Sunday, January 31, 2021

অন্ধ ভালোবাসা

অন্ধ ভালোবাসা

  মাত্র পাঁচ বছর বয়সে দশ বছরের চাচাতো ভাই ফারুকের সাথে নার্গিসের বিয়ে হয়। ছোটবেলার থেকেই নার্গিস ছিল অসম্ভব সুন্দর দেখতে।নার্গিস ও ফারুক এর মধ্যে বন্ধুত্ব দেখে দুজনেরই বাবা-মা এই সিদ্ধান্ত নেন।আস্তে আস্তে তারা বড় হতে থাকে আর বন্ধুত্ব ভালবাসায় পরিনত হতে থাকে। নার্গিসের বয়স যখন চৌদ্দ বছর তখন তার দাদুর মৃত্যু হলে শুরু হয় নার্গিসের বাবা আর ফারুকের বাবার মধ্যে সম্পত্তিগত বিবাদ। এই বিবাদ এমন পর্যায়ে পৌঁছায় দুই ভাইয়ের মধ্যে মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়।বাড়ির ভিতরে বাঁশের বেড়া দিয়ে দেওয়া হয়।উভয়ের বাবা-মা নিজেদের ছেলেমেয়েদের কে নিষেধ করে দেন কেউ কারো সাথে যেন কথা না বলে।দুটি কিশোর-কিশোরী যারা ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছে তাদের বিয়ে হয়ে গেছে;তারা তাদের সদ্য ফোটা প্রেমের কুড়িকে মেরে ফেলতে পারল না। শুরু হলো বাইরে দেখাশোনা,মেলামেশা।
    এভাবেই কেটে গেল বেশ কয়েক বছর।স্কুল-কলেজ জীবন শেষ করে উভয়েই চেষ্টা করতে লাগলো চাকরির। নার্গিসের বিয়ের জন্য বাড়ির লোক উঠেপড়ে লাগলো। নার্গিস কিন্তু নিশ্চুপ।হঠাৎ করেই নার্গিস স্কুলে চাকরি পেয়ে যায়।আর তখন সে রুখে দাঁড়ায় তার বিয়ের বিরুদ্ধে। শুরু হয় বাড়িতে প্রচন্ড ঝামেলা।সে গোপনে ফারুকের সাথে দেখা করে ঠিক করে পালিয়ে যাবে।
  একদিন স্কুলে গিয়ে নার্গিস আর বাড়ি ফিরে আসেনা।সে ফারুকের সাথে সংসার পাতে। বিয়েটা তাদের ছেলেবেলায় হয়ে গেছিল মুরুব্বিদের সামনে।সুতরাং সংসার করতে বাধা কোথায়? ফারুক ও ছোটখাটো একটা কোম্পানিতে কাজ জুটিয়ে নেয়।ঘর ভাড়া দিয়ে সংসার চালনা করা দুজনের আয়ে তাদের বেশ ভালোই চলে যায়।তাদের দিনগুলি সুখে-আনন্দে বেশ কাটছিল।কিন্তু 'ভাগ্যের লিখন না যায় খন্ডন' বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত ফারুক হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে।তার ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়ে।রোগ ধরা পড়ার ছয় মাসের মত ফারুক বেঁচে ছিল।ব্যয়বহুল এই চিকিৎসা বেশিদিন চালিয়ে যেতে পারেনা নার্গিস।সুতরাং অকালেই ঝরে যায় ভালবাসার পাঁপড়ি।শুরু হয় নার্গিসের জীবন সংগ্রাম।নিজেদের ইচ্ছামত যারা তাদের বিয়ে দিয়েছিল আর তাদেরই ইচ্ছামত যারা তাদের এক হওয়ার পথে বাঁধা দিয়েছিল সেই বাড়িতে সে কিছুতেই ফিরবে না।ছেলেবেলা থেকেই খুব সুন্দর সে কথা আগেই বলেছি।অসম্ভব বুদ্ধিমতীও ছিল সে।তার এই একলা চলার জীবনে বলতে গেলে প্রায় প্রতি মুহূর্তেই কামার্ত পুরুষের নজরে পড়েছে আর ঠিক সেই কারণেই  বিপদ তার পিছু ছাড়েনি।কিন্তু সে তার স্বভাবগত বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েই সমস্ত বিপদ থেকে মুক্ত হয়েছে।ছেলেবেলা থেকে ফারুককে ভালোবেসে তার  ভালোবাসার ছোঁয়া পেয়ে,সম্পূর্ণভাবে কাছাকাছি হয়ে তার জায়গায় অন্য কাউকেই সে কল্পনাও করতে পারে না। আড়াই 'বছরের মধ্যেই তাঁর জীবনের সব রং মুছে যায়।ফারুকের সাথে সংসার পাতার শেষ ছমাস তো  ফারুক অসুস্থই ছিল। ফারুকের জায়গায় নার্গিস স্বপ্নেও ভাবতে পারেনা অন্য কোনো পুরুষকে।তাই সে একাকী নিঃসঙ্গ জীবনই বেছে নেয়।
  ফারুককে হারানোর বেশ কয়েক বছর পরেই সে একটি শিশুকন্যা দত্তক নেয় আইনের সমস্ত জটিলতা কাটিয়ে। প্রথম অবস্থায় খুব একটা সহজে এ কাজটা হয়নি।তার জন্য তাকে অনেক দৌড়াদৌড়ি ছুটাছুটি করতে হয়েছে।মেয়েকে দেখাশোনা করার জন্য সে সর্বক্ষণের জন্য একজন আয়া রেখেছে প্রথম থেকেই।সে ভোর সাড়ে ছটায় স্কুলে বেরিয়ে সাড়ে এগারোটার মধ্যেই বাড়ি ফিরে আসে। আয়া সর্বক্ষণ থাকলেও বাড়িতে ফিরে আসার পর সে তার মেয়ের যাবতীয় কাজকর্ম নিজের হাতেই করে।
  আস্তে আস্তে ঘড়ির কাঁটার টিকটিক আওয়াজে সাথে সাথে নার্গিসের মেয়ে পপির সাথে তার জীবনের দিন,মাস,বছর গুলি এগিয়ে যেতে থাকে।অসম্ভব মেধাবী মেয়ে পপি। সরকারি খরচে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেয়ে যায় সে।মা অন্তপ্রাণ!মায়ের অনুমতি ছাড়া কোন কাজই সে করতেই যেন পারে না।
 নার্গিস তার শিক্ষাকতা জীবন থেকে অবসর নিয়েছে এখন। একা থাকলেই একাকীত্ব তাকে ঘিরে ধরে।চোখে হারায় সে তার মেয়েকে।তাই পপি যখন ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেয়ে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হয় তখন নার্গিস তার ভাড়া বাড়ি ছেড়ে দিয়ে মেয়ের সাথে মেয়ের কলেজ যাওয়ার সুবিধা হয় এমন জায়গায় বাসা ভাড়া করে মা,মেয়ে তাদের নতুন সংসার গুছিয়ে নেয়।কলকাতা শহরের এই নতুন পরিবেশে নিজেদের মানিয়ে নেওয়ার সংগ্রাম শুরু করে।
 সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি বদ্ধ ঘরের ভিতরে নার্গিসের একাকীত্ব যেন চারিপাশ থেকে তাকে গ্রাস করতে থাকে।ঠিক সন্ধ্যায় পপি যখন ফিরে আসে তখন তাকে সামনে দেখে নার্গিসের মুখে সারা দিনের জমানো কথা এক এক করে খই ফোটার মত বের হতে থাকে।সে যেন তখন পপির মেয়ে হয়ে ওঠে আর পপি তার মা।
 এইভাবে আরও বেশ কয়েকটা বছর কেটে যায়। পপি ওরফে পারভিন আক্তার একজন নামকরা ডক্টর এখন। সরকারি হাসপাতাল পোস্টিং।দিনরাত কখন যে তাকে ছুটে যেতে হয় তা সে নিজেও জানে না।এ নিয়ে অনেক মান অভিমান মা-মেয়ের মধ্যে চলে। বেশ কয়েকটা দিন ধরে পপি একজন রোগীকে নিয়ে নাকানি-চুবানি খাচ্ছে।তিনি এক্সিডেন্ট করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।নিজের নামটা  আর গ্রামের নাম নামটাই শুধু বলছে বলতে পারছেন।আর কিছুই তিনি মনে করতে পারছেন না। তিনি এখন সুস্থ হওয়ার পথে।নিয়ম অনুযায়ী সরকারি হাসপাতালে সুস্থ হয়ে গেলে সরকারি বেড দখল করে থাকা যায় না।পুলিশকে জানানো হয়েছে তারাও শুধুমাত্র ওই গ্রামের নাম শুনে কিছুই আন্দাজ করতে পারছেন না।কিন্তু চেষ্টারও ত্রুটি তারা করছেন না।এই ঘটনাটা বাড়ি ফিরে পপি আজ মায়ের কাছে করে। মা তার কাছে জানতে চান,
--- কি নাম ভদ্রলোকের?
---সহিদুল ইসলাম,বাড়ি খাদদুয়ার ।
নার্গিস পপিকে বলে,
--উনি আমার বাবা । তুই ওনাকে এখানেই নিয়ে আসিস। বাকি সব কথা তোকে আমি পরে বলবো।
  পপি স্মৃতিভ্রংশ দাদা সাহেবকে নিয়ে একদিন বাড়িতে আসে। কারও সাথে খুব একটা কথা বলেন না সকলের চোখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন।নার্গিস অনেক চেষ্টা করে যাতে তাকে সে চিনতে পারেন।কিন্তু শহিদুল সাহেব কিছুই মনে করতে পারেন না।নার্গিস দিনরাত তার সেবাযত্ন করতে থাকেন।তার একটু আধটু কথা যা সবই পপির সাথে।
  পপি একদিন হাসপাতালে,নার্গিস ঘরের কাজে ব্যস্ত।এই সময়ে সহিদুল সাহেব দরজা খোলা পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যান।অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে পাওয়া যায় না।।পপি সারাটাদিন গাড়ি নিয়ে পুরো কলকাতা শহর চষে বেড়ায়। রাত তখন দশটা হবে। পপি গাড়ি নিয়ে তার দাদা সাহেবকে  খুঁজে বেড়াচ্ছে।হঠাৎ সে একটি জটলা দেখে গাড়ি রেখে সেদিকে এগিয়ে যায়। পপি এগিয়ে গিয়ে দেখতে পায় তার দাদাসাহেব পুনরায় এক্সিডেন্ট করে রাস্তার উপর পড়ে আছেন রক্তে চারিদিক ভেসে যাচ্ছে আর পাবলিক কৌতূহলবশত সেখানে দাঁড়িয়ে সব কিছু দেখছ ঠিকই কিন্তু কেউই তৎপর হচ্ছে না তাকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার। পপি এগিয়ে গিয়ে দাদা সাহেবের মাথাটা নিজের কোলের উপর তুলে নিয়ে জনতার উদ্দেশ্যে বলে তাকে একটু সাহায্য করার জন্য ;যাতে সে বয়স্ক লোকটাকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে পারে।কিন্তু শহিদুল সাহেব পপির একটা হাত ধরে বলেন তিনি আর বাঁচতে চান না।তার একমাত্র মেয়ে নার্গিস তাকে না বলে অনেক বছর আগে কোথায় চলে গেছে তা তিনি জানেন না।আর তাকে খোঁজার জন্য তিনি বহুদিন ধরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন।এক বাড়িতে তাকে কিছু দিন আটকে রেখেছিল।নার্গিসের মতো দেখতে একটি মেয়ে কিন্তু সে অনেক বড় তাকে দেখাশুনা করতো।মেয়েটিকে তার খুব ভালো লাগতো।মেয়েটা কাছে বসে থাকলে মনে হত যেন নার্গিস বসে আছে কাছে।কিন্তু সেতো নার্গিস নয় তাই নার্গিসকে খুঁজতে তার আবার বেরিয়ে পড়া। কিন্তু মনে হচ্ছে আল্লাহতালা তাকে সে সময় আর দেবেন না।কথাগুলো বলে তিনি হাঁফাতে লাগেন।এরপর তিনি বুকপকেটে হাত দিয়ে নার্গিসের ছোটবেলার একটা ছবি পপির হাতে ধরিয়ে বললেন,
--- আমার মেয়ে নার্গিস, যদি তুমি ওকে কোনদিন দেখতে পাও ওকে বল ওর বাবা ওকে খুব ভালবাসতো।ওর বাবা কখনও চায়নি ফারুকের বাবার সাথে কোন ঝামেলা হোক। ওর বাবার ইচ্ছা ছিল ফারুকের সাথে তার বিয়ে দেওয়ার। কিন্তু নার্গিস আমাকে না বলে চলে গিয়ে খুব কষ্ট দিয়েছে। তাইতো নার্গিসকে খুঁজতেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়া।
 পপির চোখ থেকে জল পড়তে থাকে।আস্তে আস্তে সহিদুল সাহেব মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।পপি সঙ্গে সঙ্গেই তার মাকে সব ফোনে জানায়।নিজের ভালোবাসার পূর্ন মর্যাদা দিতে না বুঝেই বাবা,মাকে সে যে কষ্ট দিয়েছে সে কথা মনে করে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে।সে শুধু স্বার্থপরের মত সারাটা জীবন নিজের কথায় ভেবেছে কোনদিনই তার জন্মদাতা জন্মদাত্রীর কথা ভাবেনি। ফারুকের ভালোবাসা সত্যিই তাকে অন্ধ করে দিয়েছিল।

#টবব্লগকনটেস্ট

Saturday, January 30, 2021

স্মার্ট ফোন

স্মার্ট ফোন

 প্রেম করে আঠারো বছর বয়সের আগেই সামান্য এক ইলেকট্রিক দোকানের মালিকের সাথে পালিয়ে গিয়ে কালীঘাট মন্দিরে বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে উঠে জয়িতা। শ্বাশুড়ি মেনে নিতে বাধ্য হন কারণ স্বামী হারা ওই ছেলেই তার বেঁচে থাকার একমাত্র শিবরাত্রির সলতে।অর্থের অভাব থাকলেও জয়িতার জীবনে সুখ ছিল।আস্তে আস্তে দোকানে  উন্নতি হওয়া শুরু করল;আর তার স্বামীরও মদের প্রতি আসক্তি বাড়তে লাগলো। এরই মধ্যে জয়িতার কোল জুড়ে এলো সুন্দর ফুটফুটে একটি মেয়ে। স্বামী অরূপ রোজ রাতে মদ খেয়ে বাড়িতে এসে পান থেকে চুন খসলেই চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করতো।শেষের দিকে সে জয়িতার গায়ে হাতও তুলতো। শ্বাশুড়ি শত চেষ্টা করেও ছেলের মাতলামির হাত থেকে তার একমাত্র বউমাকে বাঁচাতে পারতেন না।দু বছরের স্মৃতি ভয়ে সিটিয়ে ঠাকুমাকে জড়িয়ে কাঁদতে শুরু করত। মদ পেটে পড়লেই অরূপ অন্য মানুষ! আর নেশা কেটে গেলে তার মতো ভালো মানুষ আর একটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না।তাই শত অত্যাচার সহ্য করেও জয়িতা তার স্বামীর সেবা থেকে একচুলও কোনদিন সরেনি। অনেক চেষ্টা করেছে স্বামীর নেশা ছাড়ানোর কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছে।
  এই ভাবেই কেটে গেছে অনেকগুলি বছর।স্মৃতি তখন বিয়ে পড়ছে।একটি ছেলের সাথে তার পরিচয় হয়।পরিচয় থেকে প্রেম।দোকানে বসে অরূপের কানে কথাটা যায়।আকন্ঠ মদ গিলে সে বাড়িতে আসে।এসেই জয়িতার সাথে তুমুল অশান্তি। এরই মধ্যে স্মৃতি টিউশনি থেকে বাড়িতে ফিরে চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ভয়ে কাঠ হয়ে সে ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকে। অরূপ রাগের মাথায় দরজার খিল নিয়ে স্মৃতির পায়ে মারতে যায়।আচমকা স্মৃতির সামনে গিয়ে জয়িতা দাঁড়িয়ে পড়ে। ওই খিলের বাড়ি জয়িতার পায়ে লাগে। আর জয়িতা চিৎকার করে উঠে মাথা ঘুরে পড়ে যায়।অরূপ শান্ত হয়ে গিয়ে খাটের উপর বসে পড়ে।
   জয়িতার পা ভেঙ্গে যায়।হাসপাতাল থেকে প্লাস্টার করে এসে জয়িতা খাটে শুয়ে।অরূপ সেই থেকে বেশ কদিন দোকানে যায় না।দোকানের কর্মচারীরা দোকান সামলায়। সম্পূর্ণ অন্য মানুষ হয়ে যায় অরূপ। সেদিনের ওই ঘটনার পর অরূপ আর মদ ছুঁয়েও দেখেনি। জয়িতার কাছে দুহাত জড়ো করে ক্ষমাও চেয়ে নিয়েছে। জয়িতার দেখাশোনা সব  অরূপ নিজের হাতেই করে।আস্তে আস্তে জয়িতা সুস্থ হয়ে উঠতে থাকে। ফিরে পাই সে তার জীবনের হারিয়ে যাওয়া সুখ।বোঝাতে সক্ষম হয় অরূপকে মেয়ে স্মৃতি যাকে ভালবাসে সে যখন ভালো ঘরের ছেলে, ভালো চাকরি করে, তাহলে বিয়েতে আপত্তি কোথায়?স্মৃতি যদি জীবনে সুখী হয় তার থেকে আর কি চাওয়ার থাকতে পারে ঈশ্বরের কাছে আমাদের ?অরূপ রাজি হয়।মেয়েও গ্রাজুয়েশন শেষ করে।
      দু'বাড়িতে বিয়ের তোরজোরের মাঝেই অরূপ একদিন বুকে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে নার্সিংহোম ভর্তি হয়।অবস্থা সংকটাপন্ন!বিয়ের মাত্র সাত দিন বাকি।স্মৃতি তার হবু স্বামী কল্যাণকে বিয়েটা পিছিয়ে দিতে বলায় কল্যাণ তাকে জানায়,
----তা কি করে সম্ভব? বিয়ের কার্ড ছাপানো, নিমন্ত্রণ করা, সবকিছু অ্যাডভান্স দেওয়া পর্যন্ত হয়ে গেছে।এই মুহূর্তে বিয়ে পিছিয়ে দেওয়া মানে সম্মানহানির সাথে সাথে অনেক টাকাও খরচ ।এটা কিছুতেই করা যাবে না।
--- কিন্তু বাবার এই অবস্থায় আমি বিয়ের পিঁড়িতে বসতে পারবো না।
---- যার শরীরের এই অবস্থা তিনি তো আর বাঁচবেন না। তাহলে খামোখা বিয়েটা পিছিয়ে দেবো কেন?
----  কি বলছো কল্যাণ? আমার বাবা তোমার বাবা নন? তোমার বাবার এইরকম অবস্থায় বিয়ে করতে তুমি রাজি হতে?
---- শোনো স্মৃতি আমাকে যদি তোমার বিয়ে করতে হয় তাহলে ওই তারিখেই বিয়ে হবে, অন্যথায় আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবোনা
---- আমার পক্ষে সেটা কিছুতেই সম্ভব নয়।এখন বুঝতে পারছি আমি তোমায় চিনতে ভুল করেছিলাম।ভালো চাকরি আর সুন্দর চেহারা থাকলে সুন্দর মনের মানুষ হওয়া যায়না। তুমি তার জলন্ত প্রমান।আজকের পর থেকে তোমার সাথে আমার আর কোন সম্পর্ক থাকবে না।আমি বেঁচে গেলাম একটা কুৎসিত মনের মানুষের সাথে সারা জীবন থাকার হাত থেকে।আসলে ঈশ্বরই আমায় এটা বুঝিয়ে দিলেন।আমি এখন বুঝতে পারছি তুমি এতদিন শুধুমাত্র আমার বাবার ব্যাংক ব্যালেন্স, আমি বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান,ভালো বাড়ি  এইসবের লোভেই আমার পেছনে পড়ে ছিলে। এটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল আমাকে নয় তোমার লোভ ছিল আমার বাবা মায়ের সম্পত্তির উপর।আমার প্রতি তোমার ছিল লোক দেখানো ভালোবাসা।তুমি ভালোভাবে জানতে তাদের অবর্তমানে তাদের সব কিছুর মালিক আমি হব আর এই কারণে তুমি আমার সাথে এতদিন ধরে অভিনয় করে গেছো।
  কল্যাণকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে স্মৃতি চলে আসে তার সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে। তার বাবা অরূপ আর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসতে পারেননি।রাক্ষুসে নার্সিংহোম লক্ষ লক্ষ টাকার বিল ধরিয়ে দেয় জয়িতার হাতে,আর সামনে এনে দেয় তার মৃত পিতাকে।
  হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজতে লাগলো স্মৃতি। কারন দোকানটাও আস্তে আস্তে কর্মচারীদের ভিতরে অসন্তোষ ও চুরির কারণে বন্ধ করে দিতে হয়।সামান্য মাইনের রিসিপশনিস্ট পদে একটি কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে যায়।বাবার মৃত্যুর তিন মাসের মধ্যেই ঠাকুমাও চলে যান।মা ও মেয়ের সংসার এখন।কোন ঝামেলা ঝক্কির ব্যাপার নেই। কিন্তু বিধাতা পুরুষ জয়িতার কপালে সুখ স্থায়ীভাবে লেখেননি।রোজের মতো অফিস যাওয়ার জন্য সকাল দশটায় বেরিয়ে যে মেয়েটা রাত আটটায় ফিরে আসে সে একদিন সারা রাতেও ফেরে না। সারারাত ছটপট করতে করতে ভোরেই থানায় হাজির হয় জয়িতা ।একটা নিখোঁজ ডায়েরি করে।সাত দিনের মাথায় মেয়ের লাশ শনাক্ত করতে তাকে নদীয়া যেতে হয়। শারীরিক অত্যাচারের পর শ্বাসরোধ করে তাকে মারা হয়েছে। ধরা পড়ে খুনিরা।তাদের জেরা করে জানা যায় চাকরিস্থল থেকে বেরিয়ে সে যখন ফাঁকা রাস্তা ধরে বাস ধরার জন্য এগোচ্ছিল তখন মুখে কাপড় চাপা দিয়ে তাকে গাড়িতে তোলা হয়।যার নির্দেশে এ কাজ তারা করেছিল সে সারারাত মেয়েটির উপর অত্যাচার করে ভোরের দিকে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলে। পরে লাশ তাদের হাতে তুলে দেয় মাটিতে পুঁতে ফেলার জন্য।এর বিনিময়ে তারা প্রচুর টাকা পেয়েছে।মূল পান্ডাকেও ধরা হয়।জয়িতা দেখে সে আর কেউ নয় তার মেয়ের প্রাক্তন প্রেমিক কল্যাণ।কল্যাণকে অরূপ ঠিক চিনেছিল। কিন্তু জয়িতা বা তার মেয়ে চিনতে পারেনি।আজ ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর জয়িতা চিনলো কল্যাণকে।
  ভেঙ্গে পড়ে জয়িতা খুব।নিঃস্ব হয়ে যায় সে।খাওয়া-দাওয়া প্রায় বন্ধ করেই নিজেকে ঘরবন্দি করে রাখে।এই অবস্থায় থাকতে থাকতে সে এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়ে যে প্রতিবেশীরা দরজা ভেঙ্গে তাকে নিয়ে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করে। দিন পনেরোর পর একটু একটু করে জয়িতা সুস্থ হয়ে উঠতে থাকে।সে দেখে তার পাশের বেডের এক ভদ্রমহিলা হাসপাতালের বেডে শুয়েই  সবসময় মোবাইল নিয়ে খুটখাট করছেন।কখনো একা একাই হাসছেন আবার কখনো বা মুখটা তার বেশ গম্ভীর।জয়িতা বুঝতে পারে নিঃসঙ্গ জীবনের সময় কাটানোর এ এক অভিনব পন্থা!এটা বুঝতে পেরেই হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়িতে এসে হাতের বালা বিক্রি করে জয়িতা এক স্মার্ট ফোন কিনে বসে। সেও সব সময় ঐ ফোনটা নিয়েই নাড়াচাড়া করতে থাকে।পাশের বাড়ির একটি ছেলের সাহায্যে সে অনেক কিছু শিখে যায়। একসময় সে স্মার্টফোনে বেশ পারদর্শী হয়ে ওঠে।দুটো সিদ্ধ ভাত করে সারাদিন ফোন নিয়ে থাকার ফলে সে তার জীবনে অনেক দুঃখ কষ্ট সাময়িক হলেও ভুলে  থাকতে পারে।
  জীবনে সুখী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে একদিন নিজের বাবা, মা, ভাইবোন কে ছেড়ে সে চলে এসেছিল অরূপের হাত ধরে। সুখ-দুঃখ মিলিয়ে জীবনটা বেশ কেটে যাচ্ছিল।কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে একে একে সবাই তাকে ছেড়ে গেছে।তবুও সে ভেঙ্গে পড়েনি।বাঁচার তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে হাসপাতালে পাশের বেডে সালেহার হাতে ফোন দেখে বেশ কয়েকবার বেড থেকে উঠে গিয়ে তার কাছে ফোনে কি কি করা যায়? কীভাবে মানুষের সাথে যোগাযোগ করা যায়?সবকিছু দেখে তারও এই ফোনের প্রতি একটা নেশা ধরে যায়। আর তখন সে মনে করে বাড়িতে গিয়ে তার সময় কাটানোর জন্য ঠিক এমনই একটা ফোন কিনবে।
আজ তার এই নিঃসঙ্গ জীবনে স্মর্টফোনটা তার সব সময়ের বন্ধু। এই ফোনটাই তার জীবনের অনেক কিছু ভুলিয়ে দিতে পেরেছে।অনেক মানুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।কত মানুষের কত কথা টুকরো টুকরো বাক্যে জানা যায়।তাই সে আজ এই ফোনটাকেই মনে করে তার পরম বন্ধু ।


