#আধুনিকা নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী আজকের সমাজের সাথে তাল মেলাতে গেলে মা ,ঠাকুমার ধ্যান,ধারণাগুলিকে বিসর্জন দিয়ে চলতে হয় | আজকের যুগের ছেলেমেয়েদের কাছে ওগুলো কুসংস্কার নামকরণে ভূষিত | কিন্তু তাদের কিছু ধ্যান ,ধারণা সুজাতার কাছে কুসংস্কার মনে হলেও পারতঃপক্ষে সুজাতা তাদের সামনে সেগুলিকে মেনে চলতো | বাবাহারা এম .এ . করা শিক্ষিত ,সুন্দরী ,আধুনিকা সুজাতার এই বিশাল পৃথিবীতে মা আর ঠাকুমা ছাড়া আর কেউ নেই |অতি আধুনিকা হওয়া সত্বেও মা ,ঠাকুমার সামনে তাদের সংস্কারকে সে মেনেই চলতো | তারা মনে আঘাত পান এমন কোনো কাজই সে করতো না | কারণ তাদেরও যে সে ছাড়া আর কেউ নেই | কিন্তু বাইরে তার অন্যরূপ | আজীবন কো .এডে .পড়া সুজাতা অনেক ছেলের সংস্পর্শে এসেছে | সুতরাং অসভ্য ,অভব্য ছেলেদের কিভাবে শায়েস্তা করতে হয় এটা তার নখদর্পনে | প্রফেসর সুজাতাকে সহকর্মী এবং ছাত্রছাত্রীরা রাগী বলেই জানে | ক্লাস ছাড়া অফিসরুমে অধিকাংশ সময়ে বই এ মুখ গুজেই থাকে | মহিলা সহকর্মীদের মধ্যে অনেকে আবার অহংকারীও বলে থাকেন | তাতে অবশ্য সুজাতার কিছু যায় আসেনা | এককান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দেয় | শুধু একটা ব্যাপারেই সে আলোচনায় অংশগ্রহণ করে -আর সেটা হচ্ছে কুসংস্কার | সহকর্মীদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা এতো লেখাপড়া শিখেও কুসংস্কার আচ্ছন্ন | তখন সে তার যুক্তিতর্ক দিয়ে বুঝিয়ে দেয় ,বহুদিন ধরে চলে আসা এটা একটা 'মিথ' | সে তাদের বোঝাতে সক্ষম হয় -প্রতিটা দেশেই সংস্কার আছে এটা ভালো ,কিন্তু কুসংস্কার দেশ ,জাতী ও ব্যক্তির পক্ষে ক্ষতিকর | তারমধ্যেও কিছু সংস্কার আছে যেগুলি বাড়াবাড়ির পর্যায়ে নিয়ে গেলে জীবনযাত্রার পক্ষে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় | সেই সংস্কারও কুসংস্কারের নামান্তর | এসব যুক্তিতর্ক শুনেসুজাতার আড়ালে আবডালে অনেকেই বলাবলি করে সব কিছুতেই সে স্রোতের প্রতিকূলে সাঁতার কাটে | সুজাতার ঠাকুমার মৃত্যুর পর তার সহকর্মীরা ঠাকুমার শ্রাদ্ধবাসরে এসে পুরোহিতের সকল কথা নিষ্ঠাভরে পালন করতে দেখে তাদের বিস্ফোরিত নেত্র তার নেত্রঅগোচর থাকেনা | তাই পরবর্তীকালে সে কলেজে এসে তার কারণও ব্যাখ্যা করে তাদের কাছে | যতই সে লেখাপড়া শিখুকনা কেন ,যতই সে আধুনিক হোকনা কেন - কোনো অবস্থাতেই মায়ের ধ্যান ,ধারণাকে অগ্রাহ্য করে তাঁকে সে আঘাত দিতে পারেনা | চলনে ,বলনে সে যতই আধুনিক হোকনা কেন কিছু পুরানো লোকাচার আর বাঙালি সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিয়ে নয় | বেশ কয়েক বছর পর --------------------------- এহেন সুজাতার জীবনেও প্রেম আসে | তারই সহকর্মী সুবিনয়কে দেখে তার খুব ভালো লাগে কিংবা ভালোবেসেও ফেলে | সুবিনয় নারী স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলতে বলতে একদিন তাকে বলেছিলো ,"আজকের সমাজে মেয়েরা আধুনিকা হতে যেয়ে ভুলে যাচ্ছে লাজলজ্জা - আধুনিকা হতে চাইছে তারা পোশাকে ; মন ও মানষিকতায় নয় - ভুলে যাচ্ছে বাঙ্গালী ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি | আধুনিকা হতে যেয়ে হয়ে পড়ছে স্বেচ্ছাচারী | ধুমপান ,মদ আর পুরুষ বন্ধুর সাথে হৈহৈ করে বেড়ানোটাই আধুনিকতা নয় | "কথাগুলি সুজাতার মনকে নাড়িয়ে দিয়েছিলো | বছর খানেকের মধ্যেই দুজনের মন দেওয়া নেওয়ার ঘটনাটা জানাজানি হয়ে যায় |আঁড়ালে আবডালে এনিয়ে কানাঘুষোও চলে | মা গত হয়েছেন সুজাতার বছর দু'য়েক হবে | সুতরাং এখন বিয়েটা করে ফেললে এই কানাঘুষোটা বন্ধ হবে | কথাহয় এখান থেকে অন্যত্র বদলী হয়ে তারা মন্দিরে বিয়েটা সারবে | দু'জনেই বদলীর চেষ্টা করতে থাকে | কিন্তু আগে সুজাতার অর্ডার লেটারটা আসে | কোয়াটারও পেয়ে যায় | সুজাতা জামশেদপুর চলে যায় | মাস দুয়েকের মধ্যে সুবিনয়ও বদলীর চিঠি পেয়ে যায় | তারা ঠিক করে কালীঘাট মন্দিরেই বিয়েটা সারবে | ছেলেবেলায় মা ,বাবাকে হারিয়ে ঠাকুমার কাছেই মানুষ সে | সেই ঠাকুমাও বেশ কয়েক বছর হলো তাকে ছেড়ে চলে গেছেন | বিয়ের আগেরদিন সুবিনয় সুজাতার কাছে চলে যায় ;পরদিন তাকে নিয়ে কালীঘাট মন্দিরে আসার জন্য | কলকাতা আসার জন্য সুজাতা একটা গাড়ি ভাড়া করে | অনেক রাত অবধি তারা গল্পগুজব ও ভবিৎসৎ পরিকল্পনায় তারা হাওয়ায় ভাসতে থাকে | কেউই ঘুমায় না বললেই হয় | খুব ভোরেই তারা বেড়িয়ে পরে | কিন্তু অকস্যাৎ আসে সেই দুর্যোগ মুহুর্ত | ভোরের রাস্তায় লড়ির সাথে তাদের গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্স | ঘটনাস্থলেই সুবিনয়ের মৃত্যু | সুজাতার সামান্য চোট | ভেঙ্গে যায় জীবনের সব স্বপ্ন | অসহায় ,পাগলিনী প্রায় সুজাতা অব্যক্ত যন্ত্রনায় নিজেকে মাসখানেক ঘরবন্দি করে রাখে | পনেরদিন তার ছুটি নেওয়াই ছিলো - আরও পনেরদিন সে ছুটি বাড়ায় | এরই মাঝে খাবারের প্রতি অনীহা ,দুর্বল লাগা ,মাঝেমাঝে মাথা ঘুরানো - সুজাতার বুঝতে বাকী থাকেনা তার জীবনে কি ঘটতে চলেছে | সে প্রেগন্যান্সি প্লেট এনে জানতে পারে তার আশঙ্খায় সত্যি ,সে মা হতে চলেছে | সুবিনয় চলে যাওয়ার আগের রাতে প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী দু'টি নরনারী তাদের ভালোবাসায় এক ও অভিন্ন হয়ে গেছিলো |কিন্তু সুজাতা তার অনাগত সন্তানকে ভ্রূনেই হত্যা করতে পারেনি | ঈশ্বরের দূত হিসাবে তার বেঁচে থাকার রসদ মনেকরে তার গর্ভেই তিলতিল করে বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দেয় | আধুনিকা সুজাতার থেকে অনাগত সন্তানের মা সুজাতা হয়ে ওঠে সে | এখানে সেই সংস্কার ,কুসংস্কার ,শিক্ষাদীক্ষা ,আধুনিক মনস্কতা - সবকিছুই চাপা পরে যায় তার মাতৃত্বের স্বাদ গ্রহণের কাছে |
নন্দা 1.1.17
নন্দা 1.1.17
No comments:
Post a Comment