মন মানেনা
নন্দা মুখাৰ্জী রায় চৌধুরী
আমার মনেহয় আমার স্বপ্নগুলো ছিলো আর পাঁচটা মেয়ের মতোই | যখন নবম বা দশম শ্রেণীতে পড়ি নিজের জীবনটাকে কল্পনা করতাম ঠিক সিনেমার নায়িকার মত | ভাবতাম হঠাৎ করেই আমার স্বপ্নের পুরুষ বেশ দামি একটা গাড়ি চড়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াবে | প্রথমে ঝগড়াঝাটি , মানাভিমান শেষে ঠিক সিনেমার কোন গল্পের মত হাওয়ায় ভাসতে থাকবো | পড়াশুনার এই বাঁধাধরা নিয়মের মধ্যে নিজেকে বেঁধে রাখতে ইচ্ছা করতোনা | কোনোরকমে টেনেটুনে পাশ করে ক্লাসে উঠতাম |
সংসারে মা , বাবা , আর ভাই ছিলো | বাবা ছোট একটা কোম্পানিতে চাকরি করতেন | অভাবের সংসার হলেও আমি ও ভাই কোনোদিন কোন কষ্ট পাইনি | সুন্দর একটা শান্তি বিরাজ করতো আমাদের সংসারে | বাবা রোজ অফিস থেকে ফেরার পথে আমার ও ভায়ের জন্য কিছু না কিছু নিয়েই আসতেন | সে বাদামভাজা হোক বা কোন তেলেভাজা | বাবা ফিরেই দুজনকে একসাথেই ডাকতেন | আর আমরা দুই ভাই বোন পড়িমরি করে তার কাছে ছুঁটে যেতাম | একটু বিশ্রাম নিয়ে চা , বিস্কুট খেয়ে দুজনকে নিয়ে পড়াতে বসাতেন | এতো ধর্য্য ছিলো বাবার আজ যখন ভাবি তখন খুব আশ্চর্য হয়ে যাই | কোন বিষয়ে কিছু বুঝতে না পারলে বারবার বুঝিয়েছেন কিন্তু কোনোদিনও দেখিনি সামান্য রেগে যেতে বা বিরক্তি প্রকাশ করতে | নিজের স্বামীর স্বভাবকে কল্পনা করতাম ঠিক বাবার মতই | জীবনের সর্বক্ষেত্রে নিয়ম মেনে চলা , ধর্য্য ও ত্যাগের প্রতিমূর্তি হিসাবে আমার জীবনে হিরো হয়ে এসে সেই ছেলেবেলা থেকে আজও বাবা ই সামনে দাঁড়ান | স্বপ্ন দেখতাম ঠিক মায়ের এই সাজানো গুছানো স্বর্গের শান্তি বিরাজমান সংসারের মত একটি সুন্দর সংসারের |
আমার পড়াশুনায় সেরকম কোন মন নেই দেখে মাধ্যমিক পাশ করার পর থেকেই বাবা আমার বিয়ের জন্য ছেলে দেখতে শুরু করেন | তখনও আমার আঠারো বছর বয়স হয়নি | মা যখন বলতেন , " ওর তো এখনো বিয়ের বয়স হয়নি "- বাবা বলতেন , " এখন থেকে শুরু করি ও উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর আমি ওর বিয়ে দেবো | বললেই কি আর ছেলে পাওয়া যায় নাকি ?আমি ঘষেমেজে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করলাম | আর ঠিক তখনই এক বাড়ি থেকে আমায় পছন্দ করলো তাদের ব্যাংকে চাকুরীরত ছেলের জন্য | দুই ভাই এক বোন তারা | আমায় দেখে তাদের সকলেরই খুব পছন্দ হোল |
সেই বাড়িতে আমার বিয়ে হয়ে গেলো | আমি অজানা , অচেনা একটি পুরুষের হাত ধরে সম্পূর্ণ একটি অপরিচিত বাড়িতে চলে এলাম অলিখিত এই চুক্তিতে তাদের সবাইকে আপন করে নেবো , ভালোবাসবো , সেবাযত্ন করবো | মনেমনে এটাও ভেবেছিলাম তারাও অপরদিকে আমার প্রতি এই কাজগুলি করবে | কিন্তু এই ভাবাটা আমার যে কত বড় ভুল ছিলো তা বুঝতে আমার মাত্র সপ্তাহ খানেক সময় লেগেছিলো | বৌভাতের পরদিনই শ্বাশুড়ী রান্নাঘরে নিয়ে গিয়ে বললেন ," আজ থেকে রান্নাঘর তুমি সামলাবে | ষোলো বছর বয়সে এসে এই রান্নাঘরে ঢুকেছি -- আজ থেকে আমার ছুটি | এখন থেকে আমি শুধু আরাম করবো |
