সুখের ঘরে আগুন (২১)
নিশিতা আর প্রলয়ের বিয়ের পর অম্বিকা ও নিলয়ের আর দেখা হয়নি।কিন্তু দুজনের মনেই কিছু অদ্ভুত স্মৃতি রয়েছে যা দুজনকে মাঝে মাঝে আচ্ছন্ন করে দেয়। ভাগ্যের উপর কারও কোন হাত নেই।একসময় পাড়ার ফাংশানের অম্বিকাকে গান গাইতে দেখে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে তার বাবা-মাকে তাদের বাড়িতে পাঠিয়েছিল নিলয়।কিন্তু অদ্ভুতভাবে প্রসঙ্গ উত্থাপনের আগেই বিয়ের সম্বন্ধটা নিয়ে আর এগোনো যায়নি। জীবনের উপর দিয়ে ঘটে গেছে এক মস্ত বড় ঝড়। কাকতালীয়ভাবে পরিচয় হয়েছে সেই অম্বিকারই সাথে। বন্ধুর বিয়ের সূত্র ধরে কয়েকটা দিনের আলাপে তারা এসেছে মনের অনেকটা কাছাকাছি।কিন্তু কেউই মন খুলে কাউকে কোন কথা জানাতে পারেনি। জীবনের যে যার মত ব্যস্ত হয়ে পড়লেও দুজনের মনের কোন একটা জায়গায় দুজনের জন্যই একটা জায়গা তৈরি হয়েছে।
রেলে চাকুরীরত নিলয় বেশ কিছুদিন ধরেই শুনছিল তাকে কলকাতা শহর থেকে অন্যত্র বদলি করা হবে।একদিন অফিসে গিয়ে উপরমহলের ডাকে সে ছুটে গিয়ে জানতে পারে সত্যিই তার ট্রান্সফার হয়ে গেছেএবং সেটা ভুবনেশ্বর। সেদিনই তার বস ট্রান্সফারলেটার ধরিয়ে দেন।খুব ভেঙ্গে পড়ে নিলয়।বাবা মায়ের এই বয়সে তাদের ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে চাকরি করার কথা সে ভাবতেই পারেনা।রাতবিরেতে হঠাৎ করে বাবা-মায়ের কোন অসুবিধা হলে তারা বড় অসহায় হয়ে পড়বেন। কিন্তু সরকারি আদেশ অমান্য করলে চাকরি থাকবে না।সাতপাঁচ ভাবতে থাকে।
সেদিন ছিল শুক্রবার। প্রলয় ফোন করে নিলয়কে জানায় রবিবার দিন তাদের বাড়িতে একটা ছোট্ট পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। কাছের কিছু বন্ধুবান্ধব সেদিন আসবে।যারা বিয়েতে খাটাখাটনি করেছে তাদের জন্য এই ছোট্ট আয়োজন।সে যেন অবশ্যই আসে। নিলয়ের মনটা সেদিন মোটেই ভাল ছিলনা।প্রলয়ের কথাগুলো শুনে সে বলল,
--- একটু ব্যস্ত আছি, পরে তোকে ফোন করবো।তবে হ্যাঁ আমি রবিবার অবশ্যই যাবো তোর বাড়িতে।
বাড়িতে ফিরে চা খেতে খেতে মা-বাবাকে কথাগুলো জানালো নিলয়।তারাও শুনে খুব মুষড়ে পড়লেন।কিন্তু কারো কিছুই করার নেই।আজকের বাজারে চাকরি পাওয়াই দুষ্কর।তার ওপর সরকারি রেলওয়ে চাকরি। তারা ওখানেই তাকে কোয়াটার দেবে।সর্ব রকম সুবিধাযুক্ত।ইচ্ছা হলে সে পুরো পরিবার নিয়ে সেখানে যেতে পারে।কিন্তু বাবা-মা পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে কিছুতেই যেতে রাজি নন।তাদের সেই এক কথা "আমাদের কোন অসুবিধা হবেনা।নিশ্চিন্ত মনে তুই যেতে পারিস।আর অসুবিধা হলেও পাড়া-প্রতিবেশীর তো আছে, রিতেশ আছে।কোন দরকার হলে তার সাথে যোগাযোগ করব।প্রয়োজনে তুই দুই একজন বন্ধু-বান্ধবের ফোন নাম্বার দিয়ে যাস। আগে তো তোকে চাকরিটা বাঁচানোর ব্যবস্থা করতে হবে।তুই গিয়ে সেখানে চাকরিতে জয়েন কর।আমরা না হয় মাস ছয়েক পরে কিছুদিন গিয়ে তোর কাছে।থাকবো। আর মাঝে মধ্যে ছুটিছাটা পেলে তুইও চলে আসিস।
