Saturday, December 28, 2019

 কিছু  প্রিয়জন  ছাড়া  
আরও একটা  বছর  কেটে  গেলো,
 যখন  কাছে  ছিল  তারা  
 তাদের  ছাড়া  বাঁচতে  পারবো  ভাবিনি  |
 অথচ  হাসি  আনন্দেই  দিব্যি আছি -
 তবে  কখনও কখনও মনের মাঝে  
 একরাশ  শূন্যতা  আষ্ঠেপৃষ্ঠে  জড়িয়ে  থাকে|

                মানবী  

Friday, December 27, 2019

কিছু সম্পর্কের নাম হয়না



  কিছু  সম্পর্কের  নাম  হয়না  

     নন্দা  মুখাৰ্জী  রায়  চৌধুরী  

    আটটা পাঁচের  বনগাঁ  লোকাল  ট্রেনটা  ধরে  রোজ  অফিস  আসা সায়নের| কত  চেনা  অচেনা  মানুষের  সাথে  রোজ  দেখা| জীবিকার  প্রয়োজনে, রোগের সাথে  যুদ্ধের  কারনে, স্কুল  কলেজের ছাত্রছাত্রী  শিক্ষক  শিক্ষিকা   নিত্য  অফিসযাত্রী  --- কত  কত  হাজার  লোক  নিত্যদিন  ট্রেন  বা  বাসে যাতায়াত  করছে| কেউ  কারোই  মনের  খবর  জানেনা| রোজ ঘড়ি  ধরে  যাতায়াতের  কারনে  অনেক  অপরিচিত  মানুষও পরিচিত  হয়ে  যায়| একসাথে  পাশাপাশি  বসে  কখনও রাজনীতি, কখনও পারিবারিক  সমস্যা  আবার  কখনোবা  সামাজিক--- ইত্যাদি  নানান  ধরণের  আলোচনা ---- পারিবারিক  নানান  সমস্যায়  " প্রয়োজন  হলে  বলবেন  "-- কথাটা  সামান্য  হলেও  মানসিক  বল  পাওয়ার  জন্য  যথেষ্ট-- হয়তো  সেভাবে  কাউকেই  পাশে  পাওয়া  যায়না  কিন্তু  সাময়িক  পরিচয়ের  সূত্র  ধরে  অনেকের  বিপদের  দিনে  এই  কথাটুকুই  অনেক  পাওয়া  | আজও পৃথিবীতে  যে  ভালো  মানুষ  আছে  আমরা  প্রত্যেকেই  কিন্তু  কোন  না  কোন  সময়  নিজেরাই  টের  পাই| হয়তো  এই  ভালো  মানুষের  সংখ্যাটা  খারাপ  মানুষের  তুলনায়  খুবই  নগন্য  কিন্তু  সংখ্যাটা  যতই  নগন্য হোকনা  কেন  তাদের  জন্যই পৃথিবীটা  আজও এতো  সুন্দর  | প্রতিটা  মুহূর্তেই  আমরা  টের  পাচ্ছি  অর্থের  লোভে  নিজের  স্বার্থ  চরিতার্থ  করার  জন্য  মানুষ  আস্তে  আস্তে  কত  হিংস্র  আর  ভয়ঙ্কর  হয়ে  উঠছে  | কিন্তু  তবুও  আজও কিছু  কিছু  মানুষ  নিজের  কথা  না  ভেবে  অন্যের  বিপদে  নিজেকে  সপে  দিতে  এক  মুহূর্তও ভাবেননা | 
    সায়নের সাথে  প্রায়ই  দেখা  হয়  নীলিমা  নামের  এক  ভদ্রমহিলার  | ভদ্র  , শিক্ষিত  , মার্জিত  | বয়স  প্রায়  পঁয়ত্রিশের  মধ্যেই  হবে  | মধ্যমগ্রাম  থেকে  ওঠেন  আর  শিয়ালদহ নামেন  | স্কুল  শিক্ষিকা | দেখা  হলেই  একগাল  হেসে  পরে  সায়নের সাথে  কুশল  বিনিময়  করেন  | মাঝে  মধ্যে  বসার  জায়গা  পেলে  নানান  বিষয়ে  কথা  হয়  | নীলিমাদেবীর  একটি  মাত্র  ছেলে  রহড়া রামকৃষ্ণ বিদ্যালয়ে  পড়াশুনা  করে  | স্বামী  ব্যাংকের  উচ্চপদস্থ  কর্মচারী  | তিনজনের  সুখী  পরিবার  | 
   সায়নের বয়স এই  আঠাশ  কি  ঊনত্রিশ  বছর  | বছর  খানেক  হোলো বিয়ে  করেছে  | সংসারে  মা  , বাবা  সে  ও  তার  বৌ  | নীলিমাদেবীর  সাথে  অধিকাংশ  দিন  দেখা  হওয়ার  সুবাদে  অসম  বয়সী  হওয়া স্বর্তেও  দুজনের  মধ্যে  বেশ  একটা  বন্ধুত্ব্যর সম্পর্ক  গড়ে  ওঠে  | ভালো  একটা  মাল্টিন্যাশনাল  কোম্পানিতে  চাকরি  করে  সে  | ইচ্ছা  করলে  গ্রামের  বাড়ি  ছেড়ে  দিয়ে  সে  তার  পরিবার  নিয়ে  কলকাতা  শহরে  ঘর  ভাড়া  করে  থাকতেই  পারে  এবং  আর্থিক  সে  ক্ষমতা  তার  আছে  | কিন্তু  কোনদিনও তার  সে  রকম  কোন  ইচ্ছা  জাগেনি  | শহরের  মানুষগুলোর  মন  মানসিকতার  চাইতে  গ্রামের  সহজ  সরল  মানুষগুলোর  মন  মানসিকতা  অনেক  ভালো  | তাদের  দুচোখে  যেন  সর্বদা  সরলতা  প্রকাশ  পায় | ছুটির  দিনগুলোতে  বছরভর  মাইনে দেওয়া  মাঠে  কাজ  করা  নিধুকাকুর  সাথে  হাতে  হাত  লাগিয়ে  কাজ  করতে  তার  আজও ভালো  লাগে  | ভালো  লাগে  ঝুড়ি  ভর্তি  করে  জমি  থেকে  তুলে  আনা সব্জিগুলি  দেখে  মা  বাবার  হাসি  হাসি  মুখটা  দেখতে  | তাই  বাড়ি  ছেড়ে  শহরে  যাওয়ার  ইচ্ছা  তার  কোনদিনও ছিলোনা  আজও নেই  | গ্রামে  সকলের  কাছে  ভালো  ছেলে  বলেই  পরিচিত  সে  | যে  কোন  মানুষের  বিপদে  আপদে  ঝাঁপিয়ে  পড়া  তার  মজ্জাগত  | 
   একদিন  অফিস  ছুটির  পর  বাড়ি  ফেরার  ট্রেন  ধরবার  জন্য  শিয়ালদা  স্টেশনে  এসে  জানতে  পারলো  কি  এক  গন্ডগোলের  কারনে  পরপর  বেশ  কয়েকটি  ট্রেন  বাতিল  হয়েছে  | বসে  বসে  তাই  স্মার্টফোনটা নিয়ে  ফেসবুক  করে  চলেছে  | সকলের  কথাবার্তায়  যা  তার  মনে  হল  বাস  ও  বন্ধ  | বাসে  করে  যারা  যাবে  ভেবেছিলো  তারা  বাস  স্টপেজ  থেকে  ফিরে আসছে  | তাদের  মধ্যে  দেখতে  পেলো  নীলিমাদেবী  ও  আছেন  | তিনি  সেই  দুপুর  থেকে  একবার  বাসস্টপেজ  আর  একবার  স্টেশন  চত্ত্বর  করে  বেড়াচ্ছেন  | অনেকের  মতই তারা  দুজনেও  অথই সমুদ্রে  পড়েছেন  | স্টেশন  চত্ত্বরে  হাজার  হাজার  লোক  গিজগিজ  করছে  | অনেকে  আবার দল বেঁধে  বেঁধে  আশেপাশের  হোটেলগুলোর  দিকে  সকলে  মিলে ভাগাভাগি  করে  থাকার  ব্যবস্থা  করতে  ছুটছেন  | সে  এক  অসহনীয়  পরিস্থিতি  | যার  যার  বাড়িতে  ফোন  করে  জানিয়ে  দিয়েছে  সায়ন ও  নীলিমাদেবী  | নীলিমাদেবীর  উদ্ভিগ্ন  স্বামী  তাকে  বারবার  অনুরোধ  করেছেন  একটা  ট্যাক্সি  ডেকে  তার  বোনের  বাড়ি  গড়িয়া  চলে  যাওয়ার  জন্য  | নীলিমাদেবীর  শত অনুরোধ স্বর্তেও  সায়ন তার  সাথে  যেতে  রাজি  হয়না  | কিন্তু  সে  ট্যাক্সি  ধরে  দেওয়ার  জন্য  নীলিমাদেবীকে  নিয়ে  স্টেশন  ছেড়ে  রাস্তায়  এসে  দাঁড়ায়  | রাত তখন  প্রায়  বারোটা  | হঠাৎ  একটি  প্রাইভেট  গাড়ি  এসে  তাদের  সামনে  দাঁড়ায়  আর  কিছু  বুঝে  ওঠার  আগেই তিনটি  ছেলে  নীলিমাদেবীকে  জোর  করে  গাড়ির  ভিতর  উঠাতে চেষ্টা  করতে  থাকে  | ঘটনার  আকস্মিকতায়  সায়ন প্রথম  অবস্থায়  কিছুটা  ঘাবড়ে  গেলেও  মুহূর্তেই  সে  সম্বিৎ  ফিরে পেয়ে  ছেলেগুলির  উপর  ঝাঁপিয়ে  পরে  | ছেলেগুলি  তখন  নীলিমাদেবীকে  ছেড়ে  দিয়ে  সায়নের উপর  চড়াও  হয়  | এলোপাথাড়ি  চড়, ঘুসি  , লাথি মারতে  থাকে  | আর  ঠিক  এই  ফাঁকে  নীলিমাদেবী  একটু  সরে  গিয়ে  চিৎকার  করতে  থাকেন | ছুটে আসে  অগণিত  রেলযাত্রী  আর  রেলপুলিশ  | পালিয়ে  যায়  তিন  দুষ্কৃতী  | সায়নের কাছে  এগিয়ে  এসে  দেখে  সে  জ্ঞান  হারিয়েছে  | সকলের  সহায়তায়  তার  জ্ঞান  ফিরে আসলে  সকলে  ধরাধরি  করে  স্টেশনে  নিয়ে  গিয়ে  একটি  বেঞ্চে তাকে  শুইয়ে  দেয় | নীলিমাদেবীর  ব্যাগেই ছিল  প্যারাসিটামল  650 | তিনি  একটি  ওষুধ  তাকে  খাইয়ে  দেন  | পরদিন  ট্রেনের  সমস্যা  মেটার  পর  প্রথম  ট্রেন  ধরেই  নীলিমাদেবী  সায়নের সমস্ত  রকম  আপত্তিকে  অগ্রাহ্য  করে  তাকে  বাড়িতে  পৌঁছে  দিয়ে  তারপর  তিনি  নিজের  বাড়িতে  যান  | 

 দিনপনের  পরে  একদিন  রবিবার  দেখে  নীলিমাদেবী  ও  তার  স্বামী  সায়নদের  বাড়িতে  আসেন  | অবশ্য  এর  আগেই  সায়ন কিছুটা  সুস্থ্য  হয়ে  অফিসে  যাতায়াত  শুরু  করলে  তাদের  আবারো  নিত্য  দেখা  সাক্ষাৎ  হতে  থাকে  | দুটি  পরিবারের  মধ্যে   এখন  নিকট  আত্মীয়ের  মতই সম্পর্ক  | মানুষের  বিপদে  সত্যিকারের  মানুষ  যে  পাশে  দাঁড়ায়  আজও তার  প্রমান  পাওয়া  যায়  |


  #আমার_লেখনীতে  তোমায়_মনে  রাখবো... সময়  

Sunday, December 22, 2019

পাশে আছি

 
পাশে  আছি  

      নন্দা  মুখার্জী  রায়  চৌধুরী  

    প্রায়  বছর  পাঁচেক  পরে  গ্রামে  ফেরা  সুশোভনের| আসবার  ইচ্ছা  মোটেই  ছিলোনা| কিন্তু  মা  বারবার  করে  বাবার  শরীর  খারাপের  কথা  বলছেন  | তাই  আসতে বাধ্য  হওয়া| গ্রামের  ছেলে  সুশোভন  ভালোবেসেছিলো  গ্রামেরই  মেয়ে  অর্পিতাকে| দুক্লাস  উঁচুতে  পড়তো  সুশোভন| মাধ্যমিক  পাশ  করার  পরই অর্পিতার  বিয়ে  দিয়ে  দেয় তার  বাড়ির  লোক| তখন  সুশোভন  উচ্চমাধ্যমিক  দিয়েছে| কিছুই  করার  ছিলোনা  তখন  সুশোভনের| অসহায়ের  মত  দেখেছিলো  মা, বাবা  আর  বোন  খুব  সেজেগুজে  অর্পিতার  বিয়ের  নিমন্ত্রণ  খেতে  যাচ্ছেন| আর  সে  নিজে  শরীর  খারাপের  অজুহাতে  দরজা  বন্ধ  করে  চোখের  জলে  বালিশ  ভিজিয়েছে| বিয়ের  কথাবার্তা  যখন  চলছে  তখন  অর্পিতা  একদিন  এসে  সুশোভনের  কাছে  খুব  কান্নাকাটি  করেছিলো| কিন্তু  সুশোভনের তখন  কিছুই  করার  ক্ষমতা  ছিলোনা| অসহায়, নিরুপায়  দুটি  তরুণ  তরুণী  বুকে  পাথর  চাপা  দিয়ে  সবকিছু  মেনে  নেওয়ার  চেষ্টা  করেছিলো মাত্র| 
  গ্রামের  পথে  বাড়ির  উর্দ্যেশ্যে  হাঁটতে হাঁটতে সেই  সব  কথা  ভীষণভাবে  মনে  পড়ছিলো  সুশোভনের| গ্রামের  স্কুল  থেকে  পাশ  করে  উচচতর  শিক্ষা  লাভের আশায়  কলকাতা  চলে  আসার  পর  আজ  এই পাঁচ  বছর  সুশোভন  আর  গ্রামে  ফেরেনি| বারবার  মা, বাবা  আর  বোনের  অনুরোধ  উপেক্ষা  করে  বলেছে সে  আর  কোনোদিনও  গ্রামে  ফিরবেনা |
  বিটেক পড়া  শেষ  করে  কলেজ  ক্যাম্পাস  থেকেই  একটা মোটা  মাইনের  চাকরি  পেয়ে  যায়| প্রতিমাসে  বেতনের  অর্ধেক  টাকা  সে  মা  বাবার  একাউন্টে  পাঠিয়ে দেয় যদিও  তার  টাকা  তারা  খরচ  করেননা | নানান  কথা  ভাবতে  ভাবতে  সে  বাড়ির  দোরগোড়ায়  এসে  দাঁড়ালো| 
  বাবার  শরীরটা  সত্যিই  খুব  খারাপ  হয়েছিলো| বাবার  ঘরেই  সে  বসে  সকলের  সাথে  কথা  বলছিলো| খাওয়াদাওয়ার  পর  যখন  শুতে  যাবে  সে  তখন  মা  তাকে  এমন  একটা  কথা  বলে  বসলেন  যা  সে  স্বপ্নেও  কল্পনা  করেনি|
--- তোর  অর্পিতার  কথা  মনে  আছে  ?
--- কেন  বলো তো  ?
--- মেয়েটার  কপালটা  সত্যিই  খুব  খারাপ  রে -
--- কেন  কি  হয়েছে  অর্পিতার  ?
--- সে  এক  ইতিহাস| ভালো  চাকরি  ভালো  বাড়ি  দেখে  মা  মরা  মেয়েটার  বিয়ে  দিলো  ওর  বাবা  কিন্তু  মেয়েটার  কপালে  বিধাতা  সুখ  লেখেননি  | বিয়ের  পর  মদ্যপ  স্বামীর  অত্যাচারে  অতিষ্ট  হয়ে  একবার  সুইসাইডও
 করতে  গেছিলো  |  
--- তারপর  ?
--- তুই  তোর  নিজের  ঘরে  যা  আমি  এক্ষুণি আসছি  |
--- আরে তুমি  বলোনা  আমার  এখানে  দাঁড়িয়ে  শুনতে  কোন  অসুবিধা  হচ্ছেনা|
 মনের  ভিতর  তখন  তার  তোলপাড়  করছে | অর্পিতা  বিয়ের  পর  ভালো  ছিলোনা,   অর্পিতা  বেঁচে  আছে  তো? নানান  প্রশ্ন  তখন  তার  মনের  মধ্যে  উঁকি  দিচ্ছে |
--- মা  বলো তারপর  কি  হয়েছে  অর্পিতার? 
--- নিজের  হাতের  শিরা  কেটে  বাড়িতে তার  স্বামী না  থাকাকালীন  সময়ে  বেশ  কয়েকঘন্টা  নিজের  ঘরে  পড়ে ছিল| ভাগ্যিস  সেদিনই  ওর  ভাই  পুজোর  জামাকাপড়  দিতে  ওর  বাড়ি  গেছিলো | অনেক  ডাকাডাকির  পরও যখন  দরজা  কেউ  খুলতে  আসেনা  ওর  ভাই  তখন  ক্লাবের  ছেলেদের  ডেকে  দরজা  ভেঙ্গে ঘরে  ঢুকে  ওই  পরিস্থিতি  দেখে | যমে  মানুষে পনেরদিন  টানাটানির  শেষে  আবার  ওর  স্বামী  ওকে  বাড়িতে  নিয়ে  যায় | ওর  বাবা , ভায়ের  ইচ্ছা  ছিল  কয়েকটা  দিন  অন্তত  ওদের  কাছে  এসে  থাকুক | কিন্তু  কিছুতেই  ওর  স্বামী  সে  কথা  শোনেনা | হাসপাতালে  থাকার  সময়  অর্পিতার  বাড়ির  লোকেরা  ইচ্ছা  থাকলেও  ওর  কাছ  থেকে  কিছু  জানার  চেষ্টা  করেনি  কারণ  ডক্টরের  নিষেধ  ছিল | বাড়িতে  নিয়ে  গিয়ে  আবার  সেই  একই  অত্যাচার  শুরু  করে | চুপচাপ  সবকিছু  মেনে  নিতে  নিতে  পরিস্থিতি  এমনই দাঁড়ায়  আস্তে  আস্তে  নিজের  ভিতরে  নিজেকে  গুটিয়ে  নিতে  থাকে |শেষে  একদিন  ওর  ভাই  ও  বাবা  গিয়ে  ওর  স্বামীর  বিরুদ্ধাচারণ  করেই  ওকে  নিয়ে  আসতে বাধ্য  হয়  | অনেক  ডাক্তার  দেখিয়েও  কোন  লাভ  হয়নি  | সবসময়  চুপচাপ  ঘরের  মধ্যেই  বসে  থাকে  | কারো  সাথেই  কোন  কথা  বলেনা | ওর  বাবারও বয়স  হয়েছে  | অর্পিতার  চিন্তায়  চিন্তায়  তার  শরীরও ঠিক  নেই  | এদিকে  ওর  ভায়েরও  বিয়ের  বয়স  হয়েছে  | কিন্তু  অর্পিতা  সুস্থ্য  না  হওয়া পর্যন্ত  ওর  ভাই  বিয়ে  করতে  চায়না  |
--- আমাকে  কি  করতে  বলছো  ?
  মা  একটু  আমতা  আমতা  করে  বললেন,
--- ওই  যে  তোর  বন্ধু  বিপিন  আছে  না  ও  বলছিলো  ------ আসলে  আমি  তোর  বাবা  মেয়েটাকে  খুব  ভালোবাসি  --
--- বিপিন  কি  বলছিলো  ?
--- না  সে  রকম  কিছু  না  ওই  আর  কি--- তুই  একটু  কলকাতা  নিয়ে  গিয়ে  চেষ্টা  করে  দেখ  না  যদি  মেয়েটাকে  সুস্থ্য  করা  যায়  --
--- মা, বিপিন  কি  বলেছে  ?
  সুশোভনের  মা  আমতা  আমতা  করে  কয়েকবার  ঢোক  গিলে  বলেই  ফেললেন  কথাটা  | কারণ  তিনি  যখন জানতে    পেরেছেন  তার  শুভ  কেন  গ্রামে  আসতে চায়না  তখন  তো  তাকে  বাড়িমুখো  করার  আপ্রাণ  চেষ্টা  তিনি  করেই  যাবেন  |
--- বলছিলো  তোরা  তো  একই  স্কুলে  পড়তিস  যদি  তোকে  দেখলে  ওর  কোন  পরিবর্তন  হয়  নুতবা  তুই  যদি  ওকে  কলকাতা  নিয়ে  গিয়ে  বড়  ডাক্তার  দেখাস  ----
--- সেতো ওর  ভাইও  করতে  পারে  |
--- হ্যাঁ তা  পারে  কিন্তু  তুই  তো  ওকে  ভালোবাসতিস---
--- আচ্ছা  এখন  যা  তোর  ঘরে  বাকি  কথা  কাল  বলবো  |
  সুশোভনের  মাথায়  তখন  নানান  চিন্তা| মা  কি  ঠিক  এই  কারণেই  ওকে  গ্রামে  ডেকে  পাঠিয়েছেন? বাবার  এখন  বয়স  হয়েছে  নিত্য  শরীর  খারাপ  লেগেই  আছে  - তবে  কি  এবার  জোর  করেছেন  অর্পিতার  জন্যই? আসলে  মা  কি  ভাবছেন? 
    পরদিন  সকাল  হতেই  সুশোভন  অর্পিতাদের  বাড়িতে  হাজির  হয়  | অর্পিতার  ঘরে  ঢোকার  আগেই  সে  তার  বাবার  কাছ কাছ  থেকে  জেনে  যায়  অর্পিতা  কারও সাথেই  কথা  বলেনা| চুপচাপ  সবসময়  ঘরের  মধ্যে  শুয়ে  বসে  থাকে  | পরিবারের  কেউ  ছাড়া  তার  ঘরে  ঢুকলে  সেদিন  রাগে সে  সেই  বেলার  খাবার  হাত  দিয়ে  ছুঁয়েও  দেখেনা  | কিছু  জানতে  চাইলে  মাথা  নেড়ে  হ্যাঁ না  তেই জবাব  দেয়| দেখো  গিয়ে  তোমার  সাথে  কথা  বলে  কিনা  ?
  সুশোভন  দরজা  ঠেলে  ঘরে  ঢোকে  | অন্য দিকে  মুখ  করে  খাটের উপর  অর্পিতা  শোয়া  | সুশোভন  গিয়ে  খাটের উপর  বসে  | অর্পিতা  ফিরেও  দেখেনা  | সুশোভন  আস্তে  আস্তে  ডাকে  ,
--- অর্পিতা  আমি  শুভ  -- এদিকে  একটু  ফেরো 
  অর্পিতা  উঠে  বসে  শুভর মুখের  দিকে  ফ্যালফ্যাল  করে  তাকিয়ে  থাকে  | শুভ  জানতে  চায়,  
----  আমায়  চিনতে  পারছো  ?
 অর্পিতা  ঘাড় নেড়ে  হ্যাঁ জানায়  |
--- কি  হয়েছে  তোমার? আমায়  বলো সব  ঠিক  হয়ে  যাবে  আমি  এসে  গেছি  তো  --
   শুভ  হাত  বাড়িয়ে  অর্পিতার  একটা  হাত  ধরে  বলে, 
--- আমি  তোমাকে  কলকাতা  নিয়ে  গিয়ে  ডক্টর  দেখাবো  কিন্তু  তার  আগে  তো  আমায়  জানতে  হবে  তোমার  কোথায়  কষ্টটা  --- 
   অর্পিতা  এবার  হাউহাউ  করে  কেঁদে  উঠে  শুভর বুকের  উপর  ঝাঁপিয়ে  পরে| ঠিক  এইরূপ  একটি  পরিস্থিতির  জন্য  সুশোভন  মোটেই  প্রস্তুত  ছিলোনা  | ধাতস্ত  হতে  তার  কিছুটা  সময়  নিলো  তারপর  সে  আস্তে  আস্তে  অর্পিতার  মাথায়  হাত  বুলিয়ে  দিতে  লাগলো  | অর্পিতার  কান্নার  আওয়াজে  তার  বাবা  ও  ভাই  ঘরে  ঢুকে  এসে  এ  দৃশ্য  দেখে  দুজনেই  ঘর  থেকে  বেরিয়ে  যান  | এবং  দুপুর  গড়িয়ে  গেলেও  তারা  কেউই  আর  এঘরে  আসেননা  কারণ  বাইরে  থেকে  দুজনেই  শুনতে  পান  অর্পিতার  গলার  আওয়াজ  |




