বুঝতে শিখেছি
নন্দা মুখাৰ্জী রায় চৌধুরী
স্বামীর মৃত্যুর পর ছোট ছোট ছেলেমেয়ে দুটিকে মানুষ করতে অতসীর কালঘাম ছুটে গেছে | দেবদূতের মত সেদিন যদি গৌরীদি পাশে এসে না দাঁড়াতো তাদের নিয়ে রাস্তায় হয়তো ভিক্ষা করে খেতে হত | নুতন বৌ হয়ে এ বাড়িতে আসার পর থেকেই পাশের বাড়ির গৌরীদির সাথে অতসীর ভাবটা যেন একটু বেশিই বলা চলে | নিজের জীবনের বিনিময়ে গৌরীদি তার পুরো পরিবারটাকে যক্ষের ধনের মত যেন আগলে রেখেছে | গৌরীদির বাবা সামান্য একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করতেন | শ্বাসকষ্ট জনিত কারনে তার দুটো লাঞ্ছই ব্লক হয়ে যায় | দারিদ্রতার কারণে একবার টিবিও হয়েছিল | পরবর্তীতে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন এজমা | চিকিৎসা সেভাবে কোনদিনও করতে পারেননি | অল্প বয়সে যখন বাবাকে হারান তখন মা ছাড়াও আরও দুটো ছোট ছোট ভাইবোনের দায়িত্ব তার উপর এসে পরে | লেখাপড়া বেশিদূর করতে পারেননি | বাবা যখন মারা যান গৌরীদির তখন সবে মাধ্যমিক পরীক্ষাটা শেষ হয়েছে | ব্যস পড়াশুনার ওখানেই ইতি | সেলাইয়ের দোকানে ঘুরে ঘুরে প্রথম অবস্থায় জামাকাপড়ে হেম সেলাই করে পয়সা রোজগার শুরু | তারপর ভালোভাবে কাটিং আর সেলাই শেখা | এরপর এমব্রয়ডারি | ভাইবোন দুটিকে লেখাপড়া শিখিয়ে সংসারী করেছে | নিজের দিকে তাকানোর আর সময় হয়নি কোনদিন | আজ তার বিশাল বুটিকের দোকান | গৌরীদি আজ সম্পূর্ণ একা | ভাই আর তার বৌ আছে ঠিকই কিন্তু গৌরীদিকে তাদের লাগে শুধুমাত্র টাকার যোগান দেওয়ার জন্যই |
অতসী তার স্বামীকে হারিয়ে যখন অথৈ সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছে ঠিক তখনই গৌরীদি একদিন অতসীর বাড়িতে এসে বলে ,
--- কিরে এইভাবে ঘরে বসে থেকে শুধু চোখের জল ফেললে চলবে? ওদের মানুষ করতে হবেনা খেয়েপরে বাঁচতে হবেনা ?
--- কিন্তু আমার পেটে তো বিদ্যের জোর কতটুকু সেতো তুমি জানো দিদি | আমি এখন কি করবো বলো এই ছোট ছোট দুটি বাচ্চাকে নিয়ে |
--- দূর পাগলী , জীবনে ভালোভাবে বাঁচতে গেলে বুদ্ধির দরকার , শুধু লেখাপড়া জানলেই হয়না | অনেক বড় বড় শিক্ষিত মানুষ বেকার হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে | চাকরি ছাড়াও এই পৃথিবীতে করার অনেক কিছু আছে - যেখানে শুধু বুদ্ধি দিয়েই কাজ হাসিল করতে হয় | আমার জীবনের গল্প তো সব তোকে বলেছি | তুই আমার দোকানে এসে কাজ করতে শুরু কর , তারপর আস্তে আস্তে আমি তোকে সব শিখিয়ে দেবো|
অতসীর সেই শুরু সামান্য কিছু রোজগার করা | দিনে দিনে সে যেমন তার গৌরীদির দোকানের মান উন্নত করেছে ততই তার আরও কাছের প্রিয় মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছে আর গৌরীদির তত্বাবধানে কাটিং থেকে শুরু করে এমব্রয়ডারি সবটাতেই আজ সে পারদর্শী |
