Sunday, November 19, 2023

স্বপ্ন দেখা বারণ

 স্বপ্ন দেখা বারণ 

 কবরীর সামনে খামটা এগিয়ে দেওয়ার সাথে সাথেই সে বুঝতে পারে কে তাকে এটা পাঠিয়েছে। কিন্তু সে তো কোনদিন কারো কাছেই কিছু সাহায্য চায়নি। বরং কেউ তাকে অর্থ সাহায্য করতে চাইলে সে নিজেই সামলে নিতে পারবে বলে জানিয়েছে। এই অর্থ সাহায্যর ব্যাপারটা অবশ্য বেশ কয়েক বছর আগে একমাত্র আয়ান তাকে বলেছিলো। তখন থেকেই কবরীর মা শয্যাশায়ী। বাম অঙ্গ পড়ে গিয়ে সেই থেকেই অসার। সামান্য একটা চাকরি গ্রাম পঞ্চায়েত অফিসে। মাস গেলে মাত্র কয়েক হাজার টাকা হাতে আসে। তাই দিয়েই দিন গুজরান আর মায়ের চিকিৎসা। আয়ান গ্রামেরই ছেলে। পরোপকারী, মানুষের বিপদ দেখলেই আপন পর না ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কবরী বুঝতে পারে আয়ান তাকে ভালোবাসে। কিন্তু গ্রামের লোকেরা এই ভালোবাসায় বাধা হয়ে দাঁড়াবে সেটা আয়ান এবং কবরী দু'জনেই ভালোভাবে জানে। কারণ কবরীরা হিন্দু আর আয়ানরা মুসলিম। তাই দু'জনেই কেউ কাউকেই জানতে না দিয়ে তাদের ভালোবাসা নিজেদের অন্তরেই রেখে দেয়।
  আয়ান চাকরি পেয়ে শহরে চলে আসে। আসবার আগে কবরীর সাথে দেখা করে বলে,
-- গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছি ঠিকই কিন্তু কোন প্রয়োজন পড়লে আমায় জানাতে ভুলো না। ফোন নম্বরটা রাখো।
-- সামান্য হলেও যা হোক একটা চাকরি করি। দু'টো মাত্র প্রাণী ঠিক চালিয়ে নিতে পারবো। তুমি ভালো থেকো। 
 কিন্তু দু'বছরের মধ্যে আয়ান আর গ্রামে ফেরেনি। কোনদিন আর ফোনও করেনি। প্রথম প্রথম কবরীর খারাপ লাগলেও এখন আর খারাপ লাগে না। কিন্তু মাঝে মধ্যেই আয়ানের কথা তার মনেপড়ে। ভুলতে চাইলেই কি আর সবকিছু মানুষ ভুলে যেতে পারে? 
  আয়ানদের বাড়ি কবরী কোনদিন যায়নি। শুনেছিল ওদের বাড়ি নাকি সর্দার পাড়ায়। ইচ্ছে করলেই কারো কাছে জেনে সে আয়ানের খবর নিতে পারতো। কিন্তু কখনোই চেষ্টা করেনি। একটা যুবতী মেয়ে গ্রামগঞ্জে যখনই একজন যুবকের খবর নেবে তখনই নানান গুঞ্জন উঠবে। হয়ত তখন শালিসী সভা ডেকে বিচার করার নামে চাকরিটাও নড়বড়ে করে দেবে। তাই মন চাইলেও বিবেক সায় দেয়নি।
  আর এদিকে আয়ান শহরে আসার পথেই তার মোবাইল হারিয়ে ফেলে। বুক পকেটে মোবাইল থাকায় স্টেশনে ভিড়ের মধ্যে হয় তা পড়ে যায় নতুবা কেউ তুলে নেয় পকেট থেকে। শহরে পৌঁছানোর পনের দিনের মাথায় বাড়ির লোক সেখানে পৌঁছে যায়। দূর সম্পর্কের চাচার বাসায় থাকা আগে থাকতেই ঠিক ছিল। তাই তাদের সেখানে পৌঁছাতে কোন বেগ পেতে হয়নি। দুই বাড়ির লোকেরা আগে থাকতেই ঠিক করে রেখেছিলেন আয়ানের চাচাত বোনের সাথে তার বিবাহ। আয়ানের কোন আপত্তিই ধোপে টেকে না। সে বিয়ে করতে বাধ্য হয়। বাড়ির লোকের লাভ একমাত্র মেয়ে হওয়ার সুবাদে শহরে দোতলাবাড়ি।
 কিন্তু সে ওখানে থেকেই খবর রাখে কবরীর। দু'বছর বাদে আয়ান গ্রামে ফেরে বউ নিয়ে। খবর যায় কবরীর কাছে। হঠাৎ করেই বুকটা একটু যেন কেপে ওঠে। হয়ে যায় একটু আনমনা। কিন্তু অচিরেই নিজেকে সামলে নেয়। 
  সে সময় মায়ের প্রচণ্ড বাড়াবাড়ি হওয়াতে গ্রামীণ হাসপাতাল জানিয়ে দেয় তাদের হাতের বাইরে। শহরে নিয়ে যেতে হবে। অর্থবল,বাহুবল কোনোটাই নেই। হঠাৎ অপরিচিত বয়স্ক এক ভদ্রলোক সন্ধ্যায় বাড়িতে আসে কিছু টাকা নিয়ে। টাকাটা যদিও খামের মধ্যে ছিল কিন্তু প্রেরকের নাম না থাকলেও কবরীর বুঝতে অসুবিধা হয় না এটা আয়ানই পাঠিয়েছে। হাত জোড় করে খামটা নিতে অস্বীকার করে। 
 পরদিন সকালে মায়ের সামান্য গয়না নিয়ে বিক্রি করতে যখন সোনার দোকানে যায় তখন পথে আয়ানের সাথে দেখা। আয়ানই প্রথম জানতে চায়,
--- কেমন আছো?
-- বিয়ে করেছ শুনলাম। বউ দেখাবে না?
-- বিয়ে করেছি না, করতে বাধ্য হয়েছি। আমার বউ তোমার মত অত সুন্দরী নয়।
--- যাক অন্যভাবে হলেও সৌন্দর্য্যের টারিফ তো করলে। এমন কী হল হঠাৎ চাকরি পেয়েই যোগাযোগ বন্ধ করে দিলে? 
-- জীবনে এমন অনেক ঘটনা ঘটে যারজন্য মানুষ মোটেই প্রস্তুত থাকে না। ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে পরিবারের গুরুজনের কথা মেনে নিতে বাধ্য হতে হয়। হিসাব করে জীবন চলে না। 
 চুপ করে থাকে কবরী। আয়ান বলতে থাকে,
 এজীবনে সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেলো শুধু জাত কিংবা ধর্মের জন্য। কত জীবন নষ্ট হয়ে যায় এই জাত আর ধর্মের বিচারে। কবে যে আমাদের বাঙ্গালী সমাজ এর থেকে পরিত্রাণ পাবে তা বোধকরি স্বয়ং সেই সৃষ্টিকর্তাও জানেন না। 
 আয়ান চুপ করে যায়। কবরী তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে দেখতে পেয়ে আবারও শুরু করে,
-- জানি কোন লাভ নেই আগেও ছিলো না তবুও আজ বলি কবরী, আমি তোমায় ভালবাসতাম আজও বাসি যতদিন এ দেহে প্রাণ আছে ততদিন ভালোবেসে যাবো। পরের জন্মে আমরা যেন একই ধর্মের মানুষ হয়ে পৃথিবীতে আসি। এই জাতপাতের বালাই এই বাঙ্গালী সমাজ থেকে কোনদিনও বিলুপ্ত হবার নয়।
 আয়ান চুপ করে যায়। চারিদিকে একটু একটু করে অন্ধকার নেমে আসছে। কবরী অন্ধকারের মধ্যেই শাড়ীর আঁচল দিয়ে চোখটা মুছে ধীরপায়ে হাঁটতে শুরু করে। কোন উত্তর সে আয়ানের কথার দেয় না। আয়ান সেদিকে তাকিয়ে থাকে। আস্তে আস্তে অন্ধকারের ভিতর কবরী একসময় আয়ানের চোখের আড়াল হয়ে যায় ঠিক যেভাবে আয়ানের জীবন থেকে সে হারিয়ে গেছে।

#মানবী ২০-১১-২৩

Sunday, October 8, 2023

সব গল্প কাল্পনিক নয় ( সংকলন)

    সব লেখা কাল্পনিক নয়


  দুই বিনুনী ঝুলিয়ে স্কুলে যাওয়ার পথে রেখা রোজ ছন্দাদের বাড়ি আসে। দু'জনে একসাথে বাকি পথটা হেঁটে স্কুলে পৌঁছায়। রেখাদের বাড়ি গ্রামে হলেও ভাইবোনেরা সব মফস্বল শহরে ঘরভাড়া নিয়ে থাকে লেখাপড়ার সুবিধার্থে। আর ছন্দার বাবা শহরে একজন নামজাদা উকিল। ছন্দার বাবা সমরেশ চৌধুরী তার ছেলেমেয়ে নিয়ে নিজের বাড়িতেই থাকেন। 
   জমিদার বাড়ির সন্তান হওয়ার সুবাদে গ্রামে প্রচুর জমিজমা, পুকুর, বাগান ইত্যাদি থাকার ফলে সমরেশ বাবুকে প্রতি শনিবার করেই গ্রামে যেতে হয়। সেখানে তাঁর স্ত্রী,মা ও এক মাত্র ছেলে থাকে। সমরেশ বাবুর পরপর বেশ কয়েকটি মেয়ে হওয়ার পর প্রায় মধ্য বয়সে এসে এই পুত্র সন্তানের জন্ম। স্বাভাবিকভাবেই সে সকলের খুব আদরের। আর বয়স যেহেতু এখন তার খুবই কম সে তার মায়ের সাথে গ্রামের বাড়িতেই থাকে।
    রেখার বাবা স্কুল শিক্ষক।তিনি ও তার স্ত্রী গ্রামেই থাকেন। কিন্তু পড়াশুনার সুবিধার্থে তার ছেলেমেয়ে শহরে ঘরভাড়া করে থাকে। রেখা ও ছন্দাদের বাড়ি একই পাড়ার কয়েকটা বাড়ির পর। পড়েও তারা একই ক্লাসে। রেখার দাদার তখন কলেজে প্রথম বর্ষ। দাদা শুভেদু পড়াশুনায় তুখোড়। এক মাথা ঝাঁকড়া চুল, বুদ্ধিদীপ্ত দু'টি চোখ, টানা ভ্রু। গায়ের রং বেশ চাপা।সুদর্শন বলতে যা বোঝায় শুভেন্দু তা কোনদিনও ছিলো না। ছিল তার একটা আলগা চেহারা। কোন মেয়ে প্রথম দর্শনেই তার প্রেমে পড়বে না একথা ঠিক কিন্তু তার মায়াভরা মুখটার মধ্যে এমন কিছু ছিলো, তার সাথে মিশলে কথা বললে তার সরলতা আর ওই মায়াভরা মুখটা মিলে একটা ভালোলাগা কাজ করতো।
   ছন্দা তাকে যে খুব একটা পছন্দ করতো তা নয়। আবার খুব যে একটা অপছন্দ করতো তাও নয়। কিন্তু বিকেল হলেই কী এক অমোঘ টানে ছন্দা ছুটে যেত রেখাদের বাড়িতে। ছন্দা যখনই তাদের বাড়িতে গেছে সে লক্ষ্য করেছে রেখার দাদা শুভেন্দু মাথা গুঁজে বইয়ের টেবিলে বসা। কলেজ থেকে ফিরে এসে শুভেন্দু কিন্তু ওই সময়টা বাড়িতে তার পড়ার টেবিলেই বসে পড়তো কিংবা বলা ভালো পড়ার ভান করে ছন্দাকে লক্ষ্য করতো। বেশ কয়েকবার প্রতিদিনই দু'জনে চোখাচোখি হয়েছে। কিন্তু দু'প্রান্তের দু'জনেই ভালোলাগা কিংবা ভালোবাসার কথা কেউ কাউকেই বলতে পারেনি। হয়ত বলা ভালো ওই বয়সে ওই সময়ে ভালোবাসাটা তারা নিজেরাও বুঝতে পারেনি। কিন্তু বিকেল হলেই শুভেন্দুকে একটিবার চোখের দেখার অদম্য এক শক্তি ছন্দাকে তার বাড়ির দিকে টেনে নিয়ে যেত। আর অদ্ভুতভাবে শুভেন্দুও বিকেলের ওই সময়টুকু কোনদিনও বাড়ির বাইরে পা রাখেনি।
   এমনই একদিন ছন্দা যখন রেখাদের বাড়ি যায় সেই মুহূর্তে রেখা ঘরে না থাকায় ওর দাদার পড়ার টেবিলের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখে শুভেন্দু একমনে একটা ছবি আঁকছে। ছন্দা তার কিছুটা কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে,
--- তুমি কী সুন্দর ছবি আঁকো দাদা। আমার একটা ছবি এঁকে দেবে?
 শুভেন্দু চোখ তুলে ছন্দার মুখের দিকে তাকায়। ওই চোখের দিকে তাকিয়ে মুহূর্তে ছন্দার বুকের ভিতর বিদ্যুৎ খেলে যায়। সে চোখ নামিয়ে নেয়। শুভেন্দু সে কথার উত্তর না দিয়ে যে ছবিটা দেখে সে তার খাতার পাতায় ছবি আঁকছিল সেটা ছন্দার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
-- এই ছবিটা তুমি রাখো। তোমাকে কিন্তু ববিতার মতোই দেখতে।তাই আলাদা করে ছবি আর আঁকতে হবে না।

           ছবিটা ছিলো বাংলাদেশের সিনেমার নায়িকা ববিতার। শুভেন্দু একবার ছবিটার দিকে আর একবার ছন্দার দিকে তাকিয়ে ছন্দার হাতে ছবিটা দিতে দিতে বলে,
-- আসলে তোমার চেহারাটা আর ববিতার চেহারার কোথায় যেন একটা মিল আছে। তাই ববিতাকে সামনে রেখে ছন্দাকে আঁকার চেষ্টা করছিলাম।
 
ছবিটা ছন্দার হাতে দেওয়ার সময় শুভেন্দুর হাতের স্পর্শে ছন্দার বুকের ভিতর আর একবার কেঁপে ওঠে। কিন্তু কিশোরী ছন্দার এ কেঁপে ওঠার মানে বোঝার মত বুদ্ধি তখনো তার হয়নি। এরফলে তার মনের ভিতরে একটা ভয়ের বাতাবরণ তৈরি হয়। সে ওই বাড়িতে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। শুভেন্দুকে রোজ একটিবার চোখের দেখার ইচ্ছাকে নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে চাপা দিয়ে রাখে।

 এর বেশ কয়েকদিন পরে একদিন স্কুলে রেখা ছন্দাকে বলে,
-- তুই আজ কয়েকদিন আমাদের বাড়িতে যাস না কেন?
ছন্দা কিছুটা সময় চুপ করে থেকে বলে,
--- যাবো আজ 
-- তোর সাথে আমার একটা কথা আছে। কথাটা তোকে আমি বলছি ঠিকই কিন্তু কথাটা আমার নয়। একজনের কথা সে তোকে বলতে লজ্জা পাচ্ছে তাই আমি বলে দিচ্ছি।
 রেখার এই হেয়ালিপূর্ণ কথা ছন্দা কিছুই বুঝতে পারে না। সে রেখার দিকে তাকিয়ে থাকে। রেখা আর কোন ভনিতা না করে সরাসরি বলে,
--- আমার দাদা তোকে ভালোবাসে রে -
 পড়াশুনায় চিরমেধাবী ছন্দা ভবিষ্যতে ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছায় পড়াশুনাটাকেই জীবনে প্রাধান্য দিয়ে এসেছে। হঠাৎ করে রেখার মুখে এই কথা শুনে ছন্দা অবাক হয়ে রেখার মুখের দিকে তাকায়। ছন্দার এই তাকানো দেখে রেখা কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে বলে,
-- আমার দাদা কিন্তু ভবিষ্যতে ডাক্তারী কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং লাইনে যাবে।
 শুভেন্দুর স্পর্শে এই যে বুকের ভিতর কেঁপে ওঠা এই যে বিকেল হলেই তাকে দেখার এক অদম্য ইচ্ছা কিশোরী ছন্দা তখনও বুঝে উঠতে পারেনি এটাই ভালোবাসা। বাবার আত্মসম্মান আর নিজের জীবনের স্বপ্ন এই দুইয়ের কারণেই হয়ত সে এ'দিকটা সারা জীবনের মত ঘুম পারিয়ে রাখতে চেয়েছিল। রেখার কথা শুনে তার মুখের দিকে তাকিয়ে শুধু একটা কথাই সে বলেছিলো,
-- ভবিষ্যতে কে কোন লাইনে যাবে তা কি এখনই বলা যায়? 
 রেখা শুধু বিষণ্ণ মনে ছন্দার দিকে তাকিয়ে ছিল। রেখা তার দাদাকে কী বলেছিলো ছন্দা তা কোনদিনও জানতে চায়নি কিন্তু সেদিন রাতেই শুধু নয় ওই ছবিটা যখনই ছন্দা হাতে নেয় আজও সে সেই মানুষটার ছোঁয়া অনুভব করে।
  এই ঘটনার কিছুদিনের মধ্যেই রেখার এক মারত্মক অসুখ হওয়াতে সে গ্রামের বাড়ি মা,বাবার কাছে চলে যায়। স্কুল আসা বন্ধ হয়। অন্য ভাইবোনদেরও পড়াশুনা শেষ হওয়ায় যে যার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে যে যার মত জীবন কাটাতে থাকে। শহরে শুধু থেকে যায় শুভেন্দু। কিন্তু ওই বাড়িতে নয় অন্য কোথাও।
   স্মৃতির পাতা ঝাপসা হলেও ববিতার ছবিটা ছন্দার জীবনে প্রথম ভালোলাগা,ভালোবাসার স্পর্শ হিসাবে সে অতি যত্ন করে নিজের কাছেই রেখে দেয়। কিন্তু ছন্দা যখন বুঝতে পারে শুভেন্দুকে সে ভালোবেসে ফেলেছিল তখন সে অনেক দেরি করে ফেলেছিল। সেই সময় যখনই সে রাস্তায় বেরোত তার চোখদু'টি ওই মানুষটাকেই খুঁজতো। কিন্তু কোথায় সে? ছন্দার সামনে দাঁড়িয়ে তার মনের খবর না জেনে চিরদিনের মত ছন্দাকে ভুল বুঝে সে যেন ছোট্ট শহরটা থেকেই হারিয়ে গেলো।
  এরপর কেটে গেছে যুগের পর যুগ। হিন্দুদের প্রতি চরম অত্যাচারের বিপর্যয় ভোগান্তি সমরেশ চৌধুরীর পরিবারের উপর মারত্মক আঘাত হানে। চলে আসে ছন্দারা ভারতের মাটিতে। কিশোরী ছন্দা তখন যৌবনে পৌঁছেছে। এই বিপর্যয়ের ভিতরে জন্মভিটে, লাতিত শৈশব, কৈশর সবকিছু ফেলে আসলেও ফেলে আসতে পারেনি ববিতার ছবিটি। প্রথম ভালোলাগার প্রথম ছোঁয়া হিসাবে অতি সযত্নে সে ছবিটি তার সাথে করেই নিয়ে আসে।
 তারপরেও কেটে গেছে বহুযুগ। বিয়ের পরও পুরনো সেই ছবি ছন্দার নতুন অ্যালবামে ঠাঁই পেয়েছে। কিছুতেই সে যুগ যুগ পড়েও শুভেন্দুকে ভুলতে পারেনি।
 
  জীবনে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন কবে কোথায় যে কিভাবে হারিয়ে গেলো তা ছন্দারও জানা নেই। গতানুগতিকভাবে সংসার জীবনে পাওয়া না পাওয়ার হিসাব করতে করতেই জীবন থেকে ছাপ্পান্নটা বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু আজও মনের কোথাও না কোথাও প্রথম ভালোলাগার মানুষটা সেই আগের মতই রয়ে গেছে। কোথাও যেন একটা অপেক্ষা ছন্দার জীবনে এই বয়সেও কাজ করে।

 এখন এন্ড্রোয়েড ফোনের দৌলতে পৃথিবী আজ হাতের মুঠোই। কিন্তু শুভেন্দু গুপ্তের কোন খোঁজ সে ফেসবুকের কোথাও পায়নি। তার জীবনের না বলা কথাটা বলার জন্য ছন্দা যেন ধনুকভাঙা পণ করে শুভেন্দুর অপেক্ষায় বসেই আছে। খুঁজে চলেছে ফেসবুকও।

 কী করেই বা সে শুভেন্দু গুপ্তকে পাবে? শুভেন্দু আজ নামকরা একজন ডাক্তার। তার নামের আগে জ্বলজ্বল করে ডাক্তার শব্দটা।তাই শুধু শুভেন্দু গুপ্ত খুঁজে সে তার শুভদাকে পায়নি। হঠাৎ একটা ফেসবুক রিকোয়েস্টে তার চোখ আটকে যায়। অ্যাকসেপ্ট করেই ফোন করে ইনবক্সে। না,তার অনুমান ভুল নয়। এই শুভেন্দুই তার জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া শুভদা।

  যে কথা কেউ কোনদিন বয়স থাকতে বলতে পারেনি ফোনের দুই প্রান্তে দুটি শেষ বয়সের মানুষ সেই কথাগুলোই অকপটে স্বীকার করে, ফেলে আসা অতীত, ফেলে আসা কৈশোরকে যেন ছুঁতে চায় বারবার। শুভেন্দু এখন লন্ডনবাসী। সুখী দাম্পত্য জীবনে এক ছেলে আর এক মেয়ে। নিজ জীবনে আজ সে সুপ্রতিষ্ঠিত।
     অল্প বয়সে স্বামীহারা দু'সন্তানের জননী ছন্দার জীবন গতানুগতিক জীবনের বাইরে কোনদিনও পা ফেলতে পারেনি। বেঁচে আছে সে। অভাব,কষ্ট,দুঃখ সবকিছু নিয়েই। কিন্তু সত্যিই কী একে বাঁচা বলে? কিসের অভাব ছিল তার জীবনে? দেখতে মন্দ নয়, অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে, পড়াশুনাতেও মন্দ ছিলো না। তবে বিধাতা কেন তার ভাগ্যটাকে নিয়ে এভাবে ছিনিমিনি খেললেন? জবাব নেই! কারণ ভাগ্যের উপর কারও হাত নেই। 

