কিছু সম্পর্কের নাম হয়না
নন্দা মুখাৰ্জী রায় চৌধুরী
আটটা পাঁচের বনগাঁ লোকাল ট্রেনটা ধরে রোজ অফিস আসা সায়নের| কত চেনা অচেনা মানুষের সাথে রোজ দেখা| জীবিকার প্রয়োজনে, রোগের সাথে যুদ্ধের কারনে, স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রী শিক্ষক শিক্ষিকা নিত্য অফিসযাত্রী --- কত কত হাজার লোক নিত্যদিন ট্রেন বা বাসে যাতায়াত করছে| কেউ কারোই মনের খবর জানেনা| রোজ ঘড়ি ধরে যাতায়াতের কারনে অনেক অপরিচিত মানুষও পরিচিত হয়ে যায়| একসাথে পাশাপাশি বসে কখনও রাজনীতি, কখনও পারিবারিক সমস্যা আবার কখনোবা সামাজিক--- ইত্যাদি নানান ধরণের আলোচনা ---- পারিবারিক নানান সমস্যায় " প্রয়োজন হলে বলবেন "-- কথাটা সামান্য হলেও মানসিক বল পাওয়ার জন্য যথেষ্ট-- হয়তো সেভাবে কাউকেই পাশে পাওয়া যায়না কিন্তু সাময়িক পরিচয়ের সূত্র ধরে অনেকের বিপদের দিনে এই কথাটুকুই অনেক পাওয়া | আজও পৃথিবীতে যে ভালো মানুষ আছে আমরা প্রত্যেকেই কিন্তু কোন না কোন সময় নিজেরাই টের পাই| হয়তো এই ভালো মানুষের সংখ্যাটা খারাপ মানুষের তুলনায় খুবই নগন্য কিন্তু সংখ্যাটা যতই নগন্য হোকনা কেন তাদের জন্যই পৃথিবীটা আজও এতো সুন্দর | প্রতিটা মুহূর্তেই আমরা টের পাচ্ছি অর্থের লোভে নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য মানুষ আস্তে আস্তে কত হিংস্র আর ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে | কিন্তু তবুও আজও কিছু কিছু মানুষ নিজের কথা না ভেবে অন্যের বিপদে নিজেকে সপে দিতে এক মুহূর্তও ভাবেননা |
সায়নের সাথে প্রায়ই দেখা হয় নীলিমা নামের এক ভদ্রমহিলার | ভদ্র , শিক্ষিত , মার্জিত | বয়স প্রায় পঁয়ত্রিশের মধ্যেই হবে | মধ্যমগ্রাম থেকে ওঠেন আর শিয়ালদহ নামেন | স্কুল শিক্ষিকা | দেখা হলেই একগাল হেসে পরে সায়নের সাথে কুশল বিনিময় করেন | মাঝে মধ্যে বসার জায়গা পেলে নানান বিষয়ে কথা হয় | নীলিমাদেবীর একটি মাত্র ছেলে রহড়া রামকৃষ্ণ বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে | স্বামী ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মচারী | তিনজনের সুখী পরিবার |
সায়নের বয়স এই আঠাশ কি ঊনত্রিশ বছর | বছর খানেক হোলো বিয়ে করেছে | সংসারে মা , বাবা সে ও তার বৌ | নীলিমাদেবীর সাথে অধিকাংশ দিন দেখা হওয়ার সুবাদে অসম বয়সী হওয়া স্বর্তেও দুজনের মধ্যে বেশ একটা বন্ধুত্ব্যর সম্পর্ক গড়ে ওঠে | ভালো একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করে সে | ইচ্ছা করলে গ্রামের বাড়ি ছেড়ে দিয়ে সে তার পরিবার নিয়ে কলকাতা শহরে ঘর ভাড়া করে থাকতেই পারে এবং আর্থিক সে ক্ষমতা তার আছে | কিন্তু কোনদিনও তার সে রকম কোন ইচ্ছা জাগেনি | শহরের মানুষগুলোর মন মানসিকতার চাইতে গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলোর মন মানসিকতা অনেক ভালো | তাদের দুচোখে যেন সর্বদা সরলতা প্রকাশ পায় | ছুটির দিনগুলোতে বছরভর মাইনে দেওয়া মাঠে কাজ করা নিধুকাকুর সাথে হাতে হাত লাগিয়ে কাজ করতে তার আজও ভালো লাগে | ভালো লাগে ঝুড়ি ভর্তি করে জমি থেকে তুলে আনা সব্জিগুলি দেখে মা বাবার হাসি হাসি মুখটা দেখতে | তাই বাড়ি ছেড়ে শহরে যাওয়ার ইচ্ছা তার কোনদিনও ছিলোনা আজও নেই | গ্রামে সকলের কাছে ভালো ছেলে বলেই পরিচিত সে | যে কোন মানুষের বিপদে আপদে ঝাঁপিয়ে পড়া তার মজ্জাগত |