ছেলেমেয়ে দুটিকে গ্রাজুয়েট করে বিয়েও দিয়েছে | ছেলে এখন বেশ ভালো চাকরি করে | মেয়ে সুখেই আছে | মাঝে মধ্যে মায়ের কাছে এসে দু একদিন করে থেকেও যায় | কিন্তু সমস্যা শুরু হল ছেলের বিয়ের ছমাসের মাথাতেই | ছেলেবৌয়ের কথামত তাদের বাড়িটা লিখে দিতে হবে | কিন্তু অতসী তাতে বিন্দুমাত্র রাজি নয় | অশান্তির সূত্রপাত এখান থেকেই | সব কথায় সে তার দিদিকে এসে বলে | পৃথিবীটা যে কত স্বার্থপর হতে পারে , স্বার্থের জন্য খুব কাছের মানুষগুলো যে কত ভয়ঙ্কর হতে পারে আজ অতসী ও গৌরী ভালোভাবেই তা বুঝে গেছে | গৌরীর পরামর্শ মত অতসী তার কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে চলে আসে গৌরীর বাড়িতে একটা ঘরের ভাড়াটিয়া হয়ে | অবশ্য নামেই ভাড়াটিয়া ভাড়া গৌরী কোনদিনও নিতোনা | নিজের বাড়ি হওয়া স্বর্তেও এই মিথ্যার আশ্রয়টুকু তাকে নিতে হয়েছিল তার ভাই ও ভাইবৌয়ের কারণে | মাস গেলে কিছু টাকা সে নিজেই তার ভাইবৌয়ের হাতে গুঁজে দিতো অতসীর ঘরভাড়া বাবদ | ব্যাস তাতেই ছিল শান্তি বজায় | দুটি নারী তাদের জীবনের সমস্ত আশাআকাঙ্খা জলাঞ্জলি দিয়ে কেউ নারী ছেড়া সন্তানের জন্য আর কেউi সন্তানসম ভাইবোনের জন্য সমস্ত জীবন উজাড় করেও তাদের কাছ থেকে বিন্দুমাত্র সম্মান টুকুও পায়নি | যতদিন তাদের প্রয়োজন ছিল ততদিনই তারা একটা ভালোবাসার মুখোশ পরে ছিল | যখন তাদের প্রয়োজন মিটে গেছে ঠিক তখনই অতি প্রিয় কাছের মানুষগুলোর মুখোশও খুলে গেছে | অতসী ও গৌরীও বুঝতে শিখে গেছে জীবনে তারা আর যে কটাদিন বাঁচবে তাদের শখ আহ্লাদগুলো মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে | এবার আর অন্যের জন্য নয় বাঁচবে সম্পূর্ণ নিজেদের জন্যই | পিছনের কথা ভেবে আর কাঁদবেনা | তাই তো তারা সাপ্তাহিক দোকান বন্ধের দিনে সেজেগুজে বেরিয়ে পরে কোনদিন সিনেমা তো কোনোদিন বড় কোন পার্কে আর ফেরার পথে বড় কোন হোটেলে ডিনার সেরে | এই বাঁধনহারা জীবনে দুজনেই খুব খুশি | অন্যদের কথা ভাবতে গিয়ে দুজনেই ভুলে গেছিলো তাদের নিজেদেরও একটা জীবন আছে | আর সেই জীবনে আছে কিছু চাহিদা যা এতদিন তারা সেই চাহিদাগুলোকে মর্যাদার আসনে বসাতে পারেনি বিবেকের তাড়নায় | এখন অন্যের জন্য নয় তারা ভাববে শুধু নিজেদের নিয়েই | জীবন তো একটাই | জীবনের অর্ধেক সময় কেটে গেছে | বাকি জীবনটা মুক্ত বিহঙ্গের মত কাটিয়ে দেওয়ার মানসিকতা নিয়েই এগিয়ে চলে মধ্যবয়সী দুটি নারী |
#আমার_লেখনীতে " অন্যের প্রশংসার জন্য নয়, নিজেকে ভালোবেসে বদলেছি আমি |"
No comments:
Post a Comment