কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা
সুখ ধরা দেয়না।
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
তুমি আর 'কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা' আর দিওনা বৌমা!আমি জানি আমার ছেলের দোষ।প্রতিটা মুহূর্তে তা স্বীকারও করছি।তাই বলে ওই একরত্তি ছেলেটাকে তুমি যখন তখন তার বাপ তুলে গালিগালাজ করবে?ওর বাপ তোমার সাথে অন্যায় করেছে কিন্তু ছেলেটার কি দোষ আমায় বলতে পারো?কথা না শুনাটাই তো ওর দুষ্টুমী।অপর্ণাদেবী কথাগুলো বলে তার আদরের নাতীটাকে হাত ধরে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে দিলেন।
গরীব ঘরের মেয়ে রানু।অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেছে।অপর্ণাদেবী খুব শখ করে তাকে ঘরের বৌ করে এনেছিলেন।রানুদের থেকে অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল পরিবার তাদের।ছেলে সুধীন ছোটখাটো একটা কোম্পানীতে যা মাইনে পায় তাদের মোটামুটি চলে যায়।অপর্ণাদেবী ছেলেকে বিয়ে দিয়ে তাকে সংসারী করতে চেয়েছিলেন।বিয়ের পর দুটো বছর বেশ ভালোই চলছিলো।অপর্ণাদেবী ছেলের বৌকে নিজের মেয়ের মত ভালোবাসেন।একটা মেয়ের খুব শখ ছিলো তার।স্বামীকে বলেছিলেন ও সে কথা।অপর্ণাদেবীর স্বামী তাকে জানিয়েছিলেন,'আজকের বাজারে ধনীরাই একটা সন্তানের বেশি নেয়না।সেখানে আমরা তো মধ্যবিত্ত পরিবার।একটা বাচ্চা মানুষ করা কি চাট্টিখানি কথা?তুমি তোমার সুধুকেই মানুষের মত মানুষ করে গড়ে তোলো।ওর বিয়ে দিয়ে তুমি ওর বৌকে তোমার মেয়ের মত ভালোবেসো।সংসারটাও সুখের হবে আমরাও মানষিক শান্তি পাবো।'তিনি তার স্বামীর কথাটাকে ধরে রেখেই রানুকে তার মেয়ের জায়গাটা দিয়েছেন।রানুও খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে।সংসারের সবকাজ সে হাসিমুখে করে।তার শ্বাশুড়ীও বসে থাকার মানুষ নয়।তিনিও টুকটাক কাজ করেই চলেছেন।অবশ্য এজন্য তিনি মাঝে মধ্যেই রানুর কাছে মৃদু ধমকও খান।
--আমি তো করছি মা,তোমার কি আমার কাজ পছন্দ হয়না?এতদিন তো তুমিই এই সংসারের যাবতীয় করেছো,এখন বয়স হয়েছে যাও গিয়ে বিশ্রাম নাও।টিভি খুলে সিরিয়াল দেখো।আমি একা ঠিক পারবো।
ভালোবাসার এই যে শাষন তার বেড়া ভেঙ্গে অপর্ণাদেবী বেরোতে পারেননা।আর ঠিক তখনই মনে পরে যায় তার স্বামীর কথা---
---দেখো গিন্নী,একটা মেয়ে তার বাপের বাড়ি থেকে যখন শ্বশুরবাড়িতে আসে তখন সে পিছনে ফেলে আসে তার শৈশব,তার ভালোলাগা মন্দলাগা,চেনা পরিচিত সবকিছুই।সবথেকে বড় কথা সে ফেলে আসে তার কাছের মানুষজনকে।এক গাছের ছাল আর এক গাছে লাগেনা।কিন্তু কিছু কিছু মেয়ে পারে যেমন তুমি পেরেছিলে।একটি মেয়ে তার নিজের পরিচিত গণ্ডি ছেড়ে যখন অন্যএকটি পরিবারে এসে পরে তখন শুধু সে কেন মানিয়ে নেবে বলো তো।কত মানুষের মনোরঞ্জন করে তাকে চলতে হয়।সেক্ষেত্রে সেই পরিবারটিরও কি উচিত নয় প্রত্যেকে একটু একটু করে ছেড়ে তার সাথেও অ্যাডজাস্ট করা।এটা কেউ করেনা বলেই সংসারগুলো ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।ছেলের বিয়ে দিয়ে একটা পরের মেয়েকে ঘরে এনে যদি তাকে পর করেই রাখা হয়,যে সংসারে সে আসে তাকে যদি সেই সংসারের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়,সংসারের যাবতীয় কাজে তাকে সারাটাদিন খাটানো হয় তাহলে সুখপাখি তো ফুড়ুৎ করে উড়বেই।'জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রেই তার স্বামীর বলা কথাগুলো তিনি উপলব্ধি করেন।
