সুখের ঘরে আগুন (পর্ব ১২)
গাড়ির ভিতর নিলয়ের মনে হতে থাকে এই কটা দিনের ঘটনা - সে যেন স্বপ্ন দেখেছে। চব্বিশটা ঘন্টা যেখানে পার হয়নি কিন্তু বিয়ের আগের রাত থেকে একটু আগে পর্যন্ত সমস্ত ঘটনায় তার কাছে আবছা হয়ে গেছে। তার ভালোলাগা ভালোবাসা দিয়ে গড়া প্রতিটা নারীই তাকে আঘাত ছাড়া অন্য কিছু দিতে পারেনি । ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর পরিহাস! কি কপাল করে জন্মগ্রহণ করেছিল! নিজেকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করেই সে ভাবতে থাকে বাড়িতে গিয়ে মা-বাবাকে সে কি বলবে? মা তো প্রচন্ড আঘাত পাবেন। কিন্তু এই মুহূর্তে এটা ছাড়া তার কাছে অন্য কোনো উপায়ও ছিল না। সে মনে মনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয় আজ যেভাবেই হোক মা-বাবাকে সত্যি ঘটনাটা জানাতেই হবে, পরের ব্যাপার পরে বোঝা যাবে।
ছেলেকে বাড়িতে ফিরতে দেখে মা তাকে নানান প্রশ্নে জর্জরিত করে দিলেন কেন শালিনীকে নিয়ে আসেনি? প্রথমে একটু চুপ করে থাকলেও পরে সে বলল,
--- তুমি একটু চা করে নিয়ে আসো, আমি আজ সমস্ত ঘটনা তোমাকে আর বাবাকে জানাবো। তখন তোমরা বুঝতে পারবে যে শালিনী কেন আসেনি।
মলিনা দেবী ভালো ভাবেই তিনি তার ছেলেকে চেনেন। তিনি জানেন ছেলে যখন বলেছে চা খেতে খেতে সবকিছু জানাবে তখন সে চা না পেলে কোন কথা আর বলবে না। তিনি এক মুহুর্ত সময় নষ্ট না করে নিজের মনে বকবক করতে করতে রান্না ঘরে চলে যান।বাবা ইশারায় ছেলের কাছে জানতে চান কি হয়েছে? নিলয় তখন বাবাকে বলে সে একই সাথে সব কথা জানাবে দুজনকে। মলিনাদেবী পাঁচ মিনিটের মধ্যে চা করে নিয়ে ড্রইং রুমে চলে আসেন। নিলয় হাসতে হাসতে মাকে বলে,
--- তুমি কি ঠাণ্ডা জলের মধ্যেই দুধ,চা, চিনি দিয়ে চা করে আনলে?
তার মা খুব রাগান্বিত হয়ে বলে উঠলেন,
--- হাসিস না, আমার এখন তোর হাসি সহ্য হচ্ছে না। কি হয়েছে এক্ষুনি খুলে বল আমাকে; আমার ভালো লাগছে না।। ভেবেছিলাম বিয়েটা হয়ে গেলে আমি তোকে নিয়ে চিন্তা মুক্ত হব।আমার তোকে নিয়ে সমস্ত চিন্তা ভাবনা তোর বইয়ের উপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে থাকবো। কিন্তু আমি কি সে কপাল করে এসেছি? কি ঘটনা ঘটিয়েছিস সমস্ত কিছু খুলে বল ।
নিলয় পরিবেশটাকে হালকা করার জন্য হেসে পড়ে বলে,
--- তুমি যদি চুপ না করো ঘটনাগুলো বলব কি করে? কিন্তু সমস্ত ঘটনা শোনার আগে তোমাদের কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে আমাকে কোনো অবস্থাতেই শালিনীকে আবার ফিরিয়ে আনতে বলবে না। মলিনাদেবী চিৎকার করে বলে উঠলেন,
