Wednesday, October 4, 2023

ভালোবাসি বলেছি অনেকবার ( ৩য় পর্ব)


  দেবেশ গিয়ে মায়ের ঘরে ঢোকে। কিন্তু মাকে দেখাশুনা করার মেয়েটিকে সে দেখতে পায় না তখন। ওয়াশরুম থেকে জল পড়ার শব্দে বুঝতে পারে সে তখন ওয়াশরুমেই আছে। মায়ের কাছে এগিয়ে গিয়ে খাটের উপর মায়ের পাশে বসে। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে কপালে আগের সেই চাঁদের মত টিপ জ্বল জ্বল করছে। চুলগুলোও খুব সুন্দর করে আঁচড়ানো।
-- মা আজ তো তোমায় খুব ফ্রেস লাগছে। মেয়েটিকে পছন্দ হল?
 দেবেশের মা ছেলের কথা শুনে মুখে সামান্য হাসি এনে ছেলের একটি হাত নিজের দু'হাতের মধ্যে নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
-- মেয়েটার মুখের মধ্যে কিছু একটা আছে জানিস? দেখলেই মনেহয় খুব কাছের কেউ। খুব আস্তে আস্তে কথা বলে। 
 -- তারমানে বলো মেয়েটিকে তোমার পছন্দ হয়েছে।তাহলে তো এবার বাইরে ট্রিটমেন্ট করতে যাওয়ার কোন অসুবিধা নেই। এতদিন তো কলকাতা ছেড়ে যেতে চাওনি বাইরে গেলে কে তোমার দেখাশুনা করবে? কারণ বাবা তার হাসপাতাল ছেড়ে বেশিদিন বাইরে গিয়ে থাকতে পারবেন না আর কোন আয়া কিংবা আমার প্রতি তোমার কোন ভরসা নেই। তাহলে বাবার সাথে কথা বলে বাইরে যাওয়ার দিনক্ষণ ঠিক করে ফেলি?
-- আরে দাঁড়া দুটো দিন যেতে দে। মেয়েটা কেমন একটু বুঝে নিতে দে।
--- আচ্ছা মা, আমায় একটা কথা বলো তো তুমি তোমার জন্য আয়া চাইছো নাকি ছেলের বিয়ের মেয়ে চাইছো?
 বিদিশা হেসে পড়ে ছেলের মাথার চুলগুলো নাড়িয়ে দিয়ে বলেন
-- সত্যি কেন রে তুই বিয়ে করতে চাস না। এই তো শরীরের হাল আমার। চলে যাওয়ার আগে একমাত্র ছেলের বউ দেখে যাবো না?
-- ছেলের বউ দেখে যেতে হলে সুস্থ হতে হবে। আমাদের কথা শুনে চিকিৎসা করাতে বাইরে যেতে হবে। তারজন্য মনের মত আয়ার দরকার হবে কেন?
-- আমি কী তাই বলেছি কখনো? আসলে বাইরে গেলে তোকে কিংবা তোর বাবাকে যে কাউকে আমাকে নিয়ে যেতে হবে। বাকি যে জন বাড়িতে থাকবে তার তো দেখভালেরও একজন চাই।
-- মা,তোমার এসব কথা শুনলে খুব হাসি পায়। বাড়িতে বিলাসী পিসি রয়েছে। বাবার কাছে শুনেছি দাদু,ঠাকুমা মারা যাওয়ার পর বিলাসী পিসিই বাবার সব কাজ করে দিতেন। বাবা তখন ডাক্তারী পড়ছেন। কয়েকমাসের ব্যবধানে বাবা,মাকে হারিয়ে বাবা খুবই ভেঙ্গে পড়েছিলেন। সেই সময় এই পিসিই তো বাবাকে সামলেছেন।
 বিদিশার কোন কিছুই অজানা নয়। তবুও তিনি চুপচাপ ছেলের কথা শুনে চলেছেন। ছেলে কথা বলে চলেছে অনর্গল তিনি ফিরে গেলেন স্বামীর কাছে গল্প শোনা অতীতে -
 স্কুল শিক্ষক বাবার একমাত্র ছেলে স্বরূপ। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকে ভীষণ ভালো রেজাল্ট করার পর বাবা,মায়ের ইচ্ছাতে জয়েন্টে বসা। ফলস্বরূপ পয়ষট্টি রাঙ্ক। সরকারিভাবে সুযোগ পেলেও এরপর কলকাতা থেকে পড়াশুনার বাকি খরচ চালানোর মত সামর্থ্য তাদের ছিল না। বিশাল একান্নবর্তী পরিবারের প্রায় পুরোচাই বহন করতেন শ্বশুরমশাই। ছেলে নিজেও আপত্তি জানিয়েছিল যে সে অন্য কোনভাবে পড়াশুনা শেষ করে ঠিক একটা চাকরি খুঁজে নেবে। কিন্তু তার বাবা, মা তা চাননি। স্বরূপের বাবা তাকে বলেছিলেন,