সম্পূর্ণ মনের বিরুদ্ধে গিয়ে দিন সাতেক পরে নিলয় রওনা হয়ে যায় তার নতুন চাকরির স্থল ভুবনেশ্বরের উদ্দেশ্য। এসি কামরায় চোখ বুজে সেদিন প্রলয়ের বাড়িতে টুকরো টুকরো ঘটনাগুলি মনে করে আনন্দের রেশটা ধরে রাখার চেষ্টা করে। সেদিন প্রলয়ের বাড়িতে যেতে তার একটু দেরিই হয়ে গেছিল। সারাটাদিন ভুবনেশ্বর যাওয়ার তোড়জোড় করতেই দেরি হয়ে যায় দুপুরের খাবার খেতে। খাওয়ার পর বিছানায় শরীর এলিয়ে দিতেই তার দুচোখ ভরে ঘুম নেমে এসেছিল। উঠতে উঠতেই সন্ধ্যা। হয়তো আরও দেরি হতো কিন্তু প্রলয় ফোন করাতেই সে সেই আওয়াজে উঠে পড়ে। সে যখন বাড়ি থেকে বেরোয় তখন সন্ধ্যা সাতটা।প্রলয়ের বারবার ফোন,
--- সবাই এসে গেছে,তুই না আসলে ঠিক জমছে না।একটা উবের ধরে তাড়াতাড়ি চলে আয়।
লিফটে করে উপরে উঠে সদর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে শুনতে পায় অম্বিকা গান করছে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পুরো গানটা শুনে তারপর সে বেল বাজায়। প্রলয় ছুটতে ছুটতে এসে দরজা খুলেই চিৎকার করতে লাগলো,
--- তোর এত দেরি হল কেন?সে কখন থেকে আমরা তোর জন্য অপেক্ষা করছি।
নিলয় এদিকে ওদিকে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে প্রলয়ের কাছে জানতে চাইল,
--- গেস্টরা সব কোথায়?
চোখ ভুরু কুঁচকে প্রলয় বলল,
--- গেস্ট বেডরুমে ---
নিলয় প্রায় আঁতকে উঠলো।গেস্ট বেডরুমে মানে?গেস্টদের নিয়ে তুই বেডরুমে বসিয়েছিস?কপাল আমার !এই বুদ্ধি নিয়ে তুই সংসার করবি কেমন করে ?এত বড় ড্রইংরুম থাকতে সবাইকে নিয়ে বেডরুমে?নিশিতা কোন আপত্তি করেনি?নাকি ওউ তোর কথায় সায় দিয়েছে?
--- আরে এত উত্তেজিত হচ্ছিস কেন?তুই ও চল সেখানে আর গিয়েই দেখতে পাবি কে কে এসেছে ?
নিলয় দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনেছে অম্বিকার গান।তাই সে জানে অম্বিকা এসেছে।কিন্তু বন্ধুকে সে কথা সে বুঝতে দিল না। প্রলয়ের কথার জবাবে ড্রয়িং রুমে বসতে বসতে বললো,
-- তোর ভীমরতি ধরেছে বলে কি আমারও ভীমরতি ধরেছে? আমি কিছুতেই তোর বেডরুমে যাবনা।আমি এখানেই বসবো দরকার হলে তুই চলে যা তাদের কাছে।খাওয়ার সময় হলে আমার খাবারটা দিয়ে দিস।আমার কাছে বসে থাকার কোন দরকার নেই।আমি জানতাম না তুই এতটা মাথামোটা! বন্ধুবান্ধব নিয়ে নিজেদের বেডরুমে ঢুকে গেছিস,তাও আবার 7 দিন আগেই বিয়ে হয়েছে তোদের।
কথাগুলো শেষ করে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে নিশিতা আর অম্বিকা আসছে।আসতে আসতে নিশিতা বলতে থাকে,
-- সেই যে দরজা খুলতে আসলে তারপরে আর ও ঘরে যাওয়ার কোন নাম নেই।আমরা দুজনে অপেক্ষা করে করে ক্লান্ত হয়ে চলে এলাম। কি এমন গভীর শলা পরামর্শ হচ্ছে সেটাই জানতে এলাম।
--- আর বোলো না নিশা। নিলয় ঘরে ঢোকার থেকে চিৎকার করে যাচ্ছে আমরা সব বন্ধুবান্ধবকে কেন বেড রুমে বসিয়েছি? সে বেডরুমের ঢুকবে না বলে জোর করে এই ঘরে বসে আমার সাথে ঝামেলা করে চলেছে।
নিশিতা হাসতে হাসতে বলল,
--- আমার বেডরুমে ঢোকার অধিকার তোমার এবং অম্বিকার আছে।
নিলয় নিশিতার দিকে হাত জোড় করে বলল,
-- ক্ষমা করো দেবী, কারো বেড রুমে ঢোকার অধিকার আমার নেই।কেউ সেই অধিকার দিলেও আমি নিতে পারবোনা।আরে আমি তো মানুষ,কতটা নিতে পারব আর কতটা নিতে পারবো না সেটা আমার থেকে আর কেউ কি ভালো জানে?
