Sunday, January 31, 2021

অন্ধ ভালোবাসা

অন্ধ ভালোবাসা

  মাত্র পাঁচ বছর বয়সে দশ বছরের চাচাতো ভাই ফারুকের সাথে নার্গিসের বিয়ে হয়। ছোটবেলার থেকেই নার্গিস ছিল অসম্ভব সুন্দর দেখতে।নার্গিস ও ফারুক এর মধ্যে বন্ধুত্ব দেখে দুজনেরই বাবা-মা এই সিদ্ধান্ত নেন।আস্তে আস্তে তারা বড় হতে থাকে আর বন্ধুত্ব ভালবাসায় পরিনত হতে থাকে। নার্গিসের বয়স যখন চৌদ্দ বছর তখন তার দাদুর মৃত্যু হলে শুরু হয় নার্গিসের বাবা আর ফারুকের বাবার মধ্যে সম্পত্তিগত বিবাদ। এই বিবাদ এমন পর্যায়ে পৌঁছায় দুই ভাইয়ের মধ্যে মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়।বাড়ির ভিতরে বাঁশের বেড়া দিয়ে দেওয়া হয়।উভয়ের বাবা-মা নিজেদের ছেলেমেয়েদের কে নিষেধ করে দেন কেউ কারো সাথে যেন কথা না বলে।দুটি কিশোর-কিশোরী যারা ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছে তাদের বিয়ে হয়ে গেছে;তারা তাদের সদ্য ফোটা প্রেমের কুড়িকে মেরে ফেলতে পারল না। শুরু হলো বাইরে দেখাশোনা,মেলামেশা।
    এভাবেই কেটে গেল বেশ কয়েক বছর।স্কুল-কলেজ জীবন শেষ করে উভয়েই চেষ্টা করতে লাগলো চাকরির। নার্গিসের বিয়ের জন্য বাড়ির লোক উঠেপড়ে লাগলো। নার্গিস কিন্তু নিশ্চুপ।হঠাৎ করেই নার্গিস স্কুলে চাকরি পেয়ে যায়।আর তখন সে রুখে দাঁড়ায় তার বিয়ের বিরুদ্ধে। শুরু হয় বাড়িতে প্রচন্ড ঝামেলা।সে গোপনে ফারুকের সাথে দেখা করে ঠিক করে পালিয়ে যাবে।
  একদিন স্কুলে গিয়ে নার্গিস আর বাড়ি ফিরে আসেনা।সে ফারুকের সাথে সংসার পাতে। বিয়েটা তাদের ছেলেবেলায় হয়ে গেছিল মুরুব্বিদের সামনে।সুতরাং সংসার করতে বাধা কোথায়? ফারুক ও ছোটখাটো একটা কোম্পানিতে কাজ জুটিয়ে নেয়।ঘর ভাড়া দিয়ে সংসার চালনা করা দুজনের আয়ে তাদের বেশ ভালোই চলে যায়।তাদের দিনগুলি সুখে-আনন্দে বেশ কাটছিল।কিন্তু 'ভাগ্যের লিখন না যায় খন্ডন' বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত ফারুক হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে।তার ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়ে।রোগ ধরা পড়ার ছয় মাসের মত ফারুক বেঁচে ছিল।ব্যয়বহুল এই চিকিৎসা বেশিদিন চালিয়ে যেতে পারেনা নার্গিস।সুতরাং অকালেই ঝরে যায় ভালবাসার পাঁপড়ি।শুরু হয় নার্গিসের জীবন সংগ্রাম।নিজেদের ইচ্ছামত যারা তাদের বিয়ে দিয়েছিল আর তাদেরই ইচ্ছামত যারা তাদের এক হওয়ার পথে বাঁধা দিয়েছিল সেই বাড়িতে সে কিছুতেই ফিরবে না।ছেলেবেলা থেকেই খুব সুন্দর সে কথা আগেই বলেছি।অসম্ভব বুদ্ধিমতীও ছিল সে।তার এই একলা চলার জীবনে বলতে গেলে প্রায় প্রতি মুহূর্তেই কামার্ত পুরুষের নজরে পড়েছে আর ঠিক সেই কারণেই  বিপদ তার পিছু ছাড়েনি।কিন্তু সে তার স্বভাবগত বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েই সমস্ত বিপদ থেকে মুক্ত হয়েছে।ছেলেবেলা থেকে ফারুককে ভালোবেসে তার  ভালোবাসার ছোঁয়া পেয়ে,সম্পূর্ণভাবে কাছাকাছি হয়ে তার জায়গায় অন্য কাউকেই সে কল্পনাও করতে পারে না। আড়াই 'বছরের মধ্যেই তাঁর জীবনের সব রং মুছে যায়।ফারুকের সাথে সংসার পাতার শেষ ছমাস তো  ফারুক অসুস্থই ছিল। ফারুকের জায়গায় নার্গিস স্বপ্নেও ভাবতে পারেনা অন্য কোনো পুরুষকে।তাই সে একাকী নিঃসঙ্গ জীবনই বেছে নেয়।