--- শালিনীকে ফিরিয়ে আনতে বলবো না, এ কথাটার মানে কি? তুই কি শালিনীকে চিরজীবনের মতো বাপের বাড়িতে দেখে আসলি? আমাদের সাথে একবারও আলোচনা করার প্রয়োজন বোধ করলি না? বিয়ে হয়েছে মাত্র কয়েকটা দিন। এরইমধ্যে বউকে বাপের বাড়িতে রেখে এসে বলছিস তাকে আর ফিরিয়ে আনবি না; আর আমরা তোকে কোন অনুরোধ করতে পারবো না এসবের মানে বুঝতে পারছি না।
নিলয়ের বাবা এবার বলে উঠেন,
মলি, তুমি একটু চুপ করো ।ওকে সব কিছু বলার সুযোগ দাও। ও হঠাৎ করে এ সিদ্ধান্ত নেইনি নিশ্চয়ই এর পিছনে বিশাল কোন কারণ আছে। আর কারণটা আমরা জানতে পারব না যতক্ষণ না তুমি চুপ করবে। বল বাবা, কিসের জন্য তুই এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলি। আমরা তোর কথার মধ্যে কোনরকম কোন কথা বলবো না। সমস্ত কিছু শোনার পর যদি আমাদের মনে হয় অন্যায়টা তোর তবে বৌমাকে কিন্তু ফিরিয়ে তোর আনতেই হবে।
নিলয় কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বিয়ের আগের রাত থেকে আজ সকাল অব্দি সমস্ত ঘটনা তার বাবা-মাকে খুলে বলল। সব কথা শুনে তারা দুজনেই থম মেরে গেলেন। বেশ অনেক্ষণ তারা চুপ করে বসে থাকলেন। নিলয় উঠে চলে যাওয়ার উপক্রম করতেই মলিনাদেবী তাকে হাতের ইশারায় বসতে বললেন। পরে তিনি তাকে বললেন,
--- এতবার করে বৌমা যখন তোর সাথে কথা বলতে চেয়েছে তখন তুই তাকে একটা সুযোগ তো দিতেই পারতিস। তার কথাগুলো শোনা তোর উচিত ছিল।
নিলয়ের বাবা এতক্ষণ চুপ করে বসে থেকে তিনি ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
--- সবকিছু জানার পর বিয়ের মত একটি ঘটনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোন মানে ছিল না ।প্রথমেই এই বিয়েটাকে ভেঙ্গে দেওয়া তোর উচিত ছিল বলে আমি মনে করি। এরকম অনেক ঘটনা অনেকের জীবনেই ঘটে; বিয়ের আসরে ও অনেকে বিয়ে ভেঙ্গে যায়। কিন্তু ভেঙ্গে দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়েই বিয়েটাকে সম্পন্ন করা উচিত হয়েছে বলে আমি মনে করি না। কিন্তু তাই বলে আমি একবারও বলছি না শালিনীকে তুমি বিয়ে করেছ বলে যেকোনো পরিস্থিতিতে তার সাথে মানিয়ে নিয়ে তোমাকে চলতে হবে। তোমার মত একটি বুদ্ধিমান ছেলের কাছ থেকে এই ধরনের মনোভাব আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিনা ।এতে লোক হাসানো বেশি হল। কি প্রয়োজন ছিল এই বিয়েটা তোমার করার? যখন তুমি জানতে পারলে সে অন্য কাউকে ভালোবাসে তোমাকে বিয়ে করতে চায়না তখনই তো তোমার এই বিয়েটা ভেঙে দেওয়া উচিত ছিল। মেয়েদের পক্ষে অনেক সময় অনেক কিছুই সম্ভব হয়না।যেটা ছেলেরা পারে সেটা অনেক সময় মেয়েরা পারেনা। এত কিছুর পরেও আমি বলব শালিনী তবুও অনেকটা এগিয়ে ছিল। বাকিটা এগোনোর জন্য তোমার সাহায্য চেয়েছিল। কিন্তু তুমি তাকে সাহায্য না করে ব্যাপারটাকে আরো ঘোলাটে করেছ। যা কিছু করেছো নিজের মর্জিতে করেছ ।তোমার উচিত ছিল ব্যাপারটা আমাকে আর তোমার মাকে জানানো।