     

Friday, December 20, 2019

বিভ্রান্ত

বিভ্রান্ত  
       নন্দা  মুখাৰ্জী  রায়  চৌধুরী

কাঁধে  হাত  দিয়ে  ভরসা  দেওয়ার  হাতটা
 কিশোরীবেলায়  ফেললাম  হারিয়ে,
 পাশে  থাকবে  বলে  কথা  দিয়েছিলো  যে  
 সেও গেলো  যে  পালিয়ে  |
 কতশত  বন্ধু  হল   
 কেউ  দেয়না  বিশ্বাসের  মর্যাদা | 
 স্নেহ, শ্রদ্ধা,ভালোবাসা,   
 সবকিছু  আজ  দুরাশা |
 মনের  মাঝের  যন্ত্রণাগুলো  
 কুড়েকুড়ে  শুধু  খায়,
 চারিদিকে  আজ  শুধুই  আঁধার
 পালাবার  পথ  নাই  |

Wednesday, December 18, 2019

জানি আছিস

জানি  আছিস  
           নন্দা  মুখাৰ্জী  রায়  চৌধুরী  

 বয়সের  ভারে  ভুলেছি  সবকিছু,
 ভুলিনি  তোকে  আজও|
 স্মৃতির  খাতায়  জমেছে  ময়লা,
 স্পষ্ট  অক্ষরগুলো |
 বাদলের  দিনে  বৃষ্টিতে  ভেজা,
 শরতে শিউলি  তলায়, 
 সময়ের  কোন  ছিলোনা  হিসাব,
 পড়লে  মনে হৃদয়  দোলায়|
 স্মৃতির  ঝাঁপি  যতই  হাতড়াই,
 তোর ছবি  চোখে  ভাসে,
 জানি মরনের ওপার হতে   
 আজও তুই  আছিস  পাশে| 

 

Saturday, December 14, 2019

বুঝতে শিখেছি



  বুঝতে  শিখেছি  
    নন্দা  মুখাৰ্জী  রায়  চৌধুরী  

    স্বামীর  মৃত্যুর  পর  ছোট  ছোট  ছেলেমেয়ে  দুটিকে  মানুষ  করতে  অতসীর  কালঘাম  ছুটে গেছে  | দেবদূতের  মত সেদিন  যদি  গৌরীদি  পাশে  এসে  না  দাঁড়াতো  তাদের  নিয়ে  রাস্তায়  হয়তো  ভিক্ষা  করে  খেতে  হত | নুতন  বৌ  হয়ে  এ  বাড়িতে  আসার  পর  থেকেই  পাশের  বাড়ির  গৌরীদির  সাথে  অতসীর  ভাবটা  যেন  একটু  বেশিই  বলা  চলে  | নিজের  জীবনের  বিনিময়ে  গৌরীদি  তার  পুরো  পরিবারটাকে  যক্ষের ধনের মত  যেন  আগলে  রেখেছে  | গৌরীদির  বাবা  সামান্য  একটা  প্রাইভেট  ফার্মে  চাকরি  করতেন  | শ্বাসকষ্ট  জনিত  কারনে  তার  দুটো  লাঞ্ছই ব্লক  হয়ে  যায়  | দারিদ্রতার  কারণে  একবার  টিবিও হয়েছিল  | পরবর্তীতে  উত্তরাধিকার  সূত্রে  পেয়েছিলেন  এজমা | চিকিৎসা  সেভাবে  কোনদিনও করতে  পারেননি | অল্প  বয়সে  যখন  বাবাকে  হারান  তখন  মা  ছাড়াও  আরও দুটো  ছোট  ছোট  ভাইবোনের  দায়িত্ব  তার  উপর  এসে  পরে  | লেখাপড়া  বেশিদূর  করতে  পারেননি | বাবা  যখন  মারা  যান  গৌরীদির  তখন  সবে মাধ্যমিক  পরীক্ষাটা  শেষ  হয়েছে  | ব্যস পড়াশুনার  ওখানেই  ইতি  | সেলাইয়ের  দোকানে  ঘুরে  ঘুরে  প্রথম  অবস্থায়  জামাকাপড়ে  হেম সেলাই  করে  পয়সা  রোজগার  শুরু  | তারপর  ভালোভাবে  কাটিং  আর  সেলাই  শেখা | এরপর  এমব্রয়ডারি | ভাইবোন  দুটিকে  লেখাপড়া  শিখিয়ে  সংসারী  করেছে  | নিজের  দিকে  তাকানোর  আর  সময়  হয়নি  কোনদিন  | আজ  তার  বিশাল  বুটিকের  দোকান  | গৌরীদি  আজ  সম্পূর্ণ  একা | ভাই  আর  তার  বৌ  আছে  ঠিকই  কিন্তু  গৌরীদিকে তাদের  লাগে  শুধুমাত্র  টাকার  যোগান  দেওয়ার  জন্যই | 
   অতসী  তার  স্বামীকে  হারিয়ে  যখন  অথৈ  সমুদ্রে  হাবুডুবু  খাচ্ছে  ঠিক  তখনই গৌরীদি  একদিন  অতসীর  বাড়িতে  এসে  বলে  ,
--- কিরে  এইভাবে  ঘরে  বসে  থেকে  শুধু  চোখের  জল  ফেললে  চলবে?  ওদের  মানুষ  করতে  হবেনা  খেয়েপরে  বাঁচতে  হবেনা  ?
--- কিন্তু  আমার  পেটে তো  বিদ্যের  জোর  কতটুকু  সেতো তুমি  জানো দিদি  | আমি  এখন  কি  করবো  বলো এই  ছোট  ছোট  দুটি  বাচ্চাকে  নিয়ে  |
--- দূর  পাগলী  , জীবনে  ভালোভাবে  বাঁচতে  গেলে  বুদ্ধির  দরকার  , শুধু  লেখাপড়া  জানলেই  হয়না  | অনেক  বড়  বড়  শিক্ষিত  মানুষ  বেকার  হয়ে  ঘুরে  বেড়াচ্ছে  | চাকরি  ছাড়াও  এই  পৃথিবীতে  করার  অনেক  কিছু  আছে  - যেখানে  শুধু  বুদ্ধি  দিয়েই  কাজ  হাসিল  করতে  হয়  | আমার  জীবনের  গল্প  তো  সব  তোকে  বলেছি  | তুই  আমার  দোকানে  এসে  কাজ  করতে  শুরু  কর  , তারপর  আস্তে  আস্তে  আমি  তোকে  সব  শিখিয়ে  দেবো| 
   অতসীর  সেই  শুরু  সামান্য  কিছু  রোজগার  করা  | দিনে  দিনে  সে  যেমন  তার  গৌরীদির  দোকানের  মান উন্নত  করেছে  ততই  তার  আরও কাছের  প্রিয়  মানুষ  হয়ে  উঠতে  পেরেছে  আর  গৌরীদির  তত্বাবধানে  কাটিং  থেকে  শুরু  করে  এমব্রয়ডারি সবটাতেই  আজ  সে  পারদর্শী  | 
   ছেলেমেয়ে  দুটিকে  গ্রাজুয়েট  করে  বিয়েও  দিয়েছে  | ছেলে  এখন  বেশ  ভালো  চাকরি  করে  | মেয়ে  সুখেই  আছে  | মাঝে  মধ্যে  মায়ের  কাছে  এসে  দু  একদিন  করে  থেকেও  যায়  | কিন্তু  সমস্যা  শুরু  হল  ছেলের  বিয়ের  ছমাসের  মাথাতেই  | ছেলেবৌয়ের  কথামত  তাদের  বাড়িটা  লিখে  দিতে  হবে  | কিন্তু  অতসী  তাতে  বিন্দুমাত্র  রাজি  নয়  | অশান্তির  সূত্রপাত  এখান থেকেই  | সব  কথায়  সে  তার  দিদিকে  এসে  বলে  | পৃথিবীটা  যে  কত  স্বার্থপর  হতে  পারে , স্বার্থের  জন্য  খুব  কাছের  মানুষগুলো  যে  কত  ভয়ঙ্কর  হতে  পারে  আজ  অতসী  ও  গৌরী  ভালোভাবেই  তা  বুঝে  গেছে  | গৌরীর  পরামর্শ  মত  অতসী  তার  কিছু  প্রয়োজনীয়  জিনিসপত্র  নিয়ে  চলে  আসে  গৌরীর বাড়িতে  একটা  ঘরের  ভাড়াটিয়া  হয়ে  | অবশ্য  নামেই  ভাড়াটিয়া  ভাড়া  গৌরী কোনদিনও নিতোনা  | নিজের  বাড়ি  হওয়া স্বর্তেও  এই  মিথ্যার  আশ্রয়টুকু  তাকে  নিতে  হয়েছিল  তার  ভাই  ও  ভাইবৌয়ের  কারণে  | মাস গেলে  কিছু  টাকা  সে  নিজেই  তার  ভাইবৌয়ের  হাতে  গুঁজে  দিতো  অতসীর  ঘরভাড়া  বাবদ  | ব্যাস  তাতেই  ছিল  শান্তি  বজায়  | দুটি  নারী  তাদের  জীবনের  সমস্ত  আশাআকাঙ্খা জলাঞ্জলি  দিয়ে  কেউ  নারী  ছেড়া সন্তানের  জন্য  আর  কেউi  সন্তানসম  ভাইবোনের  জন্য  সমস্ত  জীবন  উজাড়  করেও  তাদের  কাছ  থেকে  বিন্দুমাত্র  সম্মান  টুকুও  পায়নি  | যতদিন  তাদের  প্রয়োজন  ছিল  ততদিনই  তারা  একটা  ভালোবাসার  মুখোশ  পরে  ছিল  | যখন  তাদের  প্রয়োজন  মিটে গেছে  ঠিক  তখনই অতি প্রিয়  কাছের  মানুষগুলোর  মুখোশও  খুলে  গেছে  | অতসী  ও  গৌরীও  বুঝতে  শিখে  গেছে  জীবনে  তারা  আর  যে  কটাদিন বাঁচবে  তাদের  শখ  আহ্লাদগুলো  মিটিয়ে  নেওয়ার  চেষ্টা  করবে  | এবার  আর  অন্যের  জন্য  নয়  বাঁচবে  সম্পূর্ণ  নিজেদের  জন্যই | পিছনের  কথা  ভেবে  আর  কাঁদবেনা  | তাই  তো  তারা  সাপ্তাহিক  দোকান  বন্ধের  দিনে  সেজেগুজে  বেরিয়ে  পরে  কোনদিন  সিনেমা  তো  কোনোদিন  বড়  কোন  পার্কে  আর  ফেরার  পথে  বড়  কোন  হোটেলে  ডিনার সেরে  | এই  বাঁধনহারা জীবনে  দুজনেই  খুব  খুশি  | অন্যদের  কথা  ভাবতে  গিয়ে  দুজনেই  ভুলে  গেছিলো  তাদের  নিজেদেরও একটা  জীবন  আছে  | আর  সেই  জীবনে  আছে  কিছু  চাহিদা  যা  এতদিন  তারা  সেই  চাহিদাগুলোকে  মর্যাদার  আসনে  বসাতে  পারেনি  বিবেকের  তাড়নায়  | এখন  অন্যের  জন্য  নয়  তারা  ভাববে  শুধু  নিজেদের  নিয়েই  | জীবন  তো  একটাই  | জীবনের  অর্ধেক  সময়  কেটে  গেছে  | বাকি  জীবনটা  মুক্ত  বিহঙ্গের  মত  কাটিয়ে  দেওয়ার  মানসিকতা  নিয়েই  এগিয়ে  চলে  মধ্যবয়সী  দুটি  নারী  |

#আমার_লেখনীতে  " অন্যের  প্রশংসার  জন্য  নয়, নিজেকে  ভালোবেসে  বদলেছি  আমি |"

Monday, December 9, 2019

পাথর চাপা

 পাথর  চাপা  
           নন্দা  মুখার্জী  রায়  চৌধুরী  

 এখন  আমার  আর  কান্না  আসেনা  
 চোখের  জল  শুকিয়ে  গেছে  
 বা  হয়তো  কাঁদতেই  ভুলে  গেছি| 
 অনুভূতিগুলো  মৃয়মান হয়ে  যাচ্ছে
 মনের  বা  শরীরের  যন্ত্ৰণা
 কোনোটাই  বুকে  আর  চেপে  বসেনা|
 চারিদিকের  সমাজের  এই  অবক্ষয়  
 আমার  সকল  অনুভূতিকে  
 দুমড়ে  মুচড়ে  ভেঙ্গে দিয়ে  
 আমাকে  বোবা  ও  কালা  করেছে|

গহীনে

    #আমার_লেখনীতে  নবরূপে  আমি    .....
  
