Sunday, December 22, 2019

পাশে আছি

 
পাশে  আছি  

      নন্দা  মুখার্জী  রায়  চৌধুরী  

    প্রায়  বছর  পাঁচেক  পরে  গ্রামে  ফেরা  সুশোভনের| আসবার  ইচ্ছা  মোটেই  ছিলোনা| কিন্তু  মা  বারবার  করে  বাবার  শরীর  খারাপের  কথা  বলছেন  | তাই  আসতে বাধ্য  হওয়া| গ্রামের  ছেলে  সুশোভন  ভালোবেসেছিলো  গ্রামেরই  মেয়ে  অর্পিতাকে| দুক্লাস  উঁচুতে  পড়তো  সুশোভন| মাধ্যমিক  পাশ  করার  পরই অর্পিতার  বিয়ে  দিয়ে  দেয় তার  বাড়ির  লোক| তখন  সুশোভন  উচ্চমাধ্যমিক  দিয়েছে| কিছুই  করার  ছিলোনা  তখন  সুশোভনের| অসহায়ের  মত  দেখেছিলো  মা, বাবা  আর  বোন  খুব  সেজেগুজে  অর্পিতার  বিয়ের  নিমন্ত্রণ  খেতে  যাচ্ছেন| আর  সে  নিজে  শরীর  খারাপের  অজুহাতে  দরজা  বন্ধ  করে  চোখের  জলে  বালিশ  ভিজিয়েছে| বিয়ের  কথাবার্তা  যখন  চলছে  তখন  অর্পিতা  একদিন  এসে  সুশোভনের  কাছে  খুব  কান্নাকাটি  করেছিলো| কিন্তু  সুশোভনের তখন  কিছুই  করার  ক্ষমতা  ছিলোনা| অসহায়, নিরুপায়  দুটি  তরুণ  তরুণী  বুকে  পাথর  চাপা  দিয়ে  সবকিছু  মেনে  নেওয়ার  চেষ্টা  করেছিলো মাত্র| 
  গ্রামের  পথে  বাড়ির  উর্দ্যেশ্যে  হাঁটতে হাঁটতে সেই  সব  কথা  ভীষণভাবে  মনে  পড়ছিলো  সুশোভনের| গ্রামের  স্কুল  থেকে  পাশ  করে  উচচতর  শিক্ষা  লাভের আশায়  কলকাতা  চলে  আসার  পর  আজ  এই পাঁচ  বছর  সুশোভন  আর  গ্রামে  ফেরেনি| বারবার  মা, বাবা  আর  বোনের  অনুরোধ  উপেক্ষা  করে  বলেছে সে  আর  কোনোদিনও  গ্রামে  ফিরবেনা |
  বিটেক পড়া  শেষ  করে  কলেজ  ক্যাম্পাস  থেকেই  একটা মোটা  মাইনের  চাকরি  পেয়ে  যায়| প্রতিমাসে  বেতনের  অর্ধেক  টাকা  সে  মা  বাবার  একাউন্টে  পাঠিয়ে দেয় যদিও  তার  টাকা  তারা  খরচ  করেননা | নানান  কথা  ভাবতে  ভাবতে  সে  বাড়ির  দোরগোড়ায়  এসে  দাঁড়ালো| 
  বাবার  শরীরটা  সত্যিই  খুব  খারাপ  হয়েছিলো| বাবার  ঘরেই  সে  বসে  সকলের  সাথে  কথা  বলছিলো| খাওয়াদাওয়ার  পর  যখন  শুতে  যাবে  সে  তখন  মা  তাকে  এমন  একটা  কথা  বলে  বসলেন  যা  সে  স্বপ্নেও  কল্পনা  করেনি|
--- তোর  অর্পিতার  কথা  মনে  আছে  ?
--- কেন  বলো তো  ?
--- মেয়েটার  কপালটা  সত্যিই  খুব  খারাপ  রে -
--- কেন  কি  হয়েছে  অর্পিতার  ?
--- সে  এক  ইতিহাস| ভালো  চাকরি  ভালো  বাড়ি  দেখে  মা  মরা  মেয়েটার  বিয়ে  দিলো  ওর  বাবা  কিন্তু  মেয়েটার  কপালে  বিধাতা  সুখ  লেখেননি  | বিয়ের  পর  মদ্যপ  স্বামীর  অত্যাচারে  অতিষ্ট  হয়ে  একবার  সুইসাইডও
 করতে  গেছিলো  |  
--- তারপর  ?
