Saturday, February 27, 2021

ভাগ্যের চাকা

ভাগ্যের চাকা

  ----বৌমা এবার ওঠো।সেই সকাল থেকে ঠাকুর ঘরে পড়ে আছো।মুখে একটু জল পর্যন্ত দাওনি।যা ঘটেছে তাকে তো মেনে নিতেই হবে।আমি তো তার মা।দেখো আমি কত শক্ত হয়ে গেছি।না খেয়ে কান্নাকাটি করে নিজের শরীর খারাপ করলে আমার অনন্ত তো আর ফিরে আসবেনা।তোমাকে সুস্থ থাকতে হবে তোমার পেটেরটার কথা মনে করে।তুমি না খেয়ে থাকলে ও তো কিছু খেতে পারবে না ওর তো কষ্ট হবে।ভাগ্যকে যে খন্ডন করা যায় না!নিয়তির কাছে আমরা যে বড় অসহায়!আমিও এই বয়সেই অনন্তর বাবাকে হারিয়ে ছিলাম।তখন অনন্তর বয়স মাত্র ছ'মাস।ওর মুখে ভাত দেবো বলে সব আয়োজন সারা।বাড়িতে আত্মীয় কুটুম ভর্তি।মানুষটা কিছু টুকিটাকি জিনিস কিনতে বেরিয়ে ছিল। ফিরলো নিষ্প্রাণ দেহ হয়ে।সবই তো তুমি জানো।মুহূর্তের মাঝে শুধু বাড়ির টুনি লাইটের আলো নয় আমার আর অনন্তর জীবনের সমস্ত আলো নিভে গেলো।আমি তো তোমার পাশে আছি কিন্তু সেদিন আমার পাশে কেউ ছিলনা।এটা মনেহয় এই পরিবারের অভিশাপ। আমার কথা শোনো লক্ষী মা আমার।এবার মুখে কিছু দাও।
 পিতৃহারা অনন্তকে অনেক কষ্টে সরমাদেবী মানুষ করেছিলেন। সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় চাকরি পেয়েছিল ওয়েস্ট বেঙ্গল পুলিশে। সরমাদেবীর ইচ্ছা ছিল না ছেলে পুলিশে চাকরি করুক।তখন অনন্ত মাকে বুঝিয়ে ছিলো,
--- মা বাইশ বছর বয়স আমার। আমার হায়ার এডুকেশন আছে।আমি ঠিক ডিপার্টমেন্টাল পরীক্ষা দিয়ে এখানে উন্নতি করবো।তুমি কিছু চিন্তা করোনা।
 সরমা দেবী সেদিন ছেলের কথা ফেলতে পারেননি।তিনি ভেবেছিলেন এত অল্প বয়সে একটা সরকারি চাকরি পাচ্ছে। আস্তে আস্তে যদি ভবিষ্যতে উন্নতি হয় তাহলে তো চিন্তার কিছু থাকবেনা।এরপর বয়স বাড়লে সে সরকারি চাকরি নাও পেতে পারে।তাই তিনিও আর পরে আপত্তি করেননি। চাকরি পাওয়ার দু'বছরের মধ্যে তিনি অনন্তর বিয়ে দিয়ে নিজে পছন্দ করে বউ ঘরে আনেন। এক বছরের মাথায় তার বৌমা তাকে সুখবরটি জানান। বেশ চলছিল দিনগুলি।কিন্তু হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত সংসারের উপর নেমে এলো এক কালো মেঘ।
  অনন্ত সহ আরো বেশ কিছু কনস্টেবলকে নিয়ে থানার বড়বাবু একটি অপারেশন এর উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই গাড়িটা একটা লরির সাথে ধাক্কা লেগে ব্রিজের উপর থেকে পুলিশের গাড়িটা উল্টে যায়।ঘটনাস্থলে গাড়িতে থাকা বেশ কয়েকজন কনস্টেবল ও বড়বাবু সহ সকলেই নিহত হন। সেদিন সকালে অফিসে বেরোনোর আগে অনন্ত তার স্ত্রী এবং মাকে এই অপারেশনের যেতে হবে কথাটা জানিয়ে গেছিল। টিভিতে খবর দেখে পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজনে বাড়ি ভর্তি হয়ে গেল।কারণ নিহতদের তালিকা খবরে প্রকাশ করা হয়েছিল।তার ভীতর অনন্ত সাহার নামটিও ছিল।
 সরমাদেবী তার বৌমার পেটেরটির কথা চিন্তা করে নিজেকে শক্ত করে নেন।এবং অনেক কষ্টে তার বৌমাকে একটু দুধ,মুড়ি খাওয়ান। রাত দশটার দিকে বাড়ি ফাঁকা হয়ে গেলে সরমাদেবী গেটে তালা লাগিয়ে তার বিধ্বস্ত বৌমার পাশে এসে বসেন।বৌমার যাতে নিজেকে একটু সামলে নিতে পারে তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যান।ঠিক রাত এগারোটার দিকে খাটের পরে রাখা রিনার ফোনটা বেজে ওঠে।কিন্তু রিনা সে ফোন ধরে না। সরমাদেবী হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিয়ে তার বৌমার হাতে দিতে গিয়ে চিৎকার করে ওঠেন,
--- বৌমা, এই দেখো অনন্তর সেল থেকে ফোন এসেছে। আমার অনন্ত কি তবে বেঁচে আছে?
  তড়িৎগতিতে কাকের মত ছো মেরে রিনা ফোনটা ধরে হ্যালো বলতেই ও প্রান্ত থেকে অনন্তর গলা ভেসে এলো,
--- হ্যালো রিনা আমি আজ ডবল ডিউটিতে আছি,বাড়িতে ফিরতে পারবো না রাতে।তোমরা গেটে তালা বন্ধ করে দাও।
 রিনা কাঁদতে কাঁদতে তাকে জিজ্ঞাসা করল,
--- তুমি আজকে অপারেশনের যাওনি?
--- না না শেষ মুহূর্তে আমার যাওয়াটা ক্যানসেল হয়েছে। আমার জায়গায় অন্য একজন গেছিলো। আর সেই জন্যই আমাকে ডাবল ডিউটি করতে হচ্ছে।কিন্তু একটা মারাত্মক অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে গেছে,যে গাড়িটাই আমার যাওয়ার কথা ছিল--- আচ্ছা থাক বাড়িতে গিয়ে কাল সব জানাবো।তোমরা সাবধানে থেকো।
 ফোনটা নামিয়ে রেখে রিনা তার শ্বাশুড়িকে জড়িয়ে হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে সব কিছু জানালো। সরমাদেবীও  বৌমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন।

 

No comments:

Post a Comment