একদিন অফিস ছুটির পর বাড়ি ফেরার ট্রেন ধরবার জন্য শিয়ালদা স্টেশনে এসে জানতে পারলো কি এক গন্ডগোলের কারনে পরপর বেশ কয়েকটি ট্রেন বাতিল হয়েছে | বসে বসে তাই স্মার্টফোনটা নিয়ে ফেসবুক করে চলেছে | সকলের কথাবার্তায় যা তার মনে হল বাস ও বন্ধ | বাসে করে যারা যাবে ভেবেছিলো তারা বাস স্টপেজ থেকে ফিরে আসছে | তাদের মধ্যে দেখতে পেলো নীলিমাদেবী ও আছেন | তিনি সেই দুপুর থেকে একবার বাসস্টপেজ আর একবার স্টেশন চত্ত্বর করে বেড়াচ্ছেন | অনেকের মতই তারা দুজনেও অথই সমুদ্রে পড়েছেন | স্টেশন চত্ত্বরে হাজার হাজার লোক গিজগিজ করছে | অনেকে আবার দল বেঁধে বেঁধে আশেপাশের হোটেলগুলোর দিকে সকলে মিলে ভাগাভাগি করে থাকার ব্যবস্থা করতে ছুটছেন | সে এক অসহনীয় পরিস্থিতি | যার যার বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে সায়ন ও নীলিমাদেবী | নীলিমাদেবীর উদ্ভিগ্ন স্বামী তাকে বারবার অনুরোধ করেছেন একটা ট্যাক্সি ডেকে তার বোনের বাড়ি গড়িয়া চলে যাওয়ার জন্য | নীলিমাদেবীর শত অনুরোধ স্বর্তেও সায়ন তার সাথে যেতে রাজি হয়না | কিন্তু সে ট্যাক্সি ধরে দেওয়ার জন্য নীলিমাদেবীকে নিয়ে স্টেশন ছেড়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ায় | রাত তখন প্রায় বারোটা | হঠাৎ একটি প্রাইভেট গাড়ি এসে তাদের সামনে দাঁড়ায় আর কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিনটি ছেলে নীলিমাদেবীকে জোর করে গাড়ির ভিতর উঠাতে চেষ্টা করতে থাকে | ঘটনার আকস্মিকতায় সায়ন প্রথম অবস্থায় কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও মুহূর্তেই সে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে ছেলেগুলির উপর ঝাঁপিয়ে পরে | ছেলেগুলি তখন নীলিমাদেবীকে ছেড়ে দিয়ে সায়নের উপর চড়াও হয় | এলোপাথাড়ি চড়, ঘুসি , লাথি মারতে থাকে | আর ঠিক এই ফাঁকে নীলিমাদেবী একটু সরে গিয়ে চিৎকার করতে থাকেন | ছুটে আসে অগণিত রেলযাত্রী আর রেলপুলিশ | পালিয়ে যায় তিন দুষ্কৃতী | সায়নের কাছে এগিয়ে এসে দেখে সে জ্ঞান হারিয়েছে | সকলের সহায়তায় তার জ্ঞান ফিরে আসলে সকলে ধরাধরি করে স্টেশনে নিয়ে গিয়ে একটি বেঞ্চে তাকে শুইয়ে দেয় | নীলিমাদেবীর ব্যাগেই ছিল প্যারাসিটামল 650 | তিনি একটি ওষুধ তাকে খাইয়ে দেন | পরদিন ট্রেনের সমস্যা মেটার পর প্রথম ট্রেন ধরেই নীলিমাদেবী সায়নের সমস্ত রকম আপত্তিকে অগ্রাহ্য করে তাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে তারপর তিনি নিজের বাড়িতে যান |
দিনপনের পরে একদিন রবিবার দেখে নীলিমাদেবী ও তার স্বামী সায়নদের বাড়িতে আসেন | অবশ্য এর আগেই সায়ন কিছুটা সুস্থ্য হয়ে অফিসে যাতায়াত শুরু করলে তাদের আবারো নিত্য দেখা সাক্ষাৎ হতে থাকে | দুটি পরিবারের মধ্যে এখন নিকট আত্মীয়ের মতই সম্পর্ক | মানুষের বিপদে সত্যিকারের মানুষ যে পাশে দাঁড়ায় আজও তার প্রমান পাওয়া যায় |
#আমার_লেখনীতে তোমায়_মনে রাখবো... সময়
No comments:
Post a Comment