সুখের ঘরে আগুন (13 পর্ব)
এই ঘটনার পর বাড়ির পরিবেশটা পুরোই পাল্টে গেল। বাড়িতে তিনটি প্রাণী থাকলেও সকলেই গল্পগুজবে মেতে থাকতো। কিন্তু এখন বাড়িটা সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ। কেউ আর কারো সাথে প্রয়োজন ছাড়া একটা কথা ও বলে না। ছুটির দিন হলে একবার নিলয় আর একবার তার বাবা তাদের পছন্দ মতন খাবার অর্ডার করতেন আর সর্বক্ষণ মলিনাদেবী বকবক করতেন, আর তাদের পছন্দসই খাবার করার জন্য যারপরনাই পরিশ্রম করতেন ।তারা খেয়েদেয়ে হাসিমুখে যখন বলতো "দারুন হয়েছে"- তখন তার সমস্ত পরিশ্রম আর বকবকানি এক মুহূর্তের মধ্যে কর্পূরের মত উবে যেত। কিন্তু সেই দিনগুলি নিলয়ের বিয়ের পরেই যেন হারিয়ে গেল। বিয়ের পরে ঠিক নয় অষ্টমঙ্গলার পরে শালিনীকে তাদের বাড়িতে রেখে নিলয় যখন একা ফিরল আর ঠিক তখনই সব কিছু যেনো এলোমেলো হয়ে গেল। হারিয়ে গেছে রাতে খাবার টেবিলে বাপ ছেলের একসাথে মলিনাদেবীর পিছনে লেগে তাকে রাগিয়ে দেওয়া, হারিয়ে গেছে মলিনা দেবী সামনের জিনিস রেখে যখন সেই জিনিসটাকেই সারা ঘরময় খুঁজে বেড়াচ্ছেন আর নিলয় ও তার বাবা দেখতে পেয়েও চুপচাপ দু'জন দু'জনের মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে চলেছেন।এই হারিয়ে যাওয়ার তালিকায় আছে আরো অনেক কিছু। সুখের ঘরটাতে হঠাৎ করেই কালবৈশাখী ঝড়ের দাপটে সবকিছু তছনছ করে দিয়ে গেছে ।আর সকলেই এত বিধ্বস্ত যে এই এলোমেলো ঘটনাগুলিকে মেনে নিয়ে সুখের নাগাল কেউ আর খুঁজে পাচ্ছে না।
একদিন সকালে নিলয়ের বাবা নরেশবাবু চায়ের আশায় ডাইনিং রুমে বসে ছিলেন।পেপার একটা হাতে থাকলেও সেদিকে তার ঠিক মন ছিল না এরইমধ্যে ল্যান্ড ফোনটা বেজে ওঠে ।নরেশবাবু না উঠে পেপারটার দিকে তাকিয়ে বসে থাকেন। রান্নাঘর থেকে মলিনাদেবী চিৎকার করে বলে ওঠেন,
--- ফোনটা ধরো, ফোনটা বাজছে কানের মাথা খেয়ে বসে আছো? আমার হয়েছে যত জালা; বাড়ির সকলের মন খারাপ আর আমি যেন আনন্দে আত্মহারা! সব কাজ আমি করবো, সব দিকে নজর আমি দেবো, অথচ কাউকে কিছু বললে সে তিড়িং করে উঠবে।
নরেশবাবু উঠে গিয়ে ফোনটা ধরেন। "হ্যালো" বলাতেই অপরপ্রান্ত থেকে যার গলার আওয়াজ তিনি পেলেন তার জন্য তিনি মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না।ফোনের অপর পাড়ে শালিনীর বাবা সত্যব্রত বাবু।
--- ব্যাপারটা আমার ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না দাদা-- ।
--- আপনার মত আমিও প্রথমে ব্যাপারটা বুঝতে পারিনি। পরে আমার ছেলে সব ঘটনা আমাদের খুলে বলে,যেগুলি আপনি জানেন অথচ লুকিয়ে গেছেন। কিছু মনে করবেন না দাদা, একটা কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি, আপনার এই গোয়ার্তুমির জন্য হ্যাঁ আমি গোয়ার্তুমিই বলবো- কথাটা শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্যি। আজকালকার ছেলেমেয়েদের মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে তাদের বিয়ে দিলে এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। আপনার মেয়ের যখন অন্য কারো সাথে সম্পর্ক রয়েছে তখন তাকে জোর করে এ বিয়ে দেওয়া উচিত হয়নি;এতে শুধু আপনার মেয়েরই নয় আমার ছেলের জীবনটাও নষ্ট করে দিলেন। যার ফলে আমি আমার ছেলের ব্যক্তিগত জীবনে এই ব্যাপারে মাথা ঘামাবো না বলেই ঠিক করেছি।আপনার যা ইচ্ছা তা করতে পারেন তবে হ্যাঁ এবার অন্তত যা করবেন মেয়ের মতামত টাকে গুরুত্ব দেবেন।
অপরপ্রান্ত থেকে উত্তরের অপেক্ষা না করেই তিনি ফোন কেটে দেন। রাগের ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে তিনি এসে তার পূর্বনির্ধারিত চেয়ারটাতে বসে পড়েন কিছুক্ষণ পরে রান্নাঘর থেকে মলিনাদেবী এসে বলেন,
--- ওই বাড়ি থেকে ফোন করেছিল না? আমি ঠিক জানতাম। তা কি বললে শুনি।
--- হ্যাঁ সত্যবাবু ফোন করেছিলেন। কিছু বলার সুযোগ আমি দিইনি আর দেবোই বা কেন? তিনি যা করেছেন অত্যন্ত অন্যায় করেছেন;জোর করে নিজের মতামতকে সন্তানের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। আজকের যুগে এমনটা কেউ করে? খামোখা দুটো ছেলে মেয়ের জীবন নষ্ট করা হলো,কিছু লোক হাসানো হলো,সর্বোপরি উভয় পরিবারের কিছু অর্থ নষ্ট হল। না-আমি এই ব্যাপারটাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিনা।
--- এ নিয়ে আর ভেবে কোন লাভ নেই।যা কপালে ছিল আমাদের তা হয়ে গেছে।এখন আমাদের ছেলেটাকে এ কষ্টের ভেতর থেকে কিভাবে বের করা যায় সেটা ভাবতে হবে।
মায়ের কথা শেষ হতে না হতেই নিলয় সেখানে এসে মাকে বলল,
-- মা চা দাও ।
--- হ্যাঁ বাবা বোস,দিচ্ছি।তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে চা টা নিয়ে এসে সব কথা বলছি।
কিছুক্ষণের মধ্যে মলিনাদেবী ছেলের জন্য চা এনে তার সামনে দিয়ে নিজেও একটা চেয়ার টেনে বসলেন।তারপর স্বামীর দিকে একটু তাকিয়ে নিয়ে ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
--- আমরা অনেকদিন কোথাও ঘুরতে যাইনি,মন মেজাজ কারোর ভালো না,চল না তিনজনে মিলে বাইরে কোথাও কটাদিন ঘুরে আসি তাতে মনে হয় আমাদের কিছুটা হলেও এই মন খারাপ কমবে।
নরেশবাবু স্ত্রীর কথাটিকে লুফে নিয়ে বললেন,
--- গিন্নি একদম আমার মনের কথা বলেছ।চলো তিনজনে মিলে বাইরে কোথাও ঘুরে আসি। নীলু তুই ব্যবস্থা কর। কোথায় যাব সেটাও তুই ঠিক করবি। ঘরের এই পরিবেশটা জেলখানার মতো মনে হচ্ছে।বাইরে গিয়ে একটু বুক ভরে অক্সিজেন নিয়ে ফিরে আসি।
নিলয় চুপ করে বাবা-মায়ের কথাগুলো শুনে বুঝতে তার একটু অসুবিধা হল না একমাত্র তার জন্যই তার বাবা-মা বাইরে যাওয়া মনস্থির করলেন।সুতরাং সে তাদের কথাকে সায় দিয়ে বলল,
--- ঠিক আছে তাহলে একটু চিন্তা করে দেখি কোথায় যাওয়া যায়।আমিও ভাবছিলাম তোমাদের বলব কথাটা।সত্যিই কেমন যেন একটা পরিবেশ হয়ে গেছে এক ঘরটার ভেতর এর থেকে বেরোনোর জন্য আমাদের একটু বাইরে বের হতেই হবে।