      জীবনের হিসাবের খাতা সব শূন্যই পড়ে রইলো ছন্দার জীবনে। আসলে মানুষ যা চায় তা পায় না। আর যা পায় তা কোনদিন স্বপ্নেও সে ভাবে না। এই চাওয়া পাওয়ার যাঁতাকলে জীবনে এমন একটা সময় আসে তখন আর নিজের জন্য মানুষ বাঁচে না, নিজের জন্য কিছু চায় না - সব চাওয়া সব ইচ্ছা হয়ে পড়ে তার সন্তানের জন্য। ছন্দার মত অভাগী মানুষগুলির শেষ বয়সে এসে হয়ত ঈশ্বরের কাছ এর থেকে আর কিছুই চাওয়ার থাকে না। 
         তবে ছন্দার জীবনে আর একটি চরম পাওয়া পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে তার জীবনের প্রথম পুরুষটিকে দেরিতে হলেও সত্যিটা জানাতে পেরেছে। বিশ্বাস অবিশ্বাস বিচারের ভার অপরপ্রান্তের মানুষটির উপর। অবিশ্বাস করলেও যেমন কিছু যায় আসে না ,বিশ্বাস করলেও নয়। কারণ জীবন থেকে নতুন করে আর কিছুই চাওয়া বা পাওয়ার নেই।

  সব ভালোবাসা জীবনে পূর্ণতা পায় না। যে ভালোবাসা ছাদনাতলা় অবধি পৌঁছায় না সেখানে শুধু দূর থেকে ভালোবেসে প্রিয় মানুষটিকে খুশি থাকতে দেখেই খুশি থাকা যায়। তাই হয়ত কবিগুরু বলেছেন,
               "দূরত্ব যদি সত্যি সত্যিই 
               ভালোবাসার গভীরতা বাড়িয়ে দেয়,
                 তবে আমি দূরেই থাকতে চাই।"

 শেষ

Wednesday, October 4, 2023

ভালোবাসি বলেছি অনেকবার ( ৩য় পর্ব)


  দেবেশ গিয়ে মায়ের ঘরে ঢোকে। কিন্তু মাকে দেখাশুনা করার মেয়েটিকে সে দেখতে পায় না তখন। ওয়াশরুম থেকে জল পড়ার শব্দে বুঝতে পারে সে তখন ওয়াশরুমেই আছে। মায়ের কাছে এগিয়ে গিয়ে খাটের উপর মায়ের পাশে বসে। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে কপালে আগের সেই চাঁদের মত টিপ জ্বল জ্বল করছে। চুলগুলোও খুব সুন্দর করে আঁচড়ানো।
-- মা আজ তো তোমায় খুব ফ্রেস লাগছে। মেয়েটিকে পছন্দ হল?
 দেবেশের মা ছেলের কথা শুনে মুখে সামান্য হাসি এনে ছেলের একটি হাত নিজের দু'হাতের মধ্যে নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
-- মেয়েটার মুখের মধ্যে কিছু একটা আছে জানিস? দেখলেই মনেহয় খুব কাছের কেউ। খুব আস্তে আস্তে কথা বলে। 
 -- তারমানে বলো মেয়েটিকে তোমার পছন্দ হয়েছে।তাহলে তো এবার বাইরে ট্রিটমেন্ট করতে যাওয়ার কোন অসুবিধা নেই। এতদিন তো কলকাতা ছেড়ে যেতে চাওনি বাইরে গেলে কে তোমার দেখাশুনা করবে? কারণ বাবা তার হাসপাতাল ছেড়ে বেশিদিন বাইরে গিয়ে থাকতে পারবেন না আর কোন আয়া কিংবা আমার প্রতি তোমার কোন ভরসা নেই। তাহলে বাবার সাথে কথা বলে বাইরে যাওয়ার দিনক্ষণ ঠিক করে ফেলি?
-- আরে দাঁড়া দুটো দিন যেতে দে। মেয়েটা কেমন একটু বুঝে নিতে দে।
--- আচ্ছা মা, আমায় একটা কথা বলো তো তুমি তোমার জন্য আয়া চাইছো নাকি ছেলের বিয়ের মেয়ে চাইছো?
 বিদিশা হেসে পড়ে ছেলের মাথার চুলগুলো নাড়িয়ে দিয়ে বলেন
-- সত্যি কেন রে তুই বিয়ে করতে চাস না। এই তো শরীরের হাল আমার। চলে যাওয়ার আগে একমাত্র ছেলের বউ দেখে যাবো না?
-- ছেলের বউ দেখে যেতে হলে সুস্থ হতে হবে। আমাদের কথা শুনে চিকিৎসা করাতে বাইরে যেতে হবে। তারজন্য মনের মত আয়ার দরকার হবে কেন?
-- আমি কী তাই বলেছি কখনো? আসলে বাইরে গেলে তোকে কিংবা তোর বাবাকে যে কাউকে আমাকে নিয়ে যেতে হবে। বাকি যে জন বাড়িতে থাকবে তার তো দেখভালেরও একজন চাই।
-- মা,তোমার এসব কথা শুনলে খুব হাসি পায়। বাড়িতে বিলাসী পিসি রয়েছে। বাবার কাছে শুনেছি দাদু,ঠাকুমা মারা যাওয়ার পর বিলাসী পিসিই বাবার সব কাজ করে দিতেন। বাবা তখন ডাক্তারী পড়ছেন। কয়েকমাসের ব্যবধানে বাবা,মাকে হারিয়ে বাবা খুবই ভেঙ্গে পড়েছিলেন। সেই সময় এই পিসিই তো বাবাকে সামলেছেন।
 বিদিশার কোন কিছুই অজানা নয়। তবুও তিনি চুপচাপ ছেলের কথা শুনে চলেছেন। ছেলে কথা বলে চলেছে অনর্গল তিনি ফিরে গেলেন স্বামীর কাছে গল্প শোনা অতীতে -
 স্কুল শিক্ষক বাবার একমাত্র ছেলে স্বরূপ। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকে ভীষণ ভালো রেজাল্ট করার পর বাবা,মায়ের ইচ্ছাতে জয়েন্টে বসা। ফলস্বরূপ পয়ষট্টি রাঙ্ক। সরকারিভাবে সুযোগ পেলেও এরপর কলকাতা থেকে পড়াশুনার বাকি খরচ চালানোর মত সামর্থ্য তাদের ছিল না। বিশাল একান্নবর্তী পরিবারের প্রায় পুরোচাই বহন করতেন শ্বশুরমশাই। ছেলে নিজেও আপত্তি জানিয়েছিল যে সে অন্য কোনভাবে পড়াশুনা শেষ করে ঠিক একটা চাকরি খুঁজে নেবে। কিন্তু তার বাবা, মা তা চাননি। স্বরূপের বাবা তাকে বলেছিলেন,
-- এসব নিয়ে তোমায় কিছু ভাবতে হবে না। তুমি ডাক্তারি পড়বে। কিভাবে পড়াবো সে ভাবনা আমার।
 শান্ত স্বভাবের স্বরূপ বাবার মুখের উপর কোনদিন কোন কথা বলেনি কিন্তু সে ভালোভাবেই জানতো কলকাতা হোস্টেলে থেকে পড়ানো তার বাবার পক্ষে কতটা কষ্টকর। কিন্তু কিসের উপর নির্ভর করে তার মা এবং বাবা তাকে কলকাতা পাঠাতে চাইছেন সেটাও সে ভালোভাবেই জানতো। মায়ের বিয়ের সময় মামাবাড়ি থেকে অনেক গয়না দাদু মাকে দিয়েছিলেন একমাত্র ধনীর ঘরের দুলালীর বিয়েতে। 
  দেবেশ কথা বলতে বলতে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে মা একটু অন্যমনস্ক। মায়ের হাতটা তার হাতের মধ্যেই ছিলো। হাতে মৃদু চাপ দিয়ে সে বলে,
-- মা তুমি কী ভাবছো বলো তো?
-- কই কিছু নাতো। তোর কথা শুনছি তো
 দেবেশ হেসে পড়ে বলে
-- মা, তোমার দেবু এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। এখন আমি তোমার প্রত্যেকটা মুভমেন্ট কী বলতে চাইছে বলে দিতে পারি ঠিক তুমি যেমন করে আমার কথা বলে দাও।
 বিদিশা হো হো করে হাসতে থাকেন। অনেকদিন পরে মায়ের এই প্রাণখোলা হাসি দেখে মাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকে। 
  বাথরুম থেকে বেরিয়ে জামাকাপড় নিয়ে সুবর্ণা ছাদে চলে যায়। সেখানে গিয়ে কমকরে পাঁচশ টবে ফুটে থাকা নানান ফুলগাছে এবং তাতে ফুল ফুটে থাকায় সে এতটাই মোহিত হয়ে যায় বিদিশার কাপড়চোপড় মেলে আসতে তার অনেকটাই দেরি হয়ে যায়। ছাদের কাজ সেরে সে নিচে নেমে এসে বিদিশার ঘরে ঢুকতে গিয়ে পরিচিত একটা গলার আওয়াজ পেয়ে দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে পড়ে। পর্দার ফাঁক দিয়ে উকি দিয়ে দেখেই নিজের বুকটা নিজেই চেপে ধরে। নিজের অজান্তেই নিশ্বাস প্রশ্বাস ঘন হয়। পা দুটো আস্তে আস্তে অসার হতে থাকে। সুবর্ণা দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকে।
   স্বরূপ কলকাতা চলে এলো ডাক্তারি পড়তে। প্রথম প্রথম হোস্টেলের খাওয়াদাওয়া, নিয়মকানুনের সাথে খাপ খাওয়াতে স্বরূপকে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। গ্রামের খোলামেলা পরিবেশে বড় হওয়া স্বরূপ হোস্টেলের এই বদ্ধ পরিবেশে মানিয়ে নিতে খুব কষ্ট করতে হয়েছে। কিন্তু আস্তে আস্তে সব কিছুর সাথেই মানিয়ে নিতে সে সক্ষম হয়েছে। আর না হয়েই বা উপায় কী? মেডিকেল পড়ার যে বিশাল চাপ তার থেকে এক মুহূর্তও সময় বের করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
   একান্নবর্তী পরিবারের সন্তান স্বরূপ ভালোভাবেই জানতো বাবার টাকাতেই সংসারের সিংহভাগটা চলে। জমিজমা আজও দাদুর নামে। বাবা,কাকারা আজও ওই জমির ব্যাপারে কেউ কোনদিনও মাথা ঘামাননি। যেমন ছিল তেমনই আছে। স্বরূপের বুঝতে একটুও বাকি রইলো না প্রতিবার যখন টাকা আসে মায়ের এক একটা করে গয়না কমতে থাকে। কিন্তু বাবার কথানুযায়ী কোনদিকে না তাকিয়ে ভালোভাবে ডাক্তারি পাশ করতে হবে। এইভাবেই দিন গড়িয়ে মাস, মাস গড়িয়ে বছর চলে যেতে থাকে। তখন স্বরূপের ডাক্তারির ফাইনাল ইয়ার। সেদিন প্রচণ্ড গরম পড়েছিল। তারউপর লোডশেডিং। হোস্টেলের ছোট রুম ছেড়ে তখন সকলেই বাইরে। 
 অন্ধকার আর গরমের মধ্যেও সকলে হৈ হট্টগোলে মেতে উঠেছে। হঠাৎ একটি নারী কন্ঠের আর্তচিৎকারে কিছুক্ষনের জন্য সবাই হকচকিয়ে যায়। কোথা থেকে আওয়াজটা আসছে সেটা বুঝতেই বেশ কয়েক সেকেন্ড চলে যায়। ডাক্তারি পাঠরত ছেলেগুলো তখন গেট খুলে এদিকে ওদিকে তাকিয়ে দেখছে। অসুস্থ অবস্থায় একজন তরুণী পেটের যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। ছেলেগুলো তাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে এসে হাসপাতালে ভর্তি করে।
 ওই তরুণীর কাছ থেকে জানা যায় তার নিজের কেউ নেই। এক বাড়িতে খাওয়াপরায় সে থাকতো ছোট থেকেই। কিন্তু ওই বাড়ির গিন্নি বাড়িতে না থাকায় গৃহকর্তা রাতে তার ঘরে আসে। আগে কোনদিনও এরূপ তিনি করেননি। তাই প্রথম অবস্থায় সে কিংকর্ত্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। গৃহকর্তার সাথে ধস্তাধস্তি করে পালাতে গিয়ে টেবিলের কোণে পেটে প্রচণ্ড ধাক্কা খায়। ওই ব্যথা নিয়েই সে দৌড়াতে থাকে। শেষ পর্যন্ত এইখানে এসে সে আর পারে না। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যায়। 
 তার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। এখন ভিক্ষে করে পথেঘাটে পড়ে থাকা ছাড়া তার আর কোন উপায় নেই। মেডিকেল পাঠরত ছেলেগুলো তখন বড়ই বিপদে পড়ে। কিন্তু কারোরই সাহস হয় না এই বয়সের একটি মেয়েকে তাদের বাবা,মাকে বলে নিজেদের বাড়িতে আশ্রয় দেওয়ার। 
 স্বরূপ প্রফেসরদের সাথে কথা বলে কয়েকটা দিন মেয়েটিকে হাসপাতালেই রাখার ব্যবস্থা করে। মেয়েটিকে জানায় কয়েকদিনের মধ্যে বাড়ি যাবে সে। বাড়ি যাওয়ার সময় তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। মেয়েটিরও আর কোন উপায় ছিল না স্বরূপকে এই মুহূর্তে বিশ্বাস করা ছাড়া। তাই সে উপকারীর উপকার স্বীকার স্বরূপ প্রথম দিন থেকেই স্বরূপকে দাদা বলে ডাকতে থাকে। স্বরূপ যতই তাকে আশ্বাস দিক না কেন তার মনে একটা আশঙ্কা থেকেই যায়। প্রায় সমবয়সী কিংবা বয়সে একটু ছোট এই মেয়েটিকে বাড়িতে নিয়ে গেলে এত বড় পরিবারের সদস্যরা ঠিক কিভাবে নেবেন। বাবা,মায়ের কথা বাদ দিলেও বাদবাকীরা কিছুতেই এটা ভালো চোখে দেখবেন না। কিন্তু তবুও মনে একটা আশা ছিলো যেহেতু তার বাবার উপর অনেকটাই সকলে নির্ভরশীল তাই বাবা মেনে নিলে অন্যদের মনে নানান অভিযোগ থাকলেও কেউ বাবার মুখের উপর কিছু বলতে পারবে না।   
 স্বরূপের এই এক মস্ত দোষ ছেলেবেলা থেকেই। কেউ বিপদে পড়লেই কোনকিছু না ভেবেই তার পাশে দাঁড়িয়ে পড়ে। এক্ষেত্রেও ঠিক তাইই হল। মেয়েটিকে আশ্রয় দিতে যখন অন্যান্য ক্লাসমেটরা রাজি হল না তখন সেই মেয়েটিকে তার সাথে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ায় ঠিক করলো।

ক্রমশ 
 
   
 

Thursday, September 21, 2023

ভালোবাসি বলেছি অনেকবার ( ২য় পর্ব)

ভালোবাসি বলেছি অনেকবার (২য় পর্ব)

  বাবার চিকিৎসা করাতে এসে যার সাথেই কথা হয় সে যেকোন একটি কাজ তার বড় প্রয়োজন সেটা বলতে ভোলে না। আর এভাবেই সে ডাক্তার স্বরূপ দাশগুপ্তের কাছেও কথাটা বলে।
  ডক্টর স্বরূপ বেশ কিছুক্ষণ সুবর্ণার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। ড্রয়ার খুলে একটা কার্ড বের করে তার হাতে দিয়ে জানতে চাইলেন 
-- কতদূর পড়াশুনা করেছো? যদিও যে কাজটার কথা আমি ভাবছি সেটার জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতার কোন দরকার নেই। তোমার বাবার টিবি রোগের চিকিৎসা আজ লাস্ট ডোজ। তুমি আগামী রবিবার সকালের দিকে চলে এসো। তবে একটা কথা একটু জেনে নিই মা।অসুস্থ্য একজনকে দেখভাল করতে হবে। সপ্তাহে রবিবার ছুটি পাবে। রাতেও থাকতে হবে তার কাছে। মাইনে খারাপ পাবে না। রাজি থাকলে রবিবার চলে এসো।
-- আমি রাজি। সম্মান বাঁচিয়ে যে কোন একটা কাজ পেলেই আমার চলবে 
-- বাবাকে নিয়ে এখন আর কোন চিন্তা করতে হবে না। শুধু খাওয়াদাওয়া ভালো চলবে।
   বাবাকে নিয়ে বাড়িতে ফেরার পথে সব জানায় সে তার বাবাকে। তিনি একটি দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলেন,
-- এত লেখাপড়া শিখে শেষ পর্যন্ত আয়ার কাজ 
-- ভাবছো কেন বাবা কলকাতা শহরে থাকতে পারলে ভালো কাজের সন্ধান ঠিক পেয়ে যাবো। এখন এই মুহূর্তে এই ছাড়া আর কোন উপায় নেই আমাদের।
-- আরও বেশি করে কিছু টিউশনি তো করতে পারতিস।
-- করছিলাম তো বাবা।কিন্তু ক'টা টাকা আসে তাতে? দেখি ওই কাজ করতে করতেই ভালো কোন কাজ খুঁজে নেবো আমি। তুমি চিন্তা কোরো না। দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে।

  দু'দিন পরে সুবর্ণা একটা বিগ সপারে নিজের প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র নিয়ে স্বরূপবাবুর বাড়ি এসে হাজির হয়। ডাক্তার স্বরূপের বিশাল বাড়ি। গেটে সেন্ট্রি। গেট পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকতে গেলে মিনিট দু'য়েক হাঁটতে হবে। দু'পাশে নানান জাতের দেশী,বিদেশি গোলাপ ফুটে আছে। একজন মালি সেখানে কাজ করছেন। সেন্ট্রিকে পরিচয় দিতেই তিনি গেট খুলে দিলেন। সুবর্ণা বুঝতে পারলো আগে থাকতেই তাকে জানিয়ে রাখা হয়েছিলো। আস্তে আস্তে সে বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেলো। একজন পরিচালিকা এসে তাকে ডক্টর স্বরূপের কাছে নিয়ে গেলো। সুবর্ণাকে দেখেই তিনি বললেন,
-- বসো মা। যে কাজের জন্য তোমায় এখানে আসতে বলেছি সেই কাজে এর আগে অনেকেই এসেছেন। কিন্তু কারো কাজই সেরকম পছন্দ হয়নি আমার মিসেসের। তাই কটাদিন অন্তর অন্তর লোক পাল্টাতে হয় আমার। আমার মিসেস হাঁটাচলা করতে পারেন না খুব একটা। তাকে দেখাশুনা আর সেবাযত্ন করার জন্য তোমায় আসতে বলেছি। কারণ তুমি বলেছিলে যে কোন কাজ করতে তোমার আপত্তি নেই। তোমার একটাই কাজ সব সময় ওই ঘরে থেকে উনার সমস্ত কিছু করা। তার খাবারটাও ওই ঘরে যে কেউ পৌঁছে দিয়ে আসবে। কিন্তু উনাকে ভুলিয়ে খাইয়ে তোমাকে দিতে হবে। একসময় বিদিশা মানে আমার মিসেস গল্পের বই পড়তে ভালোবাসতেন। তুমি গল্পের বই পড়ে শোনাবে। স্নান করানো, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব সব তোমার। রবিবার আমি নিজের হাতেই এই দায়িত্ব পালন করি।তাই রবিবার তোমার ছুটি। তুমি রবিবার ভোরবেলা বাড়ি যাবে আর সোমবার ন'টার মধ্যে আবার চলে আসবে।
  সুবর্ণা এতক্ষণ চুপ করে কথা শুনছিল। এবার সে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
-- চলুন উনার ঘরে যাই।
 স্বরূপবাবু সুবর্ণাকে সাথে নিয়ে স্ত্রীর ঘরের দিকে যেতে যেতে বললেন,
--- এক একজন আসে কয়েকদিনের মধ্যেই তাকে চলে যেতে হয়।কারণ আমার মিসেসের পছন্দ হয় না। দেখো চেষ্টা করে যদি তোমাকে তার পছন্দ হয়।
  ওরা ঘরের ভিতরে এসে ঢোকেন। স্বরূপবাবু তার স্ত্রীর মাথায় হাত দিয়ে ডাকেন,
-- দিশা দেখো এই মেয়েটি আজ থেকে তোমায় দেখাশুনা করবে। ওর নাম সুবর্ণা। তুমি কথা বলে দেখো ভালো মিষ্টি মেয়ে। আমার মনেহয় তোমার একে খুব ভালো লাগবে।
 দিশা সুবর্ণার মুখের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় তাকে খাটের উপর বসতে বললেন। কিন্তু সুবর্ণা একটা চেয়ার এনে খাটের পাশে রেখে তাতে বসতে বসতে বললো,
-- অনেকটা জার্নি করে এসেছি। আগে একটু গল্প করি পরে ফ্রেস হয়ে আপনার কাছে গিয়ে বসবো।
 সুবর্ণার কথাটা শুনে বিদিশাদেবীর খুব ভালো লাগলো। তিনি ওর কথায় সম্মতি জানিয়ে বলেন,
-- ঠিক আছে। তবে তাই হোক।
 স্বরূপবাবু তখন সেখান থেকে বেরিয়ে এসে ড্রয়িংরুমে খবরের কাগজ খুলে নিয়ে বসেন। একটু পরেই তার প্রফেসর ছেলে দেবেশ ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে বাবার পাশে এসে বসে। বিলাসী চা দিয়ে যায়। এই বিলাসী বহু বছর ধরে স্বরূপবাবুর বাড়িতে আছে। এই বাড়ির প্রত্যেকটা বিষয়ে কথা বলা এবং মতামত দেওয়ার অধিকার সে নিজগুণে অর্জন করেছে। দেবেশ তাকে বহুদিন পর্যন্ত নিজের পিসি বলেই জানতো। বিলাসী চা এনে বাপ ব্যাটার সামনে রেখে বললো,
-- আজও একজন নতুন লোক এলো।কে জানে এ আবার ক'দিন টিকবে।
 কথাটা শুনে দেবেশ বলে ওঠে,
-- একে আবার কোথায় পেলে বাবা?
 স্বরূপবাবু তখন ছেলের কাছে পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিলেন। দেবেশ উদাস হয়ে বলে,
-- দেখো ক'দিন থাকে। মায়ের যে কেন এদের পছন্দ হয় না আমি বুঝতেই পারি না। মা তো শুয়েই থাকেন। হুইল চেয়ার করে শুধু ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় সাহায্যের প্রয়োজন। যারা আসে মায়ের সেবা যত্নের কোন ত্রুটি অন্তত আমি খুঁজে পাই না। তবুও কেউ টেকে না।
-- ব্যাপারটা আমার কাছেও বোধগম্য হয় না। 
-- এবার মায়ের ঘরে একটা সিসিটিভি লাগিয়ে দাও বাবা।
 কথাটা বলেই দেবেশ হো হো করে হেসে ওঠে। ওর বাবাও সেই হাসিতে যোগ দিয়ে বলেন,
-- হ্যাঁ এটাই এখন বাকি আছে -
--- এই ছাড়া আর কোন উপায় নেই বাবা। মায়ের এই মানুষগুলোকে পছন্দ না হওয়ার কারণটা তো আমাদেরও জানা দরকার বাবা।
--- না, এটা মোটেই ঠিক হবে না। দেখি আজ যে এসেছে সে কতদিন টেকে।

