Sunday, January 24, 2021

সুখের ঘরে আগুন (১৯)

সুখের ঘরে আগুন (১৯)
   বড় রাস্তার মোড়ে নেমে নিলয় কিছু তেলেভাজা কিনে নিয়ে বাড়িতে আসে। কয়েক মাস আগেও এটা ছিল নিলয়ের নিত্য রুটিন। দার্জিলিং ঘুরতে গিয়েই যেন জীবনের কালো মেঘটা কোথায় হারিয়ে গেছে।যা কিছু ঘটছে ভালই লাগছে।কিন্তু মাঝে মাঝেই শালিনীর সাথে ডিভোর্সের ব্যাপারটা মাথায় ঘুরপাক খায়। বাড়িতে এসে মাকে তেলেভাজার প্যাকেটটা ধরিয়ে দিয়ে বলে,
---  অনেকদিন মুড়ি মাখা খাওয়া হয়না মা।মুড়িটা মেখে চা টা একবারেই করে নিয়ে ড্রয়িংরুমে এসো।তিনজনে বসে গল্প করতে করতে মুড়ি মাখা আর চা খাওয়া হবে।
  অনেকদিন পর ছেলে তেলেভাজা কিনে এনেছে দেখে মলিন দেবীও খুব খুশি হন।ছেলে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হচ্ছে দেখে তিনি মনেমনে বেশ আনন্দিত। অনেকদিন পরে জলপাই তেলের বয়ামটা খুঁজে বের করেন।মুখটা খুলে নাকের কাছে নিয়ে তাতে গন্ধ হয়েছে কিনা দেখে নিয়ে মুড়ির ভিতর তেলটা ঢালতে ঢালতে ভাবতে লাগলেন,বেশ কিছুদিন জলপাই তেলের বয়ামটা রোদে দেওয়া হয়নি।তবুও এখনো  ঠিকই আছে।তিনি মুড়িটা মেখে নিয়ে ড্রয়িংরুমে আসেন।ছেলে আর তার বাবার সামনে দিয়ে বলেন,
--- তোমরা খেতে লাগো আমি চা টা করে নিয়ে আসি।
--- তোমাকে তো আগেই বললাম একবারেই চা করে নিয়ে আসতে।কতদিন পর তেলেভাজা কিনে আনলাম বলো তো?
--- আরে তোরা খেতে লাগ আমি পাঁচ মিনিটেই আসছি।
     