-- এসব নিয়ে তোমায় কিছু ভাবতে হবে না। তুমি ডাক্তারি পড়বে। কিভাবে পড়াবো সে ভাবনা আমার।
 শান্ত স্বভাবের স্বরূপ বাবার মুখের উপর কোনদিন কোন কথা বলেনি কিন্তু সে ভালোভাবেই জানতো কলকাতা হোস্টেলে থেকে পড়ানো তার বাবার পক্ষে কতটা কষ্টকর। কিন্তু কিসের উপর নির্ভর করে তার মা এবং বাবা তাকে কলকাতা পাঠাতে চাইছেন সেটাও সে ভালোভাবেই জানতো। মায়ের বিয়ের সময় মামাবাড়ি থেকে অনেক গয়না দাদু মাকে দিয়েছিলেন একমাত্র ধনীর ঘরের দুলালীর বিয়েতে। 
  দেবেশ কথা বলতে বলতে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে মা একটু অন্যমনস্ক। মায়ের হাতটা তার হাতের মধ্যেই ছিলো। হাতে মৃদু চাপ দিয়ে সে বলে,
-- মা তুমি কী ভাবছো বলো তো?
-- কই কিছু নাতো। তোর কথা শুনছি তো
 দেবেশ হেসে পড়ে বলে
-- মা, তোমার দেবু এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। এখন আমি তোমার প্রত্যেকটা মুভমেন্ট কী বলতে চাইছে বলে দিতে পারি ঠিক তুমি যেমন করে আমার কথা বলে দাও।
 বিদিশা হো হো করে হাসতে থাকেন। অনেকদিন পরে মায়ের এই প্রাণখোলা হাসি দেখে মাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকে। 
  বাথরুম থেকে বেরিয়ে জামাকাপড় নিয়ে সুবর্ণা ছাদে চলে যায়। সেখানে গিয়ে কমকরে পাঁচশ টবে ফুটে থাকা নানান ফুলগাছে এবং তাতে ফুল ফুটে থাকায় সে এতটাই মোহিত হয়ে যায় বিদিশার কাপড়চোপড় মেলে আসতে তার অনেকটাই দেরি হয়ে যায়। ছাদের কাজ সেরে সে নিচে নেমে এসে বিদিশার ঘরে ঢুকতে গিয়ে পরিচিত একটা গলার আওয়াজ পেয়ে দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে পড়ে। পর্দার ফাঁক দিয়ে উকি দিয়ে দেখেই নিজের বুকটা নিজেই চেপে ধরে। নিজের অজান্তেই নিশ্বাস প্রশ্বাস ঘন হয়। পা দুটো আস্তে আস্তে অসার হতে থাকে। সুবর্ণা দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকে।
   স্বরূপ কলকাতা চলে এলো ডাক্তারি পড়তে। প্রথম প্রথম হোস্টেলের খাওয়াদাওয়া, নিয়মকানুনের সাথে খাপ খাওয়াতে স্বরূপকে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। গ্রামের খোলামেলা পরিবেশে বড় হওয়া স্বরূপ হোস্টেলের এই বদ্ধ পরিবেশে মানিয়ে নিতে খুব কষ্ট করতে হয়েছে। কিন্তু আস্তে আস্তে সব কিছুর সাথেই মানিয়ে নিতে সে সক্ষম হয়েছে। আর না হয়েই বা উপায় কী? মেডিকেল পড়ার যে বিশাল চাপ তার থেকে এক মুহূর্তও সময় বের করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
   একান্নবর্তী পরিবারের সন্তান স্বরূপ ভালোভাবেই জানতো বাবার টাকাতেই সংসারের সিংহভাগটা চলে। জমিজমা আজও দাদুর নামে। বাবা,কাকারা আজও ওই জমির ব্যাপারে কেউ কোনদিনও মাথা ঘামাননি। যেমন ছিল তেমনই আছে। স্বরূপের বুঝতে একটুও বাকি রইলো না প্রতিবার যখন টাকা আসে মায়ের এক একটা করে গয়না কমতে থাকে। কিন্তু বাবার কথানুযায়ী কোনদিকে না তাকিয়ে ভালোভাবে ডাক্তারি পাশ করতে হবে। এইভাবেই দিন গড়িয়ে মাস, মাস গড়িয়ে বছর চলে যেতে থাকে। তখন স্বরূপের ডাক্তারির ফাইনাল ইয়ার। সেদিন প্রচণ্ড গরম পড়েছিল। তারউপর লোডশেডিং। হোস্টেলের ছোট রুম ছেড়ে তখন সকলেই বাইরে। 
