ভালোবাসার পূর্ণতা
জীবনের প্রথম ভালোবাসা কেউই ভুলতে পারেনা।অপরিণত বয়সের ভালোবাসা অধিকাংশ সময় পূর্ণতা পায়না।স্কুল কিংবা কলেজ জীবনের সহপাঠীর সাথে প্রেম অনেকের জীবনেই ঘটে থাকে।কিন্তু ছেলেটির স্টাবলিশ হওয়া পর্যন্ত অনেক পরিবারই মেয়েটিকে বসিয়ে রাখেনা।তার পড়াশুনা শেষ হয়ে গেলেই নিজ পায়ে দাঁড়ানোর অন্য কোন ছেলের সাথে তার বিয়ে দিয়ে দেন।অনেক মেয়েই আছে পরিবারের শান্তি রক্ষার্থে সে তার ভালোবাসার বলিদান দেয়।আর তার প্রেমিকটি থাকে তখন অসহায়!
ঈশিকা আর অমল যখন একাদশ শ্রেণী তখন থেকেই দুজনের মধ্যে এক সুন্দর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক।যা উচচমাধ্যমিক পরীক্ষার পর ভালোবাসায় পরিণত হয়।জয়েন্ট এন্ট্রান্স এ চান্স পেয়ে অমল সরকারিভাবে ডাক্তারী পড়ার সুযোগ পায়।আর ঈশিকা বাংলায় অনার্স নিয়ে কলেজে ভর্তি হয়। ঈশিকা সুন্দরী।সেই কলেজেরই তরুণ প্রফেসর ঈশিকাকে দেখে মুগ্ধ হন।তিনি তার বাবা মাকে দিয়ে ঈশিকাদের বাড়িতে বিয়ের সন্বন্ধ পাঠান।বলাবাহুল্য ঈশিকার বাবা মা এ প্রস্তাব লুফে নেন। ঈশিকা অনেক চেষ্টা করে বিয়েটাকে আটকাতে। কিন্তু বাবা-মায়ের ইমোশনের কাছে হার মানতে বাধ্য হয়। অমলকে সবকিছু জানায়। কিন্তু অমলের তখন ফোর্থ ইয়ার।কলেজ কামাই করার কোন উপায় নেই ।সে আসতে পারে না।যা কথা হয় ফোনেই। অমল তখন অসহায়!সেই মুহূর্তে তার তখন কিছুই করার নেই।
ঈশিকা বিয়ের পর স্বামী দেবব্রতর সাথে তার শ্বশুরবাড়ি ঠাকুরপুকুর চলে আসে।পড়াশুনায় তার আর মন ছিল না। তবুও স্বামীর অনুরোধে সে ফাইনাল পরীক্ষাটা দেয়।পাসও করে যায়। কিন্তু প্রথম ভালোবাসা হারিয়ে মনটা ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর কোন চেষ্টাই সে আর করে না।
অমল আর ঈশিকার প্রেমকাহিনী হয়তো এখানেই থেমে যেতে পারতো;যদি না বিয়ের দশ বছর পরে তাদের আবার ঘটনাক্রমে দেখা হতো। অমল এখন নামকরা একজন গাইনোকোলজিস্ট। বিয়ের দশ বছর পরেও ঈশিকা মা হতে পারেনি।জন্মগত কিছু সমস্যা থাকার কারণে। অনেক ডাক্তার সে দেখিয়েছে। কিছু ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ছোটখাটো অপারেশনও করিয়েছে।কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।কিছুদিন ধরেই গাইনোকোলজিস্ট এ. রায় চৌধুরীর নাম শুনছে।শেষ চেষ্টা অনুযায়ী তাকে একবার দেখানোর ইচ্ছা তার। একমাস আগে ডক্টর এ. রায় চৌধুরীর অ্যাপোয়েন্টমেন্ট নিতে হয়।দেবব্রত অনেক চেষ্টা করে অ্যাপোয়েন্টমেন্ট নেয়। নির্দিষ্ট দিনে স্বামীকে সাথে নিয়ে ঈশিকা আসে ডক্টর রায়চৌধুরীকে দেখাতে। সে স্বপ্নেও কল্পনা করেনি তার জন্য কি অপেক্ষা করে আছে।সিরিয়াল অনুযায়ী স্বামীকে সাথে নিয়ে সে রায়চৌধুরীর রুমে ঢোকে। ডাক্তারবাবু হাতের ইশারায় তাদের বসতে বলেন। কিন্তু রুমে ঢুকেই ঈশিকা বুঝতে পারে তার সামনেই ডাক্তার হয়ে আজ যে বসে আছে সে আর কেউ নয় তার প্রথম জীবনের ভালবাসা।