নিলয় কোন দিকে ইঙ্গিত করল প্রলয় তা ভালোভাবেই বুঝতে পারলো।সে হাসতে হাসতে বলল,
-- আরে এ প্রসঙ্গ ছাড় ;সেই বিয়ের পর তোর আর অম্বিকার সাথে আমাদের দেখা হয়নি।আচ্ছা তোদের দেখা হয়?নাকি হয়েছে?আমরা জানি না--
। কথাগুলো বলেই প্রলয় হাসতে লাগলো।নিশিতাও সেই হাসিতে যোগ দিলো।আর এই কথা শুনে অম্বিকা কিছুটা লজ্জা পেয়ে গেলো।নিলয় সেটা বুঝতে পেরে প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বলল,
--- আরে বাকিদের ডাক।আড্ডাটা এখানে বসেই মারি।রাত ও হচ্ছে।বাড়ি ফিরতে হবে তো?করেছিস তো খাওয়ার নিমন্ত্রণ সেটা মনে আছে তো?
প্রলয় নিলয়ের দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে।
--- কিরে তোর এত হাসি পাচ্ছে কেন,?আরে আমরা তো শুধু তোকে আর অম্বিকা কে বলেছি। নিজেদের মতো করে কিছুটা সময় কাটাবো বলে।আর কাউকেই বলিনি।আজকে তোরা দুজনেই শুধু আমাদের গেস্ট।আর খাবার হোটেল থেকে আসবে।খাওয়ার কিছুক্ষণ আগেই অর্ডার দেবো। গরম গরম খাওয়া-দাওয়া হবে।তবে হ্যাঁ নিশিতা চিকেনের একটা প্রিপারেশন করেছে।খুব ভালো করে ওটা।'নবাবী চিকেন' অনেকবার খেয়েছি।অবশ্য সেটা বাড়িতে তৈরি করে আমার জন্য টিফিন ক্যারিয়ারে করে নিয়ে বাস স্ট্যান্ডে এসে দিয়ে গেছে বেশ কয়েকবার।অফিসে বসেই খেতাম।
--- তুই ভাগ্যবান ভাই।আমার তো কপাল মন্দ।
নিশিতা নিলয়ের কথা শুনে গম্ভীর স্বরে বলল, মন্দ কপাল কে আমরা ভালো করে দিতে জানি।তার জন্য কিছু করতে হবে না শুধু একটু মনের কথাটা বলা দরকার।
কথায় কথায় নিলয় ওদের জানালো তার বদলী হওয়ার কথা। হঠাৎ করে এমন একটা খবরে সবাই যেন স্তম্ভিত হয়ে গেল। অম্বিকা মুখের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে বলল,
--- এক সপ্তাহের মধ্যে যেতে হবে? মাসিমা,মেসোমশাই কে এই বয়সে একা রাখা ঠিক নয়।আপনি এক কাজ করুন নিলয়দা ওদেরও সাথে নিয়ে যান।আপনি তো কোয়াটার পাবেন সুতরাং কোন অসুবিধা তো নেই।
অম্বিকার কথার জবাবে নিলয় একটু রাগত স্বরেই বলল,
-- অসুবিধা তো আছেই।তারা কিছুতেই বাড়ি ছেড়ে আমার সাথে যাবেন না।আমি আপনাদের সকলের ফোন নাম্বার তাদের কাছে দিয়ে যাবো।আমার বাবা মায়ের দায়িত্ব আপনার আর প্রলয়ের উপরেই ছেড়ে যাব।বিপদে-আপদে একটু উনাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াবেন।কোন অসুবিধা হলে আমাকে খবর দিলেই আমি সঙ্গে সঙ্গে চলে আসবো।বন্ধু হিসেবে এটুকু আমি সকলের উপরে দাবি করতেই পারি --।
প্রলয় তার বন্ধুকে আশ্বাস দিয়ে বললো,
--- তুই একদম চিন্তা করিস না,আমরা তো আছি। আর অম্বিকা তো তোর বাড়ির কাছেই।ওই সকলের আগেই ছুঁটে যাবে।আর আমরাও থাকব পাশে।কোন অসুবিধা হবে এটাই বা তুই ভাবছিস কেন? নিশ্চিন্ত মনে তুই বেরিয়ে পড়বি।মাসিমা,মেসোমশাই এর দায়িত্ব আমাদের।
খাওয়া-দাওয়া গল্প- গুজবে রাত দশটা বেজে গেলো।ফেরার সময় অম্বিকা,নিলয় একসাথেই বেরোলো ওদের বাড়ি থেকে।প্রথমে দুজনে চুপচাপই বসে ছিল।তারপর নিলয়ই কথা শুরু করে।
--- একটা কথা আপনাকে বলার ছিল।
অম্বিকা নিলয় মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
--- কি বলতে চান বলুন। তবে আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি আপনার বাবা-মাকে দেখার দায়িত্ব আমি নিলাম।তবে তাদের বলে যাবেন কোন অসুবিধা হলে আমাকে ফোন করতে।
--- না, একটা অন্য ব্যাপারে কিছু বলার ছিল।
ক্রমশঃ
No comments:
Post a Comment