গ্যাংটক থেকে ঘুরে আসার পরের মাসেই তিয়াসা বুঝতে পারে সে প্রেগন্যান্ট। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি বাচ্চা নিতে সে চায়নি। নিলয়কে জানালে সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে। দু'বাড়ির সকলেই খুশি। সুতরাং তিয়াসা তার মনের কথাটা কাউকেই বলতে পারে না। যদিও পরে সে ভেবে দেখে প্রথম সন্তান নষ্ট করলে পরে যদি তার আর সন্তান না হয়। তাই সে পরবর্তীতে খুশি মনেই সবকিছু মেনে নেয়। প্রথম থেকে শেষ অবধি প্রেগনেন্সির ফলে তার কোনোই শারীরিক সমস্যা দেখা দেয় না।
এ সময় মেয়েরা টানা কয়েকমাস বাপের বাড়িতে থাকলেও তিয়াসা তার মাকে জানিয়ে দেয় তার শ্বশুরবাড়িতে যত্নআত্তির কোন কমতি নেই। সুতরাং সে এখানেই থাকবে। চাকরি করার চিন্তা তখন মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে। নিলয় বাড়িতে থাকলেই হাঁটতে,চলতে বসতে সব সময় তার নজরদারী। খাওয়ানোর ঘটা বাড়ির সকলের এতটাই এখন খাবার দেখলেই তার আতঙ্ক। মাঝে মাঝে নিজেকে পৃথিবীর সব চেয়ে সুখী মানুষ মনেহয়। আবার কখনো নিজের অজান্তেই একটা অজানা আশঙ্কায় বুকের ভিতর কেঁপে কেঁপে ওঠে। এত সুখ সত্যিই কী তার কপালে সইবে?
শ্বশুরবাড়ির নিয়ম অনুযায়ী তার দু'বার সাধ হয়। একবার সাত মাসে আর একবার ন'মাসে। সাত মাসের সাধে সেরূপ আয়োজন না থাকলেও ন'মাসে বেশ কিছু মহিলাদের নিমন্ত্রণ করা হয়। তিয়াসার বাপেরবাড়ির লোকজন বলতে তো তিনজন। তারমধ্যে ওর বাবা কিছুতেই আসেন না। প্রথমত মেয়ের সাধ তার উপর এটা মহিলাদের অনুষ্ঠান। তাকে তিয়াসাও ফোন করে রাজি করাতে পারেনি। মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে এসে তিয়াসার মা তন্দ্রা মেয়ের সুখ দেখে ভীষণ খুশি। এর আগে তিনি এই তিন বছরে তিনবার এসেছেন পুজোর সময় নতুন জামা কাপড় দিতে সামান্য সময়ের জন্য। কিন্তু এবার তিনি সাধের আগেরদিন এসে দু'রাত থেকে তারপর গেছেন অদ্ভুত এক মানসিক তৃপ্তি নিয়ে।
সাধের পরেই শ্বাশুড়ি নীলিমা বলে দিলেন,
-- শোনো বৌমা এখন থেকে তুমি আর উপর নিচ করবে না। নিলয় বাড়িতে থাকলে সে তোমার খাবার উপরে দিয়ে আসবে আর ও যখন অফিস বা বাইরে থাকবে আমরা তোমার খাবার উপরে দিয়ে আসবো।
-- আমি খুব আস্তে আস্তে নামবো মা। আপনারও তো বয়স হয়েছে। এখন তো সংসারের কোন কাজই করি না । খেতে অন্তত নিচুতে একটু নামি।
-- না না আর তো মাত্র কয়েকদিন। এ কটাদিন লক্ষী মেয়ের মত আমার কথা শোনো মা।
তিয়াসা আর কোন কথা বলে না। কারণ সে জানে এই কথাটাই তার শ্বশুর এবং নিলয়েরও কথা হবে।