Friday, January 29, 2021

ভালোবাসার পূর্ণতা

ভালোবাসার পূর্ণতা 

  জীবনের প্রথম ভালোবাসা কেউই ভুলতে পারেনা।অপরিণত বয়সের ভালোবাসা অধিকাংশ সময় পূর্ণতা পায়না।স্কুল কিংবা কলেজ জীবনের সহপাঠীর সাথে প্রেম অনেকের জীবনেই ঘটে থাকে।কিন্তু ছেলেটির স্টাবলিশ হওয়া পর্যন্ত অনেক পরিবারই মেয়েটিকে বসিয়ে রাখেনা।তার পড়াশুনা শেষ হয়ে গেলেই নিজ পায়ে দাঁড়ানোর অন্য কোন ছেলের সাথে তার বিয়ে দিয়ে দেন।অনেক মেয়েই আছে পরিবারের শান্তি রক্ষার্থে সে তার ভালোবাসার বলিদান দেয়।আর তার প্রেমিকটি থাকে তখন অসহায়!
   ঈশিকা আর অমল যখন একাদশ শ্রেণী তখন থেকেই দুজনের মধ্যে এক সুন্দর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক।যা উচচমাধ্যমিক পরীক্ষার পর ভালোবাসায় পরিণত হয়।জয়েন্ট এন্ট্রান্স এ চান্স পেয়ে অমল সরকারিভাবে ডাক্তারী পড়ার সুযোগ পায়।আর ঈশিকা বাংলায় অনার্স নিয়ে কলেজে ভর্তি হয়। ঈশিকা সুন্দরী।সেই কলেজেরই তরুণ প্রফেসর ঈশিকাকে দেখে মুগ্ধ হন।তিনি তার বাবা মাকে দিয়ে ঈশিকাদের বাড়িতে বিয়ের সন্বন্ধ পাঠান।বলাবাহুল্য ঈশিকার বাবা মা এ প্রস্তাব লুফে নেন। ঈশিকা অনেক চেষ্টা করে বিয়েটাকে আটকাতে। কিন্তু বাবা-মায়ের ইমোশনের কাছে হার মানতে বাধ্য হয়। অমলকে সবকিছু জানায়। কিন্তু অমলের তখন ফোর্থ ইয়ার।কলেজ কামাই করার কোন উপায় নেই ।সে আসতে পারে না।যা কথা হয় ফোনেই। অমল তখন অসহায়!সেই মুহূর্তে তার তখন কিছুই করার নেই।
 ঈশিকা বিয়ের পর স্বামী দেবব্রতর সাথে তার শ্বশুরবাড়ি ঠাকুরপুকুর চলে আসে।পড়াশুনায় তার আর মন ছিল না। তবুও স্বামীর অনুরোধে সে ফাইনাল পরীক্ষাটা দেয়।পাসও করে যায়। কিন্তু প্রথম ভালোবাসা হারিয়ে মনটা ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর কোন চেষ্টাই সে আর করে না।
 অমল আর ঈশিকার প্রেমকাহিনী হয়তো এখানেই থেমে যেতে পারতো;যদি না বিয়ের দশ বছর পরে তাদের আবার ঘটনাক্রমে দেখা হতো। অমল এখন নামকরা একজন গাইনোকোলজিস্ট। বিয়ের দশ বছর পরেও ঈশিকা মা হতে পারেনি।জন্মগত কিছু সমস্যা থাকার কারণে। অনেক ডাক্তার সে দেখিয়েছে। কিছু ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে  ছোটখাটো অপারেশনও করিয়েছে।কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।কিছুদিন ধরেই গাইনোকোলজিস্ট  এ. রায় চৌধুরীর নাম শুনছে।শেষ চেষ্টা অনুযায়ী তাকে একবার দেখানোর ইচ্ছা তার। একমাস আগে ডক্টর এ. রায় চৌধুরীর অ্যাপোয়েন্টমেন্ট নিতে হয়।দেবব্রত অনেক চেষ্টা করে অ্যাপোয়েন্টমেন্ট নেয়। নির্দিষ্ট দিনে স্বামীকে সাথে নিয়ে ঈশিকা আসে ডক্টর রায়চৌধুরীকে দেখাতে। সে স্বপ্নেও কল্পনা করেনি তার জন্য কি অপেক্ষা করে আছে।সিরিয়াল অনুযায়ী স্বামীকে সাথে নিয়ে সে রায়চৌধুরীর রুমে ঢোকে। ডাক্তারবাবু হাতের ইশারায় তাদের বসতে বলেন। কিন্তু রুমে ঢুকেই ঈশিকা বুঝতে পারে তার সামনেই ডাক্তার হয়ে আজ যে বসে আছে সে আর কেউ নয় তার প্রথম জীবনের ভালবাসা।
  ঈশিকার চিনতে এক মুহূর্ত সময় না লাগলেও অমল কিন্তু প্রথম অবস্থায় ঈশিকাকে চিনতে পারেনি। অমল চিনতে পারে ঈশিকার গলার আওয়াজে। ঈশিকার মুখটা চেনা চেনা লাগলো ব্যস্ততার কারণে অন্য কোনো কথাই না গিয়ে সে সরাসরি তার সমস্যা জানতে চায়। ঈশিকা আগেই নিজেকে সামলে নিয়েছে।যেহেতু অমল তাকে চিনতে পারেনি বা চিনলেও কোন কথা বলেনি তাই ঈশিকাও নামকরা ডাক্তারের সম্মান রক্ষার্থে সে সরাসরি কোন জড়তা না রেখেই সে তার সমস্যার কথা শুরু করে।
 ঈশিকার গলার আওয়াজ শুনে অমল তাকে চিনতে পারে। কিন্তু ধরা দেয় না। ঈশিকার সমস্ত রকম পুরনো কাগজপত্র ঘেঁটে মনোযোগ সহকারে অনেকক্ষণ বসে সেগুলো দেখে ঈশিকাকে শুধুমাত্র দুটো ঔষধ দিয়ে  একমাস পর আসতে বলে দেয়।
  পরদিন অমলের চেম্বারে বেরোনোর কিছুক্ষণ আগে ঈশিকা প্রেসক্রিপশন এর উপরের নাম্বারটা দেখে অমলকে ফোন করে। 
--- অমল দা আমি ঈশিকা বলছি --
  অমল প্রথম অবস্থায় একটু ঘাবড়ে যায়।পরে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
-- হ্যাঁ বল কেমন আছো?
--- কেমন আছি আমি সে তো তুমি কালকে সব শুনলে। তুমি কেমন আছো? বাড়ির সবাই ভালো আছে তো?
--- বাবা বছর-পাঁচেক হল মারা গেছেন। মা আছেন, বাধ্যক্য জনিত কারণে নানান রোগে ধরেছে, এই চলছে আরকি?
--- আর তোমার বউ-বাচ্চা? তারা কেমন আছে?
 অমল তখন বলে উঠে একটা ইমার্জেন্সি ফোন আসছে হয়তো কোন পেশেন্টের ফোন হবে । পরে তোমার সাথে কথা হবে তুমি একদম চিন্তা করো না। আমি তোমাকে আশ্বাস দিচ্ছি তোমার কোল শুন্য থাকবে না। মা ডাক তুমি শুনবেই খুব তাড়াতাড়ি।
 অমল ফোনটা কেটে দেয়।না, সে বলতে পারেনি যে সে বিয়ে করেনি। যে জায়গাটা সে ঈশিকাকে দিয়েছিল সেই জায়গাটা অন্য কাউকে কোনদিনও দিতে পারবে না। কিন্তু এ কথা ঈশিকাকে জানিয়ে তার মনে পুরনো ব্যাথাটাকে উসকে দিতে সে পারবে না। ডাক্তারি পাশ করার পর ন'বছরের জীবনে  এবার এসেছে এক কঠিন পরীক্ষা। সেই পরীক্ষায় যেভাবেই হোক তাকে পাস করতেই হবে। ঈশিকার মুখে হাসি ফোটাতেই হবে।
  বছরখানেক অমলের আন্ডারে ট্রিটমেন্ট থাকার পর সেই শুভক্ষণটি  ঈশিকার জীবনে আসে।সে তার স্বামী দেবব্রতকে  সঙ্গে করে নিয়ে এসে ডক্টর এ. রায়চৌধুরীকে জানায় যে সে মা হতে চলেছে।এই কথাটি শুনে আনন্দে অমলের চোখে জল এসে গেছিল সে সময় ।কিন্তু নিজেকে অদ্ভুতভাবে সামলে নিয়ে ঈশিকা এবং তার স্বামীকে সে কনগ্র্যাচুলেট করে।
    দেখতে দেখতে দশ মাস দশ দিন কেটে যায়।আজ লেবার রুমে ডক্টর রায়চৌধুরী সিজার করবেন তার প্রাক্তন প্রেমিকা ঈশিকা মুখার্জিকে। প্রথম দিকে ডক্টর রায়চৌধুরীর হাতটা একটু কাঁপলেও কিছুক্ষণ পরেই তিনি নিজেকে শুধুমাত্র একজন ডাক্তার হিসেবেই কল্পনা করেন প্রেমিক হিসাবে নয়। সুন্দর ফুটফুটে একটি কন্যা সন্তানকে তিনি তুলে দেন ঈশিকার কোলে। ঈশিকার জীবন মাতৃত্বের অহংকারে পূর্ণ হয়। আর ডক্টর রায়চৌধুরী ওরফে অমল এতদিন পরে তার ভালোবাসার পূর্ণতা খুঁজে পায়।
    

Thursday, January 28, 2021

সুখের ঘরে আগুন (২১)

সুখের ঘরে আগুন (২১)

   নিশিতা আর প্রলয়ের বিয়ের পর অম্বিকা ও নিলয়ের আর দেখা হয়নি।কিন্তু দুজনের মনেই কিছু অদ্ভুত স্মৃতি রয়েছে যা দুজনকে মাঝে মাঝে আচ্ছন্ন করে দেয়। ভাগ্যের উপর কারও কোন হাত নেই।একসময় পাড়ার ফাংশানের অম্বিকাকে গান গাইতে দেখে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে তার বাবা-মাকে তাদের বাড়িতে পাঠিয়েছিল নিলয়।কিন্তু অদ্ভুতভাবে প্রসঙ্গ উত্থাপনের আগেই বিয়ের সম্বন্ধটা নিয়ে আর এগোনো যায়নি। জীবনের উপর দিয়ে ঘটে গেছে এক মস্ত বড় ঝড়। কাকতালীয়ভাবে পরিচয় হয়েছে সেই অম্বিকারই সাথে।  বন্ধুর বিয়ের সূত্র ধরে কয়েকটা দিনের আলাপে তারা এসেছে মনের অনেকটা কাছাকাছি।কিন্তু কেউই মন খুলে কাউকে কোন কথা জানাতে পারেনি। জীবনের যে যার মত ব্যস্ত হয়ে পড়লেও দুজনের মনের কোন একটা জায়গায় দুজনের জন্যই একটা জায়গা তৈরি হয়েছে।
   রেলে চাকুরীরত নিলয় বেশ কিছুদিন ধরেই শুনছিল তাকে কলকাতা শহর থেকে অন্যত্র বদলি করা হবে।একদিন অফিসে গিয়ে উপরমহলের ডাকে সে ছুটে গিয়ে জানতে পারে সত্যিই তার ট্রান্সফার হয়ে গেছেএবং সেটা ভুবনেশ্বর। সেদিনই তার বস ট্রান্সফারলেটার ধরিয়ে দেন।খুব ভেঙ্গে পড়ে নিলয়।বাবা মায়ের এই বয়সে তাদের ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে চাকরি করার কথা সে ভাবতেই পারেনা।রাতবিরেতে হঠাৎ করে বাবা-মায়ের কোন অসুবিধা হলে তারা বড় অসহায় হয়ে পড়বেন। কিন্তু সরকারি আদেশ অমান্য করলে  চাকরি থাকবে না।সাতপাঁচ ভাবতে থাকে।
  সেদিন ছিল শুক্রবার। প্রলয় ফোন করে নিলয়কে জানায় রবিবার দিন তাদের বাড়িতে একটা ছোট্ট পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। কাছের কিছু বন্ধুবান্ধব সেদিন আসবে।যারা বিয়েতে খাটাখাটনি করেছে তাদের জন্য এই ছোট্ট আয়োজন।সে যেন অবশ্যই আসে। নিলয়ের মনটা সেদিন মোটেই ভাল ছিলনা।প্রলয়ের কথাগুলো শুনে সে বলল,
---  একটু ব্যস্ত আছি, পরে তোকে ফোন করবো।তবে হ্যাঁ আমি রবিবার অবশ্যই যাবো তোর বাড়িতে।
বাড়িতে ফিরে চা খেতে খেতে মা-বাবাকে কথাগুলো জানালো নিলয়।তারাও শুনে খুব মুষড়ে পড়লেন।কিন্তু কারো কিছুই করার নেই।আজকের বাজারে চাকরি পাওয়াই দুষ্কর।তার ওপর সরকারি রেলওয়ে চাকরি। তারা ওখানেই তাকে কোয়াটার দেবে।সর্ব রকম সুবিধাযুক্ত।ইচ্ছা হলে সে পুরো পরিবার নিয়ে সেখানে যেতে পারে।কিন্তু বাবা-মা পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে কিছুতেই যেতে রাজি নন।তাদের সেই এক কথা "আমাদের কোন অসুবিধা হবেনা।নিশ্চিন্ত মনে তুই যেতে পারিস।আর অসুবিধা হলেও পাড়া-প্রতিবেশীর তো আছে, রিতেশ আছে।কোন দরকার হলে তার সাথে যোগাযোগ করব।প্রয়োজনে তুই দুই  একজন বন্ধু-বান্ধবের ফোন নাম্বার দিয়ে যাস। আগে তো তোকে চাকরিটা বাঁচানোর ব্যবস্থা করতে হবে।তুই গিয়ে সেখানে চাকরিতে জয়েন কর।আমরা না হয় মাস ছয়েক পরে কিছুদিন গিয়ে তোর কাছে।থাকবো। আর মাঝে মধ্যে ছুটিছাটা পেলে তুইও চলে আসিস। 
  সম্পূর্ণ মনের বিরুদ্ধে গিয়ে দিন সাতেক পরে নিলয় রওনা হয়ে যায় তার নতুন চাকরির স্থল ভুবনেশ্বরের উদ্দেশ্য। এসি কামরায় চোখ বুজে সেদিন প্রলয়ের বাড়িতে টুকরো টুকরো ঘটনাগুলি মনে করে আনন্দের রেশটা ধরে রাখার চেষ্টা করে। সেদিন প্রলয়ের বাড়িতে যেতে তার একটু দেরিই হয়ে গেছিল। সারাটাদিন ভুবনেশ্বর যাওয়ার তোড়জোড় করতেই দেরি হয়ে যায় দুপুরের খাবার খেতে। খাওয়ার পর বিছানায় শরীর এলিয়ে দিতেই তার দুচোখ ভরে ঘুম নেমে এসেছিল। উঠতে উঠতেই সন্ধ্যা। হয়তো আরও দেরি হতো কিন্তু প্রলয় ফোন করাতেই সে সেই আওয়াজে উঠে পড়ে। সে যখন বাড়ি থেকে বেরোয় তখন সন্ধ্যা সাতটা।প্রলয়ের বারবার ফোন,
---  সবাই এসে গেছে,তুই না আসলে ঠিক জমছে না।একটা উবের ধরে তাড়াতাড়ি চলে আয়।
 লিফটে করে উপরে উঠে সদর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে শুনতে পায় অম্বিকা গান করছে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পুরো গানটা শুনে তারপর সে বেল বাজায়। প্রলয় ছুটতে ছুটতে এসে দরজা  খুলেই চিৎকার করতে লাগলো,
--- তোর এত দেরি হল কেন?সে কখন থেকে আমরা তোর জন্য অপেক্ষা করছি।
 নিলয় এদিকে ওদিকে তাকিয়ে  কাউকে দেখতে না পেয়ে প্রলয়ের কাছে জানতে চাইল,
---   গেস্টরা সব কোথায়?
 চোখ ভুরু কুঁচকে প্রলয় বলল,
---  গেস্ট বেডরুমে ---
নিলয় প্রায় আঁতকে উঠলো।গেস্ট বেডরুমে মানে?গেস্টদের নিয়ে তুই বেডরুমে বসিয়েছিস?কপাল আমার !এই বুদ্ধি নিয়ে তুই সংসার করবি কেমন করে ?এত বড় ড্রইংরুম থাকতে সবাইকে নিয়ে বেডরুমে?নিশিতা কোন আপত্তি করেনি?নাকি ওউ তোর কথায় সায় দিয়েছে?
--- আরে এত উত্তেজিত হচ্ছিস কেন?তুই ও চল সেখানে আর গিয়েই দেখতে পাবি কে কে এসেছে ?
নিলয় দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনেছে অম্বিকার গান।তাই সে জানে অম্বিকা এসেছে।কিন্তু বন্ধুকে সে কথা সে বুঝতে দিল না। প্রলয়ের কথার জবাবে ড্রয়িং রুমে বসতে বসতে বললো,
-- তোর ভীমরতি ধরেছে বলে কি আমারও ভীমরতি ধরেছে? আমি কিছুতেই তোর বেডরুমে যাবনা।আমি এখানেই বসবো দরকার হলে তুই চলে যা তাদের কাছে।খাওয়ার সময় হলে আমার খাবারটা দিয়ে দিস।আমার কাছে বসে থাকার কোন দরকার নেই।আমি জানতাম না তুই এতটা মাথামোটা! বন্ধুবান্ধব নিয়ে নিজেদের বেডরুমে ঢুকে গেছিস,তাও আবার 7 দিন আগেই বিয়ে হয়েছে তোদের।
 কথাগুলো শেষ করে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে নিশিতা আর অম্বিকা আসছে।আসতে আসতে নিশিতা বলতে থাকে,
-- সেই যে দরজা খুলতে আসলে তারপরে আর ও ঘরে যাওয়ার কোন নাম নেই।আমরা দুজনে অপেক্ষা করে করে ক্লান্ত হয়ে চলে এলাম। কি এমন গভীর শলা পরামর্শ হচ্ছে সেটাই জানতে এলাম।
--- আর বোলো না নিশা। নিলয় ঘরে ঢোকার থেকে চিৎকার করে যাচ্ছে আমরা সব বন্ধুবান্ধবকে কেন বেড রুমে বসিয়েছি? সে বেডরুমের ঢুকবে না বলে জোর করে এই ঘরে বসে আমার সাথে ঝামেলা করে চলেছে।
 নিশিতা হাসতে হাসতে বলল,
---  আমার বেডরুমে ঢোকার অধিকার তোমার এবং অম্বিকার আছে।
 নিলয় নিশিতার দিকে হাত জোড় করে বলল,
-- ক্ষমা করো দেবী, কারো বেড রুমে ঢোকার অধিকার আমার নেই।কেউ সেই অধিকার দিলেও আমি নিতে পারবোনা।আরে আমি তো মানুষ,কতটা নিতে পারব আর কতটা নিতে পারবো না সেটা আমার থেকে আর কেউ কি ভালো জানে?
নিলয় কোন দিকে ইঙ্গিত করল প্রলয় তা ভালোভাবেই বুঝতে পারলো।সে হাসতে হাসতে বলল,
-- আরে এ প্রসঙ্গ ছাড় ;সেই বিয়ের পর তোর আর অম্বিকার সাথে আমাদের দেখা হয়নি।আচ্ছা তোদের দেখা হয়?নাকি হয়েছে?আমরা জানি না--
। কথাগুলো বলেই প্রলয় হাসতে লাগলো।নিশিতাও সেই হাসিতে যোগ দিলো।আর এই কথা শুনে অম্বিকা কিছুটা লজ্জা পেয়ে গেলো।নিলয় সেটা বুঝতে পেরে প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বলল,
--- আরে বাকিদের ডাক।আড্ডাটা এখানে বসেই মারি।রাত ও হচ্ছে।বাড়ি ফিরতে হবে তো?করেছিস তো খাওয়ার নিমন্ত্রণ সেটা মনে আছে তো?
প্রলয় নিলয়ের দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে। 
--- কিরে তোর এত হাসি পাচ্ছে কেন,?আরে আমরা তো শুধু তোকে আর অম্বিকা কে বলেছি। নিজেদের মতো করে কিছুটা সময় কাটাবো বলে।আর কাউকেই বলিনি।আজকে তোরা দুজনেই শুধু আমাদের গেস্ট।আর খাবার হোটেল থেকে আসবে।খাওয়ার কিছুক্ষণ আগেই অর্ডার দেবো। গরম গরম খাওয়া-দাওয়া হবে।তবে হ্যাঁ নিশিতা চিকেনের একটা প্রিপারেশন করেছে।খুব ভালো করে ওটা।'নবাবী চিকেন' অনেকবার খেয়েছি।অবশ্য সেটা  বাড়িতে তৈরি করে আমার জন্য টিফিন ক্যারিয়ারে করে নিয়ে  বাস স্ট্যান্ডে এসে দিয়ে গেছে বেশ কয়েকবার।অফিসে বসেই খেতাম।
--- তুই ভাগ্যবান ভাই।আমার তো কপাল মন্দ।
নিশিতা নিলয়ের কথা শুনে গম্ভীর স্বরে বলল, মন্দ কপাল কে আমরা ভালো করে দিতে জানি।তার জন্য কিছু করতে হবে না শুধু একটু মনের কথাটা বলা দরকার।

