ভাগ্যকে মানতেই হয়
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
(1)
পাঁচ ব্যাটারীর টর্চের আলোতে পুলিশ ইন্সপেক্টর বাইরের গেট , ঘরের বাইরে কোলাপ্সীবেল গেট ও সর্বশেষে ঘরে ঢোকার দরজার তালা একের পর এক ভাঙ্গার পরে চারজন পুলিশ কর্মীকে নিয়ে দোতলার বিশাল ড্রয়িংরুমের ভিতর এসে দাঁড়ালেন । অন্ধকার ঘরের লাইটের সুইচ পেতে তাদের বিশেষ বেগ পেতে হলোনা কারন পাঁচ ব্যাটারীর দু'দুটি টর্চ তাদের সাথে ছিলো । সন্ধ্যা তখন প্রায় হয় হয় । পাড়ার জনৈক ব্যক্তির ফোনে তাদের এখানে আসা । জনৈক ব্যক্তি পুলিসকে জানান, বাংলোসম বিশাল দোতলা বাড়ি থেকে কয়েকদিন ধরেই পঁচা দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে যা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে ! ঘরের ভিতর ঢুকেই প্রত্যেকেই নাকে রুমাল চাপা দেন । অগ্রহায়ণের শীতের সন্ধ্যা ;বেশ জাঁকিয়ে ঠান্ডাও পড়েছে । সকাল থেকেই কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়েছে প্রকৃতি । এই ঠান্ডার মাঝেও ওই বাড়ির বাইরে পুরুষ ও মহিলা গিজগিজ করছে । সকলের ভিতরই একটি চাপা ফিসফিসানি ! এখানে তো পারমান্যান্টলি কেউ থাকেনা ;মাঝে মাঝে রাতের দিকে লাইট জ্বলতে দেখা যায় ! কিণ্তু সেভাবে কাউকে কোনদিনও দেখা যায়নি । চারিদিকে উঁচু প্রাচীরে ঘেরা । সামনে অনেকটা জায়গা জুড়ে ফুলের বাগান । মাঝে মাঝে এক বৃদ্ধকে ওই বাড়িতে দেখা যায় বটে কিণ্তু সে নিজেকে ওই ফুল বাগানের মালি বলেই পরিচয় দেয় । বাড়ির বাইরেও বিশাল পুলিশ বাহিনী দাঁড়িয়ে ;যাতে করে কোন পাড়ার লোক ভিতরে ঢুকতে সাহস না পায় ।
ইন্সপেক্টর উত্তম মজুমদার ও তার সহকর্মীরা ঘরে ঢুকে আলো জ্বালিয়ে বিভৎস দৃশ্য দেখে কয়েক সেকেন্ড কেউই কথা বলতে পারেননি । সারাঘর রক্তে ভেসে গেছে যদিও সেই রক্ত এখন শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে । মধ্য বয়স্ক দুই ভদ্রলোক -একজন সোফার কাছে আর একজন বাথরুমের দরজার কাছে পরে আছেন । দুজনকেই ছুরিকাঘাত করে মারা হয়েছে । ঘরের মধ্যে ইতস্তত মদের বোতল , গ্লাস , নানান ধরনের খাবার দাবার ছড়ানো ছিটানো । বোঝায় যাচ্ছে মৃত দুই ব্যক্তির সাথে আরও এক বা একাধিক লোক ছিলো । যে বা যারা বচসার জেড়ে এদের দু'জনকে খুন করে সকলের অলক্ষ্যে এই বাড়ি থেকে ধীর স্থির ভাবেই বেরিয়ে গেছে । সমস্ত ঘর সার্চ করে সন্ধেহজনক কিছুই চোখে পরেনা কারও । বডি দুটিকে ময়না তদন্তের জন্য পাঠিয়ে বাড়িটা সিল করে ইন্সপেক্টর তার দলবল নিয়ে থানার উদ্দেশ্যে রওনা দেন ।
(2)
