সুখের ঘরে আগুন (১৬)
আমি আমার জীবনে বাবা মাকে একসাথে হারিয়েছি, ভালোবাসা হারিয়েছি।অপরদিকে নন্দাও ঠিক তাই।সুতরাং নন্দার কষ্টটাকে আমি ফিল করতে পারি।আমি অনেক ভেবে স্থির সিদ্ধান্তে এলাম আমাদের বাঁচতে হবে দুজন দুজনকে আঁকড়ে।একই ছাদের তলায় অথচ বেশ কয়েক যোজন দূরে। আমি নন্দাকে খুব ভালবাসতাম।নন্দার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর ও সুখে আছে জেনে আমিও ভালো ছিলাম। কিন্তু আজ ওর পরিস্থিতি দেখে প্রতিটা মুহূর্তে কষ্টে আমার বুক ফেটে যায়। একদিন নন্দাদে র বাড়িতে আমি ড্রয়িং রুমে ঘুমিয়ে আছি।অনেক রাতে হঠাৎ দেখি খুব সেজেগুজে নন্দা কারও সাথে কথা বলতে বলতে দরজা খুলে বেরিয়ে যাচ্ছে। আমি গিয়ে ওর হাত ধরে টানলাম।পিছন ফিরে আমাকে দেখে বলল,
---তুমি এখানে?ওই দেখো, বিরেশ আমাকে ডাকছে, আমি বিরেশের সাথে যাচ্ছি কিন্তু ও কিছুতেই আস্তে হাঁটছে না। আজ ও আমাকে দার্জিলিং নিয়ে যাবে বলেছে খুব ঘুরবো দুজনে।
আমি নন্দার কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম।ওর হাতটা ধরে রেখেই লাইটটা জ্বালিয়ে দিলাম। নন্দার সম্বিত ফিরে এলো কিছুটা।আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
-- বিরেশ আমাকে দার্জিলিং ডাকছে।তুমি তাড়াতাড়ি বাড়িটা বিক্রি করে দাও।আমাকে দার্জিলিং নিয়ে চলো।বিরেশ একা একা ওখানে থাকতে পারছে না। আমাকে পৌঁছে দিয়ে তুমি চলে এসো।আমি কখনো তোমায় আটকাবো না।আর তুমি থাকলে বিরেশ আমার কাছে আসতে পারবে না।
আমার জীবনে সব হারিয়ে আমি নিঃস্ব।চাকরি, বাড়ি দিয়ে আমি আর কি করবো?তাই খুব তাড়াতাড়ি জলের দামে আমার বাড়িটা বিক্রি করে দিলাম সাথে নন্দাদের বাড়িটাও। ছেড়ে দিলাম স্কুলের সরকারি চাকরিটা।নন্দাকে বাঁচিয়ে রাখা এবং ভালো রাখার তাগিদে চলে এলাম দার্জিলিং। বেশকিছুদিন হোটেলে ছিলাম।প্রথমদিন হোটেলে এসেই নন্দা আমাকে বলল, আমি যেন দুটো রুম বুক করি।অবাক হইনি।কারণ আমি জানি নন্দার মনে আমার জন্য কোন জায়গা কোনদিনও ছিলো না আজও নেই।আমি তাই করলাম।প্রতিটা রাত আমি না ঘুমিয়ে কাটাতাম।সব সময় একটা আতঙ্ক কাজ করতো এই বুঝি নন্দা হোটেলের রুম থেকে বাইরে বেরিয়ে গেলো।কিন্তু একটা ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম রুম থেকে বাইরে বেরোলেও হোটেল ছেড়ে সে বেরোতে পারবে না।বড় গেটের আগেই ছিল একটা বড় কলাপসিবল গেট।