--- তুই  তোর  নিজের  ঘরে  যা  আমি  এক্ষুণি আসছি  |
--- আরে তুমি  বলোনা  আমার  এখানে  দাঁড়িয়ে  শুনতে  কোন  অসুবিধা  হচ্ছেনা|
 মনের  ভিতর  তখন  তার  তোলপাড়  করছে | অর্পিতা  বিয়ের  পর  ভালো  ছিলোনা,   অর্পিতা  বেঁচে  আছে  তো? নানান  প্রশ্ন  তখন  তার  মনের  মধ্যে  উঁকি  দিচ্ছে |
--- মা  বলো তারপর  কি  হয়েছে  অর্পিতার? 
--- নিজের  হাতের  শিরা  কেটে  বাড়িতে তার  স্বামী না  থাকাকালীন  সময়ে  বেশ  কয়েকঘন্টা  নিজের  ঘরে  পড়ে ছিল| ভাগ্যিস  সেদিনই  ওর  ভাই  পুজোর  জামাকাপড়  দিতে  ওর  বাড়ি  গেছিলো | অনেক  ডাকাডাকির  পরও যখন  দরজা  কেউ  খুলতে  আসেনা  ওর  ভাই  তখন  ক্লাবের  ছেলেদের  ডেকে  দরজা  ভেঙ্গে ঘরে  ঢুকে  ওই  পরিস্থিতি  দেখে | যমে  মানুষে পনেরদিন  টানাটানির  শেষে  আবার  ওর  স্বামী  ওকে  বাড়িতে  নিয়ে  যায় | ওর  বাবা , ভায়ের  ইচ্ছা  ছিল  কয়েকটা  দিন  অন্তত  ওদের  কাছে  এসে  থাকুক | কিন্তু  কিছুতেই  ওর  স্বামী  সে  কথা  শোনেনা | হাসপাতালে  থাকার  সময়  অর্পিতার  বাড়ির  লোকেরা  ইচ্ছা  থাকলেও  ওর  কাছ  থেকে  কিছু  জানার  চেষ্টা  করেনি  কারণ  ডক্টরের  নিষেধ  ছিল | বাড়িতে  নিয়ে  গিয়ে  আবার  সেই  একই  অত্যাচার  শুরু  করে | চুপচাপ  সবকিছু  মেনে  নিতে  নিতে  পরিস্থিতি  এমনই দাঁড়ায়  আস্তে  আস্তে  নিজের  ভিতরে  নিজেকে  গুটিয়ে  নিতে  থাকে |শেষে  একদিন  ওর  ভাই  ও  বাবা  গিয়ে  ওর  স্বামীর  বিরুদ্ধাচারণ  করেই  ওকে  নিয়ে  আসতে বাধ্য  হয়  | অনেক  ডাক্তার  দেখিয়েও  কোন  লাভ  হয়নি  | সবসময়  চুপচাপ  ঘরের  মধ্যেই  বসে  থাকে  | কারো  সাথেই  কোন  কথা  বলেনা | ওর  বাবারও বয়স  হয়েছে  | অর্পিতার  চিন্তায়  চিন্তায়  তার  শরীরও ঠিক  নেই  | এদিকে  ওর  ভায়েরও  বিয়ের  বয়স  হয়েছে  | কিন্তু  অর্পিতা  সুস্থ্য  না  হওয়া পর্যন্ত  ওর  ভাই  বিয়ে  করতে  চায়না  |
--- আমাকে  কি  করতে  বলছো  ?
  মা  একটু  আমতা  আমতা  করে  বললেন,
--- ওই  যে  তোর  বন্ধু  বিপিন  আছে  না  ও  বলছিলো  ------ আসলে  আমি  তোর  বাবা  মেয়েটাকে  খুব  ভালোবাসি  --
--- বিপিন  কি  বলছিলো  ?
--- না  সে  রকম  কিছু  না  ওই  আর  কি--- তুই  একটু  কলকাতা  নিয়ে  গিয়ে  চেষ্টা  করে  দেখ  না  যদি  মেয়েটাকে  সুস্থ্য  করা  যায়  --
--- মা, বিপিন  কি  বলেছে  ?
  সুশোভনের  মা  আমতা  আমতা  করে  কয়েকবার  ঢোক  গিলে  বলেই  ফেললেন  কথাটা  | কারণ  তিনি  যখন জানতে    পেরেছেন  তার  শুভ  কেন  গ্রামে  আসতে চায়না  তখন  তো  তাকে  বাড়িমুখো  করার  আপ্রাণ  চেষ্টা  তিনি  করেই  যাবেন  |