সাধ খাওয়ার ঠিক পনেরোদিনের মাথায় ডাক্তার দেখাতে গেলে তিয়াসাকে নার্সিংহোম ভর্তি করে নেয়। সারাটা রাত নিলয় হাসপাতাল জেগে কাটিয়ে দেয়। পিয়া এবং তার বাবা,মা অনেক রাতে নিলয়ের পীড়াপীড়িতে বাড়ি ফিরে যান। ভোর রাতে নর্মাল ডেলিভারী হয়। একটা সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে নিলয় গিয়ে দেখেও আসে। ভোরে সে বাড়ি চলে যাওয়ার পর কিছুক্ষণের মধ্যেই হাসপাতাল থেকে ফোন আসে তিয়াসার অবস্থা মোটেই ভালো নয়।
ডেলিভারীর ঠিক ঘণ্টা দু'য়েকের মধ্যে তিয়াসার যে চারটে সেলাই পড়েছিল ব্লাড প্রেসার বেড়ে যাওয়ার ফলে ভিতর থেকে চাপ এসে সেই সেলাই ছিঁড়ে গিয়ে প্রচণ্ড ভাবে ব্লিডিং হতে শুরু করেছে। নানানভাবে ডাক্তার ব্লিডিং বন্ধ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যেতে থাকেন। তিয়াসার সম্পূর্ণ জ্ঞানে ডাক্তার রোলার ব্যান্ডেজ আঙ্গুলের সাহায্যে ভিতরে প্রবেশ করিয়ে প্রথম অবস্থায় ব্লিডিং বন্ধ করার বৃথা চেষ্টা করেন। কিন্তু কোনোই লাভ হয় না। সেই সময় ওটিতে আরও দু'জন সিনিয়র ডাক্তারকে ডাকা হয়।এই কষ্ট তিয়াসা আর নিতে পারছিলো না।সে ডাক্তারের হাত চেপে ধরে বলে,
-- ডাক্তারবাবু আমি আর সহ্য করতে পারছি না। আপনি আমাকে অজ্ঞান করে যা করার করুন।
সেই মুহূর্তে তখনো নিলয়ও এসে পৌঁছায়নি। তারা তিয়াসাকে ওটিতে নিয়ে যান। নিলয় এসে পৌঁছালে বন্ডে সই করিয়ে তিয়াসার অপারেশন শুরু হয়। ডাক্তারদের পরিভাষায় তিয়াসার হিমাটোমা অর্থাৎ একটা বড় মাংসপিন্ড এইভাবে ব্লিডিং হওয়ার ফলে ভিতরে সৃষ্টি হয়েছে। অপারেশন করে ওই মাংসপিণ্ডটা বাদ দেওয়া হয়। কিন্তু ডাক্তার নিলয়কে জানিয়ে দেন যেহেতু ব্লাড প্রেসার হাই তাই যে কোন মুহুর্তে বিপদের সম্ভাবনা হয়েছে। নিলয় প্রচণ্ড ভেঙ্গে পড়ে। দীপ্ত ছাড়া তেমন কোন বন্ধু তার নেই। কিন্তু সেই দীপ্তও তো এখন বাইরের দেশে।
অনেক ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে বাইশ দিন পরে তিয়াসা তার ফুটফুটে মেয়ে নিয়ে বাড়িতে আসে। বাড়িতে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। পিয়া দিদিকে আনতে হাসপাতাল গেছিলো। দিন সাতেক ছুটি নিয়েছিলো নিলয়। ছুটি ফুরিয়ে যেতেই সে অফিস জয়েন করে। বেশ আনন্দেই তাদের দিনগুলি কাটছিলো। হয়ত তাদের এই আনন্দ দেখে বিধাতা পুরুষ অলক্ষ্যে হেসেছিলেন। তিয়াসার জীবনে এই সুখ তিনি বেশি দিন লিখেছিলেন না। তাই মাঝে মাঝে হয়ত তারই ইচ্ছাতে তিয়াসার অজান্তেই তার বুকের ভিতর কেঁপে উঠতো। সুখ তো ক্ষণস্থায়ী! তাই বলে যে একবার সুখের মুখ দেখেছে তার কাছ থেকে সেই সুখ চলে যাওয়া মানেই তো তাকে অতল গহ্বরে ধাক্কা দেওয়া। তিয়াসা নিলয়কে জীবন সঙ্গী হিসাবে পেয়ে নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে করতো। কিন্তু সে স্বপ্নেও ভাবেনি ভবিষ্যতে তারজন্য কী অপেক্ষা করছে।
ক্রমশ
No comments:
Post a Comment