সুখের ঘরে আগুন (একাদশ পর্ব)
শালিনী বুঝতে পারে কোনো অবস্থাতেই নিলয় তার সাথে আর কোন ব্যাপারেই কথা বলবেনা। সেও চুপ করে যায় ।বাড়িতে মেয়ে আর নূতন জামাই ঢোকার সাথে সাথে শুরু হয় শাঁখ ও উলুধ্বনি সহকারে জামাই বরণ। মনের ভিতরে একটা অস্থিরতা কাজ করলেও নিলয় এই মুহূর্তে চুপ করেই থাকে। পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন সকলের সাথে নিলয় হাসিঠাট্টায় মশগুল। কাউকেই সে বুঝতে দিতে নারাজ তারও শালিনীর ভিতরকার ব্যাপারটা। কিন্তু শালিনী বহুবার চেষ্টা করেছে এত কিছু সত্ত্বেও নিলয়ের সাথে একটু আলাদা ভাবে কথা বলার ।কিন্তু নিলয় তাকে সে সুযোগ দেয়নি।
রাতে ঘরে শুতে গিয়ে ঘরে একটা ছোট খাট দেখে নিলয় এদিক-ওদিক তাকিয়ে কিছু খোঁজার চেষ্টা করে ।শালিনী বুঝতে পারে এবং ঘর থেকে বেরিয়ে যায়, ফিরে আসে একটা মাদুর নিয়ে ।নিচুতে সে একটা বিছানা করে এবং নিজেই নিচে শুয়ে পড়ে। নিলয় তাকে অনুরোধ করে উপরে উঠে শুতে ; কিন্তু শালিনী সেকথার কোন জবাব দেয় না। রাতটা এভাবেই কেটে যায় ।শালিনী আর কখনো চেষ্টা করেনি নিলয়ের সাথে কথা বলবার কারন সে ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে নিলয় তার সাথে কোন কথাই বলবে না। বিয়ের আগের দিন রাতে নিলয়কে কথাগুলো বলার জন্য এখন তার নিজের হাত নিজেকেই কামড়াতে ইচ্ছা করছে ।সে ভাবতেও পারেনি তার জীবনে হঠাৎ করে এরূপ একটি ঘটনা ঘটবে। এই ঘটনার জন্য সে মোটেই প্রস্তুত ছিল না। শংকর যে তার সাথে এরূপ একটি ঘটনা ঘটাবে তা তার স্বপ্নেরও অগোচর ছিল। সেতো শঙ্করকে ভালোবেসে, বিশ্বাস করে বিয়ের আগের দিন রাতে তার হবু স্বামীকে তার ছেলেবেলার ভালোবাসার কথা জানিয়েছিল।
পরদিন সকাল থেকেই নিলয় বাড়ি যাবার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পরলো। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী অষ্টমঙ্গলায় শ্বশুর বাড়িতে এসে আড়াই দিন থাকতে হয়। বারবার শালিনীর বাবা-মা তাকে অনুরোধ করে। সে একটি কথাই শুধু বলে,
--- কাল অফিস আছে।
কিন্তু শালিনী খুব ভালোভাবে জানে নিলয়ের এখনো তিনদিন ছুটি।সে এখানে থাকবে না বলেই বাবা-মাকে জানাচ্ছে কাল তার অফিস আছে। সবকিছু বুঝেও শালিনী চুপ করে থাকে। কারন সে নিজের পায়ে নিজেই কুড়ুল মেরেছে। তবুও সুযোগ পেয়ে একসময় সে নিলয় কে বলে,
--- আপনার তো এখনো তিনদিন ছুটি বাকি আছে যদি খুব অসুবিধা না হয় আরেকটি দিন এখানে থেকে যান। তাতে আশা করি আপনার বিশ্বাস কোন ক্ষতি হবে না।
--- আপনার কথাটা আমি মেনে নিলাম। তবে কাল আমি বাড়ি ফিরবো আপনি এখানেই থাকবেন আমি সময় মত ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দেব।
কথাটা শুনে শালিনী চমকে ওঠে। কিন্তু ওর কিছু করার নেই ও তো নিজেই নিজের কবর খুঁড়ে আছে। ইচ্ছা থাকলেও নিলয় কে ও আর ধরে রাখতে পারবেনা। শালিনী কোন উত্তর দি লো না দেখে নিলয় পুনরায় তাকে বলল,
---এটলিস্ট ছমাস আলাদা থাকতেই হবে ।তা না হলে তো ডিভোর্স পাওয়া যাবে না। হ্যাঁ আপনি ইচ্ছে করলে খোরপোষ দাবি করতে পারেন তবে আমার মনে হয় আমাদের বিয়েটা যেহেতু লোকদেখানো ছিল সেই কারণে এই খোরপোষটা মনেহয় ধোপে টিকবে না। আপনার ইচ্ছা হলে এটা করতেই পারেন আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব বিনা প্রতিবাদে আপনার দাবি পূরণের। আপনি আপনার বাবা মাকে কি বলবেন সেটা আপনার ব্যাপার। আমি আমার বাবা মাকে ঠিক ম্যানেজ করে নেব। আপনার কিছু জামাকাপড় আর হয়তোবা কিছু গয়নাগাটি ওই বাড়িতে আছে আমি একসময় লোক মারফত ওগুলো পাঠিয়ে দেব। তবে এবার আমি চলে যাওয়ার পর পরবর্তীতে আপনার সাথে আমার দেখা হবে কোর্টে।