--- বলছিলো  তোরা  তো  একই  স্কুলে  পড়তিস  যদি  তোকে  দেখলে  ওর  কোন  পরিবর্তন  হয়  নুতবা  তুই  যদি  ওকে  কলকাতা  নিয়ে  গিয়ে  বড়  ডাক্তার  দেখাস  ----
--- সেতো ওর  ভাইও  করতে  পারে  |
--- হ্যাঁ তা  পারে  কিন্তু  তুই  তো  ওকে  ভালোবাসতিস---
--- আচ্ছা  এখন  যা  তোর  ঘরে  বাকি  কথা  কাল  বলবো  |
  সুশোভনের  মাথায়  তখন  নানান  চিন্তা| মা  কি  ঠিক  এই  কারণেই  ওকে  গ্রামে  ডেকে  পাঠিয়েছেন? বাবার  এখন  বয়স  হয়েছে  নিত্য  শরীর  খারাপ  লেগেই  আছে  - তবে  কি  এবার  জোর  করেছেন  অর্পিতার  জন্যই? আসলে  মা  কি  ভাবছেন? 
    পরদিন  সকাল  হতেই  সুশোভন  অর্পিতাদের  বাড়িতে  হাজির  হয়  | অর্পিতার  ঘরে  ঢোকার  আগেই  সে  তার  বাবার  কাছ কাছ  থেকে  জেনে  যায়  অর্পিতা  কারও সাথেই  কথা  বলেনা| চুপচাপ  সবসময়  ঘরের  মধ্যে  শুয়ে  বসে  থাকে  | পরিবারের  কেউ  ছাড়া  তার  ঘরে  ঢুকলে  সেদিন  রাগে সে  সেই  বেলার  খাবার  হাত  দিয়ে  ছুঁয়েও  দেখেনা  | কিছু  জানতে  চাইলে  মাথা  নেড়ে  হ্যাঁ না  তেই জবাব  দেয়| দেখো  গিয়ে  তোমার  সাথে  কথা  বলে  কিনা  ?
  সুশোভন  দরজা  ঠেলে  ঘরে  ঢোকে  | অন্য দিকে  মুখ  করে  খাটের উপর  অর্পিতা  শোয়া  | সুশোভন  গিয়ে  খাটের উপর  বসে  | অর্পিতা  ফিরেও  দেখেনা  | সুশোভন  আস্তে  আস্তে  ডাকে  ,
--- অর্পিতা  আমি  শুভ  -- এদিকে  একটু  ফেরো 
  অর্পিতা  উঠে  বসে  শুভর মুখের  দিকে  ফ্যালফ্যাল  করে  তাকিয়ে  থাকে  | শুভ  জানতে  চায়,  
----  আমায়  চিনতে  পারছো  ?
 অর্পিতা  ঘাড় নেড়ে  হ্যাঁ জানায়  |
--- কি  হয়েছে  তোমার? আমায়  বলো সব  ঠিক  হয়ে  যাবে  আমি  এসে  গেছি  তো  --
   শুভ  হাত  বাড়িয়ে  অর্পিতার  একটা  হাত  ধরে  বলে, 
--- আমি  তোমাকে  কলকাতা  নিয়ে  গিয়ে  ডক্টর  দেখাবো  কিন্তু  তার  আগে  তো  আমায়  জানতে  হবে  তোমার  কোথায়  কষ্টটা  --- 
   অর্পিতা  এবার  হাউহাউ  করে  কেঁদে  উঠে  শুভর বুকের  উপর  ঝাঁপিয়ে  পরে| ঠিক  এইরূপ  একটি  পরিস্থিতির  জন্য  সুশোভন  মোটেই  প্রস্তুত  ছিলোনা  | ধাতস্ত  হতে  তার  কিছুটা  সময়  নিলো  তারপর  সে  আস্তে  আস্তে  অর্পিতার  মাথায়  হাত  বুলিয়ে  দিতে  লাগলো  | অর্পিতার  কান্নার  আওয়াজে  তার  বাবা  ও  ভাই  ঘরে  ঢুকে  এসে  এ  দৃশ্য  দেখে  দুজনেই  ঘর  থেকে  বেরিয়ে  যান  | এবং  দুপুর  গড়িয়ে  গেলেও  তারা  কেউই  আর  এঘরে  আসেননা  কারণ  বাইরে  থেকে  দুজনেই  শুনতে  পান  অর্পিতার  গলার  আওয়াজ  |




     

No comments:

Post a Comment