শুরু হোল আমার স্বপ্নের এক একটা পাঁপড়ি ঝরে যাওয়া | বাবা মায়ের মুখ মনে করে মানিয়ে চলার অদম্য ইচ্ছাশক্তিকে সম্বল করে সংসারের সমস্ত রকম কাজ করেও কারও মুখেই কোনোদিন হাসি দেখতে পারিনি | যে মানুষটাকে নির্ভর করে আমার প্রিয় মানুষগুলোকে ছেড়ে আসা সে মায়ের কথায় দম দেওয়া একটি রোবোটমাত্র | মায়ের হ্যাঁ তে 'হ্যাঁ' আর মায়ের না তে ' না ' মেলাতেই শুধু জানে | আমার সাথে বসে কোনদিন গল্প করা বা কোনোদিন ঘুরতে নিয়ে যাওয়া তারপক্ষে কখনই সম্ভব হয়নি | আমি শুধুমাত্র তার জৈবিক চাহিদা পূরণের একটি মেশিন মাত্র | আমার বিয়েদাড়ি ননদ মাঝে মধ্যে এসে আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়ে যেত আমার শ্বাশুড়িমায়ের কানে | বৌভাতের পর থেকে এমন কোন দিন যায়নি ভাত খেতে বসে চোখের জল ফেলিনি | বাপের বাড়িতে গেছি সেই অষ্টমঙ্গলায় | বাবা মাঝে মাঝে আমার শ্বশুরবাড়িতে আসেন | কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার এই যে আমার বাবা যখন আসেন তখন তাদের আচার আচরণ , কথাবার্তা আমার প্রতি সম্পূর্ণ পাল্টে যায় | বাবাকে তারা না খাইয়ে কিছুতেই ছাড়েনা | বাবার কাছে আমার প্রশংসায় তারা থাকে পঞ্চমুখ | তখন বাবার ওই খুশি মুখটা দেখে আমিও কোনোদিন কিছুই তাকে বলতে পারিনি |
কয়েকমাসের মধ্যেই আমি আমার ভিতরে আর একটি প্রাণের অস্তিত্ব টের পেলাম | রাতে স্বামীকে জানালাম| পাশ ফিরে শুতে শুতে সে আমায় বললো," আমায় বলে কি হবে মাকে গিয়ে বলো"| অবাক হয়ে গেলাম তার এই কথাতে| সারাটারাত চোখের জলে বালিশ ভিজলো | বারবার করে বাবার কথা মনে হচ্ছিলো | সারাটারাত না ঘুমানোর ফলে ভোরের দিকে একটু চোখটা লেগে এসেছিলো | ঘুম ভেঙ্গে ধড়মড় করে উঠে বসি সকলের চিৎকার চেঁচামেচিতে | রান্নাঘরে গিয়ে ঢোকার সাথে সাথেই শ্বাশুড়িমা চিৎকার করে বলে উঠলেন ,
-- বিয়ের পর একটা বছর গেলোনা এরমধ্যে পোয়াতী হয়ে বসলে, নিজেকে একটু সামলে চলতে পারলে না? বলি বাচ্চা হবে বলে কিন্তু কাজকাম বন্ধ করলে চলবেনা| আমার সংসার যেভাবে চলছে সেভাবেই চলবে, আমি সংসারের কোন কাজ আর করতে পারবোনা | যদি মনে করো এই অবস্থায় তুমি কোন কাজ করতে পারবেনা তাহলে চলো তোমায় হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ওটা ফেলে দিয়ে আসি |