ক্রমশ -

    

Saturday, September 9, 2023

ভালোবাসি বলেছি অনেকবার ( প্রথম পর্ব)

 ( প্রথম পর্ব)

  ট্রেনটা আর একটু হলেই মিস করে যেতো সুবর্ণা। ছুটতে ছুটতে এসে ট্রেনটা ধরে সে।  বাংলায় এম. এ. করা সুবর্ণা মরিয়া হয়েও কোন চাকরি জোগাড় করতে পারেনি এই তিন বছরে। কিন্তু হাল ছেড়ে সে দেয়নি। লাগাতার চেষ্টা সে চালিয়ে যাচ্ছে। 
  বাবা বড় বাজারে নামকরা একটা কাপড়ের দোকানে সেলসের দায়িত্বে আছেন। কিন্তু কিছুদিন ধরে তার কাশিটা কিছুতেই কমছিলো না। প্রথমে সবাই ভেবেছিল প্রচন্ড গরমে সব সময় এসি চলার কারণে ঠান্ডা লেগে তার এই কাশি। খুসখুসে কাশি একবার শুরু হলে আর তা কিছুতেই থামতে চায় না। কাশতে কাশতে বুক,পেট ব্যথা হয়ে যায়। এইভাবে কিছুদিন চলার পর দোকানের মালিক জোর করে তাকে ডাক্তারের কাছে পাঠান। 
  গরীবের ঘরে রাজরোগ। তবে এ রোগের এখন চিকিৎসা প্রচুর বেরিয়ে গেছে। যারা প্রাইভেটে দেখান তাদের ব্যাপার আলাদা। কিন্তু সরকার থেকেও বিনা পয়সায় এখন চিকিৎসা করানো হচ্ছে। তবুও ছোঁয়াচে রোগ দোকানে তো আর রাখা যায় না। তাই বহুদিনের পুরনো বিশ্বস্ত কর্মচারীকে তার মাইনে ছাড়াও বেশ কিছু টাকা দিয়ে পুরো সুস্থ হয়ে পুনরায় কাজে রাখার আশ্বাস দিয়ে ছুটি দেন। 
  সুবর্ণা তখন এম এ কমপ্লিট করে চাকরির চেষ্টা করছে। ভাই তখনো স্কুলের গণ্ডি পেরোয়নি। বাবার অসুস্থতার খবরে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। সরকারি চিকিৎসা করা ছাড়া আর উপায় নেই। তাই বাবাকে নিয়ে ট্রেন জার্নি করেই কলকাতা এসে চিকিৎসা শুরু করে। 
 ট্রেনে  লোকাল কামরায় উঠে বসার জায়গা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। লোকের হাতে পায়ে ধরে প্রায় রোজই যেভাবেই হোক বাবার জন্য একটা বসার জায়গার ব্যবস্থা সে করে।
এমনই একদিনে তার সাথে পরিচয় হয় সুলতা সেনের। সুলতা তাকে জানায় সে কলকাতা একটা নামী কোম্পানিতে চাকরি করে। সুবর্ণা মনেমনে ভাবে সে এম এ করার পড়ে এত চেষ্টা করেও আজ পর্যন্ত কোন চাকরি জোগাড় করতে পারেনি। কিন্তু সাধারণভাবে গ্র্যাজুয়েশন করে সুলতা কী সুন্দর একটা চাকরি জোগাড় করে নিয়েছে। 
 প্রায় প্রতিদিনই সুলতার সাথে সুবর্ণার দেখা হয়। সুলতা বয়সে একটু ছোট হলেও সুবর্ণার সাথে বেশ ভালো একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আর তাতেই দু'জনে দু'জনার মনের কথা,পারিবারিক কথা শেয়ার করতে থাকে।
 সুলতারা তিন ভাইবোন। মা নেই। বাবার ধরাবাধা কোন কাজ নেই। যখন যা পান তাই করেন। তাতে সামান্য যা রোজগার হয় সংসার চালিয়ে ভাইবোনদের মানুষ করা দূরহ হয়ে পড়ে। প্রথম অবস্থায় কয়েকটি ছাত্রছাত্রী জোগাড় করে টিউশন শুরু করেছিল। বেশি টাকা তাতে আসে না। গ্রামেগঞ্জে সকলে সময় মত টিউশন ফি-টাও দিতে পারে না। তখন উচ্চমাধ্যমিক দিয়েছে সবে সুলতা। পারিবারিক অবস্থা এতটাই খারাপ মা একদিন তাকে ডেকে বললেন,
-- তোর বাবার আর ক্ষমতা নেই তোকে পড়ানোর। এবার কিছু একটা করার চেষ্টা কর
 রেজাল্ট তখনও বের হয়নি।মায়ের কথা শুনে ছলছল চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
--- এই শিক্ষাগত যোগ্যতায় কোনো চাকরি পাওয়া যায় না মা। নামকরা ডিগ্রিধারী ছেলেমেয়েরা চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর আমি?
-- তাহলে লোকের বাড়ি রান্না করার কাজ খুঁজে নে,সেটা পারবি তো?
 সুলতার মা শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। আর সুলতা ঘরের মেঝেতে ধপ করে বসে পড়ে দু'হাতে চোখ ঢেকে কাঁদতে শুরু করে।
  একটা একটা করে দিন এগিয়ে যেতে থাকে রেজাল্ট বেরোনোর সময় হয়ে আসে আর সুলতার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়তে শুরু করে। অনেক চিন্তাভাবনা করে শেষ পর্যন্ত সে পাড়ার একটি টেলারিংয়ের দোকানে গিয়ে একটা কাজ ঠিক করে। ব্লাউজে হুক লাগলো,হেম করা ইত্যাদি। যেদিন আনে দোকান থেকে যত কাটিং হোক না কেন সারারাত বসে সেলাই করতে হলেও করে পরদিনই সেগুলো দোকানে দিয়ে আসে। এক একটা ব্লাউজ কিংবা চুড়িদার পাঁচটাকা হিসাবে বেশ ভালোই রোজগার করতে থাকে। কিন্তু মাথার মধ্যে পড়ার ভূতটা থেকেই যায়। রেজাল্ট বের হয়। সুলতা ভালো নম্বর নিয়েই প্রথম বিভাগে পাশ করে। কিন্তু পড়াশুনার পাঠ তো তাকে এখানেই চুকিয়ে দিতে হবে। 
  সুলতা রেজাল্ট বেরোনোর পর থেকেই বেশ মন খারাপ নিয়েই সংসারের কাজ, টেলারিংয়ের কাজ চুপচাপ করে চলে। প্রয়োজন না হলে সে বাড়ির কারো সাথেই কোন কথা বলে না। বাবা,মা বুঝতে পারলেও না বোঝার ভান করে থাকেন। সে মনেমনে নানান ধরণের প্ল্যান করতে থাকে।অনেক ভেবেচিন্তে সে একটি উপায় বের করে।
 একদিন খুব ভোরে উঠে ট্রেন ধরে কলকাতা আসে। সে আগেই সবকিছু খোঁজখবর নিয়ে এসেছে। কলেজস্ট্রিট এসে সামনাসামনি বাকি সবকিছু জেনে নেয় কিভাবে প্রাইভেটে গ্র্যাজুয়েশন করা যায়।
  ওই ইনস্টিটিউশনে একদিন সকাল দশটা থেকে দুপুর দুটো পর্যন্ত বসে থাকতে হয় তাকে নানান ফর্ম ফিলাপ করা আর সই সাবুদের জন্য। কত টাকা প্রয়োজন সে আগে থেকেই জেনে গেছিলো। তাই পাড়ার অঞ্জু কাকিমার কাছ থেকে সেই টাকাটা ধার হিসাবে নিয়ে এসেছে। এই অঞ্জু কাকিমার মেয়ে অনন্যা সুলতার বন্ধু। একই সাথে তারা পড়াশুনা করে। সেই হিসাবে কাকিমা সুলতাকে ভীষণ ভালোবাসেন। 
  সুলতার কাছে তার পারিবারিক সমস্ত ঘটনা শুনে এবং তার পড়ার প্রতি অদম্য আগ্রহ দেখে ওই ইনস্টিটিউশনের সেন্ট্রি তাকে এক পরামর্শ দেয় কারণ সুলতা তাকে জানিয়েছিল একটা কাজ জোগাড় করে দিতে কারণ যে কোন কাজ করতেই সে রাজি। সেন্ট্রি নরেশ সাথে করে তাকে নিয়ে যায় রিটায়ার্ড আই পি এস অফিসারের বাড়িতে যার আন্ডারে যুবক বয়সে সে কাজ করতো। বিপত্নীক অনিন্দ্য চ্যাটার্জী একাই থাকেন বাড়িতে ছেলে লন্ডন প্রবাসী। বাড়িতে তিন থেকে চারটে কাজের লোক। অর্থের অভাব নেই। এনজিও সংস্থা ছাড়াও তিনি প্রকৃত মেধাবী গরীব ছেলেমেয়েদের দায়িত্ব এভাবেই নিয়েছেন। তিনি এমনভাবে উইল করেছেন যে তার অবর্তমানে সমস্ত স্থাবর,অস্থাবর সম্পত্তি নানান এনজিও সংস্থায় চলে যাবে।
    নরেশের কাছে সুলতা সম্পর্কে সব শুনে তাকেও কাজে বহাল করলেন। সুলতার কাজ হচ্ছে সকলের কাজের তদারকি করা আর বাকি সময় পড়াশুনা করা। সকাল আটটা থেকে রাত আটটা। সুলতা তার মিষ্টি ব্যবহার দিয়ে অনিন্দ্য চ্যাটার্জীর মন জয় করে নেয় মাত্র কয়েকদিনেই। এই অনিন্দ্য চ্যাটার্জী পড়াশুনার প্রতি আগ্রহ এবং গরীব, মেধাবী ছেলেমেয়ে দেখলেই তাদের সমাজে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার জন্য যেন এক অলিখিত চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন।
 সুলতা বাড়িতে জানায় সে একটি কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছে। ভোরবেলা ট্রেন ধরে শিয়ালদহ নেমে এন্টালি পর্যন্ত হেঁটে এসে অনিন্দ্যবাবুর বাড়িতে ঢুকেই তার নির্দেশে বই নিয়ে পড়তে বসা। এরূপ আরও দুয়েকজন তার আছে। অথচ খাওয়াপরা শেষে মাস গেলে মোটা অঙ্কের টাকা মাস মাইনে হিসাবে হাতে পাওয়া কারণ তাদের সংসার অচল! একেই বলে ভাগ্য!
  সুলতা সাধারণ ভাবেই গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে। অনিন্দ্যবাবুর সুপারিশে সত্যিই একটা চাকরীও তার জুঠে যায়। প্রত্যেক মাসে এক দু'বার করে সে তার জেঠুকে প্রণাম করে আসতে ভোলে না।
  সুবর্ণা সব শুনে একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
-- তুমি ভাগ্যের ফলে এমন একটা মানুষের সান্নিধ্যে আসতে পেরেছো। কিন্তু আমি যে কী করি সেটাই বুঝতে পারছি না। আচ্ছা কলকাতা শহরে তো অনেক বাড়িতে মানুষ রান্নার কাজ করে। আমাকে এরকম একটা বাড়ি দেখে দিতে পারবে? দুটো তিনটে বাড়িতে রান্না করতে পারলে কিছু টাকা অন্তত রোজগার করা যেত। তানাহলে তো না খেতে পেয়েই সব মারা যাবো। আর এখানে তো কেউ আমায় চিনবে না; জানবে না বাংলায় এম এ করে আমি বাড়ি বাড়ি রান্নার কাজ করছি।
  সুলতা এবং সুবর্ণা দুজনের জীবনে সংসারে বড় সন্তান হওয়ার কারণে সংসারের জোয়াল এসে তাদের কাঁধে পড়েছে। দু'জনেই সেটা হাসিমুখে না হলেও মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে।
  বাবার চিকিৎসা করাতে এসে যার সাথেই কথা হয় সে যেকোন একটি কাজ তার বড় প্রয়োজন সেটা বলতে ভোলে না। আর এভাবেই সে ডাক্তার স্বরূপ দাশগুপ্তের কাছেও কথাটা বলে।

ক্রমশ 

    

Saturday, June 10, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৬৬ ও শেষ পর্ব)

একদিন ভালোবাসবে (৬৬ ও শেষ পর্ব)

  কেটে গেছে অনেকগুলি বছর। বাবার মৃত্যুর পর ছ'বছর দীপিকার মা বেঁচে ছিলেন। এখন মেয়ে ডাক্তারী পড়ছে। তাদের সমস্ত খরচ আজও সৌম্য বহন করে চলেছে। সুজয় বারবার দীপিকার দরজা থেকে ফিরে গেছে ভিতরে ঢোকার অনুমতি তার মেলেনি। সুজয়ের বউ সব জানতে পেরে অশান্তির উপর অশান্তি করতে করতে সুজয়কে শেষ পর্যন্ত ডিভোর্স দিয়ে চলে যায়। তা স্বত্তেও দীপিকা আজীবন সুজয়কে ক্ষমা করেনি। কিন্তু মেয়ের সাথে বাড়ির বাইরে সুজয়ের যে কথা হয় তা জানতে পেরেও কোনদিন কোন বাধা যেমন সে দেয়নি ঠিক তেমনই কখনো কোন কথা জিজ্ঞাসাও করেনি। সুজয়ের বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও কোনদিন বিন্দুমাত্র কোন টাকা সে হাত পেতে নেয়নি। সুজয় এখন একা, সম্পূর্ণ একা। বাবা,মা দু'জনেই গত হয়েছেন বেশ কয়েক বছর আগেই। মাঝে মধ্যে শরীর খারাপ করলে মেয়েকে জানায়। মেয়েও মাকে বলেই বেরোয় "ও বাড়িতে যাচ্ছি।" দীপিকা কোনদিন কোন বাধা দেয়নি কিংবা ফিরে আসার পরে কোন কথা জানতেও চায়নি। সৌম্য মাঝে মাঝে আসে। তারও যথেষ্ঠ বয়স এখন। তিয়াসার মেয়ে জুইয়ের বিয়ে হয়ে গেছে সে এখন তার স্বামীর কর্মস্থল আমেরিকায় সেটেল্ড। 
  রোজই জুইয়ের যেমন মায়ের সাথে কথা হয় ঠিক তেমনই সৌম্য আঙ্কেলের সাথেও নিত্যদিন কথা হয়। তিয়াসাকে এখন আর আর্থিক দিক থেকে সৌম্যকে কোন রকম সাহায্য করতে হয় না। এখন তার মেয়েই মাকে প্রতি মাসে একটা মোটা অংকের টাকা পাঠায়। কিন্তু আজও সৌম্য তিয়াসার সামান্যতম শরীর খারাপেই ব্যস্ত হয়ে ওঠে। ফোনে গলার আওয়াজই সৌম্যর কাছে তিয়াসা কেমন আছে তার খবর পৌঁছে যায়। 
  সৌম্য ও তিয়াসার জীবন যেন দুটি সমান্তরাল সরলরেখা। একই সাথে এগিয়ে চলেছে কিন্তু কোনদিনও মিলিত হবার নয়। ঈশ্বর পৃথিবীতে এক এক জনকে এক এক রকম কাজ দিয়েই সৃষ্টি করেন। সুন্দর চেহারার অধিকারী, ধনীর দুলাল, ভদ্র,নম্র সৌম্যকে বিধাতা সবকিছু দিয়েও কোথাও যেন একটা ফাঁক রেখে দিলেন। বঞ্চিত করলেন পার্থিব সমস্ত সুখ থেকে। এ জীবনে সৌম্য শুধু দিতেই এসেছে সকলকে। পাওয়ার ভাগ্য নিয়ে সে জন্মায়নি। জীবনে যেটুকু পেয়েছে সে তাতেই তার আত্মতুষ্টি। সম্মান পেয়েছে, ভালোবাসাও পেয়েছে। কিন্তু যে ভালোবাসায় একটা জীবন পরিপূর্ণ রূপ পেতে পারে তা থেকে সে বঞ্চিতই থেকে গেলো আজীবন। বাবা না হয়েও তিয়াসা ও দীপিকার মেয়ের সমস্ত দায়িত্ব বাবার মতোই পালন করেছে সে। দীপিকার রক্তের সম্পর্কের দাদা না হয়েও দাদার দায়িত্ব কর্তব্য থেকে বিন্দুমাত্র সরেনি। বাকি রইলো তিয়াসা! তিয়াসার জন্য তো সে সারাটাজীবনই উৎসর্গ করেছে। সবকিছুর বিনিময়ে সে কী পেলো তবে? আজ একাকী ঘরে ব্যবসার কাজ সেরে সে যখন ফেরে তখন কাজের মাসির হাতের সবটুকু ছাড়া? চোখ বুজলেই আজও তার চোখের সামনে যে নারীটির ছবি ভেসে ওঠে সে তিয়াসা। মাঝে মাঝে নিজের মনকেই সে শান্তনা দেয় হয়ত তিয়াসাকে নিজের করে পেলে এতটা ভালোবাসতে পারতো না। কখনো হয়ত তিয়াসা তার ভালোবাসার সাথে নিলয়ের ভালোবাসার তুলনা করে ফেলতো। সংসার জীবনে খুঁটিনাটি অশান্তি হতোই। তার থেকে যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। তিয়াসার প্রতি ভালোবাসাটা দিনরাত বেড়েছে বৈ কমেনি। একটা সময় প্রতিদিন নিয়ম করে সে তিয়াসার বাড়িতেও গেছে শুধুমাত্র তাকে একবার চোখের দেখা দেখতে। বিধাতার লীলা বোঝা দায়! হয়ত তিনি এ জীবনে এটুকুই লিখেছিলেন।
   একদিন ভোরবেলা সৌম্যর কাজের মাসির ফোন পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে তিয়াসা সৌম্যর বাড়িতে আসে। কাজের মাসি ওদিকে দীপিকাকেও ফোনে সব জানায়। দু'জনে ঠিক যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থাতেই চলে আসে। দীপিকা মেয়েকে ফোন করে এম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে। 
  রাতের বেলা শুধুমাত্র এক গ্লাস দুধ খেয়ে শরীর ভালো লাগছে না বলে সৌম্য শুয়ে পড়ে। রান্নার মাসি তার ঘরেই একটা ক্যাম্প খাট পাতিয়ে শোয় সেদিন। কাজের মাসি ঘুম থেকে উঠে সৌম্যর জন্য চা নিয়ে এসে ডাকাডাকি করে শেষে গায়ে ধাক্কা দিয়েও তুলতে না পেরে সকলকে খবর দেয়। নাসিংহোম নিয়ে গেলে তাদের শুনতে হয় "বড্ড দেরি করে ফেলেছেন।" ঘুমের মধ্যেই কাউকে না জানিয়ে কোনরকম কোনভাবেই কাউকেই ছুটাছুটি করতে না দিয়ে সৌম্য চলে যায় যখন পৃথিবীতে সকলের প্রতি তার দায়িত্ব-কর্তব্য সব শেষ হয়ে যায়। আজ তার এই চলে যাওয়াতে অন্যের মানসিক কষ্ট ছাড়া সংসার জীবনে কারো কোন আর অসুবিধা হবে না। কারণ যারা তার প্রতি নির্ভরশীল ছিল আজ সকলেই তাদের সন্তানের দৌলতে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে।
  দীপিকা হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে। বাড়ি ভর্তি সকলের চোখেই জল। কিন্তু অদ্ভুতভাবে তিয়াসা নীরব! তার চোখে কোন জল নেই, কারো সাথে কোন কথা নেই একদম চুপচাপ।
  বন্ধু আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে যখন কেউ কেউ ফুলের মালা নিয়ে সৌম্যর বডির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে হাতের ইশারায় দীপিকা সকলকে নিষেধ করে। সে উঠে গিয়ে তিয়াসার হাতে একটা মালা দিয়ে খুব আস্তে আস্তে বলে,
-- দিদি, সৌম্যদা জীবন থাকতে এই জিনিসটিই তোমার হাত দিয়ে চেয়েছিল। কিন্তু মুখ ফুটে কোনদিন বলেনি। আজ তুমি তার সেই ইচ্ছাটি পূরণ করো।
 তিয়াসা রক্তবর্ণ চোখ তুলে দীপিকার দিকে তাকালো। আস্তে করে মালাটা হাতে নিয়ে সৌম্যর নিথর দেহের দিকে এগিয়ে গিয়ে তার গলায় মালা পরিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থেকে ঠিক তার কাঁধের কাছটাই নিজের মুখটা গুঁজে বসে পড়ে।
  শ্মশানে যাওয়ার সময় হল।দীপিকা তিয়াসাকে তুলতে গেলো। তিয়াসা কাত হয়ে সিমেন্টের উপর পড়ে যায় তখন। দৌড়ে আসলো শ্রেষ্ঠা। নাড়ি ধরে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো। খবর দেওয়া হল মেয়েকে। ডেথ সার্টিফিকেট শ্রেষ্ঠা নিজেই লিখলো। ছুটে এলো পিয়াসা আর তার স্বামী।
 পর পর দুটি কাঁচ ঢাকা শববাহী গাড়িতে করে দুটি মরদেহ চললো। হয়ত তাদের ভালোবাসার প্রতীক্ষা আজই শেষ হল। এপারে যখন মিলন বিধাতা লেখেননি তারা দুজনেই খুঁজে নিলো পরপারের ঠিকানা।

  শেষ।

   বিশেষ ভাবে ক্ষমা প্রার্থী।শেষ পর্বটা দিতে অনেকটাই দেরি করে ফেললাম নানান সমস্যায়।

Tuesday, May 23, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৬৫ পর্ব)

একদিন ভালোবাসবে (৬৫ পর্ব)

  দীপিকা কলকাতা আসছে শুনে সৌম্য অবাক হয়ে যায়। সে জানতে চায় 
-- কলকাতা আসছো? কিন্তু তুমি তো বলেছিলে তোমার কেউ নেই 
 দীপিকা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, 
-- নিরুপায় হয়ে মিথ্যে বলতে হয়েছিলো। কিন্তু মা অর্থাৎ তোমার মা সব জানতেন। তাকে আমি একটি কথাও মিথ্যে বলিনি। তিনিই আমায় বারন করেছিলেন প্রকৃত সত্যতা কাউকে না জানাতে।
-- তাহলে তো আমার কিছু বলার নেই। কে কে আছেন তোমার পরিবারে সেটা কি এখন বলা যাবে?
-- মা,বাবা দু'জনেই আছেন। 
-- বিশেষ কেউ?
 দীপিকা চুপ করে আছে দেখে সৌম্য বললো,
-- আচ্ছা ঠিক আছে।বলতে হবে না। কলকাতা এসে ফোন করো দেখা করবো। ওখানে একা একা থাকার চেয়ে আমার মনেহয় কলকাতায় থাকা অনেক ভালো।
 ভেবে দেখো। মনে রাখবে যেখানেই থাকো না কেন সব সময় আমি সাথে আছি।

