ট্রেনের সেই রাত
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
ডক্টর ববিতা চক্রবর্তী বাবার সাথে মুম্বাই যাওয়ার পথে ট্রেনের কামরার ভিতর শুনতে পায় হঠাৎ একটা হৈ হট্টগোল।খবর নিয়ে জানতে পারে একটি দশ বারো বছরের ছেলে অসুস্থ্য হয়ে পড়েছে।ভিড় ঠেলে ছেলেটির কাছে এগিয়ে যায় ববিতা।সকলকে অনুরোধ করে সেখান থেকে চলে যেতে।ছেলেটির বাড়ির লোককে জানায় সে একজন ডক্টর।ছেলেটির পাশে বসে তাকে পরীক্ষা করতে করতে তার কেস হিস্ট্রিটা জেনে নেয়।বাচ্চাটিকে নিয়ে তার মা ও দাদা মুম্বাই যাচেছন ক্যান্সারের চিকিৎসা করাতে।হঠাৎ করেই সে ট্রেনের ভিতর অজ্ঞান হয়ে যায়।বাচ্চাটির মা কান্নাকাটি করছেন তাকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে একজন ছাব্বিশ সাতাশ বছরের যুবক।ববিতা বাচ্চাটিকে পরীক্ষা করে যুবকটির উদ্দেশে বলে,'একটু খেয়াল রাখুন আমি আসছি।'দৌড়ে নিজের সিটের কাছে এসে তার ডাক্তারী ব্যাগটা নিয়ে আবার বাচ্চাটির কাছে ফিরে যায়।একটা ইনজেকশন দিয়ে নাড়ি ধরে বসে থাকে।কাঁদতে কাঁদতে বাচ্চাটির মা ট্রেনের সিটের নীচুতেই বসে পড়েন।কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যুবকটি এক দৃষ্টিতে ভায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে।কিছুক্ষণ পরে বাচ্চাটির জ্ঞান আসে।ববিতা উঠে দাঁড়িয়ে ভদ্রমহিলাকে ধরে সিটে বসায়।যুবকটির কাছে জানতে চায়, 'এইরূপ হওয়ার কারন?'মাথা নীচু করেই সে জানায় দিন পনের আগে ডক্টর জানান তার ভায়ের ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে।তিনি কিছু ওষুধও দেন।সেগুলি খাওয়ানোর পর থেকে ভাই যেন আরও অসুস্থ্য হয়ে পড়েছে। তারা কোন ডক্টর দেখাবে জানতে চাওয়ায় যুবকটি তাকে জানায় যে এখনও ঠিক করেনি।ববিতা বলে,
---মুম্বাই ক্যান্সার হাসপাতালে সবচেয়ে বড় ডক্টর হচ্ছেন ডক্টর আগরওয়াল।
একটা কার্ড ব্যাগ থেকে বের করে যুবকটির হাতে দিয়ে বলে,
---আমার কার্ড।আমি কাল সকাল দশটা নাগাদ হাসপাতাল গিয়ে স্যারের সাথে কথা বলে রাখবো।আপনারা অবশ্য তার আগেই ওখানে পৌঁছাবেন।কোন চিন্তা করবেন না,আমার যেটুকু সাধ্য আমি করবো।
এতক্ষণে যুবকটি কথা বলে,
---আমরা দুই ভাই।রোগটা ধরা পড়ার সাথে সাথেই মাকে আর ভাইকে নিয়ে রওনা দিয়েছি।কিন্তু হঠাৎ করে ও অজ্ঞান হয়ে যাওয়াতে আমি পুরো পাজেল্ড হয়ে গেছিলাম।মাথা কাজ করছিলোনা।ভাগ্যিস আপনি ছিলেন তানাহলে যে কি হোত ঈশ্বরই জানেন।
---ভাববেন না।আমি আছি।বাবাকে নিয়ে দিদির বাড়ি যাচ্ছি।বাবাকে দিদির কাছে পৌঁছে দিয়েই আমি হাসপাতাল চলে যাবো।
সুগত এতক্ষণ পরে মেয়েটির মুখের দিকে তাকালো।নিজেই চমকে গেলো।এ তো সদ্যফোঁটা একটি গোলাপ!পাগল করে দেওয়া রূপ! মাথা ভর্তি চুল একটা হাত খোঁপা করা।প্রসাধনের লেশমাত্র নেই।আনুমানিক সাড়ে পাঁচফুটের মত হাইট।গায়ের রং যেন দুধেআলতা।চোখদুটি যেন কথা বলে।একজন ডাক্তার তার উপর সুন্দরী অথচ বিন্দুমাত্র অহংকার নেই।সুগত ভাবতে থাকে আজকের দিনে এমন মানুষও হয়?