কিন্তু এতো করেও সংসারে সুখপাখিটাকে তিনি ধরে রাখতে পারেননি।সুধীন গ্রাজুয়েশন করেছিলো।তার ইচ্ছা ছিলো অন্তত মাধ্যমিক পাশ করা একটি মেয়ের সাথে তার বিয়ে হোক।কিন্তু মায়ের রানুকে এতোই পছন্দ হয়ে গেলো সে আপত্তি করেও কোন ফল পেলোনা।বিয়ের পর রানুকে মেনে নিতে তার অসুবিধা হলেও রানুর গুণেই সে তাকে ভালবাসতে শুরু করে।বেশ চলছিলো দিনগুলি।কিন্তু হঠাৎ করেই যেন সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেলো।সুধীনের সাথেই চাকরী করে তাপসী বলে একটি মেয়ে।তার সাথেই ভাবভালোবাসা করে তাকেই পূণরায় বিয়ে করে ঘর ভাড়া করে তারা এখন থাকে।বাড়িতে টাকাপয়সা দিতে চেয়েছিলো কিন্তু অমন ছেলের কাছ থেকে টাকা নিতে অপর্ণাদেবীর রুচিতে বাঁধে।তাই তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন তাদের টাকার কোন দরকার নেই।পরবর্তীতে তিনি ও তার বৌমা সেলাই এর কাজ করতে থাকেন।কাটিংটা রানু জানতো।বাপের বাড়িতে থাকতেই শিখেছিলো।স্বামীর জমানো টাকা থেকে তিনি রানুকে একটা সেলাই মেশিন কিনে দেন।নিজেও ভালো হেম করতে জানেন।সংসার আর এই সেলাই -এই নিয়েই শ্বাশুড়ী,বৌ এর সময় কেটে যায়।প্রথম প্রথম তাদের সংসারে অনটন লেগেই থাকতো।কিন্তু এখন ব্যবসাটা দাঁড়িয়েছে।পাঁচ বছরের ছেলেকেও ভালো স্কুলেই পড়ায়।কিন্তু রানুর রাগ হলেই সে 'ওই বাপের ছেলে তো' - ---বলে নানান কথা সে ওই অবুঝ ছেলেটাকে বলে নিজের গায়ের জ্বালা মেটায়।
একমাত্র ছেলে সুধীনের এই ব্যবহারে অপর্ণাদেবী প্রথম প্রথম খুব কষ্ট পেতেন।বুকটার ভিতর হাহাকার করে উঠতো।কিন্তু এখন নিজেকে অনেকটাই সামলে নিয়েছেন।রানুকে সবসময় সাহস জুগিয়ে চলেন।কখনো ভুলেও তার সামনে সুধীনের কথা বলেননা।কিন্তু রানুর অলক্ষ্যে তিনি যেমন চোখের জল ফেলেন ঠিক সেইরূপ রানুও তার শ্বাশুড়ীর অলক্ষ্যে চোখের জল ফেলে।
রানুর ছেলে এবার মাধ্যমিক দেবে।মেইন রাস্তার উপর রানু একটা দোকান নিয়েছে।দুজন কর্মচারীও রেখেছে।শ্বাশুড়ী এখন শয্যাশায়ী।এখনও তিনি মনেমনে বিশ্বাস করেন তার সুধীন একদিন ফিরে আসবেই।কিন্তু কোনদিনও এই মনের ইচ্ছা তিনি রানুর কাছে প্রকাশ করেননি।শুধু চিরতরে চলে যাওয়ার দুদিন আগে তিনি তার কন্যাসম পুত্রবধূকে হাত দুটি ধরে বলেছিলেন,'যদি কোনদিন ও ফিরে আসে ওকে মেনে না নাও অন্তত এই বাড়িতে থাকতে দিও।আর আমি জানি একদিন ও ফিরবেই।'
রানু আজও পথ চেয়ে বসে যদি তার সন্তানের পিতা কোনদিন ফিরে আসে তাকে তো তার সন্তানের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে কারন সে যে তার সন্তানের মুখটাও কোনদিন দেখেনি।
No comments:
Post a Comment