  খুবই কষ্ট করে সুজয় সেদিন টিকিট জোগাড় করে। রিজার্ভেশন কনফার্ম না হলেও তারা ট্রেনে চেপে বসে। অনেক কষ্টে তারা পরদিন কলকাতায় পৌঁছায়। বাড়িতে যখন তারা পৌঁছায় তখনও দীপিকার বাবার জ্ঞান আছে। সুজয় রাস্তা থেকেই নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।।দীপিকা তার দিকে তাকিয়ে শুধু বলে, "থ্যাঙ্কস" । সুজয় তার মুখের দিকে তাকিয়ে পড়লে সে চোখ নামিয়ে মেয়ের হাত ধরে বাড়ির দিকে রওনা দেয়।
  বাড়িতে পৌঁছেই দৌড়ে বাবার ঘরে ঢুকে বাবার বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার সে আকুল কান্না দেখে বাড়িতে উপস্থিত অন্য সকলের চোখেও জলের ধারা নামে। বাবার মুখের কাছে মুখটা নিয়ে বলে,
-- বাবা, আমি তোমার দীপু। আমায় চিনতে পারছো। আমায় ক্ষমা করে দাও বাবা। আমি স্বার্থপরের মত নিজের কথাই ভেবেছি শুধু। তোমাদের আমি খুব কষ্ট দিয়েছি। আমি জানি এ অপরাধের কোন ক্ষমা হয় না। কিন্তু তোমরা আমায় ক্ষমা না করলে স্বয়ং ঈশ্বর আমার অপরাধের ক্ষমা করবেন না। 
 দীপিকার বাবার ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠলো। চোখের কোল বেয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। মুখের কোণে মৃদু হাসি নিয়ে মুখটা হা করলেন। পিসিমা এগিয়ে এসে একটা চামচে জল নিয়ে দীপিকার হাতে দিয়ে বললেন,
-- একটু একটু করে দাদার মুখে এই জলটা দে।
 দীপিকা কাঁদতে কাঁদতেই বাবার মুখে একটু একটু করে পুরো জলটা দিলো তিনি ঢোক গিলে তার একমাত্র আদরের সন্তান দীপুর হাত থেকে পৃথিবী ছাড়ার আগে জল খেলেন। চোখটা আধো খুলে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। সেই চোখ পরে তার আদরের সন্তান কখনো দীপা আবার কখনো বা দীপু বলে ডাকা মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতেই হাত দিয়ে বন্ধ করে দিলো।
   বাড়ির সামনে লোকজন ভর্তি। সকলের মাঝে দীপিকা সুজয়কেউ দেখতে পেলো। আসার পর থেকে কেঁদেই চলেছে। যখন সবাই বললো, "দীপা শ্মশানে যাবে মুখাগ্নি করতে -" প্রথমে দীপিকা আপত্তি জানালেও পরে মায়ের কথায় রাজি হয়। ঠিক এই মুহূর্ত থেকেই দীপিকার ভিতর অদ্ভুত এক শক্তি কাজ করতে থাকে। সে ভাবতে থাকে এতদিন সে যা অন্যায় করেছে তার বাবা,মায়ের প্রতি একটু একটু করে তার সব অন্যায়ের মাসুল তাকেই দিতে হবে। আজ বাবা নেই। মায়ের সব দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে। মাকে আর সে কষ্ট পেতে দেবে না। একমাত্র সন্তান হয়েও সে এতদিন তাদের যে কষ্ট দিয়েছে তার কোনই অধিকার ছিল না তাদের এই কষ্ট দেওয়া। দীপিকার এখন মনে হচ্ছে এতগুলো বছর সে যেন একটা ঘোরের ভিতর ছিলো। 
  শ্মশানের যাবতীয় কাজ সে নিষ্ঠার সাথে পালন করে গঙ্গায় স্নান সেরে নতুন বস্ত্র পরে বাড়ি আসে। বাড়িতে ফেরার পর এই প্রথম সে মায়ের বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
-- আমায় ক্ষমা করে দাও মা। আজ আমি মা হয়ে বুঝতে পেরেছি তোমার আর বাবার প্রতি আমি কী অন্যায় করেছি। তখন শুধুই নিজের কথাই ভেবেছি। তোমাদের কষ্ট,তোমাদের দুঃখ এসব মাথায় ছিলো না। আমার জন্যই বাবা এত তাড়াতাড়ি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। এ কষ্ট আমি কোনদিন ভুলতে পারবো না।
  দীপিকার মা মেয়ের এ আকুল কান্নার মাঝেও নিজেকে সংযত রেখে মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেন,
--- যা হয়ে গেছে তা নিয়ে ভেবে লাভ নেই। তোর বাবার এ টুকুই আয়ু ছিলো। শান্তনা একটাই তিনি চলে যাওয়ার আগে তোকে দেখে গেছেন। কিন্তু তোর কাছে আমার অনেক কিছু জানার আছে। 
-- বলবো মা তোমাকে সব বলবো। তোমাকে একা রেখে আর আমি যাবো না। আমার ভুলের মাসুল সারাজীবন ধরে দেবো। কিন্তু তোমাকে আর আমি কষ্ট পেতে দেবো না। আমার জন্য এতগুলো বছর তুমি আর বাবা অনেক কষ্ট পেয়েছ।
-- ওসব কথা ছার কী ঘটেছিল কেন কাউকে কিছুই না বলে এভাবে পালিয়ে গেলি? আমরা তো তোর পছন্দ করা ছেলের সাথেই তোর বিয়ে ঠিক করেছিলাম। তারপর কাকে তুই বিয়ে করলি সব আমায় জানা। দিদিভাইয়ের বাবার নাম কী? সে কোথায়? তুই শাঁখা,সিঁদুর পরিস না কেন?
 মায়ের এতগুলো প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে চোখের জল মুছে দীপিকা মায়ের সামনে শক্ত হয়ে বসে।

ক্রমশ
  

Monday, May 15, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৬৪ পর্ব)

একদিন ভালোবাসবে (৬৪ পর্ব)

  সুজয় মহিলার কাছে জানতে পারে দীপিকার বাবার শরীর খুব খারাপ। আর সেই জন্যই তিনি এখানে এসেছেন। সম্পর্কে তিনি দীপিকার পিসি হন। সুজয় এই মহিলাকে না চিনলেও মহিলা সুজয়কে চিনতেন। কারণ দীপিকার সাথে তার বিয়ে ঠিক হওয়ার পর তিনি যখন এই বাড়িতে এসেছিলেন তখন সুজয়কে তিনি দেখেছেন। তিনি সুজয়কে নিষেধ করেন সে যেন তার দাদার সামনে না যায়। সুজয় অনেক করে বুঝানোর চেষ্টা করে তাকে দেখা করতেই হবে। তাদের কথাবার্তার মাঝে দীপিকার মা এসে পড়েন।তিনি সুজয়কে দেখেই চিৎকার করে বলে ওঠেন,
-- তুমি কোন সাহসে এই বাড়িতে এসেছো? বেরিয়ে যাও এখান থেকে।
  সুজয় ধীর,শান্তভাবে বলে,
-- আমি দীপিকার খোঁজ পেয়েছি।
 সুজয়ের মুখ থেকে চিৎকারের মধ্যে এই কথাটা শুনে তিনি সুজয়কে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেন,
-- কোথায়? কোথায় ?আমার দীপা? ওর বাবার এই শেষ সময়ে দীপাকে একবার ওর বাবার সামনে নিয়ে এসো। তানাহলে যে মানুষটা মরেও শান্তি পাবে না।
-- আমার সাথে সে আসবে না। আপনারা কেউ সঙ্গে গেলে আমি আপনাদের নিয়ে যেতে পারি।
-- কোথায় আছে সে এখন?
-- দার্জিলিং 
 পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে দীপার মা বললেন,
-- ও দিদি, আর একবার ছেলেটাকে বিশ্বাস করে ওর সাথে তুমি যাও - গিয়ে আমার মেয়েটাকে নিয়ে এসো।

   বহুদিন পর নিজের আত্মীয়কে সামনে দেখে দীপা কান্নায় ভেঙে পড়ে। শ্রেষ্ঠাকে দেখিয়ে বলে,
-- পিসি তোমাদের নাতনী 
-- জামাই কোথায়?
 দীপিকা চুপ করে থাকে। সুজয় ঘরে না ঢুকে বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিলো। হঠাৎ পিসিকে দেখে সে এতটাই বিহ্বল হয়ে পড়েছিল কিভাবে খবর পেয়েছে, কার সাথে এসেছে এগুলো জানতে চাওয়ার কথা মনেই আসেনি। কিন্তু পিসির মুখে 'জামাই কোথায় ?' কথাটা শুনে দীপিকা যখন চুপ করে আছে সেটা লুকিয়ে দেখতে পেয়ে সুজয় ঘরে ঢুকে বলে,
-- আমি তোমাদের জামাই হতে পারিনি ঠিকই কিন্তু তোমাদের নাতনীর বাবা আমি।
  দীপিকা সুজয়ের দিকে তাকিয়ে পড়ে। সুজয় দাঁড়িয়ে আছে দেখতে পেয়ে একটা বেতের মোড়া নিয়ে এসে সুজয়ের সামনে রাখে। সুজয়কে দেখতে পেয়ে পিসিদিদার দু'হাতে জড়িয়ে রাখা কোলের ভিতর থেকে শ্রেষ্ঠা বেরিয়ে ঘরের ভিতরে যেতে উদ্যোগী হলে দীপিকা বলে,
-- মামনি তুমি আজ এখানেই থাকো। আর এদের প্রণাম করো। 
 শ্রেষ্ঠা দিদাকে প্রণাম করে সুজয়কে প্রণাম করতে গেলে সুজয় দু'হাতে তাকে বুকের সাথে চেপে ধরে। দীপিকার পিসি তখনও কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। সন্তান সুজয়ের, সুজয় বিয়ে করেছে অন্যকে। সবকিছু তার গুলিয়ে যাচ্ছে তখন। এতক্ষণ তিনি তার আসার আসল কারণটাই জানাননি। এবার তিনি দীপাকে বললেন,
-- সবকিছু কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে আমার। তোর মুখ থেকে সবকিছুই জানবো। তার আগে যে জন্য এসেছি সেই কথাটা বলি দীপা। দাদার শরীর মোটেই ভালো না। শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্যি দাদা আর বাঁচবেন না। আরো কিছুদিন হয়ত বাঁচতেন কিন্তু তোর শোকে বেশ কয়েক বছর ধরেই তিনি শয্যাশায়ী। তোর মা আমায় পাঠিয়েছেন তোকে বাড়িতে নিয়ে যেতে। শেষ সময়ে যাতে একবার তোকে দেখে যেতে পারেন।
  পিসির কথা শুনে দীপিকার দু'চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে থাকে। পিসি আবার শুরু করেন,
-- হ্যাঁ কিছুটা হলেও তোর জীবনের কী ঘটেছিল আমি আন্দাজ করতে পারছি। তবুও বলবো সুজয় তোর খবরটা না দিলে আমরা জানতেও পারতাম না কোনদিন তুই বেঁচে আছিস। আমরা তো ধরেই নিয়েছিলাম -
 পিসি কথাটা আর শেষ করেন না। দীপিকা তখন বলে,
-- ন'বছর আগে আমার চারপাশটা যখন অন্ধকার হয়ে গেছিলো তখন একটা পরিবার আমার সমস্ত দায়িত্ব নিয়ে আজও আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আমি এইখানে একটা স্কুলে ছোট ছোট বাচ্চাগুলোকে পড়াই। আমি অবশ্যই যাবো তোমার সাথে বাড়িতে।কিন্তু তার আগে আমাকে দু'জনের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। এক হচ্ছে সেই পরিবারের জীবিত একমাত্র সদস্য যিনি আমার কাছে ভগবান তুল্য।আর দুই হচ্ছে ওই স্কুলের হেডমাস্টার। আমি ফোন করে তাদের সাথে কথা বলে তোমাদের জানাচ্ছি। তবে এটাও আমি জানি তারা কেউই আমায় 'না' বলবেন না। সারারাতের ট্রেন ধকল গেছে তোমাদের। মামনি তোমাদের সব দেখিয়ে দেবে তোমরা স্নান করে ফ্রেস হয়ে নাও। একটু টিফিন করো। দুপুরে যা আছে একটু ডাল,ভাত খেয়ে নেবে।

  ছোট্ট একটা টেবিলে সুজয়,পিসি আর শ্রেষ্ঠাকে দীপিকা ডাল, আলুসিদ্ধ,ফুল কফির তরকারি দিয়ে খুব সুন্দরভাবে সাজিয়ে খেতে দেয়। সুজয়ের সাথে বারবার চোখাচোখি হলেও সে কোন কথা বলে না। সুজয়ও অপরাধীর মত খুবই চুপচাপ থেকে খেয়ে উঠে যায়। মাঝে মধ্যে সে মেয়ের সাথে দু'একটা কথা বলছে শুধু। দুটো ঘর হলেও খাট একটাই। পিসিকে খাটের উপর শুতে বললে উনি বলেন,
-- তুই সুজয়কে আর মেয়েকে খাটে শুতে দে।আমাকে নিচুতে একটা মাদুর পেতে দে। 
-- না,তোমার বয়স হয়েছে তুমি খাটে শোও।
  কথাগুলি সুজয়ের কানে যাওয়াতে সুজয় এগিয়ে গিয়ে বলল,
-- পিসিমা আমি তো একটু বেরোব টিকিটের ব্যাপারে। এখন শোবো না। শুলেই ঘুমিয়ে পড়বো। আপনি বরং খাটে শুয়ে পড়ুন।
  দুপুরে রান্না করতে করতেই দীপিকা ফোনে কথা সেরে নেয়। হেড মাস্টার মহাশয় সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে যান। আর সৌম্য কিছুটা অবাক হয়ে তাকে বলে ---

ক্রমশ 
    

Friday, April 28, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৬৩ পর্ব)

 একদিন ভালোবাসবে (৬৩ পর্ব )

   সুজয় কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। এদিকে দীপিকাও চুপচাপ বসে ফেলে আসা অতীতকে নিয়ে ভেবে চলেছে। কিছু পরে দীপিকা বলে,
-- এখানে তোমার কোন প্রয়োজন আছে বলে আমার মনেহয় না। তুমি আর এখানে এসো না। তুমি বিয়ে করেছ, তোমার বউ আছে। সে যদি জানতে পারে তুমি তোমার পুরনো প্রেমিকার সাথে দেখা করতে আসো তাহলে তোমার সুখের সংসার ভেঙে যাবে। তোমার প্রতি আমার আজ আর কোন অনুভূতি নেই। ন'বছর আগে কোন এক দুপুরে তোমার আবেগকে প্রশ্রয় দিতে গিয়ে আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেছে। তোমার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে হয়ত নিজেকেই শেষ করে দিতাম। কিন্তু ঈশ্বর অত সহজে আমার কপালে মৃত্যু লেখেননি। তিনিই তার দূত পাঠিয়ে দিলেন আমার কাছে। একথাগুলো তোমাকে না বললেও চলতো। বলছি এই কারণে - তোমার এখানে বারবার আসার কারণ হিসাবে আমার মনে কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। যে ভদ্রলোককে তুমি দেখেছো উনি মানুষরূপী ভগবান। উনার পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষই তাই। 
-- উনি বিয়ে করেননি?
-- অবান্তর প্রশ্ন করো না। ওসব জেনে তোমার কী লাভ?
-- না, মানে তুমিও তো বিয়ে করোনি তাই ভাবছিলাম --
--- সকলের সাথে নিজেকে গুলিয়ে ফেলো না। উনি এবং উনার পরিবার আজ আমার পরিবার। তারাই আমাদের সব দায়িত্ব নিয়েছেন। আমার মেয়ের উচ্চ শিক্ষার কোন গাফিলতি উনি হতে দেবেন না। জানি না এখানে তুমি কেন এসেছো? আর জানার ইচ্ছাও আমার নেই। তবে তুমি যদি মনে করো আমার মেয়ের জন্য তুমি কিছু করলে আমি সেটা হাত পেতে নেবো তাহলে ভুল ভাবছো। আমার মেয়ে আমার কাছে থেকেই তার সৌম্য  আঙ্কেলের সহয়তায় নিজেকে তৈরি করে নেবে। স্বেচ্ছায় যে দায়িত্ব তুমি নিতে চাওনি এত বছর বাদে আমি কোন কিছুর বিনিময়েই তোমার কাছ থেকে কোন দান চাই না। তুমি আর কখনো এখানে আসবে না। আর এটাই আমার শেষ কথা।
-- কিন্তু আমি তো --
-- তুমি এবার আসতে পারো। বলতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্যি তুমি আমার মেয়ের জীবনে অভিশাপ!
-- দীপিকা!
-- তোমার সাথে আমার কিংবা আমার মেয়ের সেদিনই সব সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে যেদিন তুমি আমাদের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেছিলে। এবার আসতে পারো আমার কাজ আছে।
  কথাক'টি বলে দীপিকা ধীর পায়ে ঘরে ঢুকে গেলো। সুজয় আরও কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে সেও আস্তে আস্তে ঘর থেকে মাথা নিচু করে বেরিয়ে আসলো। সামনে কিছুটা ঝাপসা দেখতে লাগলে পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখের কোণায় জমে থাকা জলটা মুছে নিলো। হয়ত নিজের পাপের কিছুটা, চোখের জল হয়ে বেরিয়ে আসলো।
  দীপিকা তার বেড়ার ঘরের ছোট্ট জানলা দিয়ে চোখ ভর্তি জল নিয়ে যতক্ষণ সুজয়কে দেখা যায় তাকিয়ে থাকলো। মাঝে মাঝে নিজের অজান্তেই বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসছে তার। কানে বাজছে সুজয়ের সেই কথা বউকে নিয়ে সে এখানে ঘুরতে এসেছে।
    সুজয়ের অফিসের কারণে তাকে তার বউকে রেখেই কলকাতা ফিরতে হয়েছিলো। কারণ অফিস তাকে আর ছুটি মঞ্জুর করেনি। কলকাতা থেকে বউয়ের প্লাস্টার কাটার আগেরদিন এসে তার প্লাস্টার কাটিয়ে তাকে নিয়ে কলকাতা ফেরে। মেয়ে কিংবা দীপিকার সাথে দেখা করার অদম্য ইচ্ছাটাকে কোনক্রমে সে আটকে রাখে। দীপিকাকে দেখার পর থেকেই নিজের প্রতি নিজের প্রচণ্ড একটা রাগ হতে থাকে। মা,বাবার কথা ভাবতে গিয়ে নিজের ভালোবাসাকে কিভাবে সে ভুলে গেলো কোথায় ছিলো তখন তার বিবেক,মনুষ্যত্ব এইসব চিন্তা করতে করতে সে মনেমনে ঠিক করে দীপিকা আর তার মেয়েকে কলকাতা যদি আনতে পারে তাহলে দিনান্তে একবার হলেও সে তাদের চোখের দেখা দেখতে পারবে। আর সেইজন্য দীপিকা যে বেঁচে আছে সেই খবরটা সে যেভাবেই হোক তার বাবা,মাকে সে জানাবে।
  দীপিকার বাবা,মায়ের বয়স এখন অনেক। তারা দু'জনেই বাইরে এখন কম বেরোন। বার্ধক্যজনিত অসুখে দু'জনেই জর্জরিত। একমাত্র মেয়ের শোকে তারা আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর সাথেও খুব একটা মেলামেশা করেন না। কিন্তু তারা আজও বিশ্বাস করেন তাদের মেয়ে বেঁচে আছে। আর সেই বিশ্বাস নিয়ে দু'জনেই কোন রকমে বেঁচে আছেন। সুজয় যদি তাদের গিয়ে তাদের মেয়ের বেঁচে থাকার খবরটা দিতে পারে তাহলে একটু হলেও হয়ত তার পাপের বোঝা হালকা হতে পারে। 
  সে মনেমনে নিজেকে তৈরি করে নেয়। দীপিকার বাড়িতে ঢুকলে অবধারিত তার বাবা,মা তাকে অপমান করবেন। কিন্তু সে সবকিছুর জন্য প্রস্তুতি নিয়েই দীপিকার বাড়ির দরজার কাছে গিয়ে কলিং বেল টেপে। ভিতর থেকে এক অচেনা মহিলা এসে দরজা খোলেন।

ক্রমশ 
    

Wednesday, April 26, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৬২ পর্ব)

 একদিন ভালোবাসবে (৬২ পর্ব )

   সুজয় সেদিন চলে আসতে বাধ্য হয়। কিন্তু সেটা ছিল ওর কাছে সাময়িক। স্বার্থপরের মত হলেও সে মনেপ্রাণে চাইছে মেয়েকে ওর কাছে এনে মানুষ করতে। আর এটা করতে যদি প্রয়োজন হয় সে দীপিকার পা ধরতেও রাজি আছে। সুজয় বিশ্বাস করে যে অন্যায় সে দীপিকার প্রতি করেছে তার কোন ক্ষমা হয় না। এখানে আসার পর দীপিকার সাথে যে ওর দু'বার দেখা হয়েছে দু'বারই দীপিকা ওর সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করেছে। কিন্তু সুজয় জানে যে ব্যবহার দীপিকার সাথে সে করেছে তার তুলনায় দীপিকার এই খারাপ ব্যবহার নস্যি। তাই দীপিকার সাথে কথা বলার সময় সুজয় সবসময় অপরাধীর যেমন থাকা উচিত ঠিক সেইরকমই থেকেছে।
   সুজয় বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে দীপিকা তার ঘরে ঢুকে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। তার চোখ থেকে সমানে জল গড়িয়ে পড়তে থাকে। আজ যে অন্ধকারটা মধ্যে সে বসে আছে একসময় ঠিক এইরকই তার জীবনে অন্ধকার ধেয়ে এসেছিলো। কিন্তু ভগবান তার কপালে সবকিছু খারাপ হয়ত লিখেছিলেন না। আর সেই কারণেই হয়ত ঈশ্বর সৌম্যকে তার কাছে দূত হিসাবে পাঠিয়েছিলেন। সেদিন যদি অত রাতে সৌম্যর সাথে দেখা না হত তাহলে হয়ত নরখাদকেরা তার দেহটাকে ছিঁড়ে খেত। তার জীবনে শুধু সৌম্য কেন তাদের পরিবারের আর দু'জনের ভূমিকাও অস্বীকার করা যায় না। বিশেষত সৌম্যর মা। যে কটাদিন সে সৌম্যদের বাড়িতে ছিল সৌম্যর মায়ের ব্যবহারে কখনোই মনে হয়নি যে সে তার নিজের মেয়ে নয়। এখানে আসার পরও যতদিন তিনি বেঁচে ছিলেন প্রায় নিয়মিত ফোন করে খবর নিয়েছেন। একবার সৌম্যর বাবাকে নিয়ে এখানে এসে থেকেও গেছেন। আলাদা করে মেয়ের জন্য কত জিনিস নিয়ে এসেছিলেন। যাওয়ার আগে সৌম্যর বাবাকে না জানিয়ে হাতে মোটা অঙ্কের টাকাও গুজে দিয়ে গেছিলেন। অন্ধকারের মধ্যে বসে অতীতের অনেক কথা তার মনে পড়তে লাগে। বাবা,মায়ের জন্য মন কেঁদে ওঠে মাঝে মাঝেই। কিন্তু অসহায়ের মত শুধু কেঁদেই চলে তখন। বাড়ি ছেড়ে আসার পরে ভয়ে তাদের সাথে আর যোগাযোগ রাখতে পারেনি। অনেকবার ভেবেছে ফোন করবে কিন্তু কী জানি এক অজানা আশঙ্কায় আর ফোন করে ওঠা সম্ভব হয়নি। সে নিজেকে কঠোরভাবে তৈরি করে নেয় কোন অবস্থাতেই সুজয়কে দেখে সে দুর্বল হবে না। কেন জানি তার মনেহয় সুজয় এতদিন পরে তাকে দেখে তার মেয়ের জন্যই এই বাসস্থান পর্যন্ত ধাওয়া করেছে। কথাটা মনে হতেই তার বুকের ভিতর ছ্যাৎ করে ওঠে। আর ঠিক তখনই শ্রেষ্ঠা তার মায়ের ঘরে ঢুকে আলোটা জ্বালিয়ে দেয়। মায়ের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে,
-- তুমি এই অন্ধকারে বসে আছো কেন?
দীপিকা হঠাৎ তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
-- তুই আমাকে ছেড়ে কোনদিন কোথাও যাবি না। আমি তোকে ছাড়া বাঁচবো না। তুই ছাড়া এই পৃথিবীতে আমার আর কেউ নেই রে!
 হঠাৎ মায়ের মুখে এই কথা শুনে আর তার কান্না দেখে কিছুটা ভ্যবাচ্যাকা খেয়ে বললো,
-- কী সব বলছো মা? আমি তোমায় ছেড়ে কেন কোথাও যাবো? তুমি আজ এত কাঁদছো কেন? আমার খিদে পেয়েছে তো।
 দীপিকা চোখ মুছে মেয়ের কপালে একটা চুম্বন করে বলে,
-- চল তোকে খেতে দিই। 