ঠিক সময়মত ববিতা হাসপাতাল পৌঁছে গিয়ে দেখে সুগতরা তার আগেই পৌঁছে কার্ড করে তার অপেক্ষাতেই বসে আছে।মা ও ভাইকে ভিতরে রেখে সে গেটের কাছে ববিতার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে।ববিতা সুগতকে দেখে একগাল হেসে পরে।সরাসরি সে ওদের নিয়ে ডক্টর আগরওয়ালার কাছে যায়।
দিন দশেক সুগতর ভাই সৌতম হাসপাতাল ভর্তি থাকে।নানান পরীক্ষানিরীক্ষায় ধরা পরে- না,ওর ক্যান্সার হয়নি।আগের রিপোর্টগুলো সব ভুল ছিলো।ভুল ডাইগোনোসিসের কারনে কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ওর শারীরিক কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচেছ।কিছুদিন হাসপাতালে অবজারভেশনে থাকলে পুরোপুরি সুস্থ্য হয়ে যাবে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচে সুগত আর ওর মা।এ কটাদিনে ববিতা ওদের অনেক কাছকাছি চলে আসে।সৌতম তো দিদি বলতে পাগল।সুগতর মা ও ববিতার প্রতি ছেলের ব্যপারে ভীষণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েন।ট্রেনের ভিতর যখন সৌতম অসুস্থ্য হয়ে পরে তাকে মা,ছেলে দুজনেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন ঠিক তখন যেন দেবদূতের মত ববিতা তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।
স্বল্পভাষী সুগত ববিতার সাথে সবসময়ই একটা দূরত্ব বজায় রেখে চলে। কারন নিজের অজান্তেই বড়লোকের অসম্ভব সুন্দরী এই ডাক্তার মেয়েটাকে তার ভালো লেগে যায়।সামান্য কয়েকটা দিনের আলাপে মুখফুটে এ কথা কিছুতেই সে ববিতাকে জানাতে পারেনা।তার উপর সে যা উপকার করেছে সারাজীবন তার কাছে ঋণী হয়েই থাকতে হবে।সামান্য একজন ব্যাঙ্ক কেরানী হয়ে ভালোবাসার কথা ববিতাকে বলা মানে সুগতর কাছে এটা বামুন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানো।সৌতম সুস্থ্য হয়ে যাওয়ার পর দুবার ববিতা তাদের সাথে দেখা করতে হোটেলে এসেছে।গল্পগুজব যা তা সকলকিছু মা আর ভায়ের সাথেই হয়েছে।সুগতর সাথে হয়েছে ভায়ের অসুখ সম্পর্কে কথাবার্তা।
সুগত তার মা, ভাইকে নিয়ে কলকাতা ফিরে আসে।ভাই ও মায়ের সাথে যে প্রায় রোজই ববিতার সাথে ফোনে কথা হয় সেটা সুগত জানে।প্রায় মাস তিনেক পরে অফিস থেকে ফিরে সুগত দেখে বাড়ির গেটের সামনে বড় একটা গাড়ি দাঁড়ানো।কে আসতে পারে ভাবতে ভাবতে ঘরে ঢুকে দেখে ববিতা ও আরও একজন সুন্দর সুপুরুষ বসে।কিছুটা অবাক হয় -মনেমনে যাকে নিয়ে স্বপ্নের জাল বুনেছে এই তিনমাস ধরে সে তাহলে অন্যকারও।নিজেকে নিজেই ধন্যবাদ দেয় ভাগ্যিস ববিতাকে বেফাঁস কিছু বলে ফেলেনি।
পাঁচ বছর পর--