 গহীনে  

        নন্দা  মুখাৰ্জী  রায়  চৌধুরী

       মাত্র  ছাব্বিশ  বছরের  সংসারে  বাড়ির  ভিতরটা  ছাড়া  বাইরের  জগৎ  সম্পর্কে  আমি  ছিলাম  সম্পূর্ণ  আনাড়ী| কেন  জানিনা  মানুষটির  উপর  নির্ভর  করে  থাকতেই  আমার  ভালো  লাগতো| আমি  আমার  সংসার  আর  ছেলেমেয়ে  নিয়েই  ভালো  থাকতাম| তবে  ছেলেমেয়ে যখন  থেকে  স্কুল  যাওয়া  শুরু  করলো ওদের   বাবার  উপর  আর  একটু  দায়িত্ব  বর্তালো| ওদের  লেখাপড়া  ব্যাপারে  আমার  সাহায্য  বলতে  স্কুল  ও  কোচিনে দিয়ে  আসা  নিয়ে  আসা| ওদের  বাবা  সরকারী চাকরী করার  সুবাদে  এবং পোস্টিং কলকাতার  বাইরে  হওয়ায়  বিয়ের  পর  অষ্টমঙ্গলা  সেরে  আসার  পরদিনই  শিলিগুড়ির  উর্দ্দেশ্যে  রওনা  দিতে  হয়েছিলো| এসব  আমি  বিয়ের  আগে  থেকেই  জানতাম| তখন  আমার  গ্রাজুয়েশনের  ফল  বের  হয়নি| বিয়েতে  আপত্তি  জানিয়েছিলাম| পড়াশুনায়  খুব  একটা  খারাপ  ছিলামনা| ইচ্ছা  ছিলো রোজগারের  একটা  রাস্তা  খুঁজে  নেবো| কিন্তু  বাবার  অকালমৃত্যু নিজের  সুপ্ত  ইচ্ছাগুলোকে  জলাঞ্জলি  দিতে  বাধ্য  করেছিলো| বিয়ের  আগে  আমাদের  পরিবারের  রোজগার  বলতে  আমার  বড়দির  সাধারণ  একটি  সরকারী চাকরী| সেও  তার  সমস্ত  আশাআকাঙ্খা অনেক  আগেই  গলা  টিপে  মেরে  ফেলেছিলো  বাবার  পাশে  দাঁড়িয়ে  সংসারে  আরও একটু   সচ্ছলতা  আনার  জন্য| বিয়ের  পিঁড়িতে  তাকে  বসানো  যায়নি  এই  একটিমাত্র  কারণের জন্যই| 
     যে  কথা  বলছিলাম| স্বামীর  সাথে  চলে  এলাম  সম্পূর্ণ  আমার  নিজের  সংসারে একটি  ভাড়া  বাড়িতে  যা  আমার  স্বামী  অথাৎ  প্রলয়  নিজের  হাতে  খুব  সুন্দর  করে  গুছিয়ে  রেখে জাঁকজমক  করে  আমায়  আনতে কলকাতায়  ছুটেছিল| প্রথম  সন্তান  আমার  মেয়ে| জম্মের  একমাসের  মধ্যেই  প্রলয়ের  প্রমোশন  হয়| এমনিতেই  মেয়ে  হওয়াতে  প্রলয় এবং  তার  পরিবার  ছিলো ভীষণ  খুশি  তার  উপর  একমাসের  মধ্যে  পদন্নোতি| চার  পুরুষ  পরে  তাদের  সংসারে  আমার  মেয়ে  প্রিয়াঙ্কার  আগমনকে   তারা  মা  লক্ষ্মীর  কৃপা  বলেই  মনে  করে| তারপর  ছবছর  পরে  আসে  আমার  ছেলে  প্রিয়ম| রান্নাবান্না, ওদের  দেখভাল  আর  স্বামীর  সেবাযত্ন  নিয়েই  আমার  সময়  কেটে  যেত| এরপর  প্রলয়  শিলিগুড়িতেই জমি  কিনে  মনের  মত  করে  বাড়িও  তৈরী  করে| আমাকে  কোন  ব্যাপারেই  কোন  হ্যাপা  পোহাতে  হয়নি এই  বাড়ির  ব্যাপারে| নিজে  অফিস  ছুটি  নিয়ে  দাঁড়িয়ে  থেকে  সবকিছু  তদারকি  করেছে| অবশ্য  মাঝে  মধ্যে  তার  সাথে  আমাকে  যেতেই  হয়েছে  আমার  পছন্দ  মতো  মত  প্রকাশ  করার  জন্য| এহেন  মানুষটা  রিটায়ারমেন্টের  দুবছর  আগে একদিন  অফিস  থেকে  বাড়ি  ফিরলো  প্রচন্ড  জ্বর  নিয়ে| রক্ত  পরীক্ষায়  ধরা  পড়লো  ম্যালেরিয়া| হাসপাতালে  সাতদিন  ধরে যমে মানুষে  টানাটানি  করে  আমি  হেরে  গেলাম| চলে  গেলো  সবকিছু  আমার  দায়িত্বে  ফেলে  রেখে| ছেলেমেয়ে  প্রচন্ড  ভেঙ্গে পড়লো  বিশেষত  মেয়ে  পিয়া| এদের  শান্তনা  দিতে  দিতে  প্রলয়ের  জন্য  চোখের  জল  ফেলতেও  যেন  ভুলে  গেলাম| অল্প বয়সে  বাবাকে  হারিয়ে  তারাও  কেমন  থম  মেরে  গেলো আর  আমি  পড়লাম  অথৈ  সমুদ্রে| আমার  মাথায়  তখন  আকাশ  ভেঙ্গে পড়েছে | ব্যাঙ্ক, এলআইসি, বাড়ির  খাজনা--- আমি  তো  কিছুই  চিনিনা  কিছুই  জানিনা| 
   শুরু  হল  আমার  জীবনের  আর  এক  অধ্যায়| পড়াশুনার  শেষে  খেয়েদেয়ে  যখন  প্রিয়া, প্রিয়ম  ঘুমিয়ে  পড়তো  আমি  বসতাম  আলমারী খুলে  প্রলয়ের  সুন্দর  করে  গুছিয়ে  রাখা  সব  ফাইলগুলো  নিয়ে| তারউপর  আছে  রোজ  ছুটাছুটি  প্রলয়ের  অফিসে  পেনশনের  জন্য| কাউকেই  চিনিনা  কিভাবে  কোথায়  এগোবো  কিছুই  না  বুঝে  নিজের  পেটের বিদ্যের  দৌলতে  আস্তে  আস্তে  বাইরের  কাজের  সাথে  নিজেকে  ঠিক  মানিয়ে  নিতে  সক্ষম  হলাম| কাজগুলি  একটা  একটা  করে  গুটিয়ে  নিয়ে  আসতে লাগলাম| যত সহজে  আমি  কথাগুলো  বলতে  পারছি  এই  কাজগুলি  কিন্তু  তত  সহজ  ছিলোনা| সরকারী চেয়ার  দখল  করে  যেসব  কর্মচারীরা  আছেন  তাদের  মধ্যে  কেউ  কেউ  নিজেদেরকে  এক  একজন  কেউকেটা  মনে  করেন| কোন  কথা  জানতে  চাইলে  একবার  থেকে  দুবার  বলতে  যেন  তাদের  আত্মসম্মানে  লাগে| তারা  ভুলে  যায়  এই  কাজগুলি  করার  জনই  সরকার  তাদের  মাসে  মাসে  মাইনে দিয়ে  রেখেছে| কিছু  কিছু  কর্মচারীর  দুর্ব্যবহার  যেন  মজ্জাগত| সমস্ত  অপমান  সহ্য করে  লাগাতার  এ  টেবিল থেকে  অন্য টেবিল  করে  বেড়িয়েছি| কিন্তু  হাল  ছাড়িনি  একমুহূর্তের  জন্যও | আমাকে  পারতেই হবে  , প্রলয়ের  অসমাপ্ত  কাজগুলিকে  সমাপ্ত  করে  ছেলেমেয়ে  দুটিকে  আমার  মানুষের  মত  মানুষ  করতে  হবে  এই  অদম্য  ইচ্ছাশক্তিই  আমাকে  সামনের  দিকে  এগিয়ে  নিয়ে  গেছে| 
  দুবছরের মধ্যে  নিজেকে  ভেঙ্গেচুরে নুতন  করে  গড়েছি| যে  আমি  কোনদিনও বাইরে  একা বেরোতে  সাহস  পেতামনা  সেই  আমি  আমার  সংসার  এবং  সন্তানদের  জন্য  ঘর  বার  যেকোনো কাজেই  আজ  সমান  পারদর্শী| আয়নার  সামনে  দাঁড়িয়ে  নিজেকে  নিজেই  মাঝে  মধ্যে  প্রশ্ন  করি  " আজকের  আমি  আর  সেদিনের  আমির  মধ্যে  আজ  বিস্তর  ফাঁরাক| আমার  মধ্যে  যে  আর  একটা  আমি  ঘুমিয়ে  ছিলো প্রলয়  থাকাকালীন  সময়ে  তার  উপর  সম্পূর্ণ  নির্ভরশীল  হয়ে  কোনদিনও  টের  পাইনি| প্রলয়  চলে  গিয়ে  আমায়  যেন  নবরূপে  সংসারের  দায়িত্ব  পালনের  জন্য  তৈরী  করে  দিয়ে  গেলো|"

পাথর চাপা

 পাথর  চাপা 
           নন্দা  মুখার্জী  রায়  চৌধুরী 

 এখন  আমার  আর  কান্না  আসেনা 
 চোখের  জল  শুকিয়ে  গেছে 
 বা  হয়তো  কাঁদতেই  ভুলে  গেছি|
 অনুভূতিগুলো  মৃয়মান হয়ে  যাচ্ছে
 মনের  বা  শরীরের  যন্ত্ৰণা
 কোনোটাই  বুকে  আর  চেপে  বসেনা|
 চারিদিকের  সমাজের  এই  অবক্ষয় 
 আমার  সকল  অনুভূতিকে 
 দুমড়ে  মুচড়ে  ভেঙ্গে দিয়ে 
 আমাকে  বোবা  ও  কালা  করেছে|

Tuesday, December 3, 2019

মনেপড়ে

মনে পড়ে 
                নন্দা মুখার্জী রায় চেধুরী 

 মনে পড়ে তোমার কথা ,
যখন থাকি একলা ঘরে ,
স্মৃতিরা সব ভিড় করে ,
বুকে বাজে না পাওয়ার ব্যথা |

স্বপ্ন দেখা কিশোরবেলা -
আজও আছে অন্তরালে ,
নাইবা পেলাম তোমায় আমি !
নিজের করে কোনো কালে |

একলা যখন থাকি আমি ,
সেই স্বপ্ন রঙ্গিন করি -
নেই সেখানে কোনো বাঁধা ,
থাকনা  জমে বুকে ব্যথা !

শেষ বয়সে ভাবি বসে ,
সারাজীবন দিলাম পাড়ি, শুধুই হেসে ,
বুকের মাঝেই থাকলে ঘুমিয়ে ,
এই বয়সেও দেখি স্বপন, তোমায় নিয়ে |

আর হবেনা মোদের দেখা ,
তোমার ভালোবাসা থাকবে মনে ,
মন যে আমার আজও চায় ,
কিছুটা সময় কাটাতে তোমার সনে |

নন্দা  27.11.16  10.40pm.

পেরেছি

#পেরেছি  
        
    নন্দা  মুখার্জী  রায়  চৌধুরী  

     বাবার  মৃত্যুর  পর  কিছু  কাজের  আশায়  পাড়ার  মাথা  হরেনকাকার  কাছে  গিয়ে  সতেরো বছর  বয়সেই  নিজের  জীবনের  চরম  মূল্য  দিতে  হয়েছিল  রীতাকে |মাকে হারিয়েছে  সেই  ছেলেবেলায় | একটি  এনজিও  সংস্থার  সাথে  যুক্ত  পাড়ার  বেলাদি  এসে  নিজে  থেকে  রীতাকে সেখানে  যুক্ত  করে  নেয়| খাওয়াপড়া  আর  সামান্য  কিছুর  টাকার  বিনিময়ে  রীতা ভালোই  থাকে  সেখানে | তবে  ভিতরে  ভিতরে  তার  একটা প্রতিশোধস্পৃহা  জম্ম  নিতে  থাকে| কয়েকবছর  পরে  এনজিও  সংস্থার  একটি  অনুষ্ঠানে  কিছু  গন্যমান্য  ব্যক্তি  উপস্থিত হন | তাদের  মধ্যে  হরেনকাকাও  ছিলেন | একটা  কাটারি  জোগাড়  করে  সোজা  স্টেজে  উঠে  পরপর  কয়েকটা  কোপ মারে  লোকটির  কাঁধে  | স্টেজেই  লুটিয়ে  পড়েন  তিনি | অট্টহাসিতে  ফেঁটে  পরে  রীতা | ঠাঁই হয়  পাগলাগারদে  |

Monday, December 2, 2019

ব্লাকবেল্ট

অণুগল্প
 
 ব্লাকবেল্ট  

      নন্দা  মুখার্জী  রায়  চৌধুরী  

     নিজে  একজন  নামকরা  নৃত্যশিল্পী  হওয়া স্বর্তেও  সকলের  অমতে  মেয়েকে  নিজের  নাচের  স্কুলে  ভর্তি  না  করে  যখন  ক্যারাটে  স্কুলে  ভর্তি  করলো  মহুয়া  তখন  শাশুড়ি  ও  স্বামী  তার  সাথে  প্রচন্ড  অশান্তি  করেছিলেন| কিন্তু  একরোখা  মহুয়া  কারও কথায়  সেদিন  কর্ণপাত  করেনি| মেয়ে  আজ  ব্লাকবেল্ট  পাওয়ায়  সে  ভীষণ  আনন্দিত| 
   শহর  থেকে  একটু  দূরে  নিজের  নাচের  স্কুলের  মেয়েদের  নিয়ে  অনুষ্ঠান  করে  ফেরার  পথে  রাস্তার  মাঝখানে  গাড়ি  খারাপ  হয়ে  যায়| শুনশান  রাস্তা  তার উপর  অধিক  রাত অল্পবয়সী  মেয়েগুলোকে  নিয়ে  সে  তখন  অথই সমুদ্রে| ড্রাইভার  আপ্রাণ  চেষ্টা  চালিয়ে  যাচ্ছে  গাড়িটিকে  তাড়াতাড়ি  সারাবার  জন্য| ঠিক  সেই  মুহূর্তে  একটি  বাইকে  করে  তিনটি  ছেলে  এসে  অযাচিতভাবে  সাহায্য  করার  জন্য  গল্প  জুড়ে  দিলো| মহুয়া  তখন  ভয়ে  ঠকঠক  করে  কাঁপছে| মহুয়ার  মেয়ে  তখন  গাড়ি  থেকে  নেমে  মহুয়ার সামনে গিয়ে  ছেলেগুলিকে বলে তাদের  কোন  সাহায্যের  দরকার  নেই| অট্টহাসিতে  তারা  ফেটে  পরে| আর  ঠিক  তখনই একটি  ছেলে  মহুয়ার  মেয়ে  মনামীর  হাত  ধরে  টান দেয়| মহুয়া  চিৎকার  করে  ওঠে| বাকি  মেয়েগুলোও  ভয়ে  তখন  জড়সড়| 
   বাড়িতে  ফিরে মেয়ের  গর্বে  গরবিনী  মা স্বামী এবং তার মাকে ডেকে  হাসতে হাসতে গল্প  করতে  লাগলো  কিভাবে  তার  ব্লাকবেল্ট  পাওয়া  মেয়ে  তিন  তিনটি  ছেলেকে  ধরাশায়ী  করেছে| "ভ্যাগিস  আজ  মনা আমাদের  সাথে  ছিলো| ও  একাই আজ  আমাদের  এতগুলো  মেয়ের  সম্মান  বাঁচিয়েছে| আজ  তোমরা  নিশ্চয়ই  বুঝতে  পারছো  প্রত্যেকটা  মেয়ের  ক্যারাটে  শেখা কতটা  দরকার| শুধু  নিজেকে  বাঁচাতেই  নয়  অন্য মেয়েদের  সম্মান  রক্ষার্থেও প্রত্যেকটা   মেয়ের  ক্যারাটে  শিক্ষাটা  জরুরি|"

Sunday, December 1, 2019

একেই বলে ভাগ্য




একেই বলে ভাগ্য 

     নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

   -- একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছো?কয়েক মাসের মধ্যে সাহাবাবুদের কেমন হালচাল পাল্টে গেছে। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ড্রয়িংরুমে ঢুকতে ঢুকতে কর্তার উর্দেশ্যে কথাগুলি বললেন ঘোষগিন্নী। 

বাজার করে এসে এককাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে সবেমাত্র পেপারটা নিয়ে বসেছেন বিমলঘোষ।বয়স ষাটের উপরে।পেটানো শরীর।লম্বা ছ'ফুটের উপরে।দেখলে কে বলবে যে তার এতো বয়স।অপরিচিত মানুষজন পঞ্চাশের নীচে বলেই চালিয়ে দেবে।খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে তাকিয়ে চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে সোফার উপর গাটা এলিয়ে দিয়ে  ঘোষবাবু বললেন, 

---এটা যে আমিও ভাবিনা তা নয়।শুধু আমি কেন পাড়ার অনেকেই এই  ব্যাপারটা নিয়ে কানাঘুষা করেই চলেছে।কিছু একটা তো ঘটেছে কিন্তু সেটা কি এটাই জানার বিষয়।ওই তো সামান্য একটা মুদির দোকান।জিনিসপত্র সেখানে নেই বললেই চলে।অভাবের সংসার।এখন তো বাজারের সেরা মাছটা তরকারিটাই কেনেন।আগের থেকে ভালো আছেন এটা ভালো কথা।কিন্তু কিভাবে এটা সম্ভব হোল সেটাই ভাবাচ্ছে। 

  গিন্নী এতক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, 

---আচ্ছা কোন দিক থেকে কোন বিষয় সম্পত্তি বা টাকা পয়সা পেলেন নাকি। 

---আরে না,বহুবার সাহাবাবু বলেছেন তাদের দুইপক্ষেরই কোন আত্মীয়স্বজন নেই।ব্যাপারটা একটু ঘোলাটে।তবে প্রতিবেশি ভালো আছে এটাই সবথেকে বড় কথা। 

---আমাকে ব্যাপারটা খুঁজে বের করতেই হবে।একটা কথা মনে আছে তোমার?বছর খানেক আগে একজন ভদ্রলোক যাকে আগে কোনদিনও ওনাদের বাড়ীতে দেখিনি অথচ হঠাৎ করেই তিনি এসে ওই বাড়িতেই মারা গেলেন।তার সৎকারও করলেন পাড়ার ছেলেদের সহায়তায়।আমরা যখন জানতে চাইলাম বললেন,'ছেলেবেলার বন্ধু।'ক'দিন বেড়াতে এসেছিলেন।হঠাৎ স্ট্রোক করেছে।'তারপর থেকেই কিন্তু দু'জনেই নিজেদের পাড়ার থেকে গুটিয়ে নিয়েছেন।তুমি যাই বলোনা কেন আমার মনেহয় গ্যাড়াকলটা ওখানেই। 

স্বামী একমনে পেপার পড়ে যাচ্ছেন তার কথার কোন উত্তর দিলেননা দেখে তিনিও রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালেন।

   বিকাল হলেই ঘোষগিন্নীদের পাড়ার বটতলায় একটা পিএনপিসির আড্ডা বসে।ঘোষগিন্নী হলেন তার মধ্যমণি।কার মেয়ে কি করলো,কার ছেলে কোথায় মারপিট করলো,কোন মেয়েটাকে নিয়ে ঘুরে বেরালো,কার ছেলের বউ সংসারে কতটা কাজ করলো---এগুলোই তাদের মুখ্য আলোচ্য বিষয়।কিন্তু আজ কিছুদিন ধরে আরও প্রাধান্য পেয়েছে সাহাবাবুর পরিবার।হঠাৎ তাদের এই বড়লোকী চালটা।সেদিন আবার রাজমিস্ত্রীকেও বাড়ীতে ঢুকতে দেখেছেন ঘোষগিন্নী।সাহাগিন্নীকে জিজ্ঞাসাও করেছিলেন, 

---কি গো দিদি ছাদ দেবেন বুঝি?কথাটার মধ্যে যে একটু ব্যঙ্গ মিশ্রিত ছিলো সেটা সাহাগিন্নীও বুঝেছিলেন।তিনিও হাসি হাসি মুখে উত্তর দিয়েছিলেন, 

---দেবো দিদি।তবে ক'দিন পর।কর্তা বলেছেন আগে তিনি দোকানটাকে সাজাবেন।তাই দোকানে আগে মিস্ত্রী কাজ করবে।এই দেখুন না দোকানের সবকিছু এনে বাড়ীতে জমা করেছে।হিমশিম খাচ্ছি সবকিছু সামলাতে।

  না,ঘোষগিন্নী আর কিছু বলার সুযোগ পাননি কারণ কাজ সামলানোর অজুহাতে তিনি দ্রুতবেগে সেখান থেকে সরে পড়েন।আর ঘোষগিন্নী অপেক্ষা করতে থাকেন তাদের বিকালের মজলিসের। 

  দোকানের ছাদ , রং,ফার্নিচার হয়ে দোকান নূতনভাবে সেজে উঠলো।পাড়াপ্রতিবেশিরা এখন প্রায় সবাই সাহাবাবুর মুদিখানার দোকান থেকেই জিনিসপত্র কেনে।কেউ একটু সস্তার আশায় আবার কেউ তার এই হঠাৎ বড়লোক হয়ে উঠার কোন গন্ধ পেতে।না -সাহাবাবু বা তার গিন্নী এ ব্যাপারে মুখে কুলুপ এটেই থাকলেন।আর তাদের তো একটিমাত্র মেয়ে বহুদিন আগেই সেই বিহারে বিয়ে হয়ে গেছে।বছরে একবার আসে সেই জামাইষষ্ঠীতে।

    দোকান সাজানোর ঠিক ছ'মাসের মাথায় সাহাবাবু তার ঘরের টালি সরিয়ে ছাদ দিলেন সিঁড়ি সমেত।পাড়াপ্রতিবেশীরা আরও যেন চক্ষু ছানাবড়া করে তাদের না জানা কথাগুলি জানার জন্য দোকানে মাল কিনতে যাওয়া আর তাদের নূতন বাড়ি দেখতে যাওয়ার প্রতিযোগীতা শুরু করলেন।কিন্তু তারা যে তিমিরে ছিলেন সেই তিমিরেই রয়ে গেলেন। 

  কেটে গেছে বেশ কয়েকটি বছর।সাহাবাবু ও তার গিন্নীর বয়সের ভারে অনেক কাজই নিজেরা আর করতে পারেননা।দোকান এখন রমরমিয়ে চলে।বিহার থেকে বিশ্বস্ত দুটি ছেলেকে মেয়ে জামাই এনে দিয়েছে।থাকা,খাওয়া আর সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে তারা তাদের কাজ করে যাচ্ছে।বাড়ীতেও একজন রান্নার লোক রেখেছেন।সাহাগিন্নীর এখন পুরো বিশ্রাম।কিন্তু সময় পেলেই দুজনে সেই রাতের কথা আস্তে আস্তে আলোচনা করেন।সেদিন যদি ঝড় জলের রাতে ওই অপরিচিত লোকটাকে আশ্রয় না দিতেন তাহলে এতো আরাম আয়েশে তাদের শেষ বয়সটা কাটতোনা।সেদিন সন্ধ্যা থেকেই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়।ঘনঘন বাজ পড়ার শব্দ।এতো জোরে ঝড় হচ্ছিলো দুজনের মনেই আশঙ্কা ছিলো টালি উড়িয়ে নিয়ে যাবে।একটা ছোট বাল্ব জ্বালিয়ে স্বামী,স্ত্রী দুজনে খাটের উপর বসে ছিলেন।হঠাৎ দরজায় ঠকঠক আওয়াজ।প্রথমে তারা ভেবেছিলেন হাওয়ার দাপট।কিন্তু কিছুক্ষণ পরে শুনতে পান, 