  ঠিক তার পরের দিন দুপুর বারোটা নাগাদ সুজয় আবার আসে। সুজয়কে দেখতে পেয়ে দীপিকা তার মেয়েকে বলে,
-- মামনি তুমি ও ঘরে যাও।
 শ্রেষ্ঠা চলে যেতে উদ্যত হলে সুজয় তাকে ডাক দেয়
-- মামনি একটু শোনো। তোমার জন্য কিছু ফল এনেছি। এগুলো নিয়ে যাও।
 শ্রেষ্ঠা তার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে পড়লে দীপিকা বলে,
-- তুমি ও ঘরে চলে যাও আঙ্কেলের কাছ থেকে আমি এগুলো নিয়ে নেবো।
 দীপিকা কথাটা বলেই হাত এগিয়ে দেয় সুজয়ের দিকে। আর শ্রেষ্ঠা সেখান থেকে দৌড়ে চলে যায়। সে বুঝতে পারে মা যখন তাকে এই অঙ্কেলটার কাছ থেকে চলে যেতে বলছে নিশ্চয় আঙ্কেলটা ভীষণ দুষ্টু। কারণ মা তাকে অনেক আগেই এসব শিখিয়ে রেখেছে। কোন অপরিচিত মানুষ আসলে সে যেন সেই সময় সেই মানুষটির সামনে না থাকে। কারণ দীপিকা এখানে এই পাহাড়িয়া অঞ্চলে এসে একটা কথা পরিস্কার বুঝেছে এখনকার মানুষজনগুলি এমনিতে খুবই ভালো কিন্তু তাদের আতে বিন্দুমাত্র আঘাত লাগলে তারা হিংস্র হয়ে উঠতে এক মুহুর্ত ভাবে না। তাই অনেক সময় অনেককিছুই মুখ না খুলে চোখের ইশারায় বুঝে নিতে হয়। মেয়েকেও ঠিক সেই একই ভাবে শিক্ষা দিয়েছে। তাই সে মায়ের কথা শুনেই সুজয়ের সামনে থেকে দৌড়ে ভিতরে ঢুকে যায়।
     সুজয়কে এবার সরাসরি দীপিকা প্রশ্ন করে
-- রোজ রোজ এখানে কী জন্য আসছো বলো তো ? এখানে তুমি কি একাই এসেছো? 
 সুজয় কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
-- না আমার স্ত্রীও এসেছে।
 কথাটা শুনেই দীপিকার বুকটা কেঁপে উঠলো। কিন্তু এমন তাতো হওয়া উচিত হয়নি। সুজয় বিয়ে করেছে,সে তার বউ নিয়ে এখানে ঘুরতে এসেছে এটা জেনে দীপিকার বুকের ভিতর কেন তোলপাল করছে। সুজয়ের প্রতি তো এখন কোন ভালোবাসা তো দূরহস্ত সামান্যতম সহানুভূতিও তো দীপিকার মনে নেই। তবে কেন সুজয় তার বউ নিয়ে এখানে ঘুরতে এসেছে শুনে ওর মনটা ছটফট করছে। 

ক্রমশ 

Friday, April 21, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৬১ পর্ব)

 একদিন ভালোবাসবে (৬১ পর্ব )

   খুব সন্তর্পনে সুজয় ওদের অনুসরণ করতে থাকে। আজ সে জ্যাকেটের উপর একটা শাল গায়ে জড়িয়েছে। মাথার উপর থেকে এমনভাবে শালটিকে মাথার পেঁচিয়ে নিয়েছে দূর থেকে কেউ দেখলে চিনতে পারবে না। সৌম্য এবং দীপিকা দু'জনেই একসাথে শ্রেষ্ঠার বেডের কাছে দাঁড়িয়ে তার সাথে কথা বলছে দেখে। মেয়েটির বয়স তার কাছে ঠিক আট ন'বছরের মধ্যেই হবে বলে মনে হল। সে আর বেশিক্ষণ ওখানে না দাঁড়িয়ে স্ত্রীর কাছে চলে গেলো। কিছুক্ষণ তার কাছে থেকে "শরীরটা ভালো লাগছে না" - বলে এক চুম্বকীয় শক্তির টানে আবার সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে ওদের দেখতে থাকে। আরও বেশ কিছুক্ষণ একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। হঠাৎ দেখে দীপিকা বেরিয়ে আসছে। ভদ্রলোকটি জোর করে মানিব্যাগ খুলে ওর হাতে কিছু টাকা দিয়ে দেন। দীপিকা বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই সুজয় শ্রেষ্ঠার বেডের কাছে দাঁড়িয়ে অতি স্বাভাবিক ভাবে জানতে চায়,
-- তোমার নাম কী? কী হয়েছে তোমার?
 মেয়েটি সুজয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
-- শ্রেষ্ঠা দাস
 সুজয়ের পদবীর সাথে মিলে গেলো। সুজয় আরো আগ্রহী হয়ে উঠলো শ্রেষ্ঠার খুঁটিনাটি জানার জন্য। পরিচয় হল সৌম্যর সাথে। কথা চলছিল কিন্তু হঠাৎ তাকিয়ে দেখে দীপিকা আসছে। মাঝপথে কথা থামিয়ে "কাজের কথা মনে পড়ে গেছে -" বলেই সুজয় দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে যায়। 
   সুজয় ঠিক তার পরের দিন ভিজিটিং আওয়ারের অনেক আগেই এসে যায়। যাতে দীপিকারা ঢোকার আগেই সে শ্রেষ্ঠার কাছে পৌঁছাতে পারে। সুজয় শ্রেষ্ঠার জন্য কিছু ফল নিয়ে গিয়ে ওর সাথে এ কথা সে কথার পর জানতে চায় আসল কথা 
-- তোমার বাবার নাম কী মামনি?
মেয়ের মুখে নিজের নাম শুনে আনন্দে, কষ্টে সুজয়ের চোখ থেকে জল পড়তে শুরু করে। শ্রেষ্ঠা তখন আঙ্কেলকে বলে,
-- জানো আঙ্কেল আমার মা'ও আমায় মামনি বলে ডাকে।
 সুজয়ের তখন মনে পড়ে দীপিকার সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার পর নতুন নতুন প্ল্যান প্রোগ্রামের মধ্যে তারা ঠিক করেছিল তাদের প্রথম ছেলে হলে তারা ডাকবে রাজা বলে আর মেয়ে হলে ডাকবে মামনি বলে। 
বাবা মায়ের চাপে পড়ে এত বড় একটা ভুল সে কী করে করলো? ভাবতেই তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো। হঠাৎ সুজয় কাচের জানলা দিয়ে দেখতে পায় দীপিকা আসছে। সুজয় তার মেয়ের কাছে আজও জানতে পারলো না কে ওই ভদ্রলোকটি?
  এরপর প্রতিদিন সুজয়কে নেশায় পেয়ে বসলো তার মেয়েকে দেখার। একদিন কথা প্রসঙ্গে মেয়ের কাছ থেকে জানতে পারে সৌম্য আঙ্কেল ভীষণ ভালো মানুষ। ও আর ওর মা থাকে সৌম্য আঙ্কেল কলকাতা থাকে। ছোট্ট মেয়েটার কাছে এই ছাড়া আর কোন খবর ছিল না আর সুজয়ও বুঝতে পারে শ্রেষ্ঠার কাছে আর কোন কথা জানতে চাওয়া ঠিক হবে না।
  হাসপাতাল রেকর্ড বুক থেকে বাকথাং এর ঠিকানা জোগাড় করে। হাসপাতাল থেকে শ্রেষ্ঠাকে ছেড়ে দেওয়ার পর সৌম্য কলকাতা ফেরে। সুজয়ের স্ত্রীর প্লাস্টার না কাটা অবধি তাকে ওখানে থাকতেই হবে। সে ঠিকানা নিয়ে পাহাড়িয়া রাস্তা পেরিয়ে দীপিকার বাসস্থানে এসে হাজির হয়। দীপিকা তাকে দেখে আঁতকে ওঠে। তার একটাই ভয় যদি সে তার মেয়েকে নিয়ে যেতে চায়। দীপিকা তাকে দেখে জানতে চায় 
-- তুমি এই পর্যন্ত ধাওয়া করেছো। তুমি যা ভাবছো তা কখনোই সম্ভব হবে না। পাহারিয়াদের তো চেনো না। আমার একটা ডাকে তারা ছুটে এসে তোমার লাশ ফেলে দেবে।
-- এতটা কেন ভাবছো? আমি তোমার প্রতি অন্যায় করেছি, মারত্মক ভুল করেছি অন্তত কনফেস করার সুযোগটুকু দাও 
-- আমায় তুমি কোন সুযোগ দিয়েছিলে? একবারও ভেবেছিলে ওই অবস্থায় একটা মেয়েকে মুখের উপর বিয়ে করতে অস্বীকার করলে তার মনের অবস্থা কী হতে পারে?
--- সেই মুহূর্তে না ভাবলেও তুমি চলে যাওয়ার সাথে সাথে ভেবেছি। ছুটে গেছি তোমাদের বাড়িতে। সারাটা রাত খুঁজেছি। থানা,পুলিশ কিচ্ছু বাদ দিইনি। কিন্তু তোমায় খুঁজে পাইনি। তোমার বাবা,মা প্রথম অবস্থায় আমার সাথে সহযোগিতা করলেও পরে তারা আমাকেই দায়ী করে নানানভাবে হেনস্থা করেন। তবে একথা সত্যি আমি তোমার প্রেগনেন্সির ব্যাপারে কাউকে কিছুই বলিনি। 
-- তোমার কোন কথা শুনবার প্রবৃত্তি আমার নেই। তুমি কী জন্য এখানে এসেছো সেটা বলো।
-- আমি জানি শ্রেষ্ঠা আমার মেয়ে। তুমি বিয়ে করোনি তাও বুঝতে পারছি। কিন্তু ওই ভদ্রলোক তোমার কে হন?
-- এসব জানতে চাওয়ার অধিকার যেমন তোমার নেই ঠিক তেমনই আমিও বলতে তোমায় বাধ্য নই। শুধু উনি নন উনার গোটা পরিবার আমার আর আমার মেয়ের কাছে ঈশ্বরের দূত সমান। এর বাইরে একটা কথাও আমি তোমায় বলবো না।
-- বেশ বোলো না। মেয়েকে একটু ডাকো ওকে আদর করেই আমি চলে যাবো।
-- না, আমি চাই না তোমার মত একজন মানুষের সংস্পর্শে ও এক মুহুর্তকাল সময় কাটাক। তুমি এখন যেতে পারো। আর কখনো তুমি এখানে আসবে না। 

ক্রমশ 

  
    

Tuesday, April 18, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৬০ পর্ব)

একদিন ভালোবাসবে (৬০ পর্ব)

  এই ক'টা বছরে সৌম্য তার বাবা,মা দু'জনকেই হারিয়েছে। তারা অনেক চেষ্টা করেছেন সৌম্যর বিয়ে দিতে। কিন্তু সৌম্যকে তারা কিছুতেই রাজি করাতে পারেননি। যেহেতু সৌম্য ব্যবসার কাজে সকাল থেকে মাঝ রাত অবধি কখনো কখনো বাইরে থাকতো তাই তিয়াসাদের ঘটনা তারা কিছুই জানেন না আর এই ব্যাপারে সৌম্য কিছু কোনদিনও তার বাড়িতে জানায়নি। মায়ের আদেশ অনুসারে সৌম্য প্রতিমাসে দীপিকাকে টাকা পাঠিয়ে দিতো যা তার বাবা জানতেন না। মেয়ে শ্রেষ্ঠা আস্তে আস্তে উপরে ক্লাসে উঠেছে আর সৌম্যর পাঠানো টাকার একটা করে অংশ বেড়েছে। 
  দীপিকা যতদিন সৌম্যদের বাড়িতে থেকেছে ততদিন সৌম্যর মায়ের কথামত সে শাঁখা, সিঁদুর পরেছে। কিন্তু ব্যকথাং এ গিয়ে সে আর ওইসব ছুঁয়েও দেখেনি। মেয়েকে স্কুলে ভর্তির সময় সে বাবার নামের জায়গায় সুজয়ের নামটা দিলেও চিরদিনের মত তার মন থেকে সে সুজয়ের নামটা মুছে ফেলেছে। 
   মেয়ের বয়স যখন প্রায় আট বছর হঠাৎ সে এতটাই অসুস্থ্য হয়ে পড়ে দীপিকার নিজের কেউ না থাকায় সে সৌম্যকে ফোন করে জানায়। সৌম্যর মায়ের অনুরোধে সৌম্য দু'দিনের জন্য গ্যাংটক ছুটে যায়। শ্রেষ্ঠাকে হাসপাতাল ভর্তি করতে হয়। দু'দিনের জায়গায় সৌম্যকে সেখানে বেশ কটাদিন থাকতে হয়। সৌম্য হোটেলেই থাকে। শ্রেষ্ঠা সুস্থ হয়ে বাড়ি আসলে সৌম্য যথারীতি বাড়িতে ফিরে আসে। কিন্তু এই সময় এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে দীপিকার জীবনে। সুজয় তার বউ নিয়ে গ্যাংটক বেড়াতে যায়। ঢালু পাহাড়ের রাস্তা চলতে গিয়ে সুজয়ের বউ পা পিছলে পড়ে গিয়ে পা ভেঙে নেয়। সেও তখন ওই হাসপাতালেই তার বউকে নিয়ে আসে। 
  হাসপাতাল গেটের কাছে দীপিকাকে দেখে সুজয় এগিয়ে আসে তার দিকে,
-- তুমি এখানে?
 দীপিকা সুজয়কে দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিলো। কিন্তু তার একদম সামনে দাঁড়িয়েই প্রশ্নটা করায় সে উত্তর দিতে বাধ্য হয়
-- কেন আমি এখানে আসতে পারি না? এ কথা জানার অধিকারও তোমার নেই - আমি এখানে কী করছি ,কেনোই বা এসেছি।
-- আমার প্রতি তোমার রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমি অন্যায় করেছি আমি স্বীকার করছি। তখন আমি শুধু নিজের কথা আর পরিবারের কথাই ভেবেছিলাম। তোমার দিকটা ভেবে দেখেছিলাম না। পরে ভেবে দেখেছি আমি যা করেছি ভুল করেছি। কিন্তু তুমি আমাকে কোন সুযোগ না দিয়েই ওই মুহূর্তের কথাটা ধরে নিয়ে আজ ন'বছর নিজেকে লুকিয়েই রাখলে।
-- আমার এসব কথা শোনার কোন ধৈর্য কিংবা সময় কোনটাই নেই। 
-- সময় নেই বললে তো হবে না? সারাজীবন তুমি আমায় আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রাখবে সত্যতা জানবে না তাতো হবে না 
-- আসল কথা আমার তোমার সাথে কথা বলতেই ইচ্ছা করছে না। ওই অভিশপ্ত দিনগুলির কথা আমি ভুলে গেছি।
 দীপিকা আর এক সেকেন্ডও সেখানে না দাঁড়িয়ে চলে যায়। তখন সৌম্য হাসপাতালের ভিতরেই ছিলো। সে বাইরে বেরিয়ে গেটের কাছে দীপিকাকে না দেখতে পেয়ে ফোন করে। তারপর কিছুটা এগিয়ে গিয়ে দু'জনে একসাথে হাসপাতাল ছেড়ে বেরিয়ে যায়। দূরে দাঁড়িয়ে সুজয় সব লক্ষ্য করে। সুজয় নিশ্চিত হয় ওই সৌম্যকান্তি যুবকটিই দীপিকার স্বামী। তাহলে তার যে সন্তান দীপিকার গর্ভে এসেছিলো সে কি পৃথিবীর আলো দেখেনি?
  সাত বছর হল সুজয়ের বিয়ে হয়েছে। কিন্তু কোন সন্তান হয়নি। ডাক্তার জানিয়েও দিয়েছেন সুজয়ের স্ত্রী কোনদিন মা হতে পারবেন না। সুজয়ের বাবা মারা গেছেন কিছুদিন আগে। মা এখনো বেঁচে। তিনি ছেলের পুনরায় বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগলেও সুজয় রাজি হয়নি। তারা একটি শিশু দত্তক নেবে বলে প্রাথমিক কাজকর্ম সেরে রেখেছে। তবে দত্তক নেবো বললেই তো আর নেওয়া যায় না। হ্যাপা অনেক। সিরিয়ালে এখনো তাদের নাম আসতে অনেক দেরি। প্রতিবছর তারা ঘুরতে বেরোয়। এবার তারা এখানে। কিন্তু এখন যে সমস্যায় সে পড়েছে কবে নাগাদ এখান থেকে বেরোতে পারবে তা একমাত্র ঈশ্বরই বলতে পারবেন। কিন্তু এই মুহূর্তে দীপিকাকে দেখে তার মনে অনেক প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সে মনেমনে ভাবে এখানে হয় সে কিংবা তার স্বামী চাকরি করে নুতবা কোন আত্মীয় ভর্তি। কিন্তু কলকাতা থেকে এতদূরে দীপিকা কী করে এলো? তবে কি ওর স্বামী এখানেই সার্ভিস করেন? পুরো ঘটনা জানতেই হবে। জানতেই হবে বাচ্চাটার কী হল? যদি সে সত্যিই পৃথিবীর আলো দেখে থাকে তাহলে হিসাব মত তার বয়স এখন আট বছর। কিন্তু সে ছেলে না মেয়ে? যে ভাবেই হোক জানতেই হবে। দীপিকার হাতে পায়ে ধরে যদি নিজের সন্তানটিকে নিজের কাছে রেখে মানুষ করতে পারে সেই চেষ্টায় সে করবে। 
  পরদিন ভিজিটিং আওয়ারে হোটেল থেকে সুজয় আবার হাসপাতাল আসে। স্ত্রীর কাছে একটু দেরীতে যাবে ঠিক করে। কিন্তু আজ তাকে দেখতেই হবে দীপিকা আজ আবার এখানে আসে কিনা। সে হাসপাতালের বাইরে একটি দোকানের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখে। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না তাকে। একটা গাড়ি এসে সেখানে দাঁড়ায় আর গাড়ি থেকে দীপিকা আর সুদর্শন পুরুষটি নেমে হাসপাতালের ভিতর চলে যায়। সুজয় ওদের ফলো করতে থাকে।

ক্রমশ - 

Sunday, April 16, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৫৯ পর্ব)

একদিন ভালোবাসবে (৫৯ পর্ব)

