Tuesday, January 26, 2021

সুখের ঘরে আগুন (২০)

সুখের ঘরে আগুন (২০)

   রিসেপশনের দিন সকালে নিলয় আর প্রলয় প্রচণ্ড ব্যস্ত।উভয় পক্ষের কিছু বন্ধুবান্ধব ইতিউতি ঘোরাঘুরি করছে। সুযোগ পেয়ে নিশিতা অম্বিকাকে ডেকে বলল,
--- হ্যাঁরে তোকে একটা কথা বলব যদি কিছু মনে না করিস  আর অনুমতি দিস সাথে অভয়টাও মাস্ট --- 
বলেই হাসতে লাগলো ।
অম্বিকা চোখ বড় বড় করে নিশিতার দিকে তাকিয়ে বলল, ---বাব্বাহ  বিয়ে হওয়ার সাথে সাথেই তুই কত ন্যাকা হয়ে গেছিস --।
--- ন্যাকা ট্যাকা না , আসলে এই ব্যাপারটাতে আমি খুব সিরিয়াস।তার কারণ কথাগুলো শোনার পর আমাকে হয়তো গলা টিপে মেরেও ফেলতে পারিস;তাই চারিপাশ থেকে সর্ব রকম প্রটেকশন নিয়েই আমি কথাগুলো তোকে বলতে চাই।
--- এই ভনিতা না করে কি বলবি পরিষ্কার করে বলতো? এমনিতেই তো তোর বিয়েতে আমাকে যা খাটালি অবশ্য আমি  একা না সাথে নিলয়দাও আছে।
--- নিলয়দার জন্য তোর খুব দরদ দেখছি।
---- এতে দরদের কি আছে বুঝলাম নাতো?
--- কিছু একটা গন্ধ পাচ্ছি, এটাই আমাকে খুঁজে বের করতে হবে গন্ধের উৎসটা কি?
--- কি  হেঁয়ালি করছিস বুঝতে পারছি না।একটু ঝেড়ে কাশ পরিষ্কার করে বল।
  ওদের কথার মাঝখানেই নিলয় প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে ওরা যে ঘরে বসে ছিল সে ঘরে এসে ঢুকলো।অম্বিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
---এখানে বসে থাকলে হবে? ভাত-কাপড়ের অনুষ্ঠানটা তো করতে হবে।
 অম্বিকা অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
--- ভাত-কাপড়ের অনুষ্ঠান করতে তো সধবা মানুষের দরকার।আমি কি করে করবো? আমার তো বিয়েই হয়নি।
 কথাটা বলেই সে খিলখিল করে হাসতে লাগলো।নিশিতা তার দিকে তাকিয়ে বলল,
----  তাহলে বিয়েটা করেই ফেল এত দেরি করছিস কেন?
--- মনের মত ছেলেই তো পাচ্ছিনা।
 নিশিতা নিলয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
---  এবার আমার বন্ধুর জন্য একটা ভালো ছেলে দেখুন।
 নিলয় উত্তরে বলল,
--- আরে এইসব কথা পরে হবে।এখন এই ভাত কাপড়ের অনুষ্ঠানটা কিভাবে করা যাবে সেটাই ভাবতে হবে। আমার তো মাথায় কিছু আসছে না।
 অম্বিকা নিলয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
--- এক কাজ করুন নিলয়দা, টুক করে গিয়ে মাসিমাকে  নিয়ে চলে আসুন।মাসিমা এসেই ভাত-কাপড়ের অনুষ্ঠানটা শেষ করবেন।
--- তা কি করে সম্ভব?এত সময় হাতে নেই।বিকেল হলেই নিমন্ত্রিতরা আসতে শুরু করবে,পার্লার থেকে লোক আসবে সাজানোর জন্য।তার থেকে আমি বলি কি- অম্বিকা, আপনি আর আমি মিলে কাজটা শেষ করি। 
 নিশিতা হাতে তালি দিয়ে বলে উঠলো,
-- গুড আইডিয়া!এটাই হবে, তুই আর নিলয়দা মিলে আমাদের ভাত-কাপড়ের অনুষ্ঠানটা করবি। আরে নিয়মকানুন তো মানুষেরই তৈরি। আচার অনুষ্ঠান গুলো করে মানুষ একটু আনন্দ উপভোগ করে।আমরা সেটা যেভাবে খুশি করি না;আনন্দ পাওয়া নিয়ে কথা।
