Thursday, November 14, 2019

নিজেকে খুঁজে পেলাম

নিজেকে খুঁজে পেলাম 
   নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী 

    ছেলেবেলার ইচ্ছাগুলিকে জলাঞ্জলি দিয়ে বাবার ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দিয়ে গ্রাজুয়েশনেরর আগেই মধুরিমা বিয়ের পিঁড়িতে বসলো।তার খুব ইচ্ছা ছিলো পড়াশুনা শেষ করে কিছু অন্তত রোজগারের রাস্তা খুঁজে নেবে।কিন্তু বাবা কিছুতেই শুনলেন না।তাই অনিচ্ছা সত্বেও বিয়ে করতে রাজি হওয়া।বিয়ের ছ'মাস পরেও মধুরিমা বুঝতে পারেনা,বাবা কেন কিসের জন্য এইরূপ একটা পরিবারের সাথে তার বিয়ে দিলেন ?
মধুরিমার স্বামী বিধানেরা চার ভাই।বিধান সকলের বড়।বাকি সকলেই পড়াশুনা করছে।সংসারে বিধানই একমাত্র রোজগেরে।সরকারী ক্লাক।নিজেদের ছোট্ট একটা বাড়ি।খুব ছোট ছোট ঘর। অথচ মধুরিমা ছিলো দোতলা বাড়ির তিন ভাইবোনের সকলের ছোট। খুব আদরের ছিলো।দিদি বড় বিয়ে হয়ে গেছে,দাদা একটা কোম্পানীতে মোটা বেতনের চাকরী করে।এই নিম্নবিত্ত পরিবারে বাবা কেন যে তার বিয়ে দিলো কিছুতেই সে আজও বুঝে উঠতে পারলোনা। 
   আপ্রাণ চেষ্টা করে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার।বিধান তার ভায়েরা অত্যন্ত সাদাসীধা।তার মা ও ঠিক তাই। অতি অল্পতেই তারা খুব খুশি।কিন্তু তাদের চালচলন,খাওয়াদাওয়ার সাথে কিছুতেই মধুরিমা খাপ খাওয়াতে পারেনা।কিন্তু বুদ্ধিমতী মেয়ে কখনোই তার আচার ব্যবহারে তা প্রকাশ করেনা।নিজেই নিজেকে শান্তনা দেয় -'কপালে যা ছিলো তাই হয়েছে।'কিন্তু তবুও মাঝে মাঝে বাবার পরে খুব রাগ হয়।কখনো এটাও ভাবে,'বাবা হয়তো শুধুমাত্র সরকারী চাকরী দেখেই এই বিয়েটায় রাজি হয়েছিলেন'। 
 বিয়ের আগেই বাবা মধুরিমাকে বলেছিলেন, 
--বিয়ের পর তুমি গ্রাজুয়েশন করবে।ওদের সাথে আমি কথা বলে নিয়েছি।' 
---কিন্তু বাবা গ্রাজুয়েশনের পর বিয়েটা হলে অসুবিধা কোথায়? 
---অসুবিধাটা ঠিক কোথায় সেটা তুমি আজ বুঝবেনা।একদিন বুঝবে হয়তো সেদিন আমি থাকবোনা।কিন্তু ঠিক বুঝতে পারবে।
বিয়ের পর এই না মানিয়ে নেওয়ার কারনেই নানান অজুহাতে মধুরিমা বাপের বাড়িতে এসে থেকেছে।কিন্তু কোনদিনও বাড়ির কারও কাছে তার কষ্টের কথা শেয়ার করেনি।আর শ্বশুরবাড়ি থেকেও তার শ্বাশুড়ী বা স্বামী মাঝে মাঝেই এই বাড়িতে এসে থাকা নিয়ে কোন কথা কোনদিনও বলেননি।অভাব সংসারে থাকলেও তারা প্রত্যকেই হাসি মুখে সে অভাবকে ভালোবাসা দিয়ে জয় করেছে।সত্যি বলতে কি আস্তে আস্তে শ্বশুরবাড়ির সকলের এই ভালোবাসায় মধুরিমার ভিতরের কষ্টগুলির দগদগে ঘায়ের উপরে একটা শক্ত প্রলেপ পড়িয়ে দেয়। 