---একটু দরজাটা খুলুন না।আমি খুব বিপদে পড়েছি।

  গিন্নী নিষেধ করলেও সাহাবাবু দরজা খুলে লোকটিকে ঘরে আনেন।কাকভেজা অবস্থায় তিনি ঘরে ঢোকেন।পিঠে একটা বড় ব্যাগ।সাহাবাবু তার একটা লুঙ্গি আর ফতুয়া পরতে দিলেন।সাথে একটি গামছা।ভদ্রলোক তখন ঠকঠক করে শীতে কাঁপছেন।সাহাবাবু তাকে নিয়ে পাশের ঘরটাতে গেলেন।গিন্নির অনেক মুখঝামটা সর্ত্বেও নিজেদের খাবার থেকে দুটো রুটি আর একটু আলুর তরকারী নিয়ে ভদ্রলোককে দিলেন।কিন্তু সন্ধ্যা থেকে বৃষ্টিতে ভিজে ভদ্রলোকের কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসাতে তিনি কিছুই খেতে পারেননা।সাহাবাবু তখন কি আর করবেন?গরীব মানুষ ঘরে কোন ওষুধপত্র ও নেই।বাইরে প্রবল ঝড়জল।এই অবস্থায় বাইরে বেরোনোও মুশকিল।কোথার থেকে কি করবেন কিছুই বুঝতে পারছেননা।তবুও ভাবলেন কাল সকালে ঝড়বৃষ্টিটা কমলে যদি একটা ডাক্তার ডাকা যায়। 

   কিন্তু সে সুযোগ তিনি আর পেলেননা।সকালে আগন্তুকের কাছে গিয়ে কোন সারাশব্দ না পেয়ে তিনি ডাক্তার ডেকে আনেন।ডাক্তার এসে জানান তিনি ভোর রাতেই মারা গেছেন।তারপর থানা পুলিশ ক্লাব অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়েছে।ইতিমধ্যে সাহাগিন্নি আগন্তুক মারা যাবার পর তার ব্যাগটি খুলে দেখতে যান কোন মোবাইল বা ঠিকানা পাওয়া যায় কিনা।ব্যাগ খুলে তো তিনি হতবাক।ব্যাগ ভর্তি টাকার বাণ্ডিল।তিনি তার স্বামীকে ডেকে দেখান।দুজনেই ঠিক করেন এ কথা তারা গোপন রাখবেন।এমনকি মেয়েকেও এ কথা জানাবেন না।নাম ধাম গোত্রহীন একজন এক ব্যাগ টাকা নিয়ে এসে তার বাড়ীতে মাত্র কয়েক ঘণ্টা থেকে চিরজীবনের জন্য চলে গেলেন একে তারা মা লক্ষ্মীর কৃপা বলেই মেনে নিলেন।পুলিশের সহায়তা নিয়ে পাড়ার ছেলেদের মাধ্যমে তিনি ভদ্রলোকের দাহকাজ সম্পন্ন করেন। 

  তারপরই তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়।আর তাদের এই হঠাৎ বড়লোক হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনী সকলের অগোচরেই ঠেকে যায়। 

Saturday, November 30, 2019

জীবনের স্বপ্ন

জীবনের  স্বপ্ন  
     নন্দা  মুখাৰ্জী  রায়  চৌধুরী  

       অনিন্দ্য বাবু মারা  যেতেই তার  বিশাল  সংসারে  অশান্তি  চরমে  উঠলো | এতদিন  ছেলেরা  হয়তো মুখ  বুজে  সব  হজম  করেছে  তাদের  বাবার  মৃত্যুর  পর  যে  যার  সম্পত্তি  নিজেদের  নামে করে  নিতে  পারবে| চার  ছেলের  তিনটিরই বিয়ে  হয়েছে , প্রত্যেকেরই  একটি  করে  সন্তান| প্রত্যেকেই  সুপ্রতিষ্ঠিত| মেঝো ছেলে  বিয়ে  করেনি| পি ডব্লু ডির মস্তবড়  ইঞ্জিনিয়ার| কলেজ  লাইফে ক্লাসমেট   চপলাকে  ভালোবেসে  প্রত্যাখ্যাত  হয়ে নারীদের  সম্পর্কেই  একটা  বিতৃষ্না  জমে  আছে  তার  মনে| তাছাড়া দাদা  বৌদি ও   ভাই  আর  ভাইবৌদের এই  সংসার  রাজনীতি  দেখে  দেখে  সে  যেন  আরও বিরক্ত| স্বাভাবিক  ভাবেই  অনিন্দ্যবাবুর  মৃত্যুর  পর  তার  সমস্ত  সম্পত্তি  চার  ছেলে  ও  স্ত্রীর মধ্যে  সমান  ভাগ  হবে| বাড়িতে  উকিল  ডাকা  হোল| অনেক  খোঁজাখুঁজির  পর  দলিলও পাওয়া  গেলো  কিন্তু  সকলের  চক্ষু  ছানাবড়া  হয়ে  গেলো  দলিলের  সাথে  একটি  উইল  দেখে| উইলে  সমস্ত  সম্পত্তি  দান করা  আছে  মেজোছেলের  নামে| অশান্তি  আরও চরমে  উঠলো| কারও মাথাতেই  আসছেনা  এতবড়  বুদ্ধিমান  মানুষ  হয়ে  বাবা  কেন  এরূপ  একটা  অবিবেচক  মানুষের  মত  কাজ  করলেন| অথচ  মেঝো  ছেলে  কিন্তু  নিরুত্তাপ| সময়ে  অসময়ে  অন্য ভায়েরা  তাকে  কথা  শুনাতে ছাড়ছেনা| সে  কারও কথারই  কোন  জবাব  দেওয়ার  প্রয়োজন বোধ  করছেনা| 
 একই  বাড়িতে  সব  ছেলেরদেরই  হাঁড়ি আলাদা | একমাত্র  মেজোছেলে  অনুপম  খায়  মায়ের  সাথে| অনিন্দ্যবাবু বেঁচে  থাকাকালীন  সময়  থেকেই  তারা  তিনজনে  একহাঁড়িতে খেতেন| বাবার  মৃত্যুর  পর এখন   সে  আর  তার  মা| বাড়ির  পরিস্থিতি  এখন  এমনই দাঁড়িয়েছে  ঘরের  চালে কাকও বসেনা| ছেলে  অনুপম  ও  মা  দুজনেই  চুপ| 
  বাবার  মৃত্যুর  প্রায়  মাস  ছয়েক  পরে  একদিন  খুব  ভোরে  অনুপম  তার  ও  মায়ের  কিছু  প্রয়োজনীয়  জিনিসপত্র  ব্যাগে  ভরে ট্যাকসি একটা  বাড়ির  সামনে  ডেকে  সব  ভাইদের  ঘুম  থেকে  ডেকে  তুলে  বাড়ির  সমস্ত  সম্পত্তি
  তিনভাগ  করে  প্রত্যেকের  দলিল  যার  যার  হাতে  তুলে  দিয়ে  বললো, " সম্পত্তিতে  আমার  কোন  লোভ  নেই| তাই  সমস্তকিছু  আমি  তোমাদের  নামে দানপত্র  করে  দিলাম| কিন্তু  মায়ের  ভাগ  আমি  কাউকেই  দিতে  পারবোনা| মা  শুধু  একা আমার| আমি  মাকে আমার  সঙ্গে  নিয়ে  যাচ্ছি| তোমরা  শান্তিতে  থেকো| ওই  দলিলের  সাথে  বাবার  আমাকে  লেখা  একটি  চিঠি  আছে  আমি তোমাদের   প্রত্যেকটি  দলিলের  সাথে  বাবার  লেখা  চিঠিটির  একটি  জেরক্স  কপি  তোমাদের  দিয়ে  গেলাম|" মাকে নিয়ে  অনুপম  ট্যাকসি করে  বেরিয়ে  গেলো| মা  অনুভাদেবী  চলে  যাওয়াতে  বাড়ির  কারোর  মধ্যেই  কোনোরূপ  প্রতিক্রিয়া  দেখা  গেলোনা| শুধু অনুভাদেবীর  কাঁদতে  কাঁদতে  মেজোছেলেকে  অনুসরণ করে বেরিয়ে  গেলেন| অনুপম  ও  তার  মা  বেরিয়ে  যাওয়ার  পর  প্রত্যেকেই  তাদের  দলিলের  সাথে  তাদের  বাবার  হাতের  লেখার  একটি  চিঠির  জেরক্সকপি  পায় যা  তাদের  মেঝভায়ের  উর্দ্যেশ্যেই  লেখা| 

 প্রাণাধিক  বাবা  অনুপম,
   আজ  তোমাকে  আমি  একটা গল্প  বলবো | যা  গল্প  হলেও  আমাদের  জীবনের  চরম  সত্যি| তোমার দাদা  ও  মাকে নিয়ে  আমি  বেনারস  বেড়াতে  যাচ্ছিলাম| তোমার  দাদা  তখন  একবছরের| বেনারস  পৌঁছে  ট্রেনের  সিটের তলা থেকে  যখন  আমাদের  ব্যাগ  নামাতে  যাই  সেখানে  দেখি  একটি  বড়  বাঁশের ঝুড়ি| ট্রেনের  সকল  যাত্রী  তখন  একএক করে  নেমে  গেছে| কৌতূহল  বশত ঝুড়িটা টেনে  বাইরে  আনি| তার  ভিতর  দেখতে  পাই  সদ্য ভূমিষ্ঠ  হওয়া যেন  এক  দেবশিশু| তার  মুখটা  দেখেই  আমি  ও  তোমার  মা  দুজনেই  কেমন  মায়ায়  জড়িয়ে  গেলাম| পুলিশের  ঝামেলার  ভিতর  যাতে  পড়তে  না  হয়  তারজন্য  তাড়াতাড়ি  ব্যাগ  থেকে  আমার  একটি  ধুতি  বের  করে  ওই  দেবশিশুটিকে  সুন্দরভাবে মুড়ে  তোমার  মায়ের  কোলে  দিয়ে  বললাম," আজ  থেকে  এই  শিশুটি  আমাদের ছেলে"| আমি  ছিলাম এক  সাধারণ  রাজ্যসরকারী কর্মচারী| প্রমোশন  পাওয়ার  স্বপ্ন  বা উপায়   কোনটাই  ছিলোনা| শিশুটিকে  নিয়ে  বাড়িতে  আসার  কয়েক  মাসের  মধ্যেই  অভাবনীয়ভাবে  আমি  হেডক্লার্ক  হই| পাড়াপ্রতিবেশীকে  জানিয়েছিলাম  আমরা  যখন  বেনারস  যাই  তখন  তোমার  মা  গর্ভবতী  ছিলেন| তাই  কারও কোন  প্রশ্নের  সম্মুখীন  আমাদের  কোনদিন  হতে  হয়নি| একেএকে  তারপর  আমার  দুই  ছেলে  আসে| তারপর  কয়েক  বছরের  মধ্যেই  আমি  অফিসার  পদে  উন্নীত  হই| আমার  যত উন্নতি  সব  ওই  দেবশিশুটির  আগমনের  পরেই| আমি  আমার  অন্য তিনটি  ছেলেকে  যথেষ্ট  শিক্ষায় শিক্ষিত  করতে  পারলেও  তাদের  মানুষ  করতে  পারিনি| আমার  চারটি  ছেলেই  সুপ্রতিষ্ঠিত| এটাই  আমার  জীবনের  চরম  পাওয়া| কিন্তু  আমার  অবর্তমানে  এই  পরিবারের  হাল  আমি  সচক্ষে  যেন  দেখতে  পাই | প্রচন্ড  লোভী  আর  স্বার্থপর  আমার  ঔরসজাত  সন্তানেরা| এতক্ষণে নিশ্চয়  বুঝতে  পারছো  সেই  দেবশিশুটি  কে? হ্যাঁ ঠিকই  ধরেছো  সে  তুমিই| যার  কথা  বলতে  গেলে  গর্বে  আমার  বুকটা  ফুলে  ওঠে| আমার  মৃত্যুর  পর  আমি  জানি  তুমি  থাকতে  তোমার  মায়ের  আজীবন  কোন  কষ্ট  হবেনা| আমার  সমস্ত  সম্পত্তি  আমি  তোমার  নামেই   তাই  করে  গেলাম| তোমার  মাকে তুমি  দেখো| না, এটা আমাদের  প্রতি  তোমার  কোন  ঋণ শোধ  নয়, মায়ের  প্রতি  পুত্রের  কর্তব্য  যে  দায়িত্ব  আমি  অন্য কারও হাতেই  সমর্পণ করতে  সাহস  পাচ্ছিনা| আমার  মৃত্যুর  পর  এই  চিঠি  তুমি  হাতে  পাবে  যা  আমি  তোমার  মায়ের  কাছে  গচ্ছিত  রেখে  গেলাম| 

                          ইতি  
                নিত্যাশীর্বাদক  তোমার  বাবা | 
   
  