শেষমেশ তারা দার্জিলিং যাওয়াই মনস্থির করলেন
টিকিট পেতে একটু অসুবিধা হলেও দিন পনের মধ্যে নিলয় তিনটি টিকিট কেটে ফেললো। কিন্তু দার্জিলিং যাওয়ার আগে একটা বড় কাজ সম্পন্ন করার জন্য সে রিতেশকে ফোন করলো। রিতেশ এক রবিবার দেখে শ্বশুরবাড়িতে এসে উপস্থিত হলো।সাথে অবশ্যই তার স্ত্রী প্রমিতা। প্রমিতা এসেই দাদাকে প্রথম অভিযোগ,
--- তোরা ঘুরতে যাচ্ছিস আমাদের বললে তো আমরা যেতাম।একটু তো আমাদের বলতে পারতিস।
--- রিতেশ বোনের অভিমান বুঝতে পেরে তাকে বলল,
--- হঠাৎ করেই ঠিক হয়েছে রে,কোন প্লান প্রোগ্রাম ছাড়াই। তাই আর কাউকে কিছু জানানোর সুযোগ হয়নি।ঠিক আছে- আমরা এই ট্যুরটা করে আসি,পরেরবার আমরা পাঁচজনে একসাথে ঘুরতে বেরোবো।
নিলয় রিতেশকে নিয়ে তার ঘরে গিয়ে আলমারি খুলে শালিনীর টুকটাক যে গয়নাগাটি আর জামাকাপড় ছিল সবগুলি একটি ব্যাগে ভরে রিতেশ এর হাতে দিয়ে বলল,
---ভাই এই শেষ কাজটা তোমাকে করতেই হবে।কারণ আমি ওই বাড়িতে জীবনেও আর পা রাখবো না।
নির্দিষ্ট দিনে তিনজনে মিলে ট্রেনের কামরায় চড়ে তারা দার্জিলিং এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। রাত 10:30 এর ট্রেন সকাল প্রায় দশটা নাগাদ পৌঁছালো।কিন্তু সেখানে পৌঁছে এক গোল বাঁধলো।নিলয়ের মা হঠাৎ করেই বমি করতে শুরু করলেন।কাছেপিঠে খোঁজ নিয়ে নিলয় একজন ডাক্তারের কাছে তাকে নিয়ে গেল বাবাকে স্টেশন চত্বরে ভিতরেই একটা জায়গায় বসিয়ে রেখে। ডাক্তার চেকআপ করে তাকে কিছু ঔষধপত্র দিলেন এবং প্রেসার মারাত্মক হাই জানিয়ে দিলেন। নিলয়ের মা নিয়মিত প্রেশারের ওষুধ খান।কিন্তু এই কটাদিন তালেগোলে তিনি ওষুধ খেতে যেমন ভুলে গেছেন নিলয় এবং তার বাবাও তাকে মনেকরে দেওয়ার কথাটাও ভুলে গেছেন। পরিণামে এই বিপত্তি!সেদিন আর নিলয় তার মা বাবাকে নিয়ে শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং রওনা হতে সাহস পেল না।একটা হোটেল বুক করে সেখানেই একরাত থাকবে বলে মনস্থির করল এবং বাবাকে সে কথা জানালো। নরেশবাবু নিলয়ের এই যুক্তিকে সমর্থন করলেন। একরাত শিলিগুড়ি হোটেলে কাটিয়ে পরদিন ভোর বেলা মলিনাদেবী কিছুটা ধাতস্থ হলে নিলয় তার মা বাবাকে নিয়ে একটা গাড়ি বুক করে দার্জিলিং এর উদ্দেশ্যে রওনা হল।
মানুষের যতই বয়স হোকনা কেন বাইরে বেড়াতে বেরোলে সকলের মনেই একটা অদ্ভুত আনন্দ বিরাজ করে। পাহাড়ী রাস্তা,দুপাশে খাদ্য দেখতে দেখতে চলা।মাঝে মধ্যে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ইস্টদেবতার নাম স্মরণ করা।তবে গাড়ির পাইলট ছেলেটি খুব ভালো।তার গাড়ি চালানোর হাতটাও খুব ভালো।ছেলেটিকে নিলয়ের এতটাই ভালো লেগে যায় যে সে তাদের দার্জিলিং ঘোরার পুরো সফরসঙ্গী করে ফেলে দোদুলকে ।
ক্রমশঃ
No comments:
Post a Comment