সম্পূর্ণ নিজের খরচে সৌম্য নিলয়ের কিডনী প্রতিস্থাপন করে। হাসপাতালে সেদিন তিয়াসার সাথে রাত জাগে সে। পিয়া অনেক রাতে নিলয়দের বাড়িতে ফিরে যায়। জুই পিয়ার কাছে খুব ভালো থাকে তাই। বেশ কয়েক ঘন্টা পরে নিলয়ের জ্ঞান আসার পর তার সাথে দেখা করে তিয়াসাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে সৌম্য ঘরে ফেরে। সৌম্য বাড়িতে টাকা-পয়সার ব্যাপারটা গোপন করে যায়। একজন বন্ধু অসুস্থ্য শুধু এটাই জানায়। সৌম্যর বাবা এখন আর তার ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপারে শারীরিক কারণে সময় দিতে পারেন না। তাই টাকা-পয়সার লেনদেনের ব্যাপারেও তিনি আর মাথা ঘামান না। ব্যবসার সমস্ত কিছুই সৌম্য দেখাশুনা করে।
রোজই সৌম্য নিলয়কে দেখতে যায় বিকেল হলেই। তবে কিছুক্ষণ থেকেই সে চলে আসে। সেদিন সুযোগ পেয়ে তিয়াসা সৌম্যকে বলে,
-- একটু কথা ছিলো।
-- হ্যাঁ বলো কী বলতে চাও?
আগে সৌম্য তিয়াসাকে তুই বললেও এখন সে তুমি বলে। কেন তা সে নিজেও জানে না। একটা ফাঁকা জায়গা দেখে দু'জনে এসে দাঁড়ায়।
-- তোমার কাছে আমার অনেক ঋণ জমা হয়ে গেলো। শুধুমাত্র একজন ক্লাসমেট হিসাবে তুমি যা করলে আমি আজীবন তোমার গোলাম হয়ে থাকবো।
-- কী উল্টোপাল্টা কথা বলছো তুমি?
-- আজ তোমাকে একটা সত্যি কথা বলবো সৌম্য। কোনদিন বলতে পারিনি যে কথা সেটাই তোমায় আজ জানাবো।
সৌম্য একটু অবাক হল।
--- কী এমন কথা যা বলতে পারোনি?
-- নিলয় অসুস্থ্য হওয়ার পর আমি যখন দিশেহারা তখন তোমার মুখটাই আমার চোখের সম্মুখে ভেসে উঠেছিলো। আমার স্থির বিশ্বাস ছিলো তুমি আমায় ফেরাবে না। তারও একটা কারণ ছিলো -
তিয়াসা চুপ করে যায়। নিলয় কৌতূহলী হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। অথচ তিয়াসা চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে।
-- কী হল বললে না কী কারণ ছিলো?
কথাটা শুনে নিচের দিকে তাকিয়েই এক নিশ্বাসে তিয়াসা বলে উঠলো,
-- কলেজ লাইফে আমি তোমায় ভালোবাসতাম! কোথায় যেন এই ভালোবাসার প্রতি আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো আমায় তুমি ফেরাবে না।
সৌম্যর বুকের ভিতর কে যেন তখন হাতুড়ি পেটাচ্ছে। সে তিয়াসার দিকে তাকিয়ে। তিয়াসা কিন্তু মুখ নিচের দিকেই করে রেখেছে। সেই ভাবেই সে পুণরায় শুরু করে,
-- তুমি খুব বড়লোকের ছেলে। নিজের মনের কথাটা কোনদিন মুখ ফুটে বলতে পারিনি আমরা তোমাদের সমকক্ষ নই বলে। যদি আমার ভালোবাসার কথা শুনে তুমি ব্যঙ্গ করো -
-- আর আজ বললে কেন?
-- জানি না। তবে তোমার মনে এ প্রশ্ন আসতে পারে কেন আমি তোমার কাছে সাহায্য চাইলাম ? কোথাও যেন তোমার প্রতি একটা জোর অনুভব করছিলাম। জানি না কেন - আমার মন বলছিল আমার বিপদে তুমি আমার পাশে থাকবে।
-- বেশ! তুমি খুশি থাকলেই আমি খুশি।
সৌম্য জানে আজ তার মনের কথাটা বলে কোন লাভ নেই। তাই সে চুপ করেই থাকে। সে একজন বন্ধু হয়েই আজীবন তিয়াসার পাশে থাকতে চায়। নিজের আবেগ,অনুভূতি সবকিছুই এত দিনের মত আজও কন্ট্রোল করেই নেয়।
-- সত্যি বলতে কী জানো? যখন আমার বিয়ে ঠিক হল তখন তোমার জন্য খুব কষ্ট হত। নিলয়ের সাথে বিয়ে হওয়ার পরও তোমার কথা ভেবেছি। কিন্তু পরবর্তীতে নিলয়ের পাগল করা ভালোবাসা পেয়ে তোমার কথা আমি ভুলেই গেছিলাম। আমি খুব স্বার্থপর সৌম্য! গ্যাংটকে গিয়ে তোমায় ফোন করতে বলেছিলে। কিন্তু আমি তা করিনি। আসলে নিলয়ের ভালোবাসা আমায় সবকিছু ভুলিয়ে রেখেছিল। আমি ভুলে গেছিলাম তোমায়। ঠিক যখন বিপদে পড়লাম তোমার কাছেই হাত পাতলাম।
-- ছাড়ো না এসব কথা। মানুষ বিপদে পড়লে তো পরিচিতদের কাছেই হাত পাতে। আর আমরা তো বন্ধু ছিলাম। এসব কথা বলে নিজেকে ছোট কোরো না। আমি কিছুই মনে করিনি। তুমি জানো না আমার বাবা সম্পূর্ণ তার নিজ অর্থে কিছু এনজিও চালান। আমিই তাদের একমাত্র সন্তান। বিয়ে থা করিনি। কী হবে এত টাকা দিয়ে যদি মানুষের উপকারেই আসতে না পারলাম।
তিয়াসা তখন প্রচন্ড কাঁদতে কাঁদতে বললো
--- সে তুমি যাই বলো না কেন আমার বিবেক আমায় প্রতিমুহূর্ত বলছে 'তুই স্বার্থপর।'
-- নিজেকে এভাবে ভেবো না। তাতে কষ্ট পাবে বেশি। বরং এটা ভাবো তোমার স্বামীর অসুস্থতায় তুমি তোমার শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে চেষ্টা করে তাকে সুস্থ করে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছো। ক'জন পারে এভাবে তার স্বামীকে সুস্থ্ করতে? কে টাকা খরচ করলো সেটা এখানে ম্যাটার করে না। নিলয়ের সুস্থ হয়ে উঠাটাই এখানে বড় কথা।এর পরেও যখনই তোমার যে কোন প্রয়োজনে আমি আছি তোমাদের সাথে।
তারপর কিছুটা সময় নিয়ে তিয়াসা একটু শান্ত হলে সৌম্য বললো,
-- যদি কিছু মনে না করো একটা কথা বলবো?
তিয়াসা সৌম্যর দিকে তাকিয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজ চোখের জল মুছে বলে,
-- বলো। তুমি যে উপকার আমার করেছো তাতে তুমি যাই বলো না কেন আমি কিছুই মনে করবো না। তুমি যা বলবে আমি তাই শুনবো।
ক্রমশ
No comments:
Post a Comment