ঈশিকার চিনতে এক মুহূর্ত সময় না লাগলেও অমল কিন্তু প্রথম অবস্থায় ঈশিকাকে চিনতে পারেনি। অমল চিনতে পারে ঈশিকার গলার আওয়াজে। ঈশিকার মুখটা চেনা চেনা লাগলো ব্যস্ততার কারণে অন্য কোনো কথাই না গিয়ে সে সরাসরি তার সমস্যা জানতে চায়। ঈশিকা আগেই নিজেকে সামলে নিয়েছে।যেহেতু অমল তাকে চিনতে পারেনি বা চিনলেও কোন কথা বলেনি তাই ঈশিকাও নামকরা ডাক্তারের সম্মান রক্ষার্থে সে সরাসরি কোন জড়তা না রেখেই সে তার সমস্যার কথা শুরু করে।
ঈশিকার গলার আওয়াজ শুনে অমল তাকে চিনতে পারে। কিন্তু ধরা দেয় না। ঈশিকার সমস্ত রকম পুরনো কাগজপত্র ঘেঁটে মনোযোগ সহকারে অনেকক্ষণ বসে সেগুলো দেখে ঈশিকাকে শুধুমাত্র দুটো ঔষধ দিয়ে একমাস পর আসতে বলে দেয়।
পরদিন অমলের চেম্বারে বেরোনোর কিছুক্ষণ আগে ঈশিকা প্রেসক্রিপশন এর উপরের নাম্বারটা দেখে অমলকে ফোন করে।
--- অমল দা আমি ঈশিকা বলছি --
অমল প্রথম অবস্থায় একটু ঘাবড়ে যায়।পরে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
-- হ্যাঁ বল কেমন আছো?
--- কেমন আছি আমি সে তো তুমি কালকে সব শুনলে। তুমি কেমন আছো? বাড়ির সবাই ভালো আছে তো?
--- বাবা বছর-পাঁচেক হল মারা গেছেন। মা আছেন, বাধ্যক্য জনিত কারণে নানান রোগে ধরেছে, এই চলছে আরকি?
--- আর তোমার বউ-বাচ্চা? তারা কেমন আছে?
অমল তখন বলে উঠে একটা ইমার্জেন্সি ফোন আসছে হয়তো কোন পেশেন্টের ফোন হবে । পরে তোমার সাথে কথা হবে তুমি একদম চিন্তা করো না। আমি তোমাকে আশ্বাস দিচ্ছি তোমার কোল শুন্য থাকবে না। মা ডাক তুমি শুনবেই খুব তাড়াতাড়ি।
অমল ফোনটা কেটে দেয়।না, সে বলতে পারেনি যে সে বিয়ে করেনি। যে জায়গাটা সে ঈশিকাকে দিয়েছিল সেই জায়গাটা অন্য কাউকে কোনদিনও দিতে পারবে না। কিন্তু এ কথা ঈশিকাকে জানিয়ে তার মনে পুরনো ব্যাথাটাকে উসকে দিতে সে পারবে না। ডাক্তারি পাশ করার পর ন'বছরের জীবনে এবার এসেছে এক কঠিন পরীক্ষা। সেই পরীক্ষায় যেভাবেই হোক তাকে পাস করতেই হবে। ঈশিকার মুখে হাসি ফোটাতেই হবে।
বছরখানেক অমলের আন্ডারে ট্রিটমেন্ট থাকার পর সেই শুভক্ষণটি ঈশিকার জীবনে আসে।সে তার স্বামী দেবব্রতকে সঙ্গে করে নিয়ে এসে ডক্টর এ. রায়চৌধুরীকে জানায় যে সে মা হতে চলেছে।এই কথাটি শুনে আনন্দে অমলের চোখে জল এসে গেছিল সে সময় ।কিন্তু নিজেকে অদ্ভুতভাবে সামলে নিয়ে ঈশিকা এবং তার স্বামীকে সে কনগ্র্যাচুলেট করে।
দেখতে দেখতে দশ মাস দশ দিন কেটে যায়।আজ লেবার রুমে ডক্টর রায়চৌধুরী সিজার করবেন তার প্রাক্তন প্রেমিকা ঈশিকা মুখার্জিকে। প্রথম দিকে ডক্টর রায়চৌধুরীর হাতটা একটু কাঁপলেও কিছুক্ষণ পরেই তিনি নিজেকে শুধুমাত্র একজন ডাক্তার হিসেবেই কল্পনা করেন প্রেমিক হিসাবে নয়। সুন্দর ফুটফুটে একটি কন্যা সন্তানকে তিনি তুলে দেন ঈশিকার কোলে। ঈশিকার জীবন মাতৃত্বের অহংকারে পূর্ণ হয়। আর ডক্টর রায়চৌধুরী ওরফে অমল এতদিন পরে তার ভালোবাসার পূর্ণতা খুঁজে পায়।
No comments:
Post a Comment