মেয়ে জুইয়ের বয়স যখন একবছর, টলমল পায়ে হাঁটছে, আধো আধো স্বরে কথা বলছে ঠিক সেই সময়ে নিলয় একদিন অফিস থেকে জ্বর নিয়ে বাড়ি এলো। পরেরদিন তাকে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ পত্র সহ কিছু টেষ্টও লিখে দিলেন। জ্বর আর না আসায় গাফিলতি করে টেষ্টগুলো আর করলো না সে। বাড়ির সকলে বলেও কিছুই লাভ হল না। আবার অফিস,বাড়ি সেই একইভাবে আনন্দে ফুর্তিতে কাটতে লাগলো সময়। মাস দু'য়েকের মধ্যে দেখা গেলো তার পায়ের পাতা ফুলছে। মাঝেমধ্যে নিজেকে দুর্বল মনেহয়। আবার ডাক্তার আবার টেষ্ট। ধরা পড়লো সুগার। খাওয়াদাওয়া প্রায় বন্ধের মুখেই। নিলয়ের মধ্যে নেই সেই আগের উদ্যমতা,নেই সেই উচ্ছাস। আস্তে আস্তে শারীরিক দিক থেকে সে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে দেখে তিয়াসা অনেক বুঝিয়ে তাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলো। তখন নিলয়ের ক্রিটি নাইনের মাত্রা অনেক বেশি। আকাশ ভেঙ্গে পড়লো পরিবারের সকলের মাথায়। এলোপ্যাথি,হোমিওপ্যাথি এমন কী কবিরাজি কোনোটাই বাদ নেই। নিলয় একদিন রাতে মেয়ে ঘুমিয়ে যাওয়ার পর তিয়াসাকে কাছে ডেকে বললো,
-- এখনো অফিস করছি। কতদিন করতে পারবো জানি না। তুমি এখন থেকেই চেষ্টা করো যদি কোন চাকরি পাও।
তিয়াসা কাঁদতে কাঁদতে নিলয়কে জড়িয়ে ধরে বললো,
-- তোমার কিছুই হবে না। তুমি ঠিক সুস্থ হয়ে যাবে। ভগবান এত নিষ্ঠুর কখনোই আমার প্রতি হবেন না।
নিলয় ঠোঁটের কোণে হাসি এনে বলে,
-- দূর পাগলী! সেতো বিধাতার হাতে। আমরা কেউ কী কিছু বলতে পারি তিনি কখন সুতো ধরে টান দেবেন?
তিয়াসা নিলয়কে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।
ওষুধ চলছে ওষুধের মত। ডাক্তার, বাড়ি আর ওষুধ এই হল এখন নিলয়ের রুটিন। ক্রিটি নাইন বাড়লো লাফিয়ে লাফিয়ে। বন্ধ হল অফিস। শুরু হল ডায়ালিসিস। দিন চলে যাচ্ছে তার মত করে কিন্তু পরিবারটির যেন সময় থমকে গেছে। প্রথমে মাসে ছিলো দু'টো ডায়ালিসিস এখন সেটা মাসে চারটে হয়েছে। ডায়ালিসিস করে আসার পর তিনদিন একটু কথাবার্তা, হাঁটাচলা করতে পারে। তারপরেই সে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। তিয়াসা বাড়ির সকলের সাথে কথা বলে কিডনি প্রতিস্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু টাকার দরকার অনেক। গয়নাগাটি, যা জমানো টাকা আছে সব নিঃস্ব করেও পুরো টাকা যোগাড় হবে না। তবুও পেপারে অ্যাড দেয়।
টাকার চিন্তায় যখন সকলে অস্থির তখনই মনে পড়ে সৌম্যর কথা। সৌম্যর কাছে হাত পাততে নিজেকে খুব ছোট মনেহয় নিজের কাছেই। কিন্তু সমস্ত দ্বিধা কাটিয়ে সে হন্যে হয়ে ব্যাগের ভিতর তার কার্ডটা খুঁজতে থাকে। নিলয় দেখতে পেয়ে জানতে চায়
-- কী খুঁজছো সেই থেকে তুমি পাগলের মত?
-- একটা কার্ড। আমার এক বন্ধু যখন আমরা গ্যাংটক যাই তখন দিয়েছিলো।
-- সে তো কবের কথা। তা কি আর খুঁজে পাবে? কী করবে তুমি তা দিয়ে?
-- যদি খুঁজে পাই তখন বলবো।
তবুও তন্নতন্ন করে তাদের যতগুলো ব্যাগ আছে সে খুঁজে চলে। একসময় দুমড়ানো মুচড়ানো সৌম্যর কার্ডটা সে খুঁজেও পায়। কিন্তু সে নিলয়ের কাছে ব্যাপারটা গোপন করে যায়। দু'দিন পর ছিলো নিলয়ের ডায়ালিসিস। তিয়াসা প্রতিবারের মত নিলয়কে নিয়ে নার্সিংহোমে যায়। ভিতরে যখন নিলয়ের ডায়ালিসিস চলছে বাইরে তিয়াসা একবুক আশা নিয়ে সৌম্যকে ফোন করে।
সমস্ত ঘটনা সে সৌম্যকে ফোনে জানায়। সৌম্য সব শুনে স্তব্ধ হয়ে যায়। নিরুপায় হয়ে তিয়াসা যে তাকে ফোন করেছে সেটা সে বুঝতে পারে। কিন্তু তার কাছে তিয়াসার এই স্বার্থপরতার থেকেও বেশি হয়ে ওঠে তিয়াসার স্বামীকে সুস্থ্য করে তার ভালোবাসার কাছে ফিরিয়ে দেওয়া। জানতে চায় কোন নার্সিংহোমে আছে আর কতক্ষণ আছে।
চলে আসে কিছুক্ষণের মধ্যে। সৌম্যকে দেখেই হাউমাউ করে কেঁদে ভাসিয়ে দেয় তিয়াসা। সৌম্য চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে একদৃষ্টে তিয়াসার দিকে তাকিয়ে থেকে মনেমনে ভাবে - 'এখানে তিয়াসার তো কোন দোষ নেই। সে তার ভালোবাসাকে বাঁচানোর জন্য শেষ লড়াইটা লড়ছে। সেও তো তিয়াসাকে ভালোবেসে তার জীবনের সমস্ত সুখ,শান্তি,আনন্দ,ফুর্তি থেকে দূরে আছে। আর তাছাড়া সে তো কোনদিন তিয়াসাকে তার ভালোবাসার কথা মুখ ফুটে জানায়নি। এখানে তিয়াসা আর সে - দুজনেই ভালোবাসার কাছে অসহায়!'
সৌম্য কথা দেয় ডোনার পেলে সে তার সাথে কথা বলবে এবং সব দায়িত্ব নেবে। নিজেকে স্বার্থপর মনে হলেও এই ছাড়া তার আর কোন পথও খোলা নেই তিয়াসার। সেদিনই সে নিলয়ের সাথে তাকে ক্লাসমেট বলে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলে,
-- এই নার্সিংহোমেই হঠাৎ করেই তার সাথে দেখা হয়ে গেছে।
ওদের মধ্যে অনেকক্ষণ কথা হয়। সৌম্য নিজেই ড্রাইভ করে ওদের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসে। নিলয় এবং তিয়াসা তাকে বারবার অনুরোধ করা স্বর্তেও সৌম্য সেদিন জরুরী কাজ আছে কিন্তু পরে আসবে বলে বেরিয়ে যায়।
ক্রমশ
No comments:
Post a Comment