  মধুরিমা সবসময় বুঝতে পারতো এই বিশাল সংসারের দায়িত্ব সামলাতে বিধান হিমশিম খাচ্ছে।কিন্তু মুখে কখনই তা প্রকাশ করতোনা।তার উপর ছিলো তার পরোপকার করার স্বভাব।নানান আর্থিক দিক থেকে তাকে যেন সংসার পিষে দিচ্ছিলো।এইসব বুঝতে পেরেই পরীক্ষা শেষে মধুরিমা কিছু প্রাইভেট টিউশন করতে থাকে যাতে তার কিছু সুরাহা হয়।ভীষণ চাপা স্বভাবের বিধান এটা বুঝতে পেরেছিলো।সে কিন্তু কখনোই হাত পেতে মধুরিমার কাছ থেকে টাকা নেয়নি।বরং তার হাতে দিতে চাইলে বলেছে, 
---চালিয়ে নিচ্ছি তো -এগুলো তোমার কাছে থাক,তুমি নিজের ইচ্ছামত খরচ কোরো। 
 মধুরিমার এই সামান্য কটা টাকা।তাই দিয়েই সে মাঝে মধ্যে বাজার করতো।নিজেই যেত।কারন শ্বাশুড়ীমাকে দিতে গেলে তিনিও ঠিক একই কথা বলতেন।মানুষ যে কত ভালো হতে পারে তা বিধানের সাথে বিয়ে না হলে মধুরিমা সত্যিই বুঝতে পারতোনা।একবছর পর মধুরিমা যেদিন বুঝতে পারলো সে মা হতে চলেছে -যখন সে তার স্বামী শ্বাশুড়ীকে কথাটা জানালো সেদিন থেকে বাড়িতে যেন খুশির বন্যা বয়ে যেতে লাগলো।সকলেই খুশি।ডাক্তার বলে দিলেন বেডরেষ্ট।যে যখন বাইরের থেকে আসে একবার করে মধুরিমার ঘরে উঁকি মেরে যায়।জানতে চায়,'বৌদি ঠিক আছো তো?' যেন পারলে তারা তাকে মাথায় করে রাখে।বিধান এই প্রথমবার বাপের বাড়িতে গিয়ে থাকতে চাইলে মিষ্টি হেসে বলে, 
--তুমি এখানেই থাকো গো।আমি তাহলে আমার সন্তান আসার প্রত্যেকটা মুভমেন্ট তোমার দেখতে পাবো। 
এরপর আর মধুরিমা কোন আপত্তি করতে পারেনি।সে যখন তার সন্তানের নড়াচড়া টের পাচ্ছে আর সেই সময় বিধান অফিস থেকে বাড়িতে ফিরে পেটটার উপরে মাথা দিয়ে তার সন্তানের নড়াচড়াটা অনুভব করার চেষ্টা করতো।আর বুঝতে পারলেই খুশিতে তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠতো।সে এক অনন্য অনুভূতিতে সারাটা রাত মধুরিমার পেটের পরে একটা হাত দিয়ে ঘুমিয়ে থাকতো।মধুরিমা প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর থেকেই সে যেন নূতন করে নিজেকে রোজ রোজ আবিষ্কার করতো।আর তা শতগুণ বেরে যায় যেদিন বিধানের সাদা ধবধবে ধুতীর একটি টুকরোর মধ্যে  করে বহু আকাঙ্ক্ষিত তার প্রথম কন্যা সন্তানকে মধুরিমার ঠিক বুকের কাছটাতে এনে শুইয়ে দেয়।মধুরিমার তখন মনে হচ্ছিলো পৃথিবীর সর্বসুখ যেন তার দোরগোড়ায়।নিজেকে সে যেন নূতনভাবে সম্পূর্ণ অন্যরকম রূপে খুঁজে পেলো।মা হওয়ার যে এতো সুখ --এ সুখের যে কোন সীমা পরিসীমা নেই ---আজ প্রথম সে বুঝতে পারলো।পৃথিবীর যে কোন সুখই যে এর কাছে ম্লান আজ প্রথম সে উপলব্ধি করলো। 

No comments:

Post a Comment