সুখের ঘরে আগুন (১৭)
বাংলায় একটা প্রবাদ আছে "ঈশ্বর যা করেন তা মঙ্গলের জন্যই করেন"- দার্জিলিং থেকে ঘুরে এসে এই প্রবাদের সত্যতা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছে নিলয় এবং তার পরিবার।মানুষের জীবনে যে কত ধরনের কষ্ট ,আর সেই কষ্টের সাথে সমানভাবে যুদ্ধ করে একটু হলেও ভালো থাকার জন্য লড়াই।দোদুল তার জীবনে সেই লড়াইয়ে জয়ী হওয়ার পথে আর দোদুল কে সামনে রেখে নিলয়ও তার জীবনে কষ্টের এই লড়াইয়ে জয়ী হবেই। শালিনীর সাথে বিয়েটা একটা দুঃস্বপ্ন ভেবেই সে ভুলে যাবে।শুরু করবে নূতন করে তার জীবন। ভাববে না পিছনের কথা আর।বিয়েই জীবনের শেষ কথা হতে পারে না। হ্যাঁ এটা ঠিক দিনান্তে বাড়ি ফিরে সকলেই একটা ভালোবাসার হাতের পরশ চায়,সুখ দুঃখগুলোকে ভাগ করে নেওয়ার জন্য পাশে এবং খুব কাছে একজন মানুষ চায়,রোগ যন্ত্রণায় শিয়রে প্রিয়জনকে চায়,দিনরাতে সর্বক্ষণের জন্য ছোট্ট একটা শিশুর আধো আধো কথা শুনতে চায়।এই ছোট্ট ছোট্ট চাওয়াগুলো নারী পুরুষ নির্বিশেষে কামনা করে।কিন্তু জীবনে সকলের এই ইচ্ছাগুলো কি পূরন হয়?অনেক স্বামী স্ত্রীর সাথে বনিবনায় তো হয়না।একই ছাদের তলায় থেকেও তারা পরস্পরের কাছে আসতে পারেনা।অনেকে কষ্ট পায় সন্তানহীনতার কারণে।
আবার বাড়ির লোকে বিয়ে করতে না চাইলে কারণ দেখান, "শেষ বয়সে তোর কাটবে কি করে?"কিন্তু কারো জীবনেই জীবন সমীকরণ তো মেলে না।বিয়ে, সন্তান জন্ম দেওয়া,তাদের মানুষ করা, তাদের বিয়ে থা দেওয়া, তারপর শাশ্বত নিয়ম অনুযায়ী একজনকে তো আগে বিদায় নিতেই হয়।আর বাকি যে জন পড়ে থাকে সে হয়ে যায় নিঃস্ব, অসহায়। পরিবারের কাছে কেউ কেউ অবাঞ্চিত হয়েও পরে। চেতন অবচেতন তখন সেই অবাঞ্চিত মানুষটি নিজেই নিজের মৃত্যু কামনা করে।আবার সাধারণত ধনী পরিবারে দেখা যায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বাবা-মাকে টাকার বিনিময়ে বৃদ্ধাশ্রমে তাদের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে পুরনো আসবাবপত্র সরিয়ে ফেলার মত রেখে আসে।কেউ খোঁজ রাখে আবার কেউবা টাকা দিয়ে তাদের দায়িত্ব কর্তব্য শেষ করে।কোন খবরাখবরের ধার ধারে না।এটাই তো জীবন!তাহলে জীবনের না পাওয়াগুলোকে নিয়ে এত কষ্টের কারণ কি?