জীবনে চলার পথে হঠাৎ দেখা কিছু মানুষ খুব কাছে চলে আসে।কখনো সে সম্পর্ক দৃঢ় হয়ে আজীবন থেকে যায় আবার কখনো খোঁজ খবরের অভাবে সেখানেই ইতি টানে।এই ব্যস্ত জীবনে অনেক সুন্দর সম্পর্কই নষ্ট হয়ে যায় শুধুমাত্র সময়ের সাথে মানুষ তাল মেলাতে পারেনা বলে।ভালো থাকা,ভালোভাবে বাঁচার প্রয়োজনে দিনরাত সবাই ছুটছে।তাই এই ছোট ছোট সম্পর্কগুলো অনেক সময় সময়ের অভাবেই আস্তে আস্তে দূর থেকে দূরে চলে যায়।জীবনে অনেক সুন্দরীদের সান্নিধ্যে এসছে সুগত কিন্তু সেভাবে কাওকে কোনদিন মনের কোণে ঠাঁই দেয়নি অথাৎ অন্যচোখে দেখার মত কারও মধ্যেই সেভাবে কোন গুণ সে খুঁজে পায়নি।যা সে দেখতে পেয়েছিলো ববিতার মধ্যে।হঠাৎ করে সেদিন বাড়িতে ববিতার সাথে আসা ছেলেটিকে দেখে নিজের অজান্তেই অপরিচিত ছেলেটির প্রতি তার একটা হিংসা কাজ করছিলো। জীবনে প্রথম কোন নারীকে নিয়ে সে সবে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলো।কিন্তু হঠাৎ করেই তার সে স্বপ্নের সুতোটা কেটে যাওয়াতে প্রথম অবস্থায় সুগত খুবই ভেঙ্গে পড়েছিল।আস্তে আস্তে সে নিজেকে সামলেও নিয়েছে।আজও কখনও কখনও পরিবারের তিনজন যখন একত্রিত হয় প্রায়ই ববিতার কথা আলোচনা হয়।সে সময় সুগত হা হু করেই তার বক্তব্য শেষ করে।কারন আজও মাত্র কয়েক দিনের হলেও তার প্রথম প্রেমকে ভুলতে পারেনি।জীবনের প্রথম প্রেমের স্মৃতি ভুলা যায়না।কেউই ভুলতে পারেনা।মনের কোণে কোন এক গহীনে তাকে ঘূম পাড়িয়েই রাখে সবাই।সে জাগে ঠিক যখন অন্যদিকের মানুষটি একাকী থাকে। ওই প্রথম প্রেম যাকে সর্বদা ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয় সে তখন ওই মানুষটাকে সঙ্গ দেয়।সিনেমার ফ্লাশব্যাকের মত অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো সামনে আসে।মনেমনে তার সাথে কত কথা হয়।স্মৃতির খাতা উল্টেপাল্টে মনের মাঝেই চলে তার অ্যানালিসিস।মাঝে মাঝে মনেহয় হয়তো কিছু বলার ছিলো বলতে পারিনি বা যা বলেছিলাম তা বলা ঠিক হয়নি।এই বলা না বলা কথাগুলো নিয়েই জীবন পারি দেওয়া।
অফিসের কাজে সুগত এখন হায়দ্রাবাদ।সকাল থেকে রাত অফিসের কাজ শেষে রাতে হোটেলে ফেরা।পৃথিবীটা তো গোল।সেইজন্যেই হয়তো অপরিচিত জায়গাগুলোতে পরিচিত মানুষের সান্নিধ্য পাওয়া যায়।হোটেলের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সুগত চা খাচ্ছিলো।হঠাৎ একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর,ফোনে কারও সাথে কথা বলছে।পিছন ঘুরে তাকিয়ে দেখে -যার সাথে জীবনে আর কোনদিন দেখা হবে ভাবেইনি সে সশরীরে তার সামনে উপস্থিত।কি এক দুর্নিবার আকর্ষণে পায়ে পায়ে সুগত এগিয়ে যায় সেই চুম্বক শক্তির কাছে।ববিতার তখন ফোনে কথা বলা শেষ।সুগত প্রথমেই মুখের দিকে তাকিয়ে ববিতার সিঁথিটা লক্ষ্য করে, তারপর হাতের দিকে।না,কোথাও কোন এয়োতীর চিহ্ন নেই।মুহূর্তে ভেবে নিলো আজকাল আর কেউ কোন চিহ্নই রাখেনা।তারউপর সে একজন ডক্টর।
---কি চিনতে পারছেন?
