একদিন ভালোবাসবে (৫৮ পর্ব)
নিলয় ওদের দেখে ঠোঁটের কোণে হাসি এনে বললো,
-- তোর বিয়েতে খুব যাওয়ার ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু শরীরে দিলো না রে
-- আমার বউয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিই
অসিত ওদের পরস্পরের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো।
শ্রাবণী প্রথম অবস্থায় নিলয়কে চিনতেই পারেনি ওর শারীরিক কন্ডিশন দেখে। কিন্তু পরমুহুর্তে নিলয়কে চিনতে পেরেই চোখ ভর্তি জল নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। ঠিক তখনই অসিতের ফোনটা বেজে ওঠায় অসিত 'একটু আসছি' - বলে বেরিয়ে যায়। শ্রাবণী নিলয়ের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
-- এমনভাবে তোমায় দেখবো কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি। এ কী হয়ে গেলো সবকিছু? কেন হল? এর থেকে জীবনে আর তোমার সাথে দেখা না হলেই ভালো হতো।
-- আমি কিন্তু অনেকদিন আগেই তোমার খোঁজ পেয়েছিলাম। কিন্তু তখন তুমি অসিতের স্ত্রী। অসিত ভীষণ ভালো ছেলে।
শ্রাবণী কেঁদেই চলে। নিলয় তাকে বলে,
--- ঈশ্বর যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন। সেই রাতের ঘটনার পর আমি তোমায় অনেক খুঁজেছি। কিন্তু -- ।ওই যে বললাম ঈশ্বর যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন। তোমার বাবা,মা এখন কেমন আছেন?
শ্রাবণী কাঁদতে কাঁদতেই বললো,
-- সে অনেক ঘটনা। তারা আজ আর কেউ বেঁচে নেই। এই পৃথিবীতে আমার নিজের লোক বলতে আছে অসিত আর অসিতের পরিবার।
নিলয়ের ঠোঁটের কোণায় মৃদু হাসি দেখা যায়।
-- নিজেকে সামলে নাও শ্রাবণী। এক্ষুণি অসিত এসে যাবে। আর শোনো তুমি এখানে আর এসো না। তাতে তোমার কষ্ট বাড়বে বৈ কমবে না। বর্তমানকে যেমন অস্বীকার করা যায় না, অতীতকেও ভুলে যাওয়া যায় না। তবুও বলবো আমার জীবনের এই শেষ বেলার আমাদের দেখা হওয়ার কথা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা কোরো।
নিলয়ের কথা শেষ হতে হতেই অসিত এসে ঢোকে,
-- আমার বউয়ের সাথে কথা হল?
-- ওই আর কী? হানিমুনে কোথায় গেলি?
-- আর কোথায়? ম্যাডাম তো সরকারি চাকরি করেন। উনার ছুটি ম্যানেজ না হওয়াতে বাঙ্গালীর কম টাকায় যেখানে হানিমুন হয় - পুরী।
দুই বন্ধু হেসে ওঠে। শ্রাবণী 'আসছি' - বলে বেরিয়ে যায়। একটু পরে তিয়াসা ভিতরে আসে। অসিতও বেরিয়ে আসে।
শ্রাবণী খুবই মনমরা হয়ে থাকে। অসিত বুঝতে পারে এমন একটা তরতাজা যুবকের এই পরিণতি স্বাভাবিক ভাবেই শ্রাবণী মেনে নিতে পারছে না। তাই ওর মন খারাপ। এটাকে স্বাভাবিক ঘটনা বলেই অসিত নানান কথা বলে শ্রাবণীকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে।
