#আমার_লেখনীতে নবরূপে আমি .....
গহীনে
নন্দা মুখাৰ্জী রায় চৌধুরী
মাত্র ছাব্বিশ বছরের সংসারে বাড়ির ভিতরটা ছাড়া বাইরের জগৎ সম্পর্কে আমি ছিলাম সম্পূর্ণ আনাড়ী| কেন জানিনা মানুষটির উপর নির্ভর করে থাকতেই আমার ভালো লাগতো| আমি আমার সংসার আর ছেলেমেয়ে নিয়েই ভালো থাকতাম| তবে ছেলেমেয়ে যখন থেকে স্কুল যাওয়া শুরু করলো ওদের বাবার উপর আর একটু দায়িত্ব বর্তালো| ওদের লেখাপড়া ব্যাপারে আমার সাহায্য বলতে স্কুল ও কোচিনে দিয়ে আসা নিয়ে আসা| ওদের বাবা সরকারী চাকরী করার সুবাদে এবং পোস্টিং কলকাতার বাইরে হওয়ায় বিয়ের পর অষ্টমঙ্গলা সেরে আসার পরদিনই শিলিগুড়ির উর্দ্দেশ্যে রওনা দিতে হয়েছিলো| এসব আমি বিয়ের আগে থেকেই জানতাম| তখন আমার গ্রাজুয়েশনের ফল বের হয়নি| বিয়েতে আপত্তি জানিয়েছিলাম| পড়াশুনায় খুব একটা খারাপ ছিলামনা| ইচ্ছা ছিলো রোজগারের একটা রাস্তা খুঁজে নেবো| কিন্তু বাবার অকালমৃত্যু নিজের সুপ্ত ইচ্ছাগুলোকে জলাঞ্জলি দিতে বাধ্য করেছিলো| বিয়ের আগে আমাদের পরিবারের রোজগার বলতে আমার বড়দির সাধারণ একটি সরকারী চাকরী| সেও তার সমস্ত আশাআকাঙ্খা অনেক আগেই গলা টিপে মেরে ফেলেছিলো বাবার পাশে দাঁড়িয়ে সংসারে আরও একটু সচ্ছলতা আনার জন্য| বিয়ের পিঁড়িতে তাকে বসানো যায়নি এই একটিমাত্র কারণের জন্যই|
যে কথা বলছিলাম| স্বামীর সাথে চলে এলাম সম্পূর্ণ আমার নিজের সংসারে একটি ভাড়া বাড়িতে যা আমার স্বামী অথাৎ প্রলয় নিজের হাতে খুব সুন্দর করে গুছিয়ে রেখে জাঁকজমক করে আমায় আনতে কলকাতায় ছুটেছিল| প্রথম সন্তান আমার মেয়ে| জম্মের একমাসের মধ্যেই প্রলয়ের প্রমোশন হয়| এমনিতেই মেয়ে হওয়াতে প্রলয় এবং তার পরিবার ছিলো ভীষণ খুশি তার উপর একমাসের মধ্যে পদন্নোতি| চার পুরুষ পরে তাদের সংসারে আমার মেয়ে প্রিয়াঙ্কার আগমনকে তারা মা লক্ষ্মীর কৃপা বলেই মনে করে| তারপর ছবছর পরে আসে আমার ছেলে প্রিয়ম| রান্নাবান্না, ওদের দেখভাল আর স্বামীর সেবাযত্ন নিয়েই আমার সময় কেটে যেত| এরপর প্রলয় শিলিগুড়িতেই জমি কিনে মনের মত করে বাড়িও তৈরী করে| আমাকে কোন ব্যাপারেই কোন হ্যাপা পোহাতে হয়নি এই বাড়ির ব্যাপারে| নিজে অফিস ছুটি নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে সবকিছু তদারকি করেছে| অবশ্য মাঝে মধ্যে তার সাথে আমাকে যেতেই হয়েছে আমার পছন্দ মতো মত প্রকাশ করার জন্য| এহেন মানুষটা রিটায়ারমেন্টের দুবছর আগে একদিন অফিস থেকে বাড়ি ফিরলো প্রচন্ড জ্বর নিয়ে| রক্ত পরীক্ষায় ধরা পড়লো ম্যালেরিয়া| হাসপাতালে