অনুরোধে ঢেঁকি গেলা
জলাঞ্জলি
মুখার্জী রায় চৌধুরী
বাবার ইচ্ছার দাম দিতে গিয়ে ' অনুরোধে ঢেঁকি গেলার পরিস্থিতি এখন রক্তিমের । বাবার কোন ছেলেবেলার বন্ধু তার সাথে হঠাৎ করে কয়েক যুগ পরে দার্জিলিং টাইগার হিলে নূতন সূর্য্যদয় দেখতে গিয়ে দেখা আর শুধু দেখা তো নয় রক্তিমের মনেহচ্ছে তার স্বপ্নের সূর্য্যটাই অস্ত যেতে বসেছে।
বাবা,মা আর বোন তিনজন মিলে দিনপনেরোর জন্য দার্জিলিং ঘুরতে গেছিলেন।রক্তিমেরও যাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু অফিসের জরুরী কাজের জন্য তিনমাস আগে টিকিট কাটা সত্বেও যেতে পারেনি।এখন নিজের চুল টেনে নিজেরই ছিঁড়তে ইচ্ছা করছে।গেলে অন্তত মেয়েটার বদনখানি দেখতে পেতো।বাবা যা রাগী তাতে রক্তিমের সাহসই হবেনা ওই মেয়েকে দেখতে চাওয়ার।ভরসা ছিলো ছোট বোন তুবড়ি।সে তো একবার বলছে,'দারুন দেখতে,'পরেরবার বলছে,'মেয়েটা একটু ট্যারা দাদা' আবার কখনোবা 'ভীষণ কালো মেয়ে।'রক্তিমের মাথা পাগল হবার জোগাড়।খাওয়া,ঘুম বিসর্জনের পথে।অফিসের কাজে ভুলভাল।মনেমনে ঠিক করলো,'যা কপালে আছে হবে,মাকে যেভাবে হোক রাজি করিয়ে বাবাকে বলতেই হবে,মেয়েটার সাথে দেখা করার কথা।'
সেদিন রাতে বাবা ও বোন খেয়ে যে যার ঘরে চলে গেলেও রক্তিম বসেই থাকে।ছেলেকে বসে থাকতে দেখে মা বললেন,
---কিছু বলবি আমাকে?
---হ্যাঁ মা,তোমার সাথে একটা কথা ছিলো।
---কি বলবি বল,আমার এখনও অনেক কাজ রয়েছে।
---বাবা হঠাৎ করে এটা না করলেই পারতেন।
---তোর বিয়ের কথা বলছিস?কেন কি হয়েছে?ছেলেমেয়ে বড় হলে তার তো বিয়ে দিতেই হবে।প্রতিটা বাবা মায়ের এটা দায়িত্ব।
---তাই বলে বলা নেই কওয়া নেই,চিনিনা জানিনা,কোনদিন দেখিওনি----এমন একটা মেয়েকে কি করে বিয়ে করি বলো তো?
---আমাদের সময়ে তো এসব ছিলোনা।বাবা মা পছন্দ করতেন আর দেখা হোত সেই ছাদনাতলায় শুভদৃষ্টির সময়ে।
---মা এখন আর সেই দিন নেই।তুমি বাবাকে একটু রাজি করাও আমি মেয়েটিকে দেখবো।
---তুই বলছিস আমি বলবো তোর বাবাকে।কিন্তু কোন লাভ হবে বলে মনেহয় না।
পরদিন খাবার টেবিলে বাবা নিজেই বললেন,
---শোনো রক্তিম আমি যখন আমার বন্ধুকে কথা দিয়েছি তখন তোমার এ বিয়ে করতেই হবে।আর আজ পর্যন্ত আমি তোমাদের খারাপ হয় এমন কিছু করিনি।ছেলেবেলার বন্ধু আমার।একই গায়ে থাকতাম।খুব ভালো পরিবার।মেয়েটি ইংলিশে অনার্স করেছে।চাকরীর চেষ্টা করছে।আমাদের সকলের পছন্দ হয়েছে।বিয়েটা এখানেই হবে আর দেখা সাক্ষাৎ ও হবে সেই ছাদনাতলায়।
চুপ করে রক্তিম কথাগুলো শুনে কোনোরকমে খেয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো।রাগে, দুঃখে চোখের থেকেই তার জল বেরিয়ে গেলো।'পরিবার ভালো'---পরিবার ধুয়ে আমি কি জল খাবো?'ইংলিশে অনার্স করেছে'---অনার্স করার জন্য কি চেহারার দরকার হয়?সে ট্যারা,খোঁড়া নাকি কালো কিছুই জানার উপায় নেই।এদিকে বাড়িতে বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে।
রক্তিমের মুখের হাসিও ফুরিয়ে গেছে।সে যেন হাসতেই ভুলে গেছে।নিমন্ত্রিতদের নামের লিষ্ট করার সময় বাবা যখন জানতে চাইলেন তার কতজন বন্ধু হবে?সে পরিষ্কার জানিয়ে দিলো,'আমার কোন বন্ধু নেই।'তার বাবা,মা উভয়েই বুঝতে পারলেন ছেলের এটা রাগের কথা।
বিয়ের দু'দিন আগের থেকেই বাড়িতে লোকজন আসতে শুরু করলো।সবার আগে এলো রক্তিমের মাসতুতো বোন-যার একবছর আগে বিয়ে হয়েছে।সেতো এসেই দাদার পিছনে লাগতে শুরু করলো।কিন্তু বোন সুনীতা বুঝতে পারলো দাদার এই বিয়েতে কোন মত নেই আর এই কারনেই তার মুখে হাসিও নেই।সে দাদাকে একলা পেয়ে জানতে চাইলো,
---হ্যাঁরে দাদা তোর কি এই বিয়েতে মত নেই?তুই কি অন্য কাউকে ভালোবাসিস?
