Tuesday, February 2, 2021

সুখের ঘরে আগুন (২২)

সুখের ঘরে আগুন (২২)

   অম্বিকা নিলয়ের কথা শুনে একটু অবাকই হয়।সাথে কিছুটা শিহরিতও হয়।নিলয় তাকে।এই মুহূর্তে কি এমন বলতে পারে? সে নিলয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
--- আরে  যা বলবেন বলুন না ,এত কিন্তু কিন্তু করছেন কেন?
 প্রথমে নিলয় কিছুক্ষন চুপ করে থাকলো।তারপর নিজের মনের মধ্যে কথাগুলির সাজিয়ে নিয়ে বলল,
--- আসলে অনেকদিন ধরে ভাবছি আপনাকে কথাগুলো জিজ্ঞাসা করবো।কিন্তু সাহসও পাইনা আর ঠিক সেরকম সময়ও আসে না।আজ যখন সুযোগটা পেয়ে গেলাম মনে মনে ভাবলাম চলে যাওয়ার আগে কথাটা জেনেই যাই।
  অম্বিকা তার মুখের দিকে অবাক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে  তার কাছে জানতে চাইলো,
--- তারমানে আপনি কিছু বলবেন না, আপনি আমার কাছে কিছু কথা জানতে চাইবেন কি তাইতো?
 কথাটা বলেই অম্বিকা হেসে দিল।আর নিলয় মুখে একটু হাসির আভাস এনে বললো,
--- ব্যাপারটা ঠিক তা নয় --- কিছু তো বলবোই আর কিছু কথা জানতে চাইবো।
---- কিন্তু আমাদের গন্তব্যের আর বেশি বাকি নেই সুতরাং যা বলার ঝটপট বলে ফেলুন।
--- আচ্ছা আপনি আমার সম্পর্কে কতটুকু জানেন?
--- মানে?
--- না মানে বলছিলাম আমরা তো এক পাড়াতেই থাকি, আমরা কি দুজন দুজনের সম্পর্কে সম্পূর্ণটা জানি?
--- যতটুকু জানলে এই একজন মানুষকে বন্ধু ভাবা যায় ঠিক ততোটুকুই জানি। আপনি শিক্ষিত, মার্জিত,পরোপকারী, সুচাকুরে সর্বোপরি একজন ভালো মনের মানুষ।
--- ব্যাস এটুকুই?
--- বাকিটা আপনার ব্যক্তিগত জীবন।আর আপনার ব্যক্তিগত জীবনে আমার প্রবেশের কোন অধিকার নেই।
--- না মানে বলছিলাম কি আমার যে বিয়ে হয়েছিল আপনি সেটা জানেন?
--- জানি,বিয়েতে আমাদের নেমন্তন্ন ছিল।বাবা মা গেছিলেন। কিন্তু আমি পরীক্ষা সামনে থাকায় যেতে পারিনি।
---  আর তার পরের ঘটনা কিছু?
--- অন্যের জীবনের ঘটনা সবকিছু আরেকজনকে জানতেই হবে তার তো কোনো মানে নেই।
--- আমি মনে করি যে কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠে হয় দুটো মানুষ না হয় দুটো পরিবারের মধ্যে;সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে গেলে দুই পক্ষের উভয়ের মধ্যে কোন লুকোচুপি থাকা উচিত নয়।
--- আমরা যখন এক পাড়াতেই থাকি তখন অল্প হলেও কিছুটা জানি বৈকি !
 উবের চালক হঠাৎ গাড়িটা থামিয়ে দেওয়ায় নিলয় বলে উঠলো,
---কি হল দাদা?
---- নির্দিষ্ট জায়গায় এসে গেছি তো।
 কথা বলতে বলতে কখন যে তারা বড় রাস্তার মোড়ে এসে গেছে দুজনের কেউই খেয়াল করেনি।গাড়ির জালনা দিয়ে দেখে নিয়ে দুজনেই নেমে গেল।নিলয় আজও কিছুতেই অম্বিকাকে কোন টাকা দিতে দিল না।সে নিজেই পেমেন্টটা দিয়ে দিল।কিছুটা রাস্তা হেঁটে এসে প্রথমেই অম্বিকাদের  বাড়ি আরও কিছুটা হেঁটে নিলয়দের । কথা মাঝখানে শেষ হয়ে যাওয়াতে নতুন করে নিলয় আর কোন প্রসঙ্গ তুললো না।শুধু অম্বিকাকে বলল,
-- অনেক কিছু বলার ছিল কাইন্ডলি যদি ফোন নাম্বারটা দেন।
 অম্বিকা ব্যাগ থেকে একটা কাগজের টুকরো বের করে তাতে নিজের ফোন নাম্বারটা লিখে নিলয়ের হাতে দিল।
--- thanks, কখন ফোন করা যাবে?