সাতদিনের মত থেকে দুই কামরার একটা বাড়িতে ভাড়া উঠে এলাম।এখানে আসার পর নন্দার পরিবর্তন হতে লাগলো।তবে রাতেরবেলা বন্ধ দরজার ভিতরে নন্দা অনর্গল কারও সাথে কথা বলতো।সকালে জানতে চাইলে মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো।আমিও জোর করতাম না।রান্নাবান্না,ঘরের কাজ সবকিছুই নিজের হাতে করতো।প্রয়োজন না হলে কখনই আমার সাথে কথা বলতো না।বেকার ঘরে চুপচাপ বসে থাকতে ভালো লাগতো না।কাজের চেষ্টা করতে লাগলাম। শেষমেষ বাড়ীওয়ালার পরামর্শে পাহাড়ী রাস্তায় ড্রাইভিং শিখে ,লাইসেন্স পেয়ে ভাগ্যের হাতে নিজেকে সঁপে দিলাম।দুবছরের মধ্যে এই ছোট্ট বাড়িটা কিনলাম দুজনের বাড়ি বিক্রির টাকায়।নন্দা কিন্তু এখন পুরো সুস্থ্য।এখন আর ও রাতেরবেলা একাএকা কথা বলেনা।আমার খুব খেয়ালও রাখে।কিন্তু এক বাড়িতে থেকেও মনের দিক থেকে আমরা শত আলোকবর্ষ দূরে।আর নন্দার ওই মাথাভর্তি যে সিঁদুর সে কিন্তু ওর স্বামী বিরেশেরই দেওয়া।কারণ ও আজও মনে করে বিরেশ বেঁচে আছে।আজও আমি ওর মনটাকে ছুঁতে পারিনি।কিন্তু আমি ওকে ভীষণ ভালোবাসি আজও।
একনাগাড়ে কথাগুলি বলে দোদুল চুপ করলো। নিলয় ও চুপ করে বসে।দোদুলের জীবনের এই কাহিনী শুনে কি বলা উচিত নিলয়ের তা জানা ছিলোনা।তাই সে চুপ করে বসে থাকলো। নিলয়কে চুপ করে থাকতে দেখে দোদুলই আবার শুরু করলো,
--- এতগুলো বছর ধরে মনের মধ্যে যে কথাগুলি লুকিয়ে রেখেছিলাম তা আজ তোমার কাছে বলতে পেরে নিজেকে খুব হালকা মনে হচ্ছে।আমি জানিনা আমার এই ভালোবাসাকে তুমি কি নাম দেবে?আমি মনেকরি এই জনমে কাজের ভালো-মন্দের ফল এই জনমেই ভোগ করে যেতে হয়।আর সেই কথা বিশ্বাস করেই আমি বলছি, নন্দা একদিন না একদিন মুখ ফুটে আমাকে তার ভালবাসার কথা জানাবে। আর যতদিন না সে তার ভালোবাসার কথা আমাকে জানায় আমি সেই আশাতেই বেঁচে থাকবো।
ফেরার সময় দোদুলই তাদের শিলিগুড়ি পৌঁছে দেয়।নিলয় দোদুলের পাশেই বসে ছিল। গাড়ি চালাতে চালাতে দোদুল নিলয় কে বলল,
--- আমার জীবনের সব ঘটনা শোনার পরই তুমি খুব চুপচাপ হয়ে গেছো।আমাকে তো তুমি কোন কিছু বললে না দাদা?তোমার কি মনে হয় দাদা?আমি চাকরি ছেড়ে, নিজের বাড়ি বিক্রি করে,জীবনের সব শখ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে নন্দাকে নিয়ে এখানে চলে এসে কি কোন ভুল করেছি?