  ফারুককে হারানোর বেশ কয়েক বছর পরেই সে একটি শিশুকন্যা দত্তক নেয় আইনের সমস্ত জটিলতা কাটিয়ে। প্রথম অবস্থায় খুব একটা সহজে এ কাজটা হয়নি।তার জন্য তাকে অনেক দৌড়াদৌড়ি ছুটাছুটি করতে হয়েছে।মেয়েকে দেখাশোনা করার জন্য সে সর্বক্ষণের জন্য একজন আয়া রেখেছে প্রথম থেকেই।সে ভোর সাড়ে ছটায় স্কুলে বেরিয়ে সাড়ে এগারোটার মধ্যেই বাড়ি ফিরে আসে। আয়া সর্বক্ষণ থাকলেও বাড়িতে ফিরে আসার পর সে তার মেয়ের যাবতীয় কাজকর্ম নিজের হাতেই করে।
  আস্তে আস্তে ঘড়ির কাঁটার টিকটিক আওয়াজে সাথে সাথে নার্গিসের মেয়ে পপির সাথে তার জীবনের দিন,মাস,বছর গুলি এগিয়ে যেতে থাকে।অসম্ভব মেধাবী মেয়ে পপি। সরকারি খরচে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেয়ে যায় সে।মা অন্তপ্রাণ!মায়ের অনুমতি ছাড়া কোন কাজই সে করতেই যেন পারে না।
 নার্গিস তার শিক্ষাকতা জীবন থেকে অবসর নিয়েছে এখন। একা থাকলেই একাকীত্ব তাকে ঘিরে ধরে।চোখে হারায় সে তার মেয়েকে।তাই পপি যখন ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেয়ে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হয় তখন নার্গিস তার ভাড়া বাড়ি ছেড়ে দিয়ে মেয়ের সাথে মেয়ের কলেজ যাওয়ার সুবিধা হয় এমন জায়গায় বাসা ভাড়া করে মা,মেয়ে তাদের নতুন সংসার গুছিয়ে নেয়।কলকাতা শহরের এই নতুন পরিবেশে নিজেদের মানিয়ে নেওয়ার সংগ্রাম শুরু করে।
 সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি বদ্ধ ঘরের ভিতরে নার্গিসের একাকীত্ব যেন চারিপাশ থেকে তাকে গ্রাস করতে থাকে।ঠিক সন্ধ্যায় পপি যখন ফিরে আসে তখন তাকে সামনে দেখে নার্গিসের মুখে সারা দিনের জমানো কথা এক এক করে খই ফোটার মত বের হতে থাকে।সে যেন তখন পপির মেয়ে হয়ে ওঠে আর পপি তার মা।
 এইভাবে আরও বেশ কয়েকটা বছর কেটে যায়। পপি ওরফে পারভিন আক্তার একজন নামকরা ডক্টর এখন। সরকারি হাসপাতাল পোস্টিং।দিনরাত কখন যে তাকে ছুটে যেতে হয় তা সে নিজেও জানে না।এ নিয়ে অনেক মান অভিমান মা-মেয়ের মধ্যে চলে। বেশ কয়েকটা দিন ধরে পপি একজন রোগীকে নিয়ে নাকানি-চুবানি খাচ্ছে।তিনি এক্সিডেন্ট করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।নিজের নামটা  আর গ্রামের নাম নামটাই শুধু বলছে বলতে পারছেন।আর কিছুই তিনি মনে করতে পারছেন না। তিনি এখন সুস্থ হওয়ার পথে।নিয়ম অনুযায়ী সরকারি হাসপাতালে সুস্থ হয়ে গেলে সরকারি বেড দখল করে থাকা যায় না।পুলিশকে জানানো হয়েছে তারাও শুধুমাত্র ওই গ্রামের নাম শুনে কিছুই আন্দাজ করতে পারছেন না।কিন্তু চেষ্টারও ত্রুটি তারা করছেন না।এই ঘটনাটা বাড়ি ফিরে পপি আজ মায়ের কাছে করে। মা তার কাছে জানতে চান,
--- কি নাম ভদ্রলোকের?
---সহিদুল ইসলাম,বাড়ি খাদদুয়ার ।
নার্গিস পপিকে বলে,
--উনি আমার বাবা । তুই ওনাকে এখানেই নিয়ে আসিস। বাকি সব কথা তোকে আমি পরে বলবো।
