায়ের মত নেই বলেই সে তাকে নিয়ে যেতে পারছে না।আর তখন তার মনের মধ্যে সব সময়ের জন্য একটা ভয় কাজ করতো তাহল এই যে কথায় কথায় সানুর বাবা যে কেসের ভয় দেখান যদি সেটা সত্যিই হয় তাহলে তার সরকারি চাকরি নিয়ে টানাটানি বেঁধে যাবে।কারণ তখন তার বয়সটাও খুব কমই ছিল তাই কি থেকে কি হবে ;সব সময়ের জন্যই মনের ভিতরে একটা ভয় কাজ করতো।এদিকে অমরেশবাবু যখন তার মেয়েকে হঠাৎ করেই পাঠিয়ে দিলেন তখন সত্যিই মনোতোষ কিন্তু কোয়ার্টারের জন্য চেষ্টা করছিল।কিন্তু দিপালী কিছুতেই সানুকে নিয়ে সংসার করাটা মেনে নিতে পারছিলো না।ওই যে আগেই বললাম মনোতোষকে যে কেউ যে কোন কথা বুঝিয়ে ফেলতে পারে কেঁদে-কেটে একসার হয়ে যদি তাকে সে বিষয়ে বোঝায়।তাই একটু হলেও কোয়ার্টার পাওয়ার ব্যাপারে মনোতোষের গড়িমসি ছিল।কিন্তু সায়নী যখন ঘর ভাড়া নিয়ে তার সাথে থাকতে চাইলো তখন সে মুখে কিছু না বললেও মনেমনে কিন্তু খুশিই হয়েছিল।
মুখচোরা স্বভাবের মানুষগুলিকে নিয়ে যারা সংসার করে একমাত্র তারাই বলতে পারে এদের নিয়ে জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে চলতে গেলে নিজেকেই সব জায়গায় ভিলেন সাজতে হয়।আর এর কারণ হচ্ছে এই মুখচোরা লোকগুলো অন্যের হ্যাঁ তে হ্যাঁ আর না তে না করার ফলে ঘরের অন্য মানুষটাকেই সেই কথাগুলি সঠিক জায়গায় আনতে গেলেই চরিত্রের নাম হয়ে পড়ে ভিলেন।তাই অধিকাংশ জায়গাতেই সায়নী খুব বাজে মানুষ হলেও মনোতোষ কিন্তু ভীষণ ভালো মানুষ।এটা যে মনোতোষের কোন দোষ তা কিন্তু নয়।আর পরবর্তীকালে সায়নীরও ব্যাপারটা গা সওয়া হয়ে গেছিলো।
প্রথম সন্তান তাদের মেয়ে।তার যখন বছর খানেক বয়স তখন দীপালীর বিয়ে ঠিক হয়।দিপালী অফিসে এসে মনোতোষের কাছে সোনার কানের ঝুমকো দুল দাবি করে।মনোতোষ বাড়িতে গিয়ে সায়নীকে সে কথাও গল্প করে।সায়নী তখন তাকে বলে,
--- ভালো তো ।তুমি একবারে একই রকমের দুটো ঝুমকো দুলের অর্ডার করো।আমার ইচ্ছা আমিও ওর মত দুল পরবো।আর ওটা পরেই আমি ওর বিয়েতে যাবো।
এই ব্যাপারটা মনোতোষ কিন্তু বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারে।মনোতোষের সৎ সাহস ছিল ঠিকই কিন্তু কথার ঘোরপ্যাচ সে বুঝতো না।তাকে কিছু বলতে গেলে সোজা সাপ্টা না বললে সে কখনোই বুঝতে পারতো না।কিন্তু সায়নীর সাথে সংসার করতে করতে সায়নী তাকে নিজের হাতে অনেকটাই নিজের মনের মত করে গড়ে নিতে সক্ষম হয়েছিল।বুদ্ধিমান মনোতোষ তার চরিত্রের দোষ ত্রুটিগুলো নিজেই সংশোধন করে নিতে পেরেছে।পরবর্তীকালে সে এই রায় চৌধুরী পরিবারে অনেকগুলি জামাইয়ের মধ্যে ছিল অন্যতম জামাই।অমরেশবাবুর প্রিয় জামাই ছিলেন এই মনা।
