Saturday, January 23, 2021

সুখের ঘরে আগুন (১৮)

সুখের ঘরে আগুন (১৮)
  কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকার পর অম্বিকা নিলয়কে
বলল,
--- নিলয়দা, আমরা তো এক পাড়াতেই যাবো,একটা ক্যাব বুক করুন বেরিয়ে পড়ি;খামোখা সেই থেকে এখানেই দাঁড়িয়ে আছি। আসলে আমি বুঝতে পারছি আপনি আমাকে চেনেন না কিন্তু আমি আপনাকে খুব ভালভাবেই চিনি।তাই আপনার সাথে আমার কথা বলতে একটুও অসুবিধা হচ্ছে না।কিন্তু আপনি যেহেতু আমাকে চেনেন না তাই কিছুতেই আমার কাছে ফ্রি হতে পারছেন না।আরে আমি পূর্বপাড়ার গলির মুখে যে বাড়িটা পড়ে না ?সেই বাড়ির মেয়ে।বাড়ির সামনে একটা বড় তেজপাতা গাছ আছে। আমার বাবা অমল সেন।এখন বুঝতে পারছেন আমার আপনার সম্পর্কটা পাড়াতুতো।তাই এখানে দাঁড়িয়ে আর সময় নষ্ট করে লাভ নেই।আপনার যদি কাজ থাকে তাহলে আপনি বেরিয়ে পড়তে পারেন।আমি একটা ক্যাব বা ট্যাক্সি ধরে বাড়ি চলে যাব।কিন্তু আর বেশি দেরি হলে আমি ঢোকার সাথে সাথে মা আমার উপর হামলে পড়বেন আর আমাকে বাঁচাতে বাবা ছুটে আসবেন।মা তখন আমাকে ছেড়ে বাবার উপর হামলে পড়বেন।এ জিনিস প্রথম থেকেই চলে আসছে। মা তখন আমাকে ছেড়ে বাবাকে ধরবেন আর সেই মুহূর্তে আমি কেটে পরি।শুরু হয় বাবা-মায়ের ঝামেলা ।
 অম্বিকা অবলীলায় কথাগুলো নিলয় কে বলে গেলো যেন কত চেনা নিলয়কে তার।অম্বিকার কথা বলার ধরণ দেখে তার কথা শেষ হলেই সে হো হো করে হাসতে লাগলো। অম্বিকা নিলয়ের হাসি দেখে বলল, 
--- না না হাসি নয়, এটাই সত্যি।সব সময় বাবা আমার হয়ে  মায়ের সাথে ঝগড়া করছেন।আর আজ তো বেশ দেরি হয়ে গেল। আমি আসছি নিলয়দা। 
--- না না দাঁড়ান একসাথেই যাব। আমি একটা ক্যাব বুক করছি।
 নিলয় একটা ক্যাব বুক করে দুজনে তাতে উঠে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।নিলয় কম কথা বললেও অম্বিকা বকবক করেই চলে। একসময় অম্বিকা নিলয়ের কাছে জানতে চায় তার নতুন জীবন কেমন চলছে? কথাটা শুনে নিলয় একটু ঘাবড়ে যায়। মনেমনে ভাবে অম্বিকাকে কোন কথা বলা ঠিক হবে না। নিলয় হেসে পড়ে বলে,
---  নতুন জীবন আর পুরনো জীবন সবই ভাগ্যের উপর নির্ভরশীল।ভাগ্য যে দিকে টেনে নিয়ে যাবে জীবনও সে দিকেই এগিয়ে চলবে।
--- তা ঠিক।তবে কি জানেন আমার মতে ভাগ্যকে মানুষ অনেক সময় নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।আর তার জন্য চায় কঠোর পরিশ্রম, একটু সহিষ্ণুতা, একটু ধৈর্য, আর সর্বোপরি বিশ্বাস ও ভালোবাসা ।এই কটা জিনিস কোন মানুষের মধ্যে যদি থাকে তাহলে সে তার ভাগ্যকে নিজেই গড়ে নিতে পারে। অনেক সময় ভুল বুঝাবুঝি আর ইগো মানুষকে বিপথে চালনা করে।