 অন্ধকার আর গরমের মধ্যেও সকলে হৈ হট্টগোলে মেতে উঠেছে। হঠাৎ একটি নারী কন্ঠের আর্তচিৎকারে কিছুক্ষনের জন্য সবাই হকচকিয়ে যায়। কোথা থেকে আওয়াজটা আসছে সেটা বুঝতেই বেশ কয়েক সেকেন্ড চলে যায়। ডাক্তারি পাঠরত ছেলেগুলো তখন গেট খুলে এদিকে ওদিকে তাকিয়ে দেখছে। অসুস্থ অবস্থায় একজন তরুণী পেটের যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। ছেলেগুলো তাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে এসে হাসপাতালে ভর্তি করে।
 ওই তরুণীর কাছ থেকে জানা যায় তার নিজের কেউ নেই। এক বাড়িতে খাওয়াপরায় সে থাকতো ছোট থেকেই। কিন্তু ওই বাড়ির গিন্নি বাড়িতে না থাকায় গৃহকর্তা রাতে তার ঘরে আসে। আগে কোনদিনও এরূপ তিনি করেননি। তাই প্রথম অবস্থায় সে কিংকর্ত্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। গৃহকর্তার সাথে ধস্তাধস্তি করে পালাতে গিয়ে টেবিলের কোণে পেটে প্রচণ্ড ধাক্কা খায়। ওই ব্যথা নিয়েই সে দৌড়াতে থাকে। শেষ পর্যন্ত এইখানে এসে সে আর পারে না। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যায়। 
 তার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। এখন ভিক্ষে করে পথেঘাটে পড়ে থাকা ছাড়া তার আর কোন উপায় নেই। মেডিকেল পাঠরত ছেলেগুলো তখন বড়ই বিপদে পড়ে। কিন্তু কারোরই সাহস হয় না এই বয়সের একটি মেয়েকে তাদের বাবা,মাকে বলে নিজেদের বাড়িতে আশ্রয় দেওয়ার। 
 স্বরূপ প্রফেসরদের সাথে কথা বলে কয়েকটা দিন মেয়েটিকে হাসপাতালেই রাখার ব্যবস্থা করে। মেয়েটিকে জানায় কয়েকদিনের মধ্যে বাড়ি যাবে সে। বাড়ি যাওয়ার সময় তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। মেয়েটিরও আর কোন উপায় ছিল না স্বরূপকে এই মুহূর্তে বিশ্বাস করা ছাড়া। তাই সে উপকারীর উপকার স্বীকার স্বরূপ প্রথম দিন থেকেই স্বরূপকে দাদা বলে ডাকতে থাকে। স্বরূপ যতই তাকে আশ্বাস দিক না কেন তার মনে একটা আশঙ্কা থেকেই যায়। প্রায় সমবয়সী কিংবা বয়সে একটু ছোট এই মেয়েটিকে বাড়িতে নিয়ে গেলে এত বড় পরিবারের সদস্যরা ঠিক কিভাবে নেবেন। বাবা,মায়ের কথা বাদ দিলেও বাদবাকীরা কিছুতেই এটা ভালো চোখে দেখবেন না। কিন্তু তবুও মনে একটা আশা ছিলো যেহেতু তার বাবার উপর অনেকটাই সকলে নির্ভরশীল তাই বাবা মেনে নিলে অন্যদের মনে নানান অভিযোগ থাকলেও কেউ বাবার মুখের উপর কিছু বলতে পারবে না।   
 স্বরূপের এই এক মস্ত দোষ ছেলেবেলা থেকেই। কেউ বিপদে পড়লেই কোনকিছু না ভেবেই তার পাশে দাঁড়িয়ে পড়ে। এক্ষেত্রেও ঠিক তাইই হল। মেয়েটিকে আশ্রয় দিতে যখন অন্যান্য ক্লাসমেটরা রাজি হল না তখন সেই মেয়েটিকে তার সাথে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ায় ঠিক করলো।

ক্রমশ 
 
   
 

No comments:

Post a Comment