---না ---
---কোনটাতে 'না' বললি?
---তোর দুটো প্রশ্নের উত্তরই আমার কাছে না।
---মানে?
---মানে আবার কি?এ বিয়েতে আমার মত নেই কারন মেয়েটিকে আমি দেখিইনি আর আমি কাউকেই ভালোবাসিনা।
---তাই বল।কিন্তু মাসিমনি তো বললো,মেয়েটাকে খুব সুন্দর দেখতে।
---বাবা তার বাল্যবন্ধুর মেয়েকে সুন্দর বলছেন তাই মা ও সুন্দর বলছেন।বাবাকে চিনিস তো,তিনি যা বলবেন মাকেও তাই বলতে হবে।
---তুই মিথ্যে চিন্তা করছিস দাদা।তুবড়িও কিন্তু বলেছে খুব সুন্দর দেখতে।
---তুই ছাড় ওর কথা।ও কখন কোনটা বলে তার কোন ঠিক আছে।আমি আর ভাববোনা,যা কপালে আছে তাই হবে।হয় কালিন্দীর নয় ট্যারা।
রক্তিমের বলার ধরনে সুনীতা হেসে ফেললো।'দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।তোর বৌ খুব সুন্দরী হবে।'
বর গিয়ে পৌঁছালো মেয়ের বাড়িতে।কিন্তু বরের তো মুখ কালো।'বরের মুখে হাসি নেই,বর হাসতে জানেনা---' নানান কথা তার কানে আসছে।কিন্তু রক্তিম তো তার জীবনসঙ্গীর যে চিত্র অঙ্কন করেছিলো আপনমনে তাকে তো সে জলাঞ্জলী দিয়েই বাবার কথাকে উপেক্ষা করতে না পেরেই ঠুঠো জগন্নাথের মত বিয়ে করতে এসেছে।
মেয়েকে নিয়ে আসা হোল।এবার সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।শুভদৃষ্টি।রক্তিমের মুখ আর নীচের দিক হতে বৌ এর মুখ পর্যন্ত ওঠেনা।সবাই হাসাহাসি করতে লাগলো।বরের তো ভারী লজ্জা!শুভদৃষ্টি না হলে বিয়ে হবে কি করে?অনেক বলাবলিতে রক্তিম তার বৌ সুদীপার মুখের দিকে তাকালো।তাকালো তো তাকিয়েই থাকলো।তখন সেখানে আর একপ্রস্ত হাসাহাসি।বর বাবাজি তো লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে বৌ এর দিকে তাকিয়েই আছে। রক্তিম মনেমনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলো---সত্যিই সে কল্পনাও করতে পারেনি তার বৌকে এতো সুন্দর দেখতে হবে।আবার মনে পরে গেলো তুবড়ির কথা।'একটু খোঁড়া দাদা।'সত্যিই খোঁড়া নয় তো?না হাঁটলে বোঝা যাবেনা।এখনই চেহারায় আপ্লুত হবার কোন কারন নেই।দেখি কপালে শেষ পর্যন্ত কি আছে।
কিছুক্ষণ পরে সে চিন্তাও দূরীভূত হোল।মনেমনে ঈশ্বরের সাথে সাথে বাবাকেও একটা ধন্যবাদ দিলো।তবুও একটা চিন্তা মন থেকে গেলোনা।'মেয়েটা সবাইকে নিয়ে মানিয়ে গুছিয়ে থাকতে পারবে তো?বাবা তো বলেছিলেন,পরিবারটা খুব ভালো।তাছাড়া উচ্চশিক্ষিত মেয়ে।নিশ্চয় পারবে।আপাতত তো চিন্তা দূর হোল।পরেরটা পরে দেখা যাবে।এখন বিয়ের আনন্দটুকু মন খুলে ভোগ করি।কি হবে আর কি হবেনা সে চিন্তা এখন জলাঞ্জলি দিয়ে দিই।
No comments:
Post a Comment