তারপর অম্বিকা একটু হেসে পড়ে বলে ওঠে,
---ওই দেখুন ক্লাসে লেকচার দিতে দিতে এমন অবস্থা হয়েছে আপনার কাছেও লেকচার দিয়ে চলেছি।
--- না না আপনি তো কথাগুলো ঠিকই বলছেন।প্রত্যেকটা কথার যুক্তি আছে।কোন অযৌক্তিক কথা তো আপনি বলছেন না। যাক গে, পরিচয় যখন হয়ে গেল তখন মাঝে মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হবে,গল্পগুজব হবে।আর তাছাড়া প্রলয় আর নিশিতার বিয়েতে তো আমরা দুজনেই বরকর্তা আর কনেকর্ত্রী ।সুতরাং এখন থেকে দু'জনকেই তো আমাদের কোমর বেঁধে লাগতে হবে। আর এই বিয়ে উপলক্ষে আমাদের দেখাও হবে অনেক।তখন জমিয়ে আড্ডাও চলবে।
 নিলয় উবেরটা বড় রাস্তার উপরেই দাঁড় করিয়ে দেয়। অম্বিকার দিকে ফিরে বলে,
--- আমি এখানে নেমে যাব।একটু কাজ আছে।আপনি  বাড়ির সামনেই নামবেন।ওই পর্যন্তই বুক করা আছে। মানিব্যাগটা বের করে সে পেমেন্টটা দিয়ে দেয়।অম্বিকা বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও সে কোন কথা শুনেনা।
 আসলে নিলয়ের কোন কাজই নেই।সে স্বেচ্ছাকৃত ওখানে নামল যাতে পাড়ার লোক তাকে ও অম্বিকাকে একসাথে গাড়ি থেকে নামতে না দেখে।কে কি বলবে তা আবার পাঁচ কান হবে। পিএনপিসি করার লোক তো পাড়ায় কম নেই!তাই অনেক সময় নিজের মতামত থেকে পাড়ার লোকের জন্যই তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হয়।
  অম্বিকা বাড়িতে পৌঁছানোর সাথে সাথে তার মা রাধাদেবি বলে উঠলেন,
--- এত রাত অব্দি কোন কলেজ হয় শুনি? কতবার কইছি মাইয়াটারে বিয়া দাও ; তা আমার কথা শুনবে কিডা? এত রাত অব্দি যদি মাইয়ামানুষ বাইরে ঘোরাঘুরি করে দিনকাল ভালা না কখন কি হইয়া যায় তার কি কোন ঠিক আছে? মাইয়া আর তার বাপ দুটিতেই কানে তুলা গুইজা থাহে।
 অম্বিকা ঘরে ঢুকে মায়ের পাশ কাটিয়ে তার নিজের ঘরে চলে যায়।আর তার বাবা তার নিজের ঘর থেকে চিৎকার করে বলতে শুরু করেন,
---  সারাদিন পর মেয়েটা বাড়ি আসার সাথে সাথে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল।আমাকেও সারাজীবন শান্তি দিলো না, মেয়েটাকে ও একটু শান্তি দেয় না।
--- হ, আমিই তো তোমাদের দুজনের যত অশান্তির কারণ। আমার কথা তোমরা কোন দিন শুনছো কও তো? তোমাদের যা করণের তা তো তোমরা কইরাই যাও। মাঝখান থেইকা আমিই চেঁচাইয়া মরি। আমারে তো সে কিছু কইবো না।অন্তত নিজে একটু জিগাও এত রাতে কইরা সে কেন বাড়ি ফিরছে? কলেজ কইরা কোন জায়গায়, কার সাথে ঘুরতাছিলো ?
 অমলবাবু আস্তে আস্তে মেয়ের ঘরে গেলেন।মেয়ে ততক্ষণে ফ্রেস হয়ে ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিয়েছে।বাবাকে দেখে উঠে বসলো।বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
