অপত্য স্নেহ----- নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
শ্বাশুড়ীর মৃত্যুর পর থেকেই সকলেই একটু ভয়ে ভয়ে থাকে | প্রত্যেকেই বলে ,মা মারা যাওয়ার পর থেকেই সন্ধ্যার পরে গাটা কেমন ভার হয়ে থাকে | কিন্তু ব্যতিক্রম শুধু রৌনক | দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়ে | ঠাকুমার আদরের নাতী | ঠাকুমার ঘরেই দুটি খাট পাতানো ছিলো | একটিতে রৌনক শুতো অন্যটিতে সুহাসিনীদেবী | পড়ার টেবিলটায় রৌনকের ছিলো ঠাকুমার ঘরে | নাতী ,ঠাকুমার ভালোবাসাটা ছিলো অত্যন্ত গাঢ় | কিন্তু সুহাসিনীদেবীর দুই ছেলে পারতপক্ষে মায়ের ঘরে যেতনা বললেই হয় | কারণ পারিবারিক ব্যবসা নিয়ে তারা খুব ব্যস্ত থাকতো | রাতে ক্লান্ত হয়ে যখন তারা ঘরে ফিরতেন তখন অসুস্থ্য মা যেতেন ঘুমিয়ে | ছেলে রৌনক সে ঘরে টেবিল ল্যাম্পের আলোতে পড়াশুনা করতো | মায়ের ঘুম আর ছেলের পড়াশুনার ব্যঘাত হবে ভেবে কেউ মায়ের ঘরে অধিকাংশ দিন আর ঢুকতেন না | বড় ছেলে দেবাংশু বিয়ে করেননি | এখন আর বিয়ের বয়সও তার নেই | ছোটছেলে সীতাংশুর ওই একটিমাত্র সন্তান | বাড়ির সকলের চোখেরমনি । ঠাকুমাকে সে নিজের প্রাণের থেকেও হয়ত একটু বেশী ভালোবাসে । রৌনকের মা অনুভাদেবী খুব একটা সুবিধার মানুষ নন । রৌনক বাড়িতে থাকাকালীপ সময়ে তিনি পঞ্চব্যঞ্জনে তিনবেলা ঠিক সময় করেই শ্বাশুড়ীর খাবার দোতলায় যেয়ে দিয়ে আসতেন । কারন যতক্ষন না ঠাকুমার খাওয়া হবে ততক্ষন পর্যন্ত সে কিচ্ছুটি খাবেনা । কিন্তু রৌনক বাড়িতে না থাকলে সেই খাবার দেবার সময় ঘন্টা দু'য়েক সামনের দিকে এগিয়ে যেত ।যেমন সকালের খাবার দুপুর বারোটাই দুধ,মুড়ি ;নামেই দুধ জলের পরিমানটা বেশী আবার দুপুরের খাবার বিকাল চারটেই , কোনোদিন ঘি, আলুসিদ্ধ আবার কোনোদিন ডাল,আলুসিদ্ধ । এ ভাবেই চলতো । কিন্তু সুহাষিনীদেবী কখনোই কারও কাছে কোনোদিনও কোনো অভিযোগ করতেন না।ভিতরে ভিতরে তিনি খুব কষ্ট পেতেন । এভাবই দিন এগিয়ে যেতে থাকে । কখনো কখনো অনুভাদেবী কারনে অকারনে শ্বাশুড়ীর উপর চড়াও হতেন রৌনকের অনুপস্থিতে ।তারও অবশ্য একটা কারন ছিলো । আর সেটা হল - বড় এক বাক্স গয়না ছিলো সুহাষিনীদেবীর । কিনতু অনুভাদেবী জানতেন না ,ঐ গয়না বাক্সের অধিকাংশ গয়নাই তিনি তার ছোটবোন আশারানীর মেয়ের বিয়েতেই দিয়ে দিয়েছেন ; পুত্রবধূটির উপর রাগ করেই ।একটি বেশ মোটা মাছের কাঁটার চেন পেয়েছেন সুহাষিনীদেবীর মৃত্যুর পর তার বালিশের তলায় একটি কাগজ জড়ানো । কাগজটাই লেখা ,"এটা রৌনকের বৌয়ের ।"সুহাষিনীদেবীর মৃত্যুর চারদিনের মাথায় সন্ধ্যায় যখন সকলে ঘরে বসে চা খাচ্ছে ঠিক তখনই সকলে শুনতে পারলো রান্নাঘরে বাসন পড়ার ঝন্ঝন্ আওয়াজ । অনুভাদেবী একা সাহষ পেলেন না ,তিনি স্বামীকে নিয়েই রান্নাঘরে গেলেন । যেয়ে দেখলেন সবই তো ঠিক আছে , তবে সবাই কিসের আওয়াজ পেলেন ? ভাবতে ভাবতেই বেড়িয়ে আসতে যাবেন ঠিক তখনই উপরের ব্যাঙ্কার থেকে একটা বড় হাঁড়ি অনুভাদেবীর মাথায় দুম করে এসে পড়লো ।'