 কথায় কথায় নিলয় ওদের জানালো তার বদলী হওয়ার কথা। হঠাৎ করে এমন একটা খবরে সবাই  যেন স্তম্ভিত হয়ে গেল। অম্বিকা মুখের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে বলল,
---  এক সপ্তাহের মধ্যে যেতে হবে? মাসিমা,মেসোমশাই কে এই বয়সে একা রাখা ঠিক নয়।আপনি এক কাজ করুন নিলয়দা ওদেরও সাথে নিয়ে যান।আপনি তো কোয়াটার পাবেন সুতরাং কোন অসুবিধা তো নেই।
অম্বিকার কথার জবাবে নিলয় একটু রাগত স্বরেই বলল,
-- অসুবিধা তো আছেই।তারা কিছুতেই বাড়ি ছেড়ে আমার সাথে যাবেন না।আমি আপনাদের সকলের ফোন নাম্বার তাদের কাছে দিয়ে যাবো।আমার বাবা মায়ের দায়িত্ব আপনার আর প্রলয়ের উপরেই ছেড়ে যাব।বিপদে-আপদে  একটু উনাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াবেন।কোন অসুবিধা হলে আমাকে খবর দিলেই আমি সঙ্গে সঙ্গে চলে আসবো।বন্ধু হিসেবে এটুকু আমি সকলের উপরে দাবি করতেই পারি --।
 প্রলয় তার বন্ধুকে আশ্বাস দিয়ে বললো,
--- তুই একদম চিন্তা করিস না,আমরা তো আছি। আর অম্বিকা তো তোর বাড়ির কাছেই।ওই সকলের আগেই ছুঁটে যাবে।আর আমরাও থাকব পাশে।কোন অসুবিধা হবে এটাই বা তুই ভাবছিস কেন? নিশ্চিন্ত মনে তুই বেরিয়ে পড়বি।মাসিমা,মেসোমশাই এর দায়িত্ব আমাদের।
  খাওয়া-দাওয়া গল্প- গুজবে রাত দশটা বেজে গেলো।ফেরার সময় অম্বিকা,নিলয় একসাথেই বেরোলো ওদের বাড়ি থেকে।প্রথমে দুজনে চুপচাপই বসে ছিল।তারপর নিলয়ই কথা শুরু করে।
--- একটা কথা আপনাকে বলার ছিল।
অম্বিকা নিলয় মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
--- কি বলতে চান বলুন। তবে আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি আপনার বাবা-মাকে দেখার দায়িত্ব আমি নিলাম।তবে তাদের বলে যাবেন কোন অসুবিধা হলে আমাকে ফোন করতে।
--- না, একটা অন্য ব্যাপারে কিছু বলার ছিল।

ক্রমশঃ
  

Tuesday, January 26, 2021

সুখের ঘরে আগুন (২০)

সুখের ঘরে আগুন (২০)

   রিসেপশনের দিন সকালে নিলয় আর প্রলয় প্রচণ্ড ব্যস্ত।উভয় পক্ষের কিছু বন্ধুবান্ধব ইতিউতি ঘোরাঘুরি করছে। সুযোগ পেয়ে নিশিতা অম্বিকাকে ডেকে বলল,
--- হ্যাঁরে তোকে একটা কথা বলব যদি কিছু মনে না করিস  আর অনুমতি দিস সাথে অভয়টাও মাস্ট --- 
বলেই হাসতে লাগলো ।
অম্বিকা চোখ বড় বড় করে নিশিতার দিকে তাকিয়ে বলল, ---বাব্বাহ  বিয়ে হওয়ার সাথে সাথেই তুই কত ন্যাকা হয়ে গেছিস --।
--- ন্যাকা ট্যাকা না , আসলে এই ব্যাপারটাতে আমি খুব সিরিয়াস।তার কারণ কথাগুলো শোনার পর আমাকে হয়তো গলা টিপে মেরেও ফেলতে পারিস;তাই চারিপাশ থেকে সর্ব রকম প্রটেকশন নিয়েই আমি কথাগুলো তোকে বলতে চাই।
--- এই ভনিতা না করে কি বলবি পরিষ্কার করে বলতো? এমনিতেই তো তোর বিয়েতে আমাকে যা খাটালি অবশ্য আমি  একা না সাথে নিলয়দাও আছে।
--- নিলয়দার জন্য তোর খুব দরদ দেখছি।
---- এতে দরদের কি আছে বুঝলাম নাতো?
--- কিছু একটা গন্ধ পাচ্ছি, এটাই আমাকে খুঁজে বের করতে হবে গন্ধের উৎসটা কি?
--- কি  হেঁয়ালি করছিস বুঝতে পারছি না।একটু ঝেড়ে কাশ পরিষ্কার করে বল।
  ওদের কথার মাঝখানেই নিলয় প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে ওরা যে ঘরে বসে ছিল সে ঘরে এসে ঢুকলো।অম্বিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
---এখানে বসে থাকলে হবে? ভাত-কাপড়ের অনুষ্ঠানটা তো করতে হবে।
 অম্বিকা অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
--- ভাত-কাপড়ের অনুষ্ঠান করতে তো সধবা মানুষের দরকার।আমি কি করে করবো? আমার তো বিয়েই হয়নি।
 কথাটা বলেই সে খিলখিল করে হাসতে লাগলো।নিশিতা তার দিকে তাকিয়ে বলল,
----  তাহলে বিয়েটা করেই ফেল এত দেরি করছিস কেন?
--- মনের মত ছেলেই তো পাচ্ছিনা।
 নিশিতা নিলয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
---  এবার আমার বন্ধুর জন্য একটা ভালো ছেলে দেখুন।
 নিলয় উত্তরে বলল,
--- আরে এইসব কথা পরে হবে।এখন এই ভাত কাপড়ের অনুষ্ঠানটা কিভাবে করা যাবে সেটাই ভাবতে হবে। আমার তো মাথায় কিছু আসছে না।
 অম্বিকা নিলয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
--- এক কাজ করুন নিলয়দা, টুক করে গিয়ে মাসিমাকে  নিয়ে চলে আসুন।মাসিমা এসেই ভাত-কাপড়ের অনুষ্ঠানটা শেষ করবেন।
--- তা কি করে সম্ভব?এত সময় হাতে নেই।বিকেল হলেই নিমন্ত্রিতরা আসতে শুরু করবে,পার্লার থেকে লোক আসবে সাজানোর জন্য।তার থেকে আমি বলি কি- অম্বিকা, আপনি আর আমি মিলে কাজটা শেষ করি। 
 নিশিতা হাতে তালি দিয়ে বলে উঠলো,
-- গুড আইডিয়া!এটাই হবে, তুই আর নিলয়দা মিলে আমাদের ভাত-কাপড়ের অনুষ্ঠানটা করবি। আরে নিয়মকানুন তো মানুষেরই তৈরি। আচার অনুষ্ঠান গুলো করে মানুষ একটু আনন্দ উপভোগ করে।আমরা সেটা যেভাবে খুশি করি না;আনন্দ পাওয়া নিয়ে কথা।
  ব্যাস যেমন কথা তেমন কাজ।প্রলয় ধুতি পাঞ্জাবি পরে চলে আসলো।নিশিতা অম্বিকার সাহায্যে হালকা করে সেজে   নির্দিষ্ট জায়গায় হাজির হয়ে গেল।অম্বিকা আর নিলয় দুজনে মিলে থালা,বাটি,গ্লাস সাজিয়ে অনুষ্ঠানের জন্য রেডি হয়ে গেলো।নিজেদের মত করে নিজেরাই সমস্ত আচার অনুষ্ঠান পালন করল।
  সত্যি বাঙ্গালীদের নানান অনুষ্ঠানে এসব মেয়েলী আচারের কোন যুক্তি আছে বলে আজকের  যুবসমাজ মনে করে না। অনুষ্ঠান বাড়িতে শুধু একটু আনন্দ ফুর্তি মজা করার জন্যই আগেকার দিনের মানুষেরা এসব নিয়ম কানুন তৈরি করেছিলেন। ভাত কাপড়ের অনুষ্ঠানের কথাই ধরা যাক প্রচুর লোকের সামনে থালা সাজিয়ে নব বিবাহিতা স্ত্রীর হাতে ভাতের থালা আর কাপড় দিয়ে বলা হয়, "ভাত-কাপড়ের দায়িত্ব নিলাম"- কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যায় অনেক স্বামীই সেই দায়িত্ব পালন করেন না। আবার অনেক ক্ষেত্রে হয়তো স্বামী বেকার, স্ত্রীই সেই দায়িত্ব পালন করে চলেছেন।কিন্তু তবুও  অনুষ্ঠানে স্বামীকেই কথাটা বলতে হয়। এই কুসংস্কারগুলি যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছে।আগেকার দিনে মানুষ বিনা বাক্য ব্যয়ে এ কুসংস্কারগুলি মেনে নিত। কিন্তু আজকের দিনের ছেলেমেয়েরা প্রতিটা কুসংস্কারের পিছনে যুক্তি খোঁজার চেষ্টা করে, যদি তারা কোন বৈজ্ঞানিক যুক্তি খুঁজে পায় তবে তারা তা মানে আর যেগুলোর ভেতর তারা কোনো বৈজ্ঞানিক যুক্তি দেখতে পায় না তারা সেগুলো কিছুতেই মানতে চায় না।
  নিশিতা ও প্রলয়ের বিয়ের পরেই অম্বিকা ও নিলয়ের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। নিশিতা বারবার প্রলয়কে বলেছে,
---  ওদের দুজনেরই দুজনকে পছন্দ হয়েছে,দুজনের চোখই সে কথা বলে দিচ্ছে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে কেউই মুখ ফুটে কাউকে সে কথা জানাচ্ছে না।আর নিলয়দার এই সমস্যাটা না মিটলে এই ব্যাপারটাতে আমরা এগোতে পারবো না ।কিন্তু তোমাকে আমি বলে রাখলাম,নিলয়দার এই সমস্যা মিটে গেলে আমি নিজে কিন্তু ওদের বিয়ের ব্যাপারে উদ্যোগী হব।অবশ্য তার আগে আমি কনফার্ম হয়ে নেব আমি যা ভাবছি তা সত্যি কিনা।
--- আরে এত তারাহুড়ো করার কি আছে?আগে ওদের একটু নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে নিতে দাও। আর যতদিন বোঝাপড়াটা চলবে ততদিন ওদের শরীর ও মন উভয়ই ভালো থাকবে।বিয়ে মানে তো সেই 'দিল্লি কা লাড্ডু'। তাছাড়া  নিলয়ের জীবনে সদ্য ঘটে যাওয়া এই ঘটনাটা থেকে বেরোনোর জন্য কিছুটা সময়েরও দরকার। এত সহজে সবকিছু ভুলে যাওয়া যায় না;ভুলে থাকার ভান করা হয়তো যায় ।কিন্তু ভুলে থাকা যায় না। কিছুদিন সময় দাও ওদের। আর তাছাড়া আমাদের রিসেপশন এর পরেই ওদের যোগাযোগটা বন্ধ হয়ে গেছে।এবার আমরা বাড়িতে ওদের দুজনকে একটু ডেকে নিই, বিয়েতে খাটাখাটনি উপলক্ষে ছোট্ট একটা পার্টি;এটাই বলব ওদের।আর সেদিনই ওদের ফোন নাম্বারটা একে অপরের কাছে যাতে থাকে সে ব্যবস্থা করার জন্য কিছু একটা করতে হবে।
   প্রলয়দের বিয়ের দিন পনেরো পরে হঠাৎ একদিন রিতেশ ফোন করে জানায় ডিভোর্সেরর চিঠি রেডি হয়ে গেছে।সে যেন গিয়ে  সবকিছু দেখে আসে। রিতেশ নিজেই আসতো কিন্তু কিছু ইমারজেন্সি কেসে ফেঁসে যাওয়ায় সে আসতে পারছেনা।তাই নিলয় তার বাড়িতে গিয়ে চিঠিটায়  সই করে আসলে পরে  শালিনীকে চিঠিটা পাঠিয়ে দেওয়া যাবে। নিলয় বাবা মাকে সবকিছু জানায়।এবং তাদের মতামত নিয়ে পরদিনই অফিসের পথে বোন প্রমিতার বাড়িতে আসে। নিলয়কে দেখতে পেয়ে রিতেশ হাসতে হাসতে বলে,
--- কেমন ঘোল খাওয়ালাম? আসলে অনেক দিন আসোনা। আর তাছাড়া তোমাকে একটা সুখবর দেওয়ার আছে।যেটা তোমার বোনের সামনে দিলেই তোমার আনন্দটা দ্বিগুণ হয়ে দেখা দেবে।
--- কি খবর ভাই?
--- আরে বলবো বলবো।চলো তোমার বোনের ঘরে চলো। ওখানে ওর সামনেই বলবো।
 নিলয় কে দেখতে পেয়ে প্রমিতা উঠে বসতে যায়। রিতেশ চেঁচিয়ে ওঠে,
--- উহু, একদম না, ডাক্তার তোমাকে টোটালি শুয়ে থাকতে বলেছেন।এখন তুমি শুধু শুয়েই  থাকবে।তোমার দাদার যত্ন আমি নিজেই করবো।একটা বছর আমার উপর সব ছেড়েই দেখোনা,আমি ঠিক তোমার সংসারকে আগলে রাখতে পারব।
 ওদের কথোপকথন শুনে নিলয় বুঝতে পারে যে সে মামা হতে চলেছে।বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
--- এই সময় ডাক্তারের কথা আর প্রলয়ের কথা সব মেনে চলবি।
  আরো কিছুক্ষন বোন ভগ্নিপতির সাথে সময় কাটিয়ে নিলয় বাড়িতে ফিরে আসে।মা-বাবাকে তার মামা হওয়ার সুখবরটা দেয়।তারাও খুব খুশি হন।
 নির্দিষ্ট দিনে নিলয়,শালিনী দুজনেই আলাদা আলাদাভাবে কোর্টে হাজির হয়ে যায়।তাদের মিউচুয়াল ডিভোর্স হয়। নিলয় সবসময় রিতেশের সাথে সাথে থেকেছে।শালিনী যাতে নিলয়ের সাথে কথা বলতে না পারে সেই কারণেই রিতেশের পিছন পিছন থাকা। সেই বিয়ের আগের দিন রাতে ফোন করে অন্য পুরুষকে ভালোবাসার কথা জানানোর পর থেকেই নিলয়ের শালিনীর প্রতি কেন জানি না একটা তীব্র ঘৃণা কাজ করে।সে যেন ধনুক ভাঙ্গা পণ করে বসে আছে সে কিছুতেই শালিনীর সাথে কোন কথা আর বলবে না। কিন্তু কোর্টে এসে শালিনীও নিলয়ের সাথে কথা বলার কোন চেষ্টাই করেনা। সেও নিলয়কে অদ্ভুত ভাবে এড়িয়ে যেতে থাকে।তার ভেতরেও একটা অভিমান কাজ করে।কারণ সে বারবার নিলয়কে কিছু বলতে চেয়েছে হয়তো সে তার ভালবাসাকে হারিয়ে নিলয় কে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিল। কিন্তু নিলয় তাকে কোনো সুযোগই দিল না।

ক্রমশঃ 
 
 
    

Sunday, January 24, 2021

সুখের ঘরে আগুন (১৯)

সুখের ঘরে আগুন (১৯)
   বড় রাস্তার মোড়ে নেমে নিলয় কিছু তেলেভাজা কিনে নিয়ে বাড়িতে আসে। কয়েক মাস আগেও এটা ছিল নিলয়ের নিত্য রুটিন। দার্জিলিং ঘুরতে গিয়েই যেন জীবনের কালো মেঘটা কোথায় হারিয়ে গেছে।যা কিছু ঘটছে ভালই লাগছে।কিন্তু মাঝে মাঝেই শালিনীর সাথে ডিভোর্সের ব্যাপারটা মাথায় ঘুরপাক খায়। বাড়িতে এসে মাকে তেলেভাজার প্যাকেটটা ধরিয়ে দিয়ে বলে,
---  অনেকদিন মুড়ি মাখা খাওয়া হয়না মা।মুড়িটা মেখে চা টা একবারেই করে নিয়ে ড্রয়িংরুমে এসো।তিনজনে বসে গল্প করতে করতে মুড়ি মাখা আর চা খাওয়া হবে।
  অনেকদিন পর ছেলে তেলেভাজা কিনে এনেছে দেখে মলিন দেবীও খুব খুশি হন।ছেলে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হচ্ছে দেখে তিনি মনেমনে বেশ আনন্দিত। অনেকদিন পরে জলপাই তেলের বয়ামটা খুঁজে বের করেন।মুখটা খুলে নাকের কাছে নিয়ে তাতে গন্ধ হয়েছে কিনা দেখে নিয়ে মুড়ির ভিতর তেলটা ঢালতে ঢালতে ভাবতে লাগলেন,বেশ কিছুদিন জলপাই তেলের বয়ামটা রোদে দেওয়া হয়নি।তবুও এখনো  ঠিকই আছে।তিনি মুড়িটা মেখে নিয়ে ড্রয়িংরুমে আসেন।ছেলে আর তার বাবার সামনে দিয়ে বলেন,
--- তোমরা খেতে লাগো আমি চা টা করে নিয়ে আসি।
--- তোমাকে তো আগেই বললাম একবারেই চা করে নিয়ে আসতে।কতদিন পর তেলেভাজা কিনে আনলাম বলো তো?
--- আরে তোরা খেতে লাগ আমি পাঁচ মিনিটেই আসছি।
     