শালিনী একটা কথারও উত্তর করেনা। ঘরে নাইট লাইট জ্বলছিল। সেই লাইটের আলোতে নিলয় দেখতেও পেলো না শালিনীর চোখ দিয়ে অবিরাম ধারায় জল পড়ে চলেছে। নিলয় ঘুমিয়ে পরল আর শালিনী সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারলো না। শুধু চোখের থেকে নোনা জল ঝরে বালিশ ভিজিয়ে দিল।
শালিনীর জীবনে শংকর এসেছিল ঝড়ের মতন সেই স্কুল লাইফ থেকে। শালিনী একদিন স্কুল যাবার পথে কিছু ছেলের টোন টিটকারীর শিকার হয়।আ র তা থেকে শালিনিকে রক্ষা করেছিল শংকর। সেই থেকেই শংকরের সাথে তার পরিচয় ।গরিব ঘরের ছেলে সে। টিউশনি করে পড়াশোনা করে ।শালিনী যখন মাধ্যমিক দেবে শংকর সে বছরই উচ্চমাধ্যমিক দেবে। দুজনের মধ্যে প্রথমে বন্ধুত্বপূর্ণ পরে তা ভালবাসায় পরিনত হয় ।শঙ্করের বাড়ির লোক সব কথা জানলেও শালিনীর বাবা-মা তাদের এ সম্পর্কের কথা জানত না ।শালি নীদের পরিবার ছিল খুব কনজারভেটিভ। শালিনীরা ছিল উচ্চবিত্ত পরিবারের আর শঙ্ক রেরা ছিল নিম্নবিত্ত । শালিনীর বাবা দারিদ্রতাকে কোনরকম সহ্য করতে পারতেন না। শালিনীর বাবা জন্ম থেকেই ছিলেন ধনী পরিবারের সন্তান। বলতে গেলে তিনি সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছিলেন। তাই কোনরকম দারিদ্রতা তিনি সহ্য করতে পারতেন না। মানসিক দিক থেকে বলতে গেলে বলা যায় তিনি ছিলেন অর্থ পিপাসু এবং অহংকারী। একমাত্র সন্তান হওয়ার ফলে উত্তরাধিকারসূত্রে তিনি পেয়েছিলেন অঢেল টাকাপয়সা, সম্পত্তি এবং পারিবারিক ব্যবসার মালিকানা। তাই তিনি যখন জানতে পারেন শংকরের সাথে শালিনীর একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, তিনি তখন তার একমাত্র কন্যার বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগে যান। শংকর কিন্তু তখন বিএসএফ এ চাকরিও পেয়েছিল। কিন্তু পালিয়ে গিয়ে শালিনীকে বিয়ে করার পক্ষপাতী সে ছিল না। শালিনী তার বিয়ে ঠিক হওয়ার পর শংকর কে বলেছিল পালিয়ে বিয়ে করতে ।কিন্তু শংকর রাজি হয়নি। শালীন শেষ মুহূর্তে বিয়েটা ভেঙ্গে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। কিন্তু হয়তো ভাগ্যের পরিহাসে তা সম্ভব হয়নি। বিয়ের দিন সকালে শংকর তার এক বন্ধুর মারফত এক চিঠি পাঠিয়েছিল শালিনীকে তাতে সে পরিষ্কার জানিয়েছিল সে চাকরিতে জয়েন করার জন্য সীমান্তপারে চলে যাচ্ছে ।শালিনী যেন এই বিয়ে করে সুখী হয় এবং তাকে সারা জীবনের মতো ভুলে যায়।
এই কথাগুলো জানানোর জন্যই বিয়ের পরদিন থেকেই শালিনী আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেছে নিলয় কে কথাগুলো জানানোর জন্য।কিন্তু নিলয় কোন অবস্থাতেই সেই রাতের ফোনের পর তার সাথে অন্য কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে রাজী হয়নি। এখন শালিনী সম্পূর্ণ নিরুপায়! কোন অবস্থাতেই নিলয় তাকে যে আর মেনে নেবে না এটা সে ভালভাবেই বুঝতে পেরেছে। ঠিক এই মুহূর্তে শালিনী তার নিজের ভাগ্য টাকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্রেকফাস্ট করেই নিলয় যাবার জন্য প্রস্তুত হয়। শালিনীর মা এসে শালীনিকে রেডি হতে বলেন। কিন্তু শালিনী বলে সে কটা দিন এখানে থাকবে। মা তাকে জানান দুজনকে একসাথে শ্বশুর বাড়িতে ফিরতে হবে। কিন্তু শালিনী জীদ করতে থাকে সে কিছুদিন এখানেই থাকবে। শালিনীর মা তার জামাইকে গিয়ে শালিনীকে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানান। নিলয় তাকে জানায় কয়েকটা দিন শালিনী যদি এখানে থাকে তাতে তার কোন অসুবিধা হবে না। সে তার বাবা-মাকে কথাগুলো বুঝিয়ে বলবে। এরজন্য শালিনীকে কোন কথা শুনতে তার বাবা-মায়ের কাছ থেকে হবে না। কোন উপায় না দেখে শালিনীর মা রাজি হতে বাধ্য হন। নিলয় তার ব্যাগ গুছিয়ে রওনা দেয়। যাওয়ার আগে শালিনীকে জানিয়ে যায়, ছয় মাসের মধ্যেই সে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দেবে। শালিনী যেন তার ভালোবাসাকে আপন করে নেয়।
No comments:
Post a Comment