---- রোজ রোজ মায়ের এই চিৎকার-চেঁচামেচি আর ভালো লাগেনা। কেন যে মা বোঝেনা কাজ না থাকলে আমি বাইরে ঘুরাঘুরি করি না।আজ আমার যে ফিরতে দেরী হবে আমি তো তোমায় জানিয়ে গেছিলাম।তুমি একটু মাকে বুঝিয়ে বলতেই পারতে তাহলে তো ঘরে ঢুকেই মায়ের এই চেঁচামেচি আমাকে শুনতে হতো না।
  অমলবাবু  সস্নেহে তার আদরের মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
---আসলে কি জানিস মা তুই বাইরে থাকলে তোর মায়ের খুব চিন্তা হয়।দিনকাল তো ভালো না।চারিদিকে নানান কথা শুনতে পায়, টিভিতে খবর দেখে তাইতো চিন্তাটা একটু বেশি তার। হ্যাঁ আমি বুঝতে পারি সারাদিন ছাত্র পড়িয়ে বাড়িতে এসে মায়ের এই চিৎকার-চেঁচামেচি তোর ভালো লাগেনা। কিন্তু এটাতো তুই অস্বীকার করতে পারিস না তোর প্রতি ভালোবাসা থেকেই মায়ের চিন্তা আসে আর এই চিন্তা থেকেই তার চেঁচামেচি ।
--- আমিতো জ্ঞানের পর থেকেই দেখে যাচ্ছি বাবা পান থেকে চুন খসলেই মায়ের এই চেঁচামেচি। মা যে খারাপ মানুষ সে কথা আমি বলছি না বাবা। কিন্তু সেই ছোট্ট থেকে চেঁচামেচি শুনতে শুনতে এখন আর সত্যিই এটা ভালো লাগেনা।
--- কি আর করা যাবে মা ? এক একজন মানুষের এক এক রকম স্বভাব।তোর মা সবটাতেই একটু টেনশন করেন বেশি; সেই টেনশন থেকেই তিনি চিৎকার, চেঁচামেচি করেন।এটা একদিক থেকে খুব ভালো লক্ষণ।এতে কি হয় জানিস ?মনের ভিতর চাপা যে টেনশনটা থাকে তা বেরিয়ে আসে। এতে শরীর-মন দুইই ভালো থাকে।
 কথাগুলো অমলবাবু মেয়েকে বললেন ঠিকই কিন্ত মেয়ে কতটা বুঝল সেই জানে।তার মায়ের এই চিৎকার-চেঁচামেচি যে তারও আর ভালো লাগেনা একথা তিনি আর কাকেই বা জানাবেন?বিয়ের পর থেকেই তো দেখে আসছেন তার কিছু মনপুতঃ না হলেই তিনি চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করেন। কিন্তু মানুষটা খুবই সরল প্রকৃতির এবং পরোপকারী । দিনরাত সংসারে পিছনে খাটছেন। আজ পর্যন্ত বাড়িতে কোন কাজের লোক রাখতে দেননি।এতদিন অমলবাবু ভেবেছেন হয়তো অর্থ সমস্যার কারণে তিনি একাই পুরো সংসারের যাবতীয় কাজ নিজেই করেন।কিন্তু তার ওমুমা চাকরি পাওয়ার পর যখন সে বারবার বাড়িতে কাজের লোক রাখতে চেয়েছে তখনই তার মা আপত্তি করে বলেছেন
---- যতদিন আমি পারুম আমি নিজেই সব কাজ করবো। আর কাজের লোকের কাজ আমার পছন্দ হয় না।ওদের সাথে সর্বক্ষণ চেঁচামেচি করা ঠিক না।যারা পারে না নিজের হাতে সংসারের কাজ করতে তারাই কাজের লোক রাখে। আমার তো কাজ করতে কোন অসুবিধা নাই।তাইলে আমার কাজের লোকের কি দরকার?আর এখনো তো আমি অথর্ব হইয়া যাইনি।যখন আমি পারুম না তখন তোমরা বাড়িতে কাজের লোক রাইখ্যা দিও।

ক্রমশঃ

    

No comments:

Post a Comment