    পরদিন কলেজে অম্বিকা আর নিশিতা টিফিন করছে আর নানান ধরণের গল্পগুজবের মেতে আছে।হঠাৎ নিশিতা বলে উঠলো,
--- হ্যাঁরে অম্বিকা, নিলয়দার বাড়ি তোদের পাড়াতে? ওর  সম্পর্কে সব জানিস?
--- মানে? সব জানি মানে?এক পাড়াতে থাকার ফলে যেটা জানি সেটা হল নিলয়দা ভদ্র,সভ্য,পরোপকারী।মানুষের পাশে দাঁড়াতে কখনো দুবার ভাবে না। সরকারি চাকরি করে ব্যস এইটুকুই।
--- না মানে বলছিলাম, নিলয়দার বিয়ে হয়েছে জানিস সবকিছু?
--- হ্যাঁ জানি তো বিয়েতে আমাদের সকলের নিমন্ত্রণ ছিল। মা আর বাবা গেছিলেন।আমি অবশ্য যাইনি।
--- তার পরের ঘটনা আর কিছু জানিস না?
--- এই তুই ঝেড়ে কাশ তো ---।কিসব মাথামুন্ডু বলছিস আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
--- না,আসলে প্রলয় তো নিলয়দার কলেজ সহপাঠী , তাই নিলয়দা প্রলয়ের সাথে সবকিছু শেয়ার করে।
--- সেতো বুঝলাম,কিন্তু এখন আসল কথা বল তুই।
--- নিলয়দা অষ্টমঙ্গলায় গিয়ে তার বউকে রেখে ফিরে এসেছে ।
--- মানে?
--- সেটাইতো বলছি।ওই বউয়ের সাথে সে আর সংসার করবে না।অবশ্য নিলয়দা ভুল করেছে বলে আমার মনে হয় না।কোন মেয়ে যদি বিয়ের আগের রাতে ফোন করে তার হবু স্বামীকে জানায় যে সে অন্য কাউকে ভালোবাসে তাহলে সেই পুরুষের পক্ষে তাকে নিয়ে সংসার করা সম্ভব নয়।
--- ঘটনাটা খুলে বল আমি তোর কথা কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা।
নিশিতা তখন পুরো ঘটনা অম্বিকাকে জানায়।অম্বিকা সব শুনে থ হয়ে যায়।কিছুক্ষণ তার মুখ থেকে কোনো কথাই বের হয় না।তারপর একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বলে,
---. প্রতিটা মানুষই তার ভাগ্য নিয়ে জন্মায়। ভাগ্যের উপর কারও কোন হাত নেই।নিলয়দার কপালে এটাই লেখা ছিল। তবে আমার মনে হয় বিয়ের আগেরদিন যখন নিলয়দা সবকিছু জানতে পেরেছিল বিয়েটা না করলেই পারত। খামোকা লোক দেখানো বিয়ে করার কোন যুক্তি ছিল বলে আমার মনে হয়না।এতে লোক হাসানোই হল।
--- খুব খারাপ লাগে জানিস ?এত ভালো ছেলেটার কপালে কি দুর্ভোগ!
--- কথাটা মনে হয় পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।পাড়ার কেউ কিছু জানে না।আর এরকম একটা লজ্জাস্কর ঘটনা অন্যদের কোন মুখেই বা জানাবে?কথাটা শুনে নিলয়দার জন্য মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। এখন বুঝতে পারছি সেদিন যখন জানতে চেয়েছিলাম 'নতুন জীবন কেমন চলছে-' তখন একটা হেঁয়ালিপূর্ণ উত্তর দিয়েছিল। এই ধরনের কোনো কথা তখন মাথাতেই আসেনি।নিলয়দার জীবনে যা ঘটেছে এইরূপ ঘটনা আমার এই প্রথম শোনা।
  অম্বিকা সেদিন বাড়িতে ফিরে তার বেস্ট ফ্রেন্ড বাবাকে ঘরে ডেকে নিলয়ের সব কথা বাবাকে জানায়।বাবা সব শুনে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলেন,
--- 'কপালের লিখন না যায় খণ্ডন'। নরেশবাবু আর তার স্ত্রী খুব শখ করে আর দেখেশুনে ছেলেটার বিয়ে দিলেন। ছেলেটার কপালটাই খারাপ!ভালো চাকরি করে, দেখতে শুনতে খারাপ নয়, পাড়ায় যথেষ্ট সুনাম আছে ভালো ছেলে হিসাবে, নিজেদের বাড়ি-- সে তো হীরের টুকরো ছেলে। যাক গে -এসব কথা পাঁচ কান না হওয়াই ভাল।তোর মাকে আর কিছু বলিস না। পেট পাতলা মানুষ কাকে কি বলে বসবে তার থেকে তার কানে না দেওয়ায় ভালো।
   নিশিতা ও প্রলয়ের বিয়েকে কেন্দ্র করে অম্বিকা ও নিলয়ের বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে।নিলয় এখন অনেকটাই ফ্রী অম্বিকার কাছে।কিন্তু নিলয় তার জীবনের সদ্য ঘটে যাওয়া এই সম্পর্ক নিয়ে অম্বিকাকে কোন কথা যেমন জানায়নি অপরদিকে অম্বিকা যে জানে সেই সম্পর্কেও নিলয়কে কিছু বলেনি।বিয়ের দিন ভোরে নিশিতা বাড়ি থেকে বাবা - মায়ের বিনা বাধায বেরিয়ে আসে।বড় রাস্তার মোড়ে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল অম্বিকা ও নিলয়। বিয়ের দিনে শুভদৃষ্টির আগে বর-কনের দেখা করতে নেই এই অজুহাতে নিলয় প্রলয় কে আসতে দেয়নি।সে অম্বিকার সাথে কথা বলে তাকে নিয়ে নিশিতাকে নিতে আসে।তারপর তারা নিশিতা ও প্রলয়ের নতুন ফ্ল্যাটে চলে যায়। প্রলয়ও তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে আর এক বন্ধুর বাড়ি ওঠে। ওখান থেকেই সে রাতে বিয়ে করতে আসবে। নিলয় একবার প্রলয়ের কাছে আর একবার তাদের ফ্ল্যাটে সারাটা দিন ছোটাছুটি করেছে।কিন্তু ক্লান্তির কোন রেশ তার শরীরে নেই।
      সন্ধ্যায় দশ-বারোজন বন্ধুকে নিয়ে প্রলয় তাদের নতুন ফ্ল্যাটে বিয়ে করতে আসে। বিয়েটা বাঙালি মতেই হয়।অম্বিকা তার বাবা-মাকে জানিয়ে এসেছিল আজ রাতে সে ফিরবে না।সুতরাং তার কোনো চিন্তায় ছিল না।নিলয় বিয়ের রাতে সব কাজ মিটে যাওয়ার পর বাড়ি ফিরে যেতে চায়। কিন্তু সকলেই তাকে অনুরোধ করে সে রাতটা থেকে যাওয়ার জন্য।নিলয় বাধ্য হয় সেদিন থাকতে। আসলে বাবা-মায়ের বয়স হয়ে যাওয়ার পর সে আর কখনোই রাতে বাইরে থাকেনি।বাইরে থাকলে তার বাবা-মায়ের জন্য খুব চিন্তা হয়; সারারাত সে ঘুমাতে পারে না।তাই ওদের বিয়েতে যখন থাকবে মনস্থির করে তখন মাকে ফোন করে জানিয়ে দেয় রাতের সে ফিরবে না।তা না হলে তো তারাও দুশ্চিন্তা করবেন।
   বিয়েতে নিশিতা হোয়াইট আর রেডের  কম্বিনেশনে বেনারসি পড়েছিল | তার সাথে মাননসই কিছু হালকা গয়না | মুখে খুবই হালকা মেকআপ | ভারী মেকআপ নিশিতার একদম পছন্দ নয় | চোখের পাতায় সামান্য আইশ্যাডো সঙ্গে মাসকারা | কাজল পড়েছিল চোখের নীচের পাতায় শুধু | চন্দন শুধু কপালের লাল টিপটাকে বিন্দি দিয়ে ঘুরিয়ে দুপাশে দুটি কল্কে এঁকে দিয়েছিলো | অতি  সাধারণ সাজ কিন্তু নিশিতাকে অপূর্ব লাগছিলো |কিন্তু নিশিতার বিয়েতে নিশিতার সাজের থেকেও অম্বিকার সাজ যেন আরো সুন্দর হয়েছিল। অপূর্ব লাগছিলো তাকে দেখতে।নিলয় তো কতবার যে আড়চোখে অম্বিকাকে দেখেছে তার কোন ইয়ত্তা নেই।সেই প্রথম দিন ফাংশনে অম্বিকার গান শুনে তাকে ভালো লেগে গেছিল।আর মনেমনে একটা স্বপ্ন এঁকে বাবা-মাকে পাঠিয়েছিল তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়ে।কিন্তু পরিস্থিতি সেই প্রস্তাব উপস্থাপন করার সুযোগ তার বাবা-মাকে দিয়েছিল না। প্রথম দিনের সেই ভালোলাগাটা এ কটাদিনে নিলয়ের মনের অজান্তেই কখন যেন ভালোবাসার রূপ পেয়েছে। কিন্তু তার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো তাকে বাধা দিচ্ছে অম্বিকাকে ভালোবাসার কথা জানাতে। নিলয় একটু একটু করে অম্বিকার প্রতি আকর্ষিত হচ্ছে।কিন্তু নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে নিজেকে ধরে রাখতে। কিন্তু আবেগকে কি ধরে রাখা যায়? বিশেষত ভালোবাসার আবেগ! বিয়ের আসরে অম্বিকার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে একটু ছোঁয়া,একটু কাছাকাছি আসা অম্বিকার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা কোন কিছু থেকেই নিজেকে নিরস্ত্র করতে পারেনি।শুধু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছেনা। কলেজ জীবনে নন্দিনীকে ভালোবেসেও তার বুকের যে ধুকপুকানি হয়নি আজ বন্ধু প্রলয়ের বিয়েতে অম্বিকাকে দেখে প্রতিটা মুহূর্তে নিজের বুকের হৃদস্পন্দন সে যেন নিজেই শুনতে পাচ্ছে। তাই সবাই যখন তাকে বিয়ের রাতে থেকে যেতে বলে, মুখে সে বারবার না বললেও তার মন চাইছিল যে সে আজ রাতটা এখানে থেকে গেলে অম্বিকাকে আরো বেশি সময় ধরে দেখতে পাবে।তাই তার রাতে থেকে যাওয়ার এটাই প্রধান কারণ হয়ে ওঠে।
  অপরদিকে অম্বিকার মনেও কি নিলয় কোন দোলা দেয়নি? তার কি ভালো লাগছেনা নিলয়ের সান্নিধ্য? সেকি সকলের অলক্ষ্যে নিলয় কে লক্ষ্য করছে না? নিলয় যে বার বার তার দিকে তাকাচ্ছে তার পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে তার কি ভালো লাগছেনা? মনের দিক থেকে দুটি হৃদয় যখন এক হয় তখনই ভালোবাসার ফুল প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে।
  বাসররাতে সকলে অম্বিকাকে চেপে ধরে গান গাওয়ার জন্য। বিশেষত নিলয়।আর নিলয়ের এই অনুরোধ অম্বিকা ফেলতে পারেনা।সে পরপর দুটি গান করে।সারারাত তারা গানে গল্প জেগে থাকে।

ক্রমশঃ

  

Saturday, January 23, 2021

সুখের ঘরে আগুন (১৮)

সুখের ঘরে আগুন (১৮)
  কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকার পর অম্বিকা নিলয়কে
বলল,
--- নিলয়দা, আমরা তো এক পাড়াতেই যাবো,একটা ক্যাব বুক করুন বেরিয়ে পড়ি;খামোখা সেই থেকে এখানেই দাঁড়িয়ে আছি। আসলে আমি বুঝতে পারছি আপনি আমাকে চেনেন না কিন্তু আমি আপনাকে খুব ভালভাবেই চিনি।তাই আপনার সাথে আমার কথা বলতে একটুও অসুবিধা হচ্ছে না।কিন্তু আপনি যেহেতু আমাকে চেনেন না তাই কিছুতেই আমার কাছে ফ্রি হতে পারছেন না।আরে আমি পূর্বপাড়ার গলির মুখে যে বাড়িটা পড়ে না ?সেই বাড়ির মেয়ে।বাড়ির সামনে একটা বড় তেজপাতা গাছ আছে। আমার বাবা অমল সেন।এখন বুঝতে পারছেন আমার আপনার সম্পর্কটা পাড়াতুতো।তাই এখানে দাঁড়িয়ে আর সময় নষ্ট করে লাভ নেই।আপনার যদি কাজ থাকে তাহলে আপনি বেরিয়ে পড়তে পারেন।আমি একটা ক্যাব বা ট্যাক্সি ধরে বাড়ি চলে যাব।কিন্তু আর বেশি দেরি হলে আমি ঢোকার সাথে সাথে মা আমার উপর হামলে পড়বেন আর আমাকে বাঁচাতে বাবা ছুটে আসবেন।মা তখন আমাকে ছেড়ে বাবার উপর হামলে পড়বেন।এ জিনিস প্রথম থেকেই চলে আসছে। মা তখন আমাকে ছেড়ে বাবাকে ধরবেন আর সেই মুহূর্তে আমি কেটে পরি।শুরু হয় বাবা-মায়ের ঝামেলা ।
 অম্বিকা অবলীলায় কথাগুলো নিলয় কে বলে গেলো যেন কত চেনা নিলয়কে তার।অম্বিকার কথা বলার ধরণ দেখে তার কথা শেষ হলেই সে হো হো করে হাসতে লাগলো। অম্বিকা নিলয়ের হাসি দেখে বলল, 
--- না না হাসি নয়, এটাই সত্যি।সব সময় বাবা আমার হয়ে  মায়ের সাথে ঝগড়া করছেন।আর আজ তো বেশ দেরি হয়ে গেল। আমি আসছি নিলয়দা। 
--- না না দাঁড়ান একসাথেই যাব। আমি একটা ক্যাব বুক করছি।
 নিলয় একটা ক্যাব বুক করে দুজনে তাতে উঠে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।নিলয় কম কথা বললেও অম্বিকা বকবক করেই চলে। একসময় অম্বিকা নিলয়ের কাছে জানতে চায় তার নতুন জীবন কেমন চলছে? কথাটা শুনে নিলয় একটু ঘাবড়ে যায়। মনেমনে ভাবে অম্বিকাকে কোন কথা বলা ঠিক হবে না। নিলয় হেসে পড়ে বলে,
---  নতুন জীবন আর পুরনো জীবন সবই ভাগ্যের উপর নির্ভরশীল।ভাগ্য যে দিকে টেনে নিয়ে যাবে জীবনও সে দিকেই এগিয়ে চলবে।
--- তা ঠিক।তবে কি জানেন আমার মতে ভাগ্যকে মানুষ অনেক সময় নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।আর তার জন্য চায় কঠোর পরিশ্রম, একটু সহিষ্ণুতা, একটু ধৈর্য, আর সর্বোপরি বিশ্বাস ও ভালোবাসা ।এই কটা জিনিস কোন মানুষের মধ্যে যদি থাকে তাহলে সে তার ভাগ্যকে নিজেই গড়ে নিতে পারে। অনেক সময় ভুল বুঝাবুঝি আর ইগো মানুষকে বিপথে চালনা করে।
তারপর অম্বিকা একটু হেসে পড়ে বলে ওঠে,
---ওই দেখুন ক্লাসে লেকচার দিতে দিতে এমন অবস্থা হয়েছে আপনার কাছেও লেকচার দিয়ে চলেছি।
--- না না আপনি তো কথাগুলো ঠিকই বলছেন।প্রত্যেকটা কথার যুক্তি আছে।কোন অযৌক্তিক কথা তো আপনি বলছেন না। যাক গে, পরিচয় যখন হয়ে গেল তখন মাঝে মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হবে,গল্পগুজব হবে।আর তাছাড়া প্রলয় আর নিশিতার বিয়েতে তো আমরা দুজনেই বরকর্তা আর কনেকর্ত্রী ।সুতরাং এখন থেকে দু'জনকেই তো আমাদের কোমর বেঁধে লাগতে হবে। আর এই বিয়ে উপলক্ষে আমাদের দেখাও হবে অনেক।তখন জমিয়ে আড্ডাও চলবে।
 নিলয় উবেরটা বড় রাস্তার উপরেই দাঁড় করিয়ে দেয়। অম্বিকার দিকে ফিরে বলে,
--- আমি এখানে নেমে যাব।একটু কাজ আছে।আপনি  বাড়ির সামনেই নামবেন।ওই পর্যন্তই বুক করা আছে। মানিব্যাগটা বের করে সে পেমেন্টটা দিয়ে দেয়।অম্বিকা বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও সে কোন কথা শুনেনা।
 আসলে নিলয়ের কোন কাজই নেই।সে স্বেচ্ছাকৃত ওখানে নামল যাতে পাড়ার লোক তাকে ও অম্বিকাকে একসাথে গাড়ি থেকে নামতে না দেখে।কে কি বলবে তা আবার পাঁচ কান হবে। পিএনপিসি করার লোক তো পাড়ায় কম নেই!তাই অনেক সময় নিজের মতামত থেকে পাড়ার লোকের জন্যই তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হয়।
  অম্বিকা বাড়িতে পৌঁছানোর সাথে সাথে তার মা রাধাদেবি বলে উঠলেন,
--- এত রাত অব্দি কোন কলেজ হয় শুনি? কতবার কইছি মাইয়াটারে বিয়া দাও ; তা আমার কথা শুনবে কিডা? এত রাত অব্দি যদি মাইয়ামানুষ বাইরে ঘোরাঘুরি করে দিনকাল ভালা না কখন কি হইয়া যায় তার কি কোন ঠিক আছে? মাইয়া আর তার বাপ দুটিতেই কানে তুলা গুইজা থাহে।
 অম্বিকা ঘরে ঢুকে মায়ের পাশ কাটিয়ে তার নিজের ঘরে চলে যায়।আর তার বাবা তার নিজের ঘর থেকে চিৎকার করে বলতে শুরু করেন,
---  সারাদিন পর মেয়েটা বাড়ি আসার সাথে সাথে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল।আমাকেও সারাজীবন শান্তি দিলো না, মেয়েটাকে ও একটু শান্তি দেয় না।
--- হ, আমিই তো তোমাদের দুজনের যত অশান্তির কারণ। আমার কথা তোমরা কোন দিন শুনছো কও তো? তোমাদের যা করণের তা তো তোমরা কইরাই যাও। মাঝখান থেইকা আমিই চেঁচাইয়া মরি। আমারে তো সে কিছু কইবো না।অন্তত নিজে একটু জিগাও এত রাতে কইরা সে কেন বাড়ি ফিরছে? কলেজ কইরা কোন জায়গায়, কার সাথে ঘুরতাছিলো ?
 অমলবাবু আস্তে আস্তে মেয়ের ঘরে গেলেন।মেয়ে ততক্ষণে ফ্রেস হয়ে ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিয়েছে।বাবাকে দেখে উঠে বসলো।বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
---- রোজ রোজ মায়ের এই চিৎকার-চেঁচামেচি আর ভালো লাগেনা। কেন যে মা বোঝেনা কাজ না থাকলে আমি বাইরে ঘুরাঘুরি করি না।আজ আমার যে ফিরতে দেরী হবে আমি তো তোমায় জানিয়ে গেছিলাম।তুমি একটু মাকে বুঝিয়ে বলতেই পারতে তাহলে তো ঘরে ঢুকেই মায়ের এই চেঁচামেচি আমাকে শুনতে হতো না।
  অমলবাবু  সস্নেহে তার আদরের মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
---আসলে কি জানিস মা তুই বাইরে থাকলে তোর মায়ের খুব চিন্তা হয়।দিনকাল তো ভালো না।চারিদিকে নানান কথা শুনতে পায়, টিভিতে খবর দেখে তাইতো চিন্তাটা একটু বেশি তার। হ্যাঁ আমি বুঝতে পারি সারাদিন ছাত্র পড়িয়ে বাড়িতে এসে মায়ের এই চিৎকার-চেঁচামেচি তোর ভালো লাগেনা। কিন্তু এটাতো তুই অস্বীকার করতে পারিস না তোর প্রতি ভালোবাসা থেকেই মায়ের চিন্তা আসে আর এই চিন্তা থেকেই তার চেঁচামেচি ।
--- আমিতো জ্ঞানের পর থেকেই দেখে যাচ্ছি বাবা পান থেকে চুন খসলেই মায়ের এই চেঁচামেচি। মা যে খারাপ মানুষ সে কথা আমি বলছি না বাবা। কিন্তু সেই ছোট্ট থেকে চেঁচামেচি শুনতে শুনতে এখন আর সত্যিই এটা ভালো লাগেনা।
--- কি আর করা যাবে মা ? এক একজন মানুষের এক এক রকম স্বভাব।তোর মা সবটাতেই একটু টেনশন করেন বেশি; সেই টেনশন থেকেই তিনি চিৎকার, চেঁচামেচি করেন।এটা একদিক থেকে খুব ভালো লক্ষণ।এতে কি হয় জানিস ?মনের ভিতর চাপা যে টেনশনটা থাকে তা বেরিয়ে আসে। এতে শরীর-মন দুইই ভালো থাকে।
 কথাগুলো অমলবাবু মেয়েকে বললেন ঠিকই কিন্ত মেয়ে কতটা বুঝল সেই জানে।তার মায়ের এই চিৎকার-চেঁচামেচি যে তারও আর ভালো লাগেনা একথা তিনি আর কাকেই বা জানাবেন?বিয়ের পর থেকেই তো দেখে আসছেন তার কিছু মনপুতঃ না হলেই তিনি চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করেন। কিন্তু মানুষটা খুবই সরল প্রকৃতির এবং পরোপকারী । দিনরাত সংসারে পিছনে খাটছেন। আজ পর্যন্ত বাড়িতে কোন কাজের লোক রাখতে দেননি।এতদিন অমলবাবু ভেবেছেন হয়তো অর্থ সমস্যার কারণে তিনি একাই পুরো সংসারের যাবতীয় কাজ নিজেই করেন।কিন্তু তার ওমুমা চাকরি পাওয়ার পর যখন সে বারবার বাড়িতে কাজের লোক রাখতে চেয়েছে তখনই তার মা আপত্তি করে বলেছেন
---- যতদিন আমি পারুম আমি নিজেই সব কাজ করবো। আর কাজের লোকের কাজ আমার পছন্দ হয় না।ওদের সাথে সর্বক্ষণ চেঁচামেচি করা ঠিক না।যারা পারে না নিজের হাতে সংসারের কাজ করতে তারাই কাজের লোক রাখে। আমার তো কাজ করতে কোন অসুবিধা নাই।তাইলে আমার কাজের লোকের কি দরকার?আর এখনো তো আমি অথর্ব হইয়া যাইনি।যখন আমি পারুম না তখন তোমরা বাড়িতে কাজের লোক রাইখ্যা দিও।