  ব্যাস যেমন কথা তেমন কাজ।প্রলয় ধুতি পাঞ্জাবি পরে চলে আসলো।নিশিতা অম্বিকার সাহায্যে হালকা করে সেজে   নির্দিষ্ট জায়গায় হাজির হয়ে গেল।অম্বিকা আর নিলয় দুজনে মিলে থালা,বাটি,গ্লাস সাজিয়ে অনুষ্ঠানের জন্য রেডি হয়ে গেলো।নিজেদের মত করে নিজেরাই সমস্ত আচার অনুষ্ঠান পালন করল।
  সত্যি বাঙ্গালীদের নানান অনুষ্ঠানে এসব মেয়েলী আচারের কোন যুক্তি আছে বলে আজকের  যুবসমাজ মনে করে না। অনুষ্ঠান বাড়িতে শুধু একটু আনন্দ ফুর্তি মজা করার জন্যই আগেকার দিনের মানুষেরা এসব নিয়ম কানুন তৈরি করেছিলেন। ভাত কাপড়ের অনুষ্ঠানের কথাই ধরা যাক প্রচুর লোকের সামনে থালা সাজিয়ে নব বিবাহিতা স্ত্রীর হাতে ভাতের থালা আর কাপড় দিয়ে বলা হয়, "ভাত-কাপড়ের দায়িত্ব নিলাম"- কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যায় অনেক স্বামীই সেই দায়িত্ব পালন করেন না। আবার অনেক ক্ষেত্রে হয়তো স্বামী বেকার, স্ত্রীই সেই দায়িত্ব পালন করে চলেছেন।কিন্তু তবুও  অনুষ্ঠানে স্বামীকেই কথাটা বলতে হয়। এই কুসংস্কারগুলি যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছে।আগেকার দিনে মানুষ বিনা বাক্য ব্যয়ে এ কুসংস্কারগুলি মেনে নিত। কিন্তু আজকের দিনের ছেলেমেয়েরা প্রতিটা কুসংস্কারের পিছনে যুক্তি খোঁজার চেষ্টা করে, যদি তারা কোন বৈজ্ঞানিক যুক্তি খুঁজে পায় তবে তারা তা মানে আর যেগুলোর ভেতর তারা কোনো বৈজ্ঞানিক যুক্তি দেখতে পায় না তারা সেগুলো কিছুতেই মানতে চায় না।
  নিশিতা ও প্রলয়ের বিয়ের পরেই অম্বিকা ও নিলয়ের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। নিশিতা বারবার প্রলয়কে বলেছে,
---  ওদের দুজনেরই দুজনকে পছন্দ হয়েছে,দুজনের চোখই সে কথা বলে দিচ্ছে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে কেউই মুখ ফুটে কাউকে সে কথা জানাচ্ছে না।আর নিলয়দার এই সমস্যাটা না মিটলে এই ব্যাপারটাতে আমরা এগোতে পারবো না ।কিন্তু তোমাকে আমি বলে রাখলাম,নিলয়দার এই সমস্যা মিটে গেলে আমি নিজে কিন্তু ওদের বিয়ের ব্যাপারে উদ্যোগী হব।অবশ্য তার আগে আমি কনফার্ম হয়ে নেব আমি যা ভাবছি তা সত্যি কিনা।
--- আরে এত তারাহুড়ো করার কি আছে?আগে ওদের একটু নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে নিতে দাও। আর যতদিন বোঝাপড়াটা চলবে ততদিন ওদের শরীর ও মন উভয়ই ভালো থাকবে।বিয়ে মানে তো সেই 'দিল্লি কা লাড্ডু'। তাছাড়া  নিলয়ের জীবনে সদ্য ঘটে যাওয়া এই ঘটনাটা থেকে বেরোনোর জন্য কিছুটা সময়েরও দরকার। এত সহজে সবকিছু ভুলে যাওয়া যায় না;ভুলে থাকার ভান করা হয়তো যায় ।কিন্তু ভুলে থাকা যায় না। কিছুদিন সময় দাও ওদের। আর তাছাড়া আমাদের রিসেপশন এর পরেই ওদের যোগাযোগটা বন্ধ হয়ে গেছে।এবার আমরা বাড়িতে ওদের দুজনকে একটু ডেকে নিই, বিয়েতে খাটাখাটনি উপলক্ষে ছোট্ট একটা পার্টি;এটাই বলব ওদের।আর সেদিনই ওদের ফোন নাম্বারটা একে অপরের কাছে যাতে থাকে সে ব্যবস্থা করার জন্য কিছু একটা করতে হবে।
