Saturday, January 16, 2021

সুখের ঘরে আগুন(১৪)

সুখের ঘরে আগুন (১৪)

   সাতদিনের ট্যুর।যেতে আসতে দুদিন আর দার্জিলিঙে ঘোরার জন্য পাঁচটা দিন।কিন্তু শিলিগুড়িতে কেটে গেল একটা দিন। সব শুনে দোদুল বললো,
---  কোন চিন্তা করবেন না দাদা।আমি আছি তো,এই সময়ের মধ্যেই আমি আপনাদের দর্শনীয় সমস্ত জায়গায় নিয়ে ঘুরে বেড়াবো।
 দোদুলকে নিলয়ের এতটাই ভাল লেগে গেল যে  তারা কোন হোটেলে খাবে,কোথায় টিফিন করবে সবকিছুই যেখানে ঘুরতে গেছে সেখানে দোদুলই ঠিক করছে।তাতে সুবিধা একটা হয়েছে বৈ কি -- এইসব জায়গাগুলোতে দোদুলের আসা যাওয়া প্রায় রোজই।তাই কোন হোটেল ভালো,কোন জায়গা দিয়ে গেলে ভাল হবে সবকিছুই দোদুলের নখদর্পণে। নিলয় তার বৃদ্ধ বাবা-মা দুজনকে একা সামলাতে যখন হিমসিম খাচ্ছিল তখন এই দোদুল ছেলেটিই নিলয়ের পাশে থেকে একজনকে সামাল দিচ্ছিল আর বাকি একজনকে নিলয় দেখছিল। নিলয়ের বাবা মা ও ছেলেটির ব্যবহার দেখে তার প্রতি খুব দুর্বল হয়ে পড়লেন।দোদুলের সাথে নিলয়ের মা তার পারিবারিক সমস্ত খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে শুরু করলেন।শেষ পর্যন্ত তিনি বায়নায় ধরে বসলেন দোদুলের বাড়িতে যাবেন।এ কথা শুনে দোদুলও খুব খুশি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে হাতে তো সময় আগেই একদিন কমে গেছে।তাহলে দার্জিলিং ঘোরা শেষ করে যাওয়ার পথে দোদুলের বাড়ি হয়ে যাওয়া যেতে পারে। সেইমতো দার্জিলিং ঘোরা, কেনাকাটা করা সব শেষ করে বাক্স-পেটরা নিয়ে দোদুলের গাড়িতেই তার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়া হল।নিলয় মনে মনে ভাবতে লাগলো মায়ের এ এক অদ্ভুত খেয়ালে মত দিয়ে ঠিক করলো না মনেহয়।দোদুলের বাড়িতে গেলেই তার কিছু খরচ হবে,আর এ কদিনে সে দোদুলকে যতটা চিনেছে তাতে তার মনে হয়েছে তাকে কোন টাকা দিতে গেলেও সে নেবে না।কিন্তু এই মুহূর্তে মায়ের মনে আঘাত দিতে পারছে না।বাবারও কোন হেলদোল নেই। বাড়িতে ফেরার কোন ইচ্ছা তার আছে বলে মনেহচ্ছে না।তিনি যেন আরো বেশি বাড়ির বাইরে থাকতে ভালোবাসছেন।বাড়িটাই সকলের কাছে বিভীষিকাময় হয়ে দাঁড়িয়েছে।কেউই বাড়ি ফিরতে চাইছেন না।কিন্তু নিলয়ের তো অফিস আছে।দার্জিলিং ঘুরতে এসে বাবা-মায়ের মনে এই খুশির দেখে সেও খুব খুশি হয়ে গেছে।
    অপরদিকে নিলয়ের বাবা মা দুজনে ফিসফিস করে আলোচনা করে চলেছেন;বাড়িতে গেলেই তো ছেলেটা আবার মন খারাপ করে থাকবে তার থেকে যে কটা দিন ওকে নিয়ে বাইরে ঘোরাঘুরি করা যায়।
দোদুল আগেই ফোন করে দিয়েছিল তার স্ত্রীকে। পাহাড় আর সবুজে ঘেরা দোদুলের বাড়ি দেখে নিলয়ের বাবা-মা তো বটেই নিলয় নিজেও অবাক হয়ে শুধু বাড়িটাকেই  দেখছে। এত সুন্দর বাড়ি !এত সুন্দর সাজানো গোছানো, বাড়ির চতুর্দিক তো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য আর বাড়ির ভিতরে? যেন এক স্বর্গপুরী। ছোট্ট ছোট্ট প্লাস্টিকের গ্রো ব্যাগগুলিতে নাম না জানা অজস্র ফুল ফুটে আছে ।তাদের দিকে তাকিয়ে থাকলে মন এক নিমিষে ভালো হয়ে যায়।