  পপি স্মৃতিভ্রংশ দাদা সাহেবকে নিয়ে একদিন বাড়িতে আসে। কারও সাথে খুব একটা কথা বলেন না সকলের চোখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন।নার্গিস অনেক চেষ্টা করে যাতে তাকে সে চিনতে পারেন।কিন্তু শহিদুল সাহেব কিছুই মনে করতে পারেন না।নার্গিস দিনরাত তার সেবাযত্ন করতে থাকেন।তার একটু আধটু কথা যা সবই পপির সাথে।
  পপি একদিন হাসপাতালে,নার্গিস ঘরের কাজে ব্যস্ত।এই সময়ে সহিদুল সাহেব দরজা খোলা পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যান।অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে পাওয়া যায় না।।পপি সারাটাদিন গাড়ি নিয়ে পুরো কলকাতা শহর চষে বেড়ায়। রাত তখন দশটা হবে। পপি গাড়ি নিয়ে তার দাদা সাহেবকে  খুঁজে বেড়াচ্ছে।হঠাৎ সে একটি জটলা দেখে গাড়ি রেখে সেদিকে এগিয়ে যায়। পপি এগিয়ে গিয়ে দেখতে পায় তার দাদাসাহেব পুনরায় এক্সিডেন্ট করে রাস্তার উপর পড়ে আছেন রক্তে চারিদিক ভেসে যাচ্ছে আর পাবলিক কৌতূহলবশত সেখানে দাঁড়িয়ে সব কিছু দেখছ ঠিকই কিন্তু কেউই তৎপর হচ্ছে না তাকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার। পপি এগিয়ে গিয়ে দাদা সাহেবের মাথাটা নিজের কোলের উপর তুলে নিয়ে জনতার উদ্দেশ্যে বলে তাকে একটু সাহায্য করার জন্য ;যাতে সে বয়স্ক লোকটাকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে পারে।কিন্তু শহিদুল সাহেব পপির একটা হাত ধরে বলেন তিনি আর বাঁচতে চান না।তার একমাত্র মেয়ে নার্গিস তাকে না বলে অনেক বছর আগে কোথায় চলে গেছে তা তিনি জানেন না।আর তাকে খোঁজার জন্য তিনি বহুদিন ধরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন।এক বাড়িতে তাকে কিছু দিন আটকে রেখেছিল।নার্গিসের মতো দেখতে একটি মেয়ে কিন্তু সে অনেক বড় তাকে দেখাশুনা করতো।মেয়েটিকে তার খুব ভালো লাগতো।মেয়েটা কাছে বসে থাকলে মনে হত যেন নার্গিস বসে আছে কাছে।কিন্তু সেতো নার্গিস নয় তাই নার্গিসকে খুঁজতে তার আবার বেরিয়ে পড়া। কিন্তু মনে হচ্ছে আল্লাহতালা তাকে সে সময় আর দেবেন না।কথাগুলো বলে তিনি হাঁফাতে লাগেন।এরপর তিনি বুকপকেটে হাত দিয়ে নার্গিসের ছোটবেলার একটা ছবি পপির হাতে ধরিয়ে বললেন,
--- আমার মেয়ে নার্গিস, যদি তুমি ওকে কোনদিন দেখতে পাও ওকে বল ওর বাবা ওকে খুব ভালবাসতো।ওর বাবা কখনও চায়নি ফারুকের বাবার সাথে কোন ঝামেলা হোক। ওর বাবার ইচ্ছা ছিল ফারুকের সাথে তার বিয়ে দেওয়ার। কিন্তু নার্গিস আমাকে না বলে চলে গিয়ে খুব কষ্ট দিয়েছে। তাইতো নার্গিসকে খুঁজতেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়া।
 পপির চোখ থেকে জল পড়তে থাকে।আস্তে আস্তে সহিদুল সাহেব মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।পপি সঙ্গে সঙ্গেই তার মাকে সব ফোনে জানায়।নিজের ভালোবাসার পূর্ন মর্যাদা দিতে না বুঝেই বাবা,মাকে সে যে কষ্ট দিয়েছে সে কথা মনে করে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে।সে শুধু স্বার্থপরের মত সারাটা জীবন নিজের কথায় ভেবেছে কোনদিনই তার জন্মদাতা জন্মদাত্রীর কথা ভাবেনি। ফারুকের ভালোবাসা সত্যিই তাকে অন্ধ করে দিয়েছিল।

#টবব্লগকনটেস্ট

No comments:

Post a Comment