আমরা হয়তো বিয়েটা এতদূর এগিয়ে নিয়ে যেতাম না। কারণ এটা সত্যি, যে মেয়ে বিয়ের আগে তার হবু স্বামীকে ফোন করে অন্য পুরুষকে ভালোবাসার কথা জানায় সে মেয়ে কতটা ডেস্পারেট হতে পারে। যাহোক ঘটনাটা যখন এতদুর গড়িয়ে গেছে আর তুমি তোমার সিদ্ধান্ত সফল করে ফেলেছ তখন বাকিটাও তুমি তোমার মর্জিতে শেষ করো। আলাদা থাকো তারপর তাকে ডিভোর্স দিয়ে নিজের জীবনটাকে অন্যভাবে সাজিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করো। বাবা হিসেবে এর বেশি আমি বলবো না ।কারণ তুমি এখন বড় হয়েছো। তোমার ব্যক্তিগত জীবনে, তোমার ব্যক্তিগত মতামতের বাইরে আমি তোমাকে এমন কিছু বলবো না যা নিজের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে আমার সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়ে সারা জীবন অশান্তি ভোগ করবে। আর আমার বর্তমান,অবর্তমানে সব সময় তোমার চেতন অবচেতন আমাকে দোষারোপ করবে।
মলিনাদেবী চুপ করে বসে থেকে শুধু কেঁদেই চলেছিলেন। কাঁদতে কাঁদতেই তিন ছেলেকে বললেন,
-- এত কিছু শোনার পরও আমি তোকে আবারো বলছি,তুই একবার বৌমার সাথে এই বিষয়ে কথা বলে দেখ তার তো মতের পরিবর্তন ও হতে পারে?
--- ক্ষমা করো মা,আমি এটা কিছুতেই পারবোনা। আমি একমাত্র এই বিয়েটা শেষ অব্দি করেছি তোমার আর বাবার সম্মানের কথা ভেবে।আমি ভেবেছিলাম আত্মীয়-স্বজনরা যখন বাড়িতে এসে গেছে তখন ঠিক সেই মুহূর্তে বিয়েটা ভেঙ্গে দেওয়া মানে তোমাদের সম্মানহানি।
নিলয়ের বাবা একথা শুনে বলে উঠলেন,
--- এখন কি বিয়েটা ভেঙ্গে দিলে সম্মানহানি হবে না? তাহলে প্রথমেই কেন তুমি এটা ভেঙ্গে দাওনি?আমি মনে করি তুমি যেটা করেছো ঠিক করোনি। ব্যাপারটা অনেকদূর গড়িয়ে গেল যেটা শোভনীয় হলো না।
কথাগুলো বলে তিনি আর এক মুহুর্ত সময় নষ্ট না করে সেখান থেকে উঠে চলে গেলেন।
মলিনাদেবী কাঁদতে কাঁদতে ওখানে বসে প্রলাপের মতো বকতে লাগলেন,
-- যা হলো ঠিক হলো না।আমার কপালটা সারাজীবনই খারাপ।ভেবেছিলাম ছেলেটার বিয়ে দিয়ে একটু শান্তিতে থাকবো। কিন্তু এখন দেখছি শান্তির থেকে অশান্তিতেই জীবন ছারখার হয়ে যাবে।এটা কি হলো?বিয়ের সাত দিনের মাথায় ছেলে তার বউকে বাপের বাড়িতে রেখে আসলো? আত্মীয় স্বজনের মধ্যে এ নিয়ে তো চর্চা চলতেই থাকবে। কেউ তো চুপ করে থাকবে না।আর কথা শোনাতেও কেউ ছাড়বে না।এখন আমি কি করবো?
মলিনাদেবী সেখানে বসেই পাগলের মত প্রলাপ বকে চলেছেন। ছেলে নিলু মায়ের দিকে তাকিয়ে বসেছিল,হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে মায়ের কাঁধে হাত দিয়ে বলল এতকিছু ভাবছো কেন? যা হয়েছে সেটা আমার ভাগ্যে ছিল। লোকে কি বলল না বলল তাতে আমার কিছু যায় আসে না। তোমার আর বাবার সম্মান নষ্ট হল এটাই আমার কাছে কষ্টের। অন্য কিছু নিয়ে আমি ভাবি না।
ক্রমশঃ
No comments:
Post a Comment