জীবনের স্বপ্ন
নন্দা মুখাৰ্জী রায় চৌধুরী
অনিন্দ্য বাবু মারা যেতেই তার বিশাল সংসারে অশান্তি চরমে উঠলো | এতদিন ছেলেরা হয়তো মুখ বুজে সব হজম করেছে তাদের বাবার মৃত্যুর পর যে যার সম্পত্তি নিজেদের নামে করে নিতে পারবে| চার ছেলের তিনটিরই বিয়ে হয়েছে , প্রত্যেকেরই একটি করে সন্তান| প্রত্যেকেই সুপ্রতিষ্ঠিত| মেঝো ছেলে বিয়ে করেনি| পি ডব্লু ডির মস্তবড় ইঞ্জিনিয়ার| কলেজ লাইফে ক্লাসমেট চপলাকে ভালোবেসে প্রত্যাখ্যাত হয়ে নারীদের সম্পর্কেই একটা বিতৃষ্না জমে আছে তার মনে| তাছাড়া দাদা বৌদি ও ভাই আর ভাইবৌদের এই সংসার রাজনীতি দেখে দেখে সে যেন আরও বিরক্ত| স্বাভাবিক ভাবেই অনিন্দ্যবাবুর মৃত্যুর পর তার সমস্ত সম্পত্তি চার ছেলে ও স্ত্রীর মধ্যে সমান ভাগ হবে| বাড়িতে উকিল ডাকা হোল| অনেক খোঁজাখুঁজির পর দলিলও পাওয়া গেলো কিন্তু সকলের চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেলো দলিলের সাথে একটি উইল দেখে| উইলে সমস্ত সম্পত্তি দান করা আছে মেজোছেলের নামে| অশান্তি আরও চরমে উঠলো| কারও মাথাতেই আসছেনা এতবড় বুদ্ধিমান মানুষ হয়ে বাবা কেন এরূপ একটা অবিবেচক মানুষের মত কাজ করলেন| অথচ মেঝো ছেলে কিন্তু নিরুত্তাপ| সময়ে অসময়ে অন্য ভায়েরা তাকে কথা শুনাতে ছাড়ছেনা| সে কারও কথারই কোন জবাব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করছেনা|
একই বাড়িতে সব ছেলেরদেরই হাঁড়ি আলাদা | একমাত্র মেজোছেলে অনুপম খায় মায়ের সাথে| অনিন্দ্যবাবু বেঁচে থাকাকালীন সময় থেকেই তারা তিনজনে একহাঁড়িতে খেতেন| বাবার মৃত্যুর পর এখন সে আর তার মা| বাড়ির পরিস্থিতি এখন এমনই দাঁড়িয়েছে ঘরের চালে কাকও বসেনা| ছেলে অনুপম ও মা দুজনেই চুপ|
বাবার মৃত্যুর প্রায় মাস ছয়েক পরে একদিন খুব ভোরে অনুপম তার ও মায়ের কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ব্যাগে ভরে ট্যাকসি একটা বাড়ির সামনে ডেকে সব ভাইদের ঘুম থেকে ডেকে তুলে বাড়ির সমস্ত সম্পত্তি
তিনভাগ করে প্রত্যেকের দলিল যার যার হাতে তুলে দিয়ে বললো, " সম্পত্তিতে আমার কোন লোভ নেই| তাই সমস্তকিছু আমি তোমাদের নামে দানপত্র করে দিলাম| কিন্তু মায়ের ভাগ আমি কাউকেই দিতে পারবোনা| মা শুধু একা আমার| আমি মাকে আমার সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি| তোমরা শান্তিতে থেকো| ওই দলিলের সাথে বাবার আমাকে লেখা একটি চিঠি আছে আমি তোমাদের প্রত্যেকটি দলিলের সাথে বাবার লেখা চিঠিটির একটি জেরক্স কপি তোমাদের দিয়ে গেলাম|" মাকে নিয়ে অনুপম ট্যাকসি করে বেরিয়ে গেলো| মা অনুভাদেবী চলে যাওয়াতে বাড়ির কারোর মধ্যেই কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা গেলোনা| শুধু অনুভাদেবীর কাঁদতে কাঁদতে মেজোছেলেকে অনুসরণ করে বেরিয়ে গেলেন| অনুপম ও তার মা বেরিয়ে যাওয়ার পর প্রত্যেকেই তাদের দলিলের সাথে তাদের বাবার হাতের লেখার একটি চিঠির জেরক্সকপি পায় যা তাদের মেঝভায়ের উর্দ্যেশ্যেই লেখা|