ছোটবেলা থেকেই চন্দন পড়াশুনায় খুব ভালো । প্রতি বছরই সে প্রথম হয়ে উপরের ক্লাসে ওঠে । স্কুলের শিক্ষকেরা প্রত্যেকেই চন্দন সম্পর্কে উচ্চ ধারনা পোষণ করেন ও তার উজ্জ্বল ভবিষৎ চোখের সম্মুখে দেখতে পান । মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক সে 90% নম্বর নিয়ে পাশ করে বাবার ইচ্ছা অনুযায়ী ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হয় । কিণ্তু উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে সে রেলের চাকরীর পরীক্ষা দিয়ে রেলে চাকরী পেলেও তার বাবা তাকে ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হতে বলেন । বাধ্য চন্দন বাবার ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দেয় । ফলে তার জীবনে স্বইচ্ছায় লক্ষ্মী এসে ধরা দিলেও ভাগ্যের পরিহাসে তাকে তা খোয়াতে হোলো । তিন ভাই বোনের বড় চন্দন । বড় ছেলের উজ্জ্বল ভবিষৎ বাবাও কল্পনা করেছিলেন । ছোট ছেলে ও মেজ মেয়েটি পড়াশুনায় ছিলো মোটামুটি । হুগলির প্রত্যন্ত গ্রামে সামান্য যা কিছু জমিজমা ছিলো তিনি সকলের অজান্তেই ছোট ছেলের নামে উইল করে রাখেন । তার ধারনা অনুযায়ী চন্দন পাশ করে বেরিয়েই চাকরী পাবে আর তখন সে গ্রামে থাকবেও না ;নিজেরটা নিজে চালিয়ে নিতে পারবে । তাই অপেক্ষাকৃত দুর্বল ছোট ছেলেকেই তিনি তার সম্পত্তির পুরোটা লিখে দেন । যেহেতু সরকারী খরচে চন্দন পড়াশুনা করতো তাই তাকে নিয়ে তার বাবার কোন চিন্তা ছিলোনা । টুকটাক হাত খরচ সে টিউশনি করেই জোগাড় করতো । চন্দনের ইঞ্জিনিয়ারিং এ যখন তৃতীয়বর্ষ তখন তার বোন চারুলতার বেশ অবস্থাপন্ন ঘরেই বিবাহ হয়ে যায় । চন্দনের স্কুল শিক্ষক বাবা মেয়ের বিয়ের ঠিক এক বছরের মধ্যেই মারা যান । চন্দন ভালভাবে ইঞ্জিনিয়ারিং এ পাশ করে চাকরীর জন্য হন্যে হয়ে ইন্টারভিউ দিয়ে যেতে লাগলো । কিণ্তু কোথায় চাকরী ? চাকরীর চাবীতো সব নেতাদের হাতে ! সরকারী থেকে বেসরকারী ! গ্রামের ছেলে চন্দনের তো কিছু ভালো সর্টিফিকেট ছাড়া আর কিছুই নেই । তাই চাকরীও তার মেলেনা । সাথে আলোচনা করে ঠিক করে ভায়ের মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলেই গ্রামের জমিজমা বিক্রি করে তারা কলকাতায় ছোটখাটো একটা ভাড়া বাড়িতে এসে উঠবে । ভাইকে কলকাতার কলেজেই ভর্তি করবে ;নিত্য সে প্রাইভেট কোম্পানীগুলিতে চাকরীর চেষ্টা করার সাথে সাথে কিছু টিউশনি করতেও পারবে । মাকে দিয়ে বাড়ির দলিল বের করিয়ে উইল দেখে সে হতভম্ব ! বাবা তাকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেছেন ! কিণ্তু কেনো ? কি তার অপরাধ ছিলো ? বাবা কেনো এটা করলেন ?
ভয়ানক অভিমান থেকে চন্দন পরদিন সকালেই মা , ভাইকে কিচ্ছুটি না জানিয়েই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পরে । সে কলকাতা শহরে নানান জায়গায় চাকরীর চেষ্টা করতে লাগে । বলা বাহুল্য তার এই মনের ইচ্ছা পূরণ হয়না । একদিন রাতের আঁধারে স্টেশনে নিজের অজান্তেই একটি খুনের স্বাক্ষী থেকে যায় । খুনীদের সেটা নজর এড়ায় না । চন্দনকেও তারা মেরে ফেলতে যায় । চন্দনের কাকুতি মিনতিতে দয়াপরোবশ হয়ে তারা চন্দনের চোখ বেঁধে তাদের বসের কাছে নিয়ে যায় । চন্দনের কাছে তাদের পারিবারিক ঘটনা জেনে ও তার কোন পিছুটান নেই শুনে তিনি বস তাদের দলে ওকে ভিড়িয়ে নেন ; নাহলে খুনের ঘটনার স্বাক্ষী থাকার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড !
চন্দন আস্তে আস্তে হয়ে উঠে কুখ্যাত ডাকাত শমশের খান ।
(3)
ক'দিন আগেই বেলেঘাটার জনবহুল এলাকায় ব্যাঙ্ক ডাকাতির সূত্র ধরে প্রশাসন জানতে পারেন সেদিনের বিলাসবহুল ওই বাড়ির দুই ব্যক্তির খুনের সাথে ব্যাঙ্ক ডাকাতির সংযোগ রয়েছে । ব্যাঙ্কের গোপন সি.সি.ভি. টিভির মাধ্যমে সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে যে দুই ব্যক্তি খুন হয়েছেন তারা ওই ব্যাঙ্ক ডাকাতির তিন মূল মাথার দুই মাথা । মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা থাকলেও দুঁদে পুলিশ অফিসারদের মৃত দুই ব্যক্তির মুখের সাথে তাদের মিল খুঁজে পেতে একটুও অসুবিধা হয়না ! সাথে আর যে তিন চারজন ছিলো তাদের খুঁজতে খুঁজতেই প্রসাশনের কালঘাম ছুটে যায় ।
(4)
কর্তব্যনিষ্ঠ পুলিশ অফিসার তার সমস্ত রকম সোর্স কাজে লাগিয়ে জানতে পারেন ওই ব্যাঙ্ক ডাকাতির সাথে কুখ্যাত সমাজ বিরোধী শমসের খানের যোগসাজোগের কথা । সেদিন ব্যাঙ্ক ডাকাতির পর ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে প্রাসাদোপম ওই বাঙ্গলো বাড়িতে যার মালিক আমেরিকায় থাকেন ;বাড়িটি দেখভালের জন্য ওই মৃত এক ব্যক্তির নিকট বাড়ির চাবী ন্যস্ত থাকে । সমস্ত খবরাখবর নিয়ে বিশেষ সোর্সের মাধ্যমে খবর পেয়ে এস্প্লানেডের নামকরা বার থেকে শমসের খানকে গ্রেপ্তার করতে যেয়ে হতভম্ব হয়ে যান ! এ কাকে দেখছেন তিনি ? শমসের খান নামে পরিচিত কুখ্যাত সমাজ বিরোধী , খুন , রাহাজানি , ব্যাঙ্ক ডাকাতি , প্রশাষনের সন্ত্রাস , ধনীব্যক্তির রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়ার মূল ব্যক্তি -একদা মেধাবী ছাত্র , সকলের প্রিয় , ইঞ্জিনিয়রিং এ ফাস্ট ক্লাস পাওয়া তার দাদা চন্দন মজুমদার ? সামান্য অভিমান থেকে দাদার আজ এই চরম পরিনতি ? কিণ্তু কেন ? কি কারনে দাদা এই অন্ধকার পথ বেছে নিলো ? তবে কি বেকারত্বের জ্বালা ? কিণ্তু কিছুই জিগ্গাসা করতে সে পারলোনা ! পুলিশকে অ্যারেস্ট করার অর্ডার দিয়ে দাদার চোখ ভর্তি জলের দিক থেকে তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিলেন যাতে তার নিজের চোখের জল তার অতি প্রিয় দাদার চোখে ধরা পরে না যায় । তিনি ভালোভাবেই জানেন শমসের খান বা তার দাদার কি চরম শাস্তি হতে পারে । দু'জনের মনেই নানান প্রশ্ন ! কিণ্তু জিগ্গাসা করার অধিকার আজ আর কারও নেই কারন একজন আইনের রক্ষক আর একজন আইনের ভক্ষক !