ববিতা ঘুরে দাঁড়িয়ে পড়লো।
--আরে আপনি?কেন চিনতে পারবোনা।সত্য বলতে কি আপনাদের কথা প্রায়ই মনে পরে।ফোনটা হারিয়ে যাওয়াতে আর যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।এখানে?বেড়াতে নাকি কাজে?
--অফিসের কাজে এসেছি।
---আর আপনি?
---আমার এক বন্ধু, আত্মীয়ও বলতে পারেন এখানেই থাকেন।খুব অসুস্থ্য হয়ে হাসপাতালে আছেন।বারবার আমাকে আসতে বলছে তাই আসা।
--মেশোমশাই আর বাড়ির অন্যরা সব কেমন আছেন?
--বাবা আজ দু'বছর হোল আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।একা একা কেটে যাচ্ছে দিনগুলো।
সুগত অবাক হোল কেন একা কেন?সেই বন্ধুটি তাহলে কোথায়?কৌতুহল সংবরণ করলো।
--সৌগত,মাসিমা এরা সব কেমন আছেন?
---ভাই এবার উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে বিটেকে ভর্তি হয়েছে যাদবপুর।আর মা?মায়ের শরীরটা খুব একটা ভালোনা।বয়স হয়েছে বুঝতেই পারছেন।আচ্ছা আমরা তো কারও রুমে গিয়ে বসতে পারি এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছি কেন?
সুগত হেসে পরে বলে,'চলুন তাহলে আমার রুমে জমিয়ে আর এককাপ চা খেতে খেতে আড্ডা দিই।
দু'জনে এসে সুগতর রুমে বসলো।চললো অনেকক্ষণ গল্প।সুগত ইচ্ছা করেই রুমের দরজাটা হাট করে খুলে রাখে।কথায় কথায় ববিতা তাকে বলে,'আগামীকাল সকালের দিকে সে তার বন্ধুকে হাসপাতাল দেখতে যাবে যদি সুগতর সময় হয় তাহলে তার সাথে গেলে তার ভালো লাগবে।সুগত রাজি হয়।কারন পরদিন তাকে দুপুর দুটো নাগাদ অফিসের কাজে বেরোতে হবে।
হাসপাতাল পৌঁছে যে বেডের কাছে সুগতকে নিয়ে গেলো ববিতা সে দেখলো সেদিনের সেই সুন্দর সুপুরুষ মানুষটি শুয়ে আছে।গলার কাছে একটা যন্ত্রণা দলা পাকিয়ে হঠাৎ যেন স্বাভাবিকভাবে নেওয়া নিঃশ্বাস প্রশ্বাসটাকেই বন্ধ করে দিলো সুগতর ।সেই সুন্দর চেহারা সেই হৃষ্টপুষ্ট চেহারার মানুষটির যেন কঙ্কাল শুয়ে আছে।সামান্য কথাবার্তা বলে সুগত হাসপাতালের করিডোরে এসে দাঁড়ালো।তার মনের ভিতরে একটা ঝড় উথালপাতাল করছে।ছেলেটি অসুস্থ্য?ববিতার আত্মীয়?আর সে কিনা এই ছেলেটির সাথে ববিতার----।নিজেকে সে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করলো।নিজের কাছে নিজেকে খুব ছোট মনেহচ্ছে তখন তার।ববিতা কিছুক্ষণ পরে বাইরে এলো।দুজনেই চুপচাপ।একটা ক্যাব বুক করে হোটেলের দিকে রওনা দিলো।কিছুটা এসে সুগত ক্যাব থেকে নেমে গেলো তার অফিসের কাজে।নামার সময় ববিতাকে বললো,সাবধানে যাবেন,সন্ধ্যায় ফিরে কথা হবে।
সুগত হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে ববিতার রুমে গিয়ে বসে গল্প করতে লাগলো।একথা সেকথার পর সুগত বললো,
---ভদ্রলোকের কি হয়েছে?আপনার কি হন উনি?