সাতদিন ধরে যমে মানুষে টানাটানি করে আমি হেরে গেলাম| চলে গেলো সবকিছু আমার দায়িত্বে ফেলে রেখে| ছেলেমেয়ে প্রচন্ড ভেঙ্গে পড়লো বিশেষত মেয়ে পিয়া| এদের শান্তনা দিতে দিতে প্রলয়ের জন্য চোখের জল ফেলতেও যেন ভুলে গেলাম| অল্প বয়সে বাবাকে হারিয়ে তারাও কেমন থম মেরে গেলো আর আমি পড়লাম অথৈ সমুদ্রে| আমার মাথায় তখন আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে | ব্যাঙ্ক, এলআইসি, বাড়ির খাজনা--- আমি তো কিছুই চিনিনা কিছুই জানিনা|
শুরু হল আমার জীবনের আর এক অধ্যায়| পড়াশুনার শেষে খেয়েদেয়ে যখন প্রিয়া, প্রিয়ম ঘুমিয়ে পড়তো আমি বসতাম আলমারী খুলে প্রলয়ের সুন্দর করে গুছিয়ে রাখা সব ফাইলগুলো নিয়ে| তারউপর আছে রোজ ছুটাছুটি প্রলয়ের অফিসে পেনশনের জন্য| কাউকেই চিনিনা কিভাবে কোথায় এগোবো কিছুই না বুঝে নিজের পেটের বিদ্যের দৌলতে আস্তে আস্তে বাইরের কাজের সাথে নিজেকে ঠিক মানিয়ে নিতে সক্ষম হলাম| কাজগুলি একটা একটা করে গুটিয়ে নিয়ে আসতে লাগলাম| যত সহজে আমি কথাগুলো বলতে পারছি এই কাজগুলি কিন্তু তত সহজ ছিলোনা| সরকারী চেয়ার দখল করে যেসব কর্মচারীরা আছেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ নিজেদেরকে এক একজন কেউকেটা মনে করেন| কোন কথা জানতে চাইলে একবার থেকে দুবার বলতে যেন তাদের আত্মসম্মানে লাগে| তারা ভুলে যায় এই কাজগুলি করার জনই সরকার তাদের মাসে মাসে মাইনে দিয়ে রেখেছে| কিছু কিছু কর্মচারীর দুর্ব্যবহার যেন মজ্জাগত| সমস্ত অপমান সহ্য করে লাগাতার এ টেবিল থেকে অন্য টেবিল করে বেড়িয়েছি| কিন্তু হাল ছাড়িনি একমুহূর্তের জন্যও | আমাকে পারতেই হবে , প্রলয়ের অসমাপ্ত কাজগুলিকে সমাপ্ত করে ছেলেমেয়ে দুটিকে আমার মানুষের মত মানুষ করতে হবে এই অদম্য ইচ্ছাশক্তিই আমাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে|
দুবছরের মধ্যে নিজেকে ভেঙ্গেচুরে নুতন করে গড়েছি| যে আমি কোনদিনও বাইরে একা বেরোতে সাহস পেতামনা সেই আমি আমার সংসার এবং সন্তানদের জন্য ঘর বার যেকোনো কাজেই আজ সমান পারদর্শী| আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে নিজেই মাঝে মধ্যে প্রশ্ন করি " আজকের আমি আর সেদিনের আমির মধ্যে আজ বিস্তর ফাঁরাক| আমার মধ্যে যে আর একটা আমি ঘুমিয়ে ছিলো প্রলয় থাকাকালীন সময়ে তার উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে কোনদিনও টের পাইনি| প্রলয় চলে গিয়ে আমায় যেন নবরূপে সংসারের দায়িত্ব পালনের জন্য তৈরী করে দিয়ে গেলো|"
No comments:
Post a Comment