    পরদিন কলেজে অম্বিকা আর নিশিতা টিফিন করছে আর নানান ধরণের গল্পগুজবের মেতে আছে।হঠাৎ নিশিতা বলে উঠলো,
--- হ্যাঁরে অম্বিকা, নিলয়দার বাড়ি তোদের পাড়াতে? ওর  সম্পর্কে সব জানিস?
--- মানে? সব জানি মানে?এক পাড়াতে থাকার ফলে যেটা জানি সেটা হল নিলয়দা ভদ্র,সভ্য,পরোপকারী।মানুষের পাশে দাঁড়াতে কখনো দুবার ভাবে না। সরকারি চাকরি করে ব্যস এইটুকুই।
--- না মানে বলছিলাম, নিলয়দার বিয়ে হয়েছে জানিস সবকিছু?
--- হ্যাঁ জানি তো বিয়েতে আমাদের সকলের নিমন্ত্রণ ছিল। মা আর বাবা গেছিলেন।আমি অবশ্য যাইনি।
--- তার পরের ঘটনা আর কিছু জানিস না?
--- এই তুই ঝেড়ে কাশ তো ---।কিসব মাথামুন্ডু বলছিস আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
--- না,আসলে প্রলয় তো নিলয়দার কলেজ সহপাঠী , তাই নিলয়দা প্রলয়ের সাথে সবকিছু শেয়ার করে।
--- সেতো বুঝলাম,কিন্তু এখন আসল কথা বল তুই।
--- নিলয়দা অষ্টমঙ্গলায় গিয়ে তার বউকে রেখে ফিরে এসেছে ।
--- মানে?
--- সেটাইতো বলছি।ওই বউয়ের সাথে সে আর সংসার করবে না।অবশ্য নিলয়দা ভুল করেছে বলে আমার মনে হয় না।কোন মেয়ে যদি বিয়ের আগের রাতে ফোন করে তার হবু স্বামীকে জানায় যে সে অন্য কাউকে ভালোবাসে তাহলে সেই পুরুষের পক্ষে তাকে নিয়ে সংসার করা সম্ভব নয়।
--- ঘটনাটা খুলে বল আমি তোর কথা কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা।
নিশিতা তখন পুরো ঘটনা অম্বিকাকে জানায়।অম্বিকা সব শুনে থ হয়ে যায়।কিছুক্ষণ তার মুখ থেকে কোনো কথাই বের হয় না।তারপর একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বলে,
---. প্রতিটা মানুষই তার ভাগ্য নিয়ে জন্মায়। ভাগ্যের উপর কারও কোন হাত নেই।নিলয়দার কপালে এটাই লেখা ছিল। তবে আমার মনে হয় বিয়ের আগেরদিন যখন নিলয়দা সবকিছু জানতে পেরেছিল বিয়েটা না করলেই পারত। খামোকা লোক দেখানো বিয়ে করার কোন যুক্তি ছিল বলে আমার মনে হয়না।এতে লোক হাসানোই হল।
--- খুব খারাপ লাগে জানিস ?এত ভালো ছেলেটার কপালে কি দুর্ভোগ!
--- কথাটা মনে হয় পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।পাড়ার কেউ কিছু জানে না।আর এরকম একটা লজ্জাস্কর ঘটনা অন্যদের কোন মুখেই বা জানাবে?কথাটা শুনে নিলয়দার জন্য মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। এখন বুঝতে পারছি সেদিন যখন জানতে চেয়েছিলাম 'নতুন জীবন কেমন চলছে-' তখন একটা হেঁয়ালিপূর্ণ উত্তর দিয়েছিল। এই ধরনের কোনো কথা তখন মাথাতেই আসেনি।নিলয়দার জীবনে যা ঘটেছে এইরূপ ঘটনা আমার এই প্রথম শোনা।
  অম্বিকা সেদিন বাড়িতে ফিরে তার বেস্ট ফ্রেন্ড বাবাকে ঘরে ডেকে নিলয়ের সব কথা বাবাকে জানায়।বাবা সব শুনে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলেন,
--- 'কপালের লিখন না যায় খণ্ডন'। নরেশবাবু আর তার স্ত্রী খুব শখ করে আর দেখেশুনে ছেলেটার বিয়ে দিলেন। ছেলেটার কপালটাই খারাপ!ভালো চাকরি করে, দেখতে শুনতে খারাপ নয়, পাড়ায় যথেষ্ট সুনাম আছে ভালো ছেলে হিসাবে, নিজেদের বাড়ি-- সে তো হীরের টুকরো ছেলে। যাক গে -এসব কথা পাঁচ কান না হওয়াই ভাল।তোর মাকে আর কিছু বলিস না। পেট পাতলা মানুষ কাকে কি বলে বসবে তার থেকে তার কানে না দেওয়ায় ভালো।
   নিশিতা ও প্রলয়ের বিয়েকে কেন্দ্র করে অম্বিকা ও নিলয়ের বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে।নিলয় এখন অনেকটাই ফ্রী অম্বিকার কাছে।কিন্তু নিলয় তার জীবনের সদ্য ঘটে যাওয়া এই সম্পর্ক নিয়ে অম্বিকাকে কোন কথা যেমন জানায়নি অপরদিকে অম্বিকা যে জানে সেই সম্পর্কেও নিলয়কে কিছু বলেনি।বিয়ের দিন ভোরে নিশিতা বাড়ি থেকে বাবা - মায়ের বিনা বাধায বেরিয়ে আসে।বড় রাস্তার মোড়ে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল অম্বিকা ও নিলয়। বিয়ের দিনে শুভদৃষ্টির আগে বর-কনের দেখা করতে নেই এই অজুহাতে নিলয় প্রলয় কে আসতে দেয়নি।সে অম্বিকার সাথে কথা বলে তাকে নিয়ে নিশিতাকে নিতে আসে।তারপর তারা নিশিতা ও প্রলয়ের নতুন ফ্ল্যাটে চলে যায়। প্রলয়ও তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে আর এক বন্ধুর বাড়ি ওঠে। ওখান থেকেই সে রাতে বিয়ে করতে আসবে। নিলয় একবার প্রলয়ের কাছে আর একবার তাদের ফ্ল্যাটে সারাটা দিন ছোটাছুটি করেছে।কিন্তু ক্লান্তির কোন রেশ তার শরীরে নেই।