   কোথা দিয়ে যে পাঁচটা বছর কেটে গেলো কেউই টের পেলো না। সবাই কেমন যেন যন্ত্রের মত চলছে। যার যা কাজ, খাওয়া-দাওয়া আর ঘুম। হাসতে, গল্প করতে সবাই যেন ভুলে গেছে। নিলয় চলে যাওয়ার পর সকলের সবকিছুই যেন এলোমেলো হয়ে গেছে। পিয়াকে বলে যাওয়া নিলয়ের কথাগুলো পিয়া অনেক চেষ্টা করেছে দিদিকে রাজি করাতে যাতে সে সৌম্যকে বিয়ে করে। কিন্তু তিয়াসার সেই এক কথা, "দেবতাকে ভালোবাসা যায়,শ্রদ্ধা করা যায় কিন্তু তাকে বিয়ে করে সংসার করা যায় না। তাকে দূর থেকেই প্রণাম জানাতে হয়।"
-- কিন্তু দিদি নিলয়দার যে এটাই শেষ ইচ্ছা ছিলো
-- না, তুই ভুল করছিস তোর নিলয়দার শেষ ইচ্ছা ছিলো তার জুইকে যেন মানুষের মত মানুষ করি। আর যে হৃদয়ে নিলয়কে জায়গা দিয়েছিলাম সে না থাকলেও সেখানে আমি অন্য কাউকেই বসাতে পারবো না।
-- তুই কি বুঝতে পারিস না সৌম্যদা তোকে ভালোবাসে। যে যা করেছে সেই ভালোবাসার জায়গা থেকেই করেছে।
-- কেন বুঝবো না। ভালো না বাসলে কেউ কি কারও জন্য এতটা করতে পারে?
-- তাহলে ওর কথা তুই ভাববি না ?
-- কে বললো ভাবি না? দেবতার স্থান ভক্তিতে হৃদয় গহীনে। সেখানে আছে ভক্তি,শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। কিন্তু সেই ভালোবাসা প্রেম নয়। প্রেমে অনেক কাঁটা থাকে। কিন্তু ভক্তির ভালোবাসায় কোন কাঁটা থাকে না। সেখানে থাকে শুধু শ্রদ্ধা।
   পিয়া আলাদাভাবে সৌম্যকেও বোঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সেখানেও ব্যর্থ হয়। সৌম্য তাকে বলে,
-- পিয়া, তোমার দিদিও জানে না যে আমি তাকে কলেজ লাইফ থেকেই ভালোবাসি। তাকে ভালোবেসেই অন্য কোন মেয়েকে নিয়ে সুখী হতে পারবো না বুঝতে পেরে আমি বিয়ে করিনি। হারিয়েই তো গেছিলো তোমার দিদি আমার কাছ থেকে। আমি জানতাম না তোমার দিদিও আমাকে ভালোবাসতো। কিছুদিন আগে জেনেছি। তিয়াসাই আমাকে জানিয়েছে। কিন্তু কী জানো? সব ভালোবাসার পূর্ণতা দিতে গেলে ভালোবাসা তার নিজস্বতা হারায়। ভালোবাসার জন্য ভালোবাসতে হয়, ভালোবেসে কিছু পাওয়ার আশা করলেই ভালোবাসা অনেক ক্ষেত্রেই হারিয়ে যায়। তিয়াসা, নিলয়ের মধ্যে যে পাগল করা ভালোবাসা ছিলো সেই ভালোবাসায় ওকে আজীবন আগলে রাখবে। নতুন করে তিয়াসা এ জীবনে আর কাউকেই পাগলের মত ভালোবাসতে পারবে না। ওদের দু'জনের ভালোবাসার মধ্যে নতুন করে আমি ঢুকতে গেলে ঝঞ্ঝাট বাড়বে বৈ কমবে না। তার চেয়ে এই ভালো তিয়াসা আর জুইয়ের দেখভাল আজীবন করে যাবো আর দূর থেকেই ওকে ভালোবেসে যাবো।
-- দিদি ঠিকই বুঝেছে তুমি মানুষ নও ,দেবতা। তোমাকে দূর থেকেই পুজো করতে হয়।
-- না,আমি দেবতা নই কিন্তু ভালোবাসা কাকে বলে সেটা বুঝি। ভালোবাসলেই যে কাছাকাছি আসতে হবে তা মোটেই নয়। ভালোবাসা সব থেকে একটা পবিত্র সম্পর্ক। সেই পবিত্র সম্পর্কটাকে টিকিয়ে রাখতে গেলে দুটি মানুষকেই একটু দূরে দূরে থাকতে হয়। আর এই পবিত্র সম্পর্কের মধ্যে থাকে না কোন পাপবোধ। এ ভালোবাসা মনকে উদাস করে, হৃদয়ে প্রফুল্লতা আনে। এ এক আলাদা অনুভুতি।
-- আমার আর কিছু বলার নেই তোমাদের দু'জনকে। আমাকে ডেকে নিলয়দা সেদিন বলেছিল, 'পিয়া যখন আমি থাকবো না তুমি কিন্তু নিজে উদ্যোগী হয়ে সৌম্য আর তিয়াসার বিয়েটা দিয়ে দেবে। আমার মায়ের কোন আপত্তি থাকবে না। কারণ এ বিষয়ে আমি মাকে আমার শেষ ইচ্ছার কথা জানিয়ে এসেছি। যে তিনটি মানুষকে আমি রেখে যাচ্ছি মা,জুই আর তিয়াসা এই তিনজনই আমার প্রাণের থেকেও প্রিয়। তাই আমি যখন থাকবো না এরা যাতে ভালো থাকে সেটা ভেবেই আমার এই সিদ্ধান্ত। তিয়াসা মায়ের খেয়াল রাখবে, মেয়েকে মানুষের মত মানুষ করবে এসব আমি জানি। কিন্তু তিয়ার কথাটাও তো আমায় ভাবতে হবে। সৌম্যর মত একজন মানুষ যদি ওর পাশে থাকে ও সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করতে পারবে। তাই এই দায়িত্বটা আমি তোমায় দিয়ে গেলাম।' 
  সৌম্য আর কিছুই বলে না পিয়ার এই কথার জবাবে। শুধু মনেমনে ভাবে 'নিলয়, তোমার মত আমিও তিয়াসাকে প্রচণ্ড ভালোবাসি। তোমার জায়গা আমি নিতে পারবো না ঠিকই কিন্তু তিয়াসা আর জুইয়ের কোন কষ্ট আমি হতে দেবো না। তুমি যেখানেই থাকো না কেন শান্তিতেই থেকো ভাই। যে দায়িত্ব তুমি আমায় দিয়ে গেছো তিয়াসার সাথে একই ছাদের তলায় না থাকলেও যতদিন আমার প্রাণ আছে আমি সে দায়িত্ব পালন করে যাবো।'
  সময়ের সাথে সাথে সবকিছুরই পরিবর্তন হতে থাকে। তিয়াসার শ্বাশুড়ি এখন শয্যাশায়ী। একজন আয়া রাখা আছে তার জন্য। তিয়াসা যখন অফিসে থাকে সেই সময়টুকু সে নীলিমাকে দেখাশুনা করে। জুই শুধু পড়াশুনায় নয় সংসারিক কাজকর্মও বেশ পারদর্শী হয়ে উঠেছে। সৌম্য আঙ্কেলকে সে দেবতার মত ভক্তি,শ্রদ্ধা করে। দিনগুলি এভাবেই কেটে যেতে থাকে।

ক্রমশ 

Friday, April 14, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৫৮ পর্ব)

একদিন ভালোবাসবে (৫৮ পর্ব)

   নিলয় ওদের দেখে ঠোঁটের কোণে হাসি এনে বললো,
-- তোর বিয়েতে খুব যাওয়ার ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু শরীরে দিলো না রে 
 -- আমার বউয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিই 
 অসিত ওদের পরস্পরের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো।
 শ্রাবণী প্রথম অবস্থায় নিলয়কে চিনতেই পারেনি ওর শারীরিক কন্ডিশন দেখে। কিন্তু পরমুহুর্তে নিলয়কে চিনতে পেরেই চোখ ভর্তি জল নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। ঠিক তখনই অসিতের ফোনটা বেজে ওঠায় অসিত 'একটু আসছি' - বলে বেরিয়ে যায়। শ্রাবণী নিলয়ের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
-- এমনভাবে তোমায় দেখবো কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি। এ কী হয়ে গেলো সবকিছু? কেন হল? এর থেকে জীবনে আর তোমার সাথে দেখা না হলেই ভালো হতো।
-- আমি কিন্তু অনেকদিন আগেই তোমার খোঁজ পেয়েছিলাম। কিন্তু তখন তুমি অসিতের স্ত্রী। অসিত ভীষণ ভালো ছেলে।
 শ্রাবণী কেঁদেই চলে। নিলয় তাকে বলে,
--- ঈশ্বর যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন। সেই রাতের ঘটনার পর আমি তোমায় অনেক খুঁজেছি। কিন্তু -- ।ওই যে বললাম ঈশ্বর যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন। তোমার বাবা,মা এখন কেমন আছেন?
 শ্রাবণী কাঁদতে কাঁদতেই বললো,
-- সে অনেক ঘটনা। তারা আজ আর কেউ বেঁচে নেই। এই পৃথিবীতে আমার নিজের লোক বলতে আছে অসিত আর অসিতের পরিবার।
 নিলয়ের ঠোঁটের কোণায় মৃদু হাসি দেখা যায়। 
-- নিজেকে সামলে নাও শ্রাবণী। এক্ষুণি অসিত এসে যাবে। আর শোনো তুমি এখানে আর এসো না। তাতে তোমার কষ্ট বাড়বে বৈ কমবে না। বর্তমানকে যেমন অস্বীকার করা যায় না, অতীতকেও ভুলে যাওয়া যায় না। তবুও বলবো আমার জীবনের এই শেষ বেলার আমাদের দেখা হওয়ার কথা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা কোরো।
 নিলয়ের কথা শেষ হতে হতেই অসিত এসে ঢোকে,
-- আমার বউয়ের সাথে কথা হল?
-- ওই আর কী? হানিমুনে কোথায় গেলি?
-- আর কোথায়? ম্যাডাম তো সরকারি চাকরি করেন। উনার ছুটি ম্যানেজ না হওয়াতে বাঙ্গালীর কম টাকায় যেখানে হানিমুন হয় - পুরী।
 দুই বন্ধু হেসে ওঠে। শ্রাবণী 'আসছি' - বলে বেরিয়ে যায়। একটু পরে তিয়াসা ভিতরে আসে। অসিতও বেরিয়ে আসে।
   শ্রাবণী খুবই মনমরা হয়ে থাকে। অসিত বুঝতে পারে এমন একটা তরতাজা যুবকের এই পরিণতি স্বাভাবিক ভাবেই শ্রাবণী মেনে নিতে পারছে না। তাই ওর মন খারাপ। এটাকে স্বাভাবিক ঘটনা বলেই অসিত নানান কথা বলে শ্রাবণীকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে।
  এদিকে ডাক্তাদের বোর্ড বসেও নিলয়ের সমস্যার সমাধান করতে পারে না। কখনো তাঁরা বলেন, হেপাটাইটিস বি, কখনো সারা শরীরে ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়েছে আবার কখনো বলতে থাকেন সেপ্রসিমিয়া। তাঁরাও ঠিক ভাবে রোগ নির্ণয় করতে ব্যর্থ হন। তিয়াসার চারিপাশ অন্ধকার হতে থাকে। সৌম্য পাজেল্ড হয়ে পড়ে। দিনকে দিন নিলয়ের অবস্থার অবনতি হতে থাকে। এদিকে নার্সিংহোমের বিল হুহু করে বেড়ে চলেছে। নিলয় নিজেই এবার সৌম্যকে বলে,
-- ভাই, বন্ধু হয়ে বন্ধুর জন্য অনেক করেছো। আর টাকা খরচ করে কোন লাভ নেই। রোগ যেখানে ডাক্তারের অধরা সেখানে বাঁচার আশা আর নেই। পরজনম বলে যদি কিছু থাকে আমরা যেন একই মায়ের গর্ভে আসি।
-- উল্টোপাল্টা কথা বোলো না নিলয়। তিয়াসা শুনলে খুব কষ্ট পাবে।
-- ইন্টেলিজেন্ট মেয়ে ও। তিয়া বুঝেই গেছে আমি আর বাঁচবো না। ও ঠিক নিজেকে সামলে নেবে। আর তুমি তো রইলে ওদের মাথার উপরে। আমার জুই যাতে মানুষ হয় দেখো। খুব অল্প সময় নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিলাম। কিন্তু ঈশ্বর আমাকে এই সময়টুকুতেই দু'হাত ভরে দিয়েছেন।
-- চুপ করো নিলয়। আমার এসব শুনতে একদম ভালো লাগছে না। এত কেন ভাবছো? আমি আছি তো। আমি তোমায় নিয়ে চেন্নাই যাবো। আমি কালই ডাক্তারের সাথে কথা বলবো।
-- পৃথিবীর যে প্রান্তেই আমায় নিয়ে যাও না কেন আমার রোগ কেউ সারাতে আর পারবে না। আমার সময় শেষ।
-- আজ তুমি বড্ড বেশি কথা বলছো। দাঁড়াও আমি গিয়ে তিয়াসাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
-- না,না বসো। ঠিক আছে আর এসব বলবো না। তবে আর একটা কথা না বলে পারছি না। আমি চলে গেলে ওদের তুমি দেখো।
--- উফফ সেই একই কথা! আমি বেরোচ্ছি।
  সৌম্য বেরিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে তিয়াসা এসে ঢোকে। সে এতক্ষণ বাইরে বসে নীরবে কেঁদে চলেছিল। তাকে দেখেই নিলয় বলে,
-- মেয়েটাকে কালকে একবার নিয়ে এসো।অনেকদিন দেখি না। বড্ড দেখতে ইচ্ছা করছে।
-- কিন্তু কাল তো ওকে ঢুকতে দেবে না। কাল তো শনিবার। পরশু নিয়ে আসবো। রবিবার ছাড়া তো বাচ্চাদের অ্যালাও করে না।
 নিলয় মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। 
-- আমায় একটু জল দেবে? বড্ড তেষ্টা পেয়েছে।
 নিলয়ের কথা শুনে তিয়াসা উঠে গিয়ে বোতল থেকে গ্লাসে জল ভরে ওকে খাইয়ে দেয়। হঠাৎ তিয়াসার হাতটা ধরে বলে,
-- আজ তোমাকে আমার একদম ছাড়তে ইচ্ছা করছে না।
 তিয়াসা কান্নায় ভেঙে পড়ে। নিলয় তাকে দু'হাতে হালকা জড়িয়ে ধরে বলে,
-- আমার কিছু হয়ে গেলে তুমি এভাবে কাঁদবে না। মাকে,মেয়েকে তো তোমাকেই সামলাতে হবে।
 তিয়াসা হাত দিয়ে নিলয়ের মুখটা চেপে ধরে বলে,
--- এসব অলুক্ষুনে কথা একদম বলবে না। তুমি ঠিক ভালো হয়ে যাবে। সৌম্য বলেছে ও তোমায় নিয়ে চেন্নাই যাবে।
-- ভাগ্য করে একটা বন্ধু পেয়েছিলে।
 কথাটা বলে মৃদু হাসে নিলয়। ইতিমধ্যে ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়ে যাওয়ায় তাকে বেরিয়ে আসতে হয়।নিলয় একদৃষ্টে তিয়াসার গমন পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চোখ থেকে অবিরল ধারায় জল পড়তে থাকে 

ক্রমশ -
    

Thursday, April 13, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৫৭ পর্ব)

অঞ্জলী বেশ কয়েকদিন ধরেই লক্ষ্য করেন ছেলে বাড়িতে থাকলে কিংবা অধিক রাতে ফিসফিস করে ফোনে কার সাথে যেন গল্প করে। তিনি একদিন অরুণাভকে ডেকে বলেন,
-- তোমার ছেলে প্রেম করছে। এবার ওর বিয়েটা দিয়ে দিতে হবে ওই মেয়ের সাথেই।
 অরুণাভ তার অঞ্জলীর মুখের দিকে নীরবে তাকিয়ে আছেন দেখে অঞ্জলী নিজেই আবার শুরু করেন -
-- অনেকদিন তোমাদের কাছ থেকে একটা কথা লুকিয়ে রেখেছি। আজ সেটা বলবো।
-- বেশ কয়েক যুগ তোমার সাথে সংসার করছি। তুমি যে কোন কথা লুকিয়ে রাখতে পারো আমি তো ভাবতেই পারছি না 
-- আসলে কী জানো তুমি যখন মেয়েটিকে নিয়ে বাড়িতে আসো আমি সত্যিই ওকে আমাদের কুহু ভেবেছিলাম। কিন্তু আস্তে আস্তে আমি কয়েক মাসের মধ্যেই সবকিছু মনে করতে পারি। আমাদের কুহু যে নেই সে যে আর কোনদিন ফিরে আসবে না এই সত্যিটা আমি বুঝতে পারি। কিন্তু ততদিনে আমি কুহু ভেবে মেয়েটিকে আমার কুহুর জায়গাটা দিয়ে ফেলেছি। খুব ভালো মেয়ে ও। এমনভাবে ও আমাকে মা বলে ডাকতো  তখন একবারের জন্যও আমার মনে হয়নি ও আমার নিজের মেয়ে নয়। কিন্তু আমি তোমাদের ইচ্ছে করেই ধরা দিইনি। ওকে কুহু বলে ডাকতেই আমার ভালো লাগতো।
  অরুণাভ চুপচাপ অঞ্জুর মুখের দিকে তাকিয়ে কথা শুনে যাচ্ছেন। অঞ্জলী যখন তাকে কথাগুলো বলছেন তার দু'চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। অরুণাভ তবুও যেন দেখতে পারছেন অঞ্জুর মুখে এক প্রসন্নতা। 
 -- মেয়েটির পরিচয় জানার জন্য মনটা উসখুস করতো । একদিন তুমি ব্যবসার কাজে তাড়াহুড়ো করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও। সমস্ত ফাইলপত্র খাট আর টেবিলে ছড়ানো-ছিটানো ছিল। সেগুলো গুছাতে গিয়ে একটা ফাইলের উপর আমি শ্রাবণী নামটা দেখে সেটা খুলে দেখি ওর সমস্ত কাগজপত্র। কিন্তু সবকিছু আমি তোমাদের কাছে গোপন করে যাই। ওকে ছাড়তে আমার মন মোটেই সায় দেয় না। তখন থেকেই আমি ভেবে রেখেছিলাম অতুর সাথে ওর বিয়ে দেবো। কিন্তু প্রথম দিকে অতুর সাথে ওর সম্পর্ক ছিল সাপ আর নেউলের।আমি জানতাম একদিন না একদিন ওরা নিজেদের মধ্যে সব মিটমাট করে নেবে। আর ওদের মিটমাট হয়ে গেলেই আমি ওদের বিয়ের কথা ভাববো।
-- তাই বলে এতদিন ধরে আমাকেও অন্ধকারের মধ্যে রেখে দিলে? অবশ্য আমরা বাপ,বেটা দু'জনেই বুঝেছিলাম ওই ছাব্বিশে জুন পুজোর নাম করে জন্মদিন পালন করার ঘটা দেখে। 
-- কই তোমরা তো কিছু বলনি তখন?
  অরুণাভ তখন হাসতে হাসতে বললেন,
-- তোমার মত আমরাও লুকিয়ে গেছিলাম।
    দু'জনের কাউকে কিছু না জানিয়েই বিয়ের বাজার করতে শুরু করে দিলেন। না জানে অসিত ,না জানে শ্রাবণী। অসিত অফিসে বেরোনোর পর পরই দু'জনে শপিং করতে বেরিয়ে পড়েন। শ্রাবণীর কাছে এক দু'দিন অন্তরই জানতে চান সে কবে নাগাদ ছুটি পাবে? 
  পাক্কা ছ'মাস পরে পুজোর ছুটিতে শ্রাবণী বাড়ি আসবে জানায়। সঙ্গে সঙ্গে পাঁজি নিয়ে আশ্বিন মাসেই বিয়ের দিনক্ষণ তারা ঠিক করে রাখেন। যেদিন শ্রাবণী বাড়িতে আসে সেদিন রাতেই খাবার টেবিলে সুখবরটা অঞ্জলী নিজেই ওদের দেন। বিয়ে বেশ ধুমধাম সহকারেই হয়। যেহেতু শ্রাবণীর কেউ নেই সেইহেতু বিয়ে বৌভাত সবকিছুরই আয়োজন এই বাড়ি থেকেই হয়। শ্রাবণীর ছুটির সমস্যার কারণে হানিমুন মাত্র তিনদিনের জন্য পুরী। জয়েন করেই কলকাতা ট্রান্সফার নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। প্রায় বছর খানেক যাতায়াতের পর সে কলকাতা আসতে সমর্থ হয়।
  এদিকে নিলয়ের অসুস্থ্যতার খবরে অসিত বেশ কয়েকবার তাকে নার্সিংহোম দেখতে গেছে। বিয়ের আগে এবং পরে বেশ কিছুদিন মনে পড়লেও নিলয়কে দেখতে যাওয়ার সুযোগ আর হয়ে ওঠেনি তার। নিলয় পুণরায় যে অসুস্থ্য হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে এ খবর সে জানতে পেরেও শ্রাবণীর শিপটিং ডিউটির জন্য যাওয়া হয়ে উঠছে না। কারণ তার এবার ইচ্ছে সে তার বউকে সাথে নিয়েই যাবে। 
  শ্রাবণী একদিন মর্নিং ডিউটি করে বাড়ি আসার পর অসিত ঠিক করে সে অফিসে যাবে না। নিলয়কে দেখতে যাবে দু'জনে। অসিতের মুখে নামটা শুনে প্রথমে শ্রাবণী একটু চমকে উঠলেও পরে ভাবে একই নামে তো কত মানুষই থাকতে পারে। তবুও তার মনের মধ্যে কোথায় যেন একটা খচখচ করতে থাকে। কিন্তু অসিতকে তো কিছুই বলা ঠিক হবে না ভেবে সেও চুপচাপ থাকে।
  বেরিয়ে পড়ে দু'জনে একদিন বিকেল বিকেল নিলয়কে দেখতে। সেদিন তিয়াসা একাই ছিলো। অন্যেরা আসলেও সকলেই একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেছিলো। শুধু পিয়াসা থেকে গেছিলো দিদি একা আছে বলে। অসিতের সাথে তিয়াসার আগেই পরিচয় ছিলো। শ্রাবণীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো অসিত। পিয়া নিলয়ের কাছে ভিতরেই ছিলো। তিয়াসা ওকে ডেকে বাইরে আসতে বললো। অসিত ও শ্রাবণী এগিয়ে গেলো নিলয়ের দিকে। 

ক্রমশ -

Tuesday, April 11, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৫৬ পর্ব)