আহ্হ্ '- বলে চিৎকার করে তিনি স্বামীকে জড়িয়ে ধরলেন । হাঁড়িটা পরে এমনভাবে কেঁটে গেলো যে দুটি সেলাই পড়লো । সেদিনের মত ঘটনা ওখানেই শেষ হলো ।দু'দিন বাদে তিনি যখন বাথরুম থেকে স্নান সেরে বেড়োতে যাবেনহঠ্যাৎ তার মনে হল কেউ যেন ধাক্কা মেরে তাকে ফেলে দিলো | "কে রে ?"- বলেই পিছন ঘুরে দেখেন কেউ না | কোমড় এবং পায়ে প্রচন্ড আঘাত পেলেন | আবার তার আর বুঝতে বাকি থাকলো না ,এটা তার মৃত শ্বাশুড়ির কর্মকান্ড | ভয়ে একদম সিঁটিয়ে গেলেন |
শ্রাদ্ধের দিনতিনেক আগে সব কাচাকুচির পর সেগুলি শুকালে সন্ধ্যার দিকে জামাকাপড়গুলি গুছিয়ে পাটপাট করে তাদের খাটের একদিকে রেখে রান্নাঘরে গেলেন চা করতে | হঠ্যাৎ তার মনে হল তাদের শোবার ঘরের দিক থেকে একটা পোড়া গন্ধ বেড়োচ্ছে | ঢিম লাইটটা জ্বালানোই ছিলো ,কিন্তু যেয়ে দেখলেন ঘরের লাইট বন্ধ এবং ধোঁয়াটা খাটের উপর থেকেই আসছে | চিৎকার ,চেঁচামেচিতে পাড়াপ্রতিবেশীরা ছুটে আসলো | কিন্তু আগুন লাগার কারণ কেউই বুঝতে পারেনা | হঠ্যাৎ করেই আবিষ্কার হয় ঢিম লাইটটাই ফেটে দেওয়ালের কিছুটা অংশ কালো হয়ে আছে | খাটের উপর যত কাপড়চোপড় ভাঁজ করা ছিলো সবই প্রায় পুড়ে গেছে কিন্তু অদ্ভুতভাবে রৌনকের জামাপ্যান্টগুলি মেঝেতে ভাঁজ করা অবস্থাতেই অক্ষতভাবে গড়াগড়ি খাচ্ছে |
সকলের আলোচনা শুনেই রৌনকও এবার বুঝতে পারে এটা তার ঠাকুমারই কাজ | সে সকলের অলক্ষে নিঃশব্দে উপরে উঠে যেয়ে ঠাকুমার খাঁটের উপরে যেয়ে বসে | ঠাকুমার ছবিটার দিকে একদৃষ্টে তাঁকিয়ে থেকে বলতে থাকে ," ঠাকুমা ,আমি জানি মা তোমাকে খুব কষ্ট দিয়েছেন | কিন্তু তিনি তো আমার মা | আমি যেমন তোমায় খুব ভালোবাসতাম ,এখান ও বাসি ,মাকেও তো আমি খুব ভালোবাসি | মা কষ্ট পেলে আমি যে খুব কষ্ট পাই ঠাকুমা ! তুমি তো আমায় খুব ভালোবাসতে ,আমি কষ্ট পেলে তোমার ও তো খুব কষ্ট হত | তবে এখন কেন আমার কষ্টটা তুমি বুঝতে পারছোনা ?" হঠ্যাৎ রৌনকের মনে হল তার মাথায় কেউ হাত রাখলো |
রৌনককে নীচুতে দেখতে না পেয়ে সকলে ছুটতে ছুটতে উপরে এসে সুহাসিনীদেবীর ঘরে ঢুকে দেখে রৌনক জ্ঞান হারিয়ে খাঁটের উপর পরে আছে | মাথায় এমনভাবে বালিশ রয়েছে যে দেখে মনে হচ্ছে সে ঘুমাচ্ছে | কিছুক্ষনের চেষ্টায় রৌনকের জ্ঞান ফিরে আসে | কিন্তু ঘটনাটা সে বাড়ির সকলের কাছেই লুকিয়ে যায় | তারপর থেকেই সুহাসিনীদেবীর আত্মার আর কোনো অস্তিত্ব কেউ টের পাইনি | সকলের নিষেধ স্বর্তেও রৌনক তার ঠাকুমার ঘরেই থাকতো | ঠিক এক বছরের মাথায় একটু বেশী বয়সেই রৌনকের একটা সুন্দর ফুটফুটে বোন তার মায়ের কোল আলো করে আসে | আর কেউ না জানুক রৌনক জানে এ তার ঠাকুমা | কারণ তিনি সেদিন রাতে তার মাথায় হাত রেখে এমন কথায় রৌনককে শুনিয়েছিলেন | রৌনক আদর করে বোনের নাম রাখে - "শোভা"- |
9.12.16
No comments:
Post a Comment