সুজয় সেদিন চলে আসতে বাধ্য হয়। কিন্তু সেটা ছিল ওর কাছে সাময়িক। স্বার্থপরের মত হলেও সে মনেপ্রাণে চাইছে মেয়েকে ওর কাছে এনে মানুষ করতে। আর এটা করতে যদি প্রয়োজন হয় সে দীপিকার পা ধরতেও রাজি আছে। সুজয় বিশ্বাস করে যে অন্যায় সে দীপিকার প্রতি করেছে তার কোন ক্ষমা হয় না। এখানে আসার পর দীপিকার সাথে যে ওর দু'বার দেখা হয়েছে দু'বারই দীপিকা ওর সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করেছে। কিন্তু সুজয় জানে যে ব্যবহার দীপিকার সাথে সে করেছে তার তুলনায় দীপিকার এই খারাপ ব্যবহার নস্যি। তাই দীপিকার সাথে কথা বলার সময় সুজয় সবসময় অপরাধীর যেমন থাকা উচিত ঠিক সেইরকমই থেকেছে।
সুজয় বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে দীপিকা তার ঘরে ঢুকে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। তার চোখ থেকে সমানে জল গড়িয়ে পড়তে থাকে। আজ যে অন্ধকারটা মধ্যে সে বসে আছে একসময় ঠিক এইরকই তার জীবনে অন্ধকার ধেয়ে এসেছিলো। কিন্তু ভগবান তার কপালে সবকিছু খারাপ হয়ত লিখেছিলেন না। আর সেই কারণেই হয়ত ঈশ্বর সৌম্যকে তার কাছে দূত হিসাবে পাঠিয়েছিলেন। সেদিন যদি অত রাতে সৌম্যর সাথে দেখা না হত তাহলে হয়ত নরখাদকেরা তার দেহটাকে ছিঁড়ে খেত। তার জীবনে শুধু সৌম্য কেন তাদের পরিবারের আর দু'জনের ভূমিকাও অস্বীকার করা যায় না। বিশেষত সৌম্যর মা। যে কটাদিন সে সৌম্যদের বাড়িতে ছিল সৌম্যর মায়ের ব্যবহারে কখনোই মনে হয়নি যে সে তার নিজের মেয়ে নয়। এখানে আসার পরও যতদিন তিনি বেঁচে ছিলেন প্রায় নিয়মিত ফোন করে খবর নিয়েছেন। একবার সৌম্যর বাবাকে নিয়ে এখানে এসে থেকেও গেছেন। আলাদা করে মেয়ের জন্য কত জিনিস নিয়ে এসেছিলেন। যাওয়ার আগে সৌম্যর বাবাকে না জানিয়ে হাতে মোটা অঙ্কের টাকাও গুজে দিয়ে গেছিলেন। অন্ধকারের মধ্যে বসে অতীতের অনেক কথা তার মনে পড়তে লাগে। বাবা,মায়ের জন্য মন কেঁদে ওঠে মাঝে মাঝেই। কিন্তু অসহায়ের মত শুধু কেঁদেই চলে তখন। বাড়ি ছেড়ে আসার পরে ভয়ে তাদের সাথে আর যোগাযোগ রাখতে পারেনি। অনেকবার ভেবেছে ফোন করবে কিন্তু কী জানি এক অজানা আশঙ্কায় আর ফোন করে ওঠা সম্ভব হয়নি। সে নিজেকে কঠোরভাবে তৈরি করে নেয় কোন অবস্থাতেই সুজয়কে দেখে সে দুর্বল হবে না। কেন জানি তার মনেহয় সুজয় এতদিন পরে তাকে দেখে তার মেয়ের জন্যই এই বাসস্থান পর্যন্ত ধাওয়া করেছে। কথাটা মনে হতেই তার বুকের ভিতর ছ্যাৎ করে ওঠে। আর ঠিক তখনই শ্রেষ্ঠা তার মায়ের ঘরে ঢুকে আলোটা জ্বালিয়ে দেয়। মায়ের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে,
-- তুমি এই অন্ধকারে বসে আছো কেন?