সৌম্যই তিয়াসার পরিবারটিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কিন্তু তিয়াসার কাছ থেকে কোন কিছুর আশা সে কখনোই করে না। কী অদ্ভুত ভালোবাসা সৌম্যর! তিয়াসার সুখ,শান্তি, ভালোথাকাই সৌম্যর একমাত্র চাহিদা। নিলয় অনেক আগেই বুঝতে পেরেছে সৌম্য তার তিয়াকে ভালোবাসে। এখন যে তিয়াসাও বোঝে না তা নয়। কিন্তু এই যে তিনটে মানুষ কেউ কাউকেই তাদের মনের কথা অন্যের সাথে শেয়ার করে না। তিনজনে যখন এক জায়গায় হয় তাদের মধ্যে প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া সাধারণত অন্য কোন ইয়ার্কি,ঠাট্টা কখনোই হয় না। সমন্তরাল তিনটি রেখা। 
  জুই খুব ভালোবাসে তার আঙ্কেলকে। আঙ্কেলকে দেখতে পেলেই দৌড়ে এসে সে আঙ্কেলের কোলে উঠে আধো আধো কথায় তাকে পাগল করে তোলে। সৌম্য যখনই এখানে আসে খালি হাতে কখনোই আসে না। জুই,নিলয় এদের জন্য কিছু না নিয়েই আসে। যেটুকু সময় সে থাকে নিলয়ের ঘরে বসেই গল্প করে। বেরোনোর আগে নিলয়ের বাবা,মায়ের সাথে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ। 
   দেখতে দেখতে বছর দু'য়েক হয়ে যায়। নিলয় এখন বেশ সুস্থই বলা চলে। সে ঘরে বসেই কম্পিউটারে কিছু না কিছু করে দুটো টাকা রোজগার করছে। বাইরে বেরোতে তাকে কখনোই তিয়াসা দেয় না। ভীষণ যত্নের মধ্যেই তাকে রাখে। যেহেতু তিয়াসা সকাল দশটার মধ্যেই বেরিয়ে যায় তাই নীলিমার উপর স্বাভাবিকভাবেই চাপটা বেশি পরে। তার উপর প্রায় চার বছরের দুষ্টু জুই। তার দুষ্টুমি, আর ছুটাছুটিতে বাড়ির সকলেই নাজেহাল। ভোরবেলা তাকে তিয়াসা স্কুলে দিয়ে আসে। তার আসবার সময় আর তিয়াসার অফিস বেরোনোর সময় যেহেতু এক তাই নিলয়ের বাবা অজয় গিয়ে তাকে স্কুল থেকে নিয়ে আসেন। এইভাবেই দিনগুলি দুঃখ,কষ্ট কখনো বা আনন্দের মধ্যেই চলে যাচ্ছিল । কিন্তু হঠাৎ করেই নিলয়ের বাবা অজয়  চিরতরে চলে যাওয়াতে আবার পরিবারের উপর বিপর্যয় নেমে এলো। সবকিছু আবার যেন লন্ডভন্ড হয়ে গেলো। সব চেয়ে সমস্যা দেখা দিলো জুইয়ের স্কুল নিয়ে। এর সমাধানও সেই সৌম্যই করলো। সে তিয়াসার অফিস টাইমের কিছুটা রদবদল করে দিলো। তিয়াসা প্রতিটা দিন প্রতি মুহূর্ত সৌম্যর কাছ থেকে শুধু নিয়েই যাচ্ছে আর কৃতজ্ঞতার বোঝা নিজের কাঁধের উপর নিতে নিতে সে প্রায় ন্যুজ হয়ে পড়েছে সৌম্যর কাছে। কিন্তু সৌম্যকে সে কথা জানানোর কোন সুযোগ সে পায় না। বলা ভালো সৌম্য সে সুযোগটুকুও তিয়াসাকে দেয় না। 
  সৌম্যই মনেহয় পৃথিবীতে একমাত্র মানুষ যে ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসা না চেয়ে ভালোবাসার মানুষটির সুখ,দুঃখের প্রতি নজর রেখে, তাকে ভালো রাখতে চায়। আর তাতেই তার সুখ তাতেই তার শান্তি।
   ঝড় যতই প্রবল হোক না কেন; সবকিছু তছনছ করে দেওয়ার পরেও মানুষ ঠিক সময়ের সাথে সাথে নিজেদের একটু একটু করে সামলে নিতে পারে। তিয়াসাও একটার পর একটা ঝড়ের পরেও সৌম্যর মত একজন প্রকৃত বন্ধুর সহয়তায় সব কিছুর থেকে মুক্তি পেলেও মানসিক শান্তি সে পায় না।এত কিছুর পরেও মাঝে মাঝেই নিলয়ের শরীরে নানান উপসর্গ দেখা দেয় দু'বছর পর থেকেই। 
   একদিন অনেক রাতে নিলয়ের কোমরে চিনচিন ব্যথা শুরু হয়। সারাদিনের পরিশ্রমের পর তিয়াসার ঘুমন্ত মুখটা দেখে সে তার ব্যথা নিয়েই সারা রাত কাটিয়ে দেয়। আস্তে আস্তে ব্যথাটা ছড়িয়ে পড়ে কোমর থেকে শরীরের নিচের অংশে। ভোরবেলা নিলয়কে নিয়ে নার্সিংহোম ছোটে সে। প্রতিটা মুহূর্তে সৌম্যকে বিরক্ত করতে তার মন আর সায় দেয় না। কিন্তু নার্সিংহোম সেই মুহূর্তেই নিলয়কে ভর্তি করে নেয়। অপারগ হয়ে সে সৌম্যকে ফোন করে। সৌম্য ছুটে আসে। সৌম্যকে দেখেই তিয়াসা তাকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে। তিয়াসা হঠাৎ তাকে জড়িয়ে ধরায় সৌম্যর শরীরের উপর দিয়ে যেন একটা বিদ্যুৎ খেলে যায়। তিয়াসার সে আকুল কান্নায় আশেপাশে লোক জড়ো হয়ে যায়। অনেক বুঝিয়ে সৌম্য তার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ছোটে ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার তাকে জানিয়ে দেন যে কোন কারণেই হোক নিলয়ের শরীরে ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়েছে। কতটা করতে পারবেন তারা সেটা নিজেরাও জানেন না। শুরু হল আবার দৌড়ঝাঁপ।
  তিয়াসার বোন পিয়াসার মাস ছ'য়েক হল বিয়ে হয়েছে একজন স্কুল শিক্ষকের সাথে। বিয়েতে তিয়াসা যাতায়াত করলেও একরাতও থাকতে পারেনি। আর নিলয় তো যেতেই পারেনি তার খাওয়া দাওয়ার রেস্টিকশনের জন্য।তাদের বাবার শরীরের অবস্থা এতটাই খারাপ নিলয়ের এই অসুস্থতার সময়ে তিনি নার্সিংহোম তাকে দেখতে আসতেও পারেননি। পিয়াসা এবং তার স্বামী তিয়াসার পাশে থেকে তার মনোবল বাড়াবার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। এরই মাঝে একদিন নিলয় পিয়ার সাথে একাকী কথা বলতে চায়।
    অধিকাংশ সময় এই চারটে প্রাণী নার্সিংহোম পরে থাকে। তিয়াসা কখনো নিলয়ের কাছে কখনো বা বাইরে বসে থাকে। ওষুধপত্র, ডাক্তারের সাথে কথা বলা সবই সৌম্য আর পিয়াসার স্বামী মিতান ই করে। 

ক্রমশ 

Sunday, April 9, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৫৫ পর্ব)

 একদিন ভালোবাসবে (৫৫ পর্ব)

 সৌম্য একটু নিজেকে গুছিয়ে নিলো। তারপর বললো,
-- চলো আমরা একটু এগিয়ে ওই চায়ের দোকান থেকে চা খেতে খেতে বাকি কথা বলি।
 তিয়াসারও সেই মুহূর্তে চা খেতে খুব ইচ্ছা করছিলো। সে সৌম্যকে অনুসরণ করে এগিয়ে যায়। ওরা চায়ের দোকানে গিয়ে দুটো চায়ের অর্ডার দিয়ে একটা বেঞ্চিতে বসে। তিয়াসা কয়েকবার চায়ে চুমুক দিয়ে সৌম্যর দিকে তাকিয়ে তার মনেহল সে যেন একটু অন্যমনস্ক। চুপচাপ চা খেয়ে চলেছে। তিয়াসা পাশে বসা সৌম্যর দিকে তাকিয়ে বলে,
-- তুমি কী বলবে বলছিলে?
সৌম্য ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-- আসলে যে কথাটা বলতে চাইছি সেটা বলা ঠিক হবে কিনা ভাবছি।
-- এত ভেবো না। আমি জানি তুমি এমন কিছু বলবে না যাতে আমি কিছু মনে করতে পারি। বলো কী বলতে চাও?
-- আসলে আমি ভাবছি - হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফেরার পর নিলয়কে অনেক নিয়মকানুনের মধ্য দিয়ে চলতে হবে ।ওর খাওয়া-দাওয়া,ওষুধপত্র ছাড়াও নিয়মিত চেকআপ আছে। কিছু ভেবেছো এসব নিয়ে?
-- ভাবছি,সব সময় ভাবছি। নিলয়ের চাকরিটা চলে গেলো, ওর ওষুধ-পথ্য,মেয়েটার পিছনে খরচ আছে,সংসার চালনা - এসব ভাবতে ভাবতেই শেষ হয়ে যাচ্ছি।
-- চাকরির চেষ্টা করছো না কেন?
-- কে বললো করছি না। আজ ছ'মাস ধরে চেষ্টা চালিয়েও ছোটখাটো কোন চাকরিও জোগাড় করতে পারছি না।
-- বাড়িতে জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারো আমার কোম্পানিতে তাহলে চেষ্টা করতে পারি। তবে ম্যানেজমেন্টের কথায় শেষ কথা। আমি শুধু অনুরোধ করতে পারি।
 সহসা তিয়াসা সৌম্যর হাত দুটি ধরে বলে,
-- চেষ্টা করে দেখো তাহলে। বেঁচে যাবো সকলে সারাজীবন তোমায় দয়ায়।
 সৌম্য তিয়াসার কাছ থেকে আস্তে আস্তে হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলে,
-- এভাবে বোলো না। আমার শুনতে ভালো লাগে না। আমি চেষ্টা করবো তোমার চাকরির জন্য। শুধু তুমি নিলয়ের কাছ থেকে অনুমতিটা নিয়ে নাও। তাহলে আগামীকাল এখানে আসবার সময় কাগজপত্রগুলো নিয়ে এসো।
-- নিলয় তো অনেক আগেই চাকরির জন্য আমায় বলেছে।
-- চাকরির জন্য বলেছে। কিন্তু আমার অফিসে চাকরি করতে দেবে কিনা সেটা তো জানতে হবে?
-- অসুবিধা কোথায়? তাছাড়া আজ যে নিলয় সুস্থ হওয়ার পথে হাঁটছে সেতো তোমার জন্যই
-- এসব কথা আর বলবে না। ও আয়ু আছে ও বাঁচবে। এসব বিধাতা আগে থাকতেই ঠিক করে রাখেন। যাহোক আমি যেটা বললাম সেটাই কোরো।
-- দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে সৌম্য। আর কোন উপায় নেই। নিলয় কোন অবস্থাতেই তোমার অফিসে চাকরি করা নিয়ে কোন কথা বলবে না। তুমি নিশ্চিন্ত থেকো। তবুও আমি তার কাছে জানতে চাইবো। তুমি কেন বলছো সেটাও আমি বুঝতে পারছি।
 সৌম্য কোন উত্তর দেয় না। আবার ওরা নার্সিংহোম ফিরে আসে। কারণ ডাক্তার রাউন্ডে আসেন ঠিক রাত আটটায়। রোজই তার সাথে দেখা করে নিলয়ের শারীরিক অবস্থার কথা জেনে তবে ওরা ফেরে। তিয়াসাকে তার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে তারপর সৌম্য বাড়ি ফেরে। 
  প্রায় একমাস নিলয়কে হাসপাতাল থাকতে হয়। এরমধ্যে বড় জোর এক দু'দিন ছাড়া সৌম্য প্রায় রোজই গেছে। বাড়িতেও সৌম্য তিয়াসার সাথে নিজের গাড়ি করেই নিলয়কে বাড়িতে নিয়ে আসে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে সাহায্য করে। এই ক'দিনেই নিলয়ের সাথে সৌম্যর বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায়। সৌম্য প্রয়োজনের একটি কথাও তিয়াসার সাথে বলে না। সেই প্রথম থেকেই। কিন্তু কেমন যেন একটা নেশার মত তাকে পেয়ে বসে রোজ তিয়াসাকে একবার দেখার। নিলয় বাড়িতে আসার পর বেশ কয়েকবার সৌম্য এখানে আসে। কিন্তু নিজের মনকে কন্ট্রোল করতে সে আস্তে আস্তে তাও বন্ধ করে দেয়। নিলয়ের ফোনে ফোন করে খোঁজ-খবর নেয় প্রায় প্রতিদিন। তিয়াসা ব্যাপারগুলো কিছুটা হলেও বুঝতে পারে।।সেও কোন কথা কারো সাথে শেয়ার করে না।
    মাসখানেক হল তিয়াসা সৌম্যর অফিসে জয়েন করেছে। প্রথম মাসের মাইনে হাতে পেয়ে সে পুরো তাজ্জব বনে যায়। এত টাকা এই সামান্য কাজে? পরে জানতে পারে সৌম্য তার সংসারের চাহিদা পূরণ করতেই পার্সোনাল একাউন্ট থেকে একমাত্র তার মাইনের টাকাটাই সে পেমেন্ট করে। অফিসে এমন একটি জায়গায় তিয়াসা বসে যেখান থেকে সৌম্য যাতায়াত করে। কিন্তু সে কখনোই তার চলতি পথে তিয়াসার সাথে কথা বলে না। তিয়াসা নিজের মত অফিসে আসে আবার নিজের মতই ছুটির পর বেরিয়ে যায়। অফিসের কেউই জানে না সৌম্য তিয়াসাকে চেনে। কিন্তু নিলয়ের চেকআপের সময় সৌম্য তার গাড়িতেই তাদের নিয়ে যায়। ওই দিনটি তিয়াসার ছুটি। এরজন্য ম্যানেজমেন্টের কাছে তাকে জবাবদিহি করতে হয় না। এটাও সৌম্যরই ব্যবস্থা।
  নিলয় আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠতে থাকে। এখন সৌম্য সপ্তাহে মাত্র একদিন তাকে দেখতে আসে। অনেক কিছুই নিলয় বুঝতে পারে তার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে। কিন্তু উপকারীর উপকার সে মনে রাখতেও জানে। এমন কিছু কখনোই তার চোখে পড়েনি যাতে মনে হয় ওদের মধ্যে কোন সম্পর্ক আছে। কিন্তু এটুকুন সে বোঝে এখন মানুষ লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে সেখানে কারো প্রতি শুধু ভালোবাসা কাজ করে না; মানুষটির মনও থাকা দরকার। আর তা সৌম্যর আছে। সেতো প্রতিটা মুহূর্তে বুঝতে পারছে তিয়াসা তাকে পাগলের মত ভালোবাসে। যা কিছু তিয়াসা করেছে শুধুমাত্র তাকে বাঁচানোর জন্যই করেছে। সেখানে সৌম্যর প্রতি তার যদি পূর্ব দুর্বলতা থেকেও থাকে বিয়ের পরে সে সবকিছুই তো ভুলে গেছিলো। এখন যেটা সৌম্যর প্রতি আছে সেটা শুধুই কৃতজ্ঞতা! সেও তো শ্রাবণীকে ভালোবাসতো। তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিল একসাথে থাকার। কই বিয়ের পরে তো তার কথা সে ভুলেই গেছিলো। আসলে প্রত্যেকটা মানুষের জীবনে কিছু অতীত থাকে। জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার তাগিদে সময় মানুষের সেই অতীতের উপর একটা প্রলেপ ফেলে দেয়। কিন্তু ভুলতে কেউ পারে না।আর এটাই জীবন!

ক্রমশ 


 
   

Thursday, April 6, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৫৪ পর্ব)

দু'মাস চলে গেলো এরপর। কিন্তু ডোনার পাওয়া গেলো না। বলতে গেলে নিত্য খোঁজ নেয় সৌম্য ফোন করে। প্রয়োজনের একটি কথাও সে তিয়াসার সাথে বলে না। কিন্তু সৌম্য সেদিন নার্সিংহোম থেকে আসার পরেই তিয়াসার সাথে আলোচনা না করেই নিজেই একটা মোটা অঙ্কের টাকার অফার দিয়ে সাতদিন অন্তর অ্যাড দিতে থাকে। প্রত্যন্ত গ্রামের থেকে কেউ কেউ আসলেও পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যম অতিক্রম করতে পারে না। নিলয়ের শারীরিক কন্ডিশনের কিছু কাগজপত্রের জেরক্স সৌম্য নিজের কাছে এনে রাখে এইগুলির কারণেই। শেষমেশ ডোনার সৌম্য জোগাড় করে। 
  সম্পূর্ণ নিজের খরচে সৌম্য নিলয়ের কিডনী প্রতিস্থাপন করে। হাসপাতালে সেদিন তিয়াসার সাথে রাত জাগে সে। পিয়া অনেক রাতে নিলয়দের বাড়িতে ফিরে যায়। জুই পিয়ার কাছে খুব ভালো থাকে তাই। বেশ কয়েক ঘন্টা পরে নিলয়ের জ্ঞান আসার পর তার সাথে দেখা করে তিয়াসাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে সৌম্য ঘরে ফেরে। সৌম্য বাড়িতে টাকা-পয়সার ব্যাপারটা গোপন করে যায়। একজন বন্ধু অসুস্থ্য শুধু এটাই জানায়। সৌম্যর বাবা এখন আর তার ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপারে শারীরিক কারণে সময় দিতে পারেন না। তাই টাকা-পয়সার লেনদেনের ব্যাপারেও তিনি আর মাথা ঘামান না। ব্যবসার সমস্ত কিছুই সৌম্য দেখাশুনা করে।
   রোজই সৌম্য নিলয়কে দেখতে যায় বিকেল হলেই। তবে কিছুক্ষণ থেকেই সে চলে আসে। সেদিন সুযোগ পেয়ে তিয়াসা সৌম্যকে বলে,
-- একটু কথা ছিলো।
-- হ্যাঁ বলো কী বলতে চাও?
 আগে সৌম্য তিয়াসাকে তুই বললেও এখন সে তুমি বলে। কেন তা সে নিজেও জানে না। একটা ফাঁকা জায়গা দেখে দু'জনে এসে দাঁড়ায়।
-- তোমার কাছে আমার অনেক ঋণ জমা হয়ে গেলো। শুধুমাত্র একজন ক্লাসমেট হিসাবে তুমি যা করলে আমি আজীবন তোমার গোলাম হয়ে থাকবো।
-- কী উল্টোপাল্টা কথা বলছো তুমি?
-- আজ তোমাকে একটা সত্যি কথা বলবো সৌম্য। কোনদিন বলতে পারিনি যে কথা সেটাই তোমায় আজ জানাবো। 
 সৌম্য একটু অবাক হল। 
--- কী এমন কথা যা বলতে পারোনি?
-- নিলয় অসুস্থ্য হওয়ার পর আমি যখন দিশেহারা তখন তোমার মুখটাই আমার চোখের সম্মুখে ভেসে উঠেছিলো। আমার স্থির বিশ্বাস ছিলো তুমি আমায় ফেরাবে না। তারও একটা কারণ ছিলো -
 তিয়াসা চুপ করে যায়। নিলয় কৌতূহলী হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। অথচ তিয়াসা চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে।
-- কী হল বললে না কী কারণ ছিলো?
 কথাটা শুনে নিচের দিকে তাকিয়েই এক নিশ্বাসে তিয়াসা বলে উঠলো,
-- কলেজ লাইফে আমি তোমায় ভালোবাসতাম! কোথায় যেন এই ভালোবাসার প্রতি আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো আমায় তুমি ফেরাবে না।
 সৌম্যর বুকের ভিতর কে যেন তখন হাতুড়ি পেটাচ্ছে। সে তিয়াসার দিকে তাকিয়ে। তিয়াসা কিন্তু মুখ নিচের দিকেই করে রেখেছে। সেই ভাবেই সে পুণরায় শুরু করে,
-- তুমি খুব বড়লোকের ছেলে। নিজের মনের কথাটা কোনদিন মুখ ফুটে বলতে পারিনি আমরা তোমাদের সমকক্ষ নই বলে। যদি আমার ভালোবাসার কথা শুনে তুমি ব্যঙ্গ করো -
-- আর আজ বললে কেন?
-- জানি না। তবে তোমার মনে এ প্রশ্ন আসতে পারে কেন আমি তোমার কাছে সাহায্য চাইলাম ? কোথাও যেন তোমার প্রতি একটা জোর অনুভব করছিলাম। জানি না কেন - আমার মন বলছিল আমার বিপদে তুমি আমার পাশে থাকবে।
-- বেশ! তুমি খুশি থাকলেই আমি খুশি।
 সৌম্য জানে আজ তার মনের কথাটা বলে কোন লাভ নেই। তাই সে চুপ করেই থাকে। সে একজন বন্ধু হয়েই আজীবন তিয়াসার পাশে থাকতে চায়। নিজের আবেগ,অনুভূতি সবকিছুই এত দিনের মত আজও কন্ট্রোল করেই নেয়।
-- সত্যি বলতে কী জানো? যখন আমার বিয়ে ঠিক হল তখন তোমার জন্য খুব কষ্ট হত। নিলয়ের সাথে বিয়ে হওয়ার পরও তোমার কথা ভেবেছি। কিন্তু পরবর্তীতে নিলয়ের পাগল করা ভালোবাসা পেয়ে তোমার কথা আমি ভুলেই গেছিলাম। আমি খুব স্বার্থপর সৌম্য! গ্যাংটকে গিয়ে তোমায় ফোন করতে বলেছিলে। কিন্তু আমি তা করিনি। আসলে নিলয়ের ভালোবাসা আমায় সবকিছু ভুলিয়ে রেখেছিল। আমি ভুলে গেছিলাম তোমায়। ঠিক যখন বিপদে পড়লাম তোমার কাছেই হাত পাতলাম।
-- ছাড়ো না এসব কথা। মানুষ বিপদে পড়লে তো পরিচিতদের কাছেই হাত পাতে। আর আমরা তো বন্ধু ছিলাম। এসব কথা বলে নিজেকে ছোট কোরো না। আমি কিছুই মনে করিনি। তুমি জানো না আমার বাবা সম্পূর্ণ তার নিজ অর্থে কিছু এনজিও চালান। আমিই তাদের একমাত্র সন্তান। বিয়ে থা করিনি। কী হবে এত টাকা দিয়ে যদি মানুষের উপকারেই আসতে না পারলাম।
  তিয়াসা তখন প্রচন্ড কাঁদতে কাঁদতে বললো
--- সে তুমি যাই বলো না কেন আমার বিবেক আমায় প্রতিমুহূর্ত বলছে 'তুই স্বার্থপর।'
-- নিজেকে এভাবে ভেবো না। তাতে কষ্ট পাবে বেশি। বরং এটা ভাবো তোমার স্বামীর অসুস্থতায় তুমি তোমার শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে চেষ্টা করে তাকে সুস্থ করে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছো। ক'জন পারে এভাবে তার স্বামীকে সুস্থ্ করতে? কে টাকা খরচ করলো সেটা এখানে ম্যাটার করে না। নিলয়ের সুস্থ হয়ে উঠাটাই এখানে বড় কথা।এর পরেও যখনই তোমার যে কোন প্রয়োজনে আমি আছি তোমাদের সাথে। 
 তারপর কিছুটা সময় নিয়ে তিয়াসা একটু শান্ত হলে সৌম্য বললো,
-- যদি কিছু মনে না করো একটা কথা বলবো?
 তিয়াসা সৌম্যর দিকে তাকিয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজ চোখের জল মুছে বলে,
-- বলো। তুমি যে উপকার আমার করেছো তাতে তুমি যাই বলো না কেন আমি কিছুই মনে করবো না। তুমি যা বলবে আমি তাই শুনবো।

ক্রমশ 

Monday, April 3, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৫৩ পর্ব )

