এই ক'টা বছরে সৌম্য তার বাবা,মা দু'জনকেই হারিয়েছে। তারা অনেক চেষ্টা করেছেন সৌম্যর বিয়ে দিতে। কিন্তু সৌম্যকে তারা কিছুতেই রাজি করাতে পারেননি। যেহেতু সৌম্য ব্যবসার কাজে সকাল থেকে মাঝ রাত অবধি কখনো কখনো বাইরে থাকতো তাই তিয়াসাদের ঘটনা তারা কিছুই জানেন না আর এই ব্যাপারে সৌম্য কিছু কোনদিনও তার বাড়িতে জানায়নি। মায়ের আদেশ অনুসারে সৌম্য প্রতিমাসে দীপিকাকে টাকা পাঠিয়ে দিতো যা তার বাবা জানতেন না। মেয়ে শ্রেষ্ঠা আস্তে আস্তে উপরে ক্লাসে উঠেছে আর সৌম্যর পাঠানো টাকার একটা করে অংশ বেড়েছে।
দীপিকা যতদিন সৌম্যদের বাড়িতে থেকেছে ততদিন সৌম্যর মায়ের কথামত সে শাঁখা, সিঁদুর পরেছে। কিন্তু ব্যকথাং এ গিয়ে সে আর ওইসব ছুঁয়েও দেখেনি। মেয়েকে স্কুলে ভর্তির সময় সে বাবার নামের জায়গায় সুজয়ের নামটা দিলেও চিরদিনের মত তার মন থেকে সে সুজয়ের নামটা মুছে ফেলেছে।
মেয়ের বয়স যখন প্রায় আট বছর হঠাৎ সে এতটাই অসুস্থ্য হয়ে পড়ে দীপিকার নিজের কেউ না থাকায় সে সৌম্যকে ফোন করে জানায়। সৌম্যর মায়ের অনুরোধে সৌম্য দু'দিনের জন্য গ্যাংটক ছুটে যায়। শ্রেষ্ঠাকে হাসপাতাল ভর্তি করতে হয়। দু'দিনের জায়গায় সৌম্যকে সেখানে বেশ কটাদিন থাকতে হয়। সৌম্য হোটেলেই থাকে। শ্রেষ্ঠা সুস্থ হয়ে বাড়ি আসলে সৌম্য যথারীতি বাড়িতে ফিরে আসে। কিন্তু এই সময় এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে দীপিকার জীবনে। সুজয় তার বউ নিয়ে গ্যাংটক বেড়াতে যায়। ঢালু পাহাড়ের রাস্তা চলতে গিয়ে সুজয়ের বউ পা পিছলে পড়ে গিয়ে পা ভেঙে নেয়। সেও তখন ওই হাসপাতালেই তার বউকে নিয়ে আসে।
হাসপাতাল গেটের কাছে দীপিকাকে দেখে সুজয় এগিয়ে আসে তার দিকে,
-- তুমি এখানে?