 নিলয়, তার মা,আর বাবা সকলে মিলে ড্রইং রুমে বসে গল্প করছিলেন।সেখানে চা নিয়ে আসে দোদুলের স্ত্রী। দোদুলের স্ত্রী ট্রে হাতে যখন ঘরে ঢোকে তখন সে বেশ কিছুটা খুঁড়িয়ে হাঁটছিল। তাই নিলয় তখন ঠিক সেই মুহুর্তে তার মুখের দিকে না তাকিয়ে  তার পায়ের দিকে তাকিয়ে তার হাঁটাটা খেয়াল করছিল। কিন্তু দোদুলের স্ত্রী ট্রেন হাতে চায়ের কাপ নিয়ে এসে টেবিলে না রেখে নিলয়ের মুখের দিকেই তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। হঠাৎ করেই নিলয় তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে উঠে দাঁড়ায়। বিস্ময় মিশ্রিত কন্ঠে নিলয় বলে ওঠে,
----  তুই এখানে?
কথাটা বলেই নিলয় নিজেকে সামলে নেয়।ধপ করে একটা বেতের চেয়ারে বসে পরে।কিন্তু কথাটা এত আস্তে বলে ঘরের মধ্যে বাকি মানুষগুলি শুনতে পায়না।অবাক হয় দোদুলের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে।দেখে সে চা টা টেবিলে রেখে ঘর থেকে আস্তে আস্তে বেরিয়ে যাচ্ছে।নিলয় বুঝতে পারে তার ও দোদুলের স্ত্রীর মধ্যে যে একটা পরিচয় ছিল সেটা সে কাউকে জানাতে চায় না। কিন্তু নিলয় কিছুতেই বুঝতে পারেনা নন্দিনী কি করে দোদুলের স্ত্রী হল?
  নন্দিনী ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলো।জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখে দোদুল গোটা মুরগীটা কাটার তসরত করে চলেছে।নিলয়ের বাবা,মা ঘর থেকে বেরিয়ে বাড়ির চারিপাশটা ঘুরে ঘুরে দেখছেন। আজ দুজনে অনর্গল ফিশফিশ  করে কথা বলে চলেছেন। নিলয় হতভম্বের মত ঘরের মধ্যেই চুপচাপ বসে। মাংস কাটা শেষ হয়ে গেলে দোদুল ঘরে এসে বলে,
---  দাদা এখানে একা একা বসে কি করছো?বাইরে চলো। আজকে তোমাদের যেতে দেবো না। আজকের রাতটা তোমরা এখানে থেকে যাবে।এতদিন এখানে বাস করছি, পাহাড়িয়া অঞ্চলে গাড়ি চালাচ্ছি কিন্তু কারো সাথে এত ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি।তোমাকে মনেহচ্ছে আমার নিজের দাদা আর মাসিমা মেসোমশাই কে মনেহচ্ছে যেন আমার বাবা-মা ফিরে এসেছেন।একটা দিন আমার এখানে থেকে যাও।অনেকদিন পরে আজ মনটা খুব ভালো লাগছে।
--- তা হয় না ভাই।আমার অফিস আছে, ছুটি শেষ।পরে নাহয় আবার আসা যাবে। যদি কিছু মনে না করো একটা কথা জিজ্ঞেস করতাম--- ।
---- না না মনে করবো কেন?বলো না তুমি কি বলতে চাও।
--- তোমাদের দেখে মনেহচ্ছে তোমরা আদতে বাঙ্গালী। তা এখানে তোমরা এলে কি করে ?