ক্রমশঃ

    

Friday, January 22, 2021

সুখের ঘরে আগুন (১৭)

সুখের ঘরে আগুন (১৭)
     বাংলায় একটা প্রবাদ আছে "ঈশ্বর যা করেন তা মঙ্গলের জন্যই করেন"- দার্জিলিং থেকে ঘুরে এসে এই প্রবাদের সত্যতা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছে নিলয় এবং তার পরিবার।মানুষের জীবনে যে কত ধরনের কষ্ট ,আর সেই কষ্টের সাথে সমানভাবে যুদ্ধ করে একটু হলেও ভালো থাকার জন্য লড়াই।দোদুল তার জীবনে সেই লড়াইয়ে জয়ী হওয়ার পথে আর দোদুল কে সামনে রেখে নিলয়ও তার জীবনে কষ্টের এই লড়াইয়ে জয়ী হবেই। শালিনীর সাথে বিয়েটা একটা দুঃস্বপ্ন ভেবেই সে ভুলে যাবে।শুরু করবে নূতন করে তার জীবন। ভাববে না পিছনের কথা আর।বিয়েই জীবনের শেষ কথা হতে পারে না। হ্যাঁ এটা ঠিক দিনান্তে বাড়ি ফিরে সকলেই একটা ভালোবাসার হাতের পরশ চায়,সুখ দুঃখগুলোকে ভাগ করে নেওয়ার জন্য পাশে এবং খুব কাছে একজন মানুষ চায়,রোগ যন্ত্রণায় শিয়রে প্রিয়জনকে চায়,দিনরাতে সর্বক্ষণের জন্য ছোট্ট একটা শিশুর আধো আধো কথা শুনতে চায়।এই ছোট্ট ছোট্ট চাওয়াগুলো নারী পুরুষ নির্বিশেষে কামনা করে।কিন্তু জীবনে সকলের এই ইচ্ছাগুলো কি পূরন হয়?অনেক স্বামী স্ত্রীর সাথে বনিবনায় তো হয়না।একই ছাদের তলায় থেকেও তারা পরস্পরের কাছে আসতে পারেনা।অনেকে কষ্ট পায় সন্তানহীনতার কারণে।
  আবার বাড়ির লোকে বিয়ে করতে না চাইলে কারণ দেখান, "শেষ বয়সে তোর কাটবে কি করে?"কিন্তু কারো জীবনেই জীবন সমীকরণ তো মেলে না।বিয়ে, সন্তান জন্ম দেওয়া,তাদের মানুষ করা, তাদের বিয়ে থা দেওয়া, তারপর শাশ্বত নিয়ম অনুযায়ী একজনকে তো আগে বিদায় নিতেই হয়।আর বাকি যে জন পড়ে থাকে সে হয়ে যায় নিঃস্ব, অসহায়। পরিবারের কাছে কেউ কেউ অবাঞ্চিত হয়েও পরে। চেতন অবচেতন তখন সেই অবাঞ্চিত মানুষটি  নিজেই নিজের মৃত্যু কামনা করে।আবার সাধারণত ধনী পরিবারে দেখা যায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বাবা-মাকে টাকার বিনিময়ে বৃদ্ধাশ্রমে তাদের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে পুরনো আসবাবপত্র সরিয়ে ফেলার মত রেখে আসে।কেউ খোঁজ রাখে আবার কেউবা টাকা দিয়ে তাদের দায়িত্ব কর্তব্য শেষ করে।কোন খবরাখবরের ধার ধারে না।এটাই তো জীবন!তাহলে জীবনের না পাওয়াগুলোকে নিয়ে এত কষ্টের কারণ কি?
   দোদুল আর নন্দিনীর জীবনের ঘটনাপ্রবাহ  নিলয়ের জীবনে আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছে। এখন তার প্রধান কাজ ছ'মাস পরে শালিনীকে ডিভোর্স দেওয়া আর বাবা-মাকে  ভালো রাখা, সুস্থ রাখা।দেখতে দেখতে তো মাস দেড়েক হয়েও গেলো। আস্তে আস্তে নিলয়দের বাড়ির পরিবেশও স্বাভাবিক হতে শুরু করল।আগের মতই হাসি-ঠাট্টা, গল্পগুজব সবই চলছে।আড়ালে আবডালে পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজনেরা সমালোচনা করলেও সামনে দাঁড়িয়ে কেউ কিছু বলার এখনো কোনো সাহস দেখায়নি।
   সেদিন ছিল রবিবার।নরেশবাবু নিলয়কে বললেন,
---  অনেকদিন রিয়াজী খাসি খাওয়া হয়নি আর যখন আজ তুই বাজার যাচ্ছিস তখন একটু খাসির মাংস নিয়ে আসিস।  তোর মা খাসির মাংসটা জম্পেশ রান্না করেন বাপ ছেলে কব্জি ডুবিয়ে গল্প করতে করতে খাবো। অনেকদিন অনেক কিছুই করা হয়নি আমাদের।
  মলিনাদেবি স্বামীর কথা শুনেই তিড়িং করে লাফিয়ে উঠলেন,
--- হ্যাঁ আমার তো দিনকে দিন বয়স কমছে আর তোর বাবার দিনকে দিন খাবারের তালিকা বাড়ছে।
--- মা,এবার আমি ঠিক করেছি একটা রান্নার লোক রাখবো।
--- তাহলেই ষোলোকলা পূরণ হয় আর কি !বলি বাপ ছেলের তো আমার হাতের রান্না ছাড়া রোচে না।রান্নার লোক রাখা মানে আমার আরো কাজ বেড়ে যাওয়া।তার পিছনে এটা করো, ওটা করো,এভাবে রান্না করো বলতে বলতেই আমার দিন শেষ হয়ে যাবে। সারাদিন বসে সে রান্না করবে আর আমি সারাদিন তার পিছনে বক বক করে যাবো।দরকার নেই তোমার ওসব চিন্তা-ভাবনা দিয়ে।যেমন চলছে তেমনই চলুক। যতদিন পারব দুটো ফুটিয়ে দেবো ।আর হ্যাঁ তোমার বাবার ফাইফরমাশও খেটে দেবো , দশকর্মা ভান্ডারের ফর্দের মত অর্ডার অনুযায়ী খাবার রান্নাও করে দেবো।
 নিলয় ব্যাগ নিয়ে হাসতে হাসতে বাজারে বেরিয়ে গেলো।মনেমনে ভাবল অনেকদিন পরে বাড়িটা আবার ঠিক সেই আগের মতই  মনে হচ্ছে।

   অম্বিকা আজ  মাস ছয়েক হলো কলেজে জয়েন করেছে। সঙ্গে সঙ্গে তার মা রাধাদেবী বিয়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন ঠিক সেই আগের মতই বাপ মেয়ের সাথে ঝামেলা লেগেই আছে। মাত্র অল্প কয়েকদিনেই অম্বিকা তার সহকর্মীদের প্রিয় পাত্রী হয়ে ওঠে। আর ছাত্র ছাত্রীরা তাকে ভীষণ ভালোবেসে ফেলে। কারণ তার ব্যবহার আর ক্লাসে তাদের অঙ্ক বোঝানোর ধরনে প্রতিটা ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে আমূল পরিবর্তন এনে দেয়।যে অঙ্কের ক্লাসে একসময় অধিকাংশ ছাত্র থাকতো অনুপস্থিত সেখানে এখন ছাত্র-ছাত্রীর উপস্থিতির হার অনেক বেশি।
 প্রথম দিন থেকেই অম্বিকার সহকর্মী নিশিতার সাথে অম্বিকার খুব ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে।একসময় 'আপনি ' থেকে' তুমি ' আর এখন' তুই ' তে এসে থেমেছে। দুজনেই মোটামুটি সমবয়সী। নিশিতা ভালোবাসে তারই সহকর্মী প্রলয়কে। অফিস রুমের সকলেই মোটামুটি সে কথা জানে আড়ালে-আবডালে এ নিয়ে বেশ কানাঘুষাও হয়। কিন্তু ওদের সামনে কেউ একথা নিয়ে কোনো আলোচনা করে না। প্রলয় হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান।আর নিশিতা anglo-indian.সুতরাং প্রলয়ের পরিবার নিশিতাকে মানতে রাজি নন আর নিশিতা প্রলয়কে ছাড়তে রাজি নয়। তারা রেজিস্ট্রি করে দুজনে বাড়ির সকলের অগোচরে মাসখানেক আগেই বিয়ে করে নিয়েছে।জুতসই একটা বাড়ি খুঁজছে। পেলেই মন্দিরে সিঁদুর পরিয়ে তারা তাদের নতুন জীবন শুরু করবে। অম্বিকার খোঁজে একটা বেশ ভালো ফ্লাট বাড়ি ছিল। সে নিশিতা ও প্রলয়কে কথাটা জানালে তারা দ্বিগুণ উৎসাহে ফ্লাট দেখে পছন্দ করলো। ফ্লাট মালিকের সাথে কথাবার্তা ফাইনাল করে নিশিতা এক কাপড়ে বাবা মাকে ছেড়ে বেরিয়ে আসবে ঠিক হল। ফ্লাটে আসার আগে তারা ফ্ল্যাটের যাবতীয় জিনিসপত্র অম্বিকাকে সাথে নিয়ে কেনাকাটা করে। এই কিনাকাটা করতে গিয়েই ঘটে মজার ঘটনা।
  একদিন কলেজ ছুটির পর অম্বিকা আর নিশিতা পূর্বকথা মত দুজনে গেল দক্ষিণ কলকাতার বেনারসি প্যালেসে বিয়ের বেনারসি কিনতে। একটার পর একটা তারা বেনারসি দেখে চলেছে।অম্বিকার পছন্দ হয় তো নিশিতার পছন্দ হয় না।কিন্তু তারা আগেই ঠিক করে এসেছে দুজনের পছন্দ হলে তবেই তারা বেনারসি কিনবে।কিন্তু কিছুতেই  কোন শাড়ি একই সাথে দুজনের পছন্দ হচ্ছে না। একটা বেনারসি হাতে নিয়ে দুই বন্ধু নাড়াচাড়া করছে দেখে বোঝা যাচ্ছে সেটা তাদের পছন্দ হয়েছে।এরইমধ্যে তারা শুনতে পায় পিছনে দাঁড়িয়ে প্রলয় তাদের বলছে,
--- উহু  না ওটাতে হবে না, ওই কালারের বেনারসি আমি কিনেছি।
দুই বন্ধুই পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে প্রলয় দাঁড়ানো সাথে নিলয়। হাতে শাড়ির একটা বড় প্যাকেট।নিলয়কে দেখতে পেয়ে নিশিতা বলে উঠলো,
---  আরে নিলয়দা,কতদিন পরে তোমার সাথে দেখা।প্রলয় অনেকবার আমাকে বলেছে আমাদের বিয়ের সব দায়িত্ব নিলয়ের হাতে।আর সত্যিই তো আমাদের দুই বাড়ির কেউ এই বিয়েতে আসবেনা।প্রলয়ের দিকটা তুমি সামলাবে আর আমার দিকটা বন্ধু অম্বিকা সামলাবে।
 এতক্ষণে নিলয়ের চোখ যায় অম্বিকার দিকে ।অম্বিকা তার দিকে তাকিয়ে দু হাত জোর করে নমস্কার করে। নিলয়ও প্রতি নমস্কার জানায়। হঠাৎ করে অম্বিকাকে দেখে নিলয় কিছুটা অপ্রস্তুত হলেও অম্বিকা কিন্তু স্বাভাবিক।কিন্তু দু'জনেই তারা যে পূর্ব পরিচিত তা তাদের বন্ধু নিশিতা বা প্রলয়কে বুঝতে দেয় না। তারপর চারজনে মিলে বিয়ের বেনারসিটা পছন্দ করে সেখান থেকে বেরিয়ে খুব বড় একটা হোটেলে খেয়ে বাড়ি আসে।টুকটাক কথাবার্তা অম্বিকা বললেও নিলয় হ্যাঁ না তেই উত্তর দেয়।নিলয় কিছুতেই যেন অম্বিকার কাছে ফ্রি হতে পাচ্ছে না। নিলয় ভাবতে থাকে তার মনের মধ্যে যে কথা ছিল তা তো সে কোনদিনও অম্বিকার কাছে প্রকাশ করেনি বা তার বাবা-মা ও তো সরাসরি গিয়ে অম্বিকার সাথে তার বিয়ের প্রস্তাব দেননি।তবে কেন অম্বিকাকে দেখে সে এতটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল?কেন তার  সামনে ফ্রি হতে পাচ্ছে না?
 হোটেল থেকে বেরিয়ে নিশিতা আর প্রলয় একটা ক্যাপ বুক করে তাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।নিশিতা ক্যাবে তার বাড়ির কাছেই নামবে আর প্রলয় মাঝ রাস্তায় নেমে বাস ধরে বাড়ি যাবে ।দাঁড়িয়ে থাকলো অম্বিকা আর নিলয় কারণ তাদের দুজনেরই বাড়ি এক পাড়াতে।

ক্রমশঃ

Thursday, January 21, 2021

সুখের ঘরে আগুন (১৬)

সুখের ঘরে আগুন (১৬)

    আমি আমার জীবনে বাবা মাকে একসাথে হারিয়েছি, ভালোবাসা হারিয়েছি।অপরদিকে নন্দাও ঠিক তাই।সুতরাং নন্দার কষ্টটাকে আমি ফিল করতে পারি।আমি অনেক ভেবে স্থির সিদ্ধান্তে এলাম আমাদের বাঁচতে হবে দুজন দুজনকে আঁকড়ে।একই ছাদের তলায় অথচ বেশ কয়েক যোজন দূরে। আমি নন্দাকে খুব ভালবাসতাম।নন্দার বিয়ে হয়ে  যাওয়ার পর ও সুখে আছে জেনে আমিও ভালো ছিলাম। কিন্তু আজ ওর পরিস্থিতি দেখে প্রতিটা মুহূর্তে কষ্টে আমার বুক ফেটে যায়। একদিন নন্দাদে র বাড়িতে আমি ড্রয়িং রুমে ঘুমিয়ে আছি।অনেক রাতে হঠাৎ দেখি খুব সেজেগুজে নন্দা কারও সাথে কথা বলতে বলতে দরজা খুলে বেরিয়ে যাচ্ছে। আমি গিয়ে ওর হাত ধরে টানলাম।পিছন ফিরে আমাকে দেখে বলল,
---তুমি এখানে?ওই দেখো, বিরেশ আমাকে ডাকছে, আমি বিরেশের সাথে যাচ্ছি কিন্তু ও কিছুতেই আস্তে  হাঁটছে না। আজ ও আমাকে দার্জিলিং নিয়ে যাবে বলেছে খুব ঘুরবো দুজনে।
 আমি নন্দার কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম।ওর হাতটা ধরে রেখেই লাইটটা জ্বালিয়ে দিলাম। নন্দার সম্বিত ফিরে এলো কিছুটা।আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
-- বিরেশ আমাকে দার্জিলিং ডাকছে।তুমি তাড়াতাড়ি বাড়িটা বিক্রি করে দাও।আমাকে দার্জিলিং নিয়ে চলো।বিরেশ একা একা ওখানে থাকতে পারছে না। আমাকে পৌঁছে দিয়ে তুমি চলে এসো।আমি কখনো তোমায় আটকাবো না।আর তুমি থাকলে বিরেশ আমার কাছে আসতে পারবে না।
  আমার জীবনে সব হারিয়ে আমি নিঃস্ব।চাকরি, বাড়ি দিয়ে আমি আর কি করবো?তাই খুব তাড়াতাড়ি জলের দামে আমার বাড়িটা বিক্রি করে দিলাম সাথে নন্দাদের বাড়িটাও। ছেড়ে দিলাম স্কুলের সরকারি চাকরিটা।নন্দাকে বাঁচিয়ে রাখা এবং ভালো রাখার তাগিদে চলে এলাম দার্জিলিং। বেশকিছুদিন হোটেলে ছিলাম।প্রথমদিন হোটেলে এসেই নন্দা আমাকে বলল, আমি যেন দুটো  রুম বুক করি।অবাক হইনি।কারণ আমি জানি নন্দার মনে আমার জন্য কোন জায়গা কোনদিনও ছিলো না আজও নেই।আমি তাই করলাম।প্রতিটা রাত আমি না ঘুমিয়ে কাটাতাম।সব সময় একটা আতঙ্ক কাজ করতো এই বুঝি নন্দা হোটেলের রুম থেকে বাইরে বেরিয়ে গেলো।কিন্তু একটা ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম রুম থেকে বাইরে বেরোলেও হোটেল ছেড়ে সে বেরোতে পারবে না।বড় গেটের আগেই ছিল একটা বড় কলাপসিবল গেট।
  সাতদিনের মত থেকে দুই কামরার একটা বাড়িতে ভাড়া উঠে এলাম।এখানে আসার পর নন্দার পরিবর্তন হতে লাগলো।তবে রাতেরবেলা বন্ধ দরজার ভিতরে নন্দা অনর্গল কারও সাথে কথা বলতো।সকালে জানতে চাইলে মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো।আমিও জোর করতাম না।রান্নাবান্না,ঘরের কাজ সবকিছুই নিজের হাতে করতো।প্রয়োজন না হলে কখনই আমার সাথে কথা বলতো না।বেকার ঘরে চুপচাপ বসে থাকতে ভালো লাগতো না।কাজের চেষ্টা করতে লাগলাম। শেষমেষ বাড়ীওয়ালার পরামর্শে পাহাড়ী রাস্তায় ড্রাইভিং শিখে ,লাইসেন্স পেয়ে ভাগ্যের হাতে নিজেকে সঁপে দিলাম।দুবছরের মধ্যে এই ছোট্ট বাড়িটা কিনলাম দুজনের বাড়ি বিক্রির টাকায়।নন্দা কিন্তু এখন পুরো সুস্থ্য।এখন আর ও রাতেরবেলা একাএকা কথা বলেনা।আমার খুব খেয়ালও রাখে।কিন্তু এক বাড়িতে থেকেও মনের দিক থেকে আমরা শত আলোকবর্ষ দূরে।আর নন্দার ওই মাথাভর্তি যে সিঁদুর সে কিন্তু ওর স্বামী বিরেশেরই দেওয়া।কারণ ও আজও মনে করে বিরেশ বেঁচে আছে।আজও আমি ওর মনটাকে ছুঁতে পারিনি।কিন্তু আমি ওকে ভীষণ ভালোবাসি আজও।
 একনাগাড়ে কথাগুলি বলে দোদুল চুপ করলো। নিলয় ও  চুপ করে বসে।দোদুলের জীবনের এই কাহিনী শুনে কি বলা উচিত নিলয়ের তা জানা ছিলোনা।তাই সে চুপ করে বসে থাকলো। নিলয়কে চুপ করে থাকতে দেখে দোদুলই আবার শুরু করলো,
---  এতগুলো বছর ধরে মনের মধ্যে যে কথাগুলি লুকিয়ে রেখেছিলাম তা আজ তোমার কাছে বলতে পেরে নিজেকে খুব হালকা মনে হচ্ছে।আমি জানিনা আমার এই ভালোবাসাকে তুমি কি নাম দেবে?আমি মনেকরি এই জনমে কাজের ভালো-মন্দের ফল এই জনমেই ভোগ করে যেতে হয়।আর সেই কথা বিশ্বাস করেই আমি বলছি, নন্দা একদিন না একদিন মুখ ফুটে আমাকে তার ভালবাসার কথা জানাবে। আর যতদিন না সে তার ভালোবাসার কথা আমাকে জানায় আমি সেই আশাতেই বেঁচে থাকবো।
   ফেরার সময় দোদুলই তাদের শিলিগুড়ি পৌঁছে দেয়।নিলয় দোদুলের পাশেই বসে ছিল। গাড়ি চালাতে চালাতে দোদুল নিলয় কে বলল,
--- আমার জীবনের সব ঘটনা শোনার পরই তুমি খুব চুপচাপ হয়ে গেছো।আমাকে তো তুমি কোন কিছু বললে না দাদা?তোমার কি মনে হয় দাদা?আমি চাকরি ছেড়ে, নিজের বাড়ি বিক্রি করে,জীবনের সব শখ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে নন্দাকে নিয়ে এখানে চলে এসে কি কোন ভুল করেছি?
    নিলয় একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বলে,
---  না ভাই তুমি কোন ভুল করনি।তুমি নন্দাকে ভালবেসেছ আর ভালোবাসার জন্য মানুষ সবকিছু ত্যাগ করতে পারে। সবাই অবশ্য পারেনা তবে সত্যিকারে ভালবাসায় ত্যাগের পরিমাণটা বেশিই থাকে। নন্দা একদিন তার ওই অলৌকিক জীবন ছেড়ে ঠিক বাস্তবে ফিরে আসবে আর সেদিনই সে সম্পূর্ণরূপে তোমার ভালোবাসাকে উপলব্ধি করতে পারবে।
  নিলয়ের কথাগুলো শোনার পর দোদুলের বুক চিরে একটা বড় দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। নিলয় চোখ বন্ধ করে আসবার সময় ঘটনাগুলোর ভাবতে থাকে।তারা যখন বেরিয়ে আসবে নন্দিনী এসে নিলয়ের বাবা মাকে প্রণাম করে।হাত জোড় করে নিলয়কে নমস্কার জানায়।আর বলে, "যদি কখনো আবার এদিকে আসেন আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসবেন দোদুলের ভালো লাগবে।"নিজের ভালবাসার প্রতি নিলয়ের খুব আস্থা ছিল।কিন্তু দোদুলের ভালোবাসার কাছে তার ভালোবাসা হেরে গেছে। দোদুলের মত করে সে নন্দিনীকে ভালবাসতে পারিনি।নন্দিনীর জন্য নিজের  জীবনের সব শখ আহ্লাদ বিসর্জন দিতে পারেনি কিন্তু দোদুল পেরেছে নন্দিনীর জন্য জীবনের সবকিছু বিসর্জন দিতে। সব সময় নিলয় তার ভাগ্যকে দোষারোপ করেছে।কিন্তু তার ভাগ্যের থেকেও আজ মনে হচ্ছে দোদুল ও নন্দিনীর ভাগ্য আরো বেশি খারাপ। শালিনীকে বিয়ে করে তার জীবনে একটা সামান্য ঘটনা ঘটে গেছে মাত্র ! কিন্তু দোদুল ও নন্দিনীর জীবনে ঘটনাপ্রবাহ আরো বেশি ভয়ংকর। সেখানে তার জীবনের ঘটনা অতি তুচ্ছ!তাই সে ঠিক করে তার জীবনের এই সামান্য ঘটনা নিয়ে  সে আর ভাববে না। আসলে মানুষের ভাগ্যে যা থাকে তা ঘটবেই। কখনও কেউ তা খন্ডন করতে পারে না;চেষ্টা করতে পারে কিন্তু ভাগ্যকে কেউ আটকাতে পারে না।
  বাড়িতে ফিরে পরদিনই সে অফিস জয়েন করে।চেষ্টা করে সবকিছু ভুলে নতুন করে শুরু করতে।নন্দিনী ও দোদুলের জীবনের ঘটনা তাকে যেন আরো বেশি করে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। ছ'মাস না গেলে শালিনীকে ডিভোর্স এর নোটিশ পাঠানো যাবে না রিতেশ জানিয়েছে। বাড়িতে ফিরেই সে তার বোন ভগ্নিপতিকে ফোন করেছে তাদের কুশল জেনেছে। প্রমিতার প্রশ্নের উত্তরে সে জানিয়েছে বাইরে থেকে ফিরে এসে তারা তিনজনই চাঙ্গা হয়ে গেছে। আর ঘটনাটাও ঠিক ; বাড়ি পরিবেশটাই যেন ঘুরে আসার পর পূর্বের মত না হলেও পরিবর্তন হয়েছে।বাড়িতে এখন সব সময় বাবা মা এর আলোচ্য বিষয় দোদুল আর নন্দা। বাবা-মা দুইজনই তাদেরকে কলকাতায় আসার নিমন্ত্রণ করে এসেছেন। দোদুল চুপ থাকলেও নন্দা কিন্তু বাবা মাকে কথা দিয়েছে সে দোদুলকে নিয়ে কলকাতায় আসবে। আর এই কথা শুনে নিলয়ের মনে হয়েছে,নন্দা দোদুলকে ভালবাসতে শুরু করেছে।কিন্তু লজ্জা বা যে কোন কারনেই হোক দোদুলের কাছে তা প্রকাশ করতে পারছে না।

