সুখের ঘরে আগুন (২৩)
নিলয় মনে মনে প্রমাদ গুনলো।এখন উপায়?সে বুঝতে পারছে মহিলা বিপদে পরেছে।মন চাইছে তাকে সাহায্য করতে ।কিন্তু একটা ইয়ং মেয়েকে সাহায্য করতে গেলে সম্ভাব্য কি কি বিপদ আসতে পারে তার একটা তালিকা চোখের সামনে ভেসে উঠছে।পরিস্থিতি এখন নিলয়ের শাঁখের করাতের মতো যেতেও কাটছে আসতেও কাটবে। মহা মুশকিলে পরল এই অযাচিত বিপদ ঘাড়ে এসে পরাতে । কিন্তু সমাধানও কিছু খুঁজে পাচ্ছে না।জীবনে একটার পর একটা অঘটন ঘটে চলাতে নিজের প্রতি নিজের আস্তাই হারিয়ে যাচ্ছে।আবার জীবনে নতুন কোন ফ্যাসাদ আসতে চলেছে এটা চিন্তা করে সে কিছুটা সময় চুপ করে থাকল। তারপর ভদ্রমহিলাকে আবারো অনুরোধ করলো একটা হোটেলে তাকে থাকবার জন্য।কারণ সে কোন অবস্থাতেই তাকে নিয়ে যেতে পারবে না বলে জানাল।কিন্তু ভদ্রমহিলা নাছোড়বান্দা।সেও নিলয়ের সাথে কোয়ার্টারে যেতে রাজি কিন্তু একা একা হোটেলের ঘরে থাকতে রাজি নয়।অবশ্য এর মধ্যে তার কোন খারাপ উদ্দেশ্য নেই।একাকী হোটেলের ঘরে থাকলে আবার যদি তার কোনো বিপদ হয় তাহলে তাকে উদ্ধার করার মতন সেখানে কেউ থাকবে না।কিন্তু এই ভদ্রলোক (নিলয়) যদি তাকে একটু আশ্রয় দেয় তাহলে মনেহয় সে ওই নরপশু গুলির হাত থেকে রেহাই পেতে পারে। চলন্ত ট্রেন থেকে নেমে জনবহুল স্টেশন থেকে কোনদিকে সে দৌড়েছিল তা বয়স্ক লোকটি না দেখতে পেলেও তার সাগরেদরা তো এখানে ওখানে ছড়িয়ে রয়েছে।কোন সময় কার নজরে পড়বে তখন আরেক বিপদ!সে নিলয়ের সামনে হাত জোড় করে একটা রাত থাকার অনুমতি ভিক্ষা করলো।
নিলয় যে কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না ।সে তার ব্যাগ দুটো নিয়ে তার কোয়ার্টারের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে আর মেয়েটি তার পিছন পিছন হাঁটতে থাকে। নিলয় ভাবতে থাকে কি পরিচয় দেবে সেই মেয়েটির? কি উটকো একটা ঝামেলায় ফেঁসে গিয়ে নিলয়ের মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। মিনিট দুই তিন হাঁটার পরে নিলয় তার কোয়ার্টারের সামনে এসে হাজির হলো।মেয়েটি তখন নিলয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,
--- এবার আপনি চাবিটা নিয়ে আসুন,আমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকি।আপনি চাবিটা নিয়ে আসার পর আমি আপনার সাথে ভিতরে যাব।তাহলে তো কাউকে কোন জবাবদিহি আপনাকে করতে হবে না।আমি কাল ভোরেই এখান থেকে চলে যাব। (তারপর স্বগউক্তির মত বলল, "কিন্তু কোথায় যাব তা ঈশ্বরই জানেন"।)
---- আপনি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকুন।আমি চাবি নিয়ে ঘরের দরজা খুলে লাইট জ্বালিয়ে আপনাকে ইশারা করলে আপনি ভিতরে ঢুকবেন।
মেয়েটি মানে অচলা মাথা কাত করে নিলয়কে সম্মতি জানালো।আর ঈশ্বরের কাছে হাতজোড় করে আজ রাতে ভগবানের মতো এরকম একটা মানুষের সাথে দেখা হওয়ার জন্য হাজার বার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল। নিলয় কেয়ারটেকারের কাছ থেকে চাবিটা নিয়ে আসবার সময় বয়স্ক লোকটি তাকে বারবার বললেন যে সে সাথে গিয়ে ঘরের দরজা খুলে লাইট জ্বালিয়ে তাকে সবকিছু দেখিয়ে দিয়ে আসবে।কিন্তু নিলয় কিছুতেই রাজি হলো না। সে বার বার বললো
-- আপনাকে উঠে যেতে হবেনা।আমার কাছে টর্চ লাইট আছে আমি ঠিক সবকিছু ম্যানেজ করে নিতে পারবো। আপনি ঘরেই থাকুক।