দীপিকা সুজয়কে দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিলো। কিন্তু তার একদম সামনে দাঁড়িয়েই প্রশ্নটা করায় সে উত্তর দিতে বাধ্য হয়
-- কেন আমি এখানে আসতে পারি না? এ কথা জানার অধিকারও তোমার নেই - আমি এখানে কী করছি ,কেনোই বা এসেছি।
-- আমার প্রতি তোমার রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমি অন্যায় করেছি আমি স্বীকার করছি। তখন আমি শুধু নিজের কথা আর পরিবারের কথাই ভেবেছিলাম। তোমার দিকটা ভেবে দেখেছিলাম না। পরে ভেবে দেখেছি আমি যা করেছি ভুল করেছি। কিন্তু তুমি আমাকে কোন সুযোগ না দিয়েই ওই মুহূর্তের কথাটা ধরে নিয়ে আজ ন'বছর নিজেকে লুকিয়েই রাখলে।
-- আমার এসব কথা শোনার কোন ধৈর্য কিংবা সময় কোনটাই নেই।
-- সময় নেই বললে তো হবে না? সারাজীবন তুমি আমায় আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রাখবে সত্যতা জানবে না তাতো হবে না
-- আসল কথা আমার তোমার সাথে কথা বলতেই ইচ্ছা করছে না। ওই অভিশপ্ত দিনগুলির কথা আমি ভুলে গেছি।
দীপিকা আর এক সেকেন্ডও সেখানে না দাঁড়িয়ে চলে যায়। তখন সৌম্য হাসপাতালের ভিতরেই ছিলো। সে বাইরে বেরিয়ে গেটের কাছে দীপিকাকে না দেখতে পেয়ে ফোন করে। তারপর কিছুটা এগিয়ে গিয়ে দু'জনে একসাথে হাসপাতাল ছেড়ে বেরিয়ে যায়। দূরে দাঁড়িয়ে সুজয় সব লক্ষ্য করে। সুজয় নিশ্চিত হয় ওই সৌম্যকান্তি যুবকটিই দীপিকার স্বামী। তাহলে তার যে সন্তান দীপিকার গর্ভে এসেছিলো সে কি পৃথিবীর আলো দেখেনি?
সাত বছর হল সুজয়ের বিয়ে হয়েছে। কিন্তু কোন সন্তান হয়নি। ডাক্তার জানিয়েও দিয়েছেন সুজয়ের স্ত্রী কোনদিন মা হতে পারবেন না। সুজয়ের বাবা মারা গেছেন কিছুদিন আগে। মা এখনো বেঁচে। তিনি ছেলের পুনরায় বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগলেও সুজয় রাজি হয়নি। তারা একটি শিশু দত্তক নেবে বলে প্রাথমিক কাজকর্ম সেরে রেখেছে। তবে দত্তক নেবো বললেই তো আর নেওয়া যায় না। হ্যাপা অনেক। সিরিয়ালে এখনো তাদের নাম আসতে অনেক দেরি। প্রতিবছর তারা ঘুরতে বেরোয়। এবার তারা এখানে। কিন্তু এখন যে সমস্যায় সে পড়েছে কবে নাগাদ এখান থেকে বেরোতে পারবে তা একমাত্র ঈশ্বরই বলতে পারবেন। কিন্তু এই মুহূর্তে দীপিকাকে দেখে তার মনে অনেক প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সে মনেমনে ভাবে এখানে হয় সে কিংবা তার স্বামী চাকরি করে নুতবা কোন আত্মীয় ভর্তি। কিন্তু কলকাতা থেকে এতদূরে দীপিকা কী করে এলো? তবে কি ওর স্বামী এখানেই সার্ভিস করেন? পুরো ঘটনা জানতেই হবে। জানতেই হবে বাচ্চাটার কী হল? যদি সে সত্যিই পৃথিবীর আলো দেখে থাকে তাহলে হিসাব মত তার বয়স এখন আট বছর। কিন্তু সে ছেলে না মেয়ে? যে ভাবেই হোক জানতেই হবে। দীপিকার হাতে পায়ে ধরে যদি নিজের সন্তানটিকে নিজের কাছে রেখে মানুষ করতে পারে সেই চেষ্টায় সে করবে।
পরদিন ভিজিটিং আওয়ারে হোটেল থেকে সুজয় আবার হাসপাতাল আসে। স্ত্রীর কাছে একটু দেরীতে যাবে ঠিক করে। কিন্তু আজ তাকে দেখতেই হবে দীপিকা আজ আবার এখানে আসে কিনা। সে হাসপাতালের বাইরে একটি দোকানের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখে। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না তাকে। একটা গাড়ি এসে সেখানে দাঁড়ায় আর গাড়ি থেকে দীপিকা আর সুদর্শন পুরুষটি নেমে হাসপাতালের ভিতর চলে যায়। সুজয় ওদের ফলো করতে থাকে।
ক্রমশ -
No comments:
Post a Comment