দোদুল আর নন্দিনীর জীবনের ঘটনাপ্রবাহ নিলয়ের জীবনে আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছে। এখন তার প্রধান কাজ ছ'মাস পরে শালিনীকে ডিভোর্স দেওয়া আর বাবা-মাকে ভালো রাখা, সুস্থ রাখা।দেখতে দেখতে তো মাস দেড়েক হয়েও গেলো। আস্তে আস্তে নিলয়দের বাড়ির পরিবেশও স্বাভাবিক হতে শুরু করল।আগের মতই হাসি-ঠাট্টা, গল্পগুজব সবই চলছে।আড়ালে আবডালে পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজনেরা সমালোচনা করলেও সামনে দাঁড়িয়ে কেউ কিছু বলার এখনো কোনো সাহস দেখায়নি।
সেদিন ছিল রবিবার।নরেশবাবু নিলয়কে বললেন,
--- অনেকদিন রিয়াজী খাসি খাওয়া হয়নি আর যখন আজ তুই বাজার যাচ্ছিস তখন একটু খাসির মাংস নিয়ে আসিস। তোর মা খাসির মাংসটা জম্পেশ রান্না করেন বাপ ছেলে কব্জি ডুবিয়ে গল্প করতে করতে খাবো। অনেকদিন অনেক কিছুই করা হয়নি আমাদের।
মলিনাদেবি স্বামীর কথা শুনেই তিড়িং করে লাফিয়ে উঠলেন,
--- হ্যাঁ আমার তো দিনকে দিন বয়স কমছে আর তোর বাবার দিনকে দিন খাবারের তালিকা বাড়ছে।
--- মা,এবার আমি ঠিক করেছি একটা রান্নার লোক রাখবো।
--- তাহলেই ষোলোকলা পূরণ হয় আর কি !বলি বাপ ছেলের তো আমার হাতের রান্না ছাড়া রোচে না।রান্নার লোক রাখা মানে আমার আরো কাজ বেড়ে যাওয়া।তার পিছনে এটা করো, ওটা করো,এভাবে রান্না করো বলতে বলতেই আমার দিন শেষ হয়ে যাবে। সারাদিন বসে সে রান্না করবে আর আমি সারাদিন তার পিছনে বক বক করে যাবো।দরকার নেই তোমার ওসব চিন্তা-ভাবনা দিয়ে।যেমন চলছে তেমনই চলুক। যতদিন পারব দুটো ফুটিয়ে দেবো ।আর হ্যাঁ তোমার বাবার ফাইফরমাশও খেটে দেবো , দশকর্মা ভান্ডারের ফর্দের মত অর্ডার অনুযায়ী খাবার রান্নাও করে দেবো।
নিলয় ব্যাগ নিয়ে হাসতে হাসতে বাজারে বেরিয়ে গেলো।মনেমনে ভাবল অনেকদিন পরে বাড়িটা আবার ঠিক সেই আগের মতই মনে হচ্ছে।
অম্বিকা আজ মাস ছয়েক হলো কলেজে জয়েন করেছে। সঙ্গে সঙ্গে তার মা রাধাদেবী বিয়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন ঠিক সেই আগের মতই বাপ মেয়ের সাথে ঝামেলা লেগেই আছে। মাত্র অল্প কয়েকদিনেই অম্বিকা তার সহকর্মীদের প্রিয় পাত্রী হয়ে ওঠে। আর ছাত্র ছাত্রীরা তাকে ভীষণ ভালোবেসে ফেলে। কারণ তার ব্যবহার আর ক্লাসে তাদের অঙ্ক বোঝানোর ধরনে প্রতিটা ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে আমূল পরিবর্তন এনে দেয়।যে অঙ্কের ক্লাসে একসময় অধিকাংশ ছাত্র থাকতো অনুপস্থিত সেখানে এখন ছাত্র-ছাত্রীর উপস্থিতির হার অনেক বেশি।
প্রথম দিন থেকেই অম্বিকার সহকর্মী নিশিতার সাথে অম্বিকার খুব ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে।একসময় 'আপনি ' থেকে' তুমি ' আর এখন' তুই ' তে এসে থেমেছে। দুজনেই মোটামুটি সমবয়সী। নিশিতা ভালোবাসে তারই সহকর্মী প্রলয়কে। অফিস রুমের সকলেই মোটামুটি সে কথা জানে আড়ালে-আবডালে এ নিয়ে বেশ কানাঘুষাও হয়। কিন্তু ওদের সামনে কেউ একথা নিয়ে কোনো আলোচনা করে না। প্রলয় হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান।আর নিশিতা anglo-indian.