নিলয়ের পাছে ভয় কেয়ারটেকার ভদ্রলোক গিয়ে যদি মেয়েটিকে দেখেন তাহলে কেলেংকারীর আর শেষ থাকবেনা। তাই যেভাবেই হোক তাকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। নিলয় চাবি নিয়ে তার নির্দিষ্ট কোয়ার্টারের দিকে এগিয়ে যায়। মোবাইলের টর্চ এর সাহায্যে দরজা খুলে ঘরে ঢুকে লাইট জ্বালায়।কোয়ার্টার সম্পর্কে তার যে ধারণা ছিল রুমের মধ্যে ঢুকে তার সেই ধারণা সম্পূর্ণভাবে পাল্টে যায়।সে ভেবেছিল ঘরগুলি নোংরা থাকবে।কোন খাট বা চেয়ার টেবিল থাকবে না।কিন্তু ভিতরে ঢুকে তার মনে হচ্ছে এখানে যেন কিছুক্ষণ আগেও কেউ ছিল।ছোট্ট একটা তক্তপোশ,দুটো চেয়ার,একটা টি টেবিল আর দু সিটের একটা সোফা।বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন।এখানে আসবার আগে বেশ কয়েকবার কেয়ারটেকারের সাথে তার কথা হয়েছিল।তাকে সে বারবার করে বলেছিল কয়েকটা দিনের থাকার মতো ব্যবস্থা করে রাখতে।খাবার সে বাইরের থেকে এনেই খাবে কিন্তু চায়ের জন্য অন্তত একটা স্টোভের ব্যবস্থা করে রাখতে। আস্তে আস্তে সবকিছু কিনে গুছিয়ে নেবে। তারপরে এই জিনিসগুলো ফেরত দিয়ে দেবে। কেয়ারটেকার ভদ্রলোক তার কথা অনুযায়ী কাজগুলো ঠিকঠাক করে রেখেছেন।
সমস্ত ঘরের লাইট জ্বালিয়ে রেখে সে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখে মেয়েটি তার ঘরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তখন মেয়েটিকে দেখে নিলয়ের খুব মায়া হয়।সে বুঝতে পারে কতটা অসহায় হলে একজন অপরিচিত পুরুষকে বিশ্বাস করে তার ঘরে রাত কাটাতে কোন মেয়ে রাজি হয়। সে মেয়েটিকে হাত দিয়ে ইশারা করে। মেয়েটি নিলয়ের ইশারা বুঝে সে দ্রুত এসে ঘরের ভিতরে ঢুকে সঙ্গে সঙ্গে ঘরের ছিটকিনিটা দিয়ে দেয়। নিলয় মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, আমি একবারে খাবার কিনে নিয়ে এসে হাত-পা ধোবো।আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন।আমি নিজেই বাইরে থেকে তালা দিয়ে যাচ্ছি।আপনি কি খাবেন বলুন?
অচলা নিলয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল
-- যার একটা রাতে একটু আশ্রয়ের জন্য অন্যের কাছে কাকুতি-মিনতি করতে হয় সে একটা রাত না খেয়েই কাটিয়ে দিতে পারবে।আমার জন্য আপনার কোন খাবার আনতে হবে না।আপনি যে আজ রাতটুকু আমায় আশ্রয় দিয়েছেন তার জন্য আপনার কথা আমার সারা জীবন মনে থাকবে।
নিলয় মেয়েটির কথাগুলো শুনে বেরিয়ে গেল বাইরে। যাওয়ার সময় বাইরে থেকে তালা দিয়ে তারপর গেল। কিছুটা এগিয়ে গিয়ে একটা খাবারের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সেখানে বেশ কয়েকজন লোকের জটলা দেখে একটু এগিয়ে গেল তাদের দিকে।সে দোকানে খাবার কিনছে ঠিকই কান দুটো তার রয়েছে জটলার দিকে খাড়া।তাদের অস্পষ্ট কথোপকথনে তার মনে হলো তারা কোনো একটি মেয়ের খবর নিচ্ছে এদিকে তাকে দেখা গেছে কিনা।একটা ছবিও কয়েকজনকে দেখিয়েছে।সবই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিলয় দেখছে।তার বুঝতে অসুবিধা হয় না তার সাথে যে মেয়েটি রয়েছে তাকে খোঁজার জন্যই এই মানুষগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে খাবার কিনে একটু দ্রুত কোয়ার্টারের দিকে পা বাড়ায়। কিন্তু জটলার ভেতর থেকে একজন মানুষ তাকে দেখে বলল,
--- দাদা ছবিটা একটু দেখবেন?মেয়েটিকে দেখেছেন কিনা এই রাস্তায়?
নিলয় দাঁড়িয়ে পরলো।এবং গলা চড়িয়ে বলল,
-- দাদা আজকে আমার এখানে প্রথম আসা।আমি কোন রাস্তাঘাট, কোন মানুষজন কিছুই চিনি না।
--তবুও ছবিটা দেখুন যদি রাস্তাঘাটে দেখে থাকেন ।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিলয় ছবিটার দিকে তাকিয়ে দেখলো ; হ্যাঁ ঠিকই তো যে মেয়েটিকে সে আশ্রয় দিয়েছে তাকেই তারা খুঁজছে। তারমানে মেয়েটা যা বলেছে প্রতিটা কথায় অক্ষরে অক্ষরে সত্যি।
--- মেয়েটাকে আপনারা খুঁজছেন কেন?মেয়েটা কি হারিয়ে গেছে?
