কোথা দিয়ে যে পাঁচটা বছর কেটে গেলো কেউই টের পেলো না। সবাই কেমন যেন যন্ত্রের মত চলছে। যার যা কাজ, খাওয়া-দাওয়া আর ঘুম। হাসতে, গল্প করতে সবাই যেন ভুলে গেছে। নিলয় চলে যাওয়ার পর সকলের সবকিছুই যেন এলোমেলো হয়ে গেছে। পিয়াকে বলে যাওয়া নিলয়ের কথাগুলো পিয়া অনেক চেষ্টা করেছে দিদিকে রাজি করাতে যাতে সে সৌম্যকে বিয়ে করে। কিন্তু তিয়াসার সেই এক কথা, "দেবতাকে ভালোবাসা যায়,শ্রদ্ধা করা যায় কিন্তু তাকে বিয়ে করে সংসার করা যায় না। তাকে দূর থেকেই প্রণাম জানাতে হয়।"
-- কিন্তু দিদি নিলয়দার যে এটাই শেষ ইচ্ছা ছিলো
-- না, তুই ভুল করছিস তোর নিলয়দার শেষ ইচ্ছা ছিলো তার জুইকে যেন মানুষের মত মানুষ করি। আর যে হৃদয়ে নিলয়কে জায়গা দিয়েছিলাম সে না থাকলেও সেখানে আমি অন্য কাউকেই বসাতে পারবো না।
-- তুই কি বুঝতে পারিস না সৌম্যদা তোকে ভালোবাসে। যে যা করেছে সেই ভালোবাসার জায়গা থেকেই করেছে।
-- কেন বুঝবো না। ভালো না বাসলে কেউ কি কারও জন্য এতটা করতে পারে?
-- তাহলে ওর কথা তুই ভাববি না ?
-- কে বললো ভাবি না? দেবতার স্থান ভক্তিতে হৃদয় গহীনে। সেখানে আছে ভক্তি,শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। কিন্তু সেই ভালোবাসা প্রেম নয়। প্রেমে অনেক কাঁটা থাকে। কিন্তু ভক্তির ভালোবাসায় কোন কাঁটা থাকে না। সেখানে থাকে শুধু শ্রদ্ধা।
পিয়া আলাদাভাবে সৌম্যকেও বোঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সেখানেও ব্যর্থ হয়। সৌম্য তাকে বলে,
-- পিয়া, তোমার দিদিও জানে না যে আমি তাকে কলেজ লাইফ থেকেই ভালোবাসি। তাকে ভালোবেসেই অন্য কোন মেয়েকে নিয়ে সুখী হতে পারবো না বুঝতে পেরে আমি বিয়ে করিনি। হারিয়েই তো গেছিলো তোমার দিদি আমার কাছ থেকে। আমি জানতাম না তোমার দিদিও আমাকে ভালোবাসতো। কিছুদিন আগে জেনেছি। তিয়াসাই আমাকে জানিয়েছে। কিন্তু কী জানো? সব ভালোবাসার পূর্ণতা দিতে গেলে ভালোবাসা তার নিজস্বতা হারায়। ভালোবাসার জন্য ভালোবাসতে হয়, ভালোবেসে কিছু পাওয়ার আশা করলেই ভালোবাসা অনেক ক্ষেত্রেই হারিয়ে যায়। তিয়াসা, নিলয়ের মধ্যে যে পাগল করা ভালোবাসা ছিলো সেই ভালোবাসায় ওকে আজীবন আগলে রাখবে। নতুন করে তিয়াসা এ জীবনে আর কাউকেই পাগলের মত ভালোবাসতে পারবে না। ওদের দু'জনের ভালোবাসার মধ্যে নতুন করে আমি ঢুকতে গেলে ঝঞ্ঝাট বাড়বে বৈ কমবে না। তার চেয়ে এই ভালো তিয়াসা আর জুইয়ের দেখভাল আজীবন করে যাবো আর দূর থেকেই ওকে ভালোবেসে যাবো।
-- দিদি ঠিকই বুঝেছে তুমি মানুষ নও ,দেবতা। তোমাকে দূর থেকেই পুজো করতে হয়।
-- না,আমি দেবতা নই কিন্তু ভালোবাসা কাকে বলে সেটা বুঝি। ভালোবাসলেই যে কাছাকাছি আসতে হবে তা মোটেই নয়। ভালোবাসা সব থেকে একটা পবিত্র সম্পর্ক। সেই পবিত্র সম্পর্কটাকে টিকিয়ে রাখতে গেলে দুটি মানুষকেই একটু দূরে দূরে থাকতে হয়। আর এই পবিত্র সম্পর্কের মধ্যে থাকে না কোন পাপবোধ। এ ভালোবাসা মনকে উদাস করে, হৃদয়ে প্রফুল্লতা আনে। এ এক আলাদা অনুভুতি।
-- আমার আর কিছু বলার নেই তোমাদের দু'জনকে। আমাকে ডেকে নিলয়দা সেদিন বলেছিল, 'পিয়া যখন আমি থাকবো না তুমি কিন্তু নিজে উদ্যোগী হয়ে সৌম্য আর তিয়াসার বিয়েটা দিয়ে দেবে। আমার মায়ের কোন আপত্তি থাকবে না। কারণ এ বিষয়ে আমি মাকে আমার শেষ ইচ্ছার কথা জানিয়ে এসেছি। যে তিনটি মানুষকে আমি রেখে যাচ্ছি মা,জুই আর তিয়াসা এই তিনজনই আমার প্রাণের থেকেও প্রিয়। তাই আমি যখন থাকবো না এরা যাতে ভালো থাকে সেটা ভেবেই আমার এই সিদ্ধান্ত। তিয়াসা মায়ের খেয়াল রাখবে, মেয়েকে মানুষের মত মানুষ করবে এসব আমি জানি। কিন্তু তিয়ার কথাটাও তো আমায় ভাবতে হবে। সৌম্যর মত একজন মানুষ যদি ওর পাশে থাকে ও সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করতে পারবে। তাই এই দায়িত্বটা আমি তোমায় দিয়ে গেলাম।'
সৌম্য আর কিছুই বলে না পিয়ার এই কথার জবাবে। শুধু মনেমনে ভাবে 'নিলয়, তোমার মত আমিও তিয়াসাকে প্রচণ্ড ভালোবাসি। তোমার জায়গা আমি নিতে পারবো না ঠিকই কিন্তু তিয়াসা আর জুইয়ের কোন কষ্ট আমি হতে দেবো না। তুমি যেখানেই থাকো না কেন শান্তিতেই থেকো ভাই। যে দায়িত্ব তুমি আমায় দিয়ে গেছো তিয়াসার সাথে একই ছাদের তলায় না থাকলেও যতদিন আমার প্রাণ আছে আমি সে দায়িত্ব পালন করে যাবো।'
সময়ের সাথে সাথে সবকিছুরই পরিবর্তন হতে থাকে। তিয়াসার শ্বাশুড়ি এখন শয্যাশায়ী। একজন আয়া রাখা আছে তার জন্য। তিয়াসা যখন অফিসে থাকে সেই সময়টুকু সে নীলিমাকে দেখাশুনা করে। জুই শুধু পড়াশুনায় নয় সংসারিক কাজকর্মও বেশ পারদর্শী হয়ে উঠেছে। সৌম্য আঙ্কেলকে সে দেবতার মত ভক্তি,শ্রদ্ধা করে। দিনগুলি এভাবেই কেটে যেতে থাকে।
ক্রমশ
No comments:
Post a Comment