Friday, November 29, 2019

মন মানেনা

মন  মানেনা  
      নন্দা  মুখাৰ্জী  রায়  চৌধুরী

    আমার  মনেহয়  আমার  স্বপ্নগুলো  ছিলো আর  পাঁচটা  মেয়ের  মতোই | যখন  নবম  বা  দশম  শ্রেণীতে  পড়ি  নিজের  জীবনটাকে  কল্পনা  করতাম  ঠিক  সিনেমার  নায়িকার  মত  | ভাবতাম  হঠাৎ  করেই  আমার  স্বপ্নের  পুরুষ  বেশ  দামি  একটা  গাড়ি  চড়ে আমার  সামনে  এসে  দাঁড়াবে | প্রথমে  ঝগড়াঝাটি , মানাভিমান  শেষে  ঠিক  সিনেমার  কোন  গল্পের  মত  হাওয়ায়  ভাসতে  থাকবো | পড়াশুনার  এই  বাঁধাধরা  নিয়মের  মধ্যে  নিজেকে  বেঁধে  রাখতে  ইচ্ছা  করতোনা | কোনোরকমে  টেনেটুনে  পাশ  করে  ক্লাসে  উঠতাম | 
   সংসারে  মা , বাবা , আর  ভাই  ছিলো | বাবা  ছোট  একটা কোম্পানিতে  চাকরি  করতেন | অভাবের  সংসার  হলেও  আমি  ও  ভাই  কোনোদিন  কোন  কষ্ট  পাইনি | সুন্দর  একটা  শান্তি  বিরাজ  করতো আমাদের  সংসারে | বাবা  রোজ  অফিস  থেকে  ফেরার  পথে  আমার  ও  ভায়ের  জন্য  কিছু  না  কিছু  নিয়েই  আসতেন | সে  বাদামভাজা  হোক  বা  কোন  তেলেভাজা | বাবা  ফিরেই  দুজনকে  একসাথেই  ডাকতেন | আর  আমরা  দুই  ভাই  বোন  পড়িমরি  করে  তার  কাছে  ছুঁটে যেতাম | একটু  বিশ্রাম  নিয়ে  চা , বিস্কুট  খেয়ে  দুজনকে  নিয়ে  পড়াতে বসাতেন | এতো  ধর্য্য  ছিলো বাবার  আজ  যখন  ভাবি  তখন  খুব  আশ্চর্য  হয়ে  যাই | কোন  বিষয়ে  কিছু  বুঝতে  না  পারলে  বারবার  বুঝিয়েছেন  কিন্তু  কোনোদিনও দেখিনি  সামান্য  রেগে  যেতে  বা  বিরক্তি  প্রকাশ  করতে | নিজের  স্বামীর  স্বভাবকে  কল্পনা  করতাম  ঠিক  বাবার  মতই | জীবনের  সর্বক্ষেত্রে  নিয়ম  মেনে  চলা , ধর্য্য  ও  ত্যাগের  প্রতিমূর্তি  হিসাবে আমার  জীবনে  হিরো  হয়ে  এসে সেই  ছেলেবেলা  থেকে  আজও বাবা  ই  সামনে  দাঁড়ান | স্বপ্ন  দেখতাম  ঠিক  মায়ের  এই  সাজানো  গুছানো  স্বর্গের  শান্তি  বিরাজমান  সংসারের  মত  একটি  সুন্দর  সংসারের | 
         আমার  পড়াশুনায়  সেরকম  কোন  মন  নেই  দেখে  মাধ্যমিক  পাশ  করার  পর  থেকেই  বাবা   আমার  বিয়ের  জন্য  ছেলে  দেখতে  শুরু  করেন | তখনও আমার  আঠারো  বছর  বয়স  হয়নি | মা  যখন  বলতেন , " ওর  তো  এখনো  বিয়ের  বয়স  হয়নি "- বাবা  বলতেন , " এখন  থেকে  শুরু  করি  ও  উচ্চমাধ্যমিক  পাশ  করার  পর  আমি  ওর  বিয়ে  দেবো | বললেই  কি  আর  ছেলে  পাওয়া  যায়  নাকি ?আমি  ঘষেমেজে  উচ্চমাধ্যমিক  পাশ  করলাম | আর  ঠিক  তখনই এক  বাড়ি  থেকে  আমায়  পছন্দ  করলো  তাদের  ব্যাংকে  চাকুরীরত  ছেলের  জন্য | দুই  ভাই  এক  বোন  তারা | আমায়  দেখে  তাদের  সকলেরই  খুব  পছন্দ  হোল | 
  সেই  বাড়িতে  আমার  বিয়ে  হয়ে  গেলো | আমি  অজানা , অচেনা  একটি  পুরুষের  হাত  ধরে  সম্পূর্ণ  একটি  অপরিচিত  বাড়িতে  চলে  এলাম  অলিখিত  এই  চুক্তিতে  তাদের  সবাইকে  আপন  করে  নেবো , ভালোবাসবো , সেবাযত্ন  করবো | মনেমনে  এটাও  ভেবেছিলাম  তারাও  অপরদিকে  আমার  প্রতি  এই  কাজগুলি  করবে | কিন্তু  এই  ভাবাটা  আমার  যে  কত  বড়  ভুল  ছিলো তা  বুঝতে  আমার  মাত্র সপ্তাহ  খানেক  সময়  লেগেছিলো | বৌভাতের  পরদিনই  শ্বাশুড়ী রান্নাঘরে  নিয়ে  গিয়ে  বললেন ," আজ  থেকে  রান্নাঘর  তুমি  সামলাবে | ষোলো বছর  বয়সে  এসে  এই  রান্নাঘরে  ঢুকেছি  -- আজ  থেকে  আমার  ছুটি | এখন  থেকে  আমি  শুধু  আরাম  করবো | 
  শুরু  হোল আমার  স্বপ্নের  এক  একটা পাঁপড়ি ঝরে  যাওয়া | বাবা  মায়ের  মুখ মনে  করে  মানিয়ে  চলার  অদম্য  ইচ্ছাশক্তিকে  সম্বল  করে সংসারের  সমস্ত  রকম  কাজ  করেও  কারও মুখেই  কোনোদিন  হাসি  দেখতে  পারিনি | যে  মানুষটাকে  নির্ভর  করে  আমার  প্রিয়  মানুষগুলোকে  ছেড়ে  আসা  সে  মায়ের  কথায়  দম দেওয়া  একটি  রোবোটমাত্র | মায়ের  হ্যাঁ তে  'হ্যাঁ' আর  মায়ের  না  তে  ' না ' মেলাতেই  শুধু  জানে  | আমার  সাথে  বসে  কোনদিন  গল্প  করা  বা  কোনোদিন  ঘুরতে  নিয়ে  যাওয়া  তারপক্ষে  কখনই  সম্ভব  হয়নি | আমি  শুধুমাত্র  তার  জৈবিক  চাহিদা  পূরণের  একটি  মেশিন  মাত্র | আমার  বিয়েদাড়ি ননদ  মাঝে  মধ্যে এসে  আগুনে  ঘৃতাহুতি  দিয়ে  যেত  আমার  শ্বাশুড়িমায়ের  কানে | বৌভাতের  পর  থেকে  এমন  কোন  দিন  যায়নি ভাত খেতে  বসে  চোখের  জল  ফেলিনি | বাপের  বাড়িতে  গেছি  সেই  অষ্টমঙ্গলায় | বাবা  মাঝে  মাঝে  আমার  শ্বশুরবাড়িতে  আসেন | কিন্তু  অদ্ভুত  ব্যাপার  এই  যে  আমার  বাবা  যখন  আসেন  তখন  তাদের  আচার  আচরণ , কথাবার্তা  আমার  প্রতি  সম্পূর্ণ  পাল্টে  যায় | বাবাকে  তারা  না  খাইয়ে  কিছুতেই  ছাড়েনা | বাবার  কাছে  আমার  প্রশংসায়  তারা  থাকে  পঞ্চমুখ | তখন  বাবার  ওই  খুশি  মুখটা  দেখে  আমিও  কোনোদিন  কিছুই  তাকে  বলতে  পারিনি | 
 কয়েকমাসের  মধ্যেই  আমি  আমার  ভিতরে  আর  একটি  প্রাণের  অস্তিত্ব  টের  পেলাম | রাতে  স্বামীকে  জানালাম| পাশ  ফিরে শুতে  শুতে  সে  আমায়  বললো," আমায়  বলে  কি  হবে  মাকে গিয়ে  বলো"| অবাক  হয়ে  গেলাম  তার  এই  কথাতে| সারাটারাত চোখের  জলে  বালিশ  ভিজলো | বারবার  করে  বাবার  কথা  মনে  হচ্ছিলো | সারাটারাত না  ঘুমানোর  ফলে  ভোরের  দিকে  একটু  চোখটা  লেগে  এসেছিলো | ঘুম  ভেঙ্গে ধড়মড় করে  উঠে  বসি সকলের  চিৎকার  চেঁচামেচিতে | রান্নাঘরে  গিয়ে  ঢোকার  সাথে  সাথেই  শ্বাশুড়িমা  চিৎকার  করে  বলে  উঠলেন ,
-- বিয়ের  পর  একটা  বছর  গেলোনা  এরমধ্যে  পোয়াতী হয়ে  বসলে, নিজেকে  একটু  সামলে  চলতে  পারলে  না? বলি  বাচ্চা  হবে  বলে  কিন্তু  কাজকাম  বন্ধ  করলে চলবেনা| আমার  সংসার  যেভাবে  চলছে  সেভাবেই  চলবে, আমি  সংসারের  কোন  কাজ  আর  করতে  পারবোনা | যদি  মনে  করো  এই  অবস্থায়  তুমি  কোন  কাজ  করতে  পারবেনা  তাহলে  চলো  তোমায়  হাসপাতালে  নিয়ে  গিয়ে  ওটা  ফেলে  দিয়ে  আসি | 
 আমার  বুকের  ভিতরটা  কেঁপে  উঠলো | এরা কি  ধরনের  মানুষ? প্রথমত  ছেলে এসে  তার  মাকে বললো- তার  বৌ  মা  হতে  চলেছে? এ  কেমন  মন  মানসিকতা এদের? কত  বছর  পরে  বাড়িতে  একটা বাচ্চা  আসতে চলেছে  তারজন্য  খুশি  না  হয়ে  কাজ  যদি  করতে  না  পারি  সেই  অজুহাতে  বাচ্চাটিকে  পৃথিবীর  আলো পর্যন্ত  দেখতে  দিতে  চাইছেনা? এরা কি  মানুষ? এর  থেকে  বরং টাকা  দিয়েই  তো  কাজের  লোক  রাখতে  পারতো| কিন্তু  কিছুই  বললামনা| এই  অবস্থাতেই  সেই  আগের  মতই সংসারের  যাবতীয়  কাজ  করে  যেতে  থাকলাম| সত্যিই  আমি  বুঝতে  পারতামনা  এই  বাড়ির  মানুষগুলো  কেন  এইরূপ| একমাত্র  আমার  দেওর ছিলো একটু  অন্যরকম| সে  বিটেক  পড়ছে| ওর  সাথেই  যা  একটু  সুখ, দুঃখের  কথা  বলতে  পারতাম| কিন্তু  সেটাও বাড়ির  অন্যসকলের  অলক্ষ্যে| আমার  স্বামীর  মতনই  সেও  মাকে  ও  বাবাকে  প্রচন্ড  ভয়  পেতো| হঠাৎ  একদিন  আমার  শ্বাশুড়িমা আমায়  বললেন, "দেখো  বৌমা  আমার  কিন্তু  বংশধর চাই | মেয়ে  হলে  কিন্তু  আমি  তোমায়  বাড়িতে  আনবোনা|" 
  সেদিন  প্রথম  শ্বাশুড়িমায়ের  উপর  কথা  বললাম,
--- ছেলে  বা  মেয়ে  যাই  হোকনা  কেন  সেতো আমার  প্রথম  সন্তান| আর  এটা তো  আমার  হাতে  নয় এতো  ঈশ্বরের  দান মা|
--- মুখে  মুখে  তর্ক  আমি  একদম  পছন্দ  করিনা| যদি  মেয়ে  হয়  তাহলে  তুমি  ওখানেই  তাকে  বিদায়  দিয়ে  আসবে  আর  তা  না  হলে  তাকে  নিয়ে  সারাজীবনের  মত  বাপের  বাড়িতে  চলে  যাবে| 
--- কেন  মা? মেয়ে  হলে  বাপের  বাড়ি  কেন  যাবো? সেতো এই  বংশেরই  মেয়ে| আপনার  প্রথম  সন্তান  ও  তো  মেয়ে| আপনি  যদি  তাকে  নিয়ে  আপনার  শ্বশুরের  ভিটেই থাকতে  পারেন  আমি  কেন  পারবোনা? আমারও তো  এটা শ্বশুরের  ভিটা | 
--- কি  এতো  বড়  কথা  তোমার? আমি  ডাকছি  সবাইকে, আজ  তোমার  একদিন  কি  আমার  একদিন | 
  চিৎকার  চেঁচামেচি  করে  বাড়ি  মাথায়  করলেন | ছেলেকে  তার  ঘরে  গিয়ে  কি  বললেন  জানিনা| সে  এসেই  আমার  গালে  এতো  জোরে  এক  থাপ্পড়  মারলো--- শুধু  এ  টুকুই  মনে  আছে  সেই  মুহূর্তে  আমার  দেওর ও  সেখানে  এসে  দাঁড়িয়েছিলো| পরে  যখন  আমার  জ্ঞান  ফেরে  আমি  হাসপাতালে আর  আমার  মুখের  উপর  আমার  মা, ভাই, বাবা  আর  আমার  দেওর উৎকণ্ঠা  নিয়ে  সব  তাকিয়ে  আছে | বাবা  আমায়  বললেন, কোন  ভয়  নেই  মা আমরা  সবাই  তোর  সাথে  আছি | এতদিন  ধরে  সবকষ্ট  মুখ  বুজে  কেন  সহ্য  করেছিস? কেন  সবকিছু  আমায়  জানাসনি? আর  তোকে  ও  বাড়িতে  যেতে  হবেনা| আমাকে  সবকথা  তোর  দেওর অনিরুদ্ধ  বলেছে| ওই  দেখ  আসল  কথাই  তো  বলতে  ভুলে  গেছি| আমি  তো  দাদু  হয়েছি  একটা  সুন্দর  ফুটফুটে  মেয়ে  হয়েছে  তোর| এখন  থেকে  ওকে  নিয়ে  তুই  আমাদের  কাছেই  থাকবি| মা  হওয়ার  আনন্দ  আর  এতদিন  পরে  আমার  ভালোবাসার  মানুষগুলোকে  একসাথে  পেয়ে  কিছুক্ষনের  জন্য  হলেও মনের  ভিতরের  সমস্ত  কষ্ট  এক  নিমেষে  মুছে  গেলো | 
   যে  কটাদিন হাসপাতাল  ছিলাম  একবার  করে  অনিরুদ্ধ  এসেছে  আমায়  ও  আমার  মেয়েকে  দেখতে | বাবার  সাথে  বাড়িতে  চলে  আসার  পরও সপ্তাহে  একদিন  বা  দুদিন  করে  সে  আসে| যতটুকু  সময়  থাকে  সে  তার  ভাইঝিকে  নিয়েই  থাকে | টুকটাক  খেলনা, জামা  এসব  নিয়ে  আসে  দেখে  আমি  তাকে  একদিন  বললাম, 
--- শোনো  অনি, তুমি  তো  চাকরী করোনা এসব  জিনিস  তুমি  আনবে  না| 
--- ও  তো  আমাদের  বংশেরই| আমাদের  বাড়ির  লোকেরা  অস্বীকার  করতে  পারে| কিন্তু  সত্যিটাকে  তো  অস্বীকার  করে  চাপা  দিয়ে  রাখা  যায়না| আমার  পরীক্ষা  শেষ| আমি  কিছু  টিউশনি  করছি| নিজের  টাকা  দিয়েই  ওর  জন্য  এসব  নিয়ে  আসি| আমি  যখন  চাকরী পাবো  ওর  সমস্ত  দায়িত্ব  আমি  নেবো| ওর  ভবিষৎ  নিয়ে  তোমায়  কিছু  ভাবতে  হবেনা| আসলে  কি  জানো বৌদি, মা  আর  দাদা  দুজনেই  সাইকোপেশান্ট| অনেকবার  চেষ্টা  করেছি  তাদের  সাইকিয়াট্রিস্টের  কাছে  নিয়ে  যাওয়ার| তারা  মনে  করে  সাইকিয়াট্রিস্ট  মানেই  পাগলের  ডাক্তার| দাদা  এতো  শিক্ষিত  হয়েও  এটা বোঝেনা| বাবা  কিন্তু  খুব  শান্তিপ্রিয়  ভালো  মানুষ| কিন্তু  মায়ের মুখের সাথে  তিনি  পেরে  ওঠেননা| তুমি  জানোনা  তোমাকে  নিয়ে  বাবা  মায়ের  মধ্যে  প্রচুর  ঝামেলা  হয়েছে| কিন্তু  সুরাহা  কিছুই  হয়নি| আমি  যে  তোমাকে  ডাক্তারের  কাছে  নিয়ে  যেতাম  সেটাও  কিন্তু  বাবা  আমায়  চুপিচুপি  বলে দিয়েছিলেন| মা  আমাকে  একটু  সমীহ  করে  চলেন  তার  কারণ  আমি  রেগে  গেলে  ভীষণ  ভাঙ্চুর করতে  শুরু  করি| হয়তো  খেয়াল  করে  দেখবে  তোমার  সাথে  মা  বা  দাদা  যে  ঝামেলাটা  করতো  সেটা  কিন্তু  আমার  অনুপস্থিতিতেই| আমি  কিছুটা  বুঝতে  পারলেও  চুপ  থাকতাম  তার  কারণ  তোমাকে  নিয়ে  মা  বা  দাদার  সাথে  আমি  ঝামেলা  করলে  তার  জেরটা আমি  বাড়িতে  না  থাকলে  তোমার  উপরই পড়তো| আর  তুমিও  আমাকে  কোনোদিন  কিছুই  বলোনি| আমিও  তো  তোমার  ছোট  ভায়ের  মত| তুমি  তোমার  কষ্টটাকে  কখনোই  আমার  সাথে  শেয়ার  করোনি| 
 আমি  উঠে  গিয়ে  অনির  মাথায়  হাত  রাখি | ওর  চোখ  ভত্তি জল  আমি  আমার  শাড়ির  আঁচল দিয়ে  মুছিয়ে  দিই|
--- আমি  সত্যিই  ভুল  করেছি  ভাই| আমি  বুঝতে  পারিনি  আমার  এতবড়  একজন  শুভাকাঙ্ক্ষী  ওই  বাড়িতেই  ছিলো| আজ  থেকে  আমার  দুটি  ভাই| আমার  আর  কোন  চিন্তায়  তো  থাকলোনা| আর  মাথার  উপরে  আছেন  বাবা  মা| সকলের  সহযোগিতায়  আমার  মেয়েটি  ঠিক  মানুষের  মত  মানুষ  হয়ে  যাবে| আজ  থেকে  আমি  আর  চোখের  জল  ফেলবোনা  , অতীতকে  নিয়েও  আর  ভাববোনা| নিজেও  এই  সামান্য  শিক্ষাগত  যোগ্যতা  নিয়ে  কিছু  করার  আপ্রাণ  চেষ্টা  করবো| ফেলে  আসা  অতীতটাকে  দুঃস্বপ্ন  বলে  ভুলে  যাওয়ার  চেষ্টা  করবো| 
  অনিরুদ্ধ  নীচু হয়ে  তার  বৌদিকে  প্রণাম  করে  ঘর  থেকে  বেরিয়ে  গেলো  দৃঢ়  সংকল্প  নিয়ে  যেভাবেই  হোক  তাকে  একটা চাকরী জোগাড়  করতেই  হবে | আর  নীলা  মানে  আমি  নূতন সূর্য্যের  আশায়  বুক  বেঁধে  আমার  মেয়ে  মুক্তমনাকে  বুকে  জড়িয়ে  ধরলাম| 

Tuesday, November 19, 2019

ভালোভাবে বাঁচো

ভালোভাবে বাঁচো 
       নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

জীবনের হিসাব মেলেনি আর 
সবকিছু ভুলে ভরা, 
প্রেমপ্রীতি,ভালোবাসা 
যত আছে মায়া মমতা, 
বাস্তবে সবই সার্থের নেশা। 
পৃথিবীর কেউ ভালোভাবে বাঁচেনা 
বাঁচার তাগিদে বাঁচা, 
মনের কোণের যত অভিমান 
দিয়ে সব বিসর্জন, 
এভাবেই বাঁচো যে কটাদিন আছো 
জীবনমৃত হয়ে থেকোনা আর। 

Sunday, November 17, 2019

একতা

একতা 
    নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী 

     নিজে একজন মহিলা সমিতির সভ্য হয়েও পারেননি ছেলে বৌ এর অত্যাচারের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে।ছেলে এবং বৌকে অনেক  বুঝিয়েছেন।কিন্তু কিছুতেই তারা বুঝতে চায়নি।মহিলা সমিতি হস্তক্ষেপ করতে চেয়েছিলো কিন্তু তিনি তা চাননি।তার পারিবারিক ঝামেলা নিয়ে বাইরের লোক হাসাহাসি করুক তা তিনি চাননি । স্বামীর তৈরি তিনকাঠা জমির উপর বিশাল দোতলা বাড়িটার জন্যই যে বৌ এর এই দুর্ব্যবহার টা তিনি ভালোই বুঝতে পারতেন।তার বাপের বাড়ির লোকেরা ঘর ভাড়া করে থাকে।তিনি বাড়িটা যদি লিখে দেন বা ওখান থেকে অন্যত্র চলে যান তাহলে তাদের এনে এখানেই তুলতে পারে।ভেড়া ছেলেটাও তাতেই রাজি।স্বামীর মোটা পেনশন পান।নিত্যদিনের এ অশান্তি থেকে মুক্তি পেতে তিনি বাড়ি ছাড়েন।ছোট্ট এক কামরার একটি ফ্লাট ভাড়া নিয়ে তিনি নিজ বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন। 
     তিনতলা ফ্লাটের একদম নিচুটা তিনি ভাড়া নেন।কিছুটা দূরত্বে একটা বস্তি ছিলো।প্রথমদিন থেকেই অধিক রাত্রে তিনি চিত্কারে চেঁচামেচি শুনতে পান।খবর নিয়ে জানেন কিছু পুরুষ সারাটাদিন পরিশ্রমের পর মদ খেয়ে বাড়িতে এসে বৌকে ধরে পেটানোটাই তাদের অধিক রাতের কাজ বলে মনে করে। না,এই ঘটনাকে নিত্যদিন মেনে নেওয়া যায়না।তিনি পরদিন মহিলাসমিতির অনান্য সভ্যদের সহায়তায় সেখানে হাজির হন।আগেই বাসস্থানের নারীদের সাথে কথা বলে আসেন। যা তিনি লোকলজ্জার ভয়ে নিজের জীবনে করতে পারেননি বা করতে চাননি তা কিছু দরিদ্রমানুষের জন্য পুলিশ এবং মহিলা সমিতির মাধ্যমে করতে পেরে নিজেকে যেন নূতনভাবে খুঁজে পেলেন। 
   

জলাঞ্জলী


     অনুরোধে ঢেঁকি গেলা
জলাঞ্জলি 

 মুখার্জী রায় চৌধুরী 

    বাবার ইচ্ছার দাম দিতে গিয়ে ' অনুরোধে ঢেঁকি গেলার পরিস্থিতি এখন রক্তিমের । বাবার কোন ছেলেবেলার বন্ধু তার সাথে হঠাৎ করে কয়েক যুগ পরে দার্জিলিং টাইগার হিলে নূতন সূর্য্যদয় দেখতে গিয়ে দেখা আর শুধু দেখা তো নয় রক্তিমের মনেহচ্ছে তার স্বপ্নের সূর্য্যটাই অস্ত যেতে বসেছে। 

বাবা,মা আর বোন তিনজন মিলে দিনপনেরোর জন্য দার্জিলিং ঘুরতে গেছিলেন।রক্তিমেরও যাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু অফিসের জরুরী কাজের জন্য তিনমাস আগে টিকিট কাটা সত্বেও যেতে পারেনি।এখন নিজের চুল টেনে নিজেরই ছিঁড়তে ইচ্ছা করছে।গেলে অন্তত মেয়েটার বদনখানি দেখতে পেতো।বাবা যা রাগী তাতে রক্তিমের সাহসই হবেনা ওই মেয়েকে দেখতে চাওয়ার।ভরসা ছিলো ছোট বোন তুবড়ি।সে তো একবার বলছে,'দারুন দেখতে,'পরেরবার বলছে,'মেয়েটা একটু ট্যারা দাদা' আবার কখনোবা 'ভীষণ কালো মেয়ে।'রক্তিমের মাথা পাগল হবার জোগাড়।খাওয়া,ঘুম বিসর্জনের পথে।অফিসের কাজে ভুলভাল।মনেমনে ঠিক করলো,'যা কপালে আছে হবে,মাকে যেভাবে হোক রাজি করিয়ে বাবাকে বলতেই হবে,মেয়েটার সাথে দেখা করার কথা।'
সেদিন রাতে বাবা ও বোন খেয়ে যে যার ঘরে চলে গেলেও রক্তিম বসেই থাকে।ছেলেকে বসে থাকতে দেখে মা বললেন, 
---কিছু বলবি আমাকে? 
---হ্যাঁ মা,তোমার সাথে একটা কথা ছিলো। 
---কি বলবি বল,আমার এখনও অনেক কাজ রয়েছে।
---বাবা হঠাৎ করে এটা না করলেই পারতেন। 
---তোর বিয়ের কথা বলছিস?কেন কি হয়েছে?ছেলেমেয়ে বড় হলে তার তো বিয়ে দিতেই হবে।প্রতিটা বাবা মায়ের এটা দায়িত্ব। 
---তাই বলে বলা নেই কওয়া নেই,চিনিনা জানিনা,কোনদিন দেখিওনি----এমন একটা মেয়েকে কি করে বিয়ে করি বলো তো? 
---আমাদের সময়ে তো এসব ছিলোনা।বাবা মা পছন্দ করতেন আর দেখা হোত সেই ছাদনাতলায় শুভদৃষ্টির সময়ে। 
---মা এখন আর সেই দিন নেই।তুমি বাবাকে একটু রাজি করাও আমি মেয়েটিকে দেখবো। 
---তুই বলছিস আমি বলবো তোর বাবাকে।কিন্তু কোন লাভ হবে বলে মনেহয় না। 
  পরদিন খাবার টেবিলে বাবা নিজেই বললেন, 
---শোনো রক্তিম আমি যখন আমার বন্ধুকে কথা দিয়েছি তখন তোমার এ বিয়ে করতেই হবে।আর আজ পর্যন্ত আমি তোমাদের খারাপ হয় এমন কিছু করিনি।ছেলেবেলার বন্ধু আমার।একই গায়ে থাকতাম।খুব ভালো পরিবার।মেয়েটি ইংলিশে অনার্স করেছে।চাকরীর চেষ্টা করছে।আমাদের সকলের পছন্দ হয়েছে।বিয়েটা এখানেই হবে আর দেখা  সাক্ষাৎ ও হবে সেই ছাদনাতলায়। 
 চুপ করে রক্তিম কথাগুলো শুনে কোনোরকমে খেয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো।রাগে, দুঃখে চোখের থেকেই তার জল বেরিয়ে গেলো।'পরিবার ভালো'---পরিবার ধুয়ে আমি কি জল খাবো?'ইংলিশে অনার্স করেছে'---অনার্স করার জন্য কি চেহারার দরকার হয়?সে ট্যারা,খোঁড়া নাকি কালো কিছুই জানার উপায় নেই।এদিকে বাড়িতে বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে।
   রক্তিমের মুখের হাসিও ফুরিয়ে গেছে।সে যেন হাসতেই ভুলে গেছে।নিমন্ত্রিতদের নামের লিষ্ট করার সময় বাবা যখন জানতে চাইলেন তার কতজন বন্ধু হবে?সে পরিষ্কার জানিয়ে দিলো,'আমার কোন বন্ধু নেই।'তার বাবা,মা উভয়েই বুঝতে পারলেন ছেলের এটা রাগের কথা।
  বিয়ের দু'দিন আগের থেকেই বাড়িতে লোকজন আসতে শুরু করলো।সবার আগে এলো রক্তিমের মাসতুতো বোন-যার একবছর আগে বিয়ে হয়েছে।সেতো এসেই দাদার পিছনে লাগতে শুরু করলো।কিন্তু বোন সুনীতা বুঝতে পারলো দাদার এই বিয়েতে কোন মত নেই আর এই কারনেই তার মুখে হাসিও নেই।সে দাদাকে একলা পেয়ে জানতে চাইলো, 
---হ্যাঁরে দাদা তোর কি এই বিয়েতে মত নেই?তুই কি অন্য কাউকে ভালোবাসিস? 
---না ---
---কোনটাতে 'না'  বললি? 
---তোর দুটো প্রশ্নের উত্তরই আমার কাছে না। 
---মানে? 
---মানে আবার কি?এ বিয়েতে আমার মত নেই কারন মেয়েটিকে আমি দেখিইনি আর আমি কাউকেই ভালোবাসিনা। 
---তাই বল।কিন্তু মাসিমনি তো বললো,মেয়েটাকে খুব সুন্দর দেখতে। 
---বাবা তার বাল্যবন্ধুর মেয়েকে সুন্দর বলছেন তাই মা ও সুন্দর বলছেন।বাবাকে চিনিস তো,তিনি যা বলবেন মাকেও তাই বলতে হবে। 
---তুই মিথ্যে চিন্তা করছিস দাদা।তুবড়িও কিন্তু বলেছে খুব সুন্দর দেখতে। 
---তুই ছাড় ওর কথা।ও কখন কোনটা বলে তার কোন ঠিক আছে।আমি আর ভাববোনা,যা কপালে আছে তাই হবে।হয় কালিন্দীর নয় ট্যারা। 
রক্তিমের বলার ধরনে সুনীতা হেসে ফেললো।'দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।তোর বৌ খুব সুন্দরী হবে।' 
     বর গিয়ে পৌঁছালো মেয়ের বাড়িতে।কিন্তু বরের তো মুখ কালো।'বরের মুখে হাসি নেই,বর হাসতে জানেনা---' নানান কথা তার কানে আসছে।কিন্তু রক্তিম তো তার জীবনসঙ্গীর যে চিত্র অঙ্কন করেছিলো আপনমনে তাকে তো সে জলাঞ্জলী দিয়েই বাবার কথাকে উপেক্ষা করতে না পেরেই ঠুঠো জগন্নাথের মত বিয়ে করতে এসেছে। 
  মেয়েকে নিয়ে আসা হোল।এবার সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।শুভদৃষ্টি।রক্তিমের মুখ আর নীচের দিক হতে বৌ এর মুখ পর্যন্ত ওঠেনা।সবাই হাসাহাসি করতে লাগলো।বরের তো ভারী লজ্জা!শুভদৃষ্টি না হলে বিয়ে হবে কি করে?অনেক বলাবলিতে রক্তিম তার বৌ সুদীপার মুখের দিকে তাকালো।তাকালো তো তাকিয়েই থাকলো।তখন সেখানে আর একপ্রস্ত হাসাহাসি।বর বাবাজি তো লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে বৌ এর দিকে তাকিয়েই আছে। রক্তিম মনেমনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলো---সত্যিই সে কল্পনাও করতে পারেনি তার বৌকে এতো সুন্দর দেখতে হবে।আবার মনে পরে গেলো তুবড়ির কথা।'একটু খোঁড়া দাদা।'সত্যিই খোঁড়া নয় তো?না হাঁটলে বোঝা যাবেনা।এখনই চেহারায় আপ্লুত হবার কোন কারন নেই।দেখি কপালে শেষ পর্যন্ত কি আছে। 
কিছুক্ষণ পরে সে চিন্তাও দূরীভূত হোল।মনেমনে ঈশ্বরের সাথে সাথে বাবাকেও একটা ধন্যবাদ দিলো।তবুও একটা চিন্তা মন থেকে গেলোনা।'মেয়েটা সবাইকে নিয়ে মানিয়ে গুছিয়ে থাকতে পারবে তো?বাবা তো বলেছিলেন,পরিবারটা খুব ভালো।তাছাড়া উচ্চশিক্ষিত মেয়ে।নিশ্চয় পারবে।আপাতত তো চিন্তা দূর হোল।পরেরটা পরে দেখা যাবে।এখন বিয়ের আনন্দটুকু মন খুলে ভোগ করি।কি হবে আর কি হবেনা সে চিন্তা এখন জলাঞ্জলি দিয়ে দিই। 

