স্মার্ট ফোন
প্রেম করে আঠারো বছর বয়সের আগেই সামান্য এক ইলেকট্রিক দোকানের মালিকের সাথে পালিয়ে গিয়ে কালীঘাট মন্দিরে বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে উঠে জয়িতা। শ্বাশুড়ি মেনে নিতে বাধ্য হন কারণ স্বামী হারা ওই ছেলেই তার বেঁচে থাকার একমাত্র শিবরাত্রির সলতে।অর্থের অভাব থাকলেও জয়িতার জীবনে সুখ ছিল।আস্তে আস্তে দোকানে উন্নতি হওয়া শুরু করল;আর তার স্বামীরও মদের প্রতি আসক্তি বাড়তে লাগলো। এরই মধ্যে জয়িতার কোল জুড়ে এলো সুন্দর ফুটফুটে একটি মেয়ে। স্বামী অরূপ রোজ রাতে মদ খেয়ে বাড়িতে এসে পান থেকে চুন খসলেই চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করতো।শেষের দিকে সে জয়িতার গায়ে হাতও তুলতো। শ্বাশুড়ি শত চেষ্টা করেও ছেলের মাতলামির হাত থেকে তার একমাত্র বউমাকে বাঁচাতে পারতেন না।দু বছরের স্মৃতি ভয়ে সিটিয়ে ঠাকুমাকে জড়িয়ে কাঁদতে শুরু করত। মদ পেটে পড়লেই অরূপ অন্য মানুষ! আর নেশা কেটে গেলে তার মতো ভালো মানুষ আর একটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না।তাই শত অত্যাচার সহ্য করেও জয়িতা তার স্বামীর সেবা থেকে একচুলও কোনদিন সরেনি। অনেক চেষ্টা করেছে স্বামীর নেশা ছাড়ানোর কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছে।
এই ভাবেই কেটে গেছে অনেকগুলি বছর।স্মৃতি তখন বিয়ে পড়ছে।একটি ছেলের সাথে তার পরিচয় হয়।পরিচয় থেকে প্রেম।দোকানে বসে অরূপের কানে কথাটা যায়।আকন্ঠ মদ গিলে সে বাড়িতে আসে।এসেই জয়িতার সাথে তুমুল অশান্তি। এরই মধ্যে স্মৃতি টিউশনি থেকে বাড়িতে ফিরে চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ভয়ে কাঠ হয়ে সে ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকে। অরূপ রাগের মাথায় দরজার খিল নিয়ে স্মৃতির পায়ে মারতে যায়।আচমকা স্মৃতির সামনে গিয়ে জয়িতা দাঁড়িয়ে পড়ে। ওই খিলের বাড়ি জয়িতার পায়ে লাগে। আর জয়িতা চিৎকার করে উঠে মাথা ঘুরে পড়ে যায়।অরূপ শান্ত হয়ে গিয়ে খাটের উপর বসে পড়ে।
জয়িতার পা ভেঙ্গে যায়।হাসপাতাল থেকে প্লাস্টার করে এসে জয়িতা খাটে শুয়ে।অরূপ সেই থেকে বেশ কদিন দোকানে যায় না।দোকানের কর্মচারীরা দোকান সামলায়। সম্পূর্ণ অন্য মানুষ হয়ে যায় অরূপ। সেদিনের ওই ঘটনার পর অরূপ আর মদ ছুঁয়েও দেখেনি। জয়িতার কাছে দুহাত জড়ো করে ক্ষমাও চেয়ে নিয়েছে। জয়িতার দেখাশোনা সব অরূপ নিজের হাতেই করে।আস্তে আস্তে জয়িতা সুস্থ হয়ে উঠতে থাকে। ফিরে পাই সে তার জীবনের হারিয়ে যাওয়া সুখ।বোঝাতে সক্ষম হয় অরূপকে মেয়ে স্মৃতি যাকে ভালবাসে সে যখন ভালো ঘরের ছেলে, ভালো চাকরি করে, তাহলে বিয়েতে আপত্তি কোথায়?স্মৃতি যদি জীবনে সুখী হয় তার থেকে আর কি চাওয়ার থাকতে পারে ঈশ্বরের কাছে আমাদের ?অরূপ রাজি হয়।মেয়েও গ্রাজুয়েশন শেষ করে।
দু'বাড়িতে বিয়ের তোরজোরের মাঝেই অরূপ একদিন বুকে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে নার্সিংহোম ভর্তি হয়।অবস্থা সংকটাপন্ন!বিয়ের মাত্র সাত দিন বাকি।স্মৃতি তার হবু স্বামী কল্যাণকে বিয়েটা পিছিয়ে দিতে বলায় কল্যাণ তাকে জানায়,
----তা কি করে সম্ভব? বিয়ের কার্ড ছাপানো, নিমন্ত্রণ করা, সবকিছু অ্যাডভান্স দেওয়া পর্যন্ত হয়ে গেছে।এই মুহূর্তে বিয়ে পিছিয়ে দেওয়া মানে সম্মানহানির সাথে সাথে অনেক টাকাও খরচ ।এটা কিছুতেই করা যাবে না।
--- কিন্তু বাবার এই অবস্থায় আমি বিয়ের পিঁড়িতে বসতে পারবো না।
---- যার শরীরের এই অবস্থা তিনি তো আর বাঁচবেন না। তাহলে খামোখা বিয়েটা পিছিয়ে দেবো কেন?