আমার বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠলো | এরা কি ধরনের মানুষ? প্রথমত ছেলে এসে তার মাকে বললো- তার বৌ মা হতে চলেছে? এ কেমন মন মানসিকতা এদের? কত বছর পরে বাড়িতে একটা বাচ্চা আসতে চলেছে তারজন্য খুশি না হয়ে কাজ যদি করতে না পারি সেই অজুহাতে বাচ্চাটিকে পৃথিবীর আলো পর্যন্ত দেখতে দিতে চাইছেনা? এরা কি মানুষ? এর থেকে বরং টাকা দিয়েই তো কাজের লোক রাখতে পারতো| কিন্তু কিছুই বললামনা| এই অবস্থাতেই সেই আগের মতই সংসারের যাবতীয় কাজ করে যেতে থাকলাম| সত্যিই আমি বুঝতে পারতামনা এই বাড়ির মানুষগুলো কেন এইরূপ| একমাত্র আমার দেওর ছিলো একটু অন্যরকম| সে বিটেক পড়ছে| ওর সাথেই যা একটু সুখ, দুঃখের কথা বলতে পারতাম| কিন্তু সেটাও বাড়ির অন্যসকলের অলক্ষ্যে| আমার স্বামীর মতনই সেও মাকে ও বাবাকে প্রচন্ড ভয় পেতো| হঠাৎ একদিন আমার শ্বাশুড়িমা আমায় বললেন, "দেখো বৌমা আমার কিন্তু বংশধর চাই | মেয়ে হলে কিন্তু আমি তোমায় বাড়িতে আনবোনা|"
সেদিন প্রথম শ্বাশুড়িমায়ের উপর কথা বললাম,
--- ছেলে বা মেয়ে যাই হোকনা কেন সেতো আমার প্রথম সন্তান| আর এটা তো আমার হাতে নয় এতো ঈশ্বরের দান মা|
--- মুখে মুখে তর্ক আমি একদম পছন্দ করিনা| যদি মেয়ে হয় তাহলে তুমি ওখানেই তাকে বিদায় দিয়ে আসবে আর তা না হলে তাকে নিয়ে সারাজীবনের মত বাপের বাড়িতে চলে যাবে|
--- কেন মা? মেয়ে হলে বাপের বাড়ি কেন যাবো? সেতো এই বংশেরই মেয়ে| আপনার প্রথম সন্তান ও তো মেয়ে| আপনি যদি তাকে নিয়ে আপনার শ্বশুরের ভিটেই থাকতে পারেন আমি কেন পারবোনা? আমারও তো এটা শ্বশুরের ভিটা |
--- কি এতো বড় কথা তোমার? আমি ডাকছি সবাইকে, আজ তোমার একদিন কি আমার একদিন |
চিৎকার চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় করলেন | ছেলেকে তার ঘরে গিয়ে কি বললেন জানিনা| সে এসেই আমার গালে এতো জোরে এক থাপ্পড় মারলো--- শুধু এ টুকুই মনে আছে সেই মুহূর্তে আমার দেওর ও সেখানে এসে দাঁড়িয়েছিলো| পরে যখন আমার জ্ঞান ফেরে আমি হাসপাতালে আর আমার মুখের উপর আমার মা, ভাই, বাবা আর আমার দেওর উৎকণ্ঠা নিয়ে সব তাকিয়ে আছে | বাবা আমায় বললেন, কোন ভয় নেই মা আমরা সবাই তোর সাথে আছি | এতদিন ধরে সবকষ্ট মুখ বুজে কেন সহ্য করেছিস? কেন সবকিছু আমায় জানাসনি? আর তোকে ও বাড়িতে যেতে হবেনা| আমাকে সবকথা তোর দেওর অনিরুদ্ধ বলেছে| ওই দেখ আসল কথাই তো বলতে ভুলে গেছি| আমি তো দাদু হয়েছি একটা সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে তোর| এখন থেকে ওকে নিয়ে তুই আমাদের কাছেই থাকবি| মা হওয়ার আনন্দ আর এতদিন পরে আমার ভালোবাসার মানুষগুলোকে একসাথে পেয়ে কিছুক্ষনের জন্য হলেও মনের ভিতরের সমস্ত কষ্ট এক নিমেষে মুছে গেলো |
যে কটাদিন হাসপাতাল ছিলাম একবার করে অনিরুদ্ধ এসেছে আমায় ও আমার মেয়েকে দেখতে | বাবার সাথে বাড়িতে চলে আসার পরও সপ্তাহে একদিন বা দুদিন করে সে আসে| যতটুকু সময় থাকে সে তার ভাইঝিকে নিয়েই থাকে | টুকটাক খেলনা, জামা এসব নিয়ে আসে দেখে আমি তাকে একদিন বললাম,