--- রাত দশটার পরে করলে ফ্রী মাইন্ডে কথা বলতে পারবো।আপনি রওনা হচ্ছেন কবে?
--- আগামীকাল সকালেই। যদি কিছু মনে না করেন তবে মাঝে মাঝে যদি আমার বাবা-মায়ের সাথে গিয়ে একটু গল্প করে আসেন;তাহলে কিন্তু উনাদেরও খুব ভালো লাগবে। আসলে আমি চলে যাওয়ার পরে উনারা খুব একা হয়ে পড়বেন।এই প্রথম বাবা মাকে ছেড়ে আমি বাইরে যাচ্ছি।তাই ভীষন চিন্তা হচ্ছে উনাদের জন্য।
--- এত ভাববেন না।একটু বিশ্বাস রাখুন না আমার উপর। আমি কথা দিচ্ছি আমি ওনাদের খেয়াল রাখব।এবার তবে আসি,সাবধানে যাবেন,ভালো থাকবেন।
  ট্রেনের কামরার ভেতর নানান কথা ভাবতে ভাবতে কোন এক সময় তার চোখ দুটি লেগে এসেছিল। ঘুমটা হঠাৎ করেই ভেঙে গেল একজন পুরুষের কর্কশ গলার আওয়াজে। তিনি চিৎকার করে তার সাথে থাকা ভদ্রমহিলাকে বলছেন,
--- ওদিকে উঁকি মেরে তুমি কি দেখছো?এখানে এসে আমার পাশে বসো। চেনা অচেনা পুরুষ মানুষ দেখলেই তার দিকে হা করে কি যে তুমি দেখো তাই ঈশ্বরই জানেন।
  নিজের স্ত্রীর সাথে পাবলিক প্লেসে মানুষ এই ভাবে কথা বলতে পারে তা নিলয় বোধ করি স্বপ্নেও কোনোদিন ভাবেনি। ইচ্ছাকৃত সে চোখ বন্ধ করে থাকলো।সে মনেমনে ভাবল এই সময়ে চোখ খুললে আর ওই ভদ্রমহিলার দিকে চোখাচোখি হয়ে গেলে তখন লোকটি হয়ত আরো কিছু অফেন্সিভ কথা তার স্ত্রীকে শোনাবে।তাই সে চোখ বন্ধ করেই পরে থাকলো। ট্রেন তখন ভুবনেশ্বর স্টেশনের কাছাকাছি।গতি খুবই ধীর লয়ে। নিলয় তার দুটো লাগেজ নিয়ে দরজার কাছে যখন এগিয়ে যাচ্ছে তখন পিছন থেকে কেউ তাকে ধাক্কা মেরে চলন্ত ট্রেন থেকে প্লাটফর্মে লাফিয়ে পড়লেন।নিলয় তাকিয়ে দেখলো ট্রেনের সেই ভদ্রমহিলা। পিছনের ভদ্রলোক হই হই করে উঠলেন। তিনি তার বিশাল মোটা ভারী শরীরটা নিয়ে নিলয়কে এক ধাক্কা মেরে গাড়ি থেকে নেমে তার স্ত্রীর খোঁজে সামনের দিকে দৌড় দিলেন।সাথে অবশ্য লাগেজটা নিতে ভুললেন না। ঘটনার আকস্মিকতায় নিলয় কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেল।ওই এসি কামরায় নিলয় আর ঐ ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা ছিলেন।আর কেউ ছিলনা।কিন্তু চলন্ত ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে ভদ্রমহিলা যে মুহূর্তের মাঝে কোথায় দৌড়ে পালিয়ে গেলেন এবং কেন গেলেন সেটা নিলয় সেই মুহূর্তে বুঝতে না পারলেও পরে সে সবকিছু জেনে গেছিল।
  নিলয় প্ল্যাটফর্ম থেকে নেমে অটোর দিকে এগিয়ে যায়। অটো করে তাকে তার কোয়াটারে যেতে হবে।সে একটা অটোর ভিতরে গিয়ে বসে।কিন্তু হঠাৎ করেই পাশে নজর  যেতে সে ভুত দেখার মত চমকে ওঠে।ট্রেনের ভিতরের সেই ভদ্রমহিলা! মুখে কাপড় জড়িয়ে মুখ ঢেকে অটোর ভিতরে বসে।নিলয় অটোতে উঠেও নেমে পড়ে। ভদ্রমহিলা তখন অটোতে বসে নিলয়ের দিকে ফিরে হাতজোড় করে বলে,
--- দয়া করে আপনি আমাকে বাঁচান।আপনি যেখানে যাচ্ছেন আপাতত আমাকে সাথে নিয়ে যান।কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি আপনার সাথে আমি আপনার বাড়িতে আমি  যাবো না।কিন্তু কিছুক্ষণ সময় আমাকে আপনার সাথে থাকতে দেন।আমি সবকিছু আপনাকে সময় মতো বলবো।এই মুহূর্তে আমার বাঁচার এটাই একমাত্র রাস্তা।ওরা আমাকে ধরতে পারলে শিয়াল কুকুরের মতন ছিঁড়ে খাবে।তাই আপনার কাছে অনুরোধ,আপনি আমাকে একটু সাহায্য করুন;অন্তত কিছুক্ষণ সময়ের জন্য।