ক্রমশঃ 

Tuesday, January 19, 2021

সুখের ঘরে আগুন (১৫)

সুখের ঘরে আগুন (১৫)

   নিলয় ঘরের মধ্যে বসে সাত-পাঁচ ভাবতে থাকে।তাদের কলেজ জীবনের দিনগুলি চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে। নন্দিনীকে যেদিন ও প্রপোজ করেছিল সেদিন নন্দিনী ওকে যে কথাগুলো বলেছিল মনের মধ্যে সেই কথাগুলি তোলপাড় করতে থাকে। খাট থেকে উঠে গিয়ে ব্যাগের ভিতর থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে। কিন্তু লাইটারটা কোথাও খুঁজে পায়না। আবার এসে খাটের উপর বসে অপেক্ষা করতে থাকে দোদুলের জন্য। কিছুক্ষণ পরে দোদুল এসে ঘরে ঢোকে।ঘরে ঢুকেই সে দরজাটা দিয়ে দেয়। নিলয়ের সামনে এগোতে এগোতে বলে মাসিমা, মেসোমশাই এর সাথে গল্প করছিলাম।উনাদের লাইট অফ করে আমি তোমার কাছে এলাম; তোমাকে কথা দিয়েছিলাম আমার জীবনের কিছু ঘটনা তোমাকে জানাবো যা আজ পর্যন্ত আমি বা নন্দা কাউকে কোনদিনই বলিনি।কিন্তু কেন জানিনা আমার মনে হল তোমাকে আমি কথাগুলো বলতে পারি, নিজের মনটাকে হালকা করতে পারি।তাই নন্দাকে বলে আসলাম ঘুমিয়ে পড়তে। আমি তোমার কাছেই রাতে থাকবো।যদিও রাতে আমি এই ঘরটাতেই ঘুমাই।হয়তো অবাক হচ্ছে কথাটা শুনে।কিন্তু এটাই সত্যি।

  তারপর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে আবারও বলতে শুরু করলো,
 --কেন  জানিনা আমার মনে হল নন্দা কিছুটা হলেও আমার মনোভাব আন্দাজ করতে পেরেছে। তাই অবাক বিস্ময় আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল।হঠাৎ করেই বললো,
---  কি এমন গল্প করবে একটা অচেনা মানুষের সাথে ?
আমি কথাটাকে অন্যভাবে ঘুরিয়ে দিয়ে বললাম,
----  এতদিন ধরে দার্জিলিং শহরে আছি কাউকে এত আপন কোনদিন মনেহয়নি। কেউ কোনদিনও আমার বাড়িতে আসতে চায়নি।আমি যে সামান্য একজন ড্রাইভার! নিতান্ত গরীব!তাই কেউ আমাকে হয়তো মানুষ মনে করে না ।কিন্তু এই প্রথমবার কাউকে দেখে আমার মনে হয়েছে সে আমার খুব আপন এবং অতি অল্প সময়ে আমি তাকে ভালবেসে ফেলেছি। মাসিমা, মেসোমশাইও ভীষণ ভালো মানুষ।আর আমার যতদূর মনে হয় আমার প্রতি তাদের ভালোবাসাটা নিঃস্বার্থ।তাই যাইনা একটু গিয়ে নিলয়দার সাথে গল্প করে আসি।
 নিলয় দোদুলের কাছ থেকে লাইটারটা চেয়ে নিয়ে নিজের সিগারেট ধরানোর আগেই দোদুলের হাতে একটা সিগারেট ধরিয়ে দেয়। দোদুল হেসে পড়ে বলে,
---  আমার চলে না দাদা আমি চা ছাড়া অন্য কোন নেশা করি না।
নিলয় একটু অবাক হয়।এই ঠান্ডা জায়গায় দোদুল বিন্দুমাত্র নেশা করে না।তারমানে সে যা মনে করেছিল সেটাই ঠিক।সত্যিই দোদুল খুব ভালো ছেলে।কিন্তু নন্দিনী কি করে দোদুলের স্ত্রী হলো সেটা জানতেই হবে।আর কথা না বাড়িয়ে নিলয় দোদুলকে বলল,
--- এবার বল তুমি তোমার জীবনের কোন কথা আমাকে বলতে চেয়েছো?আমিও শুনতে আগ্রহী।
   দোদুল শুরু করল--
 আমার বাবা আর নন্দার বাবা ছেলেবেলা থেকেই দুই বন্ধু।আমার বাবার মনের ইচ্ছা ছিল নন্দার সাথে আমার বিয়ে দেবেন। কিন্তু তিনি জানতেন না নন্দার বাবার সেটা মনের ইচ্ছে ছিল না। অনেক বছর আগে নন্দার বাবা চাকরি সূত্রে কলকাতা শহরে এসে বসবাস শুরু করেন।আর আমরা গ্রামেই থেকে যাই। মাঝেমধ্যে নন্দাকে নিয়ে তার বাবা-মা গ্রামের বাড়ি যেতেন।আমি মনেমনে নন্দাকে ভালবাসতাম।ভাবতাম নন্দাও বুঝি আমায় ভালোবাসে।কিন্তু সেই  আমিও বুঝতে পারিনি নন্দা শুধু আমাকে বন্ধুর চোখে দেখত ভালোবাসতো না।যে ভালোবাসাটা তার আমার প্রতি ছিলো সেটা হল বন্ধুপ্রীতি।আমি সেটা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি।তাই যেদিন নন্দার বিয়ে ঠিক হওয়ার পর বিয়ের কার্ড নিয়ে তারা সকলে মিলে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে আমাদের নিমন্ত্রন করলো সেদিন বাবার মতো আমিও খুব অবাক হয়েছিলাম।শুধু অবাক নয় ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম।কিন্তু মুখ ফুটে কোন কথা আমি নন্দাকে জানাইনি।কারণ এটা আমার কাছে শুধু ভালোবাসার প্রত্যাখ্যান নয় অপমানও।তাই বাবার মতো আমিও খুব চুপচাপ ছিলাম। আমরা তিনজনেই বিয়েতে এসেছিলাম কাউকে বুঝতে দিইনি আমাদের মনের কথা।
 নন্দার বিয়ের পরে আস্তে আস্তে আমাদের যোগাযোগটা কমতে থাকে।কিন্তু তবুও নন্দার বাবা মাঝেমধ্যে যখন গ্রামের বাড়িতে যেতেন আমাদের বাড়িতে যেতেন,খাওয়াদাওয়া,গল্পগুজব সবই করতেন। তবে নন্দার সাথে আমার সম্পূর্ণ যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেল। নন্দার বিয়ের দুবছর পর জামাই মেয়েকে নিয়ে নন্দার বাবা একবার গ্রামে যান।নন্দার হাজবেন্ড খুবই ভালো মনের মানুষ।ভদ্রলোক খুব ভালো সরকারি চাকরি করতেন।তার সাথে আমার খুব বন্ধুত্ব হয়ে যায়।আর তখনই তিনি আমার সাথে ঘুরতে যাওয়ার একটা প্রোগ্রাম ঠিক করেন সেটা দার্জিলিং কিছুতেই আমি তাকে এই ব্যাপারে নিরস্ত্র করতে পারিনা,আমাকে রাজি হতেই হয়। তিনি যেন ছিলেন নাছোড়বান্দা।
   দার্জিলিংয়ের পুরো ট্যুরে নন্দা কিন্তু স্বাভাবিক অথচ আমি কিছুতেই সে সামনে এলে স্বাভাবিক আচরণ করতে পারিনা।নন্দার স্বামী বিরেশের সাথে আমার ভালই বন্ধুত্ব হয়ে যায়।বিরেশ ভীষণ অমায়িক আর সহজ সোজা মানুষ।
  দার্জিলিং ঘোরা শেষ।আমরা বাড়ির পথে।হঠাৎ এলো সেই দুর্যোগ।আমাদের গাড়িটা আর একটি গাড়িকে পাশ কাটাতে গিয়ে চাকা স্লিপ করে।গাড়িটা গড়াতে থাকে আর গাড়ির ভিতরে শুরু হয় আত্মচিৎকার।গাড়িটা গিয়ে কয়েকটা গাছের সাথে আটকে যায়।উদ্দারকারি যখন এসে সেখানে পৌঁছায় তখন অনেকটাই দেরি হয়ে যায়।গাড়ির ভিতর মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় আমার বাবা,মা,নন্দার বাবা,মাকে।হাসপাতালে অজ্ঞান অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয় আমাকে আর নন্দাকে। বীরেশের ও ড্রাইভারের বডি খুঁজে পাওয়া যায় না।
  হাসপাতালে প্রথমে জ্ঞান আসে আমার।ডাক্তার নার্সদের কাছ থেকে জানতে পারি আমার একজন সফরসঙ্গী এই হাসপাতালে ভর্তি। উঠে গিয়ে দেখার মত তখনো আমার পরিস্থিতি হয়নি।ওনাদের কাছে তার বয়স মোটামুটি জেনে বুঝতে অসুবিধা হয়না যে নন্দাও এই হাসপাতালে ভর্তি। তাদের মুখ থেকেই আরো জানতে পারি বাকিদের মধ্যে চারজনকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। এছাড়া গাড়িতে যদি অন্য কেউ থেকে থাকে তাদের কোন হদিস পাওয়া যায়নি। কথাগুলো শুনে খুব ভেঙ্গে পড়ি।কিন্তু এতটাই অসহায় তখন আমি আমি উঠে গিয়ে নন্দার পাশে দাঁড়ানোর মত আমার কোনো ক্ষমতা নেই।নিজেও তো ক্ষতবিক্ষত!একইসাথে বাবা-মা দু'জনকেই হারালাম।আর নন্দা হারালো বাবা-মা আর তার স্বামীকে। প্রায়  চারদিন পর নন্দার জ্ঞান আসলো। আমি তখন কিছুটা ধাতস্থ। নার্সের সহায়তায় নন্দার কাছে গেলাম।কিন্তু তার কোনো প্রশ্নের উত্তরই আমি সঠিক ভাবে দিতে পারলাম না।নন্দাকে শান্তনা দেওয়ার কোনো ভাষাও আমার জানা ছিল না।আর সেই মুহূর্তেই আমিও যে বিধ্বস্ত! কে কাকে কতটা সান্তনা দিতে পারি?দুজনেই যে সর্বহারা।
   আস্তে আস্তে দুজনেই শারীরিকভাবে কিছুটা সুস্থ হমাম। সরকারি হাসপাতালে সহায়তায় আমরা কলকাতায় ফিরলাম। দুজনে একসাথে ফিরলাম ঠিকই কিন্তু কোন কথা দুজনের মধ্যে হলনা।সম্পূর্ণ দুটি অপরিচিত মানুষের মত ফিরে এলাম।পাশাপাশি বসে আছি অথচ দুজনের মধ্যে কোন কথা নেই।নন্দাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যখন ফিরে আসছি তখন নন্দা আমায় ডেকে বলল,
-- আমার মন বলে বীরেশ বেঁচে আছে,সে একদিন নিশ্চয়ই ফিরে আসবে।তাই আমাকে তোমার একটু সাহায্য করতে হবে।
 আমি জানতে চাইলাম,
--- কি সাহায্য তুমি চাও বল?আমি আমার জীবন দিয়ে হলেও তোমাকে সে সাহায্য করতে রাজি আছি।
 নন্দা তখন এমন একটা কথা বলে বসলো যা আমি স্বপ্নেও কল্পনা করিনি।আমাকে বলল ওদের কলকাতার বাড়িটা বিক্রি করার ব্যবস্থা করতে আর দার্জিলিং শহরের একটা বাড়ি কিনে ও সেখানে বাস করতে চায়।
তোর কথা শুনে আমার পাগলের প্রলাপ মনেহল।কিন্তু ওকে সেটা বুঝতে না দিয়ে আমি বললাম,"বিরেশ যদি কোন দিন ফিরে আসে তাহলে তো এই বাড়িতেই আসবে।তাহলে এখান থেকে যদি তুমি চলে যাও বিরেশ তো তোমাকে খুঁজে পাবে না।তাই আমার মনেহয় বাড়িটা বিক্রি না করে তুমি এখানেই তার জন্য অপেক্ষা করো।"
  কি বুঝলো আর কি ভাবলো আমি জানিনা তবে আমাকে যে বাড়িটা বিক্রির জন্য লোক দেখতেই হবে একথা সে আমার কাছ থেকে আদায় করে নিল।আমি বাড়ি ফিরে গেলাম।ফাঁকা বাড়িতে মন টেকানো দায় হয়ে পড়লো। চারিপাশে বাবা-মায়ের স্মৃতি। বাড়িতে পৌঁছানোর পরের দিন নন্দাকে ফোন করলাম।রিং হয়ে গেল,ফোন ধরলো না।ও হ্যাঁ একটা কথা বলা হয়নি।কলকাতা পৌছেই আমি দুটো ফোন কিনেছিলাম। আমাদের সব ফোনগুলোই তো ওই অ্যাক্সিডেন্টের সময় হারিয়ে গেছিল।তাই কলকাতা পৌঁছেই এক পরিচিতের কাছ থেকে  টাকা ধার করে ফোন দুটো আগে কিনি।একটা নন্দাকে দিয়ে আরেকটা আমি নিয়ে আসি।নন্দার ফোনটায় সিমটা আমি কিনে দিয়ে এসেছিলাম।এটা আমি করেছিলাম আমি বাড়িতে থাকা কালিন সময়ে যাতে নন্দর সাথে যোগাযোগ রাখতে পারি। বারবার নন্দাকে ফোন করেছি কিন্তু নন্দা ফোন ধরেননি। একদিকে বাবা মাকে হারানোর কষ্ট আর অন্যদিকে নন্দাকে নিয়ে চিন্তা। এই দুইয়ের মাঝখানে পড়ে আমারও পাগল হয়ে যাবার জোগাড়। পরপর তিনদিন বারবার ফোন করার পরও যখন নন্দার ফোন ধরল না আমি তার সাথে কোন যোগাযোগ করতে পারলাম না তখন আমি আবারও কলকাতায় নন্দার কাছে ছুটলাম।
   নন্দাদের বাড়িতে ঢোকার মুখেই দেখলাম একটা ছোট সাইনবোর্ড ঝুলানো।আর তাতে লেখা "বাড়ি বিক্রি হইবে" কিছুটা থমকে গেলাম আর মনেমনে ভাবলাম তাহলে নিশ্চয় নন্দা ঠিক আছে। বারবার কলিংবেল বাজানোর পর নন্দা এসে কোনরকমে দরজাটা খুলে দিল।আমি তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখি এক মাথা সিঁদুর,কপালে বড় করে লাল টিপ দেওয়া,হাতে শাখা পলা।কিন্তু চুলগুলো উস্কখুস্ক দেখেই বোঝা যাচ্ছিল যে শুয়ে ছিল। আমাকে দেখতে পেয়েই বলল,
---  বাড়ি বিক্রি লোক পেয়েছো?
 আমি বললাম,
---  চেষ্টা করছি, এত তাড়াতাড়ি এত বড় একটা বাড়ি কি বিক্রির লোক পাওয়া যায়?
হঠাৎ দেখি নন্দা দাঁড়াতে পারছে না। ঠকঠক করে কাঁপছে। তাকে ধরে সোফায় বসিয়ে দিলাম।জানতে চাইলাম, খাওয়া-দাওয়া করছো কিনা।আমার কথার সে কোন উত্তর দিল না।নন্দাকে সোফায় বসিয়ে রেখে আমি রান্নাঘরে গেলাম।গিয়ে দেখলাম সেদিন ফেরার সময় যেমন দেখে এসেছিলাম রান্নাঘর ঠিক তেমনি রয়েছে।ধুলোবালি আর নোংরায় পরিপূর্ণ। রান্নাঘরের যে কোন কাজ হয়নি সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে । শুধু কয়েকটা কৌটো ভর্তি মুড়ি আর বিস্কুট।আমার বুঝতে একটুও অসুবিধা হলো না এই তিনটে দিন নন্দা রান্না না করে ওই মুড়ি বিস্কুট খেয়েই কাটিয়েছে। বহুদিন ধরে এই বাড়িতে যাতায়াতের সুবাদে এ বাড়ির কোথায় কি আছে তা ছিল আমার নখদর্পনে।সেই ছোট্টবেলা থেকে এবাড়িতে আমার আসা যাওয়া।অপটু হাতে রান্নাঘরটা সামান্য পরিষ্কার করে আমি দু'কাপ চা করে তারপর ভাত চাপিয়ে দিলাম। চা নিয়ে এসে দেখি দুর্বলতায় নন্দা সোফাতেই ঘুমিয়ে পড়েছে।আমি তাকে ডেকে চা-বিস্কুট দিলাম। বিনা বাক্য ব্যয়ে সে চা ও বিস্কুট দুটি খেয়ে নিল। তারপর আমি সামনের দোকান থেকে কয়েকটা ডিম আর আলু কিনে আনি। রান্নাবান্না খুব একটা আমি না জানলেও ডিম সেদ্ধ আলু সেদ্ধ ভাত করতে পারতাম।কারণ আমি আমার চাকরির সুবাদে বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে আমাকে থাকতে হতো।আমি একটা স্কুলে টিচারী করতাম। যেহেতু আমরা গ্রামে থাকতাম আর আমার স্কুলটা ছিল আমাদের বাড়ি থেকে  বেশ খানিকটা দূরে তাই নিত্য যাতায়াত করা খুব অসুবিধা হতো।এই কারণে আমি একটা বাড়িতে ভাড়া থাকতাম। মাঝেমধ্যে এবং ছুটির দিনে বাড়িতে ফিরতাম।দার্জিলিং থেকে ফিরে এসে আমি স্কুলে জয়েন করেছিলাম।কিন্তু পুনরায় ছুটি নিয়ে নন্দার খোঁজে কলকাতা আসতে বাধ্য হই। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি নন্দাকে নিয়ে পড়লাম ভীষণ ফ্যাসাদে। আমি বুঝতে পারছিলাম নন্দা কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছেনা বিরেশ আর নেই। সে যে আস্তে আস্তে একটা ফ্রাস্টেশনে চলে যাচ্ছে এটা বেশ অনুধাবন করতে পারছিলাম। কিন্তু কি করব সেটাই বুঝতে পারছিলাম না।একদিকে আমার চাকরি অন্যদিকে নন্দা।আমি যদি নন্দাকে বলি আমার কাছে গিয়ে থাকার জন্য আমি জানি সে কিছুতেই রাজি হবে না।অথচ চাকরি বাঁচিয়ে নন্দার কাছে এসে আমার থাকাটাও সম্ভব নয়।আর আমি এখানে থেকে গেলে নন্দা কিছুতেই এটা মেনে নেবে না।
  অনেক ভেবে সব দ্বিধা দ্বন্দ্ব কাটিয়ে আমি নন্দাকে বলেই বসলাম,
--  যতদিন না বাড়ি বিক্রি হচ্ছে অন্তত সে কটা দিন তুমি আমার বাড়িতে গিয়ে থাকো।
মাথা নাড়িয়ে সে আমাকে জানিয়ে দিল তা সে যাবেনা। কিংকর্তব্যবিমূঢ় পরিস্থিতি আমার!আমি বুঝতে পারলাম চাকরি আর নন্দা এই দুটোর মধ্যে যে কোন একটাকে আমার বেছে নিতে হবে। নন্দার কথামত তার বাড়ি বিক্রি করে দার্জিলিং গিয়ে তাকে বাড়ি কিনে দিতে হলে আমার বাড়িটাকেও বিক্রি করতে হবে সাথে চাকরিটাকেও ছাড়তে হবে।কারণ নন্দাকে আমি একা ছাড়তে পারবো না।আর নন্দা বিশ্বাস না করলেও এটা যে সত্যি বিরেশ আর নেই।সে কোন দিনও ফিরবে না।আর চাকরি ছেড়ে দিলে খাবো কি? নন্দাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলাম এই বাড়িতে থেকে বিরেশের জন্য অপেক্ষা করতে।কিন্তু সে কিছুতেই সে কথা বুঝতে চাইল না। আমি তখন বুঝতে পারছি নন্দা আস্তে আস্তে মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছে।তাকে ইমিডিয়েট ডাক্তার দেখানো দরকার।কিন্তু নন্দা যে ডাক্তার দেখাতে রাজি হবে না এটাও আমি ভালোভাবে বুঝতে পারছিলাম। তাই নিজেই একজন সাইকিয়াটিস্ট এর সাথে যোগাযোগ করে তাকে সব কথা জানালাম। তিনি আমাকে সাজেস্ট করলেন যাতে ওকে দার্জিলিঙে কাছাকাছি কোথাও নিয়ে রাখা হয়।উনি আমাকে এও বললেন যে নন্দার মনের মধ্যে একটা ধারণা হয়েছে বিরেশ দার্জিলিঙে আছে।আর এই কারণেই ও কলকাতা ছেড়ে দার্জিলিংয়ের গিয়ে থাকতে চাইছে। তাই ওকে সুস্থ করতে গেলে ও যেখানে যেতে চায় সেখানেই ওকে নিয়ে যেতে হবে।