---  সে এক ইতিহাস দাদা। এখন চলুন আমরা স্নান করে নিই। বলবো আপনাকে সব বলবো।আপনাকে আমার ভীষণ ভালো লেগেছে ,নিজের কাছের মানুষ মনে হয়েছে।এই কথাগুলি আজ পর্যন্ত কেউ কোনদিনও জানতে চায়নি। আমাদের দুজনের মনেই এই কথাগুলি রয়েছে।তাই আপনি যখন আজ জানতে চাইছেন আপনাকে আমি পুরো ঘটনাটাই জানাবো। কিন্তু এখন না,নন্দা শুনে ফেলবে।আমি আপনাকে ঠিক সময় করে যাওয়ার আগে সব বলবো।তবে আবারো বলছি আজকের রাতটা আপনারা থেকে যান, আমাদের দুজনেরই খুব ভালো লাগবে।কারণ আমরাও যে কলকাতারই মানুষ। কলকাতার মানুষ দেখলেই মনেহয় তারা আমার খুব কাছের।কিন্তু কারো সাথেই এত হৃদ্রতা কোনদিন গড়ে ওঠেনি।
--- ঠিক আছে,এত করে যখন বলছো বাবা মাকে জিজ্ঞেস করি তারা যদি রাজি হন আজ রাতটা না হয় আমরা তোমার বাড়িতেই থেকে যাবো।
  কিন্তু সেই একবারই নন্দিনী সকলের সামনে এসেছিল আর আসেনি।ইচ্ছাকৃত সে নিজেকে যেন একটা খোলসের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে বা পুরনো কথাগুলো মনেকরে আর আজকে তার এই পরিস্থিতিতে সে নিজেকে নিলয়ের কাছ থেকে দূরে রাখতে বাধ্য হয়েছে।নিলয় বহুবার চেষ্টা করেছে নন্দিনীর সাথে একটু একাকী কথা বলার।কিন্তু নন্দিনী তাকে সে সুযোগ কোন অবস্থাতেই দেয়নি। রাতে খাওয়া দাওয়ার পরে নন্দিনী যখন তাদের সকলের শোয়ার ব্যবস্থা করছে এই সুযোগ পেয়ে নিলয় এসে সে ঘরে ঢোকে।নন্দিনী নিলয়কে দেখতে পেয়ে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মুখে নিলয়কে বলে,
--- আমি আশা করব পুরনো কোনো কথা তুই তুলবি না। আমার জীবনে অনেক কিছু ঘটে গেছে যার হিসাব আমি নিজেই মিলাতে পারিনি।আর তাই আমি এই ব্যাপারটা নিয়ে কারো সাথে কখনোই কোন আলোচনা করিনা।যা আমার ভাগ্যে ছিল তাই হয়েছে।জীবনে অনেক কিছুই হেলায় উপেক্ষা করেছি।কিন্তু নিজেকে কখনোই বিলিয়ে দেইনি কারো কাছে। বিশ্বাস ছিল ভাগ্যের প্রতি কিন্তু সবই ছিল যেন বালির বাঁধ। ভাগ্য আমার বিরূপ ছিল তাই যা ঘটেছে তার জন্য আমি দায়ী নই;এটা আমার দুর্ভাগ্য! এই দুর্ভাগ্যটাকেও আমি মেনে নিয়েছি।তবে হ্যাঁ দোদুল খুব ভালো ছেলে আমার খুব কেয়ার করে।
   নিলয়কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তার পাশ কাটিয়ে সে অন্য ঘরে চলে গেল।নিলয় হতভম্বের মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো।সত্যিই সে নন্দিনী মনের গভীর তল কোনদিন পায়নি আজও পেল না। অপেক্ষা করতে লাগল দোদুলের জন্য।দোদুল আসলেই  নন্দিনীর জীবনের এই ঘটনাটা সে জানতে পারবে। তাকে জানতেই হবে সবকিছু।কারণ বন্ধুদের কাছে সে শুনেছিল সেন্টাল গভমেন্টের চাকরি করা ছেলের সাথে নন্দিনীর বিয়ে হয়েছিল।যদি তাই হয় আজ কেন দোদুলের সাথে দার্জিলিংয়ের এই পাহাড় ঘেরা অঞ্চলে সমস্ত আত্মীয়স্বজন বর্জিত অবস্থায় একজন গাড়ির ড্রাইভারের সাথে তার সংসার?কেন নন্দিনী খুঁড়িয়ে হাঁটে?ওর বাবা,মা কোথায়?কিভাবে দোদুলের সাথে ওর পরিচয়?কলকাতা থেকে পাকাপাকি ভাবে কেন দার্জিলিং চলে এলো?তাকে জানতেই হবে সব।

ক্রমশঃ। 


    

No comments:

Post a Comment