---- কি বলছো কল্যাণ? আমার বাবা তোমার বাবা নন? তোমার বাবার এইরকম অবস্থায় বিয়ে করতে তুমি রাজি হতে?
---- শোনো স্মৃতি আমাকে যদি তোমার বিয়ে করতে হয় তাহলে ওই তারিখেই বিয়ে হবে, অন্যথায় আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবোনা
---- আমার পক্ষে সেটা কিছুতেই সম্ভব নয়।এখন বুঝতে পারছি আমি তোমায় চিনতে ভুল করেছিলাম।ভালো চাকরি আর সুন্দর চেহারা থাকলে সুন্দর মনের মানুষ হওয়া যায়না। তুমি তার জলন্ত প্রমান।আজকের পর থেকে তোমার সাথে আমার আর কোন সম্পর্ক থাকবে না।আমি বেঁচে গেলাম একটা কুৎসিত মনের মানুষের সাথে সারা জীবন থাকার হাত থেকে।আসলে ঈশ্বরই আমায় এটা বুঝিয়ে দিলেন।আমি এখন বুঝতে পারছি তুমি এতদিন শুধুমাত্র আমার বাবার ব্যাংক ব্যালেন্স, আমি বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান,ভালো বাড়ি এইসবের লোভেই আমার পেছনে পড়ে ছিলে। এটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল আমাকে নয় তোমার লোভ ছিল আমার বাবা মায়ের সম্পত্তির উপর।আমার প্রতি তোমার ছিল লোক দেখানো ভালোবাসা।তুমি ভালোভাবে জানতে তাদের অবর্তমানে তাদের সব কিছুর মালিক আমি হব আর এই কারণে তুমি আমার সাথে এতদিন ধরে অভিনয় করে গেছো।
কল্যাণকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে স্মৃতি চলে আসে তার সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে। তার বাবা অরূপ আর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসতে পারেননি।রাক্ষুসে নার্সিংহোম লক্ষ লক্ষ টাকার বিল ধরিয়ে দেয় জয়িতার হাতে,আর সামনে এনে দেয় তার মৃত পিতাকে।
হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজতে লাগলো স্মৃতি। কারন দোকানটাও আস্তে আস্তে কর্মচারীদের ভিতরে অসন্তোষ ও চুরির কারণে বন্ধ করে দিতে হয়।সামান্য মাইনের রিসিপশনিস্ট পদে একটি কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে যায়।বাবার মৃত্যুর তিন মাসের মধ্যেই ঠাকুমাও চলে যান।মা ও মেয়ের সংসার এখন।কোন ঝামেলা ঝক্কির ব্যাপার নেই। কিন্তু বিধাতা পুরুষ জয়িতার কপালে সুখ স্থায়ীভাবে লেখেননি।রোজের মতো অফিস যাওয়ার জন্য সকাল দশটায় বেরিয়ে যে মেয়েটা রাত আটটায় ফিরে আসে সে একদিন সারা রাতেও ফেরে না। সারারাত ছটপট করতে করতে ভোরেই থানায় হাজির হয় জয়িতা ।একটা নিখোঁজ ডায়েরি করে।সাত দিনের মাথায় মেয়ের লাশ শনাক্ত করতে তাকে নদীয়া যেতে হয়। শারীরিক অত্যাচারের পর শ্বাসরোধ করে তাকে মারা হয়েছে। ধরা পড়ে খুনিরা।তাদের জেরা করে জানা যায় চাকরিস্থল থেকে বেরিয়ে সে যখন ফাঁকা রাস্তা ধরে বাস ধরার জন্য এগোচ্ছিল তখন মুখে কাপড় চাপা দিয়ে তাকে গাড়িতে তোলা হয়।