Saturday, November 16, 2019

সুখ ধরা দেয়না


কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা 
সুখ ধরা দেয়না। 
     নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী 

   তুমি আর 'কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা' আর দিওনা বৌমা!আমি জানি আমার ছেলের দোষ।প্রতিটা মুহূর্তে তা স্বীকারও করছি।তাই বলে ওই একরত্তি ছেলেটাকে তুমি যখন তখন তার বাপ তুলে গালিগালাজ করবে?ওর বাপ তোমার সাথে অন্যায় করেছে কিন্তু ছেলেটার কি দোষ আমায় বলতে পারো?কথা না শুনাটাই তো ওর দুষ্টুমী।অপর্ণাদেবী কথাগুলো বলে তার আদরের নাতীটাকে হাত ধরে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে দিলেন। 
  গরীব ঘরের মেয়ে রানু।অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেছে।অপর্ণাদেবী খুব শখ করে তাকে ঘরের বৌ করে এনেছিলেন।রানুদের থেকে অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল পরিবার তাদের।ছেলে সুধীন ছোটখাটো একটা কোম্পানীতে যা মাইনে পায় তাদের মোটামুটি চলে যায়।অপর্ণাদেবী ছেলেকে বিয়ে দিয়ে তাকে সংসারী করতে চেয়েছিলেন।বিয়ের পর দুটো বছর বেশ ভালোই চলছিলো।অপর্ণাদেবী ছেলের বৌকে নিজের মেয়ের মত ভালোবাসেন।একটা মেয়ের খুব শখ ছিলো তার।স্বামীকে বলেছিলেন ও সে কথা।অপর্ণাদেবীর স্বামী তাকে জানিয়েছিলেন,'আজকের বাজারে ধনীরাই একটা সন্তানের বেশি নেয়না।সেখানে আমরা তো মধ্যবিত্ত পরিবার।একটা বাচ্চা মানুষ করা কি চাট্টিখানি কথা?তুমি তোমার সুধুকেই মানুষের মত মানুষ করে গড়ে তোলো।ওর বিয়ে দিয়ে তুমি ওর বৌকে তোমার মেয়ের মত ভালোবেসো।সংসারটাও সুখের হবে আমরাও মানষিক শান্তি পাবো।'তিনি তার স্বামীর কথাটাকে ধরে রেখেই রানুকে তার মেয়ের জায়গাটা দিয়েছেন।রানুও খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে।সংসারের সবকাজ সে হাসিমুখে করে।তার শ্বাশুড়ীও বসে থাকার মানুষ নয়।তিনিও টুকটাক কাজ করেই চলেছেন।অবশ্য এজন্য তিনি মাঝে মধ্যেই রানুর কাছে মৃদু ধমকও খান।
--আমি তো করছি মা,তোমার কি আমার কাজ পছন্দ হয়না?এতদিন তো তুমিই এই সংসারের যাবতীয় করেছো,এখন বয়স হয়েছে যাও গিয়ে বিশ্রাম নাও।টিভি খুলে সিরিয়াল দেখো।আমি একা ঠিক পারবো। 
  ভালোবাসার এই যে শাষন তার বেড়া ভেঙ্গে অপর্ণাদেবী বেরোতে পারেননা।আর ঠিক তখনই মনে পরে যায় তার স্বামীর কথা---
---দেখো গিন্নী,একটা মেয়ে তার বাপের বাড়ি থেকে যখন শ্বশুরবাড়িতে আসে তখন সে পিছনে ফেলে আসে তার শৈশব,তার ভালোলাগা মন্দলাগা,চেনা পরিচিত সবকিছুই।সবথেকে বড় কথা সে ফেলে আসে তার কাছের মানুষজনকে।এক গাছের ছাল আর এক গাছে লাগেনা।কিন্তু কিছু কিছু মেয়ে পারে যেমন তুমি পেরেছিলে।একটি মেয়ে তার নিজের পরিচিত গণ্ডি ছেড়ে যখন অন্যএকটি পরিবারে এসে পরে তখন শুধু সে কেন মানিয়ে নেবে বলো তো।কত মানুষের মনোরঞ্জন করে তাকে চলতে হয়।সেক্ষেত্রে সেই পরিবারটিরও কি উচিত নয় প্রত্যেকে একটু একটু করে ছেড়ে তার সাথেও অ্যাডজাস্ট করা।এটা কেউ করেনা বলেই সংসারগুলো ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।ছেলের বিয়ে দিয়ে একটা পরের মেয়েকে ঘরে এনে যদি তাকে পর করেই রাখা হয়,যে সংসারে সে আসে তাকে যদি সেই সংসারের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়,সংসারের যাবতীয় কাজে তাকে সারাটাদিন খাটানো হয় তাহলে সুখপাখি তো ফুড়ুৎ করে উড়বেই।'জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রেই তার স্বামীর বলা কথাগুলো তিনি উপলব্ধি করেন। 
  কিন্তু এতো করেও সংসারে সুখপাখিটাকে তিনি ধরে রাখতে পারেননি।সুধীন গ্রাজুয়েশন করেছিলো।তার ইচ্ছা ছিলো অন্তত মাধ্যমিক পাশ করা একটি মেয়ের সাথে তার বিয়ে হোক।কিন্তু মায়ের রানুকে এতোই পছন্দ হয়ে গেলো সে আপত্তি করেও কোন ফল পেলোনা।বিয়ের পর রানুকে মেনে নিতে তার অসুবিধা হলেও রানুর গুণেই সে তাকে ভালবাসতে শুরু করে।বেশ চলছিলো দিনগুলি।কিন্তু হঠাৎ করেই যেন সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেলো।সুধীনের সাথেই চাকরী করে তাপসী বলে একটি মেয়ে।তার সাথেই ভাবভালোবাসা করে তাকেই পূণরায় বিয়ে করে ঘর ভাড়া করে তারা এখন থাকে।বাড়িতে টাকাপয়সা দিতে চেয়েছিলো কিন্তু অমন ছেলের কাছ থেকে টাকা নিতে অপর্ণাদেবীর রুচিতে বাঁধে।তাই তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন তাদের টাকার কোন দরকার নেই।পরবর্তীতে তিনি ও তার বৌমা সেলাই এর কাজ করতে থাকেন।কাটিংটা রানু জানতো।বাপের বাড়িতে থাকতেই শিখেছিলো।স্বামীর জমানো টাকা থেকে তিনি রানুকে একটা সেলাই মেশিন কিনে দেন।নিজেও ভালো হেম করতে জানেন।সংসার আর এই সেলাই -এই নিয়েই শ্বাশুড়ী,বৌ এর সময় কেটে যায়।প্রথম প্রথম তাদের সংসারে অনটন লেগেই থাকতো।কিন্তু এখন ব্যবসাটা দাঁড়িয়েছে।পাঁচ বছরের ছেলেকেও ভালো স্কুলেই পড়ায়।কিন্তু রানুর রাগ হলেই সে 'ওই বাপের ছেলে তো' - ---বলে নানান কথা সে ওই অবুঝ ছেলেটাকে বলে নিজের গায়ের জ্বালা মেটায়।
 একমাত্র ছেলে সুধীনের এই ব্যবহারে অপর্ণাদেবী প্রথম প্রথম খুব কষ্ট পেতেন।বুকটার ভিতর হাহাকার করে উঠতো।কিন্তু এখন নিজেকে অনেকটাই সামলে নিয়েছেন।রানুকে সবসময় সাহস জুগিয়ে চলেন।কখনো ভুলেও তার সামনে সুধীনের কথা বলেননা।কিন্তু রানুর অলক্ষ্যে তিনি যেমন চোখের জল ফেলেন ঠিক সেইরূপ রানুও তার শ্বাশুড়ীর অলক্ষ্যে চোখের জল ফেলে। 
  রানুর ছেলে এবার মাধ্যমিক দেবে।মেইন রাস্তার উপর রানু একটা দোকান নিয়েছে।দুজন কর্মচারীও রেখেছে।শ্বাশুড়ী এখন শয্যাশায়ী।এখনও তিনি মনেমনে বিশ্বাস করেন তার সুধীন একদিন ফিরে আসবেই।কিন্তু কোনদিনও এই মনের ইচ্ছা তিনি রানুর কাছে প্রকাশ করেননি।শুধু চিরতরে চলে যাওয়ার দুদিন আগে তিনি তার কন্যাসম পুত্রবধূকে হাত দুটি ধরে বলেছিলেন,'যদি কোনদিন ও ফিরে আসে ওকে মেনে না নাও অন্তত এই বাড়িতে থাকতে দিও।আর আমি জানি একদিন ও ফিরবেই।' 
   রানু আজও পথ চেয়ে বসে যদি তার সন্তানের পিতা কোনদিন ফিরে আসে তাকে তো তার সন্তানের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে কারন সে যে তার সন্তানের মুখটাও কোনদিন দেখেনি। 

Thursday, November 14, 2019

নিজেকে খুঁজে পেলাম

নিজেকে খুঁজে পেলাম 
   নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী 

    ছেলেবেলার ইচ্ছাগুলিকে জলাঞ্জলি দিয়ে বাবার ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দিয়ে গ্রাজুয়েশনেরর আগেই মধুরিমা বিয়ের পিঁড়িতে বসলো।তার খুব ইচ্ছা ছিলো পড়াশুনা শেষ করে কিছু অন্তত রোজগারের রাস্তা খুঁজে নেবে।কিন্তু বাবা কিছুতেই শুনলেন না।তাই অনিচ্ছা সত্বেও বিয়ে করতে রাজি হওয়া।বিয়ের ছ'মাস পরেও মধুরিমা বুঝতে পারেনা,বাবা কেন কিসের জন্য এইরূপ একটা পরিবারের সাথে তার বিয়ে দিলেন ?
মধুরিমার স্বামী বিধানেরা চার ভাই।বিধান সকলের বড়।বাকি সকলেই পড়াশুনা করছে।সংসারে বিধানই একমাত্র রোজগেরে।সরকারী ক্লাক।নিজেদের ছোট্ট একটা বাড়ি।খুব ছোট ছোট ঘর। অথচ মধুরিমা ছিলো দোতলা বাড়ির তিন ভাইবোনের সকলের ছোট। খুব আদরের ছিলো।দিদি বড় বিয়ে হয়ে গেছে,দাদা একটা কোম্পানীতে মোটা বেতনের চাকরী করে।এই নিম্নবিত্ত পরিবারে বাবা কেন যে তার বিয়ে দিলো কিছুতেই সে আজও বুঝে উঠতে পারলোনা। 
   আপ্রাণ চেষ্টা করে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার।বিধান তার ভায়েরা অত্যন্ত সাদাসীধা।তার মা ও ঠিক তাই। অতি অল্পতেই তারা খুব খুশি।কিন্তু তাদের চালচলন,খাওয়াদাওয়ার সাথে কিছুতেই মধুরিমা খাপ খাওয়াতে পারেনা।কিন্তু বুদ্ধিমতী মেয়ে কখনোই তার আচার ব্যবহারে তা প্রকাশ করেনা।নিজেই নিজেকে শান্তনা দেয় -'কপালে যা ছিলো তাই হয়েছে।'কিন্তু তবুও মাঝে মাঝে বাবার পরে খুব রাগ হয়।কখনো এটাও ভাবে,'বাবা হয়তো শুধুমাত্র সরকারী চাকরী দেখেই এই বিয়েটায় রাজি হয়েছিলেন'। 
 বিয়ের আগেই বাবা মধুরিমাকে বলেছিলেন, 
--বিয়ের পর তুমি গ্রাজুয়েশন করবে।ওদের সাথে আমি কথা বলে নিয়েছি।' 
---কিন্তু বাবা গ্রাজুয়েশনের পর বিয়েটা হলে অসুবিধা কোথায়? 
---অসুবিধাটা ঠিক কোথায় সেটা তুমি আজ বুঝবেনা।একদিন বুঝবে হয়তো সেদিন আমি থাকবোনা।কিন্তু ঠিক বুঝতে পারবে।
বিয়ের পর এই না মানিয়ে নেওয়ার কারনেই নানান অজুহাতে মধুরিমা বাপের বাড়িতে এসে থেকেছে।কিন্তু কোনদিনও বাড়ির কারও কাছে তার কষ্টের কথা শেয়ার করেনি।আর শ্বশুরবাড়ি থেকেও তার শ্বাশুড়ী বা স্বামী মাঝে মাঝেই এই বাড়িতে এসে থাকা নিয়ে কোন কথা কোনদিনও বলেননি।অভাব সংসারে থাকলেও তারা প্রত্যকেই হাসি মুখে সে অভাবকে ভালোবাসা দিয়ে জয় করেছে।সত্যি বলতে কি আস্তে আস্তে শ্বশুরবাড়ির সকলের এই ভালোবাসায় মধুরিমার ভিতরের কষ্টগুলির দগদগে ঘায়ের উপরে একটা শক্ত প্রলেপ পড়িয়ে দেয়। 
  মধুরিমা সবসময় বুঝতে পারতো এই বিশাল সংসারের দায়িত্ব সামলাতে বিধান হিমশিম খাচ্ছে।কিন্তু মুখে কখনই তা প্রকাশ করতোনা।তার উপর ছিলো তার পরোপকার করার স্বভাব।নানান আর্থিক দিক থেকে তাকে যেন সংসার পিষে দিচ্ছিলো।এইসব বুঝতে পেরেই পরীক্ষা শেষে মধুরিমা কিছু প্রাইভেট টিউশন করতে থাকে যাতে তার কিছু সুরাহা হয়।ভীষণ চাপা স্বভাবের বিধান এটা বুঝতে পেরেছিলো।সে কিন্তু কখনোই হাত পেতে মধুরিমার কাছ থেকে টাকা নেয়নি।বরং তার হাতে দিতে চাইলে বলেছে, 
---চালিয়ে নিচ্ছি তো -এগুলো তোমার কাছে থাক,তুমি নিজের ইচ্ছামত খরচ কোরো। 
 মধুরিমার এই সামান্য কটা টাকা।তাই দিয়েই সে মাঝে মধ্যে বাজার করতো।নিজেই যেত।কারন শ্বাশুড়ীমাকে দিতে গেলে তিনিও ঠিক একই কথা বলতেন।মানুষ যে কত ভালো হতে পারে তা বিধানের সাথে বিয়ে না হলে মধুরিমা সত্যিই বুঝতে পারতোনা।একবছর পর মধুরিমা যেদিন বুঝতে পারলো সে মা হতে চলেছে -যখন সে তার স্বামী শ্বাশুড়ীকে কথাটা জানালো সেদিন থেকে বাড়িতে যেন খুশির বন্যা বয়ে যেতে লাগলো।সকলেই খুশি।ডাক্তার বলে দিলেন বেডরেষ্ট।যে যখন বাইরের থেকে আসে একবার করে মধুরিমার ঘরে উঁকি মেরে যায়।জানতে চায়,'বৌদি ঠিক আছো তো?' যেন পারলে তারা তাকে মাথায় করে রাখে।বিধান এই প্রথমবার বাপের বাড়িতে গিয়ে থাকতে চাইলে মিষ্টি হেসে বলে, 
--তুমি এখানেই থাকো গো।আমি তাহলে আমার সন্তান আসার প্রত্যেকটা মুভমেন্ট তোমার দেখতে পাবো। 
এরপর আর মধুরিমা কোন আপত্তি করতে পারেনি।সে যখন তার সন্তানের নড়াচড়া টের পাচ্ছে আর সেই সময় বিধান অফিস থেকে বাড়িতে ফিরে পেটটার উপরে মাথা দিয়ে তার সন্তানের নড়াচড়াটা অনুভব করার চেষ্টা করতো।আর বুঝতে পারলেই খুশিতে তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠতো।সে এক অনন্য অনুভূতিতে সারাটা রাত মধুরিমার পেটের পরে একটা হাত দিয়ে ঘুমিয়ে থাকতো।মধুরিমা প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর থেকেই সে যেন নূতন করে নিজেকে রোজ রোজ আবিষ্কার করতো।আর তা শতগুণ বেরে যায় যেদিন বিধানের সাদা ধবধবে ধুতীর একটি টুকরোর মধ্যে  করে বহু আকাঙ্ক্ষিত তার প্রথম কন্যা সন্তানকে মধুরিমার ঠিক বুকের কাছটাতে এনে শুইয়ে দেয়।মধুরিমার তখন মনে হচ্ছিলো পৃথিবীর সর্বসুখ যেন তার দোরগোড়ায়।নিজেকে সে যেন নূতনভাবে সম্পূর্ণ অন্যরকম রূপে খুঁজে পেলো।মা হওয়ার যে এতো সুখ --এ সুখের যে কোন সীমা পরিসীমা নেই ---আজ প্রথম সে বুঝতে পারলো।পৃথিবীর যে কোন সুখই যে এর কাছে ম্লান আজ প্রথম সে উপলব্ধি করলো। 

