সৌম্যই তিয়াসার পরিবারটিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কিন্তু তিয়াসার কাছ থেকে কোন কিছুর আশা সে কখনোই করে না। কী অদ্ভুত ভালোবাসা সৌম্যর! তিয়াসার সুখ,শান্তি, ভালোথাকাই সৌম্যর একমাত্র চাহিদা। নিলয় অনেক আগেই বুঝতে পেরেছে সৌম্য তার তিয়াকে ভালোবাসে। এখন যে তিয়াসাও বোঝে না তা নয়। কিন্তু এই যে তিনটে মানুষ কেউ কাউকেই তাদের মনের কথা অন্যের সাথে শেয়ার করে না। তিনজনে যখন এক জায়গায় হয় তাদের মধ্যে প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া সাধারণত অন্য কোন ইয়ার্কি,ঠাট্টা কখনোই হয় না। সমন্তরাল তিনটি রেখা।
জুই খুব ভালোবাসে তার আঙ্কেলকে। আঙ্কেলকে দেখতে পেলেই দৌড়ে এসে সে আঙ্কেলের কোলে উঠে আধো আধো কথায় তাকে পাগল করে তোলে। সৌম্য যখনই এখানে আসে খালি হাতে কখনোই আসে না। জুই,নিলয় এদের জন্য কিছু না নিয়েই আসে। যেটুকু সময় সে থাকে নিলয়ের ঘরে বসেই গল্প করে। বেরোনোর আগে নিলয়ের বাবা,মায়ের সাথে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ।
দেখতে দেখতে বছর দু'য়েক হয়ে যায়। নিলয় এখন বেশ সুস্থই বলা চলে। সে ঘরে বসেই কম্পিউটারে কিছু না কিছু করে দুটো টাকা রোজগার করছে। বাইরে বেরোতে তাকে কখনোই তিয়াসা দেয় না। ভীষণ যত্নের মধ্যেই তাকে রাখে। যেহেতু তিয়াসা সকাল দশটার মধ্যেই বেরিয়ে যায় তাই নীলিমার উপর স্বাভাবিকভাবেই চাপটা বেশি পরে। তার উপর প্রায় চার বছরের দুষ্টু জুই। তার দুষ্টুমি, আর ছুটাছুটিতে বাড়ির সকলেই নাজেহাল। ভোরবেলা তাকে তিয়াসা স্কুলে দিয়ে আসে। তার আসবার সময় আর তিয়াসার অফিস বেরোনোর সময় যেহেতু এক তাই নিলয়ের বাবা অজয় গিয়ে তাকে স্কুল থেকে নিয়ে আসেন। এইভাবেই দিনগুলি দুঃখ,কষ্ট কখনো বা আনন্দের মধ্যেই চলে যাচ্ছিল । কিন্তু হঠাৎ করেই নিলয়ের বাবা অজয় চিরতরে চলে যাওয়াতে আবার পরিবারের উপর বিপর্যয় নেমে এলো। সবকিছু আবার যেন লন্ডভন্ড হয়ে গেলো। সব চেয়ে সমস্যা দেখা দিলো জুইয়ের স্কুল নিয়ে। এর সমাধানও সেই সৌম্যই করলো। সে তিয়াসার অফিস টাইমের কিছুটা রদবদল করে দিলো। তিয়াসা প্রতিটা দিন প্রতি মুহূর্ত সৌম্যর কাছ থেকে শুধু নিয়েই যাচ্ছে আর কৃতজ্ঞতার বোঝা নিজের কাঁধের উপর নিতে নিতে সে প্রায় ন্যুজ হয়ে পড়েছে সৌম্যর কাছে। কিন্তু সৌম্যকে সে কথা জানানোর কোন সুযোগ সে পায় না। বলা ভালো সৌম্য সে সুযোগটুকুও তিয়াসাকে দেয় না।
সৌম্যই মনেহয় পৃথিবীতে একমাত্র মানুষ যে ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসা না চেয়ে ভালোবাসার মানুষটির সুখ,দুঃখের প্রতি নজর রেখে, তাকে ভালো রাখতে চায়। আর তাতেই তার সুখ তাতেই তার শান্তি।
ঝড় যতই প্রবল হোক না কেন; সবকিছু তছনছ করে দেওয়ার পরেও মানুষ ঠিক সময়ের সাথে সাথে নিজেদের একটু একটু করে সামলে নিতে পারে। তিয়াসাও একটার পর একটা ঝড়ের পরেও সৌম্যর মত একজন প্রকৃত বন্ধুর সহয়তায় সব কিছুর থেকে মুক্তি পেলেও মানসিক শান্তি সে পায় না।এত কিছুর পরেও মাঝে মাঝেই নিলয়ের শরীরে নানান উপসর্গ দেখা দেয় দু'বছর পর থেকেই।
একদিন অনেক রাতে নিলয়ের কোমরে চিনচিন ব্যথা শুরু হয়। সারাদিনের পরিশ্রমের পর তিয়াসার ঘুমন্ত মুখটা দেখে সে তার ব্যথা নিয়েই সারা রাত কাটিয়ে দেয়। আস্তে আস্তে ব্যথাটা ছড়িয়ে পড়ে কোমর থেকে শরীরের নিচের অংশে। ভোরবেলা নিলয়কে নিয়ে নার্সিংহোম ছোটে সে। প্রতিটা মুহূর্তে সৌম্যকে বিরক্ত করতে তার মন আর সায় দেয় না। কিন্তু নার্সিংহোম সেই মুহূর্তেই নিলয়কে ভর্তি করে নেয়। অপারগ হয়ে সে সৌম্যকে ফোন করে। সৌম্য ছুটে আসে। সৌম্যকে দেখেই তিয়াসা তাকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে। তিয়াসা হঠাৎ তাকে জড়িয়ে ধরায় সৌম্যর শরীরের উপর দিয়ে যেন একটা বিদ্যুৎ খেলে যায়। তিয়াসার সে আকুল কান্নায় আশেপাশে লোক জড়ো হয়ে যায়। অনেক বুঝিয়ে সৌম্য তার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ছোটে ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার তাকে জানিয়ে দেন যে কোন কারণেই হোক নিলয়ের শরীরে ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়েছে। কতটা করতে পারবেন তারা সেটা নিজেরাও জানেন না। শুরু হল আবার দৌড়ঝাঁপ।
তিয়াসার বোন পিয়াসার মাস ছ'য়েক হল বিয়ে হয়েছে একজন স্কুল শিক্ষকের সাথে। বিয়েতে তিয়াসা যাতায়াত করলেও একরাতও থাকতে পারেনি। আর নিলয় তো যেতেই পারেনি তার খাওয়া দাওয়ার রেস্টিকশনের জন্য।তাদের বাবার শরীরের অবস্থা এতটাই খারাপ নিলয়ের এই অসুস্থতার সময়ে তিনি নার্সিংহোম তাকে দেখতে আসতেও পারেননি। পিয়াসা এবং তার স্বামী তিয়াসার পাশে থেকে তার মনোবল বাড়াবার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। এরই মাঝে একদিন নিলয় পিয়ার সাথে একাকী কথা বলতে চায়।
অধিকাংশ সময় এই চারটে প্রাণী নার্সিংহোম পরে থাকে। তিয়াসা কখনো নিলয়ের কাছে কখনো বা বাইরে বসে থাকে। ওষুধপত্র, ডাক্তারের সাথে কথা বলা সবই সৌম্য আর পিয়াসার স্বামী মিতান ই করে।
ক্রমশ
No comments:
Post a Comment