যার নির্দেশে এ কাজ তারা করেছিল সে সারারাত মেয়েটির উপর অত্যাচার করে ভোরের দিকে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলে। পরে লাশ তাদের হাতে তুলে দেয় মাটিতে পুঁতে ফেলার জন্য।এর বিনিময়ে তারা প্রচুর টাকা পেয়েছে।মূল পান্ডাকেও ধরা হয়।জয়িতা দেখে সে আর কেউ নয় তার মেয়ের প্রাক্তন প্রেমিক কল্যাণ।কল্যাণকে অরূপ ঠিক চিনেছিল। কিন্তু জয়িতা বা তার মেয়ে চিনতে পারেনি।আজ ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর জয়িতা চিনলো কল্যাণকে।
ভেঙ্গে পড়ে জয়িতা খুব।নিঃস্ব হয়ে যায় সে।খাওয়া-দাওয়া প্রায় বন্ধ করেই নিজেকে ঘরবন্দি করে রাখে।এই অবস্থায় থাকতে থাকতে সে এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়ে যে প্রতিবেশীরা দরজা ভেঙ্গে তাকে নিয়ে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করে। দিন পনেরোর পর একটু একটু করে জয়িতা সুস্থ হয়ে উঠতে থাকে।সে দেখে তার পাশের বেডের এক ভদ্রমহিলা হাসপাতালের বেডে শুয়েই সবসময় মোবাইল নিয়ে খুটখাট করছেন।কখনো একা একাই হাসছেন আবার কখনো বা মুখটা তার বেশ গম্ভীর।জয়িতা বুঝতে পারে নিঃসঙ্গ জীবনের সময় কাটানোর এ এক অভিনব পন্থা!এটা বুঝতে পেরেই হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়িতে এসে হাতের বালা বিক্রি করে জয়িতা এক স্মার্ট ফোন কিনে বসে। সেও সব সময় ঐ ফোনটা নিয়েই নাড়াচাড়া করতে থাকে।পাশের বাড়ির একটি ছেলের সাহায্যে সে অনেক কিছু শিখে যায়। একসময় সে স্মার্টফোনে বেশ পারদর্শী হয়ে ওঠে।দুটো সিদ্ধ ভাত করে সারাদিন ফোন নিয়ে থাকার ফলে সে তার জীবনে অনেক দুঃখ কষ্ট সাময়িক হলেও ভুলে থাকতে পারে।
জীবনে সুখী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে একদিন নিজের বাবা, মা, ভাইবোন কে ছেড়ে সে চলে এসেছিল অরূপের হাত ধরে। সুখ-দুঃখ মিলিয়ে জীবনটা বেশ কেটে যাচ্ছিল।কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে একে একে সবাই তাকে ছেড়ে গেছে।তবুও সে ভেঙ্গে পড়েনি।বাঁচার তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে হাসপাতালে পাশের বেডে সালেহার হাতে ফোন দেখে বেশ কয়েকবার বেড থেকে উঠে গিয়ে তার কাছে ফোনে কি কি করা যায়? কীভাবে মানুষের সাথে যোগাযোগ করা যায়?সবকিছু দেখে তারও এই ফোনের প্রতি একটা নেশা ধরে যায়। আর তখন সে মনে করে বাড়িতে গিয়ে তার সময় কাটানোর জন্য ঠিক এমনই একটা ফোন কিনবে।
আজ তার এই নিঃসঙ্গ জীবনে স্মর্টফোনটা তার সব সময়ের বন্ধু। এই ফোনটাই তার জীবনের অনেক কিছু ভুলিয়ে দিতে পেরেছে।অনেক মানুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।কত মানুষের কত কথা টুকরো টুকরো বাক্যে জানা যায়।তাই সে আজ এই ফোনটাকেই মনে করে তার পরম বন্ধু ।
No comments:
Post a Comment