ক্রমশঃ 

Saturday, January 16, 2021

সুখের ঘরে আগুন(১৪)

সুখের ঘরে আগুন (১৪)

   সাতদিনের ট্যুর।যেতে আসতে দুদিন আর দার্জিলিঙে ঘোরার জন্য পাঁচটা দিন।কিন্তু শিলিগুড়িতে কেটে গেল একটা দিন। সব শুনে দোদুল বললো,
---  কোন চিন্তা করবেন না দাদা।আমি আছি তো,এই সময়ের মধ্যেই আমি আপনাদের দর্শনীয় সমস্ত জায়গায় নিয়ে ঘুরে বেড়াবো।
 দোদুলকে নিলয়ের এতটাই ভাল লেগে গেল যে  তারা কোন হোটেলে খাবে,কোথায় টিফিন করবে সবকিছুই যেখানে ঘুরতে গেছে সেখানে দোদুলই ঠিক করছে।তাতে সুবিধা একটা হয়েছে বৈ কি -- এইসব জায়গাগুলোতে দোদুলের আসা যাওয়া প্রায় রোজই।তাই কোন হোটেল ভালো,কোন জায়গা দিয়ে গেলে ভাল হবে সবকিছুই দোদুলের নখদর্পণে। নিলয় তার বৃদ্ধ বাবা-মা দুজনকে একা সামলাতে যখন হিমসিম খাচ্ছিল তখন এই দোদুল ছেলেটিই নিলয়ের পাশে থেকে একজনকে সামাল দিচ্ছিল আর বাকি একজনকে নিলয় দেখছিল। নিলয়ের বাবা মা ও ছেলেটির ব্যবহার দেখে তার প্রতি খুব দুর্বল হয়ে পড়লেন।দোদুলের সাথে নিলয়ের মা তার পারিবারিক সমস্ত খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে শুরু করলেন।শেষ পর্যন্ত তিনি বায়নায় ধরে বসলেন দোদুলের বাড়িতে যাবেন।এ কথা শুনে দোদুলও খুব খুশি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে হাতে তো সময় আগেই একদিন কমে গেছে।তাহলে দার্জিলিং ঘোরা শেষ করে যাওয়ার পথে দোদুলের বাড়ি হয়ে যাওয়া যেতে পারে। সেইমতো দার্জিলিং ঘোরা, কেনাকাটা করা সব শেষ করে বাক্স-পেটরা নিয়ে দোদুলের গাড়িতেই তার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়া হল।নিলয় মনে মনে ভাবতে লাগলো মায়ের এ এক অদ্ভুত খেয়ালে মত দিয়ে ঠিক করলো না মনেহয়।দোদুলের বাড়িতে গেলেই তার কিছু খরচ হবে,আর এ কদিনে সে দোদুলকে যতটা চিনেছে তাতে তার মনে হয়েছে তাকে কোন টাকা দিতে গেলেও সে নেবে না।কিন্তু এই মুহূর্তে মায়ের মনে আঘাত দিতে পারছে না।বাবারও কোন হেলদোল নেই। বাড়িতে ফেরার কোন ইচ্ছা তার আছে বলে মনেহচ্ছে না।তিনি যেন আরো বেশি বাড়ির বাইরে থাকতে ভালোবাসছেন।বাড়িটাই সকলের কাছে বিভীষিকাময় হয়ে দাঁড়িয়েছে।কেউই বাড়ি ফিরতে চাইছেন না।কিন্তু নিলয়ের তো অফিস আছে।দার্জিলিং ঘুরতে এসে বাবা-মায়ের মনে এই খুশির দেখে সেও খুব খুশি হয়ে গেছে।
    অপরদিকে নিলয়ের বাবা মা দুজনে ফিসফিস করে আলোচনা করে চলেছেন;বাড়িতে গেলেই তো ছেলেটা আবার মন খারাপ করে থাকবে তার থেকে যে কটা দিন ওকে নিয়ে বাইরে ঘোরাঘুরি করা যায়।
দোদুল আগেই ফোন করে দিয়েছিল তার স্ত্রীকে। পাহাড় আর সবুজে ঘেরা দোদুলের বাড়ি দেখে নিলয়ের বাবা-মা তো বটেই নিলয় নিজেও অবাক হয়ে শুধু বাড়িটাকেই  দেখছে। এত সুন্দর বাড়ি !এত সুন্দর সাজানো গোছানো, বাড়ির চতুর্দিক তো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য আর বাড়ির ভিতরে? যেন এক স্বর্গপুরী। ছোট্ট ছোট্ট প্লাস্টিকের গ্রো ব্যাগগুলিতে নাম না জানা অজস্র ফুল ফুটে আছে ।তাদের দিকে তাকিয়ে থাকলে মন এক নিমিষে ভালো হয়ে যায়।
 নিলয়, তার মা,আর বাবা সকলে মিলে ড্রইং রুমে বসে গল্প করছিলেন।সেখানে চা নিয়ে আসে দোদুলের স্ত্রী। দোদুলের স্ত্রী ট্রে হাতে যখন ঘরে ঢোকে তখন সে বেশ কিছুটা খুঁড়িয়ে হাঁটছিল। তাই নিলয় তখন ঠিক সেই মুহুর্তে তার মুখের দিকে না তাকিয়ে  তার পায়ের দিকে তাকিয়ে তার হাঁটাটা খেয়াল করছিল। কিন্তু দোদুলের স্ত্রী ট্রেন হাতে চায়ের কাপ নিয়ে এসে টেবিলে না রেখে নিলয়ের মুখের দিকেই তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। হঠাৎ করেই নিলয় তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে উঠে দাঁড়ায়। বিস্ময় মিশ্রিত কন্ঠে নিলয় বলে ওঠে,
----  তুই এখানে?
কথাটা বলেই নিলয় নিজেকে সামলে নেয়।ধপ করে একটা বেতের চেয়ারে বসে পরে।কিন্তু কথাটা এত আস্তে বলে ঘরের মধ্যে বাকি মানুষগুলি শুনতে পায়না।অবাক হয় দোদুলের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে।দেখে সে চা টা টেবিলে রেখে ঘর থেকে আস্তে আস্তে বেরিয়ে যাচ্ছে।নিলয় বুঝতে পারে তার ও দোদুলের স্ত্রীর মধ্যে যে একটা পরিচয় ছিল সেটা সে কাউকে জানাতে চায় না। কিন্তু নিলয় কিছুতেই বুঝতে পারেনা নন্দিনী কি করে দোদুলের স্ত্রী হল?
  নন্দিনী ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলো।জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখে দোদুল গোটা মুরগীটা কাটার তসরত করে চলেছে।নিলয়ের বাবা,মা ঘর থেকে বেরিয়ে বাড়ির চারিপাশটা ঘুরে ঘুরে দেখছেন। আজ দুজনে অনর্গল ফিশফিশ  করে কথা বলে চলেছেন। নিলয় হতভম্বের মত ঘরের মধ্যেই চুপচাপ বসে। মাংস কাটা শেষ হয়ে গেলে দোদুল ঘরে এসে বলে,
---  দাদা এখানে একা একা বসে কি করছো?বাইরে চলো। আজকে তোমাদের যেতে দেবো না। আজকের রাতটা তোমরা এখানে থেকে যাবে।এতদিন এখানে বাস করছি, পাহাড়িয়া অঞ্চলে গাড়ি চালাচ্ছি কিন্তু কারো সাথে এত ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি।তোমাকে মনেহচ্ছে আমার নিজের দাদা আর মাসিমা মেসোমশাই কে মনেহচ্ছে যেন আমার বাবা-মা ফিরে এসেছেন।একটা দিন আমার এখানে থেকে যাও।অনেকদিন পরে আজ মনটা খুব ভালো লাগছে।
--- তা হয় না ভাই।আমার অফিস আছে, ছুটি শেষ।পরে নাহয় আবার আসা যাবে। যদি কিছু মনে না করো একটা কথা জিজ্ঞেস করতাম--- ।
---- না না মনে করবো কেন?বলো না তুমি কি বলতে চাও।
--- তোমাদের দেখে মনেহচ্ছে তোমরা আদতে বাঙ্গালী। তা এখানে তোমরা এলে কি করে ?
---  সে এক ইতিহাস দাদা। এখন চলুন আমরা স্নান করে নিই। বলবো আপনাকে সব বলবো।আপনাকে আমার ভীষণ ভালো লেগেছে ,নিজের কাছের মানুষ মনে হয়েছে।এই কথাগুলি আজ পর্যন্ত কেউ কোনদিনও জানতে চায়নি। আমাদের দুজনের মনেই এই কথাগুলি রয়েছে।তাই আপনি যখন আজ জানতে চাইছেন আপনাকে আমি পুরো ঘটনাটাই জানাবো। কিন্তু এখন না,নন্দা শুনে ফেলবে।আমি আপনাকে ঠিক সময় করে যাওয়ার আগে সব বলবো।তবে আবারো বলছি আজকের রাতটা আপনারা থেকে যান, আমাদের দুজনেরই খুব ভালো লাগবে।কারণ আমরাও যে কলকাতারই মানুষ। কলকাতার মানুষ দেখলেই মনেহয় তারা আমার খুব কাছের।কিন্তু কারো সাথেই এত হৃদ্রতা কোনদিন গড়ে ওঠেনি।
--- ঠিক আছে,এত করে যখন বলছো বাবা মাকে জিজ্ঞেস করি তারা যদি রাজি হন আজ রাতটা না হয় আমরা তোমার বাড়িতেই থেকে যাবো।
  কিন্তু সেই একবারই নন্দিনী সকলের সামনে এসেছিল আর আসেনি।ইচ্ছাকৃত সে নিজেকে যেন একটা খোলসের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে বা পুরনো কথাগুলো মনেকরে আর আজকে তার এই পরিস্থিতিতে সে নিজেকে নিলয়ের কাছ থেকে দূরে রাখতে বাধ্য হয়েছে।নিলয় বহুবার চেষ্টা করেছে নন্দিনীর সাথে একটু একাকী কথা বলার।কিন্তু নন্দিনী তাকে সে সুযোগ কোন অবস্থাতেই দেয়নি। রাতে খাওয়া দাওয়ার পরে নন্দিনী যখন তাদের সকলের শোয়ার ব্যবস্থা করছে এই সুযোগ পেয়ে নিলয় এসে সে ঘরে ঢোকে।নন্দিনী নিলয়কে দেখতে পেয়ে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মুখে নিলয়কে বলে,
--- আমি আশা করব পুরনো কোনো কথা তুই তুলবি না। আমার জীবনে অনেক কিছু ঘটে গেছে যার হিসাব আমি নিজেই মিলাতে পারিনি।আর তাই আমি এই ব্যাপারটা নিয়ে কারো সাথে কখনোই কোন আলোচনা করিনা।যা আমার ভাগ্যে ছিল তাই হয়েছে।জীবনে অনেক কিছুই হেলায় উপেক্ষা করেছি।কিন্তু নিজেকে কখনোই বিলিয়ে দেইনি কারো কাছে। বিশ্বাস ছিল ভাগ্যের প্রতি কিন্তু সবই ছিল যেন বালির বাঁধ। ভাগ্য আমার বিরূপ ছিল তাই যা ঘটেছে তার জন্য আমি দায়ী নই;এটা আমার দুর্ভাগ্য! এই দুর্ভাগ্যটাকেও আমি মেনে নিয়েছি।তবে হ্যাঁ দোদুল খুব ভালো ছেলে আমার খুব কেয়ার করে।
   নিলয়কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তার পাশ কাটিয়ে সে অন্য ঘরে চলে গেল।নিলয় হতভম্বের মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো।সত্যিই সে নন্দিনী মনের গভীর তল কোনদিন পায়নি আজও পেল না। অপেক্ষা করতে লাগল দোদুলের জন্য।দোদুল আসলেই  নন্দিনীর জীবনের এই ঘটনাটা সে জানতে পারবে। তাকে জানতেই হবে সবকিছু।কারণ বন্ধুদের কাছে সে শুনেছিল সেন্টাল গভমেন্টের চাকরি করা ছেলের সাথে নন্দিনীর বিয়ে হয়েছিল।যদি তাই হয় আজ কেন দোদুলের সাথে দার্জিলিংয়ের এই পাহাড় ঘেরা অঞ্চলে সমস্ত আত্মীয়স্বজন বর্জিত অবস্থায় একজন গাড়ির ড্রাইভারের সাথে তার সংসার?কেন নন্দিনী খুঁড়িয়ে হাঁটে?ওর বাবা,মা কোথায়?কিভাবে দোদুলের সাথে ওর পরিচয়?কলকাতা থেকে পাকাপাকি ভাবে কেন দার্জিলিং চলে এলো?তাকে জানতেই হবে সব।

ক্রমশঃ। 


    

Thursday, January 14, 2021

সুখের ঘরে আগুন (১৩)

সুখের ঘরে আগুন (13 পর্ব)