নিলয় একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বলে,
--- না ভাই তুমি কোন ভুল করনি।তুমি নন্দাকে ভালবেসেছ আর ভালোবাসার জন্য মানুষ সবকিছু ত্যাগ করতে পারে। সবাই অবশ্য পারেনা তবে সত্যিকারে ভালবাসায় ত্যাগের পরিমাণটা বেশিই থাকে। নন্দা একদিন তার ওই অলৌকিক জীবন ছেড়ে ঠিক বাস্তবে ফিরে আসবে আর সেদিনই সে সম্পূর্ণরূপে তোমার ভালোবাসাকে উপলব্ধি করতে পারবে।
নিলয়ের কথাগুলো শোনার পর দোদুলের বুক চিরে একটা বড় দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। নিলয় চোখ বন্ধ করে আসবার সময় ঘটনাগুলোর ভাবতে থাকে।তারা যখন বেরিয়ে আসবে নন্দিনী এসে নিলয়ের বাবা মাকে প্রণাম করে।হাত জোড় করে নিলয়কে নমস্কার জানায়।আর বলে, "যদি কখনো আবার এদিকে আসেন আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসবেন দোদুলের ভালো লাগবে।"নিজের ভালবাসার প্রতি নিলয়ের খুব আস্থা ছিল।কিন্তু দোদুলের ভালোবাসার কাছে তার ভালোবাসা হেরে গেছে। দোদুলের মত করে সে নন্দিনীকে ভালবাসতে পারিনি।নন্দিনীর জন্য নিজের জীবনের সব শখ আহ্লাদ বিসর্জন দিতে পারেনি কিন্তু দোদুল পেরেছে নন্দিনীর জন্য জীবনের সবকিছু বিসর্জন দিতে। সব সময় নিলয় তার ভাগ্যকে দোষারোপ করেছে।কিন্তু তার ভাগ্যের থেকেও আজ মনে হচ্ছে দোদুল ও নন্দিনীর ভাগ্য আরো বেশি খারাপ। শালিনীকে বিয়ে করে তার জীবনে একটা সামান্য ঘটনা ঘটে গেছে মাত্র ! কিন্তু দোদুল ও নন্দিনীর জীবনে ঘটনাপ্রবাহ আরো বেশি ভয়ংকর। সেখানে তার জীবনের ঘটনা অতি তুচ্ছ!তাই সে ঠিক করে তার জীবনের এই সামান্য ঘটনা নিয়ে সে আর ভাববে না। আসলে মানুষের ভাগ্যে যা থাকে তা ঘটবেই। কখনও কেউ তা খন্ডন করতে পারে না;চেষ্টা করতে পারে কিন্তু ভাগ্যকে কেউ আটকাতে পারে না।
বাড়িতে ফিরে পরদিনই সে অফিস জয়েন করে।চেষ্টা করে সবকিছু ভুলে নতুন করে শুরু করতে।নন্দিনী ও দোদুলের জীবনের ঘটনা তাকে যেন আরো বেশি করে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। ছ'মাস না গেলে শালিনীকে ডিভোর্স এর নোটিশ পাঠানো যাবে না রিতেশ জানিয়েছে। বাড়িতে ফিরেই সে তার বোন ভগ্নিপতিকে ফোন করেছে তাদের কুশল জেনেছে। প্রমিতার প্রশ্নের উত্তরে সে জানিয়েছে বাইরে থেকে ফিরে এসে তারা তিনজনই চাঙ্গা হয়ে গেছে। আর ঘটনাটাও ঠিক ; বাড়ি পরিবেশটাই যেন ঘুরে আসার পর পূর্বের মত না হলেও পরিবর্তন হয়েছে।বাড়িতে এখন সব সময় বাবা মা এর আলোচ্য বিষয় দোদুল আর নন্দা। বাবা-মা দুইজনই তাদেরকে কলকাতায় আসার নিমন্ত্রণ করে এসেছেন। দোদুল চুপ থাকলেও নন্দা কিন্তু বাবা মাকে কথা দিয়েছে সে দোদুলকে নিয়ে কলকাতায় আসবে। আর এই কথা শুনে নিলয়ের মনে হয়েছে,নন্দা দোদুলকে ভালবাসতে শুরু করেছে।কিন্তু লজ্জা বা যে কোন কারনেই হোক দোদুলের কাছে তা প্রকাশ করতে পারছে না।
ক্রমশঃ
No comments:
Post a Comment