দীপিকা হঠাৎ তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
-- তুই আমাকে ছেড়ে কোনদিন কোথাও যাবি না। আমি তোকে ছাড়া বাঁচবো না। তুই ছাড়া এই পৃথিবীতে আমার আর কেউ নেই রে!
হঠাৎ মায়ের মুখে এই কথা শুনে আর তার কান্না দেখে কিছুটা ভ্যবাচ্যাকা খেয়ে বললো,
-- কী সব বলছো মা? আমি তোমায় ছেড়ে কেন কোথাও যাবো? তুমি আজ এত কাঁদছো কেন? আমার খিদে পেয়েছে তো।
দীপিকা চোখ মুছে মেয়ের কপালে একটা চুম্বন করে বলে,
-- চল তোকে খেতে দিই।
ঠিক তার পরের দিন দুপুর বারোটা নাগাদ সুজয় আবার আসে। সুজয়কে দেখতে পেয়ে দীপিকা তার মেয়েকে বলে,
-- মামনি তুমি ও ঘরে যাও।
শ্রেষ্ঠা চলে যেতে উদ্যত হলে সুজয় তাকে ডাক দেয়
-- মামনি একটু শোনো। তোমার জন্য কিছু ফল এনেছি। এগুলো নিয়ে যাও।
শ্রেষ্ঠা তার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে পড়লে দীপিকা বলে,
-- তুমি ও ঘরে চলে যাও আঙ্কেলের কাছ থেকে আমি এগুলো নিয়ে নেবো।
দীপিকা কথাটা বলেই হাত এগিয়ে দেয় সুজয়ের দিকে। আর শ্রেষ্ঠা সেখান থেকে দৌড়ে চলে যায়। সে বুঝতে পারে মা যখন তাকে এই অঙ্কেলটার কাছ থেকে চলে যেতে বলছে নিশ্চয় আঙ্কেলটা ভীষণ দুষ্টু। কারণ মা তাকে অনেক আগেই এসব শিখিয়ে রেখেছে। কোন অপরিচিত মানুষ আসলে সে যেন সেই সময় সেই মানুষটির সামনে না থাকে। কারণ দীপিকা এখানে এই পাহাড়িয়া অঞ্চলে এসে একটা কথা পরিস্কার বুঝেছে এখনকার মানুষজনগুলি এমনিতে খুবই ভালো কিন্তু তাদের আতে বিন্দুমাত্র আঘাত লাগলে তারা হিংস্র হয়ে উঠতে এক মুহুর্ত ভাবে না। তাই অনেক সময় অনেককিছুই মুখ না খুলে চোখের ইশারায় বুঝে নিতে হয়। মেয়েকেও ঠিক সেই একই ভাবে শিক্ষা দিয়েছে। তাই সে মায়ের কথা শুনেই সুজয়ের সামনে থেকে দৌড়ে ভিতরে ঢুকে যায়।
সুজয়কে এবার সরাসরি দীপিকা প্রশ্ন করে
-- রোজ রোজ এখানে কী জন্য আসছো বলো তো ? এখানে তুমি কি একাই এসেছো?
সুজয় কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
-- না আমার স্ত্রীও এসেছে।
কথাটা শুনেই দীপিকার বুকটা কেঁপে উঠলো। কিন্তু এমন তাতো হওয়া উচিত হয়নি। সুজয় বিয়ে করেছে,সে তার বউ নিয়ে এখানে ঘুরতে এসেছে এটা জেনে দীপিকার বুকের ভিতর কেন তোলপাল করছে। সুজয়ের প্রতি তো এখন কোন ভালোবাসা তো দূরহস্ত সামান্যতম সহানুভূতিও তো দীপিকার মনে নেই। তবে কেন সুজয় তার বউ নিয়ে এখানে ঘুরতে এসেছে শুনে ওর মনটা ছটফট করছে।
ক্রমশ
No comments:
Post a Comment