   প্রলয়দের বিয়ের দিন পনেরো পরে হঠাৎ একদিন রিতেশ ফোন করে জানায় ডিভোর্সেরর চিঠি রেডি হয়ে গেছে।সে যেন গিয়ে  সবকিছু দেখে আসে। রিতেশ নিজেই আসতো কিন্তু কিছু ইমারজেন্সি কেসে ফেঁসে যাওয়ায় সে আসতে পারছেনা।তাই নিলয় তার বাড়িতে গিয়ে চিঠিটায়  সই করে আসলে পরে  শালিনীকে চিঠিটা পাঠিয়ে দেওয়া যাবে। নিলয় বাবা মাকে সবকিছু জানায়।এবং তাদের মতামত নিয়ে পরদিনই অফিসের পথে বোন প্রমিতার বাড়িতে আসে। নিলয়কে দেখতে পেয়ে রিতেশ হাসতে হাসতে বলে,
--- কেমন ঘোল খাওয়ালাম? আসলে অনেক দিন আসোনা। আর তাছাড়া তোমাকে একটা সুখবর দেওয়ার আছে।যেটা তোমার বোনের সামনে দিলেই তোমার আনন্দটা দ্বিগুণ হয়ে দেখা দেবে।
--- কি খবর ভাই?
--- আরে বলবো বলবো।চলো তোমার বোনের ঘরে চলো। ওখানে ওর সামনেই বলবো।
 নিলয় কে দেখতে পেয়ে প্রমিতা উঠে বসতে যায়। রিতেশ চেঁচিয়ে ওঠে,
--- উহু, একদম না, ডাক্তার তোমাকে টোটালি শুয়ে থাকতে বলেছেন।এখন তুমি শুধু শুয়েই  থাকবে।তোমার দাদার যত্ন আমি নিজেই করবো।একটা বছর আমার উপর সব ছেড়েই দেখোনা,আমি ঠিক তোমার সংসারকে আগলে রাখতে পারব।
 ওদের কথোপকথন শুনে নিলয় বুঝতে পারে যে সে মামা হতে চলেছে।বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
--- এই সময় ডাক্তারের কথা আর প্রলয়ের কথা সব মেনে চলবি।
  আরো কিছুক্ষন বোন ভগ্নিপতির সাথে সময় কাটিয়ে নিলয় বাড়িতে ফিরে আসে।মা-বাবাকে তার মামা হওয়ার সুখবরটা দেয়।তারাও খুব খুশি হন।
 নির্দিষ্ট দিনে নিলয়,শালিনী দুজনেই আলাদা আলাদাভাবে কোর্টে হাজির হয়ে যায়।তাদের মিউচুয়াল ডিভোর্স হয়। নিলয় সবসময় রিতেশের সাথে সাথে থেকেছে।শালিনী যাতে নিলয়ের সাথে কথা বলতে না পারে সেই কারণেই রিতেশের পিছন পিছন থাকা। সেই বিয়ের আগের দিন রাতে ফোন করে অন্য পুরুষকে ভালোবাসার কথা জানানোর পর থেকেই নিলয়ের শালিনীর প্রতি কেন জানি না একটা তীব্র ঘৃণা কাজ করে।সে যেন ধনুক ভাঙ্গা পণ করে বসে আছে সে কিছুতেই শালিনীর সাথে কোন কথা আর বলবে না। কিন্তু কোর্টে এসে শালিনীও নিলয়ের সাথে কথা বলার কোন চেষ্টাই করেনা। সেও নিলয়কে অদ্ভুত ভাবে এড়িয়ে যেতে থাকে।তার ভেতরেও একটা অভিমান কাজ করে।কারণ সে বারবার নিলয়কে কিছু বলতে চেয়েছে হয়তো সে তার ভালবাসাকে হারিয়ে নিলয় কে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিল। কিন্তু নিলয় তাকে কোনো সুযোগই দিল না।

ক্রমশঃ 
 
 
    

No comments:

Post a Comment