মেয়ে জুইয়ের বয়স যখন একবছর, টলমল পায়ে হাঁটছে, আধো আধো স্বরে কথা বলছে ঠিক সেই সময়ে নিলয় একদিন অফিস থেকে জ্বর নিয়ে বাড়ি এলো। পরেরদিন তাকে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ পত্র সহ কিছু টেষ্টও লিখে দিলেন। জ্বর আর না আসায় গাফিলতি করে টেষ্টগুলো আর করলো না সে। বাড়ির সকলে বলেও কিছুই লাভ হল না। আবার অফিস,বাড়ি সেই একইভাবে আনন্দে ফুর্তিতে কাটতে লাগলো সময়। মাস দু'য়েকের মধ্যে দেখা গেলো তার পায়ের পাতা ফুলছে। মাঝেমধ্যে নিজেকে দুর্বল মনেহয়। আবার ডাক্তার আবার টেষ্ট। ধরা পড়লো সুগার। খাওয়াদাওয়া প্রায় বন্ধের মুখেই। নিলয়ের মধ্যে নেই সেই আগের উদ্যমতা,নেই সেই উচ্ছাস। আস্তে আস্তে শারীরিক দিক থেকে সে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে দেখে তিয়াসা অনেক বুঝিয়ে তাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলো। তখন নিলয়ের ক্রিটি নাইনের মাত্রা অনেক বেশি। আকাশ ভেঙ্গে পড়লো পরিবারের সকলের মাথায়। এলোপ্যাথি,হোমিওপ্যাথি এমন কী কবিরাজি কোনোটাই বাদ নেই। নিলয় একদিন রাতে মেয়ে ঘুমিয়ে যাওয়ার পর তিয়াসাকে কাছে ডেকে বললো,
-- এখনো অফিস করছি। কতদিন করতে পারবো জানি না। তুমি এখন থেকেই চেষ্টা করো যদি কোন চাকরি পাও।
  তিয়াসা কাঁদতে কাঁদতে নিলয়কে জড়িয়ে ধরে বললো,
-- তোমার কিছুই হবে না। তুমি ঠিক সুস্থ হয়ে যাবে। ভগবান এত নিষ্ঠুর কখনোই আমার প্রতি হবেন না।
 নিলয় ঠোঁটের কোণে হাসি এনে বলে,
-- দূর পাগলী! সেতো বিধাতার হাতে। আমরা কেউ কী কিছু বলতে পারি তিনি কখন সুতো ধরে টান দেবেন?
 তিয়াসা নিলয়কে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। 
 ওষুধ চলছে ওষুধের মত। ডাক্তার, বাড়ি আর ওষুধ এই হল এখন নিলয়ের রুটিন। ক্রিটি নাইন বাড়লো লাফিয়ে লাফিয়ে। বন্ধ হল অফিস। শুরু হল ডায়ালিসিস। দিন চলে যাচ্ছে তার মত করে কিন্তু পরিবারটির যেন সময় থমকে গেছে। প্রথমে মাসে ছিলো দু'টো  ডায়ালিসিস এখন সেটা মাসে চারটে হয়েছে। ডায়ালিসিস করে আসার পর তিনদিন একটু কথাবার্তা, হাঁটাচলা করতে পারে। তারপরেই সে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। তিয়াসা বাড়ির সকলের সাথে কথা বলে কিডনি প্রতিস্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু টাকার দরকার অনেক। গয়নাগাটি, যা জমানো টাকা আছে সব নিঃস্ব করেও পুরো টাকা যোগাড় হবে না। তবুও পেপারে অ্যাড দেয়। 
  টাকার চিন্তায় যখন সকলে অস্থির তখনই মনে পড়ে সৌম্যর কথা। সৌম্যর কাছে হাত পাততে নিজেকে খুব ছোট মনেহয় নিজের কাছেই। কিন্তু সমস্ত দ্বিধা কাটিয়ে সে হন্যে হয়ে ব্যাগের ভিতর তার কার্ডটা খুঁজতে থাকে। নিলয় দেখতে পেয়ে জানতে চায়
-- কী খুঁজছো সেই থেকে তুমি পাগলের মত?
-- একটা কার্ড। আমার এক বন্ধু যখন আমরা গ্যাংটক যাই তখন দিয়েছিলো। 
-- সে তো কবের কথা। তা কি আর খুঁজে পাবে? কী করবে তুমি তা দিয়ে?
-- যদি খুঁজে পাই তখন বলবো।
 তবুও তন্নতন্ন করে তাদের যতগুলো ব্যাগ আছে সে খুঁজে চলে। একসময় দুমড়ানো মুচড়ানো সৌম্যর কার্ডটা সে খুঁজেও পায়। কিন্তু সে নিলয়ের কাছে ব্যাপারটা গোপন করে যায়। দু'দিন পর ছিলো নিলয়ের ডায়ালিসিস। তিয়াসা প্রতিবারের মত নিলয়কে নিয়ে নার্সিংহোমে যায়। ভিতরে যখন নিলয়ের ডায়ালিসিস চলছে বাইরে তিয়াসা একবুক আশা নিয়ে সৌম্যকে ফোন করে।
    সমস্ত ঘটনা সে সৌম্যকে ফোনে জানায়। সৌম্য সব শুনে স্তব্ধ হয়ে যায়। নিরুপায় হয়ে তিয়াসা যে তাকে ফোন করেছে সেটা সে বুঝতে পারে। কিন্তু তার কাছে তিয়াসার এই স্বার্থপরতার থেকেও বেশি হয়ে ওঠে তিয়াসার স্বামীকে সুস্থ্য করে তার ভালোবাসার কাছে ফিরিয়ে দেওয়া। জানতে চায় কোন নার্সিংহোমে আছে আর কতক্ষণ আছে।
  চলে আসে কিছুক্ষণের মধ্যে। সৌম্যকে দেখেই হাউমাউ করে কেঁদে ভাসিয়ে দেয় তিয়াসা। সৌম্য চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে একদৃষ্টে তিয়াসার দিকে তাকিয়ে থেকে মনেমনে ভাবে - 'এখানে তিয়াসার তো কোন দোষ নেই। সে তার ভালোবাসাকে বাঁচানোর জন্য শেষ লড়াইটা লড়ছে। সেও তো তিয়াসাকে ভালোবেসে তার জীবনের সমস্ত সুখ,শান্তি,আনন্দ,ফুর্তি থেকে দূরে আছে। আর তাছাড়া সে তো কোনদিন তিয়াসাকে তার ভালোবাসার কথা মুখ ফুটে জানায়নি। এখানে তিয়াসা আর সে - দুজনেই ভালোবাসার কাছে অসহায়!'
 সৌম্য কথা দেয় ডোনার পেলে সে তার সাথে কথা বলবে এবং সব দায়িত্ব নেবে। নিজেকে স্বার্থপর মনে হলেও এই ছাড়া তার আর কোন পথও খোলা নেই তিয়াসার। সেদিনই সে নিলয়ের সাথে তাকে ক্লাসমেট বলে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলে,
-- এই নার্সিংহোমেই হঠাৎ করেই তার সাথে দেখা হয়ে গেছে।
 ওদের মধ্যে অনেকক্ষণ কথা হয়। সৌম্য নিজেই ড্রাইভ করে ওদের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসে। নিলয় এবং তিয়াসা তাকে বারবার অনুরোধ করা স্বর্তেও সৌম্য সেদিন জরুরী কাজ আছে কিন্তু পরে আসবে বলে বেরিয়ে যায়। 

ক্রমশ 

Saturday, April 1, 2023

একদিন ভালোবাসবে (৫২ পর্ব)

 একদিন ভালোবাসবে (৫২ পর্ব)

 
   গ্যাংটক থেকে ঘুরে আসার পরের মাসেই তিয়াসা বুঝতে পারে সে প্রেগন্যান্ট। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি বাচ্চা নিতে সে চায়নি। নিলয়কে জানালে সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে। দু'বাড়ির সকলেই খুশি। সুতরাং তিয়াসা তার মনের কথাটা কাউকেই বলতে পারে না। যদিও পরে সে ভেবে দেখে প্রথম সন্তান নষ্ট করলে পরে যদি তার আর সন্তান না হয়। তাই সে পরবর্তীতে খুশি মনেই সবকিছু মেনে নেয়। প্রথম থেকে শেষ অবধি প্রেগনেন্সির ফলে তার কোনোই শারীরিক সমস্যা দেখা দেয় না।
      এ সময় মেয়েরা টানা কয়েকমাস বাপের বাড়িতে থাকলেও তিয়াসা তার মাকে জানিয়ে দেয় তার শ্বশুরবাড়িতে যত্নআত্তির কোন কমতি নেই। সুতরাং সে এখানেই থাকবে। চাকরি করার চিন্তা তখন মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে। নিলয় বাড়িতে থাকলেই হাঁটতে,চলতে বসতে সব সময় তার নজরদারী। খাওয়ানোর ঘটা বাড়ির সকলের এতটাই এখন খাবার দেখলেই তার আতঙ্ক। মাঝে মাঝে নিজেকে পৃথিবীর সব চেয়ে সুখী মানুষ মনেহয়। আবার কখনো নিজের অজান্তেই একটা অজানা আশঙ্কায় বুকের ভিতর কেঁপে কেঁপে ওঠে। এত সুখ সত্যিই কী তার কপালে সইবে?
  শ্বশুরবাড়ির নিয়ম অনুযায়ী তার দু'বার সাধ হয়। একবার সাত মাসে আর একবার ন'মাসে। সাত মাসের সাধে সেরূপ আয়োজন না থাকলেও ন'মাসে বেশ কিছু মহিলাদের নিমন্ত্রণ করা হয়। তিয়াসার বাপেরবাড়ির লোকজন বলতে তো তিনজন। তারমধ্যে ওর বাবা কিছুতেই আসেন না। প্রথমত মেয়ের সাধ তার উপর এটা মহিলাদের অনুষ্ঠান। তাকে তিয়াসাও ফোন করে রাজি করাতে পারেনি। মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে এসে তিয়াসার মা তন্দ্রা মেয়ের সুখ দেখে ভীষণ খুশি। এর আগে তিনি এই তিন বছরে তিনবার এসেছেন পুজোর সময় নতুন জামা কাপড় দিতে সামান্য সময়ের জন্য। কিন্তু এবার তিনি সাধের আগেরদিন এসে দু'রাত থেকে তারপর গেছেন অদ্ভুত এক মানসিক তৃপ্তি নিয়ে।
   সাধের পরেই শ্বাশুড়ি নীলিমা বলে দিলেন,
-- শোনো বৌমা এখন থেকে তুমি আর উপর নিচ করবে না। নিলয় বাড়িতে থাকলে সে তোমার খাবার উপরে দিয়ে আসবে আর ও যখন অফিস বা বাইরে থাকবে আমরা তোমার খাবার উপরে দিয়ে আসবো।
-- আমি খুব আস্তে আস্তে নামবো মা। আপনারও তো বয়স হয়েছে। এখন তো সংসারের কোন কাজই করি না । খেতে অন্তত নিচুতে একটু নামি।
-- না না আর তো মাত্র কয়েকদিন। এ কটাদিন লক্ষী মেয়ের মত আমার কথা শোনো মা।
  তিয়াসা আর কোন কথা বলে না। কারণ সে জানে এই কথাটাই তার শ্বশুর এবং নিলয়েরও কথা হবে।
  সাধ খাওয়ার ঠিক পনেরোদিনের মাথায় ডাক্তার দেখাতে গেলে তিয়াসাকে নার্সিংহোম ভর্তি করে নেয়। সারাটা রাত নিলয় হাসপাতাল জেগে কাটিয়ে দেয়। পিয়া এবং তার বাবা,মা অনেক রাতে নিলয়ের পীড়াপীড়িতে বাড়ি ফিরে যান। ভোর রাতে নর্মাল ডেলিভারী হয়। একটা সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে নিলয় গিয়ে দেখেও আসে। ভোরে সে বাড়ি চলে যাওয়ার পর কিছুক্ষণের মধ্যেই হাসপাতাল থেকে ফোন আসে তিয়াসার অবস্থা মোটেই ভালো নয়। 
   ডেলিভারীর ঠিক ঘণ্টা দু'য়েকের মধ্যে তিয়াসার যে চারটে সেলাই পড়েছিল ব্লাড প্রেসার বেড়ে যাওয়ার ফলে ভিতর থেকে চাপ এসে সেই সেলাই ছিঁড়ে গিয়ে প্রচণ্ড ভাবে ব্লিডিং হতে শুরু করেছে। নানানভাবে ডাক্তার ব্লিডিং বন্ধ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যেতে থাকেন। তিয়াসার সম্পূর্ণ জ্ঞানে ডাক্তার রোলার ব্যান্ডেজ আঙ্গুলের সাহায্যে ভিতরে প্রবেশ করিয়ে প্রথম অবস্থায় ব্লিডিং বন্ধ করার বৃথা চেষ্টা করেন। কিন্তু কোনোই লাভ হয় না। সেই সময় ওটিতে আরও দু'জন সিনিয়র ডাক্তারকে ডাকা হয়।এই কষ্ট তিয়াসা আর নিতে পারছিলো না।সে ডাক্তারের হাত চেপে ধরে বলে,
-- ডাক্তারবাবু আমি আর সহ্য করতে পারছি না। আপনি আমাকে অজ্ঞান করে যা করার করুন।
 সেই মুহূর্তে তখনো নিলয়ও এসে পৌঁছায়নি। তারা তিয়াসাকে ওটিতে নিয়ে যান। নিলয় এসে পৌঁছালে বন্ডে সই করিয়ে তিয়াসার অপারেশন শুরু হয়। ডাক্তারদের পরিভাষায় তিয়াসার হিমাটোমা অর্থাৎ একটা বড় মাংসপিন্ড এইভাবে ব্লিডিং হওয়ার ফলে ভিতরে সৃষ্টি হয়েছে। অপারেশন করে ওই মাংসপিণ্ডটা বাদ দেওয়া হয়। কিন্তু ডাক্তার নিলয়কে জানিয়ে দেন যেহেতু ব্লাড প্রেসার হাই তাই যে কোন মুহুর্তে বিপদের সম্ভাবনা হয়েছে। নিলয় প্রচণ্ড ভেঙ্গে পড়ে। দীপ্ত ছাড়া তেমন কোন বন্ধু তার নেই। কিন্তু সেই দীপ্তও তো এখন বাইরের দেশে।
 
  অনেক ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে বাইশ দিন পরে তিয়াসা তার ফুটফুটে মেয়ে নিয়ে বাড়িতে আসে। বাড়িতে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। পিয়া দিদিকে আনতে হাসপাতাল গেছিলো। দিন সাতেক ছুটি নিয়েছিলো নিলয়। ছুটি ফুরিয়ে যেতেই সে অফিস জয়েন করে। বেশ আনন্দেই তাদের দিনগুলি কাটছিলো। হয়ত তাদের এই আনন্দ দেখে বিধাতা পুরুষ অলক্ষ্যে হেসেছিলেন। তিয়াসার জীবনে এই সুখ তিনি বেশি দিন লিখেছিলেন না। তাই মাঝে মাঝে হয়ত তারই ইচ্ছাতে তিয়াসার অজান্তেই তার বুকের ভিতর কেঁপে উঠতো। সুখ তো ক্ষণস্থায়ী! তাই বলে যে একবার সুখের মুখ দেখেছে তার কাছ থেকে সেই সুখ চলে যাওয়া মানেই তো তাকে অতল গহ্বরে ধাক্কা দেওয়া। তিয়াসা নিলয়কে জীবন সঙ্গী হিসাবে পেয়ে নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে করতো। কিন্তু সে স্বপ্নেও ভাবেনি ভবিষ্যতে তারজন্য কী অপেক্ষা করছে।

ক্রমশ 
    

Thursday, March 30, 2023

একদিন ভালোবাসবে।(৫১ পর্ব)

একদিন ভালোবাসবে ( ৫১ পর্ব)

  তিয়াসারা গ্যাংটকে পৌঁছে ভুলেই গেলো সৌম্যর কথা। প্রতিটা দিন প্রতিটা মুহূর্ত সে নিলয়ের ভালোবাসায় নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। আর ওদিকে সৌম্য প্রতিটা মুহূর্ত তিয়াসার ফোনের অপেক্ষা করেছে। অঙ্কুরিত না হওয়া প্রথম ভালোবাসাকে মনে করে যে আজও কোন মেয়েকে নিজের করে নিতে পারেনি। সেই সৌম্য যখন বিবাহিত তিয়াসাকে ট্রেনের কামরায় একাএকা দেখলো তখন তার বুকের ভিতর কে যেন সশব্দে হাতুড়ি পিটিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সেই আওয়াজ সৌম্য নিজে ছাড়া তিয়াসার কাছেও পৌঁছায়নি। এ যন্ত্রণার শব্দ অন্য কারও কাছে কখনোই পৌঁছায় না। সামনাসামনি বসে থাকা দু'টি মানুষ একজন ভাবছে তার সদ্য বিয়ে হওয়া স্বামীর ভালোবাসার কথা আর অপরজন হারানোর যন্ত্রণার দগদগে ঘায়ের কারণে বুকে অসীম বেদনা নিয়ে মুখে হাসি রেখে তারই সাথে কথা বলে চলেছে। এটাই জীবন! 
  যে ভালোবাসার কথা পরস্পর কেউ কখনো প্রকাশ করেনি, যে ভালোবাসার কথা অপরজন ভালোবাসে কিনা তাও জানার চেষ্টা কখনোই কেউ করেনি - সেই ভালোবাসাকে সৌম্য আজও মনের মধ্যে একাকীই লালন করে চলেছে। সুপুরুষ, বড় ব্যবসায়ীর একমাত্র সন্তান - অর্থ,গাড়ি,বাড়ি,বৈভব কোনকিছুতেই কমতি ছিলো না আজও নেই। চাইলেই যে কোন সুন্দরী মেয়ের বাবা তার মেয়েকে সৌম্যর হাতে তুলে দিতে রাজি হতেন। কিন্তু না - সৌম্য তার ভালোবাসার প্রতি এতটাই বিশ্বাস রেখেছিল যে সে ভেবেছিল গোলাকার এই পৃথিবীর যে কোন প্রান্তেই একদিন না একদিন সে তার ভালোবাসাকে ফিরে পাবে। 
   যখন তিয়াসারা ভাড়া বাড়িতে থাকতো তখন একই কলেজে সৌম্য ও তিয়াসা পড়তো। পরবর্তীতে একটু গ্রামের দিকে তিয়াসার বাবা অনিল দাস সামান্য জমি কিনে বাড়ি করে চলে আসেন। কিন্তু সৌম্যর সাথে সেরূপ কোন সম্পর্ক গড়ে না ওঠায় তিয়াসা সেই বাড়ির কথা কোনদিনও সৌম্যকে জানায়নি। সৌম্য জানতো ওদের পুরনো বাড়ির ঠিকানা। খোঁজও করেছিলো পরবর্তীতে। কিন্তু নতুন বাড়ির ঠিকানা মেলেনি। প্রথম প্রেম তার হারিয়ে গেলেও তার ভালোবাসার প্রতি এতটাই বিশ্বাস ছিলো সে ভেবেই নিয়েছিল আজ হোক বা কাল তিয়াসা তার হবেই।
    মানুষ ভাবে এক আর তার জীবনে ঘটে আর এক! এক জীবনে মানুষের সব আশা পূর্ণতা পায় না। তাই হয়ত জন্মান্তর কথাটা সকলে বলে থাকে। ছেলেবেলা থেকেই সৌম্য পড়াশুনায় তুখোড়,অর্থ সম্পদের মধ্যে মানুষ, সুন্দর চেহারা। কোনকিছুতেই তার কোন কমতি ছিল না। যে কোন কিছু চাইলেই সে পেয়েছে। তাই সে ধরেও নিয়েছিলো তিয়াসা হারিয়ে গেলেও একদিন না একদিন ঠিক তাকে সে খুঁজে পাবে। হায়রে মানুষের মন! 
 হঠাৎ করে একটা অপরিচিত মেয়েকে বাড়িতে নিয়ে এসে সেই মুহূর্তে তাকে প্রাণে বাঁচালেও তার শারীরিক অবস্থার কারণে সৌম্যর স্নেহময়ী মা এতদিন তাকে আগলে রেখে বাবার ইচ্ছাতেই তাকে গ্যাংটকের হাইওয়ের কাছাকাছি বাকথাং জলপ্রপাতের খুব কাছেই পাহাড়ের কোল ঘেঁষে গড়ে উঠা একটি ছোট প্রাইমারি স্কুলে পাঠিয়ে দেন। যা চলে কিছু সহৃদয় মানুষের সহয়তায়। এখানে একটা মোটা অংকের টাকা দান করেন সৌম্যর বাবা বিমানবাবু। পাহাড়ের পাদদেশেই কাঠের তৈরি বেশ কয়েকটি ছোট ছোট ঘর। দু'জন শিক্ষক এখানে থেকেই এদের পড়ানোর দায়িত্ব নিয়েছেন। এদের মধ্যে যোগ হল দীপিকা। পূর্বের দু'জনই মহিলা। দীপিকার মতই তাদেরও জীবনকাহিনী। থাকা,খাওয়া আর সামান্য কিছু অর্থের বিনিময়ে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তবে আগে যে দু'জন আছেন তাদের একজনের বয়স দীপিকার মত হলেও অন্যজন মধ্য বয়সী। তিনি স্বামীর মৃত্যুর পর নিঃসঙ্গ জীবনে এখানে এসেই একটু সুখের মুখ দেখেছেন। তার নিজ বাড়ি ছিল সিকিম। তিনি তার বাড়ি বিক্রি করে স্বামীর জমানো টাকায় এখানে এসে ছোটছোট বাচ্চাগুলোর জন্য প্রথমে তৈরি করেছিলেন একটি ছোট্ট বেড়ার ঘর। সেখানে তিনি ওদের প্রাইভেট পড়াতেন। একজন পশ্চিমবঙ্গবাসী বড় ব্যবসায়ী পর্যটকের নজরে আসে মেনকার এই কার্যকলাপ। তিনিই উদ্যোগী হয়ে মেনকার পাশে থেকে কাজটিকে একটু একটু করে বড় করে তুলেছেন। তার আগ্রহেই আরও কিছু মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। এখন সেখানে প্রায় তিরিশ জনের মত ছাত্রছাত্রী। 
  অপর যে জন সেখানে শিক্ষকতা করেন তার বয়স দীপিকার মতই। অল্প বয়সে জুই ভালোবেসে ঘর ছেড়েছিল তার প্রেমিকের সাথে। টাকার বিনিময়ে তার প্রেমিক তাকে নিষিদ্ধ পল্লীতে বিক্রি করে দিয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যক্রমে সেদিনই সে পালাতে সক্ষম হয়েছিল। সামনে যে ট্রেনটা সে পেয়েছিল তাতেই চড়ে বসেছিল। সেই ট্রেনে যাত্রী হিসাবে এমন একজনকে সে পেয়েছিল যে তাকে পৌঁছে দিয়েছিল এখানে। 

  দীপিকাকে বিমানবাবু তার ছেলেকে দিয়ে এখানেই পাঠিয়ে দেন। কারণ এমন বয়সের একটি মেয়েকে তিনি কিছুতেই বাড়িতে রাখতে রাজি নন। সৌম্য দীপিকাকে বাকথ্যানে পৌঁছে দিয়ে তারপরে বেশ কয়েকদিন সে হোটেলে অপেক্ষা করে তিয়াসা নিশ্চয় তার স্বামীর সাথে একবার হলেও দেখা করতে আসবে। সৌম্য তার কার্ডটা তিয়াসাকে দিলেও তার ফোন নম্বরটা তাড়াহুড়োয় নিতে ভুলে যায়। সুতরাং যোগাযোগের রাস্তা পুরোটাই বন্ধ।

  পুনশ্চ 

সৌম্য কী সারাজীবন তিয়াসাকে ভালোবেসেই কাটিয়ে দেবে? তিয়াসা কি নিলয়ের ভালোবাসা সারাটাজীবন ধরে রাখতে পারবে? তিয়াসার সুখী জীবন আর সৌম্যর ব্যর্থ জীবন! এটাই কী ওদের ভবিতব্য?
  এই সব প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে পড়তেই হবে এর পরবর্তী পর্বগুলি। গল্পের মোড় শুরু এখান থেকেই --।

ক্রমশ