এতো যে জটলা হচ্ছিল আর তারা মেয়েটার ছবি দেখিয়ে খুঁজছিল কিন্তু নিলয়ের এই প্রশ্নে তারা নিজেদের মধ্যে চোখ চাওয়া চাওনি করল। কিছুক্ষণ পর তাদের ভেতর থেকে একজন বলল,
-- হ্যাঁ মেয়েটি আজ দুদিন হল হারিয়ে গেছে। আমার ছোট বোন।মায়ের সাথে ঝগড়া করে বাড়ি থেকে রাগ করে বেরিয়েছে। খুঁজে পাচ্ছিনা তাই বন্ধুবান্ধব নিয়ে খুঁজতে বেরিয়েছি।
--- আপনারা বিষয়টি পুলিশকে জানান তাহলে হয়তো তাড়াতাড়ি মেয়েটিকে খুঁজে পাবেন।
সেখানকার লোকগুলির নিলয়ের কথাবার্তায় পছন্দ করলো না।তারা নিলয়কে আর ঘাটাল না।আস্তে আস্তে সে স্থান ত্যাগ করল।আর নিলয় রুটি,তড়কা কিনে নিয়ে দ্রুত কোয়ার্টারে ফিরে এলো। নিলয় কোয়ার্টারে ফিরে দেখল অচলা সিঙ্গেল সোফাটাতে জবুথবু হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। তার দরজা খোলার আওয়াজেও অচলা ঘুম থেকে জাগে না।খাবারগুলো টেবিলের উপর রেখে সে বাথরুমে গিয়ে স্নান করে ফ্রেস হয়ে এসে একটা খবরের কাগজ বিছিয়ে রুটি তড়কা রেডি করে সে অচলার কাছে দাঁড়িয়ে তাকে কয়েকবার "এই যে শুনছেন?" বলে ডাকে। কিন্তু গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন অচলা ঘুম থেকে উঠতে পারে না। নিলয় বাধ্য হয় তার গায়ে হাত দিয়ে ডাকতে।তৎক্ষণাৎ অচলা নিজের গায়ের কাপড় ঠিক করতে করতে উঠে বসে।নিলয় তার নাম জানতে চায় --।তারপর তার সামনে খাবারটা এগিয়ে দিয়ে বলে,
--- খাবারটা খেতে খেতে বলুন তো কে আপনি ?আর কেনই বা ওই লোকগুলি আপনার পিছনে পড়ে আছে?কিসের সম্পর্ক ওদের সাথে আপনার?ওরা তো আপনাকে খুঁজতে খুঁজতে এই পর্যন্ত ধাওয়া করেছে।এখন তো আপনার এখান থেকে বেরোনোই বিপদ!নিজে তো ধরা পড়বেনই আমিও রেহাই পাবো না।
---ওরা এই পর্যন্ত ধাওয়া করেছে মানে? আপনি কি করে বুঝলেন?
---আপনার ছবি দেখিয়ে আপনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে ওরা।হয়তো লোকগুলো কিছু একটা ধারণা করেছে যে আপনি হয়তো এদিকে এসেছেন। আমাকেও ছবিটা দেখিয়েছে।
--- এখন উপায়?
--- উপায় আর কি?আপনি এখান থেকে বেরোলেই ওরা আপনাকে ধরবে আর আমার বদনাম হবে। তাই কটা দিন এখানেই চুপচাপ ঘরের ভিতরে থেকে যান।তারপর একটু থেমে পূনরায় বললো,
---কিন্তু আপনার তো কোন জামাকাপড় নেই।মহা সমস্যা! থাকতে গেলে কয়েকটা কাপড়চোপড় তো দরকার আছে। আমার মাথায় কিছু আসছে না।এখন খাবারটা খেয়ে শুয়ে পড়ুন।কাল সকালে অফিস যাওয়ার আগে চিন্তাভাবনা কোরবো।ভীষণ টায়ার্ড লাগছে আজ।আপনি এই ঘরে সোফার উপরেই ঘুমিয়ে পড়ুন আমি পাশের ঘরে যাচ্ছি। কাল শুনবো আপনার সব কথা।
নিলয় খাবার শেষ করে মিনারেল ওয়াটারের বোতল থেকে জল খেয়ে বাকি জলের বোতলটা অচলার সামনে রেখে আর কোন কথা না বলে পাশের ঘরে শুতে চলে যায়।আর অচলা খাবারটা সামনে নিয়ে চুপচাপ বসে তার ভাগ্যের কথা ভাবতে থাকে।
ক্রমশঃ
No comments:
Post a Comment