 নিলয় চুপচাপ অটোতে উঠে বসলো।ড্রাইভার পাশের একটি গুমটিতে চা খাচ্ছিল।সে আরো দুজন প্যাসেঞ্জারের জন্য ওয়েট করতে লাগলো।কিন্তু নিলয় বুঝেছিল এই ভদ্রমহিলার কিছু একটা সমস্যা হয়েছে।তাই সে ড্রাইভারকে অনুরোধ করলো সে গাড়িটা রিজার্ভ করে যেতে চায় সুতরাং গাড়িটা ছেড়ে দিতে। ভদ্রমহিলা চাপাস্বরে নিলয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, "থ্যাংকস।"
  প্রায় কুড়ি পঁচিশ মিনিট পর অটো এসে থামল নিলয়ের কোয়াটারের সামনে।নিলয় অটোর ভাড়া মিটিয়ে দিলো। অটো টা চলে যেতে সে ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে বলল,
--- এবার আপনি কি করবেন?কোথায় যাবেন?আর আপনার এমন কি সমস্যা হয়েছে যে নিজের স্বামীর সাথে বেরিয়ে আপনি চলন্ত ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে নিজেকে লুকিয়ে ফেললেন?
--- আপনাকে তো আমি বলিনি উনি আমার স্বামী,তবে আপনি বুঝলেন কী করে যে উনিই আমার স্বামী?
--- তাহলে উনি আপনার কে হন? অবশ্য এই প্রশ্নগুলো করার আমার কোন অধিকার নেই। আমার কাজ শেষ।আপনি এখন নিশ্চিন্ত মনে যেখানে খুশি যেতে পারেন।
 ভদ্রমহিলা তখন মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
--- আর একটা অনুরোধ রাখবেন?আজকের রাতটা আমাকে একটু জায়গা দেবেন?সকাল হলেই আমি চলে যাব।
--- দেখুন এই জায়গায় আমি আজ নতুন।কিছুই চিনি না এখানকার আমি।এই প্রথম আসা আমার,এখানে চাকরির সূত্রেএকটি কোয়াটার পেয়েছি।চাবি এখনো হাতে পাইনি। এখন কেয়ারটেকারের সাথে দেখা করে চাবি নিয়ে আমাকে সেই ঘরে ঢুকতে হবে।এই পরিস্থিতিতে একজন অচেনা অজানা নারীকে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না।আপনি যদি চান আপনাকে আমি একটা হোটেল বুক করে দিতে পারি। সেখানে আমি পেমেন্ট দিয়ে আসবো আপনার থাকা-খাওয়ার কোন অসুবিধা হবে না।যদি রাজি হন তো বলুন,আমি কাজটা করে তারপরে যায়।
ভদ্রমহিলা মনে মনে কি ভাবলেন তিনিই জানেন।তিনি নিলয় কে অনুরোধ করলেন; না কোন হোটেল নয় আপনি আমাকে শুধু রাত্রিটুকু মাথা গোঁজার জন্য একটু আশ্রয় দেন।আমি  আপনার কাছে আর কোন কিছু দাবি করবো না। আপনাকে আমি চিনি না জানি না কিন্তু শয়তান নরপশু গুলো থেকে আপনি যে ভাল মানুষ তা আমি বুঝতে পেরেছি ট্রেনের মধ্যেই।
---ট্রেনের মধ্যে তো আপনার সাথে আমার কোন কথা হয়নি।আমি তো চোখ বুঝেই ছিলাম। তাহলে আপনি কি করে বুঝলেন ?
---বুঝতে পেরেছি।আসলে আপনারা পুরুষেরা  অনেক কিছুই বুঝতে পারেন না।আমরা মেয়েরা কিন্তু মানুষ চেনার ব্যাপারে একটু বেশি অ্যাডভান্স।অপরিণত বয়সে মেয়েরা যে ভুলগুলি করে সেগুলোর কিন্তু আর পুনরাবৃত্তি হয়না।বয়সবৃদ্ধির সাথে সাথেই আমরা অনেক কিছুই জানতে পারি,বুঝতে পারি।আমাদের মেয়েদের ঠিক মা দুর্গার মত একটা তৃতীয় নয়ন আছে আর সেই নয়নই আমাদের সবকিছু বুঝতে সাহায্য করে।বলতে পারেন ওই তৃতীয় নয়নটাই আর একটা মনের কাজ করেন।

ক্রমশঃ 


    

No comments:

Post a Comment