---ও আমার দূরসম্পর্কের দিদির ছেলে।আমার থেকে দু'বছরের বড়।একটা সময় আমরা পাশাপাশি বাড়িতে থাকতাম।ছেলেবেলার থেকেই আমাদের বন্ধুত্ব।একসময় জামাইবাবু অথাৎ রাজীবের বাবা এখানে বদলী হয়ে আসেন।তারপর এখানেই ফ্লাট কিনে পাকাপাকিভাবে বাস করতে থাকেন।রাজীবের আর একটা ভাই আছে।দিদি,জামাইবাবু দুজনেই খুব ঘুরতে ভালোবাসতেন।আর এই ঘোরায় হোল তাদের কাল।সিকিম থেকে জুলুক যাওয়ার পথে হঠাৎ করে তাদের গাড়ির সামনে একটা বড় পাথর এসে পরে।ঝিরঝির করে সেদিন বৃষ্টিও হচ্ছিল।চলন্ত গাড়িটা গিয়ে ওই বড় পাথরের গায়ে ধাক্কা মারে।তাল সামলাতে না পেরে ড্রাইভার ও আরও দু'জন সহ গাড়ি খাদে পরে যায়।সাতদিন ধরে চেষ্টা করেও কারও বডি পাওয়া যায়নি।তখনও জামাইবাবু চাকুরী করছেন।পরিবারের একজনকে চাকরী দেওয়া হবে শুনে রাজীব তখন ভায়ের জন্যই বাঁধা চাকরীটা ছেড়ে দেয়।নিজে ব্যবসা করবে বলে ঠিক করে।কিন্তু হঠাৎ করে ওর কিডনী সমস্যা ধরা পরে।মাঝে মধ্যেই ও কলকাতা আমাদের বাড়িতে আসতো।যেদিন রাজীব আমার সাথে আপনাদের বাড়ি গেছিলো তখনও কিন্তু ও অসুস্থ্য।কিন্তু ওর ছিলো অস্বাভাবিক মনের জোর।বাইরে থেকে ওকে দেখে ও যে অসুস্থ্য বোঝা যেতনা।সবসময় হাসিখুশি প্রাণবন্ত একটি ছেলে।জামাইবাবুর জমানো প্রায় পুরো টাকাটা দিয়েই একজন ডোনার জোগাড় করে ওর কিডনী ট্রান্সফার করা হয়।বছর চারেক ভালোই ছিলো।কিন্তু একদিন বাথরুমে গিয়ে ও ভীষণভাবে পরে যায়।কোমরের হাড় ভেঙ্গে যায় অপারেশনও সাকসেসফুল হয়।আস্তে আস্তে সুস্থ্য হয়ে যাচ্ছিলো।কিন্তু কিছুদিন আগে একদিন ভোর থেকে কোমরে যন্ত্রণা শুরু হয়।সঙ্গে সঙ্গে রাজীবের ভাই হাসপাতাল ভর্তি করে।পাশে দাঁড়ানোর সেরূপ কেউ না থাকায় আমায় আসার জন্য জোর করতে লাগে।কিডনিতে ওর কিন্তু কোন সমস্যা নেই।আমি ডাক্তারদের সাথে কথা বলে যা বুঝলাম ওর হাড়ের জয়েন্ট পূণরায় খুলে গেছে আর এই কারনেই হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকে ও আর বসতে পারেনি।অবস্থা মোটেই ভালো নয়।কাল অর্থোপেডিকসের সাথে আবার কথা বলবো যদি পূণরায় অপারেশান করা যায়।কিন্তু প্রতিটা মুহুর্ত এখন গুরুত্বপূর্ণ।
কারন আমার ধারণা যদি সত্যি হয় তাহলে যেকোন সময় হাড়ের থেকে রস গড়িয়ে রক্তের সাথে মিশে গিয়ে সেপ্টিসেমিয়া হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