      সন্ধ্যায় দশ-বারোজন বন্ধুকে নিয়ে প্রলয় তাদের নতুন ফ্ল্যাটে বিয়ে করতে আসে। বিয়েটা বাঙালি মতেই হয়।অম্বিকা তার বাবা-মাকে জানিয়ে এসেছিল আজ রাতে সে ফিরবে না।সুতরাং তার কোনো চিন্তায় ছিল না।নিলয় বিয়ের রাতে সব কাজ মিটে যাওয়ার পর বাড়ি ফিরে যেতে চায়। কিন্তু সকলেই তাকে অনুরোধ করে সে রাতটা থেকে যাওয়ার জন্য।নিলয় বাধ্য হয় সেদিন থাকতে। আসলে বাবা-মায়ের বয়স হয়ে যাওয়ার পর সে আর কখনোই রাতে বাইরে থাকেনি।বাইরে থাকলে তার বাবা-মায়ের জন্য খুব চিন্তা হয়; সারারাত সে ঘুমাতে পারে না।তাই ওদের বিয়েতে যখন থাকবে মনস্থির করে তখন মাকে ফোন করে জানিয়ে দেয় রাতের সে ফিরবে না।তা না হলে তো তারাও দুশ্চিন্তা করবেন।
   বিয়েতে নিশিতা হোয়াইট আর রেডের  কম্বিনেশনে বেনারসি পড়েছিল | তার সাথে মাননসই কিছু হালকা গয়না | মুখে খুবই হালকা মেকআপ | ভারী মেকআপ নিশিতার একদম পছন্দ নয় | চোখের পাতায় সামান্য আইশ্যাডো সঙ্গে মাসকারা | কাজল পড়েছিল চোখের নীচের পাতায় শুধু | চন্দন শুধু কপালের লাল টিপটাকে বিন্দি দিয়ে ঘুরিয়ে দুপাশে দুটি কল্কে এঁকে দিয়েছিলো | অতি  সাধারণ সাজ কিন্তু নিশিতাকে অপূর্ব লাগছিলো |কিন্তু নিশিতার বিয়েতে নিশিতার সাজের থেকেও অম্বিকার সাজ যেন আরো সুন্দর হয়েছিল। অপূর্ব লাগছিলো তাকে দেখতে।নিলয় তো কতবার যে আড়চোখে অম্বিকাকে দেখেছে তার কোন ইয়ত্তা নেই।সেই প্রথম দিন ফাংশনে অম্বিকার গান শুনে তাকে ভালো লেগে গেছিল।আর মনেমনে একটা স্বপ্ন এঁকে বাবা-মাকে পাঠিয়েছিল তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়ে।কিন্তু পরিস্থিতি সেই প্রস্তাব উপস্থাপন করার সুযোগ তার বাবা-মাকে দিয়েছিল না। প্রথম দিনের সেই ভালোলাগাটা এ কটাদিনে নিলয়ের মনের অজান্তেই কখন যেন ভালোবাসার রূপ পেয়েছে। কিন্তু তার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো তাকে বাধা দিচ্ছে অম্বিকাকে ভালোবাসার কথা জানাতে। নিলয় একটু একটু করে অম্বিকার প্রতি আকর্ষিত হচ্ছে।কিন্তু নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে নিজেকে ধরে রাখতে। কিন্তু আবেগকে কি ধরে রাখা যায়? বিশেষত ভালোবাসার আবেগ! বিয়ের আসরে অম্বিকার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে একটু ছোঁয়া,একটু কাছাকাছি আসা অম্বিকার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা কোন কিছু থেকেই নিজেকে নিরস্ত্র করতে পারেনি।শুধু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছেনা। কলেজ জীবনে নন্দিনীকে ভালোবেসেও তার বুকের যে ধুকপুকানি হয়নি আজ বন্ধু প্রলয়ের বিয়েতে অম্বিকাকে দেখে প্রতিটা মুহূর্তে নিজের বুকের হৃদস্পন্দন সে যেন নিজেই শুনতে পাচ্ছে। তাই সবাই যখন তাকে বিয়ের রাতে থেকে যেতে বলে, মুখে সে বারবার না বললেও তার মন চাইছিল যে সে আজ রাতটা এখানে থেকে গেলে অম্বিকাকে আরো বেশি সময় ধরে দেখতে পাবে।তাই তার রাতে থেকে যাওয়ার এটাই প্রধান কারণ হয়ে ওঠে।
  অপরদিকে অম্বিকার মনেও কি নিলয় কোন দোলা দেয়নি? তার কি ভালো লাগছেনা নিলয়ের সান্নিধ্য? সেকি সকলের অলক্ষ্যে নিলয় কে লক্ষ্য করছে না? নিলয় যে বার বার তার দিকে তাকাচ্ছে তার পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে তার কি ভালো লাগছেনা? মনের দিক থেকে দুটি হৃদয় যখন এক হয় তখনই ভালোবাসার ফুল প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে।
  বাসররাতে সকলে অম্বিকাকে চেপে ধরে গান গাওয়ার জন্য। বিশেষত নিলয়।আর নিলয়ের এই অনুরোধ অম্বিকা ফেলতে পারেনা।সে পরপর দুটি গান করে।সারারাত তারা গানে গল্প জেগে থাকে।

ক্রমশঃ

  

No comments:

Post a Comment