গাড়ি ছুটলো থানার উদ্দেশ্য ।
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
(1)
পাঁচ ব্যাটারীর টর্চের আলোতে পুলিশ ইন্সপেক্টর বাইরের গেট , ঘরের বাইরে কোলাপ্সীবেল গেট ও সর্বশেষে ঘরে ঢোকার দরজার তালা একের পর এক ভাঙ্গার পরে চারজন পুলিশ কর্মীকে নিয়ে দোতলার বিশাল ড্রয়িংরুমের ভিতর এসে দাঁড়ালেন । অন্ধকার ঘরের লাইটের সুইচ পেতে তাদের বিশেষ বেগ পেতে হলোনা কারন পাঁচ ব্যাটারীর দু'দুটি টর্চ তাদের সাথে ছিলো । সন্ধ্যা তখন প্রায় হয় হয় । পাড়ার জনৈক ব্যক্তির ফোনে তাদের এখানে আসা । জনৈক ব্যক্তি পুলিসকে জানান, বাংলোসম বিশাল দোতলা বাড়ি থেকে কয়েকদিন ধরেই পঁচা দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে যা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে ! ঘরের ভিতর ঢুকেই প্রত্যেকেই নাকে রুমাল চাপা দেন । অগ্রহায়ণের শীতের সন্ধ্যা ;বেশ জাঁকিয়ে ঠান্ডাও পড়েছে । সকাল থেকেই কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়েছে প্রকৃতি । এই ঠান্ডার মাঝেও ওই বাড়ির বাইরে পুরুষ ও মহিলা গিজগিজ করছে । সকলের ভিতরই একটি চাপা ফিসফিসানি ! এখানে তো পারমান্যান্টলি কেউ থাকেনা ;মাঝে মাঝে রাতের দিকে লাইট জ্বলতে দেখা যায় ! কিণ্তু সেভাবে কাউকে কোনদিনও দেখা যায়নি । চারিদিকে উঁচু প্রাচীরে ঘেরা । সামনে অনেকটা জায়গা জুড়ে ফুলের বাগান । মাঝে মাঝে এক বৃদ্ধকে ওই বাড়িতে দেখা যায় বটে কিণ্তু সে নিজেকে ওই ফুল বাগানের মালি বলেই পরিচয় দেয় । বাড়ির বাইরেও বিশাল পুলিশ বাহিনী দাঁড়িয়ে ;যাতে করে কোন পাড়ার লোক ভিতরে ঢুকতে সাহস না পায় ।
ইন্সপেক্টর উত্তম মজুমদার ও তার সহকর্মীরা ঘরে ঢুকে আলো জ্বালিয়ে বিভৎস দৃশ্য দেখে কয়েক সেকেন্ড কেউই কথা বলতে পারেননি । সারাঘর রক্তে ভেসে গেছে যদিও সেই রক্ত এখন শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে । মধ্য বয়স্ক দুই ভদ্রলোক -একজন সোফার কাছে আর একজন বাথরুমের দরজার কাছে পরে আছেন । দুজনকেই ছুরিকাঘাত করে মারা হয়েছে । ঘরের মধ্যে ইতস্তত মদের বোতল , গ্লাস , নানান ধরনের খাবার দাবার ছড়ানো ছিটানো । বোঝায় যাচ্ছে মৃত দুই ব্যক্তির সাথে আরও এক বা একাধিক লোক ছিলো । যে বা যারা বচসার জেড়ে এদের দু'জনকে খুন করে সকলের অলক্ষ্যে এই বাড়ি থেকে ধীর স্থির ভাবেই বেরিয়ে গেছে । সমস্ত ঘর সার্চ করে সন্ধেহজনক কিছুই চোখে পরেনা কারও । বডি দুটিকে ময়না তদন্তের জন্য পাঠিয়ে বাড়িটা সিল করে ইন্সপেক্টর তার দলবল নিয়ে থানার উদ্দেশ্যে রওনা দেন ।
(2)