     এই ঘটনার পর বাড়ির পরিবেশটা পুরোই পাল্টে গেল। বাড়িতে তিনটি প্রাণী থাকলেও সকলেই গল্পগুজবে  মেতে থাকতো। কিন্তু এখন বাড়িটা সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ। কেউ আর কারো সাথে প্রয়োজন ছাড়া একটা কথা ও বলে না। ছুটির দিন হলে একবার নিলয় আর একবার তার বাবা তাদের পছন্দ মতন খাবার অর্ডার করতেন আর সর্বক্ষণ মলিনাদেবী বকবক করতেন, আর তাদের পছন্দসই খাবার করার জন্য যারপরনাই পরিশ্রম করতেন ।তারা খেয়েদেয়ে হাসিমুখে যখন বলতো "দারুন হয়েছে"- তখন তার সমস্ত পরিশ্রম আর বকবকানি এক মুহূর্তের  মধ্যে কর্পূরের মত উবে যেত। কিন্তু সেই দিনগুলি নিলয়ের বিয়ের পরেই যেন হারিয়ে গেল। বিয়ের পরে ঠিক নয় অষ্টমঙ্গলার পরে শালিনীকে তাদের বাড়িতে রেখে নিলয় যখন একা ফিরল আর ঠিক তখনই সব কিছু যেনো এলোমেলো হয়ে গেল। হারিয়ে গেছে রাতে খাবার টেবিলে বাপ ছেলের একসাথে মলিনাদেবীর পিছনে লেগে তাকে রাগিয়ে দেওয়া, হারিয়ে গেছে মলিনা দেবী সামনের জিনিস রেখে যখন সেই জিনিসটাকেই সারা ঘরময় খুঁজে বেড়াচ্ছেন আর নিলয় ও তার বাবা দেখতে পেয়েও চুপচাপ দু'জন দু'জনের মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে  চলেছেন।এই হারিয়ে যাওয়ার তালিকায় আছে আরো অনেক কিছু। সুখের ঘরটাতে হঠাৎ করেই কালবৈশাখী ঝড়ের দাপটে সবকিছু তছনছ করে দিয়ে গেছে ।আর সকলেই এত বিধ্বস্ত যে এই এলোমেলো ঘটনাগুলিকে মেনে নিয়ে সুখের নাগাল কেউ আর খুঁজে পাচ্ছে না।
  একদিন সকালে নিলয়ের বাবা নরেশবাবু চায়ের আশায় ডাইনিং রুমে  বসে ছিলেন।পেপার একটা হাতে থাকলেও সেদিকে তার ঠিক মন ছিল না এরইমধ্যে ল্যান্ড ফোনটা বেজে ওঠে ।নরেশবাবু না উঠে পেপারটার দিকে তাকিয়ে বসে থাকেন। রান্নাঘর থেকে মলিনাদেবী চিৎকার করে বলে ওঠেন,
---  ফোনটা ধরো, ফোনটা বাজছে কানের মাথা খেয়ে বসে আছো? আমার হয়েছে যত জালা; বাড়ির সকলের মন খারাপ আর আমি যেন আনন্দে আত্মহারা! সব কাজ আমি করবো,  সব দিকে নজর আমি দেবো, অথচ কাউকে কিছু বললে সে তিড়িং করে উঠবে।
 নরেশবাবু উঠে গিয়ে ফোনটা ধরেন। "হ্যালো" বলাতেই অপরপ্রান্ত থেকে যার গলার আওয়াজ তিনি পেলেন তার জন্য তিনি মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না।ফোনের অপর পাড়ে শালিনীর বাবা সত্যব্রত বাবু।
--- ব্যাপারটা আমার ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না দাদা-- ।
--- আপনার মত আমিও প্রথমে ব্যাপারটা বুঝতে পারিনি। পরে আমার ছেলে সব ঘটনা আমাদের খুলে বলে,যেগুলি আপনি জানেন অথচ লুকিয়ে গেছেন। কিছু মনে করবেন না দাদা, একটা কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি, আপনার এই গোয়ার্তুমির জন্য হ্যাঁ আমি গোয়ার্তুমিই  বলবো- কথাটা শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্যি। আজকালকার ছেলেমেয়েদের মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে তাদের বিয়ে দিলে এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। আপনার মেয়ের যখন অন্য কারো সাথে সম্পর্ক রয়েছে তখন তাকে জোর করে এ বিয়ে দেওয়া উচিত হয়নি;এতে শুধু আপনার মেয়েরই নয় আমার ছেলের জীবনটাও নষ্ট করে দিলেন। যার ফলে আমি আমার ছেলের ব্যক্তিগত জীবনে এই ব্যাপারে মাথা ঘামাবো না বলেই ঠিক করেছি।আপনার যা ইচ্ছা তা করতে পারেন তবে হ্যাঁ এবার অন্তত যা করবেন মেয়ের মতামত টাকে গুরুত্ব দেবেন। 
   অপরপ্রান্ত থেকে উত্তরের অপেক্ষা না করেই তিনি ফোন কেটে দেন। রাগের ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে তিনি এসে তার পূর্বনির্ধারিত চেয়ারটাতে বসে পড়েন কিছুক্ষণ পরে রান্নাঘর থেকে মলিনাদেবী এসে বলেন,
---  ওই বাড়ি থেকে ফোন করেছিল না? আমি ঠিক জানতাম। তা কি বললে শুনি।
--- হ্যাঁ সত্যবাবু ফোন করেছিলেন। কিছু বলার সুযোগ আমি দিইনি আর দেবোই বা কেন? তিনি যা করেছেন অত্যন্ত অন্যায় করেছেন;জোর করে নিজের মতামতকে সন্তানের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। আজকের যুগে এমনটা কেউ করে? খামোখা দুটো ছেলে মেয়ের জীবন নষ্ট করা হলো,কিছু লোক হাসানো হলো,সর্বোপরি উভয় পরিবারের কিছু অর্থ নষ্ট হল। না-আমি এই ব্যাপারটাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিনা।
---  এ নিয়ে আর ভেবে কোন লাভ নেই।যা কপালে ছিল আমাদের তা হয়ে গেছে।এখন আমাদের ছেলেটাকে এ কষ্টের ভেতর থেকে কিভাবে বের করা যায় সেটা ভাবতে হবে।
  মায়ের কথা শেষ হতে না হতেই নিলয় সেখানে এসে মাকে বলল,
-- মা চা দাও ।
---  হ্যাঁ বাবা বোস,দিচ্ছি।তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে চা টা নিয়ে এসে সব কথা বলছি।
 কিছুক্ষণের মধ্যে মলিনাদেবী ছেলের জন্য চা এনে তার সামনে দিয়ে নিজেও একটা চেয়ার টেনে বসলেন।তারপর স্বামীর দিকে একটু তাকিয়ে নিয়ে ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
--- আমরা অনেকদিন কোথাও ঘুরতে যাইনি,মন মেজাজ কারোর ভালো না,চল না তিনজনে মিলে বাইরে কোথাও কটাদিন ঘুরে আসি তাতে মনে হয় আমাদের কিছুটা হলেও এই মন খারাপ কমবে।
  নরেশবাবু স্ত্রীর কথাটিকে লুফে নিয়ে বললেন,
---  গিন্নি একদম আমার মনের কথা বলেছ।চলো তিনজনে মিলে বাইরে কোথাও ঘুরে আসি। নীলু তুই ব্যবস্থা কর। কোথায় যাব সেটাও তুই ঠিক করবি। ঘরের এই পরিবেশটা জেলখানার মতো মনে হচ্ছে।বাইরে গিয়ে একটু বুক ভরে অক্সিজেন নিয়ে ফিরে আসি।
 নিলয় চুপ করে বাবা-মায়ের কথাগুলো শুনে বুঝতে তার একটু অসুবিধা হল না একমাত্র তার জন্যই তার বাবা-মা বাইরে যাওয়া মনস্থির করলেন।সুতরাং সে তাদের কথাকে সায় দিয়ে বলল,
---  ঠিক আছে তাহলে একটু চিন্তা করে দেখি কোথায় যাওয়া যায়।আমিও ভাবছিলাম তোমাদের বলব কথাটা।সত্যিই কেমন যেন একটা পরিবেশ হয়ে গেছে এক ঘরটার ভেতর এর থেকে বেরোনোর জন্য আমাদের একটু বাইরে বের হতেই হবে।
  শেষমেশ তারা দার্জিলিং যাওয়াই মনস্থির করলেন
 টিকিট পেতে একটু অসুবিধা হলেও দিন পনের মধ্যে নিলয় তিনটি টিকিট কেটে ফেললো। কিন্তু দার্জিলিং যাওয়ার আগে একটা বড় কাজ সম্পন্ন করার জন্য সে রিতেশকে ফোন করলো। রিতেশ এক রবিবার দেখে শ্বশুরবাড়িতে এসে উপস্থিত হলো।সাথে অবশ্যই তার স্ত্রী প্রমিতা। প্রমিতা এসেই দাদাকে প্রথম অভিযোগ,
---  তোরা ঘুরতে যাচ্ছিস আমাদের বললে তো আমরা যেতাম।একটু তো আমাদের  বলতে পারতিস।
---  রিতেশ বোনের অভিমান বুঝতে পেরে তাকে বলল,
--- হঠাৎ করেই ঠিক হয়েছে রে,কোন প্লান প্রোগ্রাম ছাড়াই। তাই আর কাউকে কিছু জানানোর সুযোগ হয়নি।ঠিক আছে- আমরা এই ট্যুরটা করে আসি,পরেরবার আমরা পাঁচজনে একসাথে ঘুরতে বেরোবো।
 নিলয় রিতেশকে নিয়ে তার ঘরে গিয়ে আলমারি খুলে শালিনীর টুকটাক যে গয়নাগাটি আর জামাকাপড় ছিল সবগুলি একটি ব্যাগে ভরে রিতেশ এর হাতে দিয়ে বলল,
---ভাই এই শেষ কাজটা তোমাকে করতেই হবে।কারণ আমি ওই বাড়িতে জীবনেও আর পা রাখবো না।
 নির্দিষ্ট দিনে তিনজনে মিলে ট্রেনের কামরায় চড়ে তারা দার্জিলিং এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। রাত 10:30 এর ট্রেন সকাল প্রায় দশটা নাগাদ পৌঁছালো।কিন্তু সেখানে পৌঁছে এক গোল বাঁধলো।নিলয়ের মা হঠাৎ করেই বমি করতে শুরু করলেন।কাছেপিঠে খোঁজ নিয়ে নিলয় একজন ডাক্তারের কাছে তাকে নিয়ে গেল বাবাকে স্টেশন চত্বরে ভিতরেই একটা জায়গায় বসিয়ে রেখে। ডাক্তার চেকআপ করে তাকে কিছু ঔষধপত্র দিলেন এবং প্রেসার মারাত্মক হাই জানিয়ে দিলেন। নিলয়ের মা নিয়মিত প্রেশারের ওষুধ খান।কিন্তু এই কটাদিন তালেগোলে তিনি ওষুধ খেতে যেমন ভুলে গেছেন নিলয় এবং তার বাবাও তাকে মনেকরে দেওয়ার কথাটাও ভুলে গেছেন। পরিণামে এই বিপত্তি!সেদিন আর নিলয় তার মা বাবাকে নিয়ে শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং রওনা হতে সাহস পেল না।একটা হোটেল বুক করে সেখানেই একরাত থাকবে বলে মনস্থির করল এবং বাবাকে সে কথা জানালো। নরেশবাবু নিলয়ের এই যুক্তিকে সমর্থন করলেন। একরাত শিলিগুড়ি হোটেলে কাটিয়ে পরদিন ভোর বেলা মলিনাদেবী কিছুটা ধাতস্থ হলে নিলয় তার মা বাবাকে নিয়ে একটা গাড়ি বুক করে দার্জিলিং এর উদ্দেশ্যে রওনা হল।
  মানুষের যতই বয়স হোকনা কেন বাইরে বেড়াতে বেরোলে সকলের মনেই একটা অদ্ভুত আনন্দ বিরাজ করে। পাহাড়ী রাস্তা,দুপাশে খাদ্য দেখতে দেখতে চলা।মাঝে মধ্যে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ইস্টদেবতার নাম স্মরণ করা।তবে গাড়ির পাইলট ছেলেটি খুব ভালো।তার গাড়ি চালানোর হাতটাও খুব ভালো।ছেলেটিকে নিলয়ের এতটাই ভালো লেগে যায় যে সে তাদের দার্জিলিং ঘোরার পুরো সফরসঙ্গী করে ফেলে দোদুলকে ।

ক্রমশঃ 
   

Saturday, January 2, 2021

সুখের ঘরে আগুন (পর্ব ১২)

সুখের ঘরে আগুন (পর্ব ১২)

   গাড়ির ভিতর নিলয়ের মনে হতে থাকে এই কটা দিনের ঘটনা - সে যেন স্বপ্ন দেখেছে। চব্বিশটা ঘন্টা যেখানে পার হয়নি কিন্তু বিয়ের আগের রাত থেকে একটু আগে পর্যন্ত সমস্ত ঘটনায় তার কাছে আবছা হয়ে গেছে। তার ভালোলাগা ভালোবাসা দিয়ে গড়া প্রতিটা নারীই তাকে আঘাত ছাড়া অন্য কিছু দিতে পারেনি । ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর পরিহাস! কি কপাল করে জন্মগ্রহণ করেছিল! নিজেকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করেই সে ভাবতে থাকে বাড়িতে গিয়ে মা-বাবাকে সে কি বলবে? মা তো প্রচন্ড আঘাত পাবেন। কিন্তু এই মুহূর্তে এটা ছাড়া তার কাছে অন্য কোনো উপায়ও ছিল না। সে মনে মনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয় আজ যেভাবেই হোক মা-বাবাকে সত্যি ঘটনাটা জানাতেই হবে, পরের ব্যাপার পরে বোঝা যাবে।
  ছেলেকে বাড়িতে ফিরতে দেখে মা তাকে নানান প্রশ্নে জর্জরিত করে দিলেন কেন শালিনীকে নিয়ে আসেনি? প্রথমে একটু চুপ করে থাকলেও পরে সে বলল,
---  তুমি একটু চা করে নিয়ে আসো, আমি আজ সমস্ত ঘটনা তোমাকে আর বাবাকে  জানাবো। তখন তোমরা বুঝতে পারবে যে শালিনী কেন আসেনি।
 মলিনা দেবী ভালো ভাবেই তিনি তার ছেলেকে চেনেন। তিনি জানেন ছেলে যখন বলেছে চা খেতে খেতে সবকিছু জানাবে তখন সে চা না পেলে কোন কথা আর বলবে না। তিনি এক মুহুর্ত সময় নষ্ট না করে নিজের মনে বকবক করতে করতে রান্না ঘরে চলে যান।বাবা ইশারায় ছেলের কাছে জানতে চান কি হয়েছে? নিলয় তখন বাবাকে বলে সে একই সাথে সব কথা জানাবে দুজনকে। মলিনাদেবী পাঁচ মিনিটের মধ্যে  চা করে নিয়ে ড্রইং রুমে চলে আসেন। নিলয় হাসতে হাসতে মাকে বলে,
---  তুমি কি ঠাণ্ডা জলের মধ্যেই  দুধ,চা, চিনি দিয়ে চা করে আনলে?
তার মা খুব রাগান্বিত হয়ে বলে উঠলেন,
--- হাসিস না, আমার এখন তোর হাসি সহ্য হচ্ছে না। কি হয়েছে এক্ষুনি খুলে বল আমাকে; আমার ভালো লাগছে না।। ভেবেছিলাম বিয়েটা হয়ে গেলে আমি তোকে নিয়ে চিন্তা মুক্ত হব।আমার তোকে নিয়ে সমস্ত চিন্তা ভাবনা তোর বইয়ের উপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে থাকবো। কিন্তু আমি কি সে কপাল করে এসেছি? কি ঘটনা ঘটিয়েছিস সমস্ত কিছু খুলে বল ।
 নিলয় পরিবেশটাকে হালকা করার জন্য হেসে পড়ে বলে,
 --- তুমি যদি চুপ না করো ঘটনাগুলো বলব কি করে? কিন্তু সমস্ত ঘটনা শোনার আগে তোমাদের কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে আমাকে কোনো অবস্থাতেই শালিনীকে আবার ফিরিয়ে আনতে বলবে  না। মলিনাদেবী  চিৎকার করে বলে উঠলেন,
---  শালিনীকে  ফিরিয়ে আনতে বলবো না, এ কথাটার মানে কি? তুই কি শালিনীকে চিরজীবনের মতো বাপের বাড়িতে দেখে আসলি? আমাদের সাথে একবারও আলোচনা করার প্রয়োজন বোধ করলি না? বিয়ে হয়েছে মাত্র কয়েকটা দিন। এরইমধ্যে বউকে বাপের বাড়িতে রেখে এসে বলছিস তাকে আর ফিরিয়ে আনবি না; আর আমরা তোকে কোন অনুরোধ করতে পারবো না এসবের মানে বুঝতে পারছি না।
  নিলয়ের বাবা এবার বলে উঠেন,
 মলি, তুমি একটু চুপ করো ।ওকে সব কিছু বলার সুযোগ দাও। ও হঠাৎ করে এ সিদ্ধান্ত নেইনি নিশ্চয়ই এর পিছনে  বিশাল কোন কারণ আছে। আর কারণটা আমরা জানতে পারব না যতক্ষণ না তুমি চুপ করবে। বল বাবা, কিসের জন্য তুই এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলি। আমরা তোর কথার মধ্যে কোনরকম কোন কথা বলবো না। সমস্ত কিছু শোনার পর যদি আমাদের মনে হয় অন্যায়টা তোর তবে বৌমাকে কিন্তু ফিরিয়ে তোর আনতেই হবে।
  নিলয় কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বিয়ের আগের রাত থেকে আজ সকাল অব্দি সমস্ত ঘটনা তার বাবা-মাকে খুলে বলল। সব কথা শুনে তারা দুজনেই থম মেরে  গেলেন।  বেশ অনেক্ষণ তারা চুপ করে বসে থাকলেন। নিলয় উঠে চলে যাওয়ার উপক্রম করতেই মলিনাদেবী তাকে হাতের ইশারায় বসতে বললেন। পরে তিনি তাকে বললেন,
---  এতবার করে বৌমা যখন তোর সাথে কথা বলতে চেয়েছে তখন তুই তাকে একটা সুযোগ তো দিতেই পারতিস। তার কথাগুলো শোনা তোর উচিত ছিল।
 নিলয়ের বাবা এতক্ষণ চুপ করে বসে  থেকে তিনি ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
--- সবকিছু জানার পর বিয়ের মত একটি ঘটনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোন মানে ছিল না ।প্রথমেই এই বিয়েটাকে ভেঙ্গে দেওয়া তোর উচিত ছিল বলে আমি মনে করি। এরকম অনেক ঘটনা অনেকের জীবনেই ঘটে; বিয়ের আসরে ও অনেকে বিয়ে ভেঙ্গে যায়। কিন্তু ভেঙ্গে দেওয়ার উদ্দেশ্য  নিয়েই বিয়েটাকে সম্পন্ন করা উচিত হয়েছে বলে আমি মনে করি না। কিন্তু তাই বলে আমি একবারও বলছি না শালিনীকে তুমি বিয়ে করেছ বলে যেকোনো পরিস্থিতিতে তার সাথে মানিয়ে নিয়ে তোমাকে চলতে হবে। তোমার মত একটি বুদ্ধিমান ছেলের কাছ থেকে এই ধরনের মনোভাব আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিনা ।এতে লোক হাসানো বেশি হল। কি প্রয়োজন ছিল এই বিয়েটা তোমার করার? যখন তুমি জানতে পারলে সে অন্য কাউকে ভালোবাসে তোমাকে বিয়ে করতে চায়না তখনই তো তোমার এই বিয়েটা ভেঙে দেওয়া উচিত ছিল। মেয়েদের পক্ষে অনেক সময় অনেক কিছুই সম্ভব হয়না।যেটা ছেলেরা পারে সেটা অনেক সময় মেয়েরা পারেনা। এত কিছুর পরেও আমি বলব শালিনী তবুও অনেকটা এগিয়ে ছিল। বাকিটা এগোনোর জন্য তোমার সাহায্য চেয়েছিল। কিন্তু তুমি তাকে সাহায্য না করে ব্যাপারটাকে আরো ঘোলাটে করেছ। যা কিছু করেছো নিজের মর্জিতে করেছ ।তোমার উচিত ছিল ব্যাপারটা আমাকে আর তোমার মাকে জানানো।আমরা হয়তো  বিয়েটা এতদূর এগিয়ে নিয়ে যেতাম না। কারণ এটা সত্যি, যে মেয়ে বিয়ের আগে তার হবু স্বামীকে ফোন করে অন্য পুরুষকে ভালোবাসার কথা জানায় সে মেয়ে কতটা ডেস্পারেট হতে পারে। যাহোক ঘটনাটা যখন এতদুর গড়িয়ে গেছে আর তুমি তোমার সিদ্ধান্ত সফল করে ফেলেছ তখন বাকিটাও তুমি তোমার মর্জিতে শেষ করো। আলাদা থাকো তারপর তাকে ডিভোর্স দিয়ে নিজের জীবনটাকে অন্যভাবে সাজিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করো। বাবা হিসেবে এর বেশি আমি বলবো না ।কারণ তুমি এখন বড় হয়েছো। তোমার ব্যক্তিগত জীবনে, তোমার ব্যক্তিগত মতামতের বাইরে আমি তোমাকে এমন কিছু বলবো না যা নিজের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে আমার সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়ে সারা জীবন অশান্তি ভোগ করবে। আর আমার বর্তমান,অবর্তমানে সব সময় তোমার চেতন অবচেতন আমাকে দোষারোপ করবে।
  মলিনাদেবী চুপ করে বসে থেকে শুধু কেঁদেই চলেছিলেন। কাঁদতে কাঁদতেই তিন ছেলেকে বললেন,
--  এত কিছু শোনার পরও আমি তোকে আবারো বলছি,তুই একবার বৌমার সাথে এই বিষয়ে কথা বলে দেখ তার তো মতের পরিবর্তন ও হতে পারে?
--- ক্ষমা করো মা,আমি এটা কিছুতেই পারবোনা। আমি একমাত্র এই বিয়েটা শেষ অব্দি করেছি তোমার আর বাবার সম্মানের কথা ভেবে।আমি ভেবেছিলাম আত্মীয়-স্বজনরা যখন বাড়িতে এসে গেছে তখন ঠিক সেই মুহূর্তে বিয়েটা ভেঙ্গে দেওয়া মানে তোমাদের সম্মানহানি।
 নিলয়ের বাবা একথা শুনে বলে উঠলেন,
--- এখন কি বিয়েটা ভেঙ্গে দিলে সম্মানহানি হবে না? তাহলে প্রথমেই কেন তুমি এটা ভেঙ্গে দাওনি?আমি মনে করি তুমি যেটা করেছো ঠিক করোনি। ব্যাপারটা অনেকদূর গড়িয়ে গেল যেটা শোভনীয় হলো না।
 কথাগুলো বলে তিনি আর এক মুহুর্ত সময় নষ্ট না করে সেখান থেকে উঠে চলে গেলেন।
মলিনাদেবী কাঁদতে কাঁদতে ওখানে বসে প্রলাপের মতো বকতে লাগলেন,
-- যা হলো ঠিক হলো না।আমার কপালটা সারাজীবনই খারাপ।ভেবেছিলাম ছেলেটার বিয়ে দিয়ে একটু শান্তিতে থাকবো। কিন্তু এখন দেখছি শান্তির থেকে অশান্তিতেই জীবন ছারখার হয়ে যাবে।এটা কি হলো?বিয়ের সাত দিনের মাথায় ছেলে  তার বউকে বাপের বাড়িতে রেখে আসলো? আত্মীয় স্বজনের মধ্যে এ নিয়ে তো চর্চা চলতেই থাকবে। কেউ তো চুপ করে থাকবে না।আর কথা শোনাতেও কেউ ছাড়বে না।এখন আমি কি করবো?
 মলিনাদেবী সেখানে বসেই পাগলের মত প্রলাপ বকে চলেছেন। ছেলে নিলু মায়ের দিকে তাকিয়ে বসেছিল,হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে মায়ের  কাঁধে হাত দিয়ে বলল এতকিছু ভাবছো কেন? যা হয়েছে সেটা আমার ভাগ্যে ছিল। লোকে কি বলল না বলল তাতে আমার কিছু যায় আসে না। তোমার আর বাবার সম্মান নষ্ট হল এটাই আমার কাছে কষ্টের। অন্য কিছু নিয়ে আমি ভাবি না।

ক্রমশঃ