প্রাণাধিক বাবা অনুপম,
আজ তোমাকে আমি একটা গল্প বলবো | যা গল্প হলেও আমাদের জীবনের চরম সত্যি| তোমার দাদা ও মাকে নিয়ে আমি বেনারস বেড়াতে যাচ্ছিলাম| তোমার দাদা তখন একবছরের| বেনারস পৌঁছে ট্রেনের সিটের তলা থেকে যখন আমাদের ব্যাগ নামাতে যাই সেখানে দেখি একটি বড় বাঁশের ঝুড়ি| ট্রেনের সকল যাত্রী তখন একএক করে নেমে গেছে| কৌতূহল বশত ঝুড়িটা টেনে বাইরে আনি| তার ভিতর দেখতে পাই সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া যেন এক দেবশিশু| তার মুখটা দেখেই আমি ও তোমার মা দুজনেই কেমন মায়ায় জড়িয়ে গেলাম| পুলিশের ঝামেলার ভিতর যাতে পড়তে না হয় তারজন্য তাড়াতাড়ি ব্যাগ থেকে আমার একটি ধুতি বের করে ওই দেবশিশুটিকে সুন্দরভাবে মুড়ে তোমার মায়ের কোলে দিয়ে বললাম," আজ থেকে এই শিশুটি আমাদের ছেলে"| আমি ছিলাম এক সাধারণ রাজ্যসরকারী কর্মচারী| প্রমোশন পাওয়ার স্বপ্ন বা উপায় কোনটাই ছিলোনা| শিশুটিকে নিয়ে বাড়িতে আসার কয়েক মাসের মধ্যেই অভাবনীয়ভাবে আমি হেডক্লার্ক হই| পাড়াপ্রতিবেশীকে জানিয়েছিলাম আমরা যখন বেনারস যাই তখন তোমার মা গর্ভবতী ছিলেন| তাই কারও কোন প্রশ্নের সম্মুখীন আমাদের কোনদিন হতে হয়নি| একেএকে তারপর আমার দুই ছেলে আসে| তারপর কয়েক বছরের মধ্যেই আমি অফিসার পদে উন্নীত হই| আমার যত উন্নতি সব ওই দেবশিশুটির আগমনের পরেই| আমি আমার অন্য তিনটি ছেলেকে যথেষ্ট শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারলেও তাদের মানুষ করতে পারিনি| আমার চারটি ছেলেই সুপ্রতিষ্ঠিত| এটাই আমার জীবনের চরম পাওয়া| কিন্তু আমার অবর্তমানে এই পরিবারের হাল আমি সচক্ষে যেন দেখতে পাই | প্রচন্ড লোভী আর স্বার্থপর আমার ঔরসজাত সন্তানেরা| এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝতে পারছো সেই দেবশিশুটি কে? হ্যাঁ ঠিকই ধরেছো সে তুমিই| যার কথা বলতে গেলে গর্বে আমার বুকটা ফুলে ওঠে| আমার মৃত্যুর পর আমি জানি তুমি থাকতে তোমার মায়ের আজীবন কোন কষ্ট হবেনা| আমার সমস্ত সম্পত্তি আমি তোমার নামেই তাই করে গেলাম| তোমার মাকে তুমি দেখো| না, এটা আমাদের প্রতি তোমার কোন ঋণ শোধ নয়, মায়ের প্রতি পুত্রের কর্তব্য যে দায়িত্ব আমি অন্য কারও হাতেই সমর্পণ করতে সাহস পাচ্ছিনা| আমার মৃত্যুর পর এই চিঠি তুমি হাতে পাবে যা আমি তোমার মায়ের কাছে গচ্ছিত রেখে গেলাম|
ইতি
নিত্যাশীর্বাদক তোমার বাবা |
No comments:
Post a Comment