সুতরাং প্রলয়ের পরিবার নিশিতাকে মানতে রাজি নন আর নিশিতা প্রলয়কে ছাড়তে রাজি নয়। তারা রেজিস্ট্রি করে দুজনে বাড়ির সকলের অগোচরে মাসখানেক আগেই বিয়ে করে নিয়েছে।জুতসই একটা বাড়ি খুঁজছে। পেলেই মন্দিরে সিঁদুর পরিয়ে তারা তাদের নতুন জীবন শুরু করবে। অম্বিকার খোঁজে একটা বেশ ভালো ফ্লাট বাড়ি ছিল। সে নিশিতা ও প্রলয়কে কথাটা জানালে তারা দ্বিগুণ উৎসাহে ফ্লাট দেখে পছন্দ করলো। ফ্লাট মালিকের সাথে কথাবার্তা ফাইনাল করে নিশিতা এক কাপড়ে বাবা মাকে ছেড়ে বেরিয়ে আসবে ঠিক হল। ফ্লাটে আসার আগে তারা ফ্ল্যাটের যাবতীয় জিনিসপত্র অম্বিকাকে সাথে নিয়ে কেনাকাটা করে। এই কিনাকাটা করতে গিয়েই ঘটে মজার ঘটনা।
একদিন কলেজ ছুটির পর অম্বিকা আর নিশিতা পূর্বকথা মত দুজনে গেল দক্ষিণ কলকাতার বেনারসি প্যালেসে বিয়ের বেনারসি কিনতে। একটার পর একটা তারা বেনারসি দেখে চলেছে।অম্বিকার পছন্দ হয় তো নিশিতার পছন্দ হয় না।কিন্তু তারা আগেই ঠিক করে এসেছে দুজনের পছন্দ হলে তবেই তারা বেনারসি কিনবে।কিন্তু কিছুতেই কোন শাড়ি একই সাথে দুজনের পছন্দ হচ্ছে না। একটা বেনারসি হাতে নিয়ে দুই বন্ধু নাড়াচাড়া করছে দেখে বোঝা যাচ্ছে সেটা তাদের পছন্দ হয়েছে।এরইমধ্যে তারা শুনতে পায় পিছনে দাঁড়িয়ে প্রলয় তাদের বলছে,
--- উহু না ওটাতে হবে না, ওই কালারের বেনারসি আমি কিনেছি।
দুই বন্ধুই পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে প্রলয় দাঁড়ানো সাথে নিলয়। হাতে শাড়ির একটা বড় প্যাকেট।নিলয়কে দেখতে পেয়ে নিশিতা বলে উঠলো,
--- আরে নিলয়দা,কতদিন পরে তোমার সাথে দেখা।প্রলয় অনেকবার আমাকে বলেছে আমাদের বিয়ের সব দায়িত্ব নিলয়ের হাতে।আর সত্যিই তো আমাদের দুই বাড়ির কেউ এই বিয়েতে আসবেনা।প্রলয়ের দিকটা তুমি সামলাবে আর আমার দিকটা বন্ধু অম্বিকা সামলাবে।
এতক্ষণে নিলয়ের চোখ যায় অম্বিকার দিকে ।অম্বিকা তার দিকে তাকিয়ে দু হাত জোর করে নমস্কার করে। নিলয়ও প্রতি নমস্কার জানায়। হঠাৎ করে অম্বিকাকে দেখে নিলয় কিছুটা অপ্রস্তুত হলেও অম্বিকা কিন্তু স্বাভাবিক।কিন্তু দু'জনেই তারা যে পূর্ব পরিচিত তা তাদের বন্ধু নিশিতা বা প্রলয়কে বুঝতে দেয় না। তারপর চারজনে মিলে বিয়ের বেনারসিটা পছন্দ করে সেখান থেকে বেরিয়ে খুব বড় একটা হোটেলে খেয়ে বাড়ি আসে।টুকটাক কথাবার্তা অম্বিকা বললেও নিলয় হ্যাঁ না তেই উত্তর দেয়।নিলয় কিছুতেই যেন অম্বিকার কাছে ফ্রি হতে পাচ্ছে না। নিলয় ভাবতে থাকে তার মনের মধ্যে যে কথা ছিল তা তো সে কোনদিনও অম্বিকার কাছে প্রকাশ করেনি বা তার বাবা-মা ও তো সরাসরি গিয়ে অম্বিকার সাথে তার বিয়ের প্রস্তাব দেননি।তবে কেন অম্বিকাকে দেখে সে এতটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল?কেন তার সামনে ফ্রি হতে পাচ্ছে না?
হোটেল থেকে বেরিয়ে নিশিতা আর প্রলয় একটা ক্যাপ বুক করে তাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।নিশিতা ক্যাবে তার বাড়ির কাছেই নামবে আর প্রলয় মাঝ রাস্তায় নেমে বাস ধরে বাড়ি যাবে ।দাঁড়িয়ে থাকলো অম্বিকা আর নিলয় কারণ তাদের দুজনেরই বাড়ি এক পাড়াতে।
ক্রমশঃ
No comments:
Post a Comment