Wednesday, November 13, 2019

বাস্তবের রূপকথা

বাস্তবের রূপকথা 
      নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী 

   স্বপ্নের মত একটা বাড়ি।বিশাল বড় গেট।গেট দিয়ে ঢুকেই আটফুটের সিমেন্ট বাঁধানো একটা পাকা রাস্তা।রাস্তার দু'পাশে সবুজ লন।ডানদিকে একটা গ্যারেজ।প্রায়ই স্বপ্নে দেখে পারমিতা।বাড়িটা পরিচিত নয়।ছেলেবেলা থেকে ঠাকুমার কাছে রাজা,বাদশা,মন্ত্রী,সেপাই গল্প শুনতে শুনতে নিজেকে মনেমনে রাজকন্যা কল্পনা করে কোন ভাবের ঠিকানায় একটি রাজপ্রাসাদে বাস করতে করতে ঘুমাতে যেতো।কিন্তু কোনদিনও তার স্বপ্নে কোন রাজপ্রাসাদ আসেনি।এসেছে বাংলো প্যাটানের ছবির মত এই বাড়ি।পারমিতার খুব কাছের বন্ধু ঠাকুমা। ঠাকুমার সাথে সে সব কথা শেয়ার করে।ঠাকুমাকে এই স্বপ্নের কথা বললে তিনি বলেন, 
--দেখবি দিদি ঠিক এইরকম একটা বাড়ির রাজকুমার এসে তোকে বধূবেশে তোর স্বপ্নে দেখা বাড়িটায় দামী গাড়ি করে নিয়ে যাবে।
  একদিন কলেজ থেকে ফিরতে একটু রাতই হয়ে গেলো।কারন কলেজ ছুটির পর কিছু নোটস এর প্রয়োজনে পারমিতা দেবর্তিদের বাড়িতে গেছিলো।দেবোর্তি অনেকটা পথই তাকে এগিয়ে দিয়ে গেছিলো।বড় রাস্তায় বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থেকে অনেকটা সময়ই চলে যায়।হঠাৎ এক বয়স্ক/বয়স্কা ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা পারমিতাকে বলে একটা ট্যাক্সি ধরে দিতে তারা শ্যামবাজার চার মাথার মোড়ে নামবেন।পারমিতা অনেক চেষ্টা করে একটি ট্যাক্সি পায়।পারমিতার বাড়ির রাস্তাও একই।শুধু চার মাথার মোড় থেকে একটা অটো ধরতে হবে।ভদ্রলোক ভদ্রমহিলার পীড়াপীড়িতে সেও ট্যাক্সিতে উঠে বসে।ট্যাক্সিটা চার মাথার মোড় থেকে সামান্য এগিয়ে একটা বড় গেটওয়ালা বাড়ির সামনে থামে।পারমিতা চমকে যায় এই সেই বাড়ি --যে বাড়ি বহুবার সে স্বপ্নে দেখেছে।কিন্তু এতো রাতে অপরিচিত মানুষের বাড়ির ভিতরে ঢুকতে সে সাহস পেলোনা।তবে তাঁদের আশ্বাস দিয়ে আসলো খুব শীগ্রই সে আসবে। 
পরদিন কলেজ যাবেনা ঠিক করলো।সকাল দশটা নাগাদই ওই বাড়ির উর্দেশ্যে সে রওনা দিলো।গেটে আজ সিকিউরিটি ।কিন্তু কাল রাতে যখন গাড়ি থেকে নেমেছিলো তখন তো গেটে কেউ ছিলোনা।এগিয়ে গিয়ে সিকিউরিটিকে গেট খুলতে বললো।পারমিতা খুব আশ্চর্য হল সিকিউরিটি তাকে কোন প্রশ্ন না করেই গেট খুলে দিলো।এতদিন সে যে বাড়িটাকে শুধু স্বপ্নে দেখেছে আজ সে সেটা চাক্ষুষ দেখছে।আনন্দ যেমন হচ্ছে মনের মধ্যে একটা ভয় ও আতংক কাজ করছে।বাড়ির সদর দরজা হাট করে খোলা।আস্তে আস্তে দোতলায় উঠে গেলো।বারবার সে মাসিমা,মেশোমশাই বলে ডাকতে লাগলো।কিন্তু কারও কোন সারাশব্দ পেলোনা।প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলো।গলদঘর্ম হয়ে যখন ছুটে পালাবে ভাবছে তখন পিছন থেকে কেউ যেন বলে উঠলো, 
---কাকে চায়?কোথা থেকে এসেছেন? 
---আসলে কাল রাতে মাসিমা,মেসোমশাই আমাকে আসতে বলেছিলেন।
সুন্দর,সুপুরুষ ছেলেটি কথাগুলো শুনে চুপ করে গিয়ে পারমিতার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো।পারমিতাও যেন এতক্ষণে সম্বিত ফিরে পেয়ে ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো,'এই কি তবে ঠাকুমার বলা রাজকুমার?' 
--হ্যাঁ কি যেন বলছিলেন,মাসিমা,মেসোমশাই এর কথা?উনারা তো এখানে থাকেননা,প্রয়োজনে আসেন।কালই উনারা ফিরে গেছেন। 
প্রশ্ন অনেক ঘুরপাক খাচ্ছে পারমিতার মাথার মধ্যে কিন্তু কোনটাই করতে পারছেনা তার কারন এতো বড় বাড়িতে শুধুমাত্র এই একটিমাত্র মানুষের বাস শুনেই অজানা ভয়ে দিশেহারা হয়ে বেরিয়ে আসতে পারলেই বাঁচে। 
---আচ্ছা তাহলে আমি আবার পরে আসবো। 
---ঠিক আছে। 
পারমিতা বেরোতে যাবে হঠাৎ তার কানে এলো ভদ্রলোক বললেন যে তোমাকে তো আসতেই হবে।পিছন ফিরে জানতে চাইলো,'কিছু বললেন?' 'কই নাতো।' 
 কোনোক্রমে সেদিন পারমিতা বাড়িতে পৌঁছালো।কাউকেই কিছু বললোনা।সারারাত ঠাকুমাকে জড়িয়ে ধরেই ঘুমোলো। 
   পরীক্ষা শেষ।পারমিতা মামাবাড়িতে ঘুরতে গেলো।সেদিনের পর থেকে সে আর ওই স্বপ্নটা দেখেনি যদিও এটা নিয়ে তার কোন মাথাব্যথা নেই।বেশ কিছুদিন মামা বাড়িতে হৈ হৈ করে কেটে গেলো।কিন্তু তাকে লুকিয়ে মামাবাড়ির সকলে যে ফোনে তার সম্মন্ধেই আলোচনা করছে এটা সে বুঝতে পারছে।কানাঘুষা চলছে।পারমিতাকে দেখলেই সব চুপ!জানতে চাইলে সকলে বলে,'ও অন্যকথা তোকে পরে বলবো।' 
 বাড়িতে ফিরে এসে জানতে পারলো তার বিয়ে ঠিক হয়েছে আগামীমাসে।ছেলে বিশাল ব্যবসায়ী, মস্তবড় বাড়ি,দূর্দান্ত দেখতে।সব কিছু শুনে সে তার ঠাকুমাকে বললো,'এটা-উঠ ছুড়ি তোর বিয়ে-তাই হচ্ছে না কি?আমার কোন মতামত নেই, আমার কোন পছন্দ নেই?আর তোমার যা ছেলে -কিছু বলতে গেলে আমায় কচুকাটা করে ফেলবে।' 
--আমার ছেলের উপর ভরসা রাখ, তোর জন্য সে রাজপুত্র জোগাড় করেছে রে!তাকে দেখলে নিজেই হা হয়ে যাবি। 

   কিছুই করার নেই।হাত পা বাঁধা।ছাদনাতলায় শুভদৃষ্টির সময়ে সে যাকে দেখলো সত্যিই সে হা হয়েই গেলো।মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগলো।পিঁড়িতে বসার পর তার বরটি একটু ঝুঁকে তাকে জানালো,'যেসব প্রশ্নগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে একটু সময় দাও সব উত্তর আমি দিয়ে দেবো।' 
পারমিতা ড্যাবড্যাব করে তার রাজপুত্র বরটির দিকে তাকিয়ে থাকলো।  
  শিল্পপতি অসিত মুখার্জী তার পাঁচ বছরের ছেলে ও বৌকে নিয়ে প্রতিবছরই ঘুরতে বেরোন।তখন ব্যবসার কাজ দেখেন বাবা নিজ হাতে।বংশপরম্পরা বিশাল পারিবারিক ব্যবসা।বহুবার তিনি দার্জিলিং গেছেন কিন্তু দার্জিলিঙের ওই সবুজ বনানী আর পাহাড় যেন তাকে বারবার ডাকে।তিনি এই ডাককে কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারেননা।তাই এক দুবছর অন্তরই তিনি সেখানে ছুটে যান।আর এই যাওয়াটাই তার জীবনের কাল হোল।বিশাল এ্যাকসিডেন্ট!একটি গাড়ি আর একটি গাড়িকে পাশ কাটাতে গিয়ে সোজা গাড়িটি চলে গেলো কয়েক হাজার ফুট নীচুতে।কিছু একটা ঘটতে চলেছে বুঝতে পেরে মুহূর্তে গাড়ির দরজা খুলে ছেলে অনিন্দ্যকে রাস্তার উপরেই ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন।অসিতবাবুর দেহ উদ্ধার হলেও তার স্ত্রীর নলিনীকে আর খুঁজে পাওয়া যায়না।অনিন্দ্যর প্রচুর আঘাত লাগে।বাঁচার আশা ছিলো ক্ষীণ।একমাস হাসপাতাল থাকতে হয়।নানানভাবে অনুসন্ধানের পর অনিন্দ্য যখন পুরোপুরি সুস্থ্য হয় তখন তার দাদু,ঠাকুমা তাকে খুঁজে পান।দাদু তাকে ছোটবেলা থেকেই ব্যবসা সংক্রান্ত খুঁটিনাটি বুঝাতে থাকেন।অতি অল্প বয়সেই সে সব ব্যপারে পারদর্শী হয়ে ওঠে।তারা প্রায়ই অনিন্দ্যকে বলতেন,'তোমাকে বিয়ে দিয়ে সংসারী করে তবে আমাদের ছুটি।এর আগে যে মরেও শান্তি পাবোনা।'কিন্তু বিধাতা তাদের কাউকেই সে সুযোগ দিলেননা।মাত্র ছ'মাসের ব্যবধানে দু'জনই তাদের আদরের বাইশ বছরের অনিন্দ্যকে রেখে চিরতরে চলে গেলেন।পাড়াপ্রতিবেশীর সাথে খুব একটা মেলামেশা না থাকলেও অনিন্দ্যর কানে বহুবার এসছে যে তারা দুজনকেই নাকি একসাথে রাতবিরেতে দেখতে পায়।সে নিজেও এর প্রমান যে পায়নি তাও নয়।চিরতরে চলে গিয়েও অনিন্দ্যকে সংসারী করতে তারা ছিলেন বদ্ধপরিকর।অনিন্দ্যর জন্য যোগ্য পাত্রী খুঁজে তার বিয়ের ব্যবস্থা করেই তারা তাদের নিজেদের মুক্তি নিজেরাই করে নিয়েছেন। 
ফুলশয্যার রাতে এই বিশাল কাহিনী শুনে পারমিতা আরও সরে গিয়ে একেবারে অনিন্দ্যর গা ঘেসে বসে।মুখ শুকিয়ে পুরো আমসি।অনিন্দ্য বুঝতে পেরে হেসে পরে বললো,'ভয় পেয়োনা গো।দাদু,ঠাকুমাকে আর কোনদিনও দেখা যাবেনা।আমি তাদের এতো আদরের নাতী,চিরতরে চলে গিয়েও আমাকে সংসারী করার জন্য এতদিন ঘুরে বেড়িয়েছেন।আজ আমি সংসারী।আর তাদের কোন ভয় নেই।  আমার মা,বাবার কাছে কোন জবাবদিহি আর করতে হবেনা। 

ক্ষমা করো

ক্ষমা করো 
     নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী 

    পেশায় নার্স মাধুরী বিয়ের পাঁচ বছর পরেও মা হতে না পারার যন্ত্রণাটা কিছুতেই উপশম করতে পারেনা।বহুবার সে একটা দত্তক নিতে চেয়েছে।কিন্তু কিছুতেই রাজি করাতে পারেনি স্বামী দেবেশকে।হাসপাতালে অধিকাংশ দিনই তার ডিউটি পরে লেবাররুমে।খুব কাছ থেকে সে দেখতে পায় মা হওয়ার তীব্র কষ্ট আর ঠিক তার পরেই সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া প্রস্ফুটিত ফুলের মত শিশুটির মুখ দেখে মায়ের মুখের হাসি।এক নিমেষে যেন সমস্ত কষ্ট উধাও হয়ে যায়।খুব ইচ্ছা করে এই সুখটাকে অনুভব করতে।কিন্তু ইচ্ছা সাধ সবই যেন পূরণ হয় সেই অদৃশ্য কারও হাতের ছোঁয়ায়। 
   দুটি মেয়ের পরে সুলেখা জম্ম দেয় আবার একটি মেয়ের।মেয়ে হয়েছে শুনেই তার মুখ না দেখেই সুলেখা হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলো।মাধুরী  জানতে চাইলো তার এই কান্নার কারন।উত্তরে সে জানালো তার শ্বাশুড়ী , স্বামী এবার মেয়ে হয়েছে শুনলে বাড়িতে আর ঢুকতে দেবেনা।অবাক হয়ে মাধুরী ভাবে কেউ সন্তান চেয়ে পায়না আর কেউ পেয়েও খুশি হতে পারেনা।এ কেমন বিচার ঈশ্বরের? 
   সুলেখার স্বামীর সাথে কথা বলে আইনী কাগজপত্র তৈরী করে সুলেখা হাসপাতালে থাকতেই মেয়েটিকে দত্তক নেয় মাধুরী।সুলেখা কিন্তু এক'দিন মেয়েটির মুখ দেখেনা।কারন হিসাবে মাধুরীকে বলে,'আমি তো মা,ওর মুখ দেখলেই আমি মায়ায় জড়িয়ে যাবো।অথচ এই মেয়ে নিয়ে যদি আমি বাড়ি যাই আমাকে তো বাড়ি থেকে তাড়িয়েই দেবে উপরন্তু আমার আর দুটি মেয়েও ভালোভাবে মানুষ হবেনা।অভাবের সংসার আমার।নুন আনতে পান্তা ফুরায়।ভায়ের সংসারেও ঠাঁই হবেনা।ও তোমার কাছে ভালো থাকবে,খাওয়া পড়ার কষ্ট হবেনা,মমুষের মত মানুষ হবে' 
  প্রস্ফুটিত একটি ফুলকে তোয়ালের মধ্যে করে বুকে জড়িয়ে মাধুরী যেদিন বাড়ি ফেরে দেবেশ এই বাচ্চাটিকে মেনে নিতে পারেনি।তার মা অনুরাধাদেবী সস্নেহে বাচ্চাটিকে বুকে জড়িয়ে ধরেছেন।তিনি তার ছেলেকে অনেক বুঝিয়েছেন কিন্তু দেবেশের এক কথা অন্যের সন্তানকে সে কিছুতেই নিজের ভাবতে পারবেনা। 
  স্বামী,স্ত্রীর মধ্যে কথা বন্ধ হোল,ঘর আলাদা হোল।যে যার ডিউটি করে যাচ্ছে কিন্তু সম্পর্ক আর ঠিক হলনা।দিন গড়িয়ে যেতে থাকলো।মাধুরীর মেয়ে মাম আস্তে আস্তে বড় হতে থাকলো।ছ'মাসে সে সমস্ত বাড়িময় হামা দিয়ে বেড়ায়।আড় চোখে দেবেশ তাকিয়ে দেখে।তার দুষ্টুমীতে মাঝে মধ্যে নিজের অজান্তেই হেসে ওঠে।পরক্ষণে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে মা বা বৌ কেউ দেখতে পেলো কিনা।কিন্তু মাধুরী বা তার শ্বাশুড়ীর কোন কিছুই নজর এড়ায়না।একজন কিছু দেখতে পেলেই অন্যজনের কানে চলে যায়। 
  মেয়ের সাতমাস বয়স হোল।এবার মুখে ভাত দিতে হবে।ঠিক হোল ঠাকুরের প্রসাদ এনেই মুখে ভাত দেওয়া হবে।কোন আড়ম্বর হবেনা।একদিন দেবেশ বসে আছে চেয়ারে, মাম হামা টেনে দেবেশের কাছে গিয়ে তার পা ধরে দাঁড়িয়ে পড়লো।দেবেশ দুই হাত দিয়ে তাকে কোলে তুলে নিলো।কোলে উঠেই মাম দুই হাতে দেবেশের চুল ধরে টানতে শুরু করলো।হঠাৎ মামের মুখ থেকে বা ----বা , বা ---বা ডাক শুনে দেবেশ মামকে বুকের সাথে চেপে ধরে দুই গালে চুমু খেলো।মাধুরী ও তার শ্বাশুড়ীর এ দৃশ্যও  দৃষ্টি এড়ালোনা।তারা চুপচাপ নিজেদের কাজে চলে গেলো।দেবেশ মামকে কোলে নিয়ে মায়ের কাছে গিয়ে বললো,'মা ওর তো সাতমাস বয়স হোল মুখেভাত দেবে না?' 
---ওই একটু প্রসাদ এনে দিয়ে দেবো ভেবেছি।ওর মা ঠাকুরমার এর থেকে আর  বেশি ক্ষমতা নেই। 
---কেন ওর বাবা আছে তো! 
  মাধুরী পিছনে এসে দাঁড়িয়েছিল সে বলে ওঠে, 
---কে ওর বাবা? 
---কেন আমি , ওই তো আমাকে মেরে চুল টেনে দু দুবার বাবা বলে ডাকলো।আরে সেদিন আমি বুঝতে পারিনি,আমি আমার ভুল স্বীকার করছি।আমি বড় করে ওর মুখে ভাত দেবো।তোমরা আয়োজন করো খরচ আমার।
কথাগুলো বলে দেবেশ চলে যাওয়ার সময় মাধুরীকে খুব আস্তে আস্তে বলে গেলো যাতে মা শুনতে না পায়', 'তোমার আর মেয়ের শোয়ার জিনিসপত্রগুলো মায়ের ঘর থেকে আমাদের ঘরে নিয়ে এসো।মামকে কোলে নিয়েই সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। 

Monday, November 11, 2019

ট্রেনের সেই রাত

ট্রেনের সেই রাত 
         নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী 