মেয়ের বয়স যখন বছর তিনেক তখন তাদের আর একটি ছেলে হয়। তারও প্রায় বছর চারেক পরে আর একটি মেয়ে।কিন্তু ছেলে যখন পেটে তখন ভারতী আসে তার দিদির কাছে।সে তার চাকরীটা ছেড়ে দিয়েই আসে ভালো কোন চাকরির আশায়।সে যে এখানে থাকতে এসেছিল সেও কিন্তু মনোতোষের কথায়।তখন অমরেশবাবুর বয়স হয়েছে বেশ অনেকটাই।মেয়েরা সবই বড় হয়ে উঠেছে।শুধুমাত্র আজকের দিনেই যে মেয়েদের পথেঘাটে নানানভাবে হেনস্থা হতে হয় তা কিন্তু নয় আগেও এ জিনিস ছিল,এখনো আছে শুধুমাত্র কম আর বেশি।
ভারতী চাকরি করতো একটি প্রাইমারি স্কুলে।মর্নিং স্কুল ছিলো।খুব ভোরে ট্রেন ধরে তাকে স্কুলে যেতে হত।সেও একদিন ইভটিজিংয়ের সম্মুখীন হয়।আর তখনই তার বাবু তাকে চাকরি ছেড়ে দিতে পরামর্শ দেন।সেই সময় মনোতোষ বাড়িতে ছিল এবং তার পরামর্শ মতই সে তার দিদির বাড়িতে গিয়ে ওঠে।
সায়নীর বড় মেয়েটি গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর নিজে পছন্দ করে বিয়ে করে।তবে সায়নী এবং মনোতোষ বেশ জাকজমক করেই তাদের বিয়ে দেয়।তবে ছেলেটি তার জীবনে সেভাবে কিছুই কোনদিন করে উঠতে পারেনি।কিন্তু প্রেমটা বেশ ভালোভাবেই রপ্ত করেছিলো।তাই মেয়ের বাড়ির চাপে বিয়ে করতেও বাধ্য হয়েছিল।যেহেতু মনোতোষ ভালো চাকরি করতো আর বেশ বড়োলোকের ছেলের সাথে ছোট মেয়েটির বিয়ে হয়েছিলো আর এক এক্সিডেন্ট এ ছোট মেয়ের শ্বশুরবাড়ির সকলেই মারা গেছিল শুধুমাত্র তাদের মেয়েটি ও নাতিটি ছাড়া।তাই এই বিপুল অর্থ ওই বেকার বাউন্ডুলে ভায়ের পিছনেও কম খরচ হয় না।
সায়নী এবং মনোতোষের জীবনে সবচেয়ে দূর্ভাগ্য যেটা তা হল তাদের জীবনদশায় তাদের দু,দুটি মেয়ের বৈধব্য মেনে নেওয়া।জীবন সুখের বলা যেতে পারে তখনই যখন সন্তান প্রতিপালন করার পর বেঁচে থাকতে তাদের সুখী দেখা।বাবা,মায়ের সামনে নিজের সন্তান অসুখী বা দুঃখকষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকলে তাদের সেই দুঃখকষ্ট শত গুণ হয়ে নিজেদের বুকে আঘাত হানে।আর এইখানেই তাদের জীবনের চরম ব্যর্থতা নেমে আসে।সায়নী ও মনোতোষ ততদিনই সুখী জীবন কাটিয়েছেন যতদিন না তাদের ছেলেমেয়ে বড় হয়ে উঠেছে।ছেলেমেয়ে একটু একটু করে বড় হয়ে উঠেছে আর তাদের জীবনের চাহিদা,ভালোমন্দ নিয়ে সায়নী ও মনোতোষ তাদের অতিকষ্টে খুঁজে পাওয়া সুখ একটু একটু করে হারাতে শুরু করেছে।
ক্রমশঃ