ছোটবেলা থেকেই চন্দন পড়াশুনায় খুব ভালো । প্রতি বছরই সে প্রথম হয়ে উপরের ক্লাসে ওঠে । স্কুলের শিক্ষকেরা প্রত্যেকেই চন্দন সম্পর্কে উচ্চ ধারনা পোষণ করেন ও তার উজ্জ্বল ভবিষৎ চোখের সম্মুখে দেখতে পান । মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক সে 90% নম্বর নিয়ে পাশ করে বাবার ইচ্ছা অনুযায়ী ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হয় । কিণ্তু উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে সে রেলের চাকরীর পরীক্ষা দিয়ে রেলে চাকরী পেলেও তার বাবা তাকে ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হতে বলেন । বাধ্য চন্দন বাবার ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দেয় । ফলে তার জীবনে স্বইচ্ছায় লক্ষ্মী এসে ধরা দিলেও ভাগ্যের পরিহাসে তাকে তা খোয়াতে হোলো । তিন ভাই বোনের বড় চন্দন । বড় ছেলের উজ্জ্বল ভবিষৎ বাবাও কল্পনা করেছিলেন । ছোট ছেলে ও মেজ মেয়েটি পড়াশুনায় ছিলো মোটামুটি । হুগলির প্রত্যন্ত গ্রামে সামান্য যা কিছু জমিজমা ছিলো তিনি সকলের অজান্তেই ছোট ছেলের নামে উইল করে রাখেন । তার ধারনা অনুযায়ী চন্দন পাশ করে বেরিয়েই চাকরী পাবে আর তখন সে গ্রামে থাকবেও না ;নিজেরটা নিজে চালিয়ে নিতে পারবে । তাই অপেক্ষাকৃত দুর্বল ছোট ছেলেকেই তিনি তার সম্পত্তির পুরোটা লিখে দেন । যেহেতু সরকারী খরচে চন্দন পড়াশুনা করতো তাই তাকে নিয়ে তার বাবার কোন চিন্তা ছিলোনা । টুকটাক হাত খরচ সে টিউশনি করেই জোগাড় করতো । চন্দনের ইঞ্জিনিয়ারিং এ যখন তৃতীয়বর্ষ তখন তার বোন চারুলতার বেশ অবস্থাপন্ন ঘরেই বিবাহ হয়ে যায় । চন্দনের স্কুল শিক্ষক বাবা মেয়ের বিয়ের ঠিক এক বছরের মধ্যেই মারা যান । চন্দন ভালভাবে ইঞ্জিনিয়ারিং এ পাশ করে চাকরীর জন্য হন্যে হয়ে ইন্টারভিউ দিয়ে যেতে লাগলো । কিণ্তু কোথায় চাকরী ? চাকরীর চাবীতো সব নেতাদের হাতে ! সরকারী থেকে বেসরকারী ! গ্রামের ছেলে চন্দনের তো কিছু ভালো সর্টিফিকেট ছাড়া আর কিছুই নেই । তাই চাকরীও তার মেলেনা । সাথে আলোচনা করে ঠিক করে ভায়ের মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলেই গ্রামের জমিজমা বিক্রি করে তারা কলকাতায় ছোটখাটো একটা ভাড়া বাড়িতে এসে উঠবে । ভাইকে কলকাতার কলেজেই ভর্তি করবে ;নিত্য সে প্রাইভেট কোম্পানীগুলিতে চাকরীর চেষ্টা করার সাথে সাথে কিছু টিউশনি করতেও পারবে । মাকে দিয়ে বাড়ির দলিল বের করিয়ে উইল দেখে সে হতভম্ব ! বাবা তাকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেছেন ! কিণ্তু কেনো ? কি তার অপরাধ ছিলো ? বাবা কেনো এটা করলেন ?
ভয়ানক অভিমান থেকে চন্দন পরদিন সকালেই মা , ভাইকে কিচ্ছুটি না জানিয়েই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পরে । সে কলকাতা শহরে নানান জায়গায় চাকরীর চেষ্টা করতে লাগে । বলা বাহুল্য তার এই মনের ইচ্ছা পূরণ হয়না । একদিন রাতের আঁধারে স্টেশনে নিজের অজান্তেই একটি খুনের স্বাক্ষী থেকে যায় । খুনীদের সেটা নজর এড়ায় না । চন্দনকেও তারা মেরে ফেলতে যায় । চন্দনের কাকুতি মিনতিতে দয়াপরোবশ হয়ে তারা চন্দনের চোখ বেঁধে তাদের বসের কাছে নিয়ে যায় । চন্দনের কাছে তাদের পারিবারিক ঘটনা জেনে ও তার কোন পিছুটান নেই শুনে তিনি বস তাদের দলে ওকে ভিড়িয়ে নেন ; নাহলে খুনের ঘটনার স্বাক্ষী থাকার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড !
চন্দন আস্তে আস্তে হয়ে উঠে কুখ্যাত ডাকাত শমশের খান ।
(3)
ক'দিন আগেই বেলেঘাটার জনবহুল এলাকায় ব্যাঙ্ক ডাকাতির সূত্র ধরে প্রশাসন জানতে পারেন সেদিনের বিলাসবহুল ওই বাড়ির দুই ব্যক্তির খুনের সাথে ব্যাঙ্ক ডাকাতির সংযোগ রয়েছে । ব্যাঙ্কের গোপন সি.সি.ভি. টিভির মাধ্যমে সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে যে দুই ব্যক্তি খুন হয়েছেন তারা ওই ব্যাঙ্ক ডাকাতির তিন মূল মাথার দুই মাথা । মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা থাকলেও দুঁদে পুলিশ অফিসারদের মৃত দুই ব্যক্তির মুখের সাথে তাদের মিল খুঁজে পেতে একটুও অসুবিধা হয়না ! সাথে আর যে তিন চারজন ছিলো তাদের খুঁজতে খুঁজতেই প্রসাশনের কালঘাম ছুটে যায় ।
(4)
কর্তব্যনিষ্ঠ পুলিশ অফিসার তার সমস্ত রকম সোর্স কাজে লাগিয়ে জানতে পারেন ওই ব্যাঙ্ক ডাকাতির সাথে কুখ্যাত সমাজ বিরোধী শমসের খানের যোগসাজোগের কথা । সেদিন ব্যাঙ্ক ডাকাতির পর ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে প্রাসাদোপম ওই বাঙ্গলো বাড়িতে যার মালিক আমেরিকায় থাকেন ;বাড়িটি দেখভালের জন্য ওই মৃত এক ব্যক্তির নিকট বাড়ির চাবী ন্যস্ত থাকে । সমস্ত খবরাখবর নিয়ে বিশেষ সোর্সের মাধ্যমে খবর পেয়ে এস্প্লানেডের নামকরা বার থেকে শমসের খানকে গ্রেপ্তার করতে যেয়ে হতভম্ব হয়ে যান ! এ কাকে দেখছেন তিনি ? শমসের খান নামে পরিচিত কুখ্যাত সমাজ বিরোধী , খুন , রাহাজানি , ব্যাঙ্ক ডাকাতি , প্রশাষনের সন্ত্রাস , ধনীব্যক্তির রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়ার মূল ব্যক্তি -একদা মেধাবী ছাত্র , সকলের প্রিয় , ইঞ্জিনিয়রিং এ ফাস্ট ক্লাস পাওয়া তার দাদা চন্দন মজুমদার ? সামান্য অভিমান থেকে দাদার আজ এই চরম পরিনতি ? কিণ্তু কেন ? কি কারনে দাদা এই অন্ধকার পথ বেছে নিলো ? তবে কি বেকারত্বের জ্বালা ? কিণ্তু কিছুই জিগ্গাসা করতে সে পারলোনা ! পুলিশকে অ্যারেস্ট করার অর্ডার দিয়ে দাদার চোখ ভর্তি জলের দিক থেকে তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিলেন যাতে তার নিজের চোখের জল তার অতি প্রিয় দাদার চোখে ধরা পরে না যায় । তিনি ভালোভাবেই জানেন শমসের খান বা তার দাদার কি চরম শাস্তি হতে পারে । দু'জনের মনেই নানান প্রশ্ন ! কিণ্তু জিগ্গাসা করার অধিকার আজ আর কারও নেই কারন একজন আইনের রক্ষক আর একজন আইনের ভক্ষক !
গাড়ি ছুটলো থানার উদ্দেশ্য ।
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
No comments:
Post a Comment