        ডক্টর ববিতা চক্রবর্তী বাবার সাথে মুম্বাই যাওয়ার পথে ট্রেনের কামরার ভিতর শুনতে পায় হঠাৎ একটা হৈ হট্টগোল।খবর নিয়ে জানতে পারে একটি দশ বারো বছরের ছেলে অসুস্থ্য হয়ে পড়েছে।ভিড় ঠেলে ছেলেটির কাছে এগিয়ে যায় ববিতা।সকলকে অনুরোধ করে সেখান থেকে চলে যেতে।ছেলেটির বাড়ির লোককে জানায় সে একজন ডক্টর।ছেলেটির পাশে বসে তাকে পরীক্ষা করতে করতে তার কেস হিস্ট্রিটা জেনে নেয়।বাচ্চাটিকে নিয়ে তার মা ও দাদা মুম্বাই যাচেছন ক্যান্সারের চিকিৎসা করাতে।হঠাৎ করেই সে ট্রেনের ভিতর অজ্ঞান হয়ে যায়।বাচ্চাটির মা কান্নাকাটি করছেন তাকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে একজন ছাব্বিশ সাতাশ বছরের যুবক।ববিতা বাচ্চাটিকে পরীক্ষা করে যুবকটির উদ্দেশে বলে,'একটু খেয়াল রাখুন আমি আসছি।'দৌড়ে নিজের সিটের কাছে এসে তার ডাক্তারী ব্যাগটা নিয়ে আবার বাচ্চাটির কাছে ফিরে যায়।একটা ইনজেকশন দিয়ে নাড়ি ধরে বসে থাকে।কাঁদতে কাঁদতে বাচ্চাটির মা ট্রেনের সিটের নীচুতেই বসে পড়েন।কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যুবকটি এক দৃষ্টিতে ভায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে।কিছুক্ষণ পরে বাচ্চাটির জ্ঞান আসে।ববিতা উঠে দাঁড়িয়ে ভদ্রমহিলাকে ধরে সিটে বসায়।যুবকটির কাছে জানতে চায়, 'এইরূপ হওয়ার কারন?'মাথা নীচু করেই সে জানায় দিন পনের আগে ডক্টর জানান তার ভায়ের ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে।তিনি কিছু ওষুধও দেন।সেগুলি খাওয়ানোর পর থেকে ভাই যেন আরও অসুস্থ্য হয়ে পড়েছে। তারা কোন ডক্টর দেখাবে জানতে চাওয়ায় যুবকটি তাকে জানায় যে এখনও ঠিক করেনি।ববিতা বলে, 
---মুম্বাই ক্যান্সার হাসপাতালে সবচেয়ে বড় ডক্টর হচ্ছেন ডক্টর আগরওয়াল।
একটা কার্ড ব্যাগ থেকে বের করে যুবকটির হাতে দিয়ে বলে, 
---আমার কার্ড।আমি কাল সকাল দশটা নাগাদ হাসপাতাল গিয়ে স্যারের সাথে কথা বলে রাখবো।আপনারা অবশ্য তার আগেই  ওখানে পৌঁছাবেন।কোন চিন্তা করবেন না,আমার যেটুকু সাধ্য আমি করবো। 
এতক্ষণে যুবকটি কথা বলে, 
---আমরা দুই ভাই।রোগটা ধরা পড়ার সাথে সাথেই মাকে আর ভাইকে নিয়ে রওনা দিয়েছি।কিন্তু হঠাৎ করে ও অজ্ঞান হয়ে যাওয়াতে আমি পুরো পাজেল্ড হয়ে গেছিলাম।মাথা কাজ করছিলোনা।ভাগ্যিস আপনি ছিলেন তানাহলে যে কি হোত ঈশ্বরই জানেন। 
---ভাববেন না।আমি আছি।বাবাকে নিয়ে দিদির বাড়ি যাচ্ছি।বাবাকে দিদির কাছে পৌঁছে দিয়েই আমি হাসপাতাল চলে যাবো।
  সুগত এতক্ষণ পরে মেয়েটির মুখের দিকে তাকালো।নিজেই চমকে গেলো।এ তো সদ্যফোঁটা একটি গোলাপ!পাগল করে দেওয়া রূপ! মাথা ভর্তি চুল একটা হাত খোঁপা করা।প্রসাধনের লেশমাত্র নেই।আনুমানিক সাড়ে পাঁচফুটের মত হাইট।গায়ের রং যেন দুধেআলতা।চোখদুটি যেন কথা বলে।একজন ডাক্তার তার উপর সুন্দরী অথচ বিন্দুমাত্র অহংকার নেই।সুগত ভাবতে থাকে আজকের দিনে এমন মানুষও হয়? 
   ঠিক সময়মত ববিতা হাসপাতাল পৌঁছে গিয়ে দেখে সুগতরা তার আগেই পৌঁছে কার্ড করে তার অপেক্ষাতেই বসে আছে।মা ও ভাইকে  ভিতরে রেখে সে গেটের কাছে ববিতার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে।ববিতা সুগতকে দেখে একগাল হেসে পরে।সরাসরি সে ওদের নিয়ে ডক্টর আগরওয়ালার কাছে যায়।
  দিন দশেক সুগতর ভাই সৌতম হাসপাতাল ভর্তি থাকে।নানান পরীক্ষানিরীক্ষায় ধরা পরে- না,ওর ক্যান্সার হয়নি।আগের রিপোর্টগুলো সব ভুল ছিলো।ভুল ডাইগোনোসিসের কারনে কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ওর শারীরিক কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচেছ।কিছুদিন হাসপাতালে অবজারভেশনে থাকলে পুরোপুরি সুস্থ্য হয়ে যাবে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচে সুগত আর ওর মা।এ কটাদিনে ববিতা ওদের অনেক কাছকাছি চলে আসে।সৌতম তো দিদি বলতে পাগল।সুগতর মা ও ববিতার প্রতি ছেলের ব্যপারে ভীষণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েন।ট্রেনের ভিতর যখন সৌতম অসুস্থ্য হয়ে পরে তাকে মা,ছেলে দুজনেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন ঠিক তখন যেন দেবদূতের মত ববিতা তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।
     স্বল্পভাষী সুগত ববিতার সাথে সবসময়ই একটা দূরত্ব বজায় রেখে চলে। কারন নিজের অজান্তেই বড়লোকের অসম্ভব সুন্দরী এই ডাক্তার মেয়েটাকে তার ভালো লেগে যায়।সামান্য কয়েকটা দিনের আলাপে মুখফুটে এ কথা কিছুতেই সে ববিতাকে জানাতে পারেনা।তার উপর সে যা উপকার করেছে সারাজীবন তার কাছে ঋণী হয়েই থাকতে হবে।সামান্য একজন ব্যাঙ্ক কেরানী হয়ে ভালোবাসার কথা ববিতাকে বলা মানে সুগতর কাছে এটা বামুন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানো।সৌতম সুস্থ্য হয়ে যাওয়ার পর দুবার ববিতা তাদের সাথে দেখা করতে হোটেলে এসেছে।গল্পগুজব যা তা সকলকিছু মা আর ভায়ের সাথেই হয়েছে।সুগতর সাথে হয়েছে ভায়ের অসুখ সম্পর্কে কথাবার্তা। 
   সুগত তার মা, ভাইকে নিয়ে কলকাতা ফিরে আসে।ভাই ও মায়ের সাথে যে প্রায় রোজই ববিতার সাথে ফোনে কথা হয় সেটা সুগত জানে।প্রায় মাস তিনেক পরে অফিস থেকে ফিরে সুগত দেখে বাড়ির গেটের সামনে বড় একটা গাড়ি দাঁড়ানো।কে আসতে পারে ভাবতে ভাবতে ঘরে ঢুকে দেখে ববিতা ও আরও একজন সুন্দর সুপুরুষ বসে।কিছুটা অবাক হয় -মনেমনে যাকে নিয়ে স্বপ্নের জাল বুনেছে এই তিনমাস ধরে সে তাহলে অন্যকারও।নিজেকে নিজেই ধন্যবাদ দেয় ভাগ্যিস ববিতাকে বেফাঁস কিছু বলে ফেলেনি। 
     পাঁচ বছর পর--

    জীবনে চলার পথে হঠাৎ দেখা কিছু মানুষ খুব কাছে চলে আসে।কখনো সে সম্পর্ক দৃঢ় হয়ে আজীবন থেকে যায় আবার কখনো খোঁজ খবরের অভাবে সেখানেই ইতি টানে।এই ব্যস্ত জীবনে অনেক সুন্দর সম্পর্কই নষ্ট হয়ে যায় শুধুমাত্র সময়ের সাথে মানুষ তাল মেলাতে পারেনা বলে।ভালো থাকা,ভালোভাবে বাঁচার প্রয়োজনে দিনরাত সবাই ছুটছে।তাই এই ছোট ছোট সম্পর্কগুলো অনেক সময় সময়ের অভাবেই আস্তে আস্তে দূর থেকে দূরে চলে যায়।জীবনে অনেক সুন্দরীদের সান্নিধ্যে এসছে সুগত কিন্তু সেভাবে কাওকে কোনদিন মনের কোণে ঠাঁই দেয়নি অথাৎ অন্যচোখে দেখার মত কারও মধ্যেই সেভাবে কোন গুণ সে খুঁজে পায়নি।যা সে দেখতে পেয়েছিলো ববিতার মধ্যে।হঠাৎ করে সেদিন বাড়িতে ববিতার সাথে আসা ছেলেটিকে দেখে নিজের অজান্তেই অপরিচিত ছেলেটির প্রতি তার একটা হিংসা কাজ করছিলো। জীবনে প্রথম কোন নারীকে নিয়ে সে সবে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলো।কিন্তু হঠাৎ করেই তার সে স্বপ্নের সুতোটা কেটে যাওয়াতে প্রথম অবস্থায় সুগত খুবই ভেঙ্গে পড়েছিল।আস্তে আস্তে সে নিজেকে সামলেও নিয়েছে।আজও কখনও কখনও পরিবারের তিনজন যখন একত্রিত হয় প্রায়ই ববিতার কথা আলোচনা হয়।সে সময় সুগত হা হু করেই তার বক্তব্য শেষ করে।কারন আজও মাত্র কয়েক দিনের হলেও তার প্রথম প্রেমকে ভুলতে পারেনি।জীবনের প্রথম প্রেমের স্মৃতি ভুলা যায়না।কেউই ভুলতে পারেনা।মনের কোণে কোন এক গহীনে তাকে ঘূম পাড়িয়েই রাখে সবাই।সে জাগে ঠিক যখন অন্যদিকের মানুষটি একাকী থাকে। ওই প্রথম প্রেম যাকে সর্বদা ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয় সে তখন ওই মানুষটাকে সঙ্গ দেয়।সিনেমার ফ্লাশব্যাকের মত অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো সামনে আসে।মনেমনে তার সাথে কত কথা হয়।স্মৃতির খাতা উল্টেপাল্টে মনের মাঝেই চলে তার অ্যানালিসিস।মাঝে মাঝে মনেহয় হয়তো কিছু বলার ছিলো বলতে পারিনি বা যা বলেছিলাম তা বলা ঠিক হয়নি।এই বলা না বলা কথাগুলো নিয়েই জীবন পারি দেওয়া।
     অফিসের কাজে সুগত এখন  হায়দ্রাবাদ।সকাল থেকে রাত অফিসের কাজ শেষে রাতে হোটেলে ফেরা।পৃথিবীটা তো গোল।সেইজন্যেই হয়তো অপরিচিত জায়গাগুলোতে পরিচিত মানুষের সান্নিধ্য পাওয়া যায়।হোটেলের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সুগত চা খাচ্ছিলো।হঠাৎ একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর,ফোনে কারও সাথে কথা বলছে।পিছন ঘুরে তাকিয়ে দেখে -যার সাথে জীবনে আর কোনদিন দেখা হবে ভাবেইনি সে সশরীরে তার সামনে উপস্থিত।কি এক দুর্নিবার আকর্ষণে পায়ে পায়ে সুগত এগিয়ে যায় সেই চুম্বক শক্তির কাছে।ববিতার তখন ফোনে কথা বলা শেষ।সুগত প্রথমেই মুখের দিকে তাকিয়ে ববিতার সিঁথিটা লক্ষ্য করে, তারপর হাতের দিকে।না,কোথাও কোন এয়োতীর চিহ্ন নেই।মুহূর্তে ভেবে নিলো আজকাল আর কেউ কোন চিহ্নই রাখেনা।তারউপর সে একজন ডক্টর।
---কি চিনতে পারছেন? 
ববিতা ঘুরে দাঁড়িয়ে পড়লো। 
--আরে আপনি?কেন চিনতে পারবোনা।সত্য বলতে কি আপনাদের কথা প্রায়ই মনে পরে।ফোনটা হারিয়ে যাওয়াতে আর যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।এখানে?বেড়াতে নাকি কাজে? 
--অফিসের কাজে এসেছি। 
---আর আপনি?
---আমার এক বন্ধু, আত্মীয়ও বলতে পারেন এখানেই থাকেন।খুব অসুস্থ্য হয়ে হাসপাতালে আছেন।বারবার আমাকে আসতে বলছে তাই আসা। 
--মেশোমশাই আর বাড়ির অন্যরা সব কেমন আছেন? 
--বাবা আজ দু'বছর হোল আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।একা একা কেটে যাচ্ছে দিনগুলো। 
  সুগত অবাক হোল কেন একা কেন?সেই বন্ধুটি তাহলে কোথায়?কৌতুহল সংবরণ করলো। 
--সৌগত,মাসিমা এরা সব কেমন আছেন? 
---ভাই এবার উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে বিটেকে ভর্তি হয়েছে যাদবপুর।আর মা?মায়ের শরীরটা খুব একটা ভালোনা।বয়স হয়েছে বুঝতেই পারছেন।আচ্ছা আমরা তো কারও রুমে গিয়ে বসতে পারি এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছি কেন? 
সুগত হেসে পরে বলে,'চলুন তাহলে আমার রুমে জমিয়ে আর এককাপ চা খেতে খেতে আড্ডা দিই। 
দু'জনে এসে সুগতর রুমে বসলো।চললো অনেকক্ষণ গল্প।সুগত ইচ্ছা করেই রুমের দরজাটা হাট করে খুলে রাখে।কথায় কথায় ববিতা তাকে বলে,'আগামীকাল সকালের দিকে সে তার বন্ধুকে হাসপাতাল দেখতে যাবে যদি সুগতর সময় হয় তাহলে তার সাথে গেলে তার ভালো লাগবে।সুগত রাজি হয়।কারন পরদিন তাকে দুপুর দুটো নাগাদ অফিসের কাজে বেরোতে হবে। 
  হাসপাতাল পৌঁছে যে বেডের কাছে সুগতকে নিয়ে গেলো ববিতা সে দেখলো সেদিনের সেই সুন্দর সুপুরুষ মানুষটি শুয়ে আছে।গলার কাছে একটা যন্ত্রণা দলা পাকিয়ে হঠাৎ যেন স্বাভাবিকভাবে নেওয়া নিঃশ্বাস প্রশ্বাসটাকেই বন্ধ করে দিলো সুগতর ।সেই সুন্দর চেহারা সেই হৃষ্টপুষ্ট চেহারার মানুষটির যেন কঙ্কাল শুয়ে আছে।সামান্য কথাবার্তা বলে সুগত হাসপাতালের করিডোরে এসে দাঁড়ালো।তার মনের ভিতরে একটা ঝড় উথালপাতাল করছে।ছেলেটি অসুস্থ্য?ববিতার আত্মীয়?আর সে কিনা এই ছেলেটির সাথে ববিতার----।নিজেকে সে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করলো।নিজের কাছে নিজেকে খুব ছোট মনেহচ্ছে তখন তার।ববিতা কিছুক্ষণ পরে বাইরে এলো।দুজনেই চুপচাপ।একটা ক্যাব বুক করে হোটেলের দিকে রওনা দিলো।কিছুটা এসে সুগত ক্যাব থেকে নেমে গেলো তার অফিসের কাজে।নামার সময় ববিতাকে বললো,সাবধানে যাবেন,সন্ধ্যায় ফিরে কথা হবে। 
সুগত হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে ববিতার রুমে গিয়ে বসে গল্প করতে লাগলো।একথা সেকথার পর সুগত বললো, 
---ভদ্রলোকের কি হয়েছে?আপনার কি হন উনি? 
---ও আমার দূরসম্পর্কের দিদির ছেলে।আমার থেকে দু'বছরের বড়।একটা সময় আমরা পাশাপাশি বাড়িতে থাকতাম।ছেলেবেলার থেকেই আমাদের বন্ধুত্ব।একসময় জামাইবাবু অথাৎ রাজীবের বাবা এখানে বদলী হয়ে আসেন।তারপর এখানেই ফ্লাট কিনে পাকাপাকিভাবে বাস করতে থাকেন।রাজীবের আর একটা ভাই আছে।দিদি,জামাইবাবু  দুজনেই খুব ঘুরতে ভালোবাসতেন।আর এই ঘোরায় হোল তাদের কাল।সিকিম থেকে জুলুক যাওয়ার পথে হঠাৎ করে তাদের গাড়ির সামনে একটা বড় পাথর এসে পরে।ঝিরঝির করে সেদিন বৃষ্টিও হচ্ছিল।চলন্ত গাড়িটা গিয়ে  ওই বড় পাথরের গায়ে ধাক্কা মারে।তাল সামলাতে না পেরে ড্রাইভার ও আরও দু'জন সহ গাড়ি খাদে পরে যায়।সাতদিন ধরে চেষ্টা করেও কারও বডি পাওয়া যায়নি।তখনও জামাইবাবু চাকুরী করছেন।পরিবারের একজনকে চাকরী দেওয়া হবে শুনে রাজীব তখন ভায়ের জন্যই বাঁধা চাকরীটা ছেড়ে দেয়।নিজে ব্যবসা করবে বলে ঠিক করে।কিন্তু হঠাৎ করে ওর কিডনী সমস্যা ধরা পরে।মাঝে মধ্যেই ও কলকাতা আমাদের বাড়িতে আসতো।যেদিন রাজীব আমার সাথে আপনাদের বাড়ি গেছিলো তখনও কিন্তু ও অসুস্থ্য।কিন্তু ওর ছিলো অস্বাভাবিক মনের জোর।বাইরে থেকে ওকে দেখে ও যে অসুস্থ্য বোঝা যেতনা।সবসময় হাসিখুশি প্রাণবন্ত একটি ছেলে।জামাইবাবুর জমানো প্রায় পুরো টাকাটা দিয়েই একজন ডোনার জোগাড় করে ওর কিডনী ট্রান্সফার করা হয়।বছর চারেক ভালোই ছিলো।কিন্তু একদিন বাথরুমে গিয়ে ও ভীষণভাবে পরে যায়।কোমরের হাড় ভেঙ্গে যায় অপারেশনও সাকসেসফুল হয়।আস্তে আস্তে সুস্থ্য হয়ে যাচ্ছিলো।কিন্তু কিছুদিন আগে একদিন ভোর থেকে কোমরে যন্ত্রণা শুরু হয়।সঙ্গে সঙ্গে রাজীবের ভাই হাসপাতাল ভর্তি করে।পাশে দাঁড়ানোর সেরূপ কেউ না থাকায় আমায় আসার জন্য জোর করতে লাগে।কিডনিতে ওর কিন্তু কোন সমস্যা নেই।আমি ডাক্তারদের সাথে কথা বলে যা বুঝলাম ওর হাড়ের জয়েন্ট পূণরায় খুলে গেছে আর এই কারনেই হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকে ও আর বসতে পারেনি।অবস্থা মোটেই ভালো নয়।কাল অর্থোপেডিকসের সাথে আবার কথা বলবো যদি পূণরায় অপারেশান করা যায়।কিন্তু প্রতিটা মুহুর্ত এখন গুরুত্বপূর্ণ। 
কারন আমার ধারণা যদি সত্যি হয় তাহলে যেকোন সময় হাড়ের থেকে রস গড়িয়ে রক্তের সাথে মিশে গিয়ে সেপ্টিসেমিয়া হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
  কথাগুলো বলতে বলতেই ববিতার গলা কান্নায় বুজে আসছিলো।কথা শেষ করে সে অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগলো।কান্নাভেজা গলায় আবারও শুরু করলো, 
---সম্পর্কে আমি ওর মাসি হই।কিন্তু কোনদিনও ও আমাকে মাসি বলে ডাকেনি।নাম ধরেই ডাকতো।ও যেমন ওর জীবনের সমস্ত কথা অবলীলায় আমার সাথে শেয়ার করতো আমিও ঠিক তাই।আমার সবথেকে কাছের বন্ধু রাজীবই। 
  ববিতা হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলো।সুগত কি করবে কি বলবে কিছুই বুঝতে না পেরে চুপচাপ বসে থাকলো কিছুক্ষণ।ববিতা শান্ত হলে বললো,ভাববেন না সব ঠিক হয়ে যাবে।' 
কথাটা বললো বটে কিন্তু রাজীবের পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে তাতে তার মনে সে কোন আশার আলো দেখতে পেলোনা।রাতে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লো।মনের মধ্যে ববিতার বলা রাজীবের কথাগুলোই ঘুরপাক খাচ্ছে।হঠাৎ ফ়োন।সুগত ভাবলো মা বা ভাই ফ়োন করেছে।দেখে ববিতার ফ়োন।কান্নাভেজা কণ্ঠে ববিতা বললো, রাজীবের অবস্থা মোটেই ভালো নয়।এক্ষুণি হাসপাতাল যেতে হবে।আপনি একটু চলুন না আমার সাথে। 
---হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়।আমি বেরোচ্ছি। 
  পুরো রাস্তা ক্যাবের মধ্যে ববিতা কাঁদতে কাঁদতে গেলো।হাসপাতাল পৌঁছে দেখে রাজীবের ভাই রাজেশ ও তার কিছু বন্ধু বান্ধব।রাজেশের সাথে কথা বলে জানতে পারে ডক্টর জবাব দিয়ে দিয়েছেন।কাঁদতে কাঁদতে ছুটে যায় রাজীবের কাছে।রাজীব তখন ভেন্টিলেশনে।সুগত জোর করে তাকে নীচে নামিয়ে আনে।বাকিরাতটুকু সকলের হাসপাতালেই কাটে।সকালে ডক্টর ডেথসার্টিফিকেট দেয় সেপ্টিসেমিয়া। 
  এই ঘটনার দুদিন পর সুগত ও ববিতা একসাথে ট্রেনে কলকাতার উর্দেশ্যে রওনা দেয়।ভীষণভাবে ভেঙ্গে পরে ববিতা।আর দিনরাত কান্নাকাটির ফলে ট্রেনের ভিতরই সে জ্বরে প্রায় অচৈতন্য হয়ে পরে।জ্বরের ঘোরে রাজীবের সাথে কথা বলতে থাকে।ফ্লাস্কের মুখটা খুলে নিয়ে নিজের রুমাল দিয়ে সারাটা রাত ববিতার মাথাটা নিজের কোলের উপর রেখে জলপটি দিতে থাকে সুগত।ঘোরের মধ্যে নানান কথা বলতে বলতে হঠাৎ ববিতা বলতে শুরু করে,'হ্যাঁ রাজু আমার সাথে সুগতর আবার দেখা হয়েছে।কিন্তু আমি তাকে বলতে পারিনি আমার ভালোবাসার কথা।সেদিন হাসপাতালেও তুই জানতে চেয়েছিলি---তোকে কথা দিয়েছি ---ওকে ঠিক বলবো সময়মত---'।সুগত ববিতার মাথায় হাত বুলাতে থাকে।আর ট্রেন ছুটে চলেছে দুরন্ত গতিতে।