এদিকে ডাক্তাদের বোর্ড বসেও নিলয়ের সমস্যার সমাধান করতে পারে না। কখনো তাঁরা বলেন, হেপাটাইটিস বি, কখনো সারা শরীরে ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়েছে আবার কখনো বলতে থাকেন সেপ্রসিমিয়া। তাঁরাও ঠিক ভাবে রোগ নির্ণয় করতে ব্যর্থ হন। তিয়াসার চারিপাশ অন্ধকার হতে থাকে। সৌম্য পাজেল্ড হয়ে পড়ে। দিনকে দিন নিলয়ের অবস্থার অবনতি হতে থাকে। এদিকে নার্সিংহোমের বিল হুহু করে বেড়ে চলেছে। নিলয় নিজেই এবার সৌম্যকে বলে,
-- ভাই, বন্ধু হয়ে বন্ধুর জন্য অনেক করেছো। আর টাকা খরচ করে কোন লাভ নেই। রোগ যেখানে ডাক্তারের অধরা সেখানে বাঁচার আশা আর নেই। পরজনম বলে যদি কিছু থাকে আমরা যেন একই মায়ের গর্ভে আসি।
-- উল্টোপাল্টা কথা বোলো না নিলয়। তিয়াসা শুনলে খুব কষ্ট পাবে।
-- ইন্টেলিজেন্ট মেয়ে ও। তিয়া বুঝেই গেছে আমি আর বাঁচবো না। ও ঠিক নিজেকে সামলে নেবে। আর তুমি তো রইলে ওদের মাথার উপরে। আমার জুই যাতে মানুষ হয় দেখো। খুব অল্প সময় নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিলাম। কিন্তু ঈশ্বর আমাকে এই সময়টুকুতেই দু'হাত ভরে দিয়েছেন।
-- চুপ করো নিলয়। আমার এসব শুনতে একদম ভালো লাগছে না। এত কেন ভাবছো? আমি আছি তো। আমি তোমায় নিয়ে চেন্নাই যাবো। আমি কালই ডাক্তারের সাথে কথা বলবো।
-- পৃথিবীর যে প্রান্তেই আমায় নিয়ে যাও না কেন আমার রোগ কেউ সারাতে আর পারবে না। আমার সময় শেষ।
-- আজ তুমি বড্ড বেশি কথা বলছো। দাঁড়াও আমি গিয়ে তিয়াসাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
-- না,না বসো। ঠিক আছে আর এসব বলবো না। তবে আর একটা কথা না বলে পারছি না। আমি চলে গেলে ওদের তুমি দেখো।
--- উফফ সেই একই কথা! আমি বেরোচ্ছি।
সৌম্য বেরিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে তিয়াসা এসে ঢোকে। সে এতক্ষণ বাইরে বসে নীরবে কেঁদে চলেছিল। তাকে দেখেই নিলয় বলে,
-- মেয়েটাকে কালকে একবার নিয়ে এসো।অনেকদিন দেখি না। বড্ড দেখতে ইচ্ছা করছে।
-- কিন্তু কাল তো ওকে ঢুকতে দেবে না। কাল তো শনিবার। পরশু নিয়ে আসবো। রবিবার ছাড়া তো বাচ্চাদের অ্যালাও করে না।
নিলয় মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।
-- আমায় একটু জল দেবে? বড্ড তেষ্টা পেয়েছে।
নিলয়ের কথা শুনে তিয়াসা উঠে গিয়ে বোতল থেকে গ্লাসে জল ভরে ওকে খাইয়ে দেয়। হঠাৎ তিয়াসার হাতটা ধরে বলে,
-- আজ তোমাকে আমার একদম ছাড়তে ইচ্ছা করছে না।
তিয়াসা কান্নায় ভেঙে পড়ে। নিলয় তাকে দু'হাতে হালকা জড়িয়ে ধরে বলে,
-- আমার কিছু হয়ে গেলে তুমি এভাবে কাঁদবে না। মাকে,মেয়েকে তো তোমাকেই সামলাতে হবে।
তিয়াসা হাত দিয়ে নিলয়ের মুখটা চেপে ধরে বলে,
--- এসব অলুক্ষুনে কথা একদম বলবে না। তুমি ঠিক ভালো হয়ে যাবে। সৌম্য বলেছে ও তোমায় নিয়ে চেন্নাই যাবে।
-- ভাগ্য করে একটা বন্ধু পেয়েছিলে।
কথাটা বলে মৃদু হাসে নিলয়। ইতিমধ্যে ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়ে যাওয়ায় তাকে বেরিয়ে আসতে হয়।নিলয় একদৃষ্টে তিয়াসার গমন পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চোখ থেকে অবিরল ধারায় জল পড়তে থাকে
ক্রমশ -
No comments:
Post a Comment