--- শোনো অনি, তুমি তো চাকরী করোনা এসব জিনিস তুমি আনবে না|
--- ও তো আমাদের বংশেরই| আমাদের বাড়ির লোকেরা অস্বীকার করতে পারে| কিন্তু সত্যিটাকে তো অস্বীকার করে চাপা দিয়ে রাখা যায়না| আমার পরীক্ষা শেষ| আমি কিছু টিউশনি করছি| নিজের টাকা দিয়েই ওর জন্য এসব নিয়ে আসি| আমি যখন চাকরী পাবো ওর সমস্ত দায়িত্ব আমি নেবো| ওর ভবিষৎ নিয়ে তোমায় কিছু ভাবতে হবেনা| আসলে কি জানো বৌদি, মা আর দাদা দুজনেই সাইকোপেশান্ট| অনেকবার চেষ্টা করেছি তাদের সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাওয়ার| তারা মনে করে সাইকিয়াট্রিস্ট মানেই পাগলের ডাক্তার| দাদা এতো শিক্ষিত হয়েও এটা বোঝেনা| বাবা কিন্তু খুব শান্তিপ্রিয় ভালো মানুষ| কিন্তু মায়ের মুখের সাথে তিনি পেরে ওঠেননা| তুমি জানোনা তোমাকে নিয়ে বাবা মায়ের মধ্যে প্রচুর ঝামেলা হয়েছে| কিন্তু সুরাহা কিছুই হয়নি| আমি যে তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতাম সেটাও কিন্তু বাবা আমায় চুপিচুপি বলে দিয়েছিলেন| মা আমাকে একটু সমীহ করে চলেন তার কারণ আমি রেগে গেলে ভীষণ ভাঙ্চুর করতে শুরু করি| হয়তো খেয়াল করে দেখবে তোমার সাথে মা বা দাদা যে ঝামেলাটা করতো সেটা কিন্তু আমার অনুপস্থিতিতেই| আমি কিছুটা বুঝতে পারলেও চুপ থাকতাম তার কারণ তোমাকে নিয়ে মা বা দাদার সাথে আমি ঝামেলা করলে তার জেরটা আমি বাড়িতে না থাকলে তোমার উপরই পড়তো| আর তুমিও আমাকে কোনোদিন কিছুই বলোনি| আমিও তো তোমার ছোট ভায়ের মত| তুমি তোমার কষ্টটাকে কখনোই আমার সাথে শেয়ার করোনি|
আমি উঠে গিয়ে অনির মাথায় হাত রাখি | ওর চোখ ভত্তি জল আমি আমার শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দিই|
--- আমি সত্যিই ভুল করেছি ভাই| আমি বুঝতে পারিনি আমার এতবড় একজন শুভাকাঙ্ক্ষী ওই বাড়িতেই ছিলো| আজ থেকে আমার দুটি ভাই| আমার আর কোন চিন্তায় তো থাকলোনা| আর মাথার উপরে আছেন বাবা মা| সকলের সহযোগিতায় আমার মেয়েটি ঠিক মানুষের মত মানুষ হয়ে যাবে| আজ থেকে আমি আর চোখের জল ফেলবোনা , অতীতকে নিয়েও আর ভাববোনা| নিজেও এই সামান্য শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে কিছু করার আপ্রাণ চেষ্টা করবো| ফেলে আসা অতীতটাকে দুঃস্বপ্ন বলে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করবো|
অনিরুদ্ধ নীচু হয়ে তার বৌদিকে প্রণাম করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো দৃঢ় সংকল্প নিয়ে যেভাবেই হোক তাকে একটা চাকরী জোগাড় করতেই হবে | আর নীলা মানে আমি নূতন সূর্য্যের আশায় বুক বেঁধে আমার মেয়ে মুক্তমনাকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম|
No comments:
Post a Comment