কথাগুলো বলতে বলতেই ববিতার গলা কান্নায় বুজে আসছিলো।কথা শেষ করে সে অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগলো।কান্নাভেজা গলায় আবারও শুরু করলো,
---সম্পর্কে আমি ওর মাসি হই।কিন্তু কোনদিনও ও আমাকে মাসি বলে ডাকেনি।নাম ধরেই ডাকতো।ও যেমন ওর জীবনের সমস্ত কথা অবলীলায় আমার সাথে শেয়ার করতো আমিও ঠিক তাই।আমার সবথেকে কাছের বন্ধু রাজীবই।
ববিতা হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলো।সুগত কি করবে কি বলবে কিছুই বুঝতে না পেরে চুপচাপ বসে থাকলো কিছুক্ষণ।ববিতা শান্ত হলে বললো,ভাববেন না সব ঠিক হয়ে যাবে।'
কথাটা বললো বটে কিন্তু রাজীবের পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে তাতে তার মনে সে কোন আশার আলো দেখতে পেলোনা।রাতে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লো।মনের মধ্যে ববিতার বলা রাজীবের কথাগুলোই ঘুরপাক খাচ্ছে।হঠাৎ ফ়োন।সুগত ভাবলো মা বা ভাই ফ়োন করেছে।দেখে ববিতার ফ়োন।কান্নাভেজা কণ্ঠে ববিতা বললো, রাজীবের অবস্থা মোটেই ভালো নয়।এক্ষুণি হাসপাতাল যেতে হবে।আপনি একটু চলুন না আমার সাথে।
---হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়।আমি বেরোচ্ছি।
পুরো রাস্তা ক্যাবের মধ্যে ববিতা কাঁদতে কাঁদতে গেলো।হাসপাতাল পৌঁছে দেখে রাজীবের ভাই রাজেশ ও তার কিছু বন্ধু বান্ধব।রাজেশের সাথে কথা বলে জানতে পারে ডক্টর জবাব দিয়ে দিয়েছেন।কাঁদতে কাঁদতে ছুটে যায় রাজীবের কাছে।রাজীব তখন ভেন্টিলেশনে।সুগত জোর করে তাকে নীচে নামিয়ে আনে।বাকিরাতটুকু সকলের হাসপাতালেই কাটে।সকালে ডক্টর ডেথসার্টিফিকেট দেয় সেপ্টিসেমিয়া।
এই ঘটনার দুদিন পর সুগত ও ববিতা একসাথে ট্রেনে কলকাতার উর্দেশ্যে রওনা দেয়।ভীষণভাবে ভেঙ্গে পরে ববিতা।আর দিনরাত কান্নাকাটির ফলে ট্রেনের ভিতরই সে জ্বরে প্রায় অচৈতন্য হয়ে পরে।জ্বরের ঘোরে রাজীবের সাথে কথা বলতে থাকে।ফ্লাস্কের মুখটা খুলে নিয়ে নিজের রুমাল দিয়ে সারাটা রাত ববিতার মাথাটা নিজের কোলের উপর রেখে জলপটি দিতে থাকে সুগত।ঘোরের মধ্যে নানান কথা বলতে বলতে হঠাৎ ববিতা বলতে শুরু করে,'হ্যাঁ রাজু আমার সাথে সুগতর আবার দেখা হয়েছে।কিন্তু আমি তাকে বলতে পারিনি আমার ভালোবাসার কথা।সেদিন হাসপাতালেও তুই জানতে চেয়েছিলি---তোকে কথা দিয়েছি ---ওকে ঠিক বলবো সময়মত---'।সুগত ববিতার মাথায় হাত বুলাতে থাকে।আর ট্রেন